শুচিস্মিতা পর্ব-১৪+১৫

0
253

#শুচিস্মিতা -১৪
Tahrim Muntahana

~ কেমন আছো তোমরা? আসতে কোন অসুবিধা হয় নি তো?

ফারাহ’র মেজ ভাসুরের কথায় আনতারা কেয়া মাথা নাড়িয়ে জানান দিলো কোনো অসুবিধা হয়নি। আনতারা বললো,

~ আমরা ভালো আছি ভাইয়া, আপনি ভালো আছেন?

কেয়ার হাতে থাকা ব্যাগ টা নিজের হাতে তুলে নিয়ে মুচকি হেসে নিরব বললো,

~ আমিও ভালো আছি। চলো, আর একটু যেতে হবে!

হাঁটতে থাকে তিনজন। সকাল সকাল বোনের বাড়িতে যাওয়ার উদ্দেশ্যে বেরিয়েছে আনতারা। সময় নেই, কাল‌ই সম্ভবত ঢাকার উদ্দেশ্য র‌ওনা হবে। ফারাহ কে ফোন করায় নিরব কে পাঠিয়ে দিয়েছে পাড়ার মোড় থেকে আনতারা দের নিয়ে আসতে। কিছুটা পথ হাঁটার পর‌ই চোখে পড়লো আহমেদ বাড়ি। পায়ের গতি বাড়িয়ে দিল দুজন। দরজায় ফারাহ কে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে দুজন‌ই এক প্রকার ঝাঁপিয়ে পড়লো। বাহারি আলাপে কেটে গেল কয়েক মুহূর্ত।‌ ফারাহ দুজন কে নিয়ে চললো শাশুড়ির ঘরে‌। না নিয়ে গেলে আবার কথা শোনাবে। মিসেস নাজমা আধ শোয়া হয়ে বসে আছেন। আনতারা কে দেখেই যেন তার মেজাজ চটকে গেল। এই মেয়ের জন্য‌ই তো তাকে অপমানিত হতে হয়েছে। আনতারা নিম্ন স্বরে সালাম দিয়ে বললো,

~ কেমন আছেন খালা?

~ আছি ভালায়, শুনলাম ঢাকা যাইতেছো, তা মাইয়া ভালা ক‌ইরা থাইকো, আকাম টাকাম ঘটাইয়ো না আবার।

শাশুড়ির কথায় ফারাহ’র দৃষ্টি তীক্ষ্ম হয়ে এলো। আনতারা’র তেমন ভাবাবেগ হলো না, সে জানতোই এসব কথা তাকে শুনতে হবে। মুচকি হেসে বললো,

~ কি যে বলেন না খালা, আমার মতো অন্ধকার দের আকাম ঘটানোর সুযোগ আছে? ঘটানোর‌ আগেই তো আপনাদের মুখ ভেসে উঠবে, এত বড় সাহস আমার নেই গো!

~ গুমোরের কথা আর গেল না, আমার পোলার বিয়া ঠিক করতাছি, চ‌ইলা আইসো, রূপসী মাইয়া দেখছি। কপাল ভালা হ‌ইতো রাজী হ‌ইলে! শুনলা না তো।

~ সমস্যা নেই খালা, আমার জন্য‌ও হয়তো কেউ অপেক্ষা করছে। যাই হোক সবার আগে দাওয়াত টা আমাকেই দিয়েন, কবজি ডুবিয়ে খেয়ে যাবো। চিন্তা করবেন না রূপসীর জন্য সুন্দর দেখে গিফট‌ও আনবো।

মিসেস নাজমা’র মুখ গোমড়া হয়ে এলো‌। চেয়েছিল অপমানের জ্বালা একটু হলে শোধ করবে, এই মেয়ের গোমরের কথায় আর পারলেন না। ফারাহ এবার হাসছে মুচকি মুচকি। আনতারা চুপ থাকলে সে নিজেই আজ রাতে উচিত কথা শুনিয়ে দিতো। মিসেস নাজমার থেকে বিদায় নিয়ে আনতারা”রা ড্রয়িং রুমে এসে বসলো। পারভীন আর রিনু রান্না করছে। আনতারা কে দেখেই রান্না ঘর থেকে বেরিয়ে এলো রিনু, ফারাহ আর একা ছাড়লো না ওদের‌। রিনু বললো,

~ কবে যাইতেছো ঢাকা?

~ কাল কে র‌ওনা হবো ভাবী!

কেয়ার কথায় রিনু মুখ বেঁকালো। কৃষ্ণবর্ণের মেয়েটাকে তার একদম পছন্দ নয়। তার মতে এই মেয়ের ঝামেলা থেকেই তাকে এত এত কাজ করতে হচ্ছে, আনতারা’ই দোষী! ফারাহ বললো,

~ এখানে বসবি নাকি ঘরে যাবি?

~ এখানেই বসি আপায়।

~ আচ্ছা তোরা বস আমি দেখি ওদিকটায় কতদূর হলো।‌

ফারাহ চলে গেল রান্নাঘরে। রিনু বুঝি এই সুযোগ পেল। রসিয়ে বললো,

~ নিবিড়ের জন্য সুন্দরী মেয়ে দেখছি, কয়েকদিন পরেই বিয়া, সুযোগ আছিল, হেলায় হারাইলা। এমন গাঁয়ের রং নিয়া এত ভালা পোলা পাইতা? এই জন্যেই বলে মাইয়া মানুষের এত গুমোর ভালো না। তাও যদি গাঁয়ের রং টা একটু ফকফকা থাকতো।

এবার রাগ হলো আনতারা’র। মনে হচ্ছে এখানে এসেই ভুল করলো। এসব সে শুনতে চেয়েছে? কেয়া কিছু বলতে নিলেই চোখ দিয়ে ইশারা করে নিষেধ করলো আনতারা। থেমে গিয়ে রাগে ফুসতে লাগলো সে। আনতারা মুচকি হেসে বললো,

~ জাতের মেয়ে কালো ভালো!

