শুভ্ররাঙা ভালোবাসা পর্ব-৩৬+৩৭+৩৮

0
226

#শুভ্ররাঙা_ভালোবাসা
#তানিয়া_মাহি(নীরু)
#পর্ব_৩৬

” স্যার আমি আপনাকে বিয়ে কেন করব? মা গতকাল বলল আমার নাকি এখন থেকে কোথাও গেলে আপনার সাথে যেতে হবে?”

সাহিল বাইকে উঠে বসতেই ফাউজিয়ার কথা শুনে তার দিকে ফিরে তাকায়। চারপাশে একবার তাকিয়ে দেখে ফাউজিয়াকে জিজ্ঞেস করে, ” আপনার কি অমত আছে? আপনি কাউকে পছন্দ করেন?”

সাহিলের প্রশ্নটা একটু অন্যরকম লাগে ফাউজিয়ার কাছে। সাহিলের কথায় স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে তিনিও হয়তো এই বিষয়টায় অবগত।

ফাউজিয়া গলার স্বর নিম্ন করে বলে, ” সেটা নেই কিন্তু স্যার আপনি তো আমার স্যার। আপনার সাথে আমার বিয়ে কীভাবে সম্ভব হবে বলেন? ডিপার্টমেন্টে জানাজানি হলে তো কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে।”

” কেলেঙ্কারি কেন হবে? আমরা তো বিয়ে নামক পবিত্র সম্পর্কে জড়াবো, আপনার কীসের?”

” আপনি আমাকে পছন্দ করেন? প্রথমদিকে আপনার চালচলন দেখে মনে করেছিলাম আপনি শুভ্রতাকে….”

ফাউজিয়াকে থামিয়ে দিয়ে সাহিল শেখ বলে ওঠে, “শুভ্রতা আমার মৃ*ত বোনের নাম।”

ফাউজিয়া সাথে সাথে থমকে যায়, মনে হয় শীতল একটা হাওয়া বয়ে গেল তার ওপর দিয়ে। বাইকে ওঠার কথাই সে ভুলে গেছে। সাহিল তাকে জানায় তার ছোট বোনের নাম ছিল শুভ্রতা। সে সাহিলের আট বছরের ছোট ছিল। সে যদি বেঁচে থাকতো তাহলে প্রায় ফাউজিয়ার সমবয়সী হতো নয়তো দুই এক বছরের ছোট হতো। শুভ্রতার বয়স যখন ছয়, তখন গ্রামের বাড়ি পুকুরে গোসল করতে নেমেছিল সাহিল। শুভ্রতা ছিল ভাইভক্ত, পুকুরের ওপাশে সাহিলসহ অনেকে গোসল করছিল আর শুভ্রতা ভাইয়ের কাছে যেতে পুকুরে নেমেছিল। গোসল করে ওঠার সময় বোনকে নিজের চোখে ভাসতে দেখেছিল সে। ফাউজিয়া বুঝতে পারে সাহিলের কথায় পরিবেশ অন্যরকম হয়ে যাচ্ছে। ফাউজিয়া সাহিল শেখের নিরবতা ভেঙে বলে ওঠে, ” স্যার, শুভ্রতা কল করছে আমাদের রওয়ানা দিয়ে দেওয়া উচিৎ বোধ হয়।”

” হুম। উঠে বসুন, সমস্যা হলে কাধ ধরে বসতে পারেন।” সাহিল ছোট করে কথার সমাপ্তি ঘটিয়ে ফাউজিয়া উঠে বসতেই বাইক চালানো শুরু করল।

রাত আটটা বাহিরে হৈচৈ শোনা যাচ্ছে। ফাউজিয়া বসে বসে শুভ্রতাকে মেহেদী পরিয়ে দিচ্ছিল। বাহিরের উঠোনে সবাই বসে আছে, আগামীকালের রান্নার জন্য পেয়াজ,রসুন কাটছে মশলা বাটছে। দুই বাড়ির অনুষ্ঠান একদিনেই হবে বলে কথা। শাকিরাও কাজ করছিল, রায়হান বাহিরে থেকে এসে পুকুরপাড়ের সিড়িতে গিয়ে বসতেই সুযোগ বুঝে শাকিরাও সেখানে চলে গিয়েছে। ফাউজিয়া আর শুভ্রতা রুমে বসে মোবাইলে গান ছেড়ে গল্প করছে আর মেহেদী দিচ্ছে। শুভ্রতা এতক্ষণে জেনে গিয়েছে সাহিল স্যারের সাথে ফাউজিয়ার বিয়ের কথা চলছে। শুভ্রতাও পরামর্শ দিয়েছে বিয়েটা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব করে নেওয়াই ভালো। ফাউজিয়াও জানায় সে এই বিষয়ে ভেবে দেখবে৷ শুভ্রতা আর ফাউজিয়ার কথাবার্তার মাঝে দরজায় নিহান এসে দাঁড়ায়। গলা খাঁকারি দিতেই ফাউজিয়া পিছনে ফিরে তাকায়। শুভ্রতা নিহানকে দেখেই লজ্জায় চোখ বন্ধ করে কপাল আর চোখ হাত দিয়ে ঢেকে নেয়। ফাউজিয়া নিহানের দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে শুভ্রতার দিকে তাকায়। শুভ্রতার লজ্জামাখা মুখ দেখে তার ভীষণ হাসি পাচ্ছে। শুভ্রতার দিকে তাকিয়েই বলে, ” তোরা কথা বল, আমি আম্মুর সাথে কথা বলে আসছি।”

ফাউজিয়া বেরিয়ে যেতেই নিহান মাথা চুলকাতে চুলকাতে শুভ্রতার দিকে এগিয়ে আসে। নিহানকে ভেতরে আসতে দেখে শুভ্রতা তাড়াহুড়ো করে বিছানা থেকে নেমে দাঁড়াতে গিয়ে শাড়ির আঁচল হাতের মেহেদীর ওপর পড়ে যায়। শুভ্রতা সেটা ডান হাতে দুই আঙুল দিয়ে তুলতে যাবে তখনই নিহান সেটা মাথায় তুলে দেয়।

” এখন সুন্দর লাগছে, একদম বউ বউ লাগছে।”

” আপনি এখানে আসতে গেলেন কেন?”

