#শুক্লপক্ষের_পরিশেষে
#লেখনীতে_নবনীতা_শেখ
|৫২|
আকাশে আতশবাজির শব্দ হচ্ছে তীব্রভাবে। চারপাশ চমকে চমকে উঠছে। এদিক-ওদিক গান বাজছে। কিছু কিছু গান জানান দিচ্ছে বসন্তের, কিছু কিছু প্রেমের। রাত শেষ হতে চলল, অথচ রাজধানী সজাগ ভীষণ। সজাগ পার্শ্ববর্তী শহরগুলোও। এমনই এক শহরের বড়ো রাস্তা দিয়ে প্রচণ্ড স্পিডে এগিয়ে যাচ্ছে কালো রঙের গাড়িটি। তার ড্রাইভিংয়ে বসে আছে আশফিক রহমান শ্রেয়ান। দেখতে অতিমাত্রিক সুদর্শন। বর্ণনায় এলে—সুঠাম শুভ্র দেহ, মাথা ভর্তি গোছানো চুল, চাপা দাড়ি, কালো চোখের মণি, সরু নাক, বাঁকানো অবিস্তীর্ণ ঠোঁট, সাইরেন আই’স আর গায়ে ওয়েল ফিটেড শার্ট! দারুণ গানের গলা তার। বয়স ত্রিশ পেরিয়েছে। অথচ এখনও যে-কোনো মেয়ের কাঙ্ক্ষিত পুরুষ হওয়ার উপরি গুণ তার মধ্যে ভরে ভরে রয়েছে। অবশ্য চেহারায় কিছুটা ভারিক্কি এসেছে, মুখে গাম্ভীর্য লেপটে থাকে সর্বদা।
অথচ এই মানব এককালে এমন ছিল না। যদি বছর দুটো আগেই ঘুরে আসি, তবে দেখতে পাব—এক অসম্ভব দুষ্ট, রসিক, বেপরোয়া, স্বার্থপর, জানোয়ার ছেলেকে। অথচ এখন সে এক দায়িত্ববান পুরুষ। এ যেন কোনো এক ঘুর্ণিঝড়ের আগমন মাত্র! আশফিক রহমান শ্রেয়ানকে সে ঘুর্ণিঝড় ১৮০° এঙ্গেলে পুরো উলটে-পালটে ছেড়েছে। সে ছেলে থেকে পুরুষ হয়ে উঠেছে। পার্থক্য একটি শব্দের হলেও প্রভাব বিস্তর।
গাড়িটি বাড়ির মূল ফটক পেরিয়ে ভেতরে চলে গেল। গ্যারাজে গাড়ি রেখে আর এক মিনিটও দেরি করল না সে। শক্ত পায়ে সরাসরি ভেতরে চলে গেল। বাড়ির সব লাইট অফ, বাইরের লাইট গ্লাস ভেদ করে ভেতরে এসে যা পড়ছে, তাতে কেবল অন্ধকারের গভীরতাটুকুই মাপা যাচ্ছে। সে আলোর সাহায্য নিয়ে এগিয়ে চলাটা বড়ো বোকামিঠাসা কাজ। শ্রেয়ান সে বোকামি করল না। সে মুখস্ত রাস্তা ধরে এগিয়ে গেল। সিঁড়ি ডিঙিয়ে এগোতে লাগল। তারপর রুমের সামনে পৌঁছাল। বড়ো একটা শ্বাস টেনে দরজার নব ঘোরাল।
রুমের লাইট জ্বালানো। রেড ফ্লাওয়ার্স দিয়ে কী সুন্দরভাবে ডেকোরেট করে রেখেছে। কিছু কিছু ক্যান্ডেল একদম শেষের দিকে এসে ঢিপঢিপ জ্বলছে, কিছু কিছু ক্যান্ডেল ফুরিয়ে নিভে গেছে। এত নান্দনিক সৌন্দর্য শ্রেয়ানের চোখে লাগছে না। তার চোখ গিয়ে আটকেছে বিছানায় তন্দ্রাঘোরে ডুবে থাকা মেয়েটির দিকে। তার পরনে লাল অর্গাঞ্জা শাড়ি, কালো ফুল স্লিভসের ব্লাউজ। শ্রেয়ান জুতো খুলে বিছানার একসাইডে উঠে বসল। শার্টের স্লিভসের বোতাম খুলে ফোল্ড করে নিল। তারপর তুশিকে ঠিকমতো গুছিয়ে শোয়াতে গেলে, তুশি বিরবির করে ওঠে। কথাগুলো বোঝার তাগিদে শ্রেয়ান কান নিচু করে তুশির মুখ বরাবর আনতেই, শুনতে পায়,
-“অনেক অনেক অ-নে-ক অপেক্ষা, তারপর ঘুম। অপেক্ষা সমান সমান ঘুম। অল্প অপেক্ষা সমান অল্প ঘুম, বেশি অপেক্ষা সমান একটু বেশি ঘুম, সারাজীবনের মতো অপেক্ষা সমান সারাজীবনের মতো ঘুম। আপনি আসবেন কবে?”
কিছুক্ষণ চুপ থাকে, তারপর আবারও গুঙিয়ে ওঠে,
-“উমম.. এসেছেন?”
শ্রেয়ান আনমনে বলে ফেলল,
-“এসেছি আমি।”
তুশি আওয়াজ পেয়েই ঠোঁট টিপে আস্তেধীরে তাকাল৷ ঘুমের রেশ ধরে চোখ খুলতেই চাইছে না। বড়ো কষ্ট করে তাকাল। শ্রেয়ানের উপস্থিতি তার নিকট ভ্রম বই কিছুই লাগছে না, তাই কোমল স্বরে শুধাল,
-“বিভ্রম?”
শ্রেয়ান মুখোমুখি হয়ে আছে তুশির, বেশ কাছে। তুশির দিকে গম্ভীরতর দৃষ্টি তার। বড়ো কঠিনভাবে বলল,
-“না।”
ভাবল তুশি কিঞ্চিৎ,
-“তবে?”
-“ভাবো।”
-“বুঝতে পারছি না।”
-“কী বুঝতে পারছ না?”
-“এটা আপনি?”
-“না।”
-“তবে?”
