শুভ্ররাঙা ভালোবাসা পর্ব-৪৫+৪৬+৪৭

0
276

#শুভ্ররাঙা_ভালোবাসা
#তানিয়া_মাহি(নীরু)
#পর্ব_৪৫

শুভ্রতা মন খারাপ করে রুমে বসে আছে। আয়েশা বেগম দুই মেয়ের জন্য নাস্তা বানিয়ে নিয়ে এসেছেন। শুভ্রতাকে চুপচাপ বসে থাকতে দেখে তিনি নাস্তার প্লেটটা টেবিলে রেখে জিজ্ঞেস করেন,” কি হয়েছে? মন খারাপ করে বসে আছিস কেন?”

” কিছু না মা, তুমি এসো বসো এখানে।”

” বসব না, নাস্তা শেষ করে তোর বাবার কাছে যা। তোর সাথে কি কথা আছে বলল।”

” ট্রান্সফারের ব্যাপারে। ”

” হ্যাঁ, হবে হয়তো।”

আয়েশা বেগম চলে যেতেই আবিরা রুমে আসে। শুভ্রতাকে বসে থাকতে দেখে সে নিজেও চেয়ার টেনে বসে। আবিরাকে দেখে হাতের ফোনটা বিছানায় রেখে বলে, ” কি হয়েছে আপু?”

আবিরা নাস্তার প্লেট থেকে খাবার মুখে নিয়ে খেতে খেতে বলে, ” বের হতে হবে, বাসায় চল।”

” কোথায় বের হব?”

” অভীক বের হতে বলেছে বিয়ের শপিং করতে বের হতে হবে।”

শুভ্রতা জানায় তার শরীরটা খারাপ লাগছে তাই সে যেতে পারবে না। আবিরা কয়েকবার যাওয়ার কথা বললেও শুভ্রতা যেতে পারবে না। আবিরা জিজ্ঞেস করে, ” শরীর খারাপ নাকি মন খারাপ?”

” শরীরটা ভালো লাগছে না। ”

” আমার তো মনে হচ্ছে মন খারাপ। ভাইয়ার সাথে কথা হয় নি?”

” না, উনি কল দেন নি৷ ”

” আচ্ছা কল দিলে কথা বল, ভালো লাগবে। তুই যেহেতু যেতে পারবি না প্রথমদিন তো নেহাকে নিয়ে যাই তাহলে।”

আরও কিছুক্ষণ কথা বলে আবিরা রুম থেকে বেরিয়ে যায়। আবিরা চলে যেতেই শুভ্রতাও চলে যায় তার বাবার কাছে। এবার নিহান আসলেই তাকে নিয়ে যাবে তাই ভার্সিটি থেকে ট্রান্সফারের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। শাহাদাত সাহেব বেশ কিছুদিন ধরে এ ব্যাপারেই চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।

” আমি আপনাকে বিয়ে করতে পারব না স্যার। আমি অনেক ভেবে দেখেছি, বিষয়টাতে আমার মন কিছুতেই টানছে না৷ আপনি খুব ভালো মানুষ, আপনার মাঝে কোন সমস্যা নেই কিন্তু তবুও কেন জানি না আপনাকে বিয়ের কথা আমি কিছুতেই ভাবতে পারছি না।”

” আমাকে অপছন্দ না হলে বিয়ে কেন করতে পারছেন না? নির্দিষ্ট একটা কারণ তো থাকতে হবে। আপনাকে এখনই বিয়ে করতে হবে এমন ওয়াদাও কেউ দিয়ে রাখেনি। আপনি সময় নেন যত ইচ্ছে।”

” কোন সমস্যা নেই, মন টানছে না। আপনি আমার অপছন্দের সেটাও না। আমি এই ব্যাপারটা কিছুতেই মেনে নিতে পারছি না৷ সারাক্ষণ মাথায় এটাই ঘুরপাক খাচ্ছে।”

” আপনি না চাইলে জোর করে তো আপনাকে আমি চাইব না ওরকম ছেলে আমি নই। আপনাকে ছাড়া আমি বাঁচব না এসব ও বলব না। আমাদের বিয়ে না হলে আপনার জীবনে কেউ আসবে আমার জীবনেও কেউ আসবে, আমাদের দুজনের একটা সংসার, একটা ঘর না হয়ে আলাদা দুইটা ঘর হবে। গন্তব্য এটা থাকলে এটাই হবে। ভাগ্য তো আর বদলাতে পারব না। ”

সাহিল ওয়েটারকে ডাকে, ওয়েটার আসলে বিল দিয়ে দেয়। কফিটা ওমনি পাশে রেখে ফাউজিয়াকে বলে, ” কফিটা শেষ করুন। ”

” আপনি খেলেন না?”

” না, আসলে আর কিছু খেতে ইচ্ছে করছে না। অনেককিছুই না চাওয়া সত্ত্বেও গলা দিয়ে নেমে গেছে।”

” আমি আপনাকে কষ্ট দিতে চাই নি। ”

” অপরাধবোধে ভুগবেন না, আমাদের ভাগ্যে যা আছে তাই হবে। আপনি ফিরিয়ে দেওয়ার পর আমার আর আপনার কাছে ফেরা হবে না ফাউজিয়া। আসছি, সৃষ্টিকর্তা আপনাকে ভালো রাখুক।”

সাহিল শেখ ফাউজিয়াকে রেখে একাই চলে যেতে লেগে কিছু একটা মনে করে আবার ফাউজিয়ার কাছে ফিরে আসে। ফাউজিয়া মাথানিচু করে বসেই ছিল। সাহিলে শেখের উপস্থিতি বুঝতে পেরে সামনে তাকায়। ফাউজিয়া তাকাতেই বলে, ” আপনাকে আমার দায়িত্বে নিয়ে এসেছিলাম, চলুন বাড়ি পৌঁছে দিই। এরপর নাহয় আর সামনে না আসলাম।”

” আমি একা যেতে পারব স্যার। আর তাছাড়া আপনি এভাবে কেন কথা বলছেন?”