শুভ্রতার প্রশ্নের কোন উত্তর না দিয়ে সে পাঞ্জাবির পকেট থেকে কিছু একটা বের করতে লাগলো। শুভ্রতা এতক্ষণে খেয়াল করল নিহান নীল রঙের পাঞ্জাবি পরে তার সামনে এসেছে। বলিষ্ঠ দেহে আটসাট নীলরঙা পাঞ্জাবিতে নিহানকে অসম্ভব সুন্দর দেখাচ্ছে। শুভ্রতা অনুভব করে নিহানকে তার ভালো লাগতে শুরু করেছে। শুভ্রতা অনিচ্ছায় বলে ওঠে, ” শুনুন আপনাকে নীল পাঞ্জাবীতে সুন্দর লাগছে।”
শুভ্রতার কথায় নিহান মুচকি হাসে, প্রিয় মানুষের নজরে সুন্দর হতে কে না চায়! প্রিয় মানুষটি যখন তার বিষয়ে ভালো লাগার কথা বলে এরকম সুন্দর অনুভূতি হয়তো পৃথিবীতে আর নেই।

হাতের দিকে খেয়াল করতেই শুভ্রতার মনটা খারাপ হয়ে যায়, নিহানকে প্রশ্ন করে ওঠে,” আপনি ঘড়িটা আজ পরেছেন কেন? আমি তো নেহাকে বলে দিয়েছি ঘড়িটা আগামীকাল রাতে পরার কথা।”

নিহান নিজের হাতের ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলে, ” কোন ঘড়ি?”

” আপনার হাতে যেটা আছে ওটা নেহা দেয় নি?”

” না, এটা তো আমি এখানে আসার আগে কিনেছিলাম।”

শুভ্রতা কপালে দিয়ে বসে পড়ে। কপালে মেহেদীর দাগ পড়বে ভেবে তাড়াতাড়ি হাত সরিয়ে নেয়। নিহান কিছু বুঝতে না পেরে আবার জিজ্ঞেস করে, ” কোন ঘড়ির কথা বলছিলে তুমি?”

শুভ্রতা নিহানের দিকে একবার তাকিয়ে আবার চোখ সরিয়ে নিয়ে বলে, ” আপনার জন্য আজ একটা ঘড়ি কিনেছিলাম, নেহার কাছে দিয়ে বলেছি কাল পরতে। ঘড়িটা বোধ হয় এরকমই হবে।”

” আচ্ছা পরব। এবার আমার কাছে একটু এগিয়ে আসা যাবে কি?”

” কেন?”

নিহান হাতের প্যাকেট থেকে একটা ছোট গলার হার বের করে শুভ্রতার সামনে মেলে ধরে। শুভ্রতার হারটা চিনতে একটুও কষ্ট হয় না। বাড়ির সবাই যখন বিকেলে কিছু কেনাকাটা করতে বের হয়েছিল তখন স্বর্ণের কিছু গহনাও কিনে। নিহানের আগে থেকেই নিষেধ ছিল শুভ্রতা যা যা নেবে সবকিছুর খরচ নিহান বহন করবে। বাড়ির সবার জন্য কিছু না কিছু নেওয়া হয় বিধায় অনেক টাকা খরচ হয়ে যায়। বিয়েটা যদিও পারিবারিকভাবেই হচ্ছে তবুও কেনাকাটা করতে গেলে কম কেনা হয় না বরং প্রয়োজনের চেয়ে বেশিই হয়ে যায়। শুভ্রতা ছোটবেলা থেকেও মিতব্যয়ী তাই কয়েকটা স্বর্ণের জিনিস কেনা হয়েছে বলে তার খুব পছন্দ হওয়া হারটার কথা কাউকে জানানো হয়নি। নিহানের চোখ হয়তো সেটা এড়িয়ে যায় নি তাই সে হারটা নিয়েই এসেছে। নিহানকে সে যতই চিনতে শুরু করেছে ততই সে অবাক হচ্ছে। একটা মানুষ সবদিকে এত নজর কীভাবে রাখতে পারে!

শুভ্রতা নিহানের দিকে এগিয়ে যায়, সামনে দাঁড়াতেই নিহান বলে, ” আমি পরিয়ে দিই?”

” হুম।”

নিহান শুভ্রতার মাথা থেকে ঘোমটা নামিয়ে হারটা পরিয়ে দেয়। শুভ্রতাকে আয়নার দিকে এগিয়ে নিয়ে গিয়ে বলে, ” দেখো তো আয়নায় কাকে দেখতে পাচ্ছো, নিজেকে নাকি আমার শুভ্রাকে? আমার মানুষটাকেই নিশ্চয়ই দেখছ। অসম্ভব সুন্দর না বলো? আমি আমার মানুষটাকে পুতুলের মতো আমার মনে সাজিয়ে রাখব। যেখানে আর কারও উপস্থিতি নেই। ”

শুভ্রতার চোখ টলমল করছে, মুখে কোন কথা নেই। নিহান বলে ওঠে, ” এই এই এই একদম কাঁদবে না। আমার প্রিয় মানুষের চোখের কাজল চোখের পানিতে লেপ্টে যাওয়ার নয়। ”

” আপনি এত ভালো কেন নিহান..…”

” এই একদম ভাই বলবি না। সবসময় এই নিহান অবধি এসেই আটকে যাবি। মুখ দিয়ে যদি কখনো….”

