শুভ্ররাঙা ভালোবাসা পর্ব-৪৮+৪৯+৫০

0
247

#শুভ্ররাঙা_ভালোবাসা
#তানিয়া_মাহি(নীরু)
#পর্ব_৪৮(১ম অংশ প্রাপ্তবয়স্ক মনস্কদের জন্য,কেউ চাইলে স্কিপ করে যেতে পারেন।)

” এই কয়েকটা মাস তোকে আমি কতটা মিস করেছি তুই ভাবতেও পারবি না শুভ্রা। মনে হয়েছে ছুটে এখানে চলে আসি, তোকে জড়িয়ে ধরি৷”

রাতে শুভ্রতা আর নিহান ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে কথা বলছিল। বলতে গেল মাঝরাত, চারপাশ স্তব্ধ, নিরবতা বিরাজ করছে। মাঝেমাঝে ঝোঁপঝাঁড় থেকে পোকা ডেকে উঠছে শুধু। নিহান শুভ্রতাকে পিছন দিক থেকে জড়িয়ে ধরে শুভ্রতার কাধে থুতনি রেখে কথা বলছে।

” মিস করেছেন, চলে আসতে ইচ্ছে করেছে তাহলে আসেন নি কেন শুনি? আপনার তো ধরাবাঁধা নিয়ম নেই।”

” অনেক কাজ ছিল। কিছু কাজ এসেছে হাতে। তোকে আমার কাছে নিয়ে যাওয়ার দুই একমাস পর আবার আসতে হবে। গ্রামের শেষ মাথায় একটা স্কুল হবে। প্রজেক্টটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর আমি ওখানে ভার্সিটিতে তোর জন্য কথা বলে রেখেছি৷ সব একদম ঠিকঠাক, শুধু রেজাল্ট দিক তারপরই কার্যক্রম শুরু হয়ে যাবে। ”

” আমার সবাইকে ছেড়ে যেতে খুব কষ্ট হচ্ছে।”

নিহান শুভ্রতাকে ছেড়ে এবার দুই বাহু শক্ত করে ধরে জিজ্ঞেস করে, ” আমার কাছে যেতে ইচ্ছে করছে না? আমার থেকে দূরে থাকতে কষ্ট হয় না তোর? ”

” সবাইকে নিয়ে একসাথে থাকার ভাগ্য কেন যে হলো না!”

” আমাকে মনে পড়ে নি এই কয়েকটা মাস? মনে হয়নি আমাকে ছাড়া তোর দিন কাটানো মুশকিল?”

” হয়েছে, খুব করে মনে হয়েছে। প্রতিটা মিনিট আমাকে আপনার অনুপস্থিতি টের পাইয়েছে। ”

” আমাকে কাছে পেতে ইচ্ছে করে নি? একটাবার ছুয়ে দেখতে ইচ্ছে করে নি?”

নিহানের কথায় এবার মিইয়ে যায় শুভ্রতা। মাথা নিচু করে নেয়। লজ্জা লাগছে তার। কোন নারীর তার ব্যক্তিগত পুরুষকে কাছে পেতে ইচ্ছে করেছে কি না, স্পর্শ করতে ইচ্ছে করেছে কি না এসব কথা সেই পুরুষের সামনে যে নারীর লাজলজ্জার বালাই নেই সেই নারীই শুধু নির্দ্বিধায় বলতে পারে। শুভ্রতার মতো মেয়ে যে কি না কথাই বলতে লজ্জা পায় নিহানের সাথে আর সে কীনা এসবের কথা বলবে! লজ্জায় মাথা হেট হয়ে যায় শুভ্রতার। নিহান আবার বলে ওঠে, ” চুপ হয়ে গেলে কেন বলো?”
শুভ্রতা কথাটা এড়িয়ে যেতে বলে, ” আর কতক্ষণ এভাবে দাঁড়িয়ে থাকবেন, রাত দুটো বাজতে চলল ঘুমাবেন না?”

” আমাকে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করেনি? মনে হয়নি এতগুলো মাস পর আসলেই কাছে পেয়ে আবেগী হয়ে গাল,চোখ,নাক,ঠোঁট চুমুতে ভরিয়ে দিবি?”
হঠাৎ কিছু একটা মনে পড়ে যাওয়ার মতো নিহান বলল, ” এই তুই আমাকে চুমু খাস নি কেন?”