” বাসায় একা যাবেন?”

” হ্যাঁ একা যেতে পারব। ”

সাহিল আর সেখানে এক মুহূর্ত সময় ব্যয় করে না। টানাপায়ে সেখান থেকে প্রস্থান করে। ফাউজিয়া নিজেও আর কফিটা খেতে পারে না। সে অনুভব করে এটা তার গলা দিয়ে নামবে না।

” একটু চেষ্টা করে দেখুন না প্লিজ, আবিরা আপুর বিয়েতে আপনি না আসলে আমার কোনকিছু ভালো লাগবে না। সবাই এখন থেকেই কত মজা করছে, ওরা কেনাকাটা করতে গেল আর আপনি যখন বললেন আসতে পারবেন না তখন থেকে আমার মন খারাপ। ”

ফোনে শুভ্রতার এমন কথার পরিপ্রেক্ষিতে বলে, ” আমি সর্বোচ্চ চেষ্টা করব শুভ্রা তবে কথা দিতে পারব না। এই কয়েকমাসে আমাকে তিনবার বাহিরের দেশে যেতে হয়েছে। উপর পদে গেলে ব্যস্ততা কমার কথা কিন্তু আমার বেড়েছে। এভাবে আরও দুইমাস কা*টবে তারপর আমি একটু ফ্রি হব।”

” ছোটবোনের বিয়েতে বড়ভাই না থাকলে বিষয়টা কেমন দেখাবে? আপনি চাইলেই হয়তো আসতে পারবেন একটু চেষ্টা করে দেখুন না প্লিজ। আপনি না আসলে এত আনন্দ আমার জন্য নয়।”

শুভ্রতার ভীষণ মন খারাপ সেটা নিহান বুঝতে পারছে কিন্তু তার যে কিছুই করার নেই। কাজের প্রেশার বেড়েছে, সবাইকে সব কাজ বুঝিয়ে দিতেই তার দিন চলছে। কাজগুলো যেন গলায় ঝুলে পড়েছে। শুভ্রতাকে ফোনেই সময় দিতে পারছে না সেখানে বাড়ি আসা তো অনেক দূরের ব্যাপার।

শুভ্রতা আবার বলে ওঠে,” আসবেন না আপনি?”

প্রিয়তমাকে মিথ্যা আশায় ভুলিয়ে রাখার মত অপরা*ধ নিহান করতে চাইছে না। কথা অন্যদিকে নিতে বলে,” তোর কি ট্রান্সফারের ব্যবস্থা হয়ে গেছে? আমি এবার বাড়ি ফিরলে আমার বউকে নিয়ে আসতে পারব?”

” হ্যাঁ, আপনি বিয়েতে আসবেন বলুন?”

” এরকম আবদার করিস না শুভ্রা, প্রিয় মানুষের আবদার মেটাতে না পারার মতো কষ্ট এই পৃথিবীতে আর নেই। আমি খুব চেষ্টা করব আসার বাকিটা আল্লাহ জানেন।”

” হুম।”

নিহান আর শুভ্রতার কথা বাড়তে থাকে। কথার সাথে একজনের অভিমানও বাড়তে থাকে আর আরেকজনের সেই অভিমান ভাঙানোর ক্ষমতা। পুরুষদের সবসময় নারীকে বোঝার ক্ষমতা রাখতে হবে নইলে সেই নারী তার হয়েও তার হবে না।

সময়টা শরৎকাল হলেও সময়ে সময়ে ভীষণ বেগে বৃষ্টি নামে। গরমের আভা কা*টিয়ে পরিবেশ নিস্তব্ধ শীতল করতে মাঝেমধ্যেই বৃষ্টির আগমণ ঘটে। আজকের অতিরিক্ত গরমেও এটার হেরফের হলো না। অভীক, আবিরা আর নেহা শপিং শেষ করে একটু জিরিয়ে নিতে আর কিছু খেতে সামনের ‘মধুবালা’ রেস্টুরেন্টে চলে যায়। আবিরা আর নেহা গিয়ে বসে নিহান বলে, ” তোমরা বসো, আমি দুই মিনিটের মধ্যে আসছি।”

আবিরা শপিং ব্যাগগুলো পাশের চেয়ারে রাখতে রাখতে নেহাকে বলে,” এটা কার রেস্টুরেন্ট জানিস?”

” আমি এখানে আসিও নি জানিও না। রেস্টুরেন্ট হচ্ছে খাবার খাওয়ার জন্য মালিকের নাম জেনে কী করব? আর এত বড় এত সুন্দর রেস্টুরেন্টের মালিক নিশ্চয়ই আমাদের পরিচিত হবে না!”

” পরিচিত হতেও পারে। আগেই কেন ভেবে নিচ্ছিস যে পরিচিত হবে না?”

” কারণ আমাদের বাড়ি থেকে পরিচিত সবাই চাকরি করে। ব্যবসা তো কেউ করে না। কারো সাহস আছে এমন একটা কাজে টাকা ব্যয় করার তুই বল আপু?”

” তা ঠিক, আমাদের বংশে সবাই জব করে তবে আমার মনে হয় জবের চেয়ে ব্যবসা অনেকগুণে ভালো। এটা যার রেস্টুরেন্ট তাকে তুই খুব ভালোভাবে না চিনলেও কিছুটা চিনিস। নাম বললে, চিনিয়ে দিলে ঠিক চিনবি। আমাকে সেদিন….”