নিহানের মুখের অবস্থা দেখে শুভ্রতা ফিক করে হেসে দেয়। নিহান আয়নার দিকে তাকিয়ে শুভ্রতার হাসি দেখছে। নিহান শুভ্রতাকে তার দিকে ফিরিয়ে নেয়। মেয়েটা তখনও হাসছে। এমনভাবে হাসছে যেন সে খুব হাসির কোন জোকস শুনিয়েছে। মেয়েটার কপালে একটা চুমু দিতে পারলে হয়তো নিহানের শান্তি লাগতো। নিহান শুভ্রতার দিকে বাঁকা হতেই শুভ্রতা পিছনে সরে যায়। নিহান ভ্রু উঁচু করে জানতে চায় কি হয়েছে?

” আমরা বিবাহিত নই। প্রথম স্পর্শটা হালাল হলে ক্ষতি কি?”

” হুম।”

নিহান বুঝতে পারে সে একটা ভুল করতে যাচ্ছিল। এত বছর যার জন্য অপেক্ষা করেছে তার অপেক্ষায় যে আর এই কয়েকটা ঘণ্টাই যেতে চাইছে না সেটা সে শুভ্রতাকে কি করে বোঝাবে!

নিহান অসহায়ের মতো আবার বলে, ” আ’ম স্যরি শুভ্রা, আমি আসলে….”

” আমি বুঝি। ”

” হ্যাঁ? ”

” আমি হয়তো আপনাকে বুঝতে শুরু করেছি।”

” কেউ হয়তো আসছে এদিকে, আমি যাই তবে। গলার ওটা পরেই থাকো, খুলে রেখো না। এটা আমার পক্ষ থেকে তোমার জন্য উপহার।”

” কালকের উপহার পাব না?”

” কালকে সবার সামনে, সবাইকে সাক্ষী রেখে পুরো ‘আমি’টাকেই দিয়ে দেব, হবে না?”

” খুব হবে।”

নিহান রুম থেকে চলে গিয়ে আবার ফিরে আসে, তৎক্ষনাৎ ফিরে আসতে দেখে শুভ্রতা জিজ্ঞেস করে, ” আবার কি হলো?”

” খোপায় দেওয়ার জন্য ফুল এনেছিলাম, রেখে দাও। ফাউজিয়া আসলে খোপায় বেধে নিও, আর কয়েকটা ছবি দিও প্লিজ৷ আজ তো আর দেখতে পাব নাহ। ”

শুভ্রতা মুচকি হেসে বলে, ” ঠিক আছে এবার যান।”

চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়িয়ে আবার পিছনে ফিরে তাকায় নিহান। বলে ওঠে, ” আচ্ছা তোমার কোনভাবে মনে হচ্ছে না তো যে আমি তোমার জন্য সঠিক নই?”

শুভ্রতা মুখে হাসির রেখা টেনে বলে, ” আপনাকে আমি নই, আমার আল্লাহ পছন্দ করেছেন, তিনি আমার জন্য সঠিক মানুষকেই রেখেছেন। এই মানুষের ভালোবাসা কখনো ভুল হতে পারে না।”

মিনিট বিশেক আগে আমজাদ সাহেবের পরিবার বিয়ে বাড়ি এসে পৌঁছেছে। সাফিয়া বেগম মেয়েকে বারবার বলে দিয়েছেন বিয়ে বাড়িতে যেন কোন ঝামেলা সে না করে। ইরাও মায়ের কথা বাধ্য মেয়ের মতো মেনে নিয়েছে তবুও সাফিয়া বেগম ভীত হয়ে আছেন। এই একটা সময়ে এসে তিনি নিজের মেয়েটাকেও বিশ্বাস করে উঠতে পারছেন না। তিনি সিদ্ধান্ত নেন মেয়েটাকে চোখে চোখে রাখতে হবে।

ইরা ফ্রেশ হয়ে শুভ্রতার কাছে যাওয়ার কথা জানালে সাফিয়া বেগম বলেন, ” দুই মিনিট অপেক্ষা করো আমিও যাব।”

” তুমি চিন্তা করো না আম্মু, আমি তোমাকে কথা দিচ্ছি আমি বিয়েতে কোনরকম সমস্যার সৃষ্টি করব না। আমি জানি তুমি আমাকে বিশ্বাস করে উঠতে পারছো না। আমার খারাপ লাগছে কিন্তু আমাকে ভরসা করতে পারো। ”

সাফিয়া বেগম মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দেন। মেয়েটা গাড়িতেও কান্না করেছে খুব। তারা সিদ্ধান্ত নিয়েছিল বিয়েতে আসবে না কিন্তু ইরার জোরাজুরিতে আসতেই হলো। ইরা বুদ্ধিমতী মেয়ে, সে যেহেতু বলেছে তাহলে খারাপ কিছু করবে না বলে সাফিয়া বেগমের বিশ্বাস।

রাত নয়টা পয়ত্রিশ, ফাউজিয়া শুভ্রতার হাতে মেহেদী দেওয়া শেষ করে বসে বসে নিজের হাতে মেহেদী নিচ্ছিল। বিয়ে আর ঈদ, হাতে মেহেদী ছাড়া জমেই না।
ফোন বেজে উঠলে স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে দেখে সাহিল ফোন দিয়েছে। ফাউজিয়া ফোনটা নিয়ে বাহিরে চলে যায়৷ ফাউজিয়া বাহিরে যাওয়ার সাথে সাথেই ইরা রুমে প্রবেশ করে। ইরাকে দেখে শুভ্রতার মুখে হাসি ফুটে যায়।

” আরে ইরা! কখন এসেছিস?”

” এই তো আধাঘণ্টা হবে হয়তো। কেমন আছো বিয়ের কনে?”

” এই তো আলহামদুলিল্লাহ। তোকে কি বলে সম্বোধন করব বল, আমার বোন নাকি ননদ?”

” বোনই বলো, আমি তোমার বোনই তো হই। নিহান ভাইয়া কোথায়? তাকে তো দেখলাম না!”

