#শুক্লপক্ষের_পরিশেষে
#লেখনীতে_নবনীতা_শেখ
|৫৫|
সময়টা ফাল্গুনের শেষের দিকের। চারদিকে বসন্ত উদযাপন আপাতত কমে এলেও প্রেমবসন্তটা দারুণভাবেই উপভোগ করছে প্রেমীরা। কারো কারো প্রেম বছর ছাড়িয়েছে, কারো কারো শুরু হয়েছে সবে, আবার কেউ তো গতমাসের ১৪ তারিখে প্রপোজ করে এখন অবধি ঝুলে আছে। একদল আবার এদের মধ্যে আছে, তারা নিরপেক্ষ, তারা কোনো কিছুতেই অংশগ্রহণ করে না। এরা সাধারণত দর্শক সারীর। বাকিরা খেলা দেখায়, এরা খেলা দেখে টাইপের জনগণের মধ্যে অবস্থান নিয়ে রাখে।
মাসটাকে মানুষভেদে কতভাগেই না ভাগ করা গেল! তবে আরেকটা দল আছে, এদেরকে এসবের মধ্যে ধরা যায় না; এরা সবকিছুর বাইরে। এরা পেয়েছে, পেয়ে হারিয়েছে। সম্পর্কে যে নেই, তা নয়। ছেলেরা সিগারেটের সাথে সম্পর্কে জড়িয়েছে, মেয়েরা আপোষে এসেছে অন্য কারো সাথে। ব্যাপারটা কেমন একটা শোনাচ্ছে, তাই না? কেমন জটিল জটিল! আসলে ব্যাপারটা যেমন শোনাচ্ছে, তার চেয়েও সহস্রগুণ বেশি জটিল। সেসবে গিয়ে লাভ নেই। আপাতত ঘরের ছেলে রাত বারোটা পেরোনোর পরও ঘরে ফিরছে না, এই যেন মূখ্য বিষয়।
নাহারা কতবার যে কল দিয়েছেন নির্দিষ্ট নম্বরটিতে, তার ইয়ত্তা নেই; অথচ প্রতিবারই সেই একই নারীকণ্ঠে সংযোগ বিচ্ছিন্নতার খবর আসছে। নাহারা আয়াতকেও কল লাগিয়েছেন। আশ্চর্যজনকভাবে ওটাও বন্ধ। বন্ধু বলতে প্রহরের তেমন কেউই নেই, তাই কারো থেকে খোঁজ নিতে পারছেন না। সবশেষে হার মেনে এই মধ্য রাত্রিতে সে মেয়েকে কল লাগালেন।
প্রিয়র ঘুম পাতলা। সে উঠে মায়ের ফোন দেখে চিন্তিত হলো। একহাতে চোখ ডলে ফোন রিসিভ করল। বেডে হেলে বসল সে, বেশ দুশ্চিন্তা নিয়ে বলল,
-“কী হয়েছে, আম্মু? কোনো সমস্যা?”
নাহারা কেঁদে ফেললেন তৎক্ষনাৎ। প্রিয় ঘাবড়ে গেল। বিয়ের পর মেয়েদের এই রাতের সময়টায় বাপের বাড়ির ওদিক থেকে কল আসাটা এক ধরনের আতঙ্ক, বুক কাঁপেই। শক্ত কারণ ছাড়া তো আর কল আসে না! তার ওপর নাহারা এভাবে কাঁদছেন! প্রিয়র বুকের অবস্থা এখন কেমন, তা বলা দায়!
প্রিয়র কণ্ঠ কাঁপতে লাগল,
-“কী হয়েছে? কাঁদছ কেন, আম্মু? সব ঠিকঠাক? বলো!”
নাহারা ভেজা গলায় বললেন,
-“প্রহর বাড়ি ফেরেনি।”
-“ফেরেনি মানে? এজন্য কাঁদছ? কোথায় ও? কল দিয়েছিলে?”
-“ফোন বন্ধ।”
শরৎ উঠেছে ততক্ষণে। প্রিয়র মুখের অস্বাভাবিক অভিব্যক্তি দেখে শরৎও বিচলিত হলো। প্রিয় শরতের দিকে তাকিয়ে বলল,
-“প্রহরকে পাওয়া যাচ্ছে না।”
শরৎ কপাল কুঁচকে ফেলল,
-“পাওয়া যাচ্ছে না মানে? ও বাচ্চা ছেলে নাকি যে হারিয়ে যাবে?”