” আসসালামু আলাইকুম ভাবি।” আবিরাকে কথা শেষ করতে না দিয়েই একজন এসে সালাম দিল। তাকে দেখেই আবিরার মুখে খুশির রেখা দেখা দিল। সালামের জবাব দিতেই লোকটা এগিয়ে এলো। নেহা রেস্টুরেন্টের বাহিরের দিকে মুখ করে থাকায় দেখতে পায় নি তাই পিছনে ঘুরে তাকাতেই কেমন এক ঝটকায় চুপচাপ হয়ে যায়।৷ থেমে যায় তার চোখ। অস্ফুটস্বরে বেরিয়ে আসে, ” সিয়াম!”

#চলবে………

#শুভ্ররাঙা_ভালোবাসা
#তানিয়া_মাহি(নীরু)
#পর্ব_৪৬

নেহা আবিরার আশেপাশে ঘুরছে অনেকক্ষণ হলো। বাড়ির সবাই কাজে ব্যস্ত থাকলেও বিয়ের কনে রূপচর্চার কাজে মনোনিবেশ করেছে। নেহার এমন ঘুরাঘুরি করা দেখে আবিরা বলে ওঠে, ” কিছু বলবি? এমন পায়চারি করছিস কেন?”

” আপু কাল বরপক্ষ কখন আসবে?”

” বিকেলের দিকে হয়তো, কেন?”

” না এমনি।”

নেহা আর কোন কথা না বলে রুম থেকে বেরিয়ে আসে। জোরে জোরে ধাপ ফেলে নিজের রুমে চলে যায়। বিছানায় বসে ভাবছে এই সময়ে রেস্টুরেন্টে যাওয়া ঠিক হবে কি না? ফোনটা নিয়ে নাড়াচাড়া করতে করতে বান্ধবীর কথা মনে পড়ে, যার বাড়ি সিয়ামের রেস্টুরেন্টের আশেপাশেই। নেহা তাড়াতাড়ি নম্বরটা বের করে কল দেয়। ওপাশের মানুষটা কল রিসিভ করে না। নেহা ফোনটা বিছানার ওপর প্রান্তে ছুড়ে ফেলে। কোন একটা মানুষের সাথে যোগাযোগ করার সকল উপায় অবলম্বন করার পরও যদি তাকে কোনভাবে পাওয়া না যায় তখন কোনকিছু ভালো লাগে না। নেহা আবিরাদের সাথে বিয়ের শপিং শেষ করে বাসায় আসার পর থেকে সিয়ামের সাথে যোগাযোগ করার জন্য উতলা হয়ে আছে। দিনকে দিন কথা বলার আগ্রহটা কেমন বেড়ে চলেছে।
সেদিন রেস্টুরেন্টে বসে যখন তিনজন কথা বলছিল তখন অভীক এসে আবিরার পাশে বসে। সিয়াম সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলে, ” কি খাবেন বলেন, আজ আমার পক্ষ থেকে ট্রিট। ”

নেহা বলে ওঠে, ” আপনি কীসের ট্রিট দিবেন?”

সিয়াম মুচকি হেসে নেহার দিকে তাকিয়ে বলে, ” আমার বন্ধু বিয়ে করতে যাচ্ছে, সেই উপলক্ষেই দিচ্ছি ভেবে নিন।”

সিয়াম আর কোন কথা না বলে ওয়েটারকে ডাকে। ওয়েটার এসে সবার অর্ডার নিয়ে চলে যাওয়ার সময় জানিয়ে যায় বিশ মিনিট লাগবে খাবার রেডি হতে।
ওয়েটার যেতেই নেহা বলে ওঠে,” আপু, পাশেই দেখলাম কসমেটিকসের দোকান। আমি গিয়ে দেখে আসি যে রঙের লিপস্টিক খুঁজছি সেটা আছে কি না?”

আবিরার আগেই অভীক বলে ওঠে,” সেটা তো রোড ক্রস করে যেতে হবে ওপাশে, এপশে দোকান নেই। খাওয়া দাওয়া করেই যাওয়া যেত সবাই মিলে।”

” সামান্য একটা লিপস্টিকের জন্য আপনাদের আর যেতে হবে না আমিই গিয়ে দেখে আসছি। ”

আবিরা সম্মতি দিলে নেহা চেয়ার ছেড়ে উঠে ব্যাগটা নিয়ে বেরিয়ে যায়। রাস্তার পাশ দিয়ে কিছুক্ষণ হেটে রাস্তা পার হওয়ার জন্য পা বাড়াতেই কেউ এসে খপ করে নেহার হাত ধরে ফেলে। নেহা পিছনে তাকাতেই দেখে সিয়াম।
” আপনি?”

” দুইপাশে গাড়ি দেখে পার হবেন না? আসুন আমার সাথে।”

সিয়াম হাত ধরে নেহাকে রাস্তার এপাশে নিয়ে আসে। নেহা বলে,” আপনি আসতে গেলেন কেন?”

” আপনার মতো পথচারীকে রাস্তা পার করে দিতে।”

“আমি রাস্তা পার হতে পারি। ঠিক চলে আসতাম, আপনি শুধু শুধু…”

” সেদিনের জন্য ধন্যবাদ নেহা। সৃষ্টিকর্তা আমাকে সাহায্য করার জন্য আপনাকে অন্তত না পাঠালে কি যে হতো!”