” বাসায় হয়তো আছে। বাসায় গেলেই পাবি হয়তো।”

” এতরাতে অন্যজনের হবু বরের সাথে দেখা করা কি ঠিক হবে? থাক কালকেই দেখা করব।”

” তুই ও না…”

ইরা আর শুভ্রতা কথা বলছে, ফাউজিয়াও এসে তাদের সাথে যোগ দেয়। ফাউজিয়া এসে বলে, ” কি রে শাকিরা এলো না তো?”

শুভ্রতা ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলে, ” দশটা বাজতে দে, শাকিরা, নেহা, আবিরা আপু, স্নিগ্ধা সবাই চলে আসবে। আজ সবাই এখানেই থাকবে, ইরা তুইও এখানে থাকবি আজ।”

ইরা মাথা নেড়ে সম্মতি জানায়। তিনজন কথা বলছে এমন সময় ইরা বলে, ” আপু তোমার ফোন বাজছে হয়তো।”

শুভ্রতা আশেপাশে হাতড়ে ফোন খুঁজে পায় না। ফাউজিয়া টেবিলের ওপর ফোন দেখতে পেয়ে শুভ্রতার দিকে এগিয়ে দেয়। শুভ্রতা ফোন হাতে নিয়ে স্ক্রিনে তাকিয়ে দেখে আবার সেই অচেনা নম্বর।

#চলবে…..

#শুভ্ররাঙা_ভালোবাসা
#তানিয়া_মাহি(নীরু)
#পর্ব_৩৭

আজ শুভ্রতার বিয়ে। পার্লার থেকে দুইটা মেয়ে এসেছে তাকে সাজাতে। শুভ্রতা এমনিতেই এক কথায় শুভ্রপরী, বউসাজে তাকে অত্যাধিক সুন্দর লাগবে এটা বলার অপেক্ষা রাখে না। শুভ্রতার মা মাঝে মাঝে এসে দরজায় দাঁড়িয়ে উঁকি দিয়ে মেয়েকে দেখে দেখে যাচ্ছেন। মেয়ের হাসিমাখা মুখ দেখ আনন্দে তার চোখও টলমল করছে। শুভ্রতার সাজ প্রায় কমপ্লিট, মেয়েকে দেখে অস্ফুট স্বরে বলে ওঠে ‘মাশাআল্লাহ’।

ইরা এদিক ওদিক ঘুরছে, নিহানকে সে কোথাও খুঁজে পাচ্ছে না। এই বিয়ের পরিবেশ তাকে কাটারঞ্জিত গোলাপের ন্যায় কষ্ট দিচ্ছে। নিজের মনের কথাগুলো বলতে না পেরে গ***লা কা***/টা মুরগির মতো ছটফট করছে। নিহান বাড়িতেই থাকার কথা। একটু পরেই হয়তো তৈরি হয়ে শুভ্রতাদের বাড়িতে যেতে হবে। বাড়ির সবাই কোন না কোন কাজে ব্যস্ত। সবার চোখ ফাঁকি সে নিহানের রুমে প্রবেশ করে। রুমটা ভীষণ পরিপাটি, ফুল দিয়ে সাজানোও হয়েছে। প্রিয় মানুষের বিয়ে, রুম সাজানো দেখে ইরার ভীষণ কান্না পাচ্ছে। অন্যদিকে তার বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করছে যে নিহানকে তার মনের কথা জানালে নিহান হয়তো এই বিয়ে করবে না। আজ কেমন স্বার্থপর লাগছে নিজেকে। লাগুক! নিজের ভালোর জন্য মাঝেমধ্যে একটু স্বার্থপর হতে হয়।

নিহান ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে বিছানায় ইরাকে বসে থাকতে দেখে একটু অবাক হয়। ইরা বিছানায় হাত বুলিয়ে এদিক ওদিক দেখছে। নিহান ওয়াশরুম থেকে বেরিয়েছে সেটা সে খেয়াল করে নি। নিহান তাড়াতাড়ি করে টিশার্ট পরে নেয়। মাথাটা ভালো করে মুছতে মুছতে ইরার দিকে এগিয়ে এসে বলে,
” কি রে তুই এখান কি করছিস?”

নিহানের উপস্থিতিতে ইরা বেশ চমকে ওঠে। বিছানায় বসা থেকে দাঁড়িয়ে যায়। দরজার দিকে এগিয়ে গিয়ে দরজা ভেতর থেকে লক করে দেয় যেন কেউ বিরক্ত না করে কথার মাঝে। ইরার কান্ড দেখে আরেকবার অবাক হয় নিহান।

” দরজা কেন আটকাচ্ছিস তুই?”

ইরা চকিতে বলে উঠল, ” আমি আপনাকে ভালোবাসি নিহান ভাই।”

” হোয়াট! মাথা ঠিক আছে তোর? ইরা এসব কি হচ্ছে? দরজা খুলে দে, তুই এক্ষুণি রুম থেকে বেরিয়ে যা।”

” প্লিজ একটু শুনুন না।”

” ইরা তুই এখান থেকে বেরিয়ে যাবি এক মিনিটের মধ্যে, তোকে আমি এখানে দেখতে চাই না। দেখতে চাই না মানে দেখতে চাই না।”

ইরা ধপাস করে বিছানায় বসে পড়ে। কিছুক্ষণ মাথা নিচু করে থেকে নিহানের দিকে তাকায়। ইরার চোখে পানি, নিহান অন্যদিকে নজর ফেলে। আরেকবার বলে, ” ইরা তুই এখান থেকে চলে যা, কেউ তোকে আর আমাকে একা রুমে দেখলে খারাপ ভাববে। যখন তখন যে কেউ চলে আসতে পারে।”

ইরা স্বল্পস্বরে চিৎকার দিয়ে বলে, ” আসুক। দেখুক সবাই, কাউকে ভালোবেসে কীভাবে কান্না করতে হয়। প্রিয় মানুষের বিয়েতে বুকে পাথর চেপে রেখে কীভাবে উপস্থিত থাকতে হয়৷ সবাই দেখুক ভালোবাসার কথা জানালে কীভাবে দূর দূর শুনতে হয়। ”

