#শুভমুহূর্ত (অন্তিম পর্ব)
#অনিন্দিতা_মুখার্জী_সাহা
Feminine Wisdom
“মা উঠ ইবার, যা হাত মুখটো ধুয়ে লে। ভালো ইক্খান কাপড়টো পর। চল আমার সাথে । গিয়ে দেখ ক্যানে
লুকখি দিদি কি রুকম রান্নাটো কোরচে আজ । “- লাজু সাত সকালে এসে সুমিত্রার ঘরের দরজা জানলা সব খুলে দিতে দিতে বললো । আজ কিছুতেই বিছানা ছাড়তে ইচ্ছে করছে না সুমিত্রার । শুয়ে শুয়ে স্মৃতি চারণেও অনেক সময় পাথর হয়ে যাওয়া বুকটা নাড়া দেয়। আজ পাঁচববছর হোলো পাথর হয়ে গেছে সুমিত্রা! একদম শক্ত একটা পাথর।
বরকে আর ছেলেকে হারিয়েছে দুই মাসের ফারাকে। ছেলের এরকম আচরণকে হারিয়ে ফেলাই বলে সুমিত্রা। তাতে মাঝে মধ্যে খারাপ লাগলেও দুঃখ হয়না! বরং মনটা রঙিন হয়ে যায় যখন লাজু এসে প্রজাপতির মত ছটফট করে সুমিত্রার চারপাশে আর বাচ্চাদের মত বোকাবোকা কথায়, হাসিতে ভরিয়ে রাখে তখন সুমিত্রাকে! তখন সত্যি সুমিত্রার মন কৃতজ্ঞতায় ভরে যায় ছেলের প্রতি! ছেলে হিসেবে একটা ভালো কাজ করে গেছে অর্ক।
” আরি কথাটো শুনিস না বলে রাগ হয় ! যা উঠ কেনে, মুখচোখ ধু, দুধটা খা, একটু সাজগুজ কর তারপুরে চোল দেখি আমার সাথে!” লাজুর কথায় আর রাগে আর শুয়ে থাকতে পারলো না সুমিত্রা! উঠতে উঠতে বললো- “লাজু তুই যা মা , লক্ষ্মী একা এতো রান্না করছে, তুই গিয়ে হাত লাগা আমি আসছি !” “সেটি হবেক লাই বুঝলি! আমি গেলেতো তুই আরও শুয়ে থাকবি ! বল দেখি মা তুকে ইরকম দিখলে বাবাটো খুশী হবে কি? ” -লাজুর কথায় হেসে ফেললেন সুমিত্রা। মেয়েটা বড্ড সরল! ও বলে ভাস্কর নাকি এই বাড়ির আশেপাশেই থাকে! ওর মত কেন যে এতো সরল হয় না সবাই!
উঠেই বাথরুম যেতে গিয়ে সুমিত্রা বললো “আমার আলমারি খুলে একটা শাড়ি বের করে রাখ আমি আসছি। “বাথরুমে ঢুকেই একমগ জল গায়ে ঢালতেই শিরশির করে উঠলো, ঠান্ডা পরা শুরু হচ্ছে খুব সাবধানে থাকতে হবে। লক্ষ্মীদের বাবা চলে যাওয়ার পর থেকে কেমন করে জানেনা খুব সুস্থ হয়ে উঠেছে সুমিত্রা। সুগার একদম ঠিক থাকে আজকাল। অথচ যা অসুস্থ থাকার সুমিত্রাই ছিল! সুস্থ ভাস্করের আগে তো সুমিত্রারই যাওয়ার কথা ছিল।
কিন্তু ওই যে! চার আঙুলের কপাল! যেদিকে নিয়ে যাবে যেতেই হবে! ভাস্কর চলে গেল আর সুমিত্রা দিব্বি থেকে গিয়ে সব করে যাচ্ছে! সত্যি সবই তো করলো -শেষ দিন যেমন যেমন বলে গেছিল ভাস্কর – ওঁর বন্ধু ঘোষদার সাথে যোগাযোগ করে আশ্রম খোলা, তবে সেটা বৃদ্ধাশ্রম নয় বাচ্চাদের হোম যারা মানসিকভাবে বিকলাঙ্গ এমন বাচ্চাদের জন্য, খুব অল্প কিছুই টাকার বিনিময়ে বাচ্চারা এখানে থেকে বড় হয়।
সেটাও প্রথমে নিচ্ছিলো না সুমিত্রা! কিন্তু দেখলো এভাবে টানা যাবে না! ওদের ট্রিটমেন্ট চলে তার একটা বড় খরচ! আর আয় বলতে সেরকম কিছু নেই সুমিত্রার! অর্ক টাকা পাঠায় কিন্তু সেটা ব্যাঙ্কেই পড়ে থাকে! হাত দিতে মন চায়নি! তাই এই বাচ্চাগুলোকে রাখার জন্য কিছু টাকা নেয়!