নেহা আর সিয়াম পাশাপাশি হাটতে হাটতে কথা বলতে থাকে। এক পর্যায়ে সিয়াম নিজের কার্ডটা নেহাকে দেয়, কোন প্রয়োজন হলে তাকে কল দিতে বলে। নেহা কার্ডটা নিয়ে হাসিমুখে নিজের ব্যাগে রাখে।

নেহা সেদিন শপিং করে এসে খুব ক্লান্ত থাকায় বাসায় আর না খেয়েই ঘুমিয়ে পড়ে৷ পরদিন সিয়ামের কথা মনে হতেই কল করার জন্য ব্যাগে রাখা কার্ডটা খোঁজে কিন্তু কিছুতেই পায় না। নেহার মনটা যেন কালোমেঘে ঢেকে যায়৷ নেহা ভাবতে থাকে তাহলে কি ওটা কোনভাবে ব্যাগ থেকে পড়ে গেল?

শুভ্রতা ছাদে বসে ছিল। অন্ধকার রাত, আকাশে দুই একটা তারা জ্বলজ্বল করছে। শুভ্রতা ছাদের রেলিংয়ে হেলান দিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে ছিল। এশার নামাজটা আদায় করে ভালো লাগছিল না বিধায় ছাদে এসে দাঁড়িয়েছে সে। হঠাৎ চিলেকোঠার দরজায় শব্দ হতেই শুভ্রতা সেদিকে তাকায়। স্নিগ্ধা তার দিকেই এগিয়ে আসছে দেখে আগের মতোই দাঁড়িয়ে থাকে শুভ্রতা।

” আপু তোর মন খারাপ? ভাইয়া আসতে পারবে না তাই এখানে মন খারাপ করে দাঁড়িয়ে আছিস?”

শুভ্রতা কোন কথা বলে না। যেভাবে দাঁড়িয়ে ছিল সেভাবেই দাঁড়িয়ে থাকে। স্নিগ্ধা বুঝে যায় শুভ্রতার মন ভীষণ খারাপ। স্নিগ্ধাও শুভ্রতার পাশে রেলিংয়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে বলে, ” আম্মু তোর জন্য পায়েস পাঠিয়েছিল। তোকে দিতে এসে দেখি বিছানার ওপর ফোন বাজছে। স্ক্রিনে বড় বড় অক্ষরে লেখে ” জামাইজান”

শুভ্রতা চোখ বড় বড় করে বলে, ” আমার ফোনে এই নামে কারো নম্বর সেভ করা নেই একদম উল্টাপাল্টা কথা বলবি না। ”

” তুই এই নামে নম্বর সেভ করতে ভুল করেছিস জন্য কি আমি বলতে ভুল করব? তোর বর তোকে ফোনের ওপর ফোন দিয়েই যাচ্ছে আর তুই ছাদে দাঁড়িয়ে দুঃখবিলাস করছিস! কাল বিয়ে আর তুই এখানে এভাবে থাকলে আবিরা আপু, বড়আম্মু মন খারাপ করবে না? আর ওদিকে নেহার কথা আর কি বলব! যা তাড়াতাড়ি বরকে বাঁচা আগে। ”

শুভ্রতা আর কোন কথা না বলে দৌঁড়ে নিচে চলে আসে। নিজের রুমে ঢুকে দেখে তখনও ফোন বাজছে। শুভ্রতা তাড়াতাড়ি করে কলটা রিসিভ করলে ওপাশ থেকে নিহান বলে ওঠে, ” আমি কখন থেকে কল দিচ্ছি, কি করছিলি তুই?”

শুভ্রতা নীরবস্বরে বলে, ” ভালো লাগছিল না তাই ছাদে দাঁড়িয়ে ছিলাম৷ স্নিগ্ধা বলল ফোন বাজছে তাই দৌঁড়ে আসলাম। আপনি কি আসছেন?”

” না, আমার আসা হবে না সেটা জানাতেই কল দিলাম তোকে। বাড়ির সবাই কি করছে?”

” আপনার আসা হবে না?”

” না।”

শেষ পর্যন্ত যে আশা বুকে জিইয়ে রেখেছিল শুভ্রতা সেটাও শেষ হয়ে গেল। ছাদ থেকে রুমে আসা পর্যন্ত তার মনে হয়েছিল নিহান তাকে বলবে, ” শুভ্রতা আমি বাসায় ফিরছি, তুই মন খারাপ করে থাকিস না। ” কিন্তু তা আর হলো না। শুভ্রতাকে চুপচাপ থাকতে দেখে নিহান আবার বলে ওঠে, ” কি হলো চুপ করে আছিস কেন?”

” আপনার জানা উচিৎ আপনাকে কেউ ভালোবাসে, আপনার জানা উচিৎ আপনার অনুপস্থিতি কাউকে আকাশসম দুঃখ দেয়, আপনার জানা উচিৎ আপনার অনুপস্থিতিতে কোন আনন্দঘন উৎসবমুখর পরিবেশটাও বিষাদে ছেয়ে যায়।”

” কি করব বল? আমার হাতে যে কিছুই নেই।”

” আপনি তো বড় অফিসার হয়েছেন, তবু নিজের প্রয়োজনে বাড়ি আসতে পারবেন না? কি লাভ হলো তাহলে মেজর হয়ে?”