” পাগল হয়ে গেছিস তুই? ভালোবাসার কথা বলতে এসেছিস? আমি আমার কৈশোর থেকে একটা মানুষকেই ভালোবেসে এসেছি। কয়েকটা দিন বা কয়েকটা মাস নয় একেবারে আট নয় বছর। তাকে আমি আজ পেতে চলেছি, আমি তাকে কিছুতেই হারাতে চাই না। সে আমার খুব কষ্টে পাওয়া নারী।”

ইরা কাঁদতে কাঁদতে বলে, ” আমাকে কেন ভালোবাসলেন না নিহান ভাই? আপুর বদলে আমাকে ভালোবাসলে কি হতো? দুনিয়াতে কি যু***দ্ধ লেগে যেত নাকি মানুষ মা***রা যেত? আমাকে ভালোবাসলে কি এমন হতো? শুভ্রতা আপু অত্যাধিক সুন্দর জন্য তাকে ভালোবেসেছেন?”

” ভালোবাসা সবার জন্য আসে না ইরা, পাগলামি করিস না৷ ভালোবাসা জাত, বর্ণ, ধর্ম কিছুই দেখে না। যাকে যার নজরে ভালো লাগে তার প্রতি র*ক্ত কণিকা তৈরির মতো সেকেন্ডে ভালোবাসা তৈরি হয়ে যায়। ”

” আপনাকে অনেক ভালোবাসি নিহান ভাই।”

” ইরা অনেক হয়েছে এবার তুই আমার রুম থেকে চলে যা। তুই নিজে থেকে না গেলে আমি কিন্তু…”

” গলা ধাক্কা দিয়ে বের করে দেবেন?”

” প্রয়োজন হলে তাই করব। তুই এখন যা এখান থেকে আমার রেডি হতে হবে।”

” ভালোবাসার কথা জানাতে এসে সম্মান হারাবো এ কথা মাথায় আসেনি।”

” মানে?”

” কিছু না, আপনার নতুন জীবনের জন্য শুভ কামনা নিহান ভাই। আসছি..”

ইরা আর এক মুহূর্ত দেরি না করে রুম থেকে বেরিয়ে যায়। নিহান একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে রেডি হতে চলে যায়।

শুভ্রতার মা প্লেটে করে খাবার নিয়ে মেয়ের রুমে আসে। শুভ্রতার সাজ কমপ্লিট, এখন একজন চুলটা বেধে দিচ্ছে। আরেকজন ফাউজিয়াকে একটু সাজিয়ে দিচ্ছে। ফাউজিয়াও প্রায় শুভ্রতার মতো ফর্সা, নীল রঙের গাউনে তাকে নীলপরির মতো দেখাচ্ছে। ফাউজিয়ার সাজও প্রায় শেষ।

আয়েশা বেগম খাবারের প্লেটটা নিয়ে শুভ্রতার পাশে বসলেন। শুভ্রতা মাকে দেখে বলে ওঠে, ” মা, বাবা কোথায়? সকালে দেখেছি এরপর আর একটুও দেখিনি৷ বাবা কি খুব ব্যস্ত? একটুও আসলো না যে এদিকে?”

” এখানে তোকে সাজানো হচ্ছে,এর মধ্যে পুরুষ মানুষ কীভাবে আসবে? তুই ক’টা খেয়ে নে আমি তোর বাবাকে পাঠিয়ে দিই। গলার এই হারটা কোথায় পেলি? এটা কি নেওয়া হয়েছিল?”

শুভ্রতা আমতা আমতা করতে থাকে৷ ফাউজিয়া পাশে থেকে বলে ওঠে, ” ওটা নিহান ভাইয়া ওকে গিফট করেছে আন্টি। এটা আপনারা কিনেন নি।”

আয়েশা বেগম মুখে হাসির রেখা টেনে মেয়ের চিবুকে হাত রেখে বলেন, ” খুব সুখী হ’ মা, খুব সুখী হ। ”

একটু থেমে পার্লারের মেয়েদের উদ্দেশ্যে আবার বলেন, ” তোমাদের সাজানো হলে দুজন যাও কিছু খেয়ে নাও। তোমাদের সাজানোর টাকা পেয়েছ তো নাকি?”

দুজনের মধ্যে একজন বলে ওঠে,” জি আন্টি পেয়েছি।”

শুভ্রতার মাথায় বউওরনা দিয়ে মুখের সামনে একটা আয়না ধরে বলে, ” দেখুন তো ম্যাম, কেমন লাগছে আপনাকে?”

শুভ্রতা আয়নায় নিজেকে দেখে। নিজের প্রতি নিজেরই যেন নজদ লেগে যাবে। একটা মেয়ের হয়তো বিয়ে করার চেয়ে বউ সাজার ইচ্ছেটা বেশি, শুভ্রতারও তেমন। আয়েশা বেগম আর ফাউজিয়া শুভ্রতার দিকে এক পলকে চেয়ে রয়েছে। শুভ্রতার সৌন্দর্য্যে কোন খুত যেন চোখে পড়ছে না। আগেও তো অনেক মেয়েকে বউ সাজে দেখেছে, কই এত সুন্দর তো লাগে নি!

পার্লারের মেয়ে দুইটা বেরিয়ে গেলে আয়েশা বেগম মেয়েকে খাইয়ে দিতে থাকেন। ফাউজিয়াকেও ডেকে নেন খাইয়ে দিতে এমন সময় শাকিরা আসে। ওদের দুজনকে খাইয়ে দিতে দেখে শাকিরা কোমরে দুইহাত দিয়ে রাগীভঙ্গিতে দাঁড়ায়, ” কি ব্যাপার কাকী, তুমি আমাকে ভুলে গেলে?”