এই একটা কথাই হয়তো রিনুকে চুপ করিয়ে দিতে সক্ষম! চুপ হয়ে গেল সে, উঠে নিজের ঘরে চলে গেল। আপায়ের উত্তরে বেশ খুশি কেয়া। কিছু কিছু মানুষ কে অল্পতেই অনেককিছু বলা যায়। বোনের সাথে প্রায় ঘন্টা তিনেক থেকে বাড়ির পথে র‌ওনা হলো আনতারা। আসার সময় কেমন শক্ত করে জড়িয়ে ধরেছিল ফারাহ। আবার কতদিন পর দেখবে মেয়েটাকে, আনতারা যাওয়ার দিকের দৃষ্টি ছলছল করে উঠে ফারাহ! এত বড় শহরে বোন কে ছাড়তে ইচ্ছে করে না, না আছে আপনজন, না আছে পরিচিত কেউ! ভয় হয় ফারাহ’র তবে সে তো নিজস্ব ভয়ের জন্য বোনের স্বপ্নে বাঁধা দিতে পারে না, এমনিই না বুঝে শুনে ইতিমধ্যে তার দ্বারা ভুল হয়ে গেছে। বোনের যাওয়ার দিক তাকিয়ে ফারাহ বিড়বিড় করে বলে উঠলো,

~ রানীর মতো ফিরবি তারা! সারা গ্রাম যেন বলে ওই দেখ তালুকদার বাড়ির গর্ব যাচ্ছে!

গোধূলি বিকেলের শুরু। গ্রামের বাজারের কাছাকাছি আসতেই আনতারা’র চোখে পড়ে ছোট চাচা কে। আমির তালুকদার মূলত দুজনের জন্য‌ই অপেক্ষা করছিলো। দুজন কে দেখে এগিয়ে যায় সে‌। সরাসরি বলে উঠে,

~ শীত তো সামনে, লেপ নিতে হবে না? আমি তোশকের ফরমায়েশ দিয়ে গিয়েছিলাম আম্মা, কিন্তু লেপের টা মনে ছিল না। তবে এখন বললে রাতের মধ্যে করে দিবে!

~ লেপ লাগবে না ছোট চাচা। ঢাকায় গিয়ে ফাতিন ভাইয়ের সাথে গিয়ে দুটো বড় বড় কম্বল কিনবো।

আমির তালুকদার মাথা নেড়ে সায় জানায়। ধুনকারেরা দল বেঁধে লেপ, তোষক, জাজিম ইত্যাদি শীত নিবারণী সামগ্রী বানাতে ব্যস্ত। মৌসুম ভিত্তিক সকল পণ্যের দাম বেড়ে যায় বলেই চাষীরা প্রয়োজন মতো মাস খানিক আগেই বানাতে দিয়ে যায়। আমির তালুকদার তোশক নিতে চললেন আনতারা’দের নিয়ে, প্রয়োজন মতো আরো কিছু সামগ্রী কিনে দিলেন, শহরে হয়তো দাম একটু বেশীই পড়বে। গাড়ি যেহেতু যাচ্ছেই, এখান থেকে নিয়ে গেলেই সুবিধা।‌ আনতারা ব্যাগ হাতড়ে একটা লিস্ট বের করলো, আমির তালুকদারের হাতে তুলে দিয়ে বললো,

~ শহরে দাম বেশি পড়বে ছোট চাচা, এগুলো গ্রাম থেকেই নিয়ে যাই? তুমি কিনে নিয়ে এসো, আমরা যাই, বড়চাচি নাকি আরো কি কি সাথে দিবে!

আমির তালুকদার আনতারা’র কথা মতোই বড় বাজারের দিকে র‌ওনা হয়। আনতারা’রা আবার অটোতে উঠে বসে। জাঁকজমক একটা ভাব চলে এসেছে যেন। আসবেই বা না কেন, বাড়ির দু মেয়ে অচেনা শহরে যাচ্ছে, বড়রাই তো‌ সুবিধা দেখবে!

পরদিন সকাল! ভোরে আলো ফুটতে না ফুটতেই গাড়ি এসে হাজির। আজ শেষ বারের মতো আর গ্রামীণ প্রকৃতিতে গা ভাসানো হলো না আনতারা’র। কাল গভীর রাত পর্যন্ত জিনিসপত্র গোছানোয় ব্যস্ত ছিল বলে সকালে উঠতে দেরী হয়েছে। গাড়ি আসতেই মিসেস কামরুন্নাহার দুজন কে তাড়া দিলেন রেডি হতে। তিনি আর‌ও ঘন্টা দুয়েক আগে উঠেছেন। বেশ কিছু খাবার সাথে দিয়েছেন। কিছুসময় অতিবাহিত হতেই প্রতিবেশী রা একত্র হলো তালুকদার বাড়ির গেইটের সামনে, বিদায় দিতে এসেছে আরকি। আমির তালুকদার গাড়িওয়ালার সাথে মালামাল গুলো গাড়িতে তুলছেন, বলাবাহুল্য সেও যাচ্ছে আনতারা’দের সাথে। ফাতিনের কাছে দুজন কে তুলে দিয়ে তিনি ফিরে আসবেন। যেহেতু আনতারা বাড়ি থেকে বাইরে পা রাখছেই, ফাতিন একদম কোচিংয়ের মূল শাখায় ফার্মগেট ভর্তি করিয়ে দিয়েছে, কাছাকাছি দু রুমের এক ফ্ল্যাট ভাড়া করে দিয়েছে; তার সাথেই রাখতো তবে তার ঠিকানা ওদের থেকে বহু দূরে। কেয়ার কাছাকাছি এক কলেজে ট্রান্সফার হয়েছে তবে বেশ কিছু টাকা খরচ করতে হয়েছে। মেয়ে দুটো রেডি হয়ে বাইরে বের হতেই একপ্রকার ঘিরে ধরলো সবাই, যে যা পারে উপদেশ দিয়ে দিচ্ছে।‌ হয়তো মন থেকে, নয়তো উপরে উপরে; যে যা পারছে কথা শুনিয়ে যাচ্ছে নিজেদের মতো। আনতারা সবার সাথে খানিক সময় কথা বলে একটু দূরে দাঁড়িয়ে থাকা রাজিব তাজ‌ওয়ারের দিকে এগিয়ে গেল।‌ নিম্ন স্বরে সালাম জানিয়ে বললো,