শুভ্রতা ভ্রু কুচকে নিহানের দিকে তাকিয়ে আছে। নিহানকে আগাগোড়া একবার পর্যবেক্ষণ করে নিল। এই লোকটা উল্টাপাল্টা কথা বলা শুরু করল কেন? তাকে লুকিয়ে নে* শা করেনি তো?

” আপনি ঠিক আছেন?”

” কেন? ঠিক নেই মনে হচ্ছে?”

শুভ্রতা মুখে কিছু না বলে হ্যাঁসূচক মাথা ঝাঁকালো।
নিহান এতক্ষণে শুভ্রতার হাত ছেড়ে বেলকনির গ্রিলে হাত রেখে দাঁড়িয়ে শুভ্রতার সাথে কথা বলছিল। শুভ্রতার নিরবতা কাটাতে বাম হাত দিয়ে শুভ্রতাকে টেনে সামনে দাঁড় করিয়ে আবার বাম হাত দিয়ে গ্রিল ধরল। নিহান শুভ্রতার দিকে তাকিয়ে আছে আর শুভ্রতা অন্যদিকে। নিহানের আচরণ এবার তাকে লজ্জা পাইয়ে দিচ্ছে।

” বউ!”

নিহানের ডাকে তার দিকে তাকায়। নিহান ঠোঁট প্রসস্থ করে, নিহানের হাসিমাখা মুখ শুভ্রতা একপলকে দেখতে থাকে।

” এই বউ।”

” এসব কি ডাক?”

” বউ একটা চুমু খাই?”

” কি অসভ্য আপনি!”

শুভ্রতার কথার প্রত্তুত্তোরে কিছু না বলে শুভ্রতার গালে ঠোঁট ছুইয়ে দেয় নিহান। শুভ্রতা নিঃশ্বাস আটকে চোখ বন্ধ করে দাঁড়িয়ে আছে সেখানে। নিহান গাল থেকে ঠোঁট উঠাতেই ভারী একটা নিঃশ্বাসের শুব্দ হয়। শুভ্রতার এহেন কর্মকান্ডে তাকে আরেকবার ভড়কে দিতে শুভ্রতার কোমর দুইহাতে চেপে ধরে। শুভ্রতা টাল সামলাতে না পেরে নিহানের বুকে হাত রাখে। সামনের ছোট চুলগুলো চোখে মুখে আটকে যায়। শুভ্রতা মুখে হাত দেওয়ার আগেই নিহান হাত দিয়ে চুলগুলো কানের পিছনে গুজে দেয়। শুভ্রতা এবার নিহানের দিকে তাকিয়ে আছে। নিহান বুঝতে পারছে না শুভ্রতা এখন মনে মনে কি ভাবছে? তাকে কি গা*লম*ন্দ করছে? করতেও পারে আবার না করতেও পারে।
নিহান এবার শুভ্রতার গালের পাশে হাত রেখে শুভ্রতার চোখে চোখ রেখে বলে, ” আরেকটু অস*ভ্যতামি করতে ইচ্ছে করছে। তোমার ঠোঁট দুটো আমাকে আহ্বান করছে শুভ্রা। আজকে যদি আরেকটু অশ্লী*ল প্রেমিকের মতো আচরণ করি তাহলে কি খুব অন্যা*য় হবে? এই অ*ন্যায়ের শা*স্তিস্বরূপ তোমাকেই চাইব আমি। ”

শুভ্রতার ঘনঘন নিঃশ্বাস নিচ্ছে আর প্রশ্বাস ফেলছে। মুখ দিয়ে একটা কথাও বের হচ্ছে না তার, এই মুহুর্তে হয়তো কোন নারীর কথা বের হওয়াটাই অসম্ভব কিছু। অতঃপর নিহানের সম্মোহনী ডাকে সাড়া দিয়েই ফেলল শুভ্রতা। দুজন দুজনকে নতুন করে পাওয়ায় মেতে উঠলো। প্রকৃতিও সাক্ষী হলো নতুন এক যুগলের পূর্ণতায়।

তিনটা দিন কেটে গিয়েছে। আবিরা আর অভীক এসে আবার বাড়ি ফিরেও গিয়েছে। নেহা আর সিয়ামের ব্যাপারটা কচ্ছপের গতিতে এগোচ্ছে। অসম্ভব ছটফটানিতে দিনগুলো কাটছে ফাউজিয়ার। একটাবারের জন্য সাহিল শেখ-এর সাথে যোগাযোগ করে উঠতে পারে নি সে। সবাই সবার ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে ব্যস্ত। সকালেই ফাউজিয়ার সাথে দেখা করে এসেছে শুভ্রতা। ফাউজিয়ার মুখে সবটা শুনে সে কী রাগ তার! এত ভালো একটা মানুষকে পেয়েও কেউ এভাবে হারায়!