-“বুঝতে পারছি না কিছু।”
প্রিয় ফোন স্পিকারে রাখল। ওপাশ থেকে নাহারার আহাজারি শুনতে পেয়ে শরৎ বলল,
-“মা, আপনি কাঁদবেন না। আমি দেখছি।”
নাহারা কল কাটতেই শরৎ প্রিয়কে বলল,
-“আয়াতকে কল দাও।”
-“দিচ্ছি।”
আয়াতের দুটো সিমই বন্ধ পেল। প্রিয় শরতের দিকে তাকাল,
-“কিছু করুন না!”
শরৎ প্রিয়কে একহাতে জড়িয়ে নিয়ে বলল,
-“শান্ত হন, আমি দেখছি।”
ঠিক তিন মিনিট পর একটা আননোওন নম্বর থেকে প্রিয়র ফোনে কল এলো। প্রিয় রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে পুরুষালি গম্ভীর স্বর শুনতে পেল,
-“হ্যালো, আপু? শুনতে পাচ্ছিস?”
-“হ্যালো, হ্যালো, প্রহর?”
-“হ্যাঁ, আপু।”
প্রিয় শরৎকে কাছে ডাকল, ফোন স্পিকারে দিয়ে বলল,
-“তুই কই আছিস, ভাই? চিন্তায় মরে যাচ্ছি সবাই।”
প্রহর হেসে বলল,
-“খুব সমস্যায় ফেলে দিয়েছি না তোদের?”
-“মারব তোকে। তুই কই এখন এটা বল। দাঁড়া, আম্মুকেও কলে অ্যাড করি। আম্মু মরা কান্না কাঁদছে তোর জন্য।”
-“ঠিক আছে।”
নাহারা কলে জয়েন হতেই বলল,
-“হ্যালো? ওর খোঁজ পাইছিস?”
প্রিয় বলল,
-“হুঁ।”
-“কোথায় আছে?”
-“কলে অ্যাড আছে, কথা বলো।”
-“কলে আছে মানে? হ্যালো? প্রহর?”
-“হু আম্মু!”
-“বাপ, তুই কই?”
নাহারার বুকে যেন জান এলো সবে। বড়ো করে একটা শ্বাস ফেলে প্রহর বলল,
-“আমি কক্সবাজারে। একটা ট্যুরে এসেছি। মাঝরাস্তায় ফোন বন্ধ হয়ে গেছে বলে জানাতে পারিনি।”
নাহারা স্তম্ভিত হয়ে রইল কিয়ৎক্ষণ। পরপর চিল্লিয়ে উঠল,
-“এটা কোন ধরনের কাজ, প্রহর? বাড়িতে না জানিয়ে তুমি ঘুরতে গেছো? এদিকে তোমার বাবার চিন্তা করতে করতে শরীর খারাপ হয়ে গেছে! এত লা-পরোয়া তুমি কীভাবে হও? আমি ভাবতেই পারছি না।”
নাহারা উত্তেজিত হয়ে উঠেছে। প্রিয় তাকে সামলিয়ে বলল,
-“আম্মু, থামো। অনেক রাত হয়েছে, ঘুমাও তোমরা।”
-“তাই বলে ও এরকম যাচ্ছে তাই করে বেড়াবে? এই শিক্ষা দিয়েছি তোমাদের?”
প্রিয় শক্ত গলায় বলল,
-“মা! ঘুমাতে বলেছি। বাকি কথা কাল সকালে বলব।”
মেয়ের আওয়াজের এমন দৃঢ়তায় নাহারা নড়েচড়ে উঠলেন সামান্য। কিছু একটা হয়েছে বা হচ্ছে, তার আন্দাজটা করলেন তিনি। কল কেটে দিলেন। প্রিয় প্রহরকে তখন বলল,
-“কার ফোন এটা?”
-“জানি না, পাশের সিটে এক ভাইয়া ছিলেন, তার থেকে নিয়ে কল দিলাম।”
-“কবে ফিরবি?”
-“সপ্তাহ খানেক।”
-“ঠিক আছে, আমি তোর অ্যাকাউন্টে কিছু টাকা পাঠিয়ে দিচ্ছি।”
-“লাগবে না, আপু।”
-“লাগতে পারে।”
প্রহর আর কিছু বলল না। প্রিয় কোমল গলায় বলল,
-“কিছু একটা ঘটেছে, তার প্রমাণ তোর আওয়াজ ও কাণ্ডজ্ঞানহীনতা। সুন্দর একটা সময় কাটা। তোর বলার অপেক্ষায় থাকব।”
-“আপু, ভালোবাসি।”
-“আপু লাভস ইউ ঠু, ভাই। সাবধানে থাকিস।”
কল কেটে দিলো প্রিয়। শরৎ বলল,
-“আপনি কী ভাবছেন?”
