শুভ্ররাঙা ভালোবাসা পর্ব-৪২+৪৩+৪৪

0
242

#শুভ্ররাঙা_ভালোবাসা
#তানিয়া_মাহি(নীরু)
#পর্ব_৪২

শুভ্রতা ওয়াশরুমে, বিছানায় রাখা ফোনটা বাজছে। নিহান ফোনটা হাতে নিয়ে দেখে নম্বরটা সেভ করা নেই। কারো ফোন তার অনুমতি ছাড়া ধরা ঠিক না কিন্তু নিহান ইচ্ছে দমিয়ে উঠতে পারল না। প্রথমবার কল কেটে গেলে দ্বিতীয়বার আবার কল আসলে নিহান কল রিসিভ করে। কিন্তু ওপাশ থেকে কোন আওয়াজ নেই। নিহান চুপ করে আছে জানার জন্য যে ওপাশ থেকে কে কথা বলবে! কিন্তু কেউ কোন কথা না বলায় নিহানের সন্দেহ বেড়ে যায়। কেউ শুভ্রতাকে বিরক্ত করছে? শুভ্রতার থেকে জানতে হবে ভেবে কল কেটে শুভ্রতার জন্য অপেক্ষা করতে থাকে সে। কিছুক্ষণ পর শুভ্রতা বেরিয়ে আসে। নিহান তার ফোনটা হাতে নিয়ে নাড়াচাড়া করছে। শুভ্রতা তোয়ালে দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে জানালার দিকে এগিয়ে গিয়ে পর্দা সরিয়ে দেয়। হু হু করে বাতাস দলবেধে ভেতরে প্রবেশ করতে থাকে। শুভ্রতা সেখানেই দাঁড়িয়ে আছে।

” তোকে কেউ অযথা কল দিয়ে ডিস্টার্ব করছে?”

নিহানের কথায় পিছনে ফিরে তাকায় শুভ্রতা। সেই অচেনা নম্বর থেকে কি তবে আবার কল এসেছিল? নিহান রিসিভ করেছিল! ব্লক করে দেওয়া উচিৎ ছিল কিন্তু সে কয়টা নম্বর ব্লক করবে? সেদিনের পর থেকে চার/ পাঁচটা নম্বর কালো তালিকায় ফেলেছে সে। শুভ্রতাকে চুপ থাকতে দেখে নিহান আবার বলে,

” তুই ওয়াশরুমে ছিলি তখন কেউ কল দিয়েছিল। প্রথমবার রিসিভ করিনি। দ্বিতীয়বার কল আসলে রিসিভ করায় দেখলাম কেউ কথা বলল না। ”

শুভ্রতা হাতের তোয়ালেটা চেয়ারের ওপর রেখে নিহানের দিকে আসতে আসতে বলল, ” কয়েকদিন হলো এরকম কল আসছে। আমি কয়েকটা নম্বর ব্লক করেছি তবুও অন্য নম্বর থেকে এরকম কল আসে। কেউ কোন কথা বলে না।”

” আমাকে জানাস নি কেন?”

” জানানোর মতো কিছু না তো। এরকম ফোন তো আসেই, অনেকে ডিস্টার্ব করে৷ এটা নিয়ে চিন্তা করার কি আছে?”

” আমি যদি তোর ফোনের নম্বর চেঞ্জ করে দিই তাহলে কি সমস্যা হবে? যদি বলিস তাহলে আমি আজই নতুন সিম তুলে দিব।”

” হ্যাঁ সমস্যা নেই, ভালোই হবে।”

” ঠিক আছে।”

কথা শেষ করতেই দারুণ প্রবল একটা শব্দে বাহিরে তাকায় দুজন। অনেক দূর থেকে বৃষ্টি তাদের এলাকার দিকে আসছে। এরকম শব্দ অনেক কম শোনা যায়। বৃষ্টি যখন প্রবল আকার ধারণ করে অন্য এলাকার বৃষ্টি হওয়ার শব্দ শোনা যায়। মনে হয় অন্য এলাকা থেকে তেড়ে আসছে তার কয়েক সেকেন্ড পরেই বৃষ্টি নেমে পড়ে। এখানেও সেরকম হলো। হুট করে প্রবল শব্দের বৃষ্টি নেমে পড়ল। তৎক্ষণাৎ শুভ্রতার মনে পড়ল তার শাড়ি ছাদে রোদে দেওয়া হয়েছিল, নিয়ে আসার কথা খেয়াল নেই তার। শুভ্রতা বাহিরের দিকে দৌঁড়ে যাবে তখনই নিহান হাত টেনে ধরে।

” দৌঁড়াচ্ছিস কেন? ”

” ছাড়ুন, তাড়াতাড়ি ছাদে যেতে হবে। ছাদে শাড়ি রোদে দিয়েছিলাম, ভিজে গেল।”

” আমি যাচ্ছি, তোমার যেতে হবে না। বসে থাকো।” বলেই নিহান উঠে দাঁড়ায়। শুভ্রতাকে দাঁড় করিয়ে নিজে চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়ায়। হুট করে কিছু মনে হতেই আবার দাঁড়িয়ে যায়। পিছনে ফিরে শুভ্রতাকে জিজ্ঞেস করে, ” বৃষ্টিতে ভিজবি শুভ্রা?”