তারপর ওদের পড়াশুনোর ব্যবস্থা আছে, খাওয়া দাওয়া সবের মধ্যে আছে ওদের সবার প্রিয় লাজু দিদি। লাজুর ওদের প্রতি ভালোবাসা দেখে চোখ জুড়িয়ে যায় সুমিত্রার! ওদের শাসন করে, আদর করে, আবার চোখ বড় বড় করে ভয় দেখায় । হাসি পেয়ে যায় সুমিত্রার ওর পাকামি দেখে!
বাচ্চা গুলোর চিকিৎসার দায়িত্বে আছে মুখার্জী ডাক্তারের ভাইয়ের মেয়ে আর ওদের পড়াশুনো সাথে পুরো হোমের দায়িত্বে আছে রোমি, ঘোষদার মেয়ে। বড় ভালো মেয়ে । বিয়ে করেনি! দিনের বেশিরভাগ সময় ওদের সাথে কাটিয়ে দেয়! লক্ষ্মী আছে বাচ্চাদের খাওয়ার দায়িত্বে। আরও দুজন থাকে টুকটাক কাজ করে। সব মিলিয়ে গোছানো সংসার এখন সুমিত্রার। আগের থেকে অনেক মজবুত আর বড়! সুমিত্রা জানে মৃত্যু ছাড়া এই পরিবার ভাঙার দায়িত্ব কারোর নেই।
অর্ক সুইডেন যাওয়ার পর থেকে ছাড়াছাড়া কথা হতো। এক বছরের মাথায় বাবু ফোনে জানায় ওদের ছেলে হয়েছে। সেইদিনটায় কিছুক্ষণের জন্য হলেও সব ভুলে গেছিলো সুমিত্রা! সেই প্রথম জিজ্ঞেস করেছিল কবে আসবি! কী নির্দ্বিধায় বলেছিলো সেদিন অর্ক ” ঠিক নেই “! তাও নাতি হওয়ার জন্য এতো খুশি সেদিন হয়েছিল সুমিত্রা তা ভাষায় বোঝানো সম্ভব না। ওঁর বংশের প্রদীপ! ভাস্করের ছায়া! কিন্তু দেখার উপায় নেই।
কয়েকমাস পর একদিন সন্ধ্যেবেলা অর্কর আবার ফোন। ওই ছেলে নাকি মানসিকভাবে বিকলাঙ্গ। সুস্থ নয়! মোহর নাকি খুব অখুশি ছেলেকে নিয়ে! সেটা শুনে সুমিত্রা খুব কেঁদেছিলো! ভাস্কর চলে যাওয়ার পর এই দ্বিতীয়বার খুব কেঁদেছিলেন সুমিত্রা ।
বংশের প্রথম নাতি সে মানসিক ভাবে বিকলাঙ্গ – শোনার পরই ঘোষদার সাথে প্ল্যান করে এই বাড়িতে আশ্রম খোলার কাজ শুরু হয়েছে। সুমিত্রার ইচ্ছেতেই বিকলাঙ্গ বাচ্চাদের নিয়ে কাজ শুরুর করেছেন উনি আর রুমি। ওদের অবহেলাটা সুমিত্রা মেনে নিতে পারেনা! কী করে মেনে নেবে ওর সংসারেই যে এরকম একটা খুঁত! তাও ওকে দেখতে ইচ্ছে করতো সুমিত্রার! ধরতে ইচ্ছে করতো!
তাই আশ্রমের বাচ্চাগুলো নিয়েই ব্যস্ত থাকে সারাদিন, কোনো ভুলভাল চিন্তা আজকাল আর আসে না। শরীরও এখন অনেক সুস্থ! হতে চললো পাঁচ বছর! অর্ক ফোন করলো কীনা আজকাল আর খুব একটা ভাবায় না সুমিত্রাকে!