শুভ্রতা আর নিহানের আরও কিছুক্ষণ কথা চলে। কথার মাঝে নেহা এসে দরজায় নক দিয়ে বলে, ” কথা শেষ করে একটু আমার রুমে এসো প্লিজ একটু দরকার আছে। ” শুভ্রতা মাথা ঝাঁকিয়ে সম্মতি জানাতেই নেহা সেখান থেকে চলে যায়। শুভ্রতাও নিহানের সাথে কথা শেষ করে রুম থেকে বের হয়।

সকাল সকাল সিয়াম এসে অভীকের পিছনে ঘুরঘুর করছে নেহার নম্বরের জন্য। অভীক যেন কোনভাবেই সিয়ামকে পাত্তা দিচ্ছে না। সিয়াম অভীকের ফোনটা কোনভাবে নিয়ে নিলেও সে অভীকের ফোনের লক খুলতে পারছে না। অভীক বসে হো হো করে হাসছে আর বলছে, ” আমি যখন আবিরার প্রেমে পড়েছিলাম তখন তো খুব মজা করেছিলি। কত কথা বলেছিলি আর আজ নিজের দিকে তাকিয়ে দেখ একবার।”

সিয়াম ফোনটা আবার অভীকের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলে, ” লাগবে না নম্বর, আমি নিজেই নেব আজ তোর শালিকার কাছে থেকে।”

” যদি নেহার বয়ফ্রেন্ড থাকে তাহলে? অনার্সে পড়া মেয়েকে তুই সিঙ্গেল পাবি?”

” ওর চালচলন কথাবার্তায় আমার মনে হয়েছে নেহার প্রেমিক নেই।”

” দোয়া করি শালিকা যেন একা না থাকে।”

সিয়াম ভ্রু কুচকে অভীকের দিকে তাকিয়ে বলে, ” বন্ধু হয়ে শ*ত্রুর মতো দোয়া করতে লজ্জা করছে না তোর? ”

” একদম লজ্জা করছে না, লজ্জা করারও কথা না। ”

অভীকের কথা শুনে অসহায়ের মতো তার দিকে তাকিয়ে থাকে সিয়াম। অভীকের হাসি দেখে সিয়ামের একটা কথাই মাথায় আসছে, ” হাতি কাদায় পড়লে চামচিকাতেও লা*থি মা*রে।”

সকাল সকাল আবিরা নেহা আর স্নিগ্ধাকে নিয়ে পার্লারে গিয়েছে। শুভ্রতাকে অনেকবার যেতে বলায়ও সে যায় নি। শুভ্রতা নিজের মন খারাপ কিছুতেই কাটিয়ে উঠতে পারছে না। সবার সাথে হাসিখুশি মুখে কথা বললেও মন থেকে কালো মেঘ কিছুতেই সরছে না।
শুভ্রতা বাড়ির বড়দের সাথে রান্নাঘরে কাজ করছিল। প্রায় দুপুর হয়ে যাচ্ছে দেখে রাবেয়া বেগম শুভ্রতাকে রেডি হতে ঠেলেঠুলে পাঠিয়ে দেয়। শুভ্রতাও আর দেরি না করে রুমে চলে যায়। ঘড়িতে একটা বাজতে চলেছে অর্থাৎ পার্লার থেকে সবাই খুব তাড়াতাড়ি চলে আসবে। শুভ্রতা তাড়াতাড়ি তোয়ালে আর আপাতত পরার মতো কিছু নিয়ে ওয়াশরুমে চলে যায়। গোসল শেষ করে মাথা মুছতে মুছতে রুমে এসে দেখে রুম ভেতর থেকে লক করা। শুভ্রতার যতটুকু মনে পড়ে সে দরজা খোলা রেখেছিল। দরজার দিকে এগিয়ে যেতেই টেবিলে রাখা ফোনটা বেজে ওঠে। শুভ্রতার পা থেমে যায়। সামনের দিকে না এগিয়ে এবার টেবিলের কাছে গিয়ে ফোনটা হাতে নিতেই পিছন থেকে কেউ এসে তার কোমর চেপে ধরে। শুভ্রতা চিৎকার দিতেই উক্ত ব্যক্তি কোমর ছেড়ে সামনে এসে শুভ্রতার সামনে দাঁড়ায়।

শুভ্রতা বলে ওঠে, ” ক কে আ আপনি?”

#চলবে……

#শুভ্ররাঙা_ভালোবাসা
#তানিয়া_মাহি(নীরু)
#পর্ব_৪৭

গোসল শেষ করে মাথা মুছতে মুছতে রুমে এসে দেখে রুম ভেতর থেকে লক করা। শুভ্রতার যতটুকু মনে পড়ে সে দরজা খোলা রেখেছিল। দরজার দিকে এগিয়ে যেতেই টেবিলে রাখা ফোনটা বেজে ওঠে। শুভ্রতার পা থেমে যায়। সামনের দিকে না এগিয়ে এবার টেবিলের কাছে গিয়ে ফোনটা হাতে নিতেই পিছন থেকে কেউ এসে তার কোমর চেপে ধরে। শুভ্রতা চিৎকার দিতেই উক্ত ব্যক্তি কোমর ছেড়ে সামনে এসে শুভ্রতার সামনে দাঁড়ায়।

শুভ্রতা বলে ওঠে, ” ক কে আ আপনি?”

শুভ্রতার সারাশরীর ভয়ে কাঁপছে। অচেনা, অজানা মানুষের তো বেডরুম পর্যন্ত পৌঁছানোর কথা না। শুভ্রতা একপলকে সামনে দাঁড়ানো মুখোশ পরা ব্যক্তিটির দিকে তাকিয়ে আছে। শুভ্রতার ভয়ার্ত মুখ দেখে ব্যক্তিটি নিজেই মুখ থেকে মুখোশ খুলে ফেলে হাসি মুখে শুভ্রতার দিকে তাকায়।
শুভ্রতা বলে ওঠে, “আপনি!”