শুভ্রতা মুখে কিছু না বলে মাথা ওপর নিচু নাড়িয়ে বুঝিয়ে দেয় সে বৃষ্টিতে ভিজবে। নিহানও মুচকি হেসে হাতের ইশারায় তার পিছে পিছে আসতে বলে।

অন্ধকার নেমে পড়েছে, এখানে ওখানে আলো জ্ব*লছে। দূরের আলোগুলো ঠিক যেন জোনাকি পোকার মতো লাগছে। দুজন এখনো ছাদে দাঁড়িয়ে ভিজছে। নিহান চিলেকোঠার পাশে দাঁড়িয়ে মুগ্ধচোখে শুভ্রতার বৃষ্টিতে ভেজা দেখছে। কয়েকবার ডেকেছিল চলে আসার জন্য কিন্তু শুভ্রতা আসে নি। তার নাকি আরও কিছুক্ষণ ভিজতে হবে। মেয়েরা কি আসলেই এতটা বৃষ্টিবিলাসী হয়! বৃষ্টি দেখলেই কেমন ছটফট করে বাহিরে আসার জন্য, বৃষ্টি ছুয়ে দেওয়ার জন্য।
শুভ্রতা দুইহাত দুই পাশে মেলে দিয়ে আকাশের দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে। মনে মনে হাজারো দোয়া, আকুতি-মিনতি রবের কাছে। বৃষ্টি হলো আল্লাহর রহমত। বৃষ্টির সময় দোয়া করলে দোয়া কবুল হয়, আকাশের দিকে তাকালে রব সেটা দেখেন। শুভ্রতা বৃষ্টিতে ভিজে নিহানকে সারাজীবনের জন্য পাশে চাইছে। নিহান শুধু বৃষ্টিতে ভেজা মেয়েটাকে দেখছে, তার ভেতরের কথাগুলো তো শুধু রব শুনছেন।

” আপু, তুমি মাকে বোঝাও না স্যারের ব্যাপারটা। স্যারকে কখনো বিয়ে করা যায় বলো? মানছি উনি খুব ভালো মানুষ কিন্তু উনাকে নিয়ে আমি কোন কিছুই ভাবতে পারছি না কিন্তু মা বলছেন তুমি আর ভাইয়া বাসায় আসলেই বিয়ের কথা পাকাপাকি করে ফেলবেন। যেই না শুনেছে আমার দুই বান্ধবীরই বিয়ে হয়ে গেছে তারপর থেকে আরও বেশি তাড়াহুড়ো করছে। মাত্র অনার্স সেকেন্ড ইয়ারে পড়ছি এখনই এত তাড়াহুড়ো কীসের বলো তো?”

ফাউজিয়া কথাগুলো একনাগাড়ে বলে দম নিল। ওপাশ থেকে ফাউজিয়ার বড়বোন মেহজাবিন কথাগুলো শুনে বলল,” স্যার আর ছাত্রীর অবশ্যই বিয়ে হয়। অহরহ হচ্ছে, কিন্তু বিষয়টা তোর ভালো না লাগলে আমি মা’র সাথে কথা বলব। তুই একদম এসব নিয়ে চিন্তা করিস না, মন দিয়ে পড়াশোনা কর।”

” আচ্ছা, তুমি প্লিজ মাকে কল করে বলে দিও।”

” আচ্ছা বলব। তোর টেস্ট পরিক্ষা কবে?”

” সাহিল স্যার তো বলল এই মাসেই পরিক্ষা হবে।”

” এত জলদি?”

” হ্যাঁ, ডিপার্টমেন্টের প্রধান এসেছে নতুন। উনি খুব স্ট্রিক্ট। পড়াশোনায় গাফিলতি একদম সহ্য করেন না।”

দুই বোনের মাঝে আরও কিছুক্ষণ কথা হলো। কথা শেষ করে ফাউজিয়া মায়ের রুমে চলে গেল। খাওয়ার সময় হয়ে গিয়েছে, খাবার খেয়ে ওষুধ দিতে হবে মাকে।

ফাউজিয়া মায়ের রুমের দিকে গিয়ে দেখে মা ফোনে কারো সাথে কথা বলছে। একটু এগিয়ে গিয়েই শুনতে পায় তার মা বলছে, ” আপনি চিন্তা করবেন না আপা, আমার মেয়ের সাহস নেই আমার মুখের ওপর কথা বলার। আপনার ছেলের মতো ছেলেই হয় না। ওর রাজি না হওয়ার কোন কারণ দেখি না আমি। আপনি এসব নিয়ে একদম ভাববেন না। আমি আমার মেয়ে-জামাইকে আসতে বলেছি। ওদের সাথে আলোচনা করে অবশ্যই ভালো সিদ্ধান্তে পৌঁছব। ”

ফাউজিয়া বুঝতে পারে তার মা সাহিলের মায়ের সাথে কথা বলছে। বিষয়টা ফাউজিয়ার কাছে একদম ঠিক লাগছে না। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে খাওয়ার সময় হয়ে গেছে। তাই সে টেবিলের দিকে যায় খাবার বেড়ে মাকে দিতে যাবে বলে।
ফাউজিয়া মনে মনে অস্বস্তিবোধ করছে। মায়ের সাথে কোন কথা বলা যাচ্ছে না। স্যারের সাথে বিয়ের বিষয়টায় মন কোনভাবেই সায় দিচ্ছে না কিন্তু মা সেই কথা শুনতে নারাজ৷

” ব্যাগপত্র গুছিয়েছিস নিহান? কালকে ট্রেন কয়টায় তোর বিকেল পাঁচটায়?”

মিসেস রাবেয়ার কথা শুনে ভাতের লোকমাটা মুখে তুলতে পারল না শুভ্রতা। নিহান আগামীকালই চলে যাবে! কই কথাটা তো তাকে জানায়নি নিহান। শুভ্রতা খাবারটা মাঝপথেই আটকে রেখে নিহানের দিকে তাকালো৷ নিহান আগে থেকেই শুভ্রতার দিকে তাকিয়ে আছে। শুভ্রতা তাকালে সে চোখ ফিরিয়ে নিয়ে মাকে বলে,

” এই তো রুমে গিয়েই গুছিয়ে ফেলব। ”

রাবেয়া বেগম শুভ্রতাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ” শুভ্রতা তুই একটু নিহানকে সাহায্য করিস রে মা। আমিই গুছিয়ে দিতাম আগে কিন্তু এখন তো তুই এসেছিস। এই কাজটা এখন থেকে তোর।”