-“কিছু ভাবতে চাইছি না আমি। ভাবাভাবির কাজটা অনেক কঠিন। আপাতত যা হচ্ছে, তা হবেই, হতে থাকুক।”
-“আচ্ছা।”
-“নীরজ?”
-“হুম?”
-“কাল অফিস আছে, আমার মাথায় একটু হাত বুলিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিন। ঘুম প্রয়োজন আমার।”
প্রিয় শুয়ে পড়ল চোখ বুঁজে। শরতের হাতের আঙ্গুলগুলো গোছালোভাবে তার চুলের গোড়ায় ছুঁয়ে যাচ্ছে। কিছুক্ষণের মধ্যে প্রিয় ঘুমিয়ে গেল। শরৎ তাকিয়ে রইল এই ক্লান্ত মুখখানিতে। তার মাঝে মাঝে খুব ইচ্ছে করে, মেয়েটাকে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী ফুল বানাতে। অথচ সে পারে না। এতটা ব্যর্থ লাগে নিজেকে, সে নিশ্চুপ হয়ে যায়৷ এই যে এই মেয়েটা! সে কি এত যন্ত্রণা পাওয়ার যোগ্য? পৃথিবীর কি মায়া হয় না?
আচ্ছা, যে ফুলের অকালপ্রয়াত ঘটল, সে ফুল কি নিজেকে আরেকটি সুযোগ দিতে পারে না? আরেকবার, অন্য গাছের ফুল হয়ে জন্মাতে পারে না? যদিও বা জন্মায়, তবে সে জনমে কেন পূর্বজনমের স্মৃতি থাকবে? সে ফুলে কেন অন্য গাছের ব্যথা থাকবে?
শরৎ ঝুঁকে গেল সামান্য। ঘুমন্ত প্রিয়র কপালে শুষ্ক চুমু খেয়ে মনে মনে শুধাল,
-“আপনি কি জানেন, আপনি কারো শখের ফুল?”
______
পৃথিবীতে সুখ ও দুঃখ যেন একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ ব্যাপার। যে সুখ পাচ্ছে, একাধারে সে দুঃখও পাচ্ছে। কোনোটাই স্থায়ী নয় অবশ্য। একটাকে বেছে নেওয়ার সুযোগও নেই। নিলে দুটোকেই নিতে হয়, আর দুটোই উপভোগ করতে হয়। আমরা প্রায়শই বলে থাকি, “গল্পটা ভিন্ন হলেও হতো!”
ব্যাপারটা কি আদতেই তাই? ভিন্ন হলে কেমন হতো? একটা সুখের গল্পের শুরু থেকে শেষ অবধি কেবল সুখ তো থাকে না, কিংবা একটা দুঃখের গল্পেও আদ্যোপান্ত কেবল দুঃখ থাকে না। নমুনায় এলে দেখানো যায় শরৎ-প্রিয়, শ্রেয়ান তুশিকে। তাদের গল্পটা এখন সুখের, শুরুতে কি এমন ছিল?
আর আয়াত-প্রহর? ওদেরটা?