” সারপ্রাইজ.. ”

শুভ্রতা চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে, হঠাৎ নিহানকে অবাক করে দিয়ে জড়িয়ে ধরে সে। নিহানকে যেন তার অবাস্তব কিছু মনে হচ্ছে। শুভ্রতা বিশ্বাসই করতে পারছে না যে নিহান এসেছে তার কাছে। নিহান শক্ত করে শুভ্রতাকে জড়িয়ে ধরে। শুভ্রতা বুকে মাথা রেখেই বলে, ” আপনি জানেন আপনাকে ছাড়া আমার কত কষ্ট হচ্ছিল? কিচ্ছু ভালো লাগছিল না আমার। ”

” দেখতেই তো আসলাম আমার বউ কতটা কষ্ট পাচ্ছে! ”

” আমার কষ্ট দেখার খুব ইচ্ছে? কষ্ট দেখার জন্যই কি ইচ্ছে করে কষ্ট দেন আমায়?”

” আমাকে না পাওয়ায় কেমন কষ্ট হয় তোর সেটা আমি দেখতে চাইতেই পারি। আমি ছাড়া অন্যকেউ তোকে কষ্ট দেওয়ার কথা চিন্তা করলেও ভুল করবে। যে মাথা দিয়ে ভাববে তোকে কষ্ট দেবার কথা সেই মা*থা আমি দে*হ থেকে আলাদা করে দেব।”

শুভ্রতা নিহানের কাছে থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নেয়। নিহান খেয়াল করে শুভ্রতার মুখে হাসি ফুটেছে। হঠাৎ করে প্রিয় মানুষ সামনে চলে এলে কে না খুশি হয়!

শুভ্রতা বিছানার ওপর রাখা শাড়িটা হাতে নিয়ে নিহানকে বলে, ” আপনি তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে আসুন, আমি ততক্ষণে রেডি হয়ে নিই। এখানে দেরি করলে আরও বেশি দেরি হয়ে যাবে।”

” এত পথ পাড়ি দিয়ে আসলাম বউয়ের সাথে সুখ-দুঃখের আলাপ করব না?”

শুভ্রতা শাড়ির আঁচলটা শরীরে এলিয়ে দিয়ে মুচকি হেসে বলে, ” বউ তো আর পালিয়ে যাচ্ছে না। বউ আপনারই, আলাপ করার অনেক সময় পাবেন।”

” তোমাকে হারিয়ে যেতে দিলে তো হারাবে। ”

” কতগুলো মাস বউকে ছেড়ে ছিলেন বলুন তো? এখন এসে বড় বড় কথা!”

নিহান শুভ্রতার কোমরে হাত রেখে এক ঝটকায় নিজের খুব কাছে নিয়ে আসে। শুভ্রতা অপ্রস্তুত হয়ে যায়। নিহানের চোখমুখে দুষ্টুমির ছাপ স্পষ্ট। নিহান শুভ্রতার মুখের ওপর আসা ভেজা চুলগুলো আঙুলের ডগা দিয়ে কানের পিছনে গুজে দেয় আর বলে,” আজ সব দূরত্ব ঘুচিয়ে দেব, হবে না?”

শুভ্রতা বেশ লজ্জা পেয়ে যায়। অন্যদিকে তাকিয়ে বলে, ” ছাড়ুন তো, দেরি হয়ে যাচ্ছে। এখনই দেখা যাবে কেউ না কেউ চলে আসবে।”

নিহান শুভ্রতার মুখ তার দিকে করে কপাল থেকে ঠোঁট পর্যন্ত আঙুল বেয়ে চিবুকে ঠেকিয়ে বলে, ” কেউ আসলেও দরজার ওপাশ পর্যন্তই। ভয় নেই আমাদের এই অবস্থায় কেউ দেখবে না।”

” আপনি ছাড়ুন আমাকে আর তাড়াতাড়ি গিয়ে গোসলটা সেরে নিন।”

শুভ্রতা জোর করতে থাকে নিজেকে ছাড়িয়ে নেওয়ার। নিহানের থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নেওয়া যেয়ে অসম্ভব সেটা জেনেও নড়াচড়া করতে দেখে নিহান আরও শক্ত করে চেপে ধরে। শুভ্রতা অসহায় চোখে নিহানের দিকে তাকায়৷ নিহান হেসে বলে ওঠে, ” নে ছাড়িয়ে নে দেখি কত শক্তি আছে শরীরে।”

” ছাড়বেন না? আমাকে তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নিচে যেতে হবে। বড়মা তাড়াতাড়ি যেতে বলেছে, ওখানে অনেক কাজ আছে।”

নিহান শুভ্রতাকে ছেড়ে দেয়। শুভ্রতা স্থীর হয়ে দাঁড়ায়। নিহান শুভ্রতার কপালে আলতো করে চুমু খেয়ে বলে, ” তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নে আমরা একসাথে নিচে নামবো, ঠিক আছে?”
শুভ্রতা মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানায়। নিহানও পোশাক পরিবর্তন করে ওয়াশরুমে চলে যায়।

অভীক আর আবিরার বিয়ের কাজ শুরু হয়ে গিয়েছে। আবিরা আর অভীককে পাশাপাশি বসানো হয়েছে। অভীকের পাশে সিয়াম বসে আছে আর অন্যদিকে আবিরার পিছনে দাঁড়িয়ে আছে স্নিগ্ধা, নেহা আর শুভ্রতা। বিয়ে সম্পন্ন হলে আবিরার মা নেহাকে মিষ্টি বিলি করতে বললেন। নেহা ঘরভর্তি মানুষ এড়িয়ে সেখান থেকে বেরিয়ে এলো। মিষ্টি রান্নাঘরে রাখা আছে জেনে নেহা সোজা রান্নাঘরে চলে গেল। মিষ্টি রাখা পাত্রটি টেবিলের ওপর থেকে নিয়ে ঘরতেই দেখে সিয়াম দরজায় দাঁড়িয়ে আছে। নেহা শুকনো ঢোক গিলে নেয়। সিয়ামকে দেখে সে ভীষণ অপ্রস্তুত হয়ে যায়। এদিক ওদিক তাকাতে থাকে সে। নেহার আমতা আমতা করে বলে, ” আব্ কিছু লাগবে আপনার? ”

সিয়াম এগিয়ে এসে বলে, ” হ্যাঁ লাগবে তো অনেককিছুই। কোনটা রেখে কোনটা বলি বলুন তো? ”

” ম মানে?”