নিহান বাহিরে গাড়ি ডেকে এনে, ব্যাগপত্র হাতে হাতে গাড়িতে তুলছে। অন্যদিকে শুভ্রতা বাবার বাড়িতে একবার বাবাকে আর একবার মাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে। শুভ্রতার সাথে সাথে বাড়ির তিনটা মানুষের মনেও কালো মেঘ নেমে এসেছে। পাশেই দাঁড়িয়ে স্নিগ্ধা ফুপিয়ে ফুপিয়ে কান্নাকাটি করছে। শাহাদাত সাহেব মেয়েকে বারবার বোঝাচ্ছেন কয়েকমাস পরপরই আসা হবে, সে যেন কষ্ট না পায় আর ফোন তো আছেই। শুভ্রতার একটাই কথা সে যখন চাইবে বাবা-মা, বোনকে ছুয়ে তো দেখতে পারবে না, মন খারাপ হলে সেই মন খারাপের গল্প তো বাবা রাতের বেলায় ছাদে বসে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে বের করবে না। বাবাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে আছে শুভ্রতা। এমন করছে যেন ছেড়ে দিলেই কিছু হয়ে যাবে৷
নিহান শুভ্রতাদের বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করে দেখে শুভ্রতা কেঁদেই যাচ্ছে। কিছুটা সময় সেখানে ব্যয় করে শেষ মুহুর্তে শুভ্রতাকে নিয়ে বের হয়। অতিরিক্ত সময় ব্যয় করলে ট্রেন তাদের ছেড়ে চলে যাবে।
রাবেয়া বেগমও টলমল চোখে শুভ্রতাকে জড়িয়ে ধরে আছেন। গাড়িতে উঠার পূর্বমুহুর্তে শুভ্রতাকে ছাড়লেন। সবার থেকে বিদায় নিয়ে গাড়িতে উঠবে এমন সময় শাকিরা দৌঁড়ে এসে জড়িয়ে ধরে।

” সাবধানে থাকিস ওখানে শুভ্রতা, আমাকে ভুলে যাস না প্লিজ। মাঝেমধ্যে কল করবি কিন্তু। ”

” আচ্ছা করব। তুইও সাবধানে থাকিস। ভাইয়া আসে নি?”

” ওই তো আসছে, আমি তো গাড়ি থেকে নেমেই দৌঁড়ে চলে এসেছি।”

রায়হানও এগিয়ে আসে। অতঃপর শেষ মুহুর্তে সবার কাছে থেকে শেষবারের মতো বিদায় নিয়ে রওয়ানা দেয় শুভ্রতা আর নিহান। গাড়ি যতদূর দেখা যায় বাড়ির সবার চোখ ততদূর দেখতে থাকে। শুভ্রতাও কারো মায়া ত্যাগ করতে না পেরে বার-বার ফিরে তাকাচ্ছিল৷

দুজনের জন্য ছোট একটা কেবিনরুম নিয়েছে নিহান। শুভ্রতা সেখানেই জানালার পাশে বসে আছে। নিহান ফোনে কারও সাথে কথা বলছে আর মাঝেমাঝে হোল্ড করে শুভ্রতাকে বলছে, ” মাথা বা হাত বাহিরে যেন বের করিস না শুভ্রা। অঘটন ঘটে যেতে পারে, চুপচাপ বসে থাক একটু আমি আসছি এখনই।”
শুভ্রতা নিহানের কথাটা শুনে আবার বাহিরে মনোযোগ দিচ্ছে শুভ্রতা। এবার প্রথম না এই একই কথা নিহান তাকে পাঁচবার বলেছে। এক কথা নিশ্চয়ই কারও পাঁচবার শুনতে ভালো লাগবে না। শুভ্রতারও ভালো লাগে নি৷ রাগ হয়েছে, খুব রাগ হয়েছে। সে তো বাচ্চা না, তাকে এত বুঝানোরও কিছু নেই। কিছুক্ষণ পর নিহান এসে তার পাশে বসে। শুভ্রতা দেখেও না দেখার মতো বসেই থাকে। নিহান শুভ্রতার কাধে হাত দিয়ে নিজের কাছে নিয়ে আসে। নিজের বুকের একপাশে জড়িয়ে নেয়৷ মাথা তুলতে চাইলেই আবার দাবিয়ে রাখে। শুভ্রতা বিরক্তিস্বরে বলে ওঠে, ” ছাড়ুন।”