-“তোমার স্বামী।”
আড়ষ্টতায় তুশি নড়েচড়ে উঠল। শ্রেয়ান দূরত্ব চুকিয়ে নিল মাঝের, তুশির আধখোলা ঠোঁটে ঠোঁট ছুঁয়ে দিলো, স্বল্পক্ষণের ব্যবধানে সামান্য দূরত্ব আবারও তৈরি করল। তাকিয়ে রইল লাজুক চোখের দিকে। তুশি সে দৃষ্টিতে কেঁপে উঠল। একহাতে বিছানার চাদর খামচে ধরল, ঠোঁট দুটো একটা আরেকটার সাথে চেপে ধরল। শ্রেয়ান হেসে আরেকবার চুমু খেল ঠোঁটদ্বয়ের ভাঁজে। আরেকটা ছোট চুমু গলার মাঝে খেয়ে বুকে মুখ গুঁজে শুয়ে পড়ল। চোখ বন্ধ করে আদেশের সুরে বলল,
-“প্রচণ্ড হেডেক হচ্ছে। চুলগুলো টেনে দাও, তুশি।”
তুশির গায়ের কাঁপুনিটা শ্রেয়ানের ভারি পছন্দ হচ্ছে। কেমন যেন ঘুম ঘুম পাচ্ছে। এদিকে তুশির গায়ে বিন্দুমাত্র শক্তি নেই। হুট করে ঘুম ভাঙার পর থেকে এসব কী হচ্ছে, বুঝে উঠতে পারছে না। বুঝে ওঠার অবস্থাও নেই। তবুও সে হাত দুটো ওঠাল। একহাত শ্রেয়ানের পিঠে ও অন্য হাত শ্রেয়ানের চুলের ভাঁজে রেখে দিলো। ছোট ছোট হাতগুলোর বলহীন স্পর্শে শ্রেয়ানের ঘুম চোখে আশি শতাংশ নেমে এলো। ঘুমিয়ে যাওয়ার আগমুহূর্তে তুশির উদ্দেশ্যে আবারও বলল,
-“সকালে ডেকো না, বহুদিন পর ঘুম পাচ্ছে।”
তুশি আস্তে-ধীরে স্বাভাবিক হতে লাগে আর তার ঠিক পরপর বাধভাঙ্গা খুশিতে অন্তরটা ভরে ওঠে। তার স্বামী এই প্রথম তার সান্নিধ্যে এসেছে, অথচ তার চোখে কামনা ছিল না, অগাধ মায়া আর অপরিমেয় ধরে রাখার ইচ্ছেশক্তি ছিল। তুশির আর কী চাই? আর কী চাই? কিচ্ছু না।
_______
-“আপডেট কী?”
আয়াতের প্রশ্নে প্রহর কপাল কুঁচকে ফেলল। আর অর্থ এ-ই—কীসের আপডেট! কথাটা বুঝে আয়াত বলল,
-“আঙ্কেল-আন্টিকে আমার ব্যাপারে বলবি কবে? এদিকে তো গ্যাঞ্জাম লেগে যাবে। জলদি জলদি কর সব।”
প্রহর আয়াতের দিকে তাকিয়ে বলল,
-“আম্মু-আব্বুকে বলেছে, আপু।”
আয়াত সামান্য কেঁপে উঠল, বড়ো উত্তেজনা নিয়ে শুধাল,
-“ওনারা কী বললেন? কোনো সমস্যা নেই তো? রাজি?”
প্রহর সামান্য হাসল,
-“প্রথমে কিছুটা ইতিউতি করছিল। এরপর যখন তোর নাম বললাম, তখন একবাক্যে রাজি।”
শব্দ করে আয়াত বলল,
-“আলহামদুলিল্লাহ, আলহামদুলিল্লাহ, আলহামদুলিল্লাহ!”
-“আমার অনার্সটা হোক, আর মাস ৩ লাগবে। এ-কটাদিন সামলাতে পারবি না?”
আয়াত উৎফুল্ল হয়ে বলব,
-“কেন পারব না? অবশ্যই পারব। তোর জন্য আমি আমার পছন্দের আইস্ক্রিমকেও তালাক দিতে পারি, ব্যাটা! ক’জ আই লাভ ইউ।”
প্রহর মিহি হেসে আয়াতের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো। আয়াত ঠোঁট কামড়ে হাসল। পরক্ষণেই স্বীয় সত্তায় আবির্ভাব ঘটিয়ে বলল,
-“মাম্মা, তুই জোস! এত জোস কেন তুই? হুয়াই ম্যান? একটা ব্যাটা মানুষ তুই, তুই কেন এত জোস হবি? অন্য জোস জোস মাইয়াদের পিছে ঘুরবি, মাইয়ারা কেন তোকে চোখ দিয়ে গিলে খাবে? চ্যাহ! প্রকৃতির নিয়ম উলটা-পালটা করে দিচ্ছিস। তোর তো এ জগতে থাকার অধিকারই নাই।”
প্রহর অনিমেষ তাকিয়ে রইল। আয়াত বলতেই লাগল,
-“শোন, প্রহর! তুই ব্যাটা এক পিস এই দুনিয়াতে, তা নিয়ে সন্দেহ নাই। আমিও একপিসই। আমার মতো ওহ সো সুইট মেয়ে তুই দুইটা খুঁজে পাবি? জীব্বনেও না। লিখে দিতে পারি—যদি আমার মতো দ্বিতীয়টা পাস, তবে এই মেহেরিন আয়াত সাওদাহ্ নিজের নাম চেঞ্জ করি চামচিকা রাখব।”
ঠোঁট টিপে হাসল প্রহর,
-“তাই না?”
-“জী জী, অবশ্যই তাই।”
কিছুটা থেমে আবারও বলল,
-“শোন প্রহর, আমার বান্ধবী আছে না? তুশি? ও আর আমি আগে বহুত প্ল্যান করতাম লাইফ নিয়ে। এই হবে, সেই হবে। আমাদের প্ল্যান যেখানেই শুরু হতো না কেন, শেষ হতো গিয়ে এক বাড়িতে বিয়ে নিয়ে। কিন্তু তা তো না-ও হতে পারে এবং হলোও না। তাই আমরা আরেকটা প্ল্যান রেখেছিলাম। সেটা হচ্ছে ট্যুরের। প্রতিমাসে মাসে ট্যুর দেবো আমরা চারজন। মানে ও আর ওর জামাই, আমি আর আমার জামাই মানে তুই। জোস হবে না বল?”