শুভ্রতা মুখ দিয়ে কোন কথা উচ্চারণ করল না। শুধু মাথা ঝাঁকিয়ে সম্মতি জানালো। আবিরা খাওয়া শেষ করে চলে গেল। আবিরার সাথে সাথে শুভ্রতাকেও উঠতে দেখে রাবেয়া বেগম বললেন, ” খাবার শেষ হয়নি, প্লেটের খাবার শেষ করে উঠবি। বস ওখানে।”

শুভ্রতা বাম হাত দিয়ে চেয়ার ধরে দাঁড়িয়ে বলল, ” আমার পেটে আর জায়গা নেই বড়আম্মু। আর খেতে পারব না।”

” কিন্তু…”

” থাক মা জোর করো না। ওর খাওয়া হয়েছে জন্যই তো উঠে পড়েছে।”

শুভ্রতা কোন কথা না বলে সেখান থেকে চলে যায়। নিহানও আর খেতে পারছে না। সে শুভ্রতার মুখের কালো মেঘটা দেখেছে। হয়তো রুমে গেলেই গাল বেয়ে পড়া বৃষ্টি দেখতে হবে। মেয়েটা ভালোবাসি না, ভালোবাসি না বলেও এত অভিমান করে!
এত এত ভালো মুহুর্তের মাঝে নিহানের চলে যাওয়ার বিষয়টা বলতে ইচ্ছে করছিল না তার। চলে যা গিয়েও তো উপায় নেই। এই চলে যাওয়াটা যে কোনভাবেই আটকে রাখা যাবে না। প্রিয় মানুষকে এত কাছে পাওয়ার পর কি এতদিন এত দূরে থাকা সম্ভব হবে নিহানের পক্ষে? নিহানের মতো শুভ্রতারও কি কষ্ট হবে!

নিহান প্লেট থেকে হাত গুটিয়ে নিয়ে মায়ের দিকে প্রশ্ন ছুড়ে দেয়, ” মা আগামীকাল গেলে আমার আসতে আসতে দুই থেকে আড়াই মাস৷ আমি ভেবেছি আগামীবার এসে শুভ্রাকে নিয়ে যাব। ওখানে তো পুরো ফ্ল্যাটে শুধু আমাকেই থাকতে হয়। রান্নাবান্না করাও ঝামেলা, শুভ্রা গেলে আমার একটু সুবিধাও হবে।”

” হ্যাঁ নিয়ে যাবি সমস্যা কি? আর তাছাড়া আমিও ভেবেছিলাম ওকে এবারই নিয়ে যাবার কথা বলব কিন্তু তোর বাবা আসবে কিছুদিনের মধ্যে আবার নাকি শুভ্রতার টেস্ট পরিক্ষা। তারপর কয়েকমাস পর ফাইনাল৷ এসে ফাইনাল দিলেই হবে। ”

” আচ্ছা আমি কাকার সাথেও কথা বলে দেখব। ”

” শুভ্রতার বাবার সাথে?”

” হ্যাঁ। ”

” আচ্ছা বলে দেখিস। এখন যা রুমে গিয়ে ব্যাগ গুছিয়ে নে।”

রাবেয়া বেগম খাওয়া শেষ করে উঠে চলে গেলেন। নিহানও উঠে দাঁড়ালো। একবার উপরতলার দিকে তাকিয়ে রইল অসহায় দৃষ্টিতে। মেয়েটা কি করছে কে জানে! সে ভেবেছিল খাওয়া দাওয়া করে রুমে গিয়ে শুভ্রতাকে বিষয়টা জানাবে কিন্তু তার আগেই জেনে গেল। নিহান হাত ধুতে চলে যায় তাড়াতাড়ি করে।

নিহান রুমের ভেতরে এসে দরজা লাগিয়ে দেয়। শুভ্রতা রুমে নেই তার মানে নিশ্চয়ই ব্যালকনিতে মন খারাপ করে দাঁড়িয়ে আছে। বিয়ের দুইদিনে নিহান শুভ্রতার প্রতি আরও বেশি ভালোবাসা অনুভব করতে পারছে। এই মেয়ের চোখের পানি সে কোনভাবেই আগেও সহ্য করতে পারত না এখনো পারবে না। নিহান মনে মনে ভাবতে থাকে, ” আচ্ছা, যাওয়ার কথাটা মায়ের মুখে শুনে কি খুব কষ্ট পেয়েছে শুভ্রা? “এত এত ভালো সময় কাটানোর সময়ে যে মন খারাপ করিয়ে দিতে একদম ইচ্ছে করেনি নিহানের।

নিহান ব্যালকনিতে গিয়ে দেখে শুভ্রতা দাঁড়িয়ে আছে। নিহানের উপস্থিতি বুঝেও ঠায় দাঁড়িয়ে রইল শুভ্রতা। নিহান গিয়ে পিছন থেকে শুভ্রতাকে জড়িয়ে ধরলেও শুভ্রতা নিশ্চুপ। শুভ্রতাকে চুপ থাকতে দেখে নিহান এবার শুভ্রতাকে নিজের দিকে ফিরিয়ে নিয়ে বলল, ” কি হয়েছে? মন খারাপ?”

শুভ্রতা কিছু না বলে অন্যাদিকে তাকালো। নিহান আবার শুভ্রতার মুখটা তার দিকে ফিরিয়ে নিল। ” কথা বলবি না আমার সাথে?”

” আপনি চলে যাচ্ছেন সেটা আমাকে বললেন না কেন?”

” তুই তো জানতি বিয়ের পরের দিন আমার চলে যেতে হবে। তবু আজকের দিনটা ম্যানেজ করেছিলাম। ভাবলাম তোর মনে আছে তাই বলিনি। এত ভালো মুহুর্তে চলে যাওয়ার কথা বলে মন খারাপ করতে চাইনি। শুনলে তোর ও মন খারাপ হত। তাই ভাবলাম রাতে রুমে এসে তোকে ব্যাগ গুছাতে বলব।”

” আমার একটুও ভালো লাগছে না। ”

” ভালোবাসিস আমাকে?”