নিহান বুঝতে পারে এতক্ষণ ওখানে বসে কথা বলায় শুভ্রতা রেগে গিয়েছে। নিহান বলে ওঠে,” আমি দূরে থাকায় আমার প্রিয়তমার মনে কি মেঘ করেছে? কালো মেঘ? বৃষ্টি নামার সম্ভাবনা আছে নাকি গর্জনেই মেঘ কেটে সাফ হয়ে যাবে?”

শুভ্রতা অভিমানী গলায় বলে, ” কিচ্ছু হবে না সরুন। যান গিয়ে আরও কয়েকজনের সাথে কথা বলুন। আমি কে, আমাকে কেন সময় দিতে হবে?”

” চুমু দিলে কি বউয়ের রাগ কমে যাবে?”

বড় বড় চোখে তাকায় শুভ্রতা। স্বামী হিসেবে কি এবার নিহানের ভয়ে চুপসে যাওয়া উচিৎ? হয়তো। কিন্তু নিহান উল্টো কাজ করে বসলো। শুভ্রতার কপালে চুমু দিয়ে দিল। শুভ্রতা লজ্জায় নিহানের বুকেই মুখ লুকায়।

#চলবে……

#শুভ্ররাঙা_ভালোবাসা
#তানিয়া_মাহি(নীরু)
#পর্ব_৪৯

” পড়তে এসেছো, পড়ায় মন দাও। লুকিয়ে চুরিয়ে আমাকে এতবার দেখার কিছু নেই অরু।”

সাহিলের কথায় চুপসে যায় অরু। ওরনার আঁচল আঙুলে পেচাতে পেচাতে বইয়ের দিকে তাকায়। সাহিলের গলা শুনে সাহিলের মা দরজায় এসে দাঁড়ায়।

” কিছু হয়েছে?”

” না মা, তুমি রুমে গিয়ে বসো। পড়ানোর মাঝে আসবে না তো।”

” মেয়েটাকে বকছিস কেন? ও তোর কত ছোট!”

” কেন বকেছি সেটা ও নিজে বুঝেছে, তোমার বুঝতে হবে না মা।”

” তুই যে এই কয়েক বছরে ঠিক কতটা বদমেজাজি হয়েছিস খেয়াল আছে? একটু ঠিক করে নে নিজেকে।”

” বড়মা, তোমার ছেলেকে বলো প্রাক্তনের ওপরের রাগ যেন আমাকে না দেখায়। ওই মেয়ের কথা মনে করে তোমার ছেলে সবসময় আমাকে বকে। একটু না তাকানোও যাবে না, মগের মুল্লুক নাকি? আমার চোখ দিয়ে যাকে ইচ্ছে আমি তাকে দেখব।”

কথাগুলো বলেই অরু টেবিলে রাখা বই আর খাতাগুলো নিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য উঠে দাঁড়ালে সাহিল বলে ওঠে, ” বেশি পেকে গেছিস তুই, হাটুর বয়সী মেয়ে এত পাকা পাকা কথা বলবি আর আমি মেনে নেব ভেবেছিস? ঠাটিয়ে দাঁতকপাটি খুলে দেব একদম। চুপচাপ যেটা লিখতে দিয়েছি সেটা লিখবি।”

সাহিলের কথায় আবার চুপচাপ বসে যায় অরু। চুপচাপ লিখতে শুরু করে আবার। সাহিলের মা ও এবার সেখান থেকে চলে যান। সাহিল বসে বসে নিজের কাজ করতে থাকে ল্যাপটপে।

এক,দুই করে গোটা পাঁচটা বছর কেটে গিয়েছে। বয়সও সাতাশ থেকে বত্রিশে গড়িয়েছে। মেজাজটাও সময় এবং বয়সের সাথে খিটখিটে হয়ে গিয়েছে যার দরুন অরুকে প্রতিদিনই কড়া কথা শুনিয়ে দেয় সাহিল৷ সাহিল যখন মাকে নিয়ে আবার গ্রামে ফিরে আসে তখন অরু ক্লাস নাইনে পড়ে। প্রথমদিকে সাহিলের সামনাসামনি না হলেও দুবছর যাবৎ বেশিরভাগ সময়ই সাহিলের কাছাকাছি থাকার চেষ্টা করে। অপ্রয়োজনীয় কথা তেমন মুখ থেকে বেরোয় না কিন্তু প্রয়োজনে কথা ঝুড়ি থেকে বের করতেই থাকে। সাহিল বুঝতে পারে মেয়েটা তাকে পছন্দ করে।