-“হুঁ।”
-“এভাবে তাকিয়ে আছিস কেন? শোন, আজ একটা সিরিয়াস কথা বলি তোকে। এই যে তোর এই চুপচাপ থাকাটা! এটা আমার খুব ভালো লাগে। আমার মতো এক্সট্রোভার্টের জন্য ইউ আর দ্যা পার্ফেক্ট ওয়ান। ট্রাস্ট মি, ব্রো। তোর মতো আমাকে কেউ বুঝবে না, আমার খেয়াল রাখবে না। অ্যান্ড দ্যা মোস্ট ইম্পর্টেন্ট থিং, আমাকে তোর মতো কেউ ভালোবাসবে না। অন্যান্য মানুষের বয়ফ্রেন্ড করে কী জানিস? গার্লফ্রেন্ডের তৃষ্ণা পেয়েছে কি না জিজ্ঞেস করে, আর তুই সরাসরি পানির বোতল হাতে ধরিয়ে দিস। অন্যান্যরা জিজ্ঞেস করে, ‘তোমার অস্বস্তি হচ্ছে?’
তুই আমার স্বস্তির ব্যবস্থা করে বলিস, ‘এখন ভালো লাগবে।’
অন্যান্য মানুষের বয়ফ্রেন্ড বলে, ‘তোমার চেহারায় দুশ্চিন্তা, কী হয়েছে বলো?’
আমার তুই আমাকে কখনও জিজ্ঞেস করিসনি তা, বুঝে নিয়েছিস, দুশ্চিন্তা দূর করেছিস কিছু না করেই কীভাবে কীভাবে যেন। আফটার আব্বুজান, ইউ আর দ্যা ওনলি ওয়ান, হু মেকস মি মাচ স্পেশ্যাল। আমার পৃথিবীতে এতখানি স্পেশ্যাল আমি আর কাউকে দেখিনি, যতটা তুই আমাকে ফিল করিয়েছিস। বিনিময়ে আমি আমৃত্যু ভালোবেসে যাব তোকে। এখন বরঞ্চ প্রশ্ন জাগে। তুই আমার বয়ফ্রেন্ড, প্রহর? না তো। বয়ফ্রেন্ডরা এমন হয় না। তোকে আমি কোনো ক্যাটাগরিতেই ফেলতে পারিনি। বহু ভেবে উত্তর পেলাম, তোর সাথে আমার একটা অ-সম্পর্ক আছে। আমি শেষ অবধি এভাবেই থাকতে চাই। যদি অ-সম্পর্ক এত সুন্দর হয়, আমি এই সম্পর্কটার কোনো নাম দেবো না। কক্ষনও না। বিয়ের পরও এভাবেই থাকবে। কিচ্ছু পালটাতে দেবো না আমি।”
মলিন হয়ে উঠল প্রহরের ঠোঁটের হাসিটা। মাথা নাড়ল সে। নিজ দায়িত্বে প্রেয়সীর হাত ধরল, সে হাতের পিঠে একটা চুমু খেল। প্রহরের এহেন কাণ্ডে আয়াত থতমত খেয়ে ওঠে,
-“জিনে ভর করেছে নাকি, মাম্মা? চ্যাহ! এসব কী? তোকে ভালো ভাবছিলাম। আর তুই কি না? চ্যাহ! মামুউউউ, দাদুউউউ, নানুউউ!”
প্রহর কিছু বলল না। অনিমেষ দেখে গেল তার এই পুতুলটাকে। পলকটাও ফেলছে না ঠিকঠাক। যেই এই পলক ফেলার সময়টাও তার কাছে নেই।
_______
প্রিয় অফিস থেকে ফেরার বহু পরে আজ শরৎ ফিরেছে। এসে থেকে কেমন ক্লান্ত। মাত্র ফ্রেশ হতে ওয়াশরুমে গেল। আজ আসার পর থেকে তেমন কিছু বলেনি প্রিয়কে। রোজ একটা ফুল নিয়ে আসে, রোজ জলদি আসে! অথচ আজ?
ঘড়িতে বাজে রাত বারোটা প্রায়। এই অবধি শরৎ এত দেরিতে আসেনি তো। দেরি হওয়ার সম্ভাবনা থাকলেও কল/ম্যাসেজ করে দিয়েছে। প্রিয়র বুক কাঁপছে। কিছু হয়েছে কি? অবশ্যই হয়েছে। নতুবা অকস্মাৎ এই পরিবর্তনই বা কীসের? প্রিয় ভাবনায় পড়ে গিয়ে দেখল শরৎ বেশ কিছু কাপড় ছড়িয়ে ছিটিয়ে ফেলে রেখেছে।
প্রিয় এগিয়ে এসে ফেলে রাখা কাপড়গুলো গোছাতে গোছাতেই ওপাশ থেকে শরতের ফোনের ম্যাসেজ টিউন বেজে উঠল। প্রিয় কখনও শরতের ফোন ধরে না, কেন যেন খুব নিম্নমানের কাজ লাগে এটা তার কাছে। তবুও আজ সে এই কাজটা করল। নোটিফিকেশনে ম্যাসেজের আইডিটার নাম সেভ করা ‘শর্মি’ দিয়ে। ম্যাসেজটাও পড়ল নোটিফিকেশন থেকে, ওখানে লেখা,
-“আজকের দিনটা ওয়ান অফ দ্যা মোস্ট স্পেশ্যাল ডে অভ মাই লাইফ। আ’ম থ্যাংকফুল টু ইউ শরৎ, ফর মেকিং মাই ডে। অ্যান্ড আই লাভ.. ”
এটুকুই শো হলো। আর এতেই প্রিয় আঁতকে উঠল। তার ফোনের লক প্রিয়র জানা নেই। কিংবা জানা থাকলেও এই মুহূর্তে মনে পড়ছে না।৷ ওদিকে শরতের দেরি হচ্ছে। প্রিয়র মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে অসংখ্য কথা। শ্রেয়ানের কাহিনিগুলো। সে-ও তো খেলেছিল প্রিয়কে নিয়ে। অথচ শুরুতে কী নিঁখুত অভিনয়!