ওদিকে আছে নীহিনের গল্প! বেচারির মনে দুঃখ নেই। সে জীবনের আসল মানেটা খুব ভালোভাবেই জানে। সে অতিসুখে আত্মহারা হয় না, দুঃখে মূর্ছাও যায় না। সে তাল মিলিয়ে চলে। সুখে সুখবিলাস, দুঃখে দুঃখবিলাস! এজন্য জীবন তাকে খুব একটা নড়বড়ে করে উঠতে পারে না। এক্ষেত্রে পাষণ্ড জীবন এসে হাঁপিয়ে যায়, জিতে যাওয়ার খুশিতে প্রাণখোলা হাসিতে মেতে ওঠে সুন্দর মেয়ে নীহিন। জীবন উপভোগ করতে তো সে-ই জানে, যে চাওয়া-পাওয়ার হিসেবে না বসে প্রতিটি মুহূর্তকে রঙিন বানাতে সক্ষম। নীহিনকে এক্ষেত্রে সেরা বলতে দ্বিধা করা উচিত নয়।
শরৎ-প্রিয়র জীবনটা বেশ চলছে, ওদিকে শ্রেয়ানের দায়িত্বপূর্ণ আচরণ তুশির মনকে আপ্লুত করছে প্রতিটি ক্ষণে। তুশি আগে যতখানি চাপা স্বভাবের ছিল, এখন যেন তার বেশ বিপরীতে এসেছে। এই তো, গত পরশু হুট করেই দুলতে দুলতে শ্রেয়ানের কাছে এসে বলল,
-“শোনেন না! আম্মু বাড়িতে বেড়াতে আসতে বলছিল খুব। চলেন, সামনের সপ্তাহে ঘুরে আসি ঢাকা থেকে।”
কতটা জোর দিয়ে বলল, ‘চলেন, ঘুরে আসি’! কথাটা শুনে শ্রেয়ান হেসে দু-দিকে মাথা নাড়ে তখন। তারপর থেকে এখন অবধি বিভিন্ন গোছগাছ করছে তুশি। এই তো, রাতে শ্রেয়ান অফিস থেকে ফিরলেই ওরা বেরোবে।
____
এখন সন্ধ্যে নামার সময়। সূর্যটা সাগরের ওপর ফেলে পড়েছে, প্রতিবিম্বটা জলের সাথে মিশে ক্ষণে ক্ষণে কাঁপছে। সূর্যের হলদেটে আলো এখন রক্তিমাভায় পরিণত হয়েছে। চারপাশে কী মুগ্ধতা! প্রহর বুকে হাত গুঁজে বালির ওপর দাঁড়িয়ে একদৃষ্টে ঢেউ দেখে যাচ্ছে। এমন তরঙ্গোচ্ছ্বাস তো তার বুকে থাকার কথা! অথচ বুকের ভেতরটা কী অদ্ভুত শান্ত! কেমন যেন খালি খালি। কিছুই নেই টাইপের অনুভূতি প্রহরকে চুপ করিয়ে রাখছে।
যেভাবে আস্তে-ধীরে গোধূলিটা নীলচে সন্ধ্যেতে মিশে গেল, ঠিক সেভাবেই নীলাভ আকাশটায় রাত নেমে এলো। প্রহর যেমনি ছিল, তেমনিটাই দাঁড়িয়ে ঠান্ডা বাতাস উপভোগ করতে লাগল। হোটেলে ফিরবে ঢের রাতে। আপাতত এছাড়া আর কী-ই বা কাজ?
দেখতে দেখতে চোখ ক্লান্ত হয়ে এলে সে দু-চোখের পাতা বন্ধ করে ফেলল। মস্তিষ্ক কথার বাণ ছুঁড়তে লাগল,
-“অপ্রিয়, বিয়ের দু-দিন পেরোল তো!”
অদৃশ্য কোনো মানবী জল হয়ে তার পা ছুঁয়ে গেল, অশ্রবণীয় আওয়াজে ফিসফিসিয়ে বলল,
-“পেরোল তো!”
প্রহর আনমনে হাসল,
-“সাত বছরের প্রেম কি বিয়ের দু-দিনে ভুলতে পেরেছ?”
-“পেরেছি।”
-“নিজস্বতা আমার, তুমি ভালো আছো?”
এ প্রশ্নের জবাব এলো না। প্রহরের হাসি ছড়িয়ে পড়ল অধর জুড়ে,
-“সরি সরি, নিজস্বতা ডাকটা পছন্দ হলো না, তাই তো? বেশ! তোমায় আমি তবে ডাকব বিরহিণী।”
প্রহর থামল। চোখ খুলল নরমভাবে। সোজা দৃষ্টি স্থির রাখল সমুদ্রজলে। সে জল বিরহ সেজে ছুঁয়ে যাচ্ছে তাকে, দহন ঘটছে দেহে! প্রহরের অন্তরটা যেন জানাচ্ছে,
-“ওহে বিরহিণী, তোমার বিরহে পুড়ে হলাম ছাঁই।”
প্রহর আবার শুধাল,
-“এবার বলো, ভালো আছো তো?”
ওপাশ থেকে নিশ্চুপ আওয়াজেরা জলতরঙ্গের সাথে তার পা ছুঁয়ে বলতে লাগল,
-“ভালো থাকা? তুমি ছাড়া অসম্ভব!”