~ দোয়া করবেন চাচা, আপনাদের দোয়া খুব কাজে লাগবে আমাদের।

~ ভালো ভাবে থাইকো মা, শহরের মানুষ জন কি রকম তা জানি না তবে গ্রামের মতো হয়তো না; তাই সাবধানে চলাফেরা ক‌ইরো।

আনতারা মাথা নাড়লো, মুচকি হেসে মিসেস মমতার সামনে দাঁড়াতেই তিনি তাকিয়ে র‌ইলেন আনতারা’র দিকে‌। মেয়ে টাকে সে আগে আদর করতো, খুব একটা না করলেও কখনো তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে নি। তবে যেদিন বুঝতে পারলো তার ছেলের এই মেয়ে কে পছন্দ সেদিন থেকে কেন জানি দেখলেই রাগ হতো, কোনো মা ই চায় না তার ছেলের জন্য কালো মেয়েকে ব‌উ করে আনতে! মিসেস মমতা কে উদ্দেশ্য করে আনতারা বললো,

~ বড় মাপের সাইকিয়াট্রিস্ট হলেও কি আপনি তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে কথা বলবেন চাচি? না একটু সমিহ করবেন? যাই হোক আসছি চাচি, ভালো থাকবেন। দোয়া করবেন আমাদের জন্য!

মিসেস মমতাকে কিছুই বলার সুযোগ দিলো না আনতারা, গাড়িতে চেপে বসলো। গাড়ি ছুটতে শুরু করতেই মিসেস কামরুন্নাহার কেঁদে উঠলেন, এতক্ষণ অনেক কষ্টে কান্না টা লুকিয়ে রেখেছিলেন, বাড়ি টা ফাঁকা করে দুই মেয়েই শহরে চলে গেল, প্রাণ কি সহে? মিসেস সেলিনা জা কে সামলে ভেতরে নিয়ে গেলেন। ফরিদ তালুকদার যতদূর গাড়িটা দেখা যায় তাকিয়ে র‌ইলেন, মনে মনে উপর ওয়ালার কাছে কতশত দোয়া জানালেন! অন্যদিকে নিজের ঘরের বেলকনিতে পর্দার আড়ালে দাঁড়িয়ে মেয়ের শহরে গমন দেখলেন আহনাফ তালুকদার , বুকটা কাঁপছে তার। যেখানে সাথে তার যাওয়ার কথা ছিলো, সেখানে ছোট ভাই গেল; মেয়ের সামনে যেতেও এখন লজ্জা করে তার। দৃষ্টি মেলাতে ভয় হয়; তাইতো দূরে দূরে থাকছে। মুখটা দেখলেই মনে পড়ে মেয়ের সাথে করা অন্যায় গুলো, মরে যেতে ইচ্ছে করে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজের ঘরে এসে বসে আহনাফ তালুকদার। হাতে ছোট্ট একটা ফটোফ্রেম। যেখানে বাবা-মা ও সন্তানের সুন্দর একটি মুহূর্ত ক্যাপচার করা। বুকটা আবার হুহু করে উঠলো তার! ভুলের প্রায়শ্চিত্ত না জানি কতদিন দিতে হয়! হয়তো আমৃত্য!

….

বিকেল সবে শুরু হয়েছে। কম্পিউটার অপারেটর হিসেবে নিয়োগ হয়েছে রাশিদ। কোম্পানি টা বেশ বড় না হলেও ভালোয় নাম ডাক রয়েছে। ডাটা এন্ট্রির কাজ গুলোতে নিজের উপর‌ই বেতন নির্ভর করে, যে যত পরিশ্রম তার প্রাপ্তি তত! পরিচিত কয়েকজন কে ধরেই মূলত চাকরির ব্যবস্থা টা করেছে রাশিদ, পরিচিতি না থাকলে আবার ভালো চাকরি খুঁজে পাওয়া কঠিন! এখন যে যুগ এসেছে, টাকা হাতে রেখে চাকরির আবেদন করতে হয় সেখানে পরিচিতদের সহায়তায় সে টাকা ছাড়াই চাকরি টা একপ্রকার হাতিয়ে নিয়েছে। এরপর থেকেই শুরু হয়েছে তার যুদ্ধ! যুদ্ধ‌ই তো! অপরূপা কে ছাড়া কয়েক মুহূর্ত দূরে থাকা তার কাছে কতটা পীড়াদায়ক, সেখানে গোটা কয়েকদিন রয়েছে!

আজ রাশিদ ছুটি নিয়েছছ লাঞ্চের পর। ফাতিন ফোন দিয়ে জানালো সে আসছে! রান্নার ব্যবস্থা করতে হবে! এ কয়দিন তো সে কোনো রকম ডিম ভাজি, আলু ভর্তা, ভাত আর বাহিরের অর্ডার কৃত খাবার দিয়ে চালিয়ে দিয়েছে; শুচিস্মিতার সামনে তো আর এসব দেওয়া যাবে না! তাই বুদ্ধি করে ফ্ল্যাট মালিকের বুয়া কে দ্বিগুন টাকা বকশিস দিয়ে রান্না করিয়ে নিয়েছে। এখন চলছে সে ফাতিনের দেওয়া ঠিকানায়। মনের মধ্যে কিরকম অনুভূতি হচ্ছে বলে বুঝাতে পারবে না সে। কতদিন পর তার শুচিস্মিতা কে দেখবে, চক্ষু শিতল হবে, অন্তর আরো বেশী করে পুড়বে। এই পুড়াতেও যেন কত সুখ! রিকশা এসে থামলো বাস স্টেশনের সামনে! এখানেই তো আসতে বললো। ভিড়ভাট্টা ঠেলেঠুলে ফাঁকা এক বেঞ্চে বসে হাতে থাকা ঘড়ির দিকে চোখ বুলালো, ঠোঁটের কোণে সুক্ষ্ম এক হাসি ফুটে উঠলো। সময়ের আধা ঘন্টা আগেই সে চলে এসেছে! সময় যেন যেতে চায়ছে না, মিনারেল ওয়াটারের এক বোতল কিনে পুরো বোতল টা এক নিমিষেই খালি করলো রাশিদ, সাথে সাথে টের‌ পেল পেটের ভেতর গুড়গুড় শব্দ, জানান দিলো পেটে কিছু পড়েনি, খিদে পেয়েছে। বুয়া কে রাজি করানোর চক্করে পড়ে খাওয়া হয়নি, পাশের চায়ের দোকান থেকে এক প্যাকেট এনার্জি প্লাস বিস্কুট নিয়ে খাওয়া শুরু করলো। এই ফাঁকে একটু এনার্জি হোক শরীরে। না জানি এতদিন পর অপরূপা কে দেখে কেমন রিয়েকশন দেয়! অজ্ঞান হয়ে গেলে আবার সমস্যা!