স্নিগ্ধা রেল স্টেশনে বসে আছে। বারবার হাতঘড়িটায় চোখ রাখছে আর রেললাইনের দিকে তাকাচ্ছে। তাকে দেখে যে কেউ বুঝবে, সে কারো জন্য অপেক্ষা করছে। প্লাটফর্মে বসে বসে কারো জন্য অপেক্ষারত রমনীকে দেখে সাতাশ /আটাশ বছরের একটা ছেলে স্নিগ্ধার পাশে এসে বসে। এদিক ওদিক তাকিয়ে গলা খাঁকারি দিয়ে জিজ্ঞেস করে, ” কারো জন্য অপেক্ষা করছেন বুঝি? দূর থেকে দেখছিলাম অনেকক্ষণ যাবৎ বসে আছেন তাই ভাবলাম আমার সঙ্গ হয়তো আপনার খারাপ লাগবে না।”

স্নিগ্ধা পায়ের থেকে জুতো খুলে ছেলেটার সামনে উল্টেপাল্টে দেখতে দেখতে বলে, ” এটা আপনার পিঠে পড়লেও মন্দ লাগবে না বোধ হয়, তাই না?”
ছেলেটা আস্তে করে পাশে বসা থেকে উঠে দাঁড়ায়। আমতা আমতা করে বলতে শুরু করে, আ আসলে আমি ভাবলাম…..”

” তোর ভাবাভাবির টুট টুট টুট শা*লা গেলি এখান থেকে?”

স্নিগ্ধা হুঙ্কার দিতেই ছেলেটা দৌঁড় দেয়। ঘণ্টাখানেক ধরে ট্রেনের অপেক্ষায় বসে ছিল স্নিগ্ধা। ট্রেনে তার নতুন বস আসার কথা রংপুর থেকে। দুই বছর আগে সে বাবা আর নিহানের সাহায্যে তার স্বপ্নের প্রফেশনে যেতে পেরেছে। দুবছর ধরে সে একটা টিমের সাথে ট্রেইনিংয়ে থেকে দেড় বছর হলো চাকরিতে জয়েন করেছে। সেই টিমের বড় অফিসার বদলি হয়েছে আজ নতুন একজনের আসার কথা। তাকেই রিসিভ করতে এসে ফেঁসে গেছে সে।

স্নিগ্ধা বসতে গিয়েই খেয়াল করে পাশে রাখা ছোট্ট পার্সব্যাগটা নেই। সামনে, এদিক ওদিক তাকাতেই খেয়াল হয় ছেলেটা এখানে বসেছিল তাহলে চুরি করার জন্যই! স্নিগ্ধা আবারও সামনের ছেলেটার দিকে তাকিয়ে উচ্চস্বরে বলে ওঠে, ” ওই দাঁড়া বলছি…” জোরে ছুট লাগায় স্নিগ্ধাও।

শুভ্রতা বাড়ি ফিরছে। এই পাঁচটা বছরে হাতেগোনা কয়েকটা বার বাড়ি যাওয়া হয়েছে তার। পড়াশোর জন্য বেশিদিন বাড়ির মানুষের সাথে থাকতে পারেনি সে। দুদিন আগেই বিসিএস পরিক্ষা শেষ করেছে। আপাতত কোনকিছুর জন্য পড়াশোনা নেই তাই নিহানকে জানানোর পর নিহান না আসতে পারলেও গাড়ি আর সাথে ড্রাইভারকে পাঠিয়ে দিয়েছে।
গাড়ি চলছে আপন গতিতে। শুভ্রতা বসে নতুন পুরাতন অনেক কথা ভাবছে। একটা কারণ নিয়ে সে বেশ চিন্তিত। সেই কথে ভেবে একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে শুভ্রতা। কিছুদিন হলো বেশিরভাগ সময় অন্যমনস্ক থাকে সে। কেন যেন কোন আনন্দ তাকে ছুঁতে পারছে না। স্বামী বিষয়ক কোন সমস্যা নেই তার। নিহান হয়তো কখনোই স্বামী হিসেবে খারাপ হবে না। দিনকে দিন তার ভালোবাসা বেড়েই চলেছে। সে ভালো স্বামী হিসেবে নিজেকে ধরে রেখেছে। উন্নতিও তাকে দূরে রাখে নি। এই পাঁচ বছরের একবছর সময় হলো সে জেনারেল হয়েছে। সফলতা তাকে চারদিক দিয়ে ছুয়ে গেলেও কোন একদিকে সে শূন্য আর সেটা শুভ্রতার কারণেই।