সেবার সামান্য ঘুমিয়ে গিয়েছিল সে, ওদিকে শ্রেয়ান সারারাত বাইরে মশার কামড় খেতে খেতে সরি বলছিল, অথচ এরপর মাসের পর মাসের প্রিয় হাসপাতালে গা পাতলেও সেখানে শ্রেয়ানের বিন্দু সমান গায়ে বাঁধেনি। পানশীতে এত এত মানুষের সামনে হাঁটু গেড়ে সেই প্রপোজালটা! জীবনের বাকি ৬৮টি বছরের দায়িত্ব নিতে বলে, ছ’বছরেই হারিয়ে যাওয়া! চাঁদের সাথে রোজ তুলনা করতে করতে চাঁদের মতো কলঙ্কিত করে ছেড়ে যাওয়া। এক নারীকে অপশনে ফেলে একাধিকের সাথে মন বিনিময়! এসবই তো সে পেয়েছে শ্রেয়ানের থেকে। তারপর সে শরৎকে বিশ্বাস করল।
খট করে ওয়াশরুমের দরজা খুলে ফেলল শরৎ। প্রিয়র হাতে তার ফোন এবং চেহারায় অস্বাভাবিকতা। মুখটা অসামান্য রক্তিম। ক্ষণে ক্ষণে ছোট্ট নাকটা ফুলে-ফেঁপে উঠছে। বুকভার হয়ে আসছে। রাগ আটকানোর অভিলাষে শান্ত থাকার প্রয়াসটায় বার বার সে ঠোঁট চেপে ধরছে, ডান গালের টোলটা দৃশ্যমান হচ্ছে।
শরৎ এক কদম এগোতেই প্রিয় দুটো পা পিছিয়ে যায়। ভ্রুকুটি করে শরৎ শুধাল,
-“কিছু হয়েছে?”
প্রিয় তাকাল শরতের দিকে। বড়ো বড়ো চোখ দুটো দিয়ে যেন আগুন ঝরছে..
চলবে..
#শুক্লপক্ষের_পরিশেষে
#লেখনীতে_নবনীতা_শেখ
|৫৩+৫৪|
-“আজকের দিনটা ওয়ান অফ দ্যা মোস্ট স্পেশ্যাল ডে অভ মাই লাইফ। আ’ম থ্যাংকফুল টু ইউ শরৎ, ফর মেকিং মাই ডে। অ্যান্ড আই লাভ টু ওয়ার্ক অন দ্যিস প্রোজেক্ট। থ্যাংকস ফর গিভিং মি দিস অপারচ্যুনেটি। এই প্রোজেক্টটায় আমার প্রোমোশন কনফার্ম।”
পুরো ম্যাসেজটা দেখাল শরৎ প্রিয়কে। প্রিয় কিছু বলছে না। সে অপ্রস্তুত ভঙ্গিমায় এদিক-ওদিক চাইছে। শরৎ প্রিয়র দু-বাহুতে ধরে বলল,
-“বি নরমাল। বসো এখানে, পানি খাও। আমি বোঝাচ্ছি বিষয়টা।”
প্রিয় বসল, শরৎ পানির বোতলটা এগিয়ে দিয়ে বলল,
-“আমার কলিগ শর্মি। ও সবকিছুতেই একটু নার্ভাস থাকত আগে, নার্ভাসনেসে কোনো কাজই ঠিকমতো করতে পারত না। এজন্য ওকে কাজও দেওয়া হতো বেছে বেছে। এখন ওর নার্ভাসনেস কাটলেও, ওকে কেউ ভরসা করে কোনো বড়ো ধরনের কাজ দিতে পারে না।
গতদিন ইয়াকিন ভাই সিলেটের নতুন প্রোজেক্টটা আমাকে দিলে, আমি সেটা নিই। তারপর আজ সবকিছু গুছিয়ে, বাকিটা শর্মিকে হ্যান্ড-ওভার করে দিই। আপাতত শর্মি ছাড়া সবার হাতেই অসম্ভব কাজের প্যারা, তাই ইয়াকিন ভাই না করতে পারেননি। শর্মিও এতে নিজেকে প্রুভ করার একটা সুযোগ পাবে। আমিও আগামী মাসখানেকের নামে আপনার কাছে ব্যস্ত হব না। বুঝেছেন, ম্যাডাম? আজ সেসবে এত সময় গেল, ফিরতেও দেরি হয়ে গেল। সরি। কানে ধরে। দেখেন এদিকে।”
প্রিয় তাকাল। দেখতে পেল শরৎ হাঁটু গেড়ে তার সামনে বসে আছে, কানে হাত তার। চেহারায় অসম্ভব কিউটনেস। আর ঠোঁটে ছোট্ট বুলি,
-“মিসেস নীরজ শিকদারকে রাগিয়ে দেওয়ার জন্য মিস্টার নীরজ শিকদার একটু সরি। বেশি সরি নয়, কেননা আপনার লাল-টমেটোর মতো ফেইসটা অসম্ভব আবেদনময়ী, আমার ভালো লেগেছে। আর আমি বার বার দেখতে চাই, বার বার রাগাতে চাই।”
প্রিয় হেসে ফেলল। শরৎ গাল টিপে দিলো প্রিয়র,
-“এভাবেই হাসবেন। আপনার হাসি সুন্দর।”
শরৎ উঠে পড়লে প্রিয়ও পিছু নেয়,
-“খেয়ে এসেছেন না?”
-“না, প্রিয়। আপনি এখানে আমার অপেক্ষায় থাকবেন, আর ওদিকে আমি খেয়ে উঠব? আমাদের না ভাগাভাগির সম্পর্ক? একা একা কীভাবে কী করি?”
কথাটা বলে শরৎ অদ্ভুত ভঙ্গিমায় চমৎকারভাবে হাসল। প্রিয়র সেই হাসিটা কী যে ভালো লাগল!