মালামাল ভর্তি গাড়িতে বসে আছে ফাতিন। নিজের ঠিকানায় দিয়েছিল ড্রাইভার কে। গাড়ি আসতেই চেপে বসেছে সে। আনতারা’রা বাসে করে ঢাকা যাচ্ছে। সে এখান থেকে বাস স্টেশনেই নামবে।
বহুদিন পর আবার সেই তিক্ত অনুভূতির সম্মুখীন হবে, না চাইতেও হতে হবে। বুকে কেমন জ্বালা করছে সকাল থেকেই। সে যদি পারতো এই অনুভূতি গুলো কে দূরে কোথাও রেখে আসতো, মনের বেইমানির জন্য হয়তো মনকেই নির্বাসন দিয়ে দিতো! তবে সে অপারগ, একটা ভুলে আজ কেন হয়তো বাকিটা জীবন তাকে মাশুল দিতে হবে! ভাবতে ভাবতেই স্টেশনের সামনে এসে গাড়ি থামলো। নেমে গেল ফাতিন, ফাতিন কে দেখেই অর্ধেক খাওয়া বিস্কুট এগিয়ে দিলো রাশিদ। কোনো রকম ভুমিকা ছাড়াই মুখে পুরে নিলো। বললো,

~ অনেকক্ষণ এসেছিস?

~ বিশ মিনিট হলো!

~ শরীর বসে গেছে, খাওয়া দাওয়া করছিস না নাকি?

~ খাই তবে তৃপ্তি পাই না!

~ কেন তৃপ্তি পালিয়ে গেছে নাকি?

~ নাহ, সে তো গ্রামে ফেলে এসেছিলাম। তবে আজ থেকে মন হচ্ছে তৃপ্তি পাবো!

রাশিদের কথায় আর দৃষ্টি মেলাতে পারলো না ফাতিন। হয়তো ধরা পড়ে যাওয়ার ভয়ে। যদি রাশিদ বুঝে যায় শুচিস্মিতার কথা তার মুখে শুনে বুকে জ্বালা হচ্ছে! রাশিদ হয়তো অন্যসময় লক্ষ্য করতো, তবে তার দৃষ্টি যে এখন বাস থেকে নামা মেয়েটির দিকে। অপলক তাকিয়ে রয় রাশিদ। চোখ শিতল হয়ে আসে, বুকের ভেতরে জমিয়ে রাখা মেঘ গুলো যেন কেটে যেতে থাকে।‌ ফাতিন নিজেও তাকায়, বেশীক্ষণ নয়। অল্পতেই তার দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসে, নিজেকে স্বাভাবিক করে এগিয়ে যায়। রাশিদ নড়ে না, চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। আমির তালুকদার ফাতিনের সাথে কথা বলে, সে দেরী করবে না, পরের বাসেই ফিরে যাবে। আনতারা কেয়াকে নিয়ে ভিড় ঠেলে খালি জায়গায় দাঁড়ায়। হুট করে কেয়ার দৃষ্টি রাশিদের উপর পড়তেই খানিক শব্দ করে চেঁচিয়ে উঠে সে,

~ আপায়, ওই দেখ রাশিদ ভাই!

থমকায় আনতারা, ধক করে উঠে বুক। জলদি করে ঘাড় ঘুরিয়ে রাশিদের দিকে তাকায়। কেমন করে দেখছে। কেয়া আনতারা কে ফেলেই রাশিদের কাছে আসে, ধাক্কা দেয়। ঘোর কাটে রাশিদের, মাথা চুলকে কেয়ার মাথায় গাট্টা বসিয়ে আমির তালুকদারের সাথে ভালো মন্দ জিজ্ঞেস করে নেয়। সময় চলে যায় কিছু সময়। রিকশা ডেকে আবার চারজন বসে পড়ে। ফ্ল্যাটের সামনে গাড়ি থামাতেই আনতারা নজর ঘুরিয়ে যতটুকু পারে দেখে নেয়। চারপাশ টা ভালো লেগেছে তার, গাছপালা, ফুলে ঘেরা বাগান, শান্ত পরিবেশ; যেন আনতারা’র মন মতো। রাশিদ আনতারা’দের নিজের ফ্ল্যাটে নিয়ে বসায়। ফ্রেশ হতে বলে ড্রাইভার সহ তিনজনে হাতে হাতে মালামাল গুলো নামিয়ে রাখে। আনতারা’দের কিছুই করতে হয় না। কম সময়েই আজকে রাতে থাকার জন্য পরিবেশ তৈরি করে আবার ফিরে আসে রাশিদের ফ্ল্যাটে। ততক্ষণে আনতারা কেয়া রেস্ট নিচ্ছিলো। ফাতিন ওয়াশ রুমে যেতেই আনতারা ছুটে যায় রাশিদের কাছে। ঝটপট বলে উঠে,

~ আপনি এখানে কেন রাশিদ ভাই?

~ এখানেই তো থাকার কথা!

~ মানে?

~ বুঝতে পারছো না? যার জন্য গ্রাম ছাড়লাম, যার জন্য শহুরে ভিড়ভাট্টায় ঘাঁটি গাড়লাম, তাকে রেখে অন্য কোথাও থাকি কি করে! খুঁজে খুঁজে ঠিক এখানেই চাকরি নিলাম, আমার পাশের ফ্ল্যাট টা আগেই ভাড়া নিয়ে রেখেছিলাম! নাহলে হয়তো অন্যকারো দখলে থাকতো!

চলবে….?
#শুচিস্মিতা -১৫
Tahrim Muntahana

~ রাশিদ ভাই যে এখানেও আমার প্রতিবেশী হয়ে গেল ছোট চাচি!