দুইদিন আগে হঠাৎ অর্কর ফোন- আবার সব ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল। পাঁচ বছর পর ও নাকি ফিরছে। দিন সাতেক থেকে আবার ফিরে যাবে সুইডেন। গা টা মুছতে মুছতে নিজের মনেই বললেন “আবার কি স্বার্থ নিয়ে আসছে কে জানে !”
“হুলো তোর! তাড়াতাড়ি বেরো কেনে!” দরজায় ধাক্কা দিয়ে চলেছে পাগলিটা, মোটে তিষ্টোতে দেয় না। আজ ভাস্করের মৃত্যু দিন, প্রতি বছর আজকের দিনে ভাস্কর যা যা ভালোবাসতো খেতে সব রান্না লক্ষ্মী নিজে হাতে করে আশ্রমের বাচ্চাদের খাওয়ায়, স্টেশনের সামনে ফুটপাথে থাকা সবাইকে দিয়ে আসে। খুব জমজমাট এই দিনটা ।
যেমন বাবুর বাবা ধুস! কি যে ভাবে সুমিত্রা!লক্ষ্মী লাজুর বাবা পছন্দ করতেন সেরকম আয়োজন করা হয়। সন্তানদের নাম পরিবর্তন করাতে কিছুটা খারাপ লাগলেও মনে মনে সুমিত্রা বেশ খুশি, শান্তি হয় এটা ভেবে পরের মেয়েদুটো জিতিয়ে দিল ওনাকে। অশিক্ষিত গ্রাম্য পরিবেশ জিতে গেছে শিক্ষিত সমাজের কাছে।
***
“মা ভালো আছো? “-কাঁধে ব্যাগ ,হাতে চার বছরের রায়ানকে নিয়ে আজ পাঁচ বছর পর ফিরলো অর্ক। চেয়ারে বসে টুপি বুনছেন সুমিত্রা । এই আশ্রমে প্রায় গোটা চোদ্দ বাচ্চা থাকে। সবার জন্য টুপি বানাচ্ছেন উনি। শীত পড়ার অনেকটা আগে শুরু করেছেন। জানেন না আদৌ শেষ হবে কিনা। ডাক শুনে মুখ তুলতেই অবাক সুমিত্রা এ কাকে দেখছে ! এ তো একদম পঁয়ত্রিশ বছরের ভাস্কর। বুকটা মুচড়ে উঠলো সুমিত্রার। নিজের ছেলেকে কতদিন পর দেখছে! অর্ক অনেকটা মোটা হয়েছে আর তাতে ওকে ভাস্করের মত লাগছে! ছেলের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে খেয়াল করেনি ওর হাত ধরে আছে ওর বহুদিনের কাঙ্খিত – ওর নাতি!
চেয়ার ছেড়ে উঠে সোজা চলে গেল সুমিত্রা নাতির দিকে । নাতিকে জড়িয়ে ধরলো বুকে । হোক না অসুস্থ্ এ যে বহুদিনের শখ! বাবুর ছেলেকে বুকে আঁকড়ে বাঁচবে। বাচ্চাটারও মুখে কি হাসি! দেখে মনে হোলো কখনো কেউ এভাবে আদর করেনি কোনোদিনও। সুমিত্রা দেখেছে বাচ্চারা এমনিতেই ভালোবাসাটা বোঝে আর এই ধরণের বাচ্চারা যেন ভালোবাসার কাঙাল কারণ ছোট থেকে ওদের ভালোবাসার লোকের বড়ো অভাব! দেখছে তো সুমিত্রা!
উঁকি মেরে সুমিত্রা বললো ” মোহর কি ওই বাড়িতে উঠেছে! ” তাড়াতাড়ি ভুল ভাঙানোর ভঙ্গিতে বললো অর্ক ” না মা ও আসেনি, শরীরটা ভালো নেই গো !”