____
আয়াত রমনার কৃষ্ণচূড়া বেছানো রাস্তা দিয়ে হাঁটছে। শুভ্র গায়ে তার লাল টকটকে চুড়িদার। ওড়না গলায় জড়ানো। দুই হাতে ওড়নার দুই প্রান্ত ধরে মাঝে সাঝে ছড়িয়ে দিচ্ছে পাখা মেলার ভঙ্গিমায় ওড়াল দেওয়ার তাগিদে। মাঝে মাঝে আঁড়াআঁড়িভাবে পিছে মুড়ে প্রহরকে দেখছে। বরাবরই প্রহরকে দেখতে পাচ্ছে একই মুখাবয়বে। ভ্রু উঁচিয়ে শুধাল,
-“অমন সঙের মতো দাঁড়িয়ে কেন?”
প্রহরের সোজাসাপটা জবাব,
-“তোকে দেখতে ভালো লাগছে।”
আয়াত বিষম খেয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। প্রহর হাতের পানির বোতলটা তার দিকে এগিয়ে দিলো। সে পানি খেয়ে বুকে হাত দিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল,
-“ওভাবে বলিস না, ভাই। মনে হয় তোর ওপর জিন ভর করেছে।”
প্রহর চোখে হাসল। চোখের কার্ণিশে সামান্য ভাঁজ এলো। কিছুক্ষণ পর আয়াতের ফোনে তার বাবা মোশাররফ সরদারের কল আসে। আয়াত কল রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে মোশাররফ সাহেব বলেন,
-“আম্মু, কোথায় আছ তুমি?”
আয়াত হেসে হেসেই বলল,
-“এই তো, ফ্রেন্ডদের সাথে একটু ঘুরতে এসেছি।”
-“বাসায় ফেরো জলদি।”
-“কেন, বাবা?”
-“একটু প্রয়োজন আছে।”
-“কী প্রয়োজন?”
-“বেশি প্রশ্ন কোরো না, এসো জলদি।”
আয়াতের মুখ গোমড়া হয়ে এলো। কল কেটে ফোন ব্যাগে ঢোকাতেই প্রহর বলল,
-“কিছু হয়েছে?”
-“বাবা ফিরতে বলল।”
-“আচ্ছা, চল তোকে পৌঁছে দিয়ে আসি।”
আয়াত ঠোঁট উলটে বলল,
-“কিন্তু আমার যেতে ইচ্ছে করছে না।”
প্রহর আশে-পাশে একবার তাকাল, মানুষের আনাগোনা এদিকটায় নেই একদমই। ব্যাপারটা নিশ্চিত করে সে আয়াতের নিকটে এলো। মাঝসিঁথিতে ছোট্ট করে চুমু খেলো সময় নিয়ে। আয়াত কেঁপে উঠল। চোখ বন্ধ করে ফেলল। পরক্ষণেই একটি দীর্ঘায়িত হাসি তার ঠোঁটে এসে এঁটে গেল। ফিসফিসিয়ে বলল,
-“এমন বিদায় সহস্রবার চাই।”
প্রহর সেভাবে ঠোঁট ছুঁইয়েই হাসল। সামান্য সরে এসে আয়াতের মাথার পেছনের দিকের চুলগুলোয় হাত বুলিয়ে দিলো। আয়াত প্রসন্ন হেসে বলল,
-“তোর ওপর আজ খুব প্রেম প্রেম পাচ্ছে, প্রহর। চল বিয়ে করে ফেলি। লাল ঘোমটার আড়ালে তোর লাল টুকটুকে বউ! ভাবতে পারছিস? জাস্ট ইম্যাজিনটা কর!”
প্রহর হেসে বলল,
-“করলাম ইম্যাজিন।”
-“কেমন লাগবে আমাকে?”
-“খুব সুন্দর লাগবে।”
আয়াত প্রহরের একহাতের বাহু ধরে বাচ্চামো করে বলল,
-“শ্বশুরবাড়ি যাবার বয়সে বাপের বাড়ি যেতে হচ্ছে। আমার কষ্টটা বুঝতে পারছিস?”
প্রহর কিছু বলল না। আয়াত তখন বলল,
-“শোন, ফোনের ধারেই থাকিস। আমি গিয়েই কল দেবো। আজ সারারাত আমার সাথে প্রেমালাপ করতে হবে। ঘুমের নাম নিবি তো সোজা নাইজেরিয়া পাঠিয়ে দেবো।”
-“ঠিক আছে।”
মলিন মুখে আয়াত বলল,
-“চল, দিয়ে আয় আমাকে।”
প্রহর বাইকে করে আয়াতকে বাড়ির সামনে অবধি এসে নামিয়ে দিলো। আয়াত নেমে আর পিছে তাকাল না। সোজা চলে গেল। প্রহর বেশ কিছুক্ষণ ওভাবেই বসে রইল। হাত-পা অসার হয়ে আসছে তার। পাশে একটা টঙের দোকান ছিল, প্রহর সেখানে ঢুকে গেল সোজা। দোকানিকে উদ্দেশ্য করে বলল,
-“মামা, এক প্যাকেট বেনসন দেন তো।”
দোকানি বেনসনের প্যাকেট দিতেই প্রহর পকেট থেকে পাঁচশত টাকার একটা চকচকে নোট এগিয়ে দিলো। দোকানি সে নোট নিয়ে আলোর দিকে ধরে এদিক-ওদিক দেখল। এরপর তা রেখে দিয়ে একটা দুইশত টাকার কোঁচকানো নোট প্রহরকে ধরিয়ে দিলো। অন্যান্য দিন হলে প্রহর এই নোটটা চেঞ্জ করিয়ে নিত। আজ নিল না। সেভাবেই পকেটে ঢুকিয়ে ফেলল। সিগারেটের প্যাকেট উলটে পালটে দেখে, ভেতর থেকে একটা বের করল। দোকানের সরু দড়িতে বাঁধা লাইটারটি নিয়ে একটা সিগারেট জ্বালাল। ঠোঁটে ছোঁয়াল সেটা। ধোঁয়া উড়ছে, পৃথিবী তার নিকট ধোঁয়াটে লাগছে।