আনতারা’র কথায় ভ্রু কুঁচকালো মিসেস কামরুন্নাহার। ধরণীতে সবে মাত্র সন্ধ্যা নেমেছে। বাঁকা চাঁদ খানিক লজ্জিত ভঙ্গিমায় হাসছে, অন্ধকার আকাশে জ্বলজ্বল করছে। বাহারি ফুলের গন্ধে মো মো করছে পরিবেশ। নিজেদের ফ্ল্যাটে অবস্থান করছে আনতারা’রা। ফাতিন আজ রাশিদের সাথে থাকবে।‌ ফাঁক পেয়েই ছোট চাচি কে ফোন দিয়েছে আনতারা। কথার মাঝেই কথাটা বলে উঠলো সে। মিসেস কামরুন্নাহার কিছুটা বুঝলেও প্রশ্ন করলো,

~ রাশিদ তোদের বিল্ডিংয়ে থাকছে? ও না মিরপুরে কাজ করে!

আনতারা হেসে উঠলো। মিরপুরে কাজ করে? ছেলেটা কিভাবে বোকা বানিয়ে রেখেছে সবাই কে। হেসেই বললো,

~ না ছোটচাচি, আমি তো এখানে এসে দেখি রাশিদ ভাই এখানে‌। বাড়িতে মিথ্যে বলেছে। শুধু কি বিল্ডিং? পাশের ফ্ল্যাট টাই তার। আর মজার কথা শুনবে? আমাদের ফ্ল্যাট টা ১৫ দিন আগে থেকেই তার ভাড়া করা!

মিসেস কামরুন্নাহার স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন। রাশিদ থাকা মানে তার আর কোনো টেনশন নেই। তার মেয়ের উপর ভরসা আছে, কোনো ভুল সে করবে না। আরো কিছুক্ষণ কথা বলে ফোন রেখে দেয় আনতারা। আজ আর পড়া হবে না, বেলকনিতে চলে যায় বাইরের পরিবেশ দেখতে। ঠিক তখনি পাশ থেকে ভেসে আসে,

“আমার বন্ধুর বাঁকা নয়নে গো,
বন্ধুর বাঁকা নয়নে
কি মোহিনী আছে গো সই, কে জানে ?
সখী গো, প্রাণসখী গো,
ওই রূপ যখন মনে পড়ে,
খাঁচার পাখি রয় না ঘরে
ঘুরে বেড়ায় বন্ধুয়ার সন্ধানে!”

ফ্যাচ ফ্যাচ কন্ঠের গান টাও যেন প্রাণ পেয়েছে, কি আবেগ মেশানো ছিলো! আনতারা এগিয়ে যায় রাশিদের বেলকনির দিকে। নাহ বেলকনিতে নেই, ঘরে বসেই গান টা গাইছে রাশিদ। আনতারা’র খুব ইচ্ছে করে রাশিদের মুখটা দেখার, দৃষ্টিতে দৃষ্টিতে মেলাতে। আবেগে ভরা গানটার মাঝে নিশ্চয়‌ই চোখের দৃষ্টিতেও আবেগ মেশানো থাকবে? সেই আবেগে সে ভাসতে চায়, বেশী নয় অল্পক্ষণ ভাসতে চায়। তাই গলা উঁচিয়ে বললো,

~ ফাতিন ভাই চা খাবো আমি, হবে?

গানের শব্দ গুলো যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেলো। কাছাকাছি কারো পায়ের শব্দ শুনে রেলিং ঘেঁষে অন্যদিকে তাকিয়ে রইলো সে, ধরা পড়লে চলবে না। কিছুক্ষণ পর টের পেল দূরে থাকা গানের লিরিক্স গুলো খুব কাছ থেকে শুনতে পাচ্ছে আনতারা। ঘুরে তাকায়, রাশিদের সুশ্রী মুখশ্রী ভেসে উঠে। যার গাঢ় দৃষ্টি তার উপরেই। আনতারা এগিয়ে এসে রাশিদের মুখোমুখি দাঁড়ায়, নিশ্চুপ হয়ে যায় রাশিদ। কিছুক্ষণ দেখে নিয়ে বলে উঠে,

~ মনে হচ্ছে বহুজনম পর চোখ তার প্রাণ পেল, ঠোঁট তার নির্জীবতা হারালো, হৃদয় নতুন ছন্দ খুঁজে পেল!

আনতারা ঠোঁটের কোণে মুচকি হাসি ধরে রাখে। কথা বলতে ইচ্ছে করে না। কেটে যায় কিছুটা সময়, একে অপর কে দেখে নেয় তৃপ্তি নিয়ে। হঠাৎ করেই আবার ফাতিনের আগমন, নড়েচড়ে উঠে আনতারা। দৃষ্টি ঘুরাতে থাকে। ফাতিনের হাতে চারটে চায়ের কাপ। রাশিদের দিকে তাকায় না সে, কষ্ট হয় ছেলেটার অনুভূতি মাখা দৃষ্টি দেখলে! ফাতিনের কন্ঠস্বর শুনে কেয়া’ও এসে উপস্থিত হয়। রাত নয়টা পর্যন্ত হাসি মজার মধ্যে কেটে যায়, কিছু সময়ের জন্য ভুলে যায় মনের গোপন অনুভূতি গুলো। এ সময় যদি আর না আসে?

মিসেস নাজমা চটে আছেন মেজ ব‌উয়ের উপর। এখন পর্যন্ত নাতি নাতনির মুখ দেখাতে পারলো না, রাগার ই কথা। এতদিন এই কথা তার মাথায় আসে নি, ছোট ছেলের জন্য বিকেলে মেয়ে দেখতে গিয়ে যখন শুনলো ‘আপনার মেজ ব‌উ কি বন্ধা নাকি’! তখন থেকেই তার মাথা গরম হয়ে আছে। খোলাসা করে কিছু বলছেও না, কাউকে কাছে ঘেঁষতেও দিচ্ছে না। নিজের ঘরে বসে একা একাই বিলাপ করে যাচ্ছে। পারভিন তাড়াহুড়ো করে নাহিদ কে খবর পাঠিয়েছে, সে জানে বাড়ির বড় ছেলে ছাড়া এই বিলাপ কেউ বন্ধ করতে পারবে না, দেখা যাবে না ঘুমিয়ে সারারাত আজেবাজে বকছে। সময়ের আগেই নাহিদ চলে এসেছে, রাত এখন প্রায় দশটা বাজতে চললো। আগেই আর মায়ের ঘরে গেল না সে, বরং হাত মুখ ধুয়ে খাবার নিয়ে মায়ের ঘরের দরজায় টোকা দিলো। যদিও দরজা একেবারে বন্ধ করে নি। দরজায় টোকা শুনেই যেন মিসেস নাজমা’র রাগ বাড়লো,