শুভ্রতা নিশ্চুপ হয়ে যায় আবার। নিহানও কিছু বলে না। শুভ্রতা নিরবতা কাটিয়ে বলে ওঠে, ” আপনার অনুপস্থিতি হয়তো আমার মন খারাপের কারণ হবে। গত কিছুদিন ধরে ভালো লাগা কাজ করছিল কিন্তু কাল থেকে অদ্ভুত এক অনুভূতি কাজ করছে। তাকে ভালোবাসা বলা যায় কি না ঠিক বুঝতে পারছি না। এই অনুভূতির নির্দিষ্ট কোন সঙ্গা আছে কি না তাও জানি না।”

” আল্লাহ না করুক, আমি যদি তোর জীবনে ভাগ্যক্রমে কখনো না-ও থাকি তোর চারপাশের সবকিছু, ভোরের সূর্য থেকে শুরু করে রাতের চাঁদ পর্যন্ত তোকে আমার কথা মনে করিয়ে দিবে। আমার উপস্থিতি হয়তো তুই এই রুমের আনাচে কানাচে পাবি। ”

” আপনি আমার আছেন এই কথায় দিন আসুক, সেখানো আপনার অনুপস্থিত আমি সহ্য করে নেব কিন্তু আপনি আমার নেই এই ভেবে একটা সেকেন্ড আমার না আসুক।”

” ভালোবাসিস?”

” বলতে পারব না।”

” প্লিজ…”

” আপনার ব্যাগ গুছাতে হবে না? আপনি কিন্তু ওখানে গিয়ে প্রতিদিন আমাকে কল করবেন। একদিন হেরফের হলে কিন্তু আমি কথা বলব না বলে দিলাম। শুনুন মানুষ তার অবসরে প্রিয় মানুষের সাথে কথা বলে না, ব্যস্ততার মাঝে সময় বের করে কথা বলতে হয়। এখন চলুন, মন খারাপ করে থেকে তো কোন লাভ হবে না, শুধু শুধু সময় খারাপ যাবে। তার চেয়ে যতক্ষণ আছেন, একটু ভালো সময় কাটানো যাবে।”

” এভাবেই সবসময় আমাকে বোঝার চেষ্টা করবি, বদলে যাস না কখনো।”

” হুম।”

রুমে এসে দুজন মিলে ব্যাগ গুছিয়ে নিচ্ছে। নিহান কাজের মাঝে বারবার সময় দেখছে। শুভ্রতা নিহানের এমন আচরণ দেখে জিজ্ঞেস করে, ” বারবার ঘড়ি দেখছেন কেন?”

” অনেক রাত হয়ে যাচ্ছে ঘুমোতে হবে তাইইই।”

নিহান কথা শেষ করতেই টেবিলে রাখা ফোনটা বেজে ওঠে। নিহান তাড়াতাড়ি করে ফোনটা কেটে দেয়।
” আচ্ছা তুমি থাকো, আমি একটু বাহিরে থেকে আসছি।” বলেই নিহান রুম থেকে বেরিয়ে যায়। শুভ্রতা ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে রাত এগারোটা। প্রয়োজনীয় কল আসলে ব্যালকনিতে যাবে, কল কেটে বাহিরে কেন গেল সে!

#চলবে…..

#শুভ্ররাঙা_ভালোবাসা
#তানিয়া_মাহি(নীরু)
#পর্ব_৪৩

নিহান বাড়ি থেকে বের হতেই ইরার সাথে দেখা হয়ে যায়। নিহানদের বাড়ির পাশেই ইরাদের বাসা। মাঝেমাঝে গ্রামে আসলে তাদের বাড়িতে থাকে। এতরাতে বাড়ির বাহিরে একটা মেয়ের দাঁড়িয়ে থাকার বিষয়টা কেউই ভালো চোখে দেখবে না। ইরাকে দেখে নিহান এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করে, ” এতরাতে তুই এখানে কেন? এটা গ্রাম, শহর না। বাহিরে কী কাজ তোর?”

” বাসায় নেট পাচ্ছিল না, ট্রেনের টিকিট কা*টতে বাহিরে এসেছি।”

” কালকে কাটা যেত না? এতরাতে বাহিরে থাকা মোটেও ভালো দেখায় না ইরা। ভেতরে যা এখনই।”

” কাজ হয়ে গেছে প্রায়। আমার কথা বাদ দেন, আপনি নতুন বউকে রেখে বাহিরে কেন?”

” বউকে খুশি রাখার ব্যবস্থা করতেই এসেছি।”

” যদি আপনার বউ হতে পারতাম! আপনার বউ হলে নিশ্চয়ই আমাকেও খুশি করতে অনেককিছু করতেন?”

” থাপ্পড় খাবি ইরা। বেশি পেকে গেছিস তুই। ”

” মজা করলাম। কালকে এই বাড়ি আর আপনাদের জীবন থেকে একেবারে বিদায় হব।”

কথাটা বলেই ইরা বাড়ির মধ্যে চলে গেল। নিহান রাগান্বিত চোখে চেয়ে রইল৷ এই মেয়ে বড্ড বাড় বেড়েছে, যখন তখন যা-তা বলে ফেলছে।
নিহান সেখানে আর দেরি না করে রাস্তার দিকে এগিয়ে যায়।


পরদিন বিকেল চারটা, শুভ্রতা রান্নাঘরে নিহানের জন্য কিছু একটা রান্না করছে। বাসার সবাই নিজেদের রুমেই আছে। শুভ্রতার মুখে হাসি নেই। ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই নিহান তার গন্তব্যের দিকে অগ্রসর হবে।

নিহান রান্নাঘরে ঢুকে বলল,” তোর হলো? একটু রুমে আসবি না?”

কড়াইয়ে কিছু নাড়তে নাড়তে বলল, ” আপনি যান, আমি দুই মিনিটের মধ্যে আসছি।”

” আমি কিন্তু রেডি, একটু আগেই যেতে হবে। ট্রেনের আসার কোন ঠিকঠিকানা নাই যখন তখন চলে আসতে পারে।”

” এই যে আমার হয়ে গেছে, আপনি যান আমি এক্ষুণি আসছি।”

” কিন্তু করছিস টা কি?”