আয়েশা বেগম হাসতে হাসতে শাকিরাকে ডেকে হাত বাড়ায়।

নেহা ঘড়ি আর ফোন হাতে নিয়ে নিহানের রুমে চলে যায়। নিহান তখন পাঞ্জাবীতে আতর মাখছিল আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে। নেহা গিয়ে পাশে দাঁড়িয়ে ঘড়ি এগিয়ে দিয়ে বলে, ” ভাইয়া এই নাও তোমার ঘড়ি, তোমার হবু বউ দিয়েছে।”

নিহান ঘড়িটা নিয়ে হাতে পরতে পরতে বলে, ” যা এখন।”

” যাব কেন? তোমাকে তোমার বউ দেখাতে এলাম।”

” মানে? শুভ্রা এখানে এসেছে?”

” আরে নাহ, আমি স্নিগ্ধার ফোনে ভিডিয়ো কল দিচ্ছি তুমি দেখো কি সুন্দর লাগছে শুভ্রতা আপুকে। এত সুন্দর বউ আমি কখনো দেখি নি।”

” এখন দেখব না যা, বউকে বিয়ে করতে যেয়েই দেখব। আমার এখন তাড়াতাড়ি রেডি হতে হবে, মা তাড়া দিয়ে গেছে একবার। সবাই বসে আছে আমার জন্য।”

” ঠিক আছে, যাচ্ছি। তবে ভালো একটা জিনিস মিস করলা ভাইয়া।”

” গেলি তুই!”

নেহা চলে গেলে নিহান আলমারি থেকে শুভ্রতার জন্য কিনে রাখা রিং এর বক্সটা পাঞ্জাবির পকেটে নিয়ে নেয়। রাতে রুমে অনেকেই হয়তো থাকবে তাদের সামনে বা শুভ্রতার সামনে গিফট বের করা উচিৎ হবে না।
নিহান রুম থেকে বেরিয়ে যাবে এমন সময় বিছানার ওপর রাখা ফোনটা বেজে ওঠে। নিহান বুঝতে পারে ভুলে ফোন রেখে যাচ্ছিল সে। বিছানার কাছে গিয়ে ফোনটা হাতে নিয়ে রিসিভ করে৷ ওপাশ থেকে কেউ কিছু বললে নিহান বলে ওঠে, ” আচ্ছা সমস্যা নেই ওকে দেখে রেখো, আমি চাচ্ছি না আজকের দিনে কোন সমস্যা সৃষ্টি হোক। এই দিনটা এগিয়ে নিয়ে আসতে অনেক কাঠখড় পো**ড়া*তে হয়েছে আমার। ও কোনভাবেই যেন নজরের বাহিরে না যায়। ”

#চলবে……

#শুভ্ররাঙা_ভালোবাসা
#তানিয়া_মাহি(নীরু)
#পর্ব_৩৮

বিয়ের আসরে বাড়ির সকলে উপস্থিত। বিয়ের আসরটা দুইবাড়ির সামনের বড় উঠোনটায় করা হয়েছে। আবিরা, স্নিগ্ধা, নেহা, শাকিরা, ফাউজিয়া সবাই এক জায়গায় দাঁড়িয়ে বিয়ে হয়ে গেলে কোথায় কীভাবে মজা করবে সেগুলো ঠিক করছে। ফাউজিয়া নতুন হিসেবে একটু অস্বাভাবিক লাগার কথা কিন্তু তাকে কেউ এখানে অন্যরকম অনুভব করতে দিচ্ছে না। আবিরা ইরাকে তাদের সাথে ডেকেছিল কিন্তু ইরা তাদের সাথে আসে নি। সে তার মায়ের কাধে মাথা রেখে কোমর দুইহাত দিয়ে জড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে। নিহানের মা আর শুভ্রতার মা দুজনই শুভ্রতার কাছাকাছি রয়েছে। একপাশে নিহান এবং অন্যপাশে মা, হবু শাশুড়ী। কাজী সাহেব কবুল বলতে বলেছে মিনিট দুয়েক আগে কিন্তু শুভ্রতা মুখ থেকে টু শব্দটি বের করছে না। সামনের চেয়ার থেকে শাহাদাত সাহেব বলে উঠলেন, ” কবুল’টা তাড়াতাড়ি বলে দে মা, এত সময় নিচ্ছিস কেন? এত সময় নিতে হয় না মা। সৃষ্টিকর্তা তোর ভাগ্যে ভালো কিছু রেখেছে ইন শা আল্লাহ। ”

কারো কথাই যেন শুভ্রতার কর্ণকুহরে পৌঁছাচ্ছে না। হয়তো তার এক হাত সামনে এসে কোনকিছুতে বাধাপ্রাপ্ত হয়ে আবার ফিরে যাচ্ছে। শুভ্রতা হাতের সাথে হাত ঘষে যাচ্ছে, এমন সময় নিহান শুভ্রতার হাতে হাত রাখে। শুভ্রতা নিহানের দিকে তাকাতেই নিহান চোখ হালকা বন্ধ করে সম্মতি দিতে বলে দেয়। শুভ্রতা নিহানের থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে কবুল বলে দেয়। সাথে সাথে সবাই আনন্দে চিৎকার দিয়ে ওঠে। এবার নিহানের কবুল বলার পালা, সবাই নিহানের দিকে তাকিয়ে আছে। পুরুষ এমনিতেও কবুল বলতে বেশি সময় নেয় না তারা তাড়াতাড়ি বউ নিয়ে যেতে পারলেই বাঁচে। নিহানকে কবুল বলতে বললে নিহান সাথে সাথে মাথা নিচু করে কবুল বলে দেয়। নিহানের মুখ থেকে ‘কবুল’ উচ্চারণ হওয়ার সাথে সাথে ইরার চোখ থেকে বৃষ্টিফোটার মতো কষ্ট ঝরে পড়ে। ইরা তার মায়ের থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে চলে যেতে চাইলে তার মা জোর করে রেখে দেয়। সাফিয়া বেগম মনে করেন ইরার সহ্য করতে হবে, পৃথিবীর সব পছন্দের জিনিস বা ভালোবাসার মানুষ আমাদের হবে না এটা ইরাকে বুঝতে হবে।

” বাবা, আমার কান্না পাচ্ছে। ”

শাহাদাত সাহেব রুমের এখানে ওখানে ইনহেলারটা খুঁজছিলেন। আজ কেমন যেন নিঃশ্বাসটা বন্ধ হয়ে আসছে। মেয়ের কথায় পিছনে ফিরে তাকান তিনি। মেয়ের কথার পরিপ্রেক্ষিতে বলেন, ” কি হয়েছে মা? কান্না কেন পাবে তোর?”