” ম্যাম, আর কতদূর? কিছু বলছেন না যে?”

শুভ্রতার ভাবনার বিচ্ছেদ ঘটে ড্রাইভারের ডাকে। সে সোজা হয়ে বসে। ড্রাইভার কী বলল সেটা সে স্পষ্ট বোঝে নি। শুধু এটুকু বুঝেছে যে তাকে উদ্দেশ্য করে কিছু বলা হয়েছে।

” কিছু বললে মামা?”

” কইলাম আর কতদূর যাইতে হইব? ম্যালাদূরই তো চইলা আইলাম আমরা।”

” না মামা, আমরা মাত্র কিছুক্ষণ হলো পাবনা জেলাতে ঢুকেছি। এখনো প্রায় আধাঘন্টা লাগবে। আমাকে বাড়ির সামনে নামিয়ে দিয়ে আপনি যাবেন গাড়িটা ধুতে। নোংরা হয়ে গেছে দেখলাম আসার সময়। আমাদের বাড়ির পাশেই গাড়ি ধোয়ার ব্যবস্থা আছে আমি টাকা দিয়ে দেব আপনার অসুবিধা হবে না। বাড়িও চিনিয়ে দিয়ে রাখব আপনাকে।”

” আচ্ছা মেমসাহেব। ”

” তোমাকে কতবার বলেছি মামা যে ম্যাম, মেমসাহেব বলে আমাকে ডাকবে না? আমাকে শুভ্রতা বলেই ডেকো।”

” না মানে…”

” নিহানের ভয় পাচ্ছো? ওর বিষয়টা আমি দেখে নেব। ও বুঝতেই চায় না অতিরিক্ত সম্মানে সবসময় ভালোবাসাটা থাকে না। তুমি মনোযোগ দিয়ে গাড়ি ড্রাইভ করো।”

বাড়িতে না জানিয়েই রওয়ানা দিয়েছে সে। না জানিয়ে হয়তো খুব একটা ভুল সে করে নি। হঠাৎ প্রিয় মানুষকে দেখলে মানুষ বেশি আবেগী হয়ে যায়। সেই আনন্দটা অন্য সব আনন্দ থেকে ভিন্ন। সিটে ফেলে রাখা ফোনটা হাতে নেয় সে। ফোনের কললিস্টে একটা নাম জ্বলজ্বল করছে, ” ফাউজু”। নম্বরে কল লাগায় সে। কয়েকবার রিং হয়ে কেটে যায়। সাথে সাথে আবার কলব্যাক আসে। শুভ্রতা কলটা রিসিভ করে কানে নেয়।

” শুভ্রতা?”

” হ্যাঁ রে কেমন আছিস?”

” এইতো ভালোই আছি, খুব একটা খারাপ না। তোর কি অবস্থা বল তো?”

” এই তো বাড়ি ফিরছি, প্রায় পেয়ে গেছি।”

” সত্যি?কোন রাস্তা ধরে আসছিস বল তো?”

” ভার্সিটির এই রাস্তায়।”

” পার করে গেছিস?”

” না। মিনিট দুই লাগবে।”

” সামনে এসে নামবি তুই পাঁচ মিনিটের জন্য হলেও। ”

” তুই কি কলেজে?”