চলবে…
#শুক্লপক্ষের_পরিশেষে
#লেখনীতে_নবনীতা_শেখ
|৫৬|
নীহিন ঢাকায় বেড়াতে এসেছে আজ বিকেলে, সাথে আরহা আর নিশানও এসেছে। বিকেলটা আড্ডায় জমে-টমে গেলেও, রাতে শোয়া নিয়ে বাঁধল বিরাট ঝামেলা। দুটো বেডরুমের একটায় মেয়েরা থাকবে, অন্যটায় ছেলেরা। এই সিদ্ধান্তে সবাই রাজি হলেও দ্বিমত পোষণ করল শরৎ।
তার সোজা কথা, বউ ছাড়া সে ঘুমাবে না। যে ঘরে বউ নেই, সে ঘর আবার কেমন ঘর? এর চেয়ে বরং সে ওয়াশরুমে রাত্রিযাপন করবে৷ আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, বাকি সদস্যরা শরতের এমন আক্ষেপ করে বলা “ওয়াশরুমে রাত্রিযাপন” বিষয়টাও মেনে নিল হাসিমুখে! বয়সের ভারে শরৎ পারে না গড়াগড়ি খেয়ে কেঁদে কেঁদে বলতে, “আমার বউ লাগবে, বউ না দিলে উঠব না।”
রাতে এত এত চিন্তার মাঝে শরতের মুখটা একদম রস চিপে আলাদা করা তালের মতো চুপসে ছিল। তাদের বেডরুমে থাকবে নীহিন, আরহা আর প্রিয়। আর অন্য রুমটায় নিশান ও শরৎ। শরৎ অসহায় মুখে একবার প্রিয়, অন্যবার নিজেদের বেডরুম দেখে পালাক্রমে শ্বাস ফেলছিল।
রাতের দিকে বসার ঘরে সবাই বসে মুভি দেখতে লাগল। শরতের মুখটা সেই শুরু থেকেই গম্ভীর। সে না হাসছে, না কথা বলছে। ব্যাপারটা ধরতে পেরে নিশান ঠোঁট টিপে হেসে যাচ্ছে। তার খুব ইচ্ছে করছে বড়ো ভাইয়ের কাঁধে হাত রেখে বলতে,
-“চিন্তা করবেন না, বড়ো ভাই। আমার বিশ্বাস আপনি আপনার বউকে অতিশয় শীঘ্রই কাছে পাবেন।”
ব্যাপারটা কেমন যেন রসিকতার পর্যায়ে এসে পড়েছে। প্রিয় ফিক করে হেসে ফেলল। শরৎ রেগে-মেগে ওর দিকে চোখ কটমট করে তাকাতেই প্রিয় শব্দ করে হেসে উঠল। গা বাঁচানোর তাগিদে শোবার রুম গোছানোর বাহানায় প্রস্থান ঘটাল, যেন ওই নজর থেকে সরতে পারলেই আপাতত সে বাঁচে।
রুমে এসে হাঁফ ছেড়ে বসে পড়ল। পর পর বুকে হাত রেখে খিলখিল করে হাসতে লাগল। জীবন তাকে কী সুন্দর সুন্দর মুহূর্ত দিচ্ছে! এক পৃথিবী সমান ভালোবাসা হারানোর পর জীবন তাকে গোটা মহাবিশ্ব সমান ভালোবাসা দিয়েছে। কী সৌভাগ্য তার! চারদিকে শান্তি, শান্তি ও কেবল শান্তি!
এর মাঝে কল এলো প্রিয়র ফোনে। ভিডিয়ো কল। প্রিয় মিহি হেসে কল রিসিভ করে সামনে ধরল। ওপাশ থেকে প্রহর বলল,
-“কী করিস, আপু?”
-“কিছু করছি না। তুই? কেমন ঘুরছিস?”
-“ভালো, মাত্র হোটেলে ফিরলাম। ভাইয়া কই?”
-“তোর ভাইয়া ড্রয়িং রুমে বসে আছে। বাড়ি থেকে নীহিনেরা এসছে না! ওদের সাথেই।”
-“ও আচ্ছা।”
-“হ্যাঁ।”
তারপর দুইজনেই চুপ। প্রহর কথা খুঁজে পাচ্ছে না, প্রিয়ও কিছু বলতে পারছে না। প্রিয় সরাসরি জিজ্ঞেস করতে চাইছে না। প্রহর নিজ থেকে কীভাবে বলবে তা বুঝে উঠছে না। অবশেষে প্রহর অনেক ভেবে বলল,
-“আচ্ছা আপু, প্রকৃতির চমক এত বিশ্রী হয় কেন?”