অন্তর্মুখী মানুষদের সাথে বাহ্যিক দুনিয়ার লেনদেন একটু কমই বটে। তারা মনের কথা মুখে আনতে প্রচণ্ড দ্বিধা করে। তারা বুকের ভেতর পাহাড় পোষে, বাইরে থেকে সহজ-শান্ত-সরল! তাদের জীবনধারা একটু কঠিন। তারা ইন্টার্যাক্ট করতে পারে না সহজে।
অথচ এই অন্তর্মুখী মানুষের মাঝে এক ধরনের বিশেষ ক্ষমতা আছে, যা আমাদ্ব্র জানার বাইরে। তাদের ইএসপি সাংঘাতিক হয়। ইএসপি হলো এক্সট্রা সেনসরি পারসেপশন বা অতীন্দ্রিয় ক্ষমতা; যেটাকে আমরা সহজে সিক্সথ সেনস্ও বলতে পারি। তারা প্রকৃতির সাথে কানেকশন রেখে চলে। তাদের গ্যেসিং সেনস্ অমায়িক। তারা মানুষের হাবভাব বোঝে। তারা ভবিতব্য সম্পর্কে আগাম টের পেতে পারে।
যেমনটা প্রহর পাচ্ছে আজ ক’সপ্তাহ ধরে! খুব টের পাচ্ছে। আর সবচেয়ে ইন্ট্রেস্টিং ব্যাপার হলো, যেই ঘটনা ঘটবে বলে সে অনুমান করছে, সেই ঘটনা আজ ঘটবে, আর আজকের সন্ধ্যাতেই ঘটবে। সে ভুল হলে, একটু পর তার প্রয়োজনীয়তা পড়তে পারে। খুব চাইছে, সে আজ ভুল হোক। তার সেনসিং পাওয়ারটা নষ্ট হয়ে যাক, তার সব ধরনের পারসেপশন ভুল বের হোক। খুব চাইছে সে।
সিগারেটের আগুনের তাপ যখন হাত স্পর্শ করল, প্রহর তবুও ধরে রাখল। সময় নিয়ে সেটা ফেলে আরেকটা ধরাল। তারপর আরেকটা, তারপর আরেকটা। সিগারেটের প্রতি ঝোঁক তার বছর কয়েক হবে। তবে সে নিয়ন্ত্রণে থেকেছে। দিনে ৩টার অধিক কখনও নেয়নি। তবে বিগত সপ্তাহ ধরে সে নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছে।
ঘন্টা গেলেও যখন আয়াতের কল এলো না, প্রহর ধোঁয়া উড়তে থাকা সিগারেটটার দিকে তাকিয়ে হাসল। তার অনুমান ২০%, ৩০%, ৫০%, ৮০%, ৯৫% এ গিয়ে থামল। আর ৫% এর আশা নিয়ে সে ওভাবেই দাঁড়িয়ে রইল, সন্ধ্যা নামতে লাগল।
______
আয়াত রুমে ঢুকতেই মোশাররফ সাহেব এসে বললেন,
-“আম্মু, একটু কথা ছিল তোমার সাথে।”
-“বলো। কিন্তু, তোমাকে এত ক্লান্ত দেখাচ্ছে কেন?”
মোশাররফ সাহেবের সাদা কাবলিটা কুঁচকে আছে, স্লিভস অগোছালোভাবে গোটানো, চুল-দাড়িও এলোথেলো। বড়ো করে একটা শ্বাস ফেলে তিনি বললেন,
-“তোমার আমজাদ আঙ্কেল আছেন না?”
-“হ্যাঁ, তোমার বন্ধু। তিনি না?”
-“হ্যাঁ। ও স্ট্রোক করেছে গতরাতে। আমি কাল থেকে হসপিটালেই ছিলাম। এখন ও কথায় কথায় বলছে, ছেলেকে আজই বিয়ে দেবে। আমি খুব করে বলেছিলাম, সুস্থ হলেই আয়োজন করে বিয়েটা দেবো। ও মানতেই চাইছে না। তাই জলদি তোমাকে ডেকে নিলাম।”
আয়াত বুঝতে পারছে না ব্যাপারটা। চোখ পিটপিট করে বলল,
-“এখানে আমি কী করতে পারি?”
-“তোমাকে আমি অনেকদিন আগেই বলেছিলাম আমার বন্ধুর ছেলের সাথে তোমার বিয়ের কথা। তোমার আপত্তি ছিল না, কেবল সময় চেয়েছিলে। এখন পরিস্থিতি অনুকূলে। রেডি হও, একটু পর বিয়ে পড়ানো হবে।”
আঁতকে উঠল আয়াত,
-“আশ্চর্য! এভাবে কীভাবে কী? কে মরল না বাঁচল, তাতে আমি কেন নিজের লাইফের এত বড়ো ডিসিশনে আসব?”
অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে মোশাররফ সাহেব একবার মেয়ের দিকে তাকালেন৷ পা ভেঙে এলো তার, বসে পড়লেন সোফায়। দু-হাত দিয়ে মুখ ঢেকে ফেলেছেন তিনি। বার বার ঘন ঘন শ্বাস নিচ্ছেন। বিরবির করছেন,
-“আমি ওদিকে কথা দিয়ে রেখেছি! বিয়ের ব্যবস্থা করতে বলেছি। কিছুক্ষণের মধ্যেই কাজি চলে আসবে, ওর ছেলে মাহিন আর ভাবিও চলে আসবে। আমি মুখ দেখাব কীভাবে!”