~ কেডা? আমার কাছে ঘেঁষবা না কেউ। এই বাড়িতে আমার কোনো দাম আছে? এহন আমি বুড়ি হ‌ইয়া গেছি, পথে ফালায় রাখলেও কেউ ক‌ওনের নাই।

নাহিদ আস্তে আস্তে পা ফেলে ঘরের ভেতর ঢুকলো। মুখ বেঁকিয়ে অন্য দিকে তাকিয়ে রইলেন তিনি। মায়ের পাশে বসে বললো,

~ তুমি তো আমাদের সব আম্মা। তুমি না থাকলে এই সংসার চলবে? দেখা যাবে তিন ব‌উ ঝগড়া লাগিয়ে আলাদা হ‌ওয়ার পাইতারা করছে। তুমি আছো বলেই তো ওদের এমন সাহস হয়ে উঠে নি। কি হয়েছে আমাকে বলো। কে কি বলেছে তোমার?

~ কুলা*ঙ্গার জন্ম দিছি একটা, আমার মুখের উপর কথা কয়। বলে কি না তার ব‌উ রে জানি কথা না হুনাই। আমি তোরে ডরাই নাহি? বন্ধা মাইয়া নিয়ে সংসার করবা আমি তা মানমু না, আমার কি নাতিনের মুখ দেখার শখ জাগে না?

নাহিদের এবার বোধগম্য হলো মায়ের রাগের কারণ। মা কে বোঝানোর স্বরে কিছু বলবে তার আগেই মেজ ব‌উ রিনু গর্জে বলে উঠলো,

~ আপনে না মানার কে আম্মা? আপনের‌ পোলা সংসার করবে আপনে তো না। বিকেল থেকে আমারে কথা শোনায় যাইতেছেন, এতক্ষণ চুপ ছিলাম। সমস্যা টা যদি আপনার পোলার হয়?তখন কি বলবেন আম্মা, তখন কিন্তু এই রিনুও আপনের সংসার পায়ে ঠেইলা চ‌ইলা‌ যাইবো।

পরিস্থিতি যেন গমগম করে উঠলো। নাহিদ কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে বসে র‌ইলো। ঠিক তখনি নিজের ঘর থেকে তেড়ে এসে রিনুর গালে থাপ্পড় বসালো নিরব। গালে হাত দিয়ে আশ্চর্য চোখে তাকালো রিনু। সবটাই তার কাছে স্বপ্ন‌ মনে হচ্ছে। নিরব যে তাকে মারতে পারে বিশ্বাস করতে পারছে না। যে ছেলে তার কথায় উঠে বসে, সে ছেলে তাকে মারলো? রিনুকে অবাক করে দিয়ে নিরব আবার বললো,

~ আমার আম্মার সাথে ভালো করে কথা বলো রিনু। তোমাকে কিছু বলি না দেখে মাথায় উঠে বসছো। আমি আগেই আম্মা কে বলছি তোমাকে এ ব্যাপারে কথা না বলতে‌। তুমি জানার পরেও এই ঘরে আসার সাহস কি করে হলো? এর পর বড় গলায় কথা বলবি গলা চিপে মেরে ফেলবো!

মিসেস নাজমা খুশিতে যেন নেচে উঠলো। পরিস্থিতি পুরো বিগড়ে গেলো। পারভিন এগিয়ে এসে রিনুকে সরিয়ে নিলো নিরবের কাছ থেকে। নিরবের কাজে সেও অবাক হয়েছে, ব‌উ মারা তার পছন্দের নয়। আগে শাসন না করে, এখন পুরুষত্ব দেখাতে এসেছে। মিসেস নাজমা বললো,

~ আরেক টা মার, আমার মুখের উপরে কথা কয়, সাহস কত বড় ওই মাইয়ার।

~ আম্মা! আপনি গুরুজন, ক‌ই ব‌উ কে মারার জন্য ছেলেকে দুটো মারবেন তার বদলে আরো মারতে বলছেন?

ফারাহ’র কথায় মুখ বেঁকালেন মিসেস নাজমা। নিরব আবার গর্জে বলে উঠলো,

~ ওর গালে আরো আগেই থাপ্পড় বসানো উচিত ছিলো, নাহলে মুখে লাগাম থাকতো, ছোটলোকের বাচ্চার সাহস অতিরিক্ত বেড়ে গেছে।

এবার মনে হয় নাহিদের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেল। একে তো তার‌ই সামনে ব‌উয়ের গাঁয়ে হাত তুলেছে, তার উপর গালি দিচ্ছে সবার সামনে! সেও যে ভালো তেমন না, রাগ উঠলে সেও গালি দিতো, পরে যখন বুঝতে পারতো ক্ষমা চেয়ে নিতো।‌ কিন্তু এসব কি পরিবারের মানুষ জানে? ঘরের ঝগড়া ঘরেই সীমাবদ্ধ রেখেছে, অথচ আজ তার‌ই সামনে তার ভাই ব‌উ কে মারলো! সর্বশক্তি দিয়ে চড় বসিয়ে দিলো নিরবের গালে, মিসেস নাজমা’র মুখটা চুপসে গেলেন। আর কিছু বলার সাহস তার হলো না, বড় ছেলেকে তিনি খুব মানেন। বড় ভাইয়ের চড় খেয়ে নিরবের হুশ এলো সে রাগের মাথায় কি করে ফেলেছে, লজ্জায় মাথা নত করে নিলো নিরব। একে তে মায়ের বলা কথাগুলো, তার‌উপর‌ বিকেল থেকে বিলাপ, ব‌উয়ের আহাজারি; রাগ সামাল দিতে পারেনি! আশেপাশের চাচি ভাবিদের কাছেও শুনতে হয় তার ব‌উ বন্ধা, যদিও এতে তার সমস্যা নেই তবে কয়দিন শুনতে ভালো লাগে? আজ যেন মিসেস নাজমা আগুনে ঘি ঢেলে পরিস্থিতি বিগড়ে দিলো! নাহিদ আর দাঁড়ালো না, মায়ের দিকে একপলক তাকিয়ে হনহন করে বের হয়ে গেল ঘর থেকে। স্বামীর যাওয়ার দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস গোপন করলো পারভিন। আজ আর বাড়ি ফিরবে না সে জানে। নিজেও নিজের ঘরে চলে গেল, এসব নাটক আর ভালো লাগে না! পারভিনের ঘরে খাবার দিয়ে ফারাহ নিজেও খেয়ে নিলো, না খেয়ে থাকার মানেই হয়না। নিরব কে খাবার খেতে ডাকলেও সে আসেনি, তাই নিজের মতো সব গুছিয়ে রিনুর জন্য খাবার নিয়ে নিজের ঘরে ঢুকলো। মেয়েটা কখন থেকে কেঁদে যাচ্ছে,