প্রিয় হেসে বলল,
-“কারণ প্রকৃতি অকস্মাৎ চমকে দিতে ভালোবাসে। এখন সে ঠিক সময়ে ঠিক চমক দিলে আমরা খুশি হই, ওদিকে ভুল কিছু হয়ে গেলেই বিশ্রী ঠেকে যায় ব্যাপারটা।”
-“তোর কাছে সব প্রশ্নের উত্তর আছে, তাই না আপু?”
-“সব প্রশ্নের উত্তর নেই, তবে তোর প্রশ্নের উত্তর থাকলেও থাকতে পারে। জিজ্ঞেস করতে থাক, দেখি আছে কি না।”
প্রহর হেসে মাথার পেছনের চুলগুলো চুলকে নিয়ে বলল,
-“আমি কি ধরে রাখতে জানি না?”
প্রিয়র চোখে অবসন্নতা লেপটে গেল,
-“তোকে আমি ধরে রাখা শেখাইনি, বাবু। ছোট থেকে সবকিছু আমিই করে এসেছি। তোকে কেউ বকলে আমি মেরে এসেছি, তোকে কেউ কষ্ট দিলে আমি তাকে এর ফলাফল দেখিয়ে এসেছি, তোর কিছু করা লাগেনি। তুই এজন্য ছোট থেকেই আমার ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছিলি। বন্ধুবান্ধব ছিল না তোর। আর আমি তো ছিলাম, আছি, থাকব! আমাকে ধরে রাখার মতো কোনো প্রয়োজন তোর ছিল না। তাই শিখিসনি। এখানে তোর দোষ কী করে দিই?”
প্রহর আবারও জিজ্ঞেস করল,
-“আমি তাকে দোষ দিতে পারছি না কেন?”
-“কারণ তোর নিজের এখানে অধিক দোষ।”
-“আমার?”
-“হুঁ।”
-“কী দোষ?”
-“আমি কী করে জানব? তুই ভাব!”
প্রহর ভাবতে বসল। এখানে অবশ্যই তার বেশি দোষ। সে আগে থেকেই টের পাচ্ছিল। সে তো পারতোই আয়াতকে রেখে দিতে। কিংবা সে বিকেলে যখন তারা রমনায় ছিল, চাইলেই তো ফিরে না যেতে দিয়ে আটকে রাখতে পারতো! সে কি পারতো না? তবে কেন তা না করে আয়াত কী করে না করে, তার ভরসায় বসে রইল? ভুলকাজ!
প্রহর সরাসরি বলল,
-“আপু, সাওদাহ্র বিয়ে হয়ে গেছে।”
বুকের ভেতরটায় কাঁপন ধরে গেল প্রিয়র। দৃঢ় চোখের পাতা কিয়ৎক্ষণের জন্য বুঁজে এলো। পর পর খুলে গেল৷ এবার সে শান্ত। বুকের ভেতর চলতে লাগা অশান্ত ঝড়ের বহিঃপ্রকাশ বাইরে দিয়ে দেখা গেল না। তবে চোখ দুটো লাল হয়ে এলো। অসম্ভব শান্ত চোখ দুটো রক্তাভ। স্বাভাবিকভাবেই শুধাল,
-“কবে?”
-“যেদিন এলাম, ওদিন।”
-“তোকে বলে করেছে?”
-“বিয়ের মিনিট দশেক আগে জানিয়েছিল।”
-“ডিড শি চিট অন ইউ?”
প্রহর হো হো করে হেসে বলল,
-“না। বেসিক্যালি আই ডিড।”
-“কীভাবে?”
পুরো ঘটনাটা কয়েক শব্দে বর্ণনা করল প্রহর। প্রিয়র হতাশামিশ্রিত শ্বাস ধরা ছুঁতে লাগল। তারপর বলল,
-“তুই কি কখনও আয়াতকে ভালোবেসেছিলি?”
-“ভালোবেসেছিলাম কি না জানি না, তবে নিজস্বতা ভেবেছিলাম। নিজের কাছে রাখতে চেয়েছিলাম।”
-“আর নিজের কাছে রাখার জন্য কতটুকু কী করেছিলি?”
-“নাত্থিং!”
হো হো করে হেসে উঠল প্রহর। প্রিয় আবারও বলল,
-“একটা মানুষ পাগলের মতো ভালোবেসে গেলে বিনিময়ে আমরা তাকে একটুখানি সান্ত্বনামূলক ভালোবাসা দেখাই। আয়াত তোর থেকে এতটুকুও ভালোবাসা দেখেনি। তুই অস্বীকার করবি?”