আয়াত ধপ করে বিছানায় বসে পড়ল। অপ্রস্তুত হয়ে বসার দরুন ওড়নায় লেগে শেল্ফ থেকে গ্লাসের শো-পিসটা পড়ে ভেঙে গেল। শব্দ পেয়ে শক্ত-সামর্থ্য চেহারার মোশাররফ সরদারও সামান্য ঘাবড়ে উঠলেন ক্ষণিকের জন্য। দু-বার শ্বাস টেনে আয়াতের কাছে চলে এলেন তিনি। পাশে বসে বললেন,
-“আমাকে বিশ্বাস করো না, আম্মু? তোমার জন্মের সময়ই তোমার মা মারা যায়। তারপর থেকে তো তোমার গোটা দুনিয়া আমিই। তোমাকে সহস্র সুযোগ দিয়েছি জীবন উপভোগের। বিনিময়ে পেয়েছি তোমার বিশ্বাস। এখানে না-হয় বাবাকে আরেকটু বিশ্বাস করো? আই প্রমিস আম্মু, বাবা তোমাকে একটুও ঠকাবে না।”
আজ হুট করেই বুকের ভেতরে ‘মা’ শব্দটা খুব তীব্রভাবে লাগছে আয়াতের। অভ্যন্তরে ভীষণ দূর্বল কিসিমের অথচ বাহ্যিকতায় সর্বোচ্চ শক্তপোক্ত মেয়েটি আজ না পারছে রাগতে, না পারছে কাঁদতে। কেবল স্তব্ধ হয়ে একদৃষ্টে মেঝেতে তাকিয়ে আছে। পায়ের নখ দিয়ে টাইলস খুড়ছে সে। হাত দুটো মুঠো হয়ে আছে, নখগুলো হাতের তালুকে রক্তাভ বানিয়ে ছেড়েছে। সে এক্ষুণি উঠে চলে যাবে এখান থেকে। প্রহর? প্রহরকে ছাড়া সে কীভাবে থাকবে? অন্তত একবার তার বাবাকে বলা উচিত প্রহরের কথা।
সে তাকাল মোশাররফ সাহেবের দিকে। তার বাবার চোখ ভেজা। সে উত্তরের আশায় তাকিয়ে আছে। এক নিমিষেই নিজের পুরো শৈশব আয়াতের চোখের সামনে ভেসে উঠল। সে কীভাবে মানা করবে এই মুহূর্তে? এখন তার বাবাকে যদি প্রহরের কথা বলে, কখনও মানা করবেন না তিনি। একদমই মানা করবেন না। রাজি হয়ে যাবেন একবাক্যে। কিন্তু বিনিময়ে ভীষণ অসম্মানিত হতে হবে তাঁকে। মেয়ের স্বার্থে এটুকু অসম্মান তিনি শতবার কাঁধে নিতে পারেন। কিন্তু আয়াত তার বাবাকে অসম্মানিত হতে দেখতে পারবে?
ছোট ছোট আঙ্গুলে যেই বাবার হাত ধরে সে চলতে শিখেছে, তার বিপরীত পথ কী করে ধরবে? আবারও বলতে চাইল প্রহরের কথাটা। একবার বলে দেওয়া উচিত। বাকিটা পরে দেখা যাবে। যা হওয়ার হবে, প্রথমে তো তার ভালোবাসা! একবার বললেই কী সুন্দরভাবে সবটার সমাধান এসে যাবে!
ঠিক তখন মোশাররফ সাহেব আয়াতের মুঠো করে রাখা হাত ধরে বললেন,
-“আম্মু, বাবাকে আরেকটু বিশ্বাস করো। মাহিন ছেলে হিসেবে ভালো খুব। কথা দিচ্ছি, কখনও অসুখী রাখবে না তোমাকে।”
নাহ! এভাবে শুধু শুধু কষ্ট পাওয়া। আয়াত মুখ খুলল বলার জন্য, “বাবা, আমি প্রহরকে ভালোবাসি।”
জড়তা অথবা সংকোচ কিংবা বাবার ঋণ! আয়াতের কথাগুলো শব্দ পরিবর্তন করে ফেলল,
-“আমি রাজি।”
মোশাররফ সাহেব স্বস্তি পেলেন। মেয়ের কপালে চুমু খেয়ে চলে গেলেন। আয়াত চোখ বন্ধ করে ফেলল। মিনিট পাঁচেক সময় নিয়ে প্রহর আর তার এই অবধি কাটানো এত শত মুহূর্তগুলো ভাবতে লাগল। কী সুন্দর সময়গুলো! আচ্ছা, ও যাওয়ার পর কি প্রহর আবারও সেই আগের মতোই হাদারাম সেজে যাবে? ফিক করে হেসে ফেলল সে।
চোখ খুলে দেখল, সামনে রুমু দাঁড়িয়ে ফোঁপাচ্ছে। আয়াতকে ওর দিকে তাকাতে দেখেই রুমু বলল,
-“আমি আঙ্কেলরে বলি গিয়ে, প্রহর ভাইয়ার কথা? আপু, তোমার কষ্ট আমার সহ্য হচ্ছে না। কান্না পাচ্ছে।”
আয়াত হাত বাড়িয়ে রুমুকে কাছে আসার নির্দেশ দিলো। রুমু এসে পা ভাঁজ করে আয়াতের সামনে বসে পড়তেই, আয়াত ওর মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,
-“কিচ্ছু বলা লাগবে না।”
-“আপু, কেন বলা লাগবে না? প্রহর ভাইয়া কষ্ট পাবেন, তুমি কষ্ট পাবা! আমি তো মরেই যাব।”
-“বাবা বলেছে, আমি অসুখী থাকব না।”
-“তুমি ভেতর থেকে মরে যাবা, আপু। প্রহর ভাইয়াও মরে যাবে।”
-“পাগলি! কেউ মরবে না। সবাই ভালো থাকবে।”
রুমুর কান্না থেমে গেল। নিশ্চিত আয়াত পাগল হয়েছে। নয়তো এসব সে বলে কীভাবে? আয়াতের জায়গায় সে থাকলে, অন্তত কয়েকবার তো জ্ঞান হারাতোই! অথচ প্রকৃতি আজ কী খেলা দেখাচ্ছে! রুমু আবারও কেঁদে ফেলল। আয়াত রুমুকে বলল,
-“কাঁদিস না। কান্নাকাটি বিরক্ত লাগছে।”
রুমুর কান্না থামার বদলে আরও বেড়ে যাচ্ছে। আয়াত উঠে আলমারি থেকে মায়ের শাড়ি-গয়নাগুলো বের করল। ফ্রেশ হয়ে শাড়ি পরে নিল। চুলগুলো বিনুনি করল একটা। কানে ছোট গোলপাশা আর হাতে মায়ের দুটো মোটা বালা পরল। সাজতে ইচ্ছে করছে না ঠিক। তবে যতটা না সাজলে বাবার চোখ ফাঁকি দিয়ে সুখী হওয়ার নাটকটা না করা যায়, ততটা সেজে নিল সে। টঙের দোকান থেকে আয়াতের গতিবিধি লক্ষণীয় নয়। তবে প্রহর বসে বসে তা কল্পনা করে নিচ্ছে।
কিছুক্ষণের মধ্যেই একটা সাদা রঙের প্রাইভেট কার প্রহরের সামনে দিয়ে সোজা আয়াতদের বাড়ির ভেতরে ঢুকে গেল। প্রহর স্থির চোখে তা দেখল। আকাশে রাত নামল এরপর। মনেও রাত নামল।
আয়াত বলেছিল, বাড়ি গিয়েই কল দেবে প্রহরকে। সে দেয়নি। প্রহর কি অপেক্ষা করছে? সারাজীবন হিমু সেজে তাকে রূপার মতো অপেক্ষা করাল। আজ কি সে অপেক্ষা করবে? হিমুরা তো অপেক্ষা করে না। তারা পরিণতি দেখে। ব্যাপারটা বেশ জানে আয়াত। তবুও একবার কল করল।
প্রহর জানে কলটা কার। সে পকেট হাতড়ে ফোন বের করে কন্ট্যাক্ট নেইম না দেখেই কল রিসিভ করে কানে তুলল। ওপাশ থেকে শব্দ আসছে না। প্রহর স্থিরভাবে বারান্দার দিকে তাকিয়ে রইল। আয়াত পর পর ক’টা দীর্ঘশ্বাস ফেলতে লাগল। সময় নিয়ে প্রহর বলল,
-“একটু বারান্দায় আয়।”
আয়াত তৎক্ষণাৎ বারান্দায় ছুটে গেল। অন্ধকারের মাঝেও তার চোখ গিয়ে আটকাল কিছুটা দূরে টঙের দোকানের সামনে বাইকে হেলান দিয়ে বসে সিগারেট ফুঁকতে থাকা এক অসম্ভব রকমের মন কেমনের কারণের দিকে।
বারান্দায় বঁধুবেশে তার প্রেয়সীর আগমন যেন বুকের ভেতর তীব্র ঘুর্ণিঝড়ের সৃষ্টি হলো। প্রহর ডাকল,
-“সাওদাহ্!”