নিহান শুভ্রতার দিকে এগিয়ে গিয়ে কড়াইয়ে শুকিয়ে কালো বানিয়ে ফেলা মাংস দেখে বলে ওঠে,” কালাভুনা!”

শুভ্রতা চুলা বন্ধ করে নিহানের জন্য প্লেটে রুটি আর মাংস বেড়ে নিতে নিতে বলে, ” আমি তো ওটা রান্না করতে পারি না, কীভাবে রান্না করে সেটাও জানি না তাই ভাবলাম এরকম করে দেই, এটাও বেশ ভালো লাগে।”

” দেখেই লোভ জাগছে, রুমে নিয়ে আয়। আমি যাচ্ছি তাহলে।”

নিহান রান্নাঘর থেকে চলে গেলে শুভ্রতাও রান্নাঘরের সবকিছু গুছিয়ে রেখে খাবারের প্লেটটা নিয়ে রুমের দিকে চলে যায়।

নিহান শক্ত করে শুভ্রতাকে জড়িয়ে ধরে আছে। শুভ্রতা সকাল থেকে মন খারাপ করে ছিল। যদিও নিহানের সামনে তাকে দেখাতে হাসিহাসি মুখ করে থেকেছে তবে নিহান বেশ বুঝতে পেরেছিল শুভ্রতার মন খারাপ। রাতের মতো পছন্দের উপহার দিয়ে শুভ্রতার মন আর ভালো করতে চায় নি নিহান। নিহানের প্রস্থান উপলক্ষে শুভ্রতার মন খারাপ তাকে স্বস্তি দিয়েছে। নিহান বুঝতে পেরেছে সে তার প্রিয় মানুষের মনে জায়গায় করে নিতে পেরেছে। সেই জায়গাটা দখল করে নিয়েছে যে জায়গার মানুষের উপস্থিতি মানুষকে আনন্দ দেয় আর অনুপস্থিতি দেয় বিরহ। অতঃপর নিহান ও তার প্রিয় মানুষের প্রিয় হতে শুরু করেছে। সম্পর্কে জোর না করে সময় দিলেই সেটা সুন্দর একটা আকার ধারণ করে।

শুভ্রতা নিহানের বুক থেকে মাথা তুলতেই নিহান বলে, ” বাহিরে সবাই অপেক্ষা করে শুভ্রা, আমাদের যেতে হবে তো নাকি?”

শুভ্রতা হালকা নাক টেনে জবাব দেয়, ” হুম।”

” চোখে পানি কেন শুনি?”

” আমার না কেমন খালি খালি লাগছে। আপনি চলে গেলে আমি এই বাড়িতে থাকতে পারব না আমি আমাদের বাড়ি গিয়ে থাকব।”

” যেখানে ইচ্ছে সেখানে থেকো, শুধু মানুষটা আমার নামে থাকলেই চলবে।”

” অন্যকারো হওয়ার সুযোগ আছে নাকি এখনো?”

” খু*ন করে ফেলব।”

” কি? কাকে?”

” তোকে।”

” পারবেন?”

” অন্যকারো হয়ে দেখ, বুঝতে পারবি আমি কতটা ভয়ং*কর। ”

” আপনার কথা খুব মনে পড়বে।”

নিহান আবার শুভ্রতাকে নিজের বুকে টেনে নেয়। দুইদিনেই এত ভালোবাসা! এত ভালোবাসা কপালে সহ্য হবে তো! নিহান এটা ভেবে খুশি হয় যে মন থেকে চাইলে আর মানুষটা সঠিক হলে হয়তো সবকিছু পূর্ণতা পায়। নিহান ভাবতে পারেনি শুভ্রতার মনে এত তাড়াতাড়ি এত ভালোবাসা সৃষ্টি হবে। গ্রীষ্মকালে কাঠফাটা রোদে কয়েকফোঁটা বৃষ্টি যেমন পরিবেশে শীতলতা ছড়ায় নিহান বুঝতে পারে শুভ্রতার ব্যাপারটাও ঠিক ওই কয়েক ফোঁটা বৃষ্টির মতো।

শুভ্রতাকে একহাতে জড়িয়ে রেখে অন্য হাত দিয়ে শুভ্রতার মাথা হাত বুলাতে বুলাতে বলে, ” আমি খুব তাড়াতাড়ি চলে আসব শুভ্রা, খুব তাড়াতাড়ি চলে আসব। যখন আসব তখন তোকে নিয়ে যাব। এতগুলো বছর তোকে ছেড়ে থাকা সম্ভব হলে এই দুইমাস আমার কাছে দুই যুগ মনে হবে। আমি খুব তাড়াতাড়ি এসে তোকে আমার কাছে নিয়ে যাব দেখিস।”

চোখের পানি মুছে শুভ্রতা নিহানের সাথে নিচে আসে। বাড়ির সবাই তাদের জন্য অপেক্ষা করছিল। নিহান শুভ্রতাকে একপাশে বাহু ধরে আলিঙ্গন করেই সিড়ি দিয়ে নিচে নামছিল। শুভ্রতা নিচে অনেক মানুষকে দেখে নিজেকে নিহানের থেকে ছাড়িয়ে নেয়। নিহান দাঁড়িয়ে যায়, ” কি হলো।”

” কিছু না।”

” ছাড়িয়ে নিলি যে?”