“কি হয়েছে? “-সুমিত্রা গলায় চিন্তা ফুটিয়ে জিজ্ঞেস করতেই অর্ক বললো ” মা একটু রেস্ট নেবো, তারপর সব বলছি। ” সুমিত্রা ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে বললেন ওপরে তোর ঘরটা রাখা আছে, গিয়ে বিশ্রাম কর। আমি চা জল পাঠাচ্ছি। বলেই লাজু বলে ডেকে উঠলো সুমিত্রা , আজ আর অর্ক লাজুকে পাশাপাশি রাখতে অসুবিধা নেই ওনার।
লাজু নামটা শুনেই ইতস্তত করতে থাকলো অর্ক। সুমিত্রা বললেন ” তুই যা, আমার দাদুভাই আমার কাছেই থাক এখানে!” যেন এটাই চাইছিলো অর্ক শুনেই বড় বড় পা ফেলে ওপরে চলে গেল। যেতে গিয়ে দেখলো বাড়িটা সামনের দিকটা পার্টিশন করে দেওয়া পিছন দিকে ওপরের দুটো ঘর আর নিচের দুটো ঘর। সামনে আশ্রম। আজ এই বাড়িতে ঢুকে সেই আগের সুখটা আর পাচ্ছে না অর্ক ।সবকেমন বদলে গেলো , কত সুন্দর হতে পারতো সবটা ।জীবনের সব হিসেব গুলোই এখন মনে হয় মিললো না! সব পেলো – নিজের ভালোবাসার মানুষ, ছেলে, বিদেশ ভ্রমণ, মোটা টাকা কিন্তু তাও যেন কিছু নেই!
নিজের ঘরে ঢুকে অর্ক দেখলো একদম পরিপাটি করে গোছানো । এতদিন যে কেউ ছিল না বোঝা যাচ্ছে না। ফ্যানটা অন করে বসে কিছুটা জিরোতেই শুনলো-
” আসবো ?” -গলা শুনে ঘাড় ঘোরাতেই দেখলো দরজার সামনে লাজু দাঁড়িয়ে । তাকিয়ে অবাক হয়ে গেলো অর্ক , আজও মেয়েটা একই আছে , ওরকমই সুন্দরী ।
“এসো” – বলতেই ঢুকে খাটের পশে রাখা টেবিল চা , জল , লুচি তরকারি রেখে চলে যেতে যাবে ঐসময় অর্ক বললো “ভালো আছো ?” ঘাড় নাড়িয়ে দাঁড়িয়ে রইলো লাজু। সারাদিন কলকল করা মেয়েটা কেমন থমকে গেছে , দেখে যে কেউ অবাক হয়ে যাবে ।
এই হয়তো মেয়েদের মন , আজও কিছু না পেয়ে যার নাম করে সিঁদুর পরে সে আজ ওর সামনে , কি করে উদাস না হয়ে পারে লাজু তা সে যতই গেঁয়ো অশিক্ষিত হোক ! অর্কর চোখে তো লাজু এরকমই একটা মেয়ে! ওর চোখে তো শিক্ষিত মোহর! যার মোহে আজ সব পেয়েও কিছু পায়নি অর্ক! ওর উচ্চাকাঙ্খার সাথে পাল্লা দিতে দিতে ক্লান্ত এখন অর্ক।
অর্কর চোখ পড়লো লাজুর লাল রঙের সিঁথিতে। আর এটা দেখে যেন মরমে মরে যাচ্ছে ও । আজ একে নিয়ে থাকলে বোধহয় জীবনটা এতো জটিল হতো না ! একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো “মার শরীর ভালো আছে তো ? আর লক্ষ্মীদি ? এসে দেখলাম না তো !” লাজু বললো ” মা ভালো টো আছে রে , তুই চিন্তা টো করিস লাই , আর লুকখি দিদি টাই তো তোর জন্য এতো কিছুটো বানালোক রে । আসবেক ঠিক তোর কাছে।” বলে আর দাঁড়ালো না লাজু । দাঁড়ানোটা ওর জন্য ক্ষতি বুঝেই হয়তো পালালো !