~ আর কাঁদবেন না মেজ ভাবী। খাবার টা খেয়ে নিন।

ফারাহ বুঝিয়ে শুনিয়ে রিনুকে খাবার টা খাওয়ালো, অনেক রাত হয়ে গেছে, বর কে তো সব জানাতে হবে! নিজেও বারান্দায় চলে গেল ফোন নিয়ে। এখন হয়তো ডিউটি থেকে ফিরেছে নিয়ন। ফোন দেওয়ার সাথে সাথেই ফোন রিসিভ হলো, ফারাহ হাসলো। এতক্ষণের গুমোট ভাব কেটে গেছে। প্রিয় মানুষটার সাথে কথা বললে কষ্ট গুলো কোথায় পালিয়ে যায় বোঝা বড় কঠিন!

রাত পোহালেই দোকানপাট খোলার সাথে‌‌ সাথে আনতারা’রা বেরিয়ে পড়েছে। রাশিদ ও আজ অফিস যায় নি। চারজন মিলে দুটো রিকশা করে এদিক ওদিক ঘুরে ঘুরে টুকিটাকি জিনিসপত্র কিনছে, ঘরের সরঞ্জাম ফেরার পথে কিনবে। এই ফাঁকে এলাকাটাও ভালো ভাবে চিনিয়ে দিচ্ছে দুজন কে। প্রাথমিক ভাবে কিছু জায়গা চিনলে আস্তে আস্তে সব চিনে যাবে, নতুন বন্ধু হবে, চালাক চতুর‌ও হয়ে যাবে। শপিং মলে এসে রিকশা থামতেই নেমে পড়লো তিনজন। আনতারা খানিক অবাক হয়েছে শপিং মলে আসতে দেখে, তবে হুট করেই ফাতিনের হাতের মুঠোয় নিজের হাত দেখে থেমে যায়, কেয়ার হাত ধরে আছে রাশিদ। যে ভিড়, আবার না হারিয়ে যায়!
বড়সড় এক দোকানের সামনে দাঁড়াতেই কেয়া বলে উঠলো,

~ আমরা এখানে কেন ফাতিন ভাই? আমাদের তো সব আছেই!

~ কলেজ ড্রেস ছাড়া কলেজে ঢুকতে পারবি? মাঝে মাঝে বিভিন্ন প্রোগ্রাম হয়, সেগুলোর জন্য আগে থেকেই প্রস্তুতি নিতে হবে, হুটহাট ঘুরতে যাবি, শহরে এসেছিস এদের কালচারের সাথে মানিয়ে নিতে না পারলে ভালো লাগবে না, গ্রামে ফিরে যেতে ইচ্ছে করবে।

ফাতিন রাশিদ নিজেদের অভিজ্ঞতা মতোই অনেক গুলো শপিং করে দিলো, কিন্তু যখন টাকা ফাতিন দিতে নিবে, থামিয়ে দিলো আনতারা, তাড়াহুড়ো করে বলে উঠলো,

~ একি ফাতিন ভাই, আপনি দিচ্ছেন কেন টাকা?

ভ্রু কুঁচকালো ফাতিন, বিরক্তি কন্ঠে বললো,

~ পরিবার‌ও ভাগ করে ফেলছিস নাকি?

~ আমি সে কথা বলিনি ফাতিন ভাই। ছোটচাচির হুকুম এটা।

~ তোরা আমার কাজিন, ছোট থেকে বড় হ‌ওয়া দেখেছি, ভাই হিসেবে আমার একটা দায়িত্ব আছে আনতারা। আমার বাবা-মায়ের ভুলের শাস্তি আমাকে দিচ্ছিস কেন? এটা আমার দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। মোট কথা আমাদের টাকার ভাগ আছে নাকি, এক পরিবার, আমি ছোট চাচিকে মানিয়ে নিবো তোর ভাবতে হবে না।

আনতারা’র আর কিছু বলার থাকলো না, ফাতিন যেমন তার দিক থেকে ঠিক, ছোট চাচিও তার দিক থেকে ঠিক। শপিংমল থেকে বের হয়ে আবার রিকশায় চেপে বসলো চারজন। কেয়া তো খুব খুশি এত এত শপিং করে, আনতারা যে খুশি নয় তা না। শুধু কেয়ার মতো সে প্রকাশ করছে না। প্রিয় মানুষটাকে নিয়ে প্রথম ঢাকা শহর ঘুরছে, আনন্দ দ্বিগুন নয় কি? কেয়ার কলেজের পাশে সুন্দর একটি ক্যাফে আছে, সেখানেই ছুটলো চারজন। রিকশা থেকে নেমে হঠাৎ ফাতিনের কিছু মনে হতেই কেয়া কে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলো,

~ তোর রিকশা ভাড়া প্রতিদিন চল্লিশ টাকা লাগবে কেয়া, রিকশা ডেকে সরাসরি জায়গার কথা বলে বসে পড়বি, ভাড়া কত জিজ্ঞেস করলেই বেশী চাইবে, আর যদি বুঝতে পারে এলাকায় তুই নতুন তাহলে তো কথায় নেই, শহরে চলতে গেলে স্মার্টনেস একটু বেশীই প্রয়োজন। আর এলাকা টা খুব বেশি ভালো নয়, ছিনতাইয়ের অহরহ ঘটনা ঘটে, নিজের সেইফটি নিজেকেই দেখতে হবে। বুঝতে পেরেছিস দুজন?