-“এত সত্য কথা অস্বীকার করে পারা যায়?”
-“না, যায় না। তুইও অস্বীকার করবি না।”
-“ঠিক আছে।”
-“মেয়েটা তোকে ভালোবেসেছিল, খুব ভালোবেসেছিল। বুঝতে পারছিস ব্যাপারটা?”
-“পারছি। আর তা আমার বুকটার ওপর সহস্র ধারালো সুচ হয়ে বিঁধছে।”
-“আর কয়টা দিন পরে লক্ষ-কোটি সুচ বেশি বিঁধবে তোর বুকে। কেননা তুই তাকে তার চেয়েও বেশি ভালোবেসেছিস কিন্তু বিন্দু সমান প্রকাশ করিসনি।”
আরেকটা তীক্ষ্ণ সত্য! প্রহর তা জানে, জানে বলেই কষ্ট কম পাচ্ছে। এই যন্ত্রণাটার প্রাপ্য সে। একপাক্ষিক মেয়েটা কষ্ট পাবে, তা কেন হয়? প্রহর তাকাল প্রিয়র ক্লান্ত চোখে। তার হাসিটায় কতখানি বিষাদ মিশে আছে, তা কেন প্রিয় ধরতে পারছে?
প্রিয়র পূর্বের কথার জবাবে প্রহর বলল,
-“তাই হোক আমার সাথে।”
-“তুই কষ্ট পাচ্ছিস খুব?”
-“পাচ্ছি, তবে খুব না, অল্প।”
-“অল্প কেন?”
-“নিজ দোষে মুখ থুবড়ে পড়ার পর কাঁদার অবকাশ থাকে না।”
-“তবে মন পুড়ছে?”
-“পুড়ছে তো।”
-“ভাই আমার, তোর কষ্ট আমার সহ্য হচ্ছে না। ইচ্ছে করছে ওর বরকে মেরে ওকে নিয়ে আসি।”
প্রিয়র ছেলেমানুষী কথায় প্রহর হাসবে কি না বুঝতে পারছে না। এদিক-ওদিক চেয়ে বলল,
-“আপু, মানুষ সব পায় না তো। তাই না?”
-“হ্যাঁ, তাই।”
-“এজন্যই অনুপম গেয়েছিলেন, সব পেলে নষ্ট জীবন।”
-“হুম।”
-“অপ্রাপ্তি সুন্দর। আমাদের অনেক সুন্দর স্মৃতি ছিল। বেঁচে থাকার জন্য যথেষ্ট না?”
প্রিয় শান্ত চোখে তাকিয়ে রইল। জীবনের সিদ্ধান্ত মেনে নিতে পারলে জীবন কী সুন্দর! নয়তো এর চেয়ে বিশ্রী দ্বিতীয়টি নেই। সে মেনে নিতে পারেনি বলেই জীবনের বেশ বড়ো একটা সময় জীবন্মৃত ছিল। অথচ প্রহর!
প্রিয় বিরবির করল,
-“ভাই আমার, তোর পৃথিবীটা সুন্দর হোক।”
নীহিন এলো রুমে, প্রিয়র দিকে এগিয়ে গিয়ে একহাত জড়িয়ে ধরে বলল,
-“ভাবি, ভাই ডাকছে। চলো চলো।”
-“ডাকছে?”
-“হ্যাঁ।”
-“আচ্ছা, যাচ্ছি।”
প্রহর নীহিনকে দেখে মুচকি হেসে বলল,
-“হাই নীহিন, কী খবর?”
প্রিয় নীহিনের হাতে ফোন ধরিয়ে বলল,
-“কথা বলো!”
এরপর চলে গেল। নীহিন কী বলবে ভেবে পাচ্ছে না। ইতস্তত করতে করতে বলল,
-“আলহামদুলিল্লাহ ভালো। প্রহর ভাই, আপনি কেমন আছেন?”
-“ভালো আছি।”
-“দিনকাল ভালো যায়, প্রহর ভাই?”
-“হ্যাঁ, যাচ্ছে। তোমার ব্যাপার বলো?”
-“এই তো!”
-“পড়াশোনা কেমন চলছে?”
-“জি ভালো।”
-“এক্সাম কেমন দিলে?”
-“বেশ ভালো।”
-“অ্যাডমিশনের প্রিপারেশন?”