দুপুরে খাবার টেবিলে অর্ক আর সুমিত্রা বসে , লাজু ছেলেটাকে খাওয়াচ্ছে আর লক্ষ্মী খেতে দিচ্ছে । অর্ক বুঝলো এই সময়েই কথাটা সেরে ফেলতে হবে ।” মা এই আশ্রম ঘুরে দেখলাম । ভালোই করেছো ! এখানে এসে রায়ান কত খুশি !” সঙ্গে সঙ্গে কথার পৃষ্টে কথা জুড়ে দিয়ে সুমিত্রা বলে উঠলো ” রায়ান বেশি খুশি লাজুকে পেয়ে। “কিছুক্ষণ ঘরটা চুপচাপ থাকা জরুরি তাই হয়তো কেউ কিছু বললো না , আবার অর্কই শুরু করলো ” লক্ষ্মীদির হাতের এই পোস্ত উফ , বড্ড মিস করি ।”
লক্ষ্মী গদগদ হয়ে আর কিছুটা পাতে দিয়ে দিল, নিজের কথা ভাবলো কিনা কে জানে ! সুমিত্রা জানে এটা ওর ভাগেরটাই গেলো!
” বলছি মা !” চিবোতে চিবোতে এই বলছি মা শুনেই বুঝে গেছে সুমিত্রা এবার বোমটা ফেলবে ওর ছেলে । মনে মনে প্রমাদ গুনতেই শুরু করলো অর্ক “,মা আমি এই হোমে কিছু ডোনেট করতে চাই ।” শুনেও যেন নিশ্চিন্ত হলো না সুমিত্রা, তাও বললো- ” ভালো তো , ঘোষ জেঠুর সাথে কথা বল “খেতে খেতেই মাথা নাড়ালো অর্ক , বুঝে উঠতে পারলো না মোহরের কথাটা লাজুর সামনে বলা ঠিক হবে কিনা , ভাবতে গিয়েই মুখ ফসকে বলেই ফেললো ” মা মোহর আবার প্রেগনেন্ট , এইবার খুব রেস্টে না থাকলে এটাও সমস্যা হতে পারে তাই তুমি রায়ানকে রেখে দাও , তোমার এই হোমে ও বেড়ে উঠুক । ” একটা কিছু বিস্ফোরণ হবে জানতো সুমিত্রা কিন্তু এ আশাতীত ।
মনে যাই থাক মুখে বলে দিল “সম্ভব না ” এতো সোজা উত্তর হয়তো ঘরের কেউ আশা করেনি , এতো সোজা উত্তর যে তার ওপর অর্ক কিছু বলার সাহসটাও পেলো না ।অর্ক খেয়ে নিজের ঘরে চলে যেতেই লাজু সুমিত্রার পায়ে পড়ে গেলো ” মা , রিখে দিনা উকে ,ওর লিজের মাটো পারবেকলাই সামালতে ! আবার একটা আসলি এর কি হবেক মা ? আমি তো কিছুটি চাইনি তুর কাছে । দে না কেনে এই ছিলেটাকে ! দে না মা । আর কিচ্ছুটি চাইবোক লা তুর থিকে ।” বলতে বলতে কেঁদে চলেছে লাজু ।
দরজায় দাঁড়িয়ে লক্ষ্মী, হাপুস নয়নে কেঁদে যাচ্ছে । অবলা আর সবলা যাই হোক ভালোবাসাটা সবাই বোঝে । এসে থেকে লাজু যেভাবে বাচ্চাটাকে কাছে টেনে নিয়েছে ও যেন লাজুর চোখের জল সহ্য করতে না পেরে ঘরময় ছোটাছুটি করে বেড়াচ্ছে । হঠাৎ অর্ক এসে বললো “লাজু, ওকে একটু রেডি করে দাও ,আমরা ওর মামাবাড়ি যাবো ” লক্ষ্মী বোধহয় কিছু আঁচ করতে পেরে বললো ” এই সময় ওখানে যাবে? কাল ভোরে !” অর্ধেকেই থামিয়ে অর্ক বললো ” না লক্ষ্মীদি ওর দিদা দাদুকে বলে দেখি যদি ওরা রাখে ! ওর ব্যবস্থা করে আমি ফিরবো , তোমরা সব জানো লক্ষ্মীদি ,তোমাদের লুকিয়ে লাভ নেই , নতুনটাকে সুস্থ করতে গিয়ে মোহর কিছুতেই ওকে বাঁচতে দেবে না ।”