দুজন‌ই বাধ্যগত ছাত্রীর মতো মাথা নাড়ালো। ফাতিন যেন বড় ভাইয়ের সকল দায়িত্ব কর্তব্যের লিস্ট আগেই করে রেখেছিল‌। তোতা পাখির মতো বুঝিয়ে যাচ্ছে। রাশিদ ভাই-বোন দের মধ্যে একটা কথাও বলে নি। সেও বলবে পরে, হয়তো সময় টা যখন তার থাকবে!

ব্যাগপত্র গুছিয়ে বাবার বাড়ি যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে রিনু। যে সংসারে তার সম্মান নেই সে সংসারে সে থাকবে না।‌ পারভিন নিজেও কিছু করতে পারছে না। রিনু কে যেতে দেওয়া মানে এই ঝামেলা টা আরো বাড়ানো। আর এই ঝামেলা যতদিন থাকবে তার বরটাও স্বাভাবিক আচরণ করবে না। ফারাহ যদিও সেসবে ইন্টারেস্ট দেখাচ্ছে না, তার মতে বাবার বাড়ি চলে যাওয়ায় ভালো। যার ভরসায় পরিচিত বাড়ি ছেড়ে অপরিচিতদের আপন‌ করেছে সেই যদি এমন করে, থাকার প্রশ্ন‌ই আসে না। রিনু সিদ্ধান্তে একপ্রকার নিরব সমর্থন জারি করেছে সে। পারভিন রিনুর রেড়ি হ‌ওয়াতে বাঁধা দিয়ে বললো,

~ মুখপু্রি চলে যাচ্ছিস, কয়দিন পর আরেকটা ব‌উ ঘরে তুলবে তখন কপাল তোর পুড়বে‌। জেনে শুনে নিজের অবস্থান হারাচ্ছিস।

থেমে গেল রিনু। পাশ থেকে ফারাহ বললো,

~ বড়ভাবী এভাবে বলছো কেন? মেজ ভাবী ঠিক‌ই করছে, মেজ ভাই কি করে পারলো সবার সামনে মারতে? এই টুকু রাগ মেজ ভাবীর সাজে। আমি থাকলে তো টপাটপ কয়েকটা চড় দিয়ে নিতাম।

ফারাহ’র কথায় যেন রিনু আরো উৎসাহ পেল। বললো,

~ বড়ভাবী তুমি বাঁধা দিও না, ওর সাহস কি ক‌রে হ‌ইলো আমার গাঁয়ে হাত তুলার, বাবা মা কে বলবো তারাই একটা বিহিত করবে।

পারভিন হতাশার শ্বাস ফেললো। এই দুটোকে কি করে বোঝায় সংসারে ঝামেলা হয়, সব ঝামেলা তেই যদি বাবার বাড়ি মানুষদের যোগ করা হয় সংসার আর নিজের থাকে না। জোর করে রিনুকে পাশে বসিয়ে বললো,

~ আমাকে বলো তোমাকে নিরব ভাই এতদিন কিছু বলেছে? সব কথা শুনে নাই? পুরুষ মানুষের বংশের বাতির দরকার হয়, তারপরেও বাচ্চা নিয়ে তোমাকে কিছু বলছছে? তুমিও জানো আশেপাশের ভাবী চাচি রা নিরব ভাইকে কতকিছু বলে, তারপরেও ভাই যে তোমাকে কিছু বলে না, তোমার ভাগ্য ভালো না? পুরুষ মানুষের রাগ নাকের ডগায় থাকে, রাগ উঠলে মানুষ হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। নিরব ভাই তো আম্মাকে বলেই দিছিলো যাতে তোমাকে কিছু না বলে, তারপরেও তুমি কথা বললে কেন? আম্মা নিজের মতো বিলাপ করে চুপ হয়ে যেত, আর তুমি নাহিদ কেও অসম্মান করেছো, ও তো সমাধান করত‌ই। আম্মা কে ভালো ভাবে বুঝালে বুঝতো, তুমিই রাগ করে ব্যাপারটা ঘেঁটে দিলে! এখন আবার বাবার বাড়ি লোকেদের টেনে স্বামীর ভালোবাসায় প্রশ্ন তুলছো। বাবার বাড়ি মুখ দেখাতে পারবে? সবাই বলবে না তোমার বর খারাপ, তখন তোমার‌ই কষ্ট হবে।

থামলো পারভিন, রিনু বুঝেছে। রাগ নিভে গেছে তার। এবার পারভিন ফারাহ’র দিকে তাকিয়ে বললো,

~ সংসার এত সহজ নয় ফারাহ। ঝগড়া হলেই যদি দুজন দুজনের আত্মসম্মান ইগো নিয়ে পড়ে থাকো, সম্পর্কে দূরত্ব বাড়বে। স্বামী স্ত্রীর মধ্যে একজনে রাগ করলে আরেকজনের চুপ থাকতে হয়, পরে ঠিক‌ই নিজের ভুল বুঝে ক্ষমা চাইবে। আর নাহিদ তোমার বদল নিরব কে মেরেছে, বড়ভাই হিসেবে শাসন করছে, এখন তুমি চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত না নিয়ে বাড়িতে থেকে বর কে শায়েস্তা করো। এতেই মঙ্গল!

বড় ব‌উয়ের দায়িত্ব পালন করে পারভিন চললো নিজের ঘরে। নাহিদ কে বলতে হবে। ফারাহ রিনুও বুঝলো বিষয়টা। তাই দুজনেই চুপ করে কিছুক্ষণ বসে, নিজের কাজ করতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। সংসার‌ ঝামেলাও হুটহাট চলে আসে আবার হুটহাট করেই সমাধান হয়। আত্মসম্মানের দোহায় সব জায়গায় দিলে নিজের আসল‌ ব্যক্তিত্বটাই হারিয়ে ফেলার যোগাড় হয়। বিয়ের পর মেয়েদের স্বামীর সংসার‌ই সব, আপন করতে না পারলে নিজের জন্য‌ই নেতিবাচক!

চলবে…?