” নিচে বড়রা সবাই আছে তো।”

” তাতে কি হয়েছে? আমি কি অন্যকাউকে ধরেছি নাকি? আমি নিজের নামে করে নেওয়া বউকে জড়িয়ে ধরেছিলাম।”

শুভ্রতা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল ” আমাদের সম্পর্ক আমাদের মধ্যেই মিষ্টতায় থাকুক, কারো নজর লাগিয়ে এই সম্পর্কে তিক্ততা আনতে চাই না।”

” ভালোবাসি শুভ্রা।”

শুভ্রতার পা থেমে যায়। নিহানের এই দুটি শব্দ তার হৃৎস্পন্দনের সাথে শরীর আর পায়ের গতিও যেন থামিয়ে দিয়েছে। ট্রাফিক সিগন্যালে রেডলাইট জ্ব*লে উঠলে যেমন সব যানবাহন একসাথে থেমে যায় শুভ্রতাও ঠিক সেভাবেই থেমে নিহানের দিকে তাকিয়ে থাকে। নিহান শুভ্রতাকে দেখে মুচকি হেসে নিজেই নিচের দিকে চলে আসতে থাকলে শুভ্রতা নিজের কান্ড বুঝতে পেরে নিজেউ নিজের মাথায় একটা বারি দিয়ে নিজেও চলে আসে।

নিহানের মায়ের সাথে সাথে শুভ্রতার মাও এটা ওটা বানিয়ে নিহানের জন্য ব্যাগ ভর্তি করে রেখেছে। সবাই বসে কথাবার্তা বলছিল। ইরা, ইরার বাবা-মাও আছে। তারা সবাইকে জানায় তারাও রাতের ট্রেনে ঢাকা ফিরে যাবে৷ আবিরা, নেহা আর স্নিগ্ধা পাশে দাঁড়িয়ে কোন একটা বিষয় নিয়ে কথা বলছে। রাবেয়া বেগম আর শুভ্রতার মা আয়েশা বেগম এক সোফায় পাশাপাশি বসে আছে, ইরার মা-বাবার সাথে কথা বলছে। ইরা এগিয়ে গিয়ে তিন চাচাতো বোনের সাথে যোগ দেয়। শুভ্রতার বাবা গাড়ি ডেকে নিয়ে আসলে নিহান বসা থেকে দাঁড়িয়ে যায়। আমজাদ, শাহাদাত সাহেব আর নিহান মিলে ব্যাগগুলো বাহিরে নিয়ে গিয়ে গাড়িতে রাখে। সবাই বাহিরে এসে গাড়ির কাছে দাঁড়িয়েছে নিহান খেয়াল করে শুভ্রতা টলমল চোখে তার দিকে এক পলকে তাকিয়ে আছে। হঠাৎ সে প্যান্টের পকেটে হাত দিয়ে কিছু একটা খুঁজে শুভ্রতাকে বলে, ” আমি হয়তো ওয়ালেটটা আনতে ভুলে গেছি, নিয়ে আসবি একটু?”

শুভ্রতা হ্যাঁসূচক মাথা ঝাঁকিয়ে বাড়ির মধ্যে চলে যায়। দুই, তিনমিনিট চলে গেলেও শুভ্রতাকে ফিরতে না দেখে নিহান নিজেই ওয়ালেটের কথা বলে বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করে। রুমে গিয়ে দেখে শুভ্রতা এখানে ওখানে ওয়ালেট খুঁজছে। নিহান শুভ্রতাকে ডাকতেই শুভ্রতা দরজার দিকে তাকিয়ে বলে, ” কোথায় রেখেছেন ওয়ালেট? আমি পাচ্ছি না কিছুতেই।”

” ওটা আমার কাছেই আছে। তুই আরেকবার আমার বুকে আসবি? গাড়িতে উঠে খুব খারাপ লাগছিল, মনে হচ্ছিল আরেকটাবার তোকে কাছে টেনে নিই।”

শুভ্রতা মুহুর্তের মধ্যে দৌড়ে গিয়ে নিহানের বুকে মাথা রাখে। নিহানও পরম যত্নে শুভ্রতাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। শুভ্রতাকে জড়িয়ে রেখেই বলে, ” রাতে যে চুড়ি জোড়া দিলাম ওটা সবসময় পরে থাকবি। চুড়ি জোড়া আমার খুব পছন্দের, দুই বছর লেগেছিল টাকা জমিয়ে ওটা বানাতে। রাতে আমার এক বন্ধু ওটা দিয়ে গিয়েছে। ও দিতে চেয়েছিল না রাতে ওর আসতে কষ্ট হবে ভেবে। আমি অনেক রিকুয়েষ্ট করে ওটা আনিয়েছি ওকে দিয়ে। সবসময় এটা সঙ্গে রাখবি আমার চিহ্ন হিসেবে নয় আমার ভালোবাসার অংশ এটা।”

#চলবে……

#শুভ্ররাঙা_ভালোবাসা
#তানিয়া_মাহি(নীরু)
#পর্ব_৪৪

দেখতে দেখতে কে*টে গিয়েছে বেশ কয়েকটা মাস। নিহান যদিও বলেছিল শুভ্রতাকে দুই মাস পর এসে নিয়ে যাবে কিন্তু বাড়ির সবার সিদ্ধান্তের কাছে নিজের সিদ্ধান্ত দমিয়ে রাখতে হয়েছিল তার। নিহান চলে যাওয়ার পরের সময়গুলো শুভ্রতাকে পড়াশোনায় খরচ করতে হয়েছে বেশি । ইনকোর্সের পরেই টেস্ট আর তারপরে তিনমাস পরেই ফাইনাল পরিক্ষা। শুভ্রতার যাওয়ার ব্যাপারে ঘোর আপত্তি জানিয়েছিল শুভ্রতার বাবা শাহাদাত সাহেব। তিনি জানিয়েছিলেন মেয়ের ফাইনাল পরিক্ষার পরই মেয়েকে পাঠাবেন নিহানের কাছে। মেয়েকে নিয়ে তার অনেক স্বপ্ন। ছোটমেয়েটা ডিটেকটিভ হবে, ডিটেকটিভ হবে করে সারাক্ষণ চিল্লায়। বাবার ইচ্ছে দুইটা মেয়েই তাদের স্বপ্ন পূরণ করুক। শুভ্রতার অনেকদিনের ইচ্ছে আইন নিয়ে পড়াশোনা করে ভালো কিছু করার বাবার মতো। বাবা যেমন ন্যায়ের জন্য লড়াই করেন, ঠিক তেমন বাবার মতো ভালো কিছু করার ইচ্ছে তার।