সিয়াম নেহার পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে বলে, ” মানে.. আচ্ছা বলছি তার আগে একগ্লাস পানি খাওয়ান তো বেয়াইন সাহেবা। ”

নেহা মিষ্টির পাত্রটা আবার টেবিলে রাখাতে রাখতে বলে ” আমার নাম নেহা।”

শুভ্রতা তাড়াহুড়ো করে রান্নাঘরের দরজায় আসতেই দেখে নেহা আর সিয়াম একসাথে। সে বুঝে যায় মিষ্টি তাকেই নিয়ে যেতে হবে নইলে আজ কারো ভাগ্যে আবিরার বিয়ের মিষ্টি জুটবে না। শুভ্রতা গলা খাঁকারি দিতেই সিয়াম আর নেহা একসাথে শুভ্রতার দিকে তাকায়। শুভ্রতা মুখে হাসির রেখা টেনে বলে, ” নেহা আমি মিষ্টি নিয়ে যাচ্ছি, তুই আস্তেধীরেই আয়।” বলেই এগিয়ে গিয়ে মিষ্টি নিয়ে বের হতেই নিহান এসে সামনে দাঁড়ায়। মিষ্টির পাত্রটি শুভ্রতার হাত থেকে একপ্রকার ছিনিয়ে নিয়ে বলে, ” তোর আর মিষ্টির ওজন একই। বয়ে আনছিলি কীভাবে?”

” মোটেও না, শুধু শুধু বাজে বকছেন।”

” তোকে তো কোলে নিয়েছি আমি, আমার চেয়ে তুই বেশি বুঝবি নাকি ওজন এক নাকি ভিন্ন?”

” তাড়াতাড়ি মিষ্টি বিতরণ করুন বাকি কথা পরে হবে।” শুভ্রতা নিহানকে ঠেলে সবাই যে রুমে আছে সেদিকে পাঠিয়ে দেয়।

সিয়াম গ্লাসের পানি শেষ করতেই নেহা বলে, ” আর কি চাই বলেন?”

সিয়াম গ্লাস রাখতে রাখতে বলে, ” আপনার কাছে চাইলেই কি পাওয়া যায়? এরকম যদি হয় তাহলে লিষ্টটা বাড়াতে হবে।”

” স্পষ্ট করে বলুন তো কি বলতে চাইছেন?”

” আপনাকে চাইলে কি পাওয়া যাবে? যদি পাওয়া যায় তো বলুন বড়বোনের বিয়েতে ছোটবোনকেও নিয়ে যাই!”

সিয়ামের কথায় হেসে ফেলে নেহা। প্রথমদিনে সে সিয়ামকে যেমন ভেবেছিল তেমন একদমই নয়।
নেহা হাসি থামিয়ে বলে, ” আমি তো জিনিস নই যে চাইলেই পাওয়া যাবে, আমি তো মানুষ আর মানুষকে চাইলেই পাওয়া যায় না। মানুষকে পেতে অনেক কাঠখড় পো*ড়াতে হয়। এখন বলুন আমাকে ছাড়া আর কি চাই?”

সিয়াম বলে, ” যা কিছুই চাই না কেন সেসবের শেষ আপনিই তাই আপনাকেই চেয়ে বসলাম। এখন বলেন কি করলে আপনাকে পাওয়া যাবে?”

” কোনভাবেই পাওয়া যাবে না।” বলেই নেহা চলে যেতে লাগলে সিয়াম নেহার হাত ধরে ফেলে। নেহা সিয়ামের দিকে তাকিয়ে আবার হাতের দিকে তাকাতেই সিয়াম হাত ছেড়ে দেয়।

ফাউজিয়া রুমে পায়চারি করছে। পাশের রুম থেকে তার মা অনর্গল কথা শুনিয়েই যাচ্ছে। চুপচাপ কথা শোনা ছাড়া তার যে কোন উপায় নেই আজ।

কিছুক্ষণ আগে সাহিল শেখ-এর মা ফাউজিয়াদের বাসায় এসেছিলেন। কলিংবেল বাজতেই ফাউজিয়া গিয়ে দরজা খুলে দেখে সাহিল শেখ-এর মা দাঁড়িয়ে। ফাউজিয়া সালাম দিয়ে ভেতরে আসতে বললে তিনি ফাউজিয়ার সাথে টুকটাক কথা বলে তার মায়ের রুমে চলে যায়। ফাউজিয়া বেশ বুঝতে পারে উনার মন খারাপ তবুও মুখে মিথ্যে হাসি। ফাউজিয়ার খুব অস্বস্তি অনুভব হচ্ছে কিন্তু তার যে মন কিছুতেই টানছে না।

ফাউজিয়া চা করে মায়ের রুমের দিকে যেতেই শুনতে পায় ভদ্রমহিলা তার মাকে বলছে, ” সাহিল এখন বেঁকে বসেছে৷ সে এখন বিয়েটা করবে না। চাকরিটাও ছেড়ে দিয়েছে, ফ্ল্যাট বিক্রি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বলছে গ্রামে চলে যাবে ওখানে কিছু একটা করবে। তার হঠাৎ এই সিদ্ধান্ত কেন কিছুই বুঝতে পারছি না। আপনার সামনে আসতেও লজ্জা লাগছিল কিন্তু মেয়েটার জীবন জড়িয়ে আছে আমাদের সাথে, কথাটা কীভাবে বলব বুঝতে পারছিলাম না তারপর ভাবলাম কথাটা জানাতে তো আমি বাধ্য,তাই জানাতে আসলাম।”

ফাউজিয়ার হাত কাঁপছে, ধীরপায়ে রুমে প্রবেশ করে চা রেখে আবার বাহিরে চলে আসে সে। বাহিরে আর কোথাও না দাঁড়িয়ে সোজা নিজের রুমে চলে যায় ফাউজিয়া। বিয়েতে অমত করায় এত বড় সিদ্ধান্ত কেন নিল সাহিল?