গলাটা ধরা লাগলো অর্কর ।বাঁচতে দেবে না শুনে বাচ্চাটাকে জড়িয়ে আর জোরে কেঁদে উঠলো লাজু । শুধু সুমিত্রা এখনো কপালে হাত দিয়ে শুয়ে আছে । “যাও রায়ান রেডি হও” – অর্কের গলায় এমন কিছু ছিল যাতে ছুটে গিয়ে পায়ে পড়লো লাজু ” উকে আমার কাছে দিয়ে যা কেনে ! আর কিচ্ছুটি চাইবোক না , ” তারপর রায়ানকে জড়িয়ে বললো “তুই আমার কাছে থাকতেক চাস না ? তোর লাজুমার কোলটাতে থাকতেক চাস না ? ” কিচ্ছু বুঝতে না পেরে লাজুর বুকে মুখ রেখে কেঁদে যাচ্ছে রায়ান । আস্তে আস্তে উঠে বসলো সুমিত্রা! খুব ক্ষীণ কিন্তু দৃঢ় ভাবে বললেন
” রাখতে পারি , কিন্তু খাতায় কলমে ওর গার্জিয়ান হবে লাজু , লাজু রায় । আর কোনোদিনও কোনোভাবে এর অধিকার চাইতে আসবে না তোমরা ।” যদি রাজি থাকো এই কদিনে সব ব্যবস্থা করে যেও ।
*****
সব কাজ সেরে আজ ফেরার দিন অর্কের , সব কাজ মোটামুটি গুছিয়ে এনেছে , বাকিটাতে ওর উপস্থিতি না থাকলেও হবে , ছেলেটাও যেন অনেকটা সুস্থ , ওর জীবনে ভালোবাসার বড্ড অভাব ছিল । লাজু যেভাবে ওকে আগলে রেখেছে আর চিন্তা নেই অর্কের । যাওয়ার আগে একবার ডাকলো লাজুকে – “লাজু তোমার কাছে আমার ঋণের শেষ নেই , আজ আমি চলে যাচ্ছি জানিনা আর দেখা হবে কিনা ! তোমাকে কিছু দিতে খুব ইচ্ছে করছে । কিছু চাওয়ার থাকলে চাইতে পারো।”
অর্ক ভেবেছিলো মেয়েটা কিচ্ছু বলবে না কিন্তু মুখ খুললো লাজু ” দিবি?” অর্ক ভয়ে ভয়ে মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বললো । ” দাঁড়া কিনে !” বলেই লাজু ছুটলো। ফিরে এলো পাঁচ মিনিটের মধ্যে হাতে সিঁদুর কৌটো।
” দি কেনে আর একবারটি পরিয়ে ” অর্ক একটুও থামলো না , দুই আঙুলে তুলে রাঙিয়ে দিল লাজুর সিঁথি । লাজু বসে পড়ে অর্কর পা দুটোতে হাত দিতেই ওকে উঠিয়ে বুকে টেনে কপাল এঁকে দিল বৌয়ের স্বীকৃতি কানে কানে বললো ” ভালো থেকো ”
কেউ না খালি ঘরের চার দেওয়াল সাক্ষী হয়ে রইলো এই শুভমুহূর্তের । না আর দেখা হয়নি ওদের! লাজুও সারাজীবনে আর কিচ্ছু চায়নি! সুমিত্রাও মারা গেছে তিন বছর হলো! না অর্ক আসার সুযোগ পায়নি! পৃথিবী জুড়ে তখন করোনা থাবা বসিয়েছে! তাতেই সুমিত্রা টিকতে পারেনি!
এখন লক্ষ্মী, লাজু আর রায়ান তিনজনে একসাথে থাকে! সাথে রোমি আরও অনেকে আছে! ওদিকে অর্ক আর মোহর খুব খুশি ওদের একটা ফুটফুটে ছেলে হয়েছে! এইটুকুতেই খুশি লাজু। আর যাই হোক ওরা রায়ানকে নিতে আসবে না!
লাজু স্নান করে সিঁথিতে সিঁদুর পরতেই দেখলো রায়ান জল ঘাঁটছে! ও চিৎকার করে বললো
” দাঁড়া কিনে, আসছি আমি! লাজু মা টাকে চিনিস লাই তুই!”
খিল খিল করে হাসছে রায়ান! আর এতেই বেঁচে আছে লাজু! লাজবন্তী সোরেল, না না লাজবন্তী রায়!
সমাপ্ত