” জানি না বাবা আমার কান্না পাচ্ছে৷ ওই রুমে সবাই কত মজা করছে কিন্তু আমার কিছু ভালো লাগছে না। কেমন যেন লাগছে, ভীষণ কান্না পাচ্ছে।”

” নতুন জীবনের সবকিছু পরিচিত হলেও সবকিছু নতুন। তুই তো এখানেই থাকবি তোর কোন চিন্তা নেই মা। ”

” তুমি কিছু খুঁজছিলে?”

” হ্যাঁ, আমার ইনহেলারটা কোথায় যে রেখেছি!”

” তোমার ব্যাগে আছে দেখো।”

শাহাদাত সাহেব এখানে ওখানে খোঁজাখুঁজি বাদ দিলেন। শুভ্রতা বলার পর মনে হলো সহজে যেন খুঁজে পাওয়া যায় তাই সেটা ব্যাগে রাখা হয়েছে। নিজের কাজ মিটিয়ে মেয়ের পাশে এসে বসলেন। টেবিলে রাখা একটা বই হাত বাড়িয়ে নিয়ে সেটা শুভ্রতার হাতে দিয়ে বললেন, ” এই বইটা তোর জন্য কিনেছিলাম। সময় পেলেই বইটা পড়বি অনেকে কিছু জানতে ও শিখতে পারবি। ”

শুভ্রতা বইটা হাতে নিতেই স্নিগ্ধা রুমে এসে শুভ্রতার পাশে দাঁড়িয়ে বলে, ” আপু তোমাকে সবাই ডাকছে।”

” তুই যা আমি পরে আসছি। ”

শাহাদাত সাহেব মেয়ের মাথায় হাত দিয়ে বুকে টেনে নিয়ে বললেন, ” যা মা, সবাই ডাকছে। সবার সাথে আনন্দ কর৷ তোর মাকে একটু পাঠিয়ে দিস এখানে।”

” ঠিক আছে বাবা।”

শুভ্রতা আর স্নিগ্ধা চলে গেলে শাহাদাত সাহেব বালিশটা ঠিক করে শুয়ে পড়েন৷ অনেকগুলো মাস পর একটু নিশ্চিন্ত লাগছে নিজেকে। অনেকগুলো রাত নির্ঘুম কাটাতে হয়েছে, আজ হয়তো একটু শান্তিতে ঘুমাতে পারবেন তিনি।

নিহান ফোনে কথা বলা শেষ করে পিছনে ফিরতেই দেখে ইরা দাঁড়িয়ে আছে। নিহান পাশ কাটিয়ে চলে যাবে ঠিক তখনই ইরা বলে ওঠে, ” পরশু চলে যাচ্ছেন?”

” হ্যাঁ সেরকমই কথা হলো। ”

” নতুন বউ রেখে চলে যেতে কষ্ট হবে না?”

” ইরা, তুই আমার চাচাতো বোন, প্রাক্তনের মতো কথা বলবি না। এসব তোকে মানায় না।”

” আমার কথা আর আপনাকে শুনতে হবে না নিহান ভাই। আমি খুব জলদি বাহিরে চলে যাচ্ছি। আমি আর আপনার মুখোমুখি হতে পারব না, আমার সাহস নেই।”

” যেখানেই থাকিস, দোয়া করি সবসময় ভালো থাকিস।”

” যখন কবুল বলছিলেন সেই সময়ের মতো অসহায় নিজেকে কখনো লাগে নি৷ আপনার নিশ্চয়ই এমন লেগেছিল শুভ্রতা আপুর প্রথম বিয়েতে?”

” ইরা, তুই আমার সম্পর্কে ছোট বোন, সে হিসেবে থাকলে খুশি হব।”

নিহান ইরাকে পাশ কাটিয়ে চলে যেতে লাগলে ইরা আবার বলে ওঠে, ” ভালোবাসি আপনাকে নিহান ভাই, খুব বেশি ভালোবাসি। ”

নিহান শুনেও যেন না শোনার অভিনয় করে, এক মুহুর্তের জন্য না দাঁড়িয়ে চলে যায়। সে এক নারীতে আ*সক্ত পুরুষ। কোন পুরুষ এক নারীতে আ*সক্ত হলে তার সামনে পৃথিবীর সবচেয়ে সেরা কোন নারীকে এনে দাঁড় করালেও সেই পুরুষের শখের নারীই তার চোখ শীতলকারিনী। নিহান শুভ্রতার কাছে যেতে যেতে সিদ্ধান্ত নেয় ইরার মুখোমুখি আর হওয়া যাবে না, হলেও কঠোর থাকতে হবে নইলে মেয়েটা উল্টাপাল্টা কাজ করে বসবে।

সাহিল শেখ শুভ্রতাদের বাড়ির বাহিরে এসে ফাউজিয়াকে কল দিল। ফাউজিয়া মিনিট বিশেক আগে মায়ের কল পেয়ে বাসায় যাওয়ার জন্য তৈরি হয়ে নিয়েছে। শুভ্রতা অনেকবার বলেছে আজকে অন্তত থেকে যাওয়ার জন্য কিন্তু ফাউজিয়া থাকতে নারাজ। এমনিতেই একদিন থাকা হয়ে গিয়েছে, তার মায়ের শরীরটাও খারাপ। নিজের ব্যাগটা নিয়ে রুমের বাহিরের দিকেই বসে শাকিরার সাথে কথা বলছিল ফাউজিয়া। হঠাৎ ফোন বেজে ওঠায় সে শুভ্রতাকে ডাক দিলে শুভ্রতা বাহিরে বেরিয়ে আসে।

” স্যার এসে গেছে?”