-“নিচ্ছি, প্রহর ভাই।”
এরপর আর কেউ কথা বলল না। প্রহর চুপিচুপি বারান্দার ধারে চলে এলো। এখান থেকে সমুদ্রটা বেশ দারুণভাবে দেখা যাচ্ছে। প্রহর ব্যাক ক্যামেরা ওপেন করে বলল,
-“নীহিন, আজ কিছু কথা বলব তোমায়, মন দিয়ে শোনো।”
-“হ্যাঁ, বলুন না, প্রহর ভাই!”
-“তুমি ভীষণ বুঝদার একজন মেয়ে। তোমার থেকে শেখার অনেক বিষয় আছে। আজ যেটা বলব, সেটা তুমি জানো। তবে আমার বলে স্বস্তি লাগবে বলে বলছি।”
প্রহর থামল, তারপর আবার ডাকল,
-“নীহিন, শুনছ?”
-“বলুন, শুনছি।”
-“ওই যে, সমুদ্রের জল দেখতে পাচ্ছ?”
-“পাচ্ছি।”
-“ওটা জীবন।”
-“আচ্ছা।”
-“আর ঢেউগুলো হচ্ছে কষ্ট।”
-“আচ্ছা।”
-“তীরটা হচ্ছে তোমার বুক। ঠিক আছে?”
-“ঠিক আছে।”
-“দেখতে পাচ্ছ? কষ্ট বার বার তোমার বুকে আছড়ে পড়ছে, আবার ফিরে যাচ্ছে। আবারও আসছে, আবারও যাচ্ছে। একটা চক্রের মতো চলছে।”
-“আর সুখ?”
-“সেটা স্বয়ং তোমার কাছেই আছে। দুঃখ এলে সাময়িকভাবে তা ভুলে যাবে। তারপর আবারও সুখ পাবে। কেবল হতাশ হবে না। জীবন সুন্দর।”
-“ঠিক আছে, প্রহর ভাই। মনে রাখব।”
প্রহর হাসল,
-“মনে রাখার বিষয় এটা না। এটা বোঝার বিষয়। বুঝতে পেরেছ?”
-“পেরেছি, প্রহর ভাই।”
-“শোনো। জীবন চক্রের মতো। চন্দ্রচক্রের মতো ধরো। শুক্লপক্ষ, কৃষ্ণপক্ষ বোঝো?”
-“আপনার থেকে বুঝতে ভালো লাগছে, প্রহর ভাই। আপনি বুঝিয়ে দিন।”
-“ঠিক আছে। শুক্লপক্ষ ও কৃষ্ণপক্ষ হচ্ছে চাঁদের পূর্ণিমা ও অমাবস্যার সময়কাল। পূর্ণচাঁদ আস্তে-ধীরে অমাবস্যায় রূপ নেয়, এই সময়কাল হলো কৃষ্ণপক্ষ। আবার অমাবস্যা পনেরো তিথি পর পরিপূর্ণ চাঁদের আকৃতি ধারণ করে, এটা শুক্লপক্ষ। কৃষ্ণপক্ষের প্রথম রাতটা ভরা চন্দ্রিমার, শেষে আঁধার। শুক্লপক্ষের শুরুতে আঁধারিয়া, শেষে পূর্ণচাঁদ। নীহিন, তুমি বলো। এই চক্রের হিসেবে তুমি সুখ-দুঃখকে কীভাবে মাপবে?”
নীহিন ভেবে বলল,
-“সুখ-দুঃখ চক্রাকারে আসতেই থাকবে। কখনও চলবে কৃষ্ণপক্ষ, কখনও শুক্লপক্ষ। কৃষ্ণপক্ষে চন্দ্রক্ষয় হবেই, চাঁদ ধীরে ধীরে বিলুপ্ত হতে লাগবে। শেষে গিয়ে বিলীন হয়ে যাবে। অমানিশা আসবে। এখানে হতাশার কিছু নেই। অপেক্ষায় থাকতে হবে শুক্লপক্ষের, শুক্লপক্ষের পরিশেষের। পরিশেষে পূর্ণচাঁদ। পরিশেষে সুখ।”
প্রহর হেসে বলল,
-“তোমার জীবনেও কেউ সুখ নামাতে আসুক।”
নীহিন প্রশস্ত হেসে বলল,
-“আমি অপেক্ষায় আছি সেই মানুষটার, প্রহর ভাই। সে শীঘ্রই আসুক।”
চলবে…