কেঁপে উঠল আয়াত,
-“হুঁ…”
-“সুন্দর দেখাচ্ছে তোকে।”
আয়াত কিছু বলল না। সেভাবেই তাকিয়ে রইল। রুমু তখন এসে বলল,
-“আপু, তোমাকে ডাকতেছে সবাই। সময় হয়ে গেছে। চলো।”
আয়াত সেদিকে তাকাল না। তবে রুমুর কথার শব্দগুলো প্রহরের কানে এসে লেগেছে। সময় হয়ে গেছে? সবাই ডাকছে? আজ তার ব্যক্তিগত মানুষটা এতগুলো মানুষের মধ্যমণি হবে। সবাই দেখবে। সবাই প্রশংসা করবে। আর রাতে আরেকজন ছুঁয়ে দেবে। প্রকৃতির নিয়ম! কী সুন্দর!
প্রহর সিগারেটে সুখটান দিয়ে ধোঁয়া আকাশে ওড়াল, বড়ো শীতল আওয়াজে বলল,
-“চাঁদ আমার, তুমি অন্যের আকাশকে শোভিত কোরো।
ভালোবাসা আমার, তুমি ভালো থেকো।”
আয়াত ফট করে কল কেটে দিলো। প্রহর ফোন পকেটে ঢুকিয়ে ফেলে হাতের সিগারেট ফেলে দিলো। আরেকটি সিগারেট ধরিয়ে নিল এরপরই। পুরোটা সময় একবারের জন্যও দৃষ্টিটা বারান্দা থেকে সরায়নি। আয়াত সরে গেল। বারান্দার গ্লাস আটকে দিলো, এরপর পর্দা টাঙিয়ে ফেলল।
প্রহরের অনুমান শক্তিকে পুরোপুরি নির্ভুল বানিয়ে সে সাড়ে সাত বছরের ভালোবাসা ছেড়ে সম্পূর্ণ অপরিচিত এক মানুষকে স্বামী হিসেবে তিনবার কবুল করে নিল। এ-দিকে সে অন্য কারো জন্য সাজল, ও-দিকে প্রহর সিগারেটের দ্বিতীয় প্যাকেটটিও প্রায় খালি করে ফেলল।
হয়তো আয়াত যদি আজ একবার মোশাররফ সাহেবকে নিজের ভালোবাসার কথাটা বলত, গল্পটা সম্পূর্ণ ভিন্ন হতো। কিন্তু এতে কিছু সীমাবদ্ধতা ছিল। যা আয়াত ডিঙিয়ে যেতে পারেনি। যে বাবা তার সব ইচ্ছে-অনিচ্ছের প্রাধান্য দিয়েছে, তার চোখে জল সে দেখতে পারেনি। ছোটবেলায় যেই বাবা মাথা উঁচু করে বাঁচতে শিখিয়েছে, সেই বাবার মাথা নিচু হয়ে যাবে—এমনটা সে ভাবতে পারেনি। যেই বাবা সর্বদা তাকে নিজের চেয়ে ওপরে রেখেছে, তার চেয়ে বেশি সে নিজেকে ভালোবাসতে পারেনি। অতঃপর তার পঁচিশ বছরের ভালোবাসার কাছে সাড়ে সাত বছরের ভালোবাসা নত হলো।
এখানে দোষ তার শতাংশের। ভালোবাসাকে যদি আমৃত্যু ভালো থাকা হিসেবে নিশ্চিতই সে না করতে পারে, তবে কেন ভালোবেসেছিল? এই ভুলটার অনুশোচনা তার হওয়া উচিত। তাই শাস্তি হিসেবে বেছে নিল অন্যের সংসার। তারপর মনে মনে নিজের মনকেই সে চরম একটা অভিশাপ দিয়ে ফেলল, “মেহেরিন আয়াত সাওদাহ্, তুই পুরুষের মন ভেঙেছিস, তোর জীবনটা গুড়িয়ে যাক।”
ঠিক প্রহরের সামনে দিয়েই বউ সেজে সেই সাদা রঙের গাড়িটিতে করে আয়াত চলে গেল। সিগারেটের আরেকটি প্যাকেট পকেটে পুড়ে নিয়ে সে-ও শহরের অলি-গলিতে উদ্ভ্রান্তের মতো ছুটতে লাগল৷ আজ রাতে তার এত যত্নের নারীটিকে অন্য পুরুষ মলিন করে দেবে। প্রহর বাইকের স্পিড আরও বাড়িয়ে দিলো।
চলবে…