” হ্যাঁ কল দিয়েছেন দেখছি। আমি তবে এখন বের হই। তুই সাবধানে থাকিস, ফ্রি হলে কল দিস।”

” ঠিক আছে চল এগিয়ে দিয়ে আসছি।”

” আচ্ছা।”

ফাউজিয়ার সাথে শাকিরা আর শুভ্রতা বাড়ির বাহিরের দিকে আসে। তিনজন বাহিরে এসে দেখে সাহিল স্যার উঠোনে বাইকের একপাশে দাঁড়িয়ে আছে। তিনজনই সেদিকে এগিয়ে গেল। শুভ্রতা দুজনের থেকে একটু এগিয়ে গিয়ে বলল, ” আসসালামু আলাইকুম স্যার। কেমন আছেন?”

সাহিল শেখ পিছনে ফিরে সালামের জবাব দিয়ে বললেন, ” নতুন জীবনের জন্য শুভকামনা শুভ্রতা। প্রতিটা দিন আপনার ভালো কাটুক। ”

” স্যার ভেতরে চলুন না, এখান থেকে চলে গেলে বিষয়টা কেমন দেখায়!”

” না না দেরি করব না। আমাদের এখনই বের হতে হবে। রাত হয়ে যাচ্ছে অনেক, নতুন বউয়ের এরকম বাহিরে বের হওয়া উচিৎ না।”

” জি স্যার। স্যার ভেতরে আসলে ভালো লাগতো।”

সাহিল শেখ কাঁপা কাঁপা হাতটাই শুভ্রতার মাথায় রাখেন। শুভ্রতা সাহিল শেখের দিকে তাকালে তিনি বলেন, ” অন্য একদিন আসব, আজ যেতে হবে৷ ভালো থাকবেন।”

শুভ্রতা চকিতে বলে ওঠে, ” স্যার আপনি কিন্তু আমার সাথে তুমি করে বলতেই পারেন আমি তো আপনার ছোট বোনের মতোই হব হয়তো।”

সাহিল শেখ ফাউজিয়ার দিকে তাকায়। ফাউজিয়া অন্যদিকে তাকায়, সাহিল শেখ বুঝতে পারে গতকালের কথাটা ফাউজিয়া বলে দিয়েছে। মেয়েদের পেটে আসলেও কথা জমে থাকতে চায় না, বেস্টফ্রেন্ডের কাছে তো একদমই নয়। সাহিল শেখ ফাউজিয়ার দিকে থেকে চোখ ফিরিয়ে নিয়ে শুভ্রতার দিকে তাকিয়ে বলে, ” ঠিক আছে, এখন যাও বাড়ির মধ্যে। অনেকরাত হয়ে যাচ্ছে। এভাবে বের হতে নেই।”

” ঠিক আছে। সাবধানে যাবেন স্যার। ”

রাত দশটা-

শুভ্রতার বিছানায় সবাই বসে বসে গল্প করছে। আবিরা আর শাকিরা যেন গল্পের আসরের মধ্যমণি হয়ে বসে আছে। স্নিগ্ধা আর নেহা পূর্বের দিনগুলোর মতোই একসাথে। দুজন কোথাও গেলে সবসময় একসাথে থাকবে। সমবয়সী ভাই-বোনের মধ্যে অনেকটা দা-কুমড়ার সম্পর্ক থাকে কিন্তু তারা দুজন একদম বিপরীত। ইরা একপাশে বসে ফোন ঘাটাঘাটি করছে। বাড়ির বড়রা একেএকে সবাই নিজেদের বাড়ি, রুমে চলে গিয়েছেন। এখন শুধু বাড়ির মেয়েগুলো রয়েছে। রায়হান আর নিহান রুমে প্রবেশ করতেই শাকিরা বলে ওঠে, ” তোমাদের এতক্ষণে সময় হলো আসার?”

রায়হান এগিয়ে এসে বিছানার একপাশ ঘেষে দাঁড়িয়ে বলে, ” কেন?”

শাকিরা সোজা হয়ে বসে বলে, ” কেন আবার? কত রাত হয়ে যাচ্ছে দেখেছ? ওরা নিজেদের রুমে যাবে না?”

আবিরা বেশ স্বাভাবিক ভঙ্গিতেই বলে ওঠে, ” ভাইয়াকে দেখে তো মনে হচ্ছে বাড়িতে বউ নিয়ে যাওয়ার কোন তাড়া নেই।”

ইরা ফোন থেকে চোখ সরিয়ে বলে ওঠে, ” বউ আদৌ বরের ঘরে যাবে তো? বর এখন আসছে বউ নিতে।”

নিহান শুভ্রতার দিকে এগিয়ে এসে শুভ্রতাকে বলে, ” দাঁড়াও তো, আর কত এখানে বসে থাকবে? উঠে দাঁড়াও।”

রায়হান হাসতে হাসতে বলে, ” তুই কি এখন শুভ্রতাকে কোলে করে নিয়ে যাবি নাকি?”

” আমার বউ তার শ্বশুরবাড়িতে প্রথমদিন হেটে যাবে না। সে তার নিজের ঘর অবধি আমার কোলে উঠেই যাবে।”

নিহান শুভ্রতাকে কোলে নিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে যায়। শুভ্রতা শক্ত করে পাঞ্জাবি আর পাঞ্জাবির মালিককে ধরে আছে। চোখ মুখ খিচে বারবার বলছে, “নামিয়ে দিন আমাকে, আমি পড়ে যাব। ”
কে শোনে কার কথা নিহান শুভ্রতাকে নিয়ে তাদের বাড়ির দিকে রওয়ানা দিল।

#চলবে……