ফাউজিয়া তাড়াহুড়ো করে সাহিল শেখ-এর নম্বর বের করে কল করে। রিং হচ্ছে আর ফাউজিয়ার হৃৎস্পন্দন বাড়ছে। ফোনে রিং হচ্ছে আর রুমের এপাশ থেকে ওপাশে পায়চারি করছে ফাউজিয়া। কল কেটে গেলে আবার কল দিতেই নম্বর ব্যস্ত বলল ফাউজিয়া ভাবে সাহিল শেখ হয়তো তাকে কলব্যাক করছে। ফাউজিয়া কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে কিন্তু কল আসছে না দেখে সে আবার কল দেয়, নম্বর আবার ব্যস্ত বললে ফাউজিয়া বুঝে যায় সাহিল তার নম্বর ব্লক করেছে। টেক্সট করবে এমন সময় সাহিলের মা এসে ফাউজিয়ার কাছে থেকে বিদায় নিয়ে চলে যায়।
সাহিলের মা চলে যাওয়ার পর থেকেই ফাউজিয়ার মা মেয়েকে নিয়ে চেঁচাতে শুরু করেছেন কারণ তিনি বুঝতে পেরেছেন তার মেয়ের জন্যই এসব কিছু হচ্ছে। পাশের রুম থেকে মা কথা শোনাতেই আছে আর এপাশে বসে ফাউজিয়া বারবার সাহিলের ফোনে কল দেওয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছে।

আবিরার বিয়ে সম্পন্ন হয়েছে অনেকটা সময় আগেই। এখন বরযাত্রীর সবাই বাড়ি ফেরার জন্য তৈরি। ছোট বড় সকলে একে একে বাড়ি থেকে বের হয়ে গাড়িতে উঠছে। আবিরার বাড়ির সবাই আবিরা আর অভীককে নিয়ে ধীরেধীরে বের হচ্ছে। অভীক আমির সাহেবের কাছে বিদায় নিতে আসলে আমির সাহেব অভীকের হাত দুটো নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বলেন, ” বাবা হিসেবে আমি আমার মেয়ের পাশে খুব কম সময় ছিলাম। আমি চেয়েছি আমার ছেলে-মেয়েরা যেন অভাব কি সেটা না বোঝে সেজন্য আমি আমি পরিবার থেকে দূরে থেকেছি। দূরে থাকলেই যে ভালোবাসা কম থাকে এমন না। একটা বাবার কাছে তার মেয়ে যে কী অমূল্য সম্পদ সেটা তুমিও বুঝবে যখন তুমি বাবা হবে৷ আমি আমার মেয়েকে বাবার স্নেহ প্রতিদিন দিতে পারি নি তবে তুমি স্বামী হিসেবে তার পাশে থেকো। আমার মেয়েটা ভুল করলে তাকে সঠিকটা বুঝিও। তাকে কড়া কথা শুনিও না, গায়ে ভুলে ফুলের টোকাও দিবে না আমি শুনলে সেটা সহ্য করতে পারব না। আমার মেয়ের দ্বারা কোন অন্যায় হলে সেটা আমাকে জানাবে, প্রয়োজনে আমি আমার মেয়েকে শুধরে দেব। আমার মেয়ে যেন ভালো থাকে সেই চিন্তা করেই তোমাদের বিয়েতে আমি অমত করি নি।”

আমির সাহেব দম ফেলে আবার বলেন,” আমার মেয়েকে খুব ভালো রেখো বাবা।”

অভীক আমির সাহেবকে আস্বস্ত করে বলে, ” আপনি কোন চিন্তা করবেন না বাবা, আবিরা খুব ভালো থাকবে ইন শা আল্লাহ। ”

আরও কিছু কথা বলে আমির সাহেবের থেকে বিদায় নিয়ে একে একে আবিরার মা, নিহান, শুভ্রতার মা, শুভ্রতা, শুভ্রতার বাবা সবার থেকে বিদায় নিয়ে আবিরাকে নিয়ে গাড়িতে উঠে বসে অভীক। আবিরার বাবা দূরে দাঁড়িয়ে আছেন। রাবেয়া বেগম কান্না করছে। এত এত কান্নাজড়ানো পরিবেশের মাঝে সিয়ামেরও মন খারাপ হতে থাকে। বাইক নিয়ে একা দাঁড়িয়ে আছে সে। নেহাকে কোথাও দেখা যাচ্ছে না। হঠাৎ ঝড়ো হাওয়ার গতিতে নেহা এসে সিয়ামের সামনে এসে দাঁড়ায়। সিয়াম একপলকে তাকিয়ে আছে নেহার দিকে। নেহা সিয়ামের তাকানো উপেক্ষা করে তার পাঞ্জাবির পকেটে কিছু একটা রেখে বোনের গাড়ির সামনে দৌঁড়ে যায়। সিয়াম তাড়াহুড়ো করে পকেটে হাত দিয়ে কাগজের টুকরো পায়, সামনে নিয়ে ভাজ খুলতেই তার মুখে হাসি ফুটে যায়।

#চলবে…..