শুভ্রতার ফাইনাল পরিক্ষার শেষ দিন। শাকিরাকে অনেক আগেই রায়হান এসে নিয়ে গিয়েছে। শুভ্রতা, শাকিরা আর ফাউজিয়ার একসাথে আজকে ঘুরাঘুরির কথা ছিল। রায়হানের এদিকে কাজ থাকায় শাকিরাকে নিতে এসেছিল রায়হান।
শাকিরাকে বিদায় দিয়ে শুভ্রতা আর শাকিরা হাতের ডানদিকের রাস্তায় রওয়ানা দেয়। ওখানে নতুন রেস্টুরেন্ট হয়েছে। বন্ধুদের কাছে ভালো রিভিউও পেয়েছে তারা। পরিক্ষা ছাড়া ফাউজিয়া আর শুভ্রতার অনেকদিন দেখা হয় না। পরিক্ষার মাঝে তেমন ছুটি না থাকায় তারা কোথাও বের ও হতে পারে নি। তাই দুজনে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল পরিক্ষার শেষের দিন অনেক ঘুরবে। রাস্তার পাশের মাঠটাতে আইসক্রিম দেখেই দুজন সেদিকে গিয়ে দাঁড়ায়।
দুজন দাঁড়িয়ে আইসক্রিম খাচ্ছিল এমন সময় শুভ্রতার নাম ধরে কেউ ডাকতেই পিছনে ফিরে তাকায়।

” আপনি!”

“তোমার সাথে কিছু কথা আছে আমার শুভ্রতা। আমি অনেক ভেবে তোমার কাছে এসেছি। ”

” আপনার সাথে আমার কোন কথা নেই। শেষ হয়ে যাওয়া অধ্যায়ে নতুন কোন শব্দ সংযোজন করতে চাই না আমি।”

” প্লিজ শুভ্রতা, পাঁচটা মিনিট সময় দাও আমাকে। ”

” আপনি এখান থেকে না গেলে আমি এক্ষুনি নিহানকে কল দিব ইমতিয়াজ! ”

শুভ্রতার মুখে ইমতিয়াজ নাম শুনেই লোকটা মাথা থেকে পা অবধি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে নেয় ফাউজিয়া। এই লোকটা ইমতিয়াজ! এই লোকটাই শুভ্রতার সাথে ছেড়ে যাওয়ার মতো অন্যা*য়টা করেছিল! কিন্তু শুভ্রতা তো এখন তাকে ছাড়াই ভালো আছে তাহলে এখন কেন এসেছে সে? ভালো থাকাকে খারাপ থাকায় পরিণত করতে!

ইমতিয়াজ আরও কিছুক্ষণ কথা বলার চেষ্টা করল কিন্তু পারল না৷ শুভ্রতা আইসক্রিমের বিল দিয়ে ফাউজিয়াকে নিয়ে হাটা ধরল। ফাউজিয়া হতবিহ্বল হয়ে একবার শুভ্রতাকে দেখছে আর একবার ইমতিয়াজকে। শুভ্রতার মুখে মেঘ জমেছে, নিকষ কালো মেঘ। ফাউজিয়া অনুভব করতে পারল শুভ্রতা কি পরিমাণ কষ্ট সহ্য করেছে আড়াই, তিনবছর! ফাউজিয়া শুভ্রতার থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে পিছনে ইমতিয়াজের দিকে যেতে থাকলে শুভ্রতা সেদিকে তাকিয়ে থাকে।

” এই যে আপনি, এর আগেও আমি আপনাকে ডিপার্টমেন্টের আশেপাশে দেখেছি তখনই সন্দেহজনক লেগেছিল, আর কখনো যদি আপনাকে শুভ্রতার আশেপাশে দেখেছি তাহলে একদম হাত-পা ভেঙে রাস্তায় ফেলে রাখব বলে দিলাম। তিন তিনটা বছর মেয়েটাকে কষ্টে রেখেছিলেন, যেই না দেখেছেন মেয়েটা একটু ভালো আছে আর ওমনি চলে এসেছেন গন্ডগোল পাকাতে তাই না? মেয়েদের অতি সভ্য ভাববেন না। সময়মত ধ্বং*স করে দিতে দুইবার ভাববো না বলে দিলাম। ”
কথাগুলো এক নাগাড়ে বলে ইমতিয়াজের সামনে থেকে চলে যেতে থাকে ফাউজিয়া। শুভ্রতার কাছে গিয়ে তার হাত ধরতেই দুজন এগুতে থাকে। ইমতিয়াজ ফাউজিয়ার কথায় পাত্তা না দিয়ে শুভ্রতাকে আবার ডেকে বলে, ” প্লিজ শুভ্রতা একটাবার আমার কথা শুনো। অনেক কথা বলার আছে তোমাকে।”

অক্টোবর মাস শেষের দিকে,তৃতীয় সপ্তাহ চলছে। বাড়িতে সকাল থেকে রান্নাবান্নার কাজ চলছে। আয়েশা বেগম এবং রাবেয়া বেগম একের পর এক পদ রান্না করেই যাচ্ছে। স্নিগ্ধা আর নেহা দুজন ড্রয়িংরুম থেকে শুরু করে সবগুলো রুম বারান্দা পরিস্কার করছে বাড়ির দুজন কাজের মহিলার সাথে। বাড়ি পরিস্কারের কাজ শেষ করে মায়েদের সাথে রান্নাঘরে সাহায্য করছে। নিহানের বাবা আমির সাহেব বসে কারো সাথে ফোনে কথা বলছিলেন। তিনি এসেছেন বেশ কিছুদিন হয়েছে। তিনি আসার পর মেয়ের বিয়ে দিতে চেয়েছিলেন তাই আজ অভীকের বাড়ি থেকে সবাই এখানে আসবে।
অন্যদিকে শুভ্রতা আবিরাকে রেডি করতে ব্যস্ত। বিছানায় শুভ্রতার সবগুলো শাড়ি ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখা হয়েছে। আবিরা কিছুতেই শাড়ি সিলেক্ট করতে পারছে না। শুভ্রতা নিজেও কিছু বলছে না কারণ সে চাইছে আবিরা নিজেই শাড়ি পছন্দ করুক। শাড়ি নাড়াচাড়া করে অনেকটা সময় পেরিয়ে গিয়েছে। শুভ্রতা বুঝতে পারল আবিরার ওপর এই বিষয়টা ছেড়ে দিলে তার আর শাড়ি পছন্দ করা হবে না তাই সে গাঢ় খয়েরী রঙের শাড়ি আবিরাকে পরার কথা বলল। বিছানায় রাখা সবগুলো শাড়ি অত্যাধিক সুন্দর হওয়ায় সে দোটানায় পড়ে গিয়েছিল। যাক শেষ পর্যন্ত একটা শাড়ি সিলেক্ট করা গেল এটা ভেবেই সে শান্ত হলো।

শাড়ি পরানো শুরু হলে দরজার বাহিরে নক করার শব্দ শোনা যায়। আবিরার শাড়ির কুচিগুলো ঠিক করেই শুভ্রতা গিয়ে দরজাটা খুলে দেয়। নেহা আর স্নিগ্ধা বাহিরে দাঁড়িয়ে আছে। স্নিগ্ধা ভেতরে একটা উঁকি দিয়েই বলল, ” আপু, উনারা সবাই চলে এসেছে। আপুকে নিয়ে যেতে বলেছে।”

” আচ্ছা তোরা যা আমি আপুকে নিয়ে পাঁচ মিনিটের মধ্যে আসছি। অভীক ভাইয়াও এসেছে?”

” কে? বর! হ্যাঁ এসেছে তো। দারুণ দেখতে।”

” হয়েছে হয়েছে এখন যা।”

নেহা আর স্নিগ্ধাকে তাড়িয়ে দিয়ে শুভ্রতা আবিরার বাকি সাজটুকু শেষ করে। আবিরাকে অভীকের বাড়ির সবার সামনে নিয়ে যাওয়া হলে অভীকের মা ইশারায় আবিরাকে ডেকে পাশে বসান। পাশের সোফায় অভীক এবং বন্ধু সিয়াম বসে আছে।
নানারকম কথা আর আলাপ আলোচনা চলতে থাকে। সবাই তাকে নির্দ্বিধায় পছন্দ করে নেয়। অভীকের মা নিজের আঙুল থেকে পছন্দের রিংটাও খুলে আবিরাকে পরিয়ে দেয়। অভীকের বাবা এবং আবিরার বাবার কথামতো নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে বিয়ে ঠিক হয়।

খাওয়া দাওয়া শেষ করে সবাই বসে গল্প করছে এমন সময় সিয়াম অভীককে ইশারা করে জানায় সে ওয়াশরুমে যাবে। অভীক কাউকে জিজ্ঞেস করতে বললে সিয়াম শুভ্রতার দিকে তাকিয়ে ইশারা করতেই শুভ্রতা এগিয়ে আসে।

” জি ভাইয়া?”

” ভাবি, ওয়াশরুমটা……”

” আচ্ছা আচ্ছা দাঁড়ান আমি কাউকে সাথে পাঠিয়ে দিচ্ছি। এই নেহা…..” নেহাকে ডাকতেই নেহা এগিয়ে আসলে সিয়ামের ব্যাপারটা জানায়। সিয়ামের ওয়াশরুমের কথা শুনে ফিক করে হেসে ফেলে। শুভ্রতা মুখ বেজার করে বলে, ” একদম হাসবি না, যা ওয়াশরুম দেখিয়ে দে। ”

নেহা হাসতে হাসতেই সিয়ামকে বলে, ” আসুন আমার সাথে।”

সিয়াম উঠে নেহার পিছুপিছু যেতে থাকে। ওয়াশরুমের কাছাকাছি গেলে নেহা বলে, ” আমি কি চলে যাব? আপনি একা আসতে পারবেন তো তাই না?”

সিয়াম সে কথার উত্তর না দিয়ে বলে, ” এলার্জির কোন ওষুধ হবে কি বাসায়? ওষুধ হলে খুব উপকার হতো।”

নেহা সিয়ামের মুখের দিকে খেয়াল করে দেখে সিয়ামকে দেখতে অন্যরকম লাগছে। নেহা এগিয়ে গিয়ে বলে, ” আপনার কি খুব খারাপ লাগছে?

সিয়াম দেয়াল ধরে দাঁড়ায়, নিজের ভর সহ্য করে দাঁড়িয়ে থাকতে কষ্ট হচ্ছিল তার। জোরে জোরে শ্বাস নিতে নিতে বলে , ” আসলে আমার চিংড়ি মাছে এলার্জি, মাঝে ওষুধ খেয়ে ঠিক হয়ে গিয়েছিল। এখন হয়তো আবার সমস্যাটা হচ্ছে।”

” আমি কাউকে ডাকব? আপনার কি খুব খারাপ লাগছে?”

” না, কাউকে জানাব না জন্যই এখানে আসলাম। আপনি শুধু দেখুন এলার্জির ওষুধ দিতে পারবেন কি না। কাউকে জানানোর প্রয়োজন নেই।”

” আচ্ছা আপনি আমার হাত ধরুন, সামনের রুমটায় একটু বসুন আমি ওষুধ এনে দিচ্ছি।”

নেহা হাত বাড়িয়ে দিতেই সিয়াম নেহার হাত ধরে নেয়। নেহা সিয়ামকে নিয়ে পাশের রুমটায় বসিয়ে দেয়। তাড়াহুড়ো করে নিজের রুমে গিয়ে ওষুধের কৌটায় ওষুধ খুঁজে না পেয়ে দৌঁড়ে মায়ের রুমে যায়।

মায়ের রুমে ওষুধের কৌটায় ওষুধ পেয়ে নেহার মুখে হাসি ফুটে যায়। সিয়ামের কাছে যাওয়ার সময় ওষুধ আর ফ্রিজ থেকে পানির বোতলটা নিয়ে যায়।

#চলবে…..