” হ্যাঁ আমি ক্লাস থেকে বের হচ্ছি। এখনই শেষ করে দিচ্ছি ক্লাস। ”

” আচ্ছা ঠিক আছে আসছি।”

কলটা কাটে ফাউজিয়া। তাড়াতাড়ি করে ক্লাস শেষ করে গেইটের উদ্দেশ্যে বের হয়। কয়েকমাস হলো সে কলেজের টিচার হয়ে এসেছে। কড়া টিচার হয়েও কেমন আজ ফাঁকি দিয়ে বেরিয়ে আসতে হলো তার!
শুভ্রতা গাড়ি থামিয়ে রেখে পাশেই দাঁড়িয়ে ফাউজিয়ার জন্য অপেক্ষা করছে। কিচ্ছুক্ষণ পরই ফাউজিয়াকে দেখতে পায় সে। যদিও বোরখা পরা তবুও বান্ধবী চলনে চেনা খুব একটা অসম্ভবের ব্যাপার না। এত পুরোনো বান্ধবীকে আবার দেখে দুজনের মুখেই হাসি ফুটে যায়।

স্নিগ্ধা নিজের পার্সব্যাগটা উদ্ধার করে উঠতে পারে নি। তবুও সে এটা ভেবে সন্তুষ্ট যে সেখানে শুধুমাত্র টাকা ছাড়া আর কিছু ছিল না। ডিটেকটিভ টিমের সদস্য নিজের পার্সব্যাগ উদ্ধার করতে পারেনি এটা বড্ড লজ্জার বিষয়। ছোট একটা জিনিসের জন্য তো আর রিভালবার ব্যবহার করা যায় না!

স্নিগ্ধা ঠিক আগের জায়গাতেই দাঁড়িয়ে আছে। পাশে কয়েকজন কথা বলাবলি করছে সেখান থেকেই বুঝতে পারল ট্রেন চলে গেছে। মাথায় যেন আকাশ ভে*ঙে পড়ে স্নিগ্ধার। আশেপাশে তাকিয়ে দেখতে থাকে। ফোনের গ্যালারি থেকে ছবি বের করে ভালো করে দেখে নেয়। প্রথম দেখায় মানুষকে ছবির সাথে খুব একটা মেলানো যায় না। স্নিগ্ধা ছবিটা বের করেই সামনের দিকে এগুতে থাকে। শেষপ্রান্তে গাছের নিচে কালো একটা ব্যাগ হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে সিগারেট ফুকছে একজন। স্নিগ্ধা আরেকটু কাছাকাছি গিয়ে ছবির সাথে মেলাতে থাকে। হ্যাঁ এটাই, ইনিই এনএসআই অফিসার মাহতিম তন্ময়। স্নিগ্ধা পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে সালাম দিতেই লোকটা মুখ থেকে ধোঁয়া ছেড়ে স্নিগ্ধার দিকে তাকায়।

” জি?”

” আপনি মাহতিম তন্ময়? ”

” হুম। ”

” স্যার আমি স্নিগ্ধা শাহাদাত। আপনাকে রিসিভ করার জন্য আমাকে পাঠানো হয়েছে।”

” ইউ আ’র ফাইভ মিনিটস লেইট। ”

” স্যার আমি দেরি করি নি। আমি প্রায় দেড় ঘণ্টা যাবৎ অপেক্ষা করছি। আপনার ট্রেন অনেক দেরি করে এসেছে। আমি সামনেই ওখানে বসেছিলাম…..”

” চলুন। গাড়ি এনেছেন নাকি অন্য কোন গাড়িতে যেতে হবে?”

” স্যার গাড়ি এসেছে। আপনি চলুন।”

” গাড়িতেই আপনি পুরো কে*স আমাকে এক্সপ্লেইন করবেন মিস.. ”

” স্নিগ্ধা।”

#চলবে……

#শুভ্ররাঙা_ভালোবাসা
#তানিয়া_মাহি(নীরু)
#পর্ব_৫০

” ছয় বছর জে*লে ছিলি, ছাড়া পাচ্ছিস তবু এখানেও ত্যাড়ামি করলে ছুড়ে ফেলে দেব আবার যেখানে ছিলি।”
জেলারের মুখে হুমকি শুনে চুপসে যাওয়ার পরিবর্তে আরও তেজ দেখিয়ে ইমতিয়াজ বলে ওঠে, ” তোরা এক একটা জানো**য়া*রের বাচ্চা বুঝেছি? কেউ টাকার গরমে মিথ্যা কে*সে জেলবন্দি করে আবার কেউ বের না হতেই আবার ভেতরে পাঠানোর জন্য প্রস্তুত থাকে। তোরা কোনদিন মানুষ হবি না।”

ইমতিয়াজের কথা শুনে পিছন থেকে এক কনস্টেবল এসে লা*ঠিপে*টা করতে শুরু করে। ইমতিয়াজ হাত দিয়ে ঠেকানোর প্রচেষ্টায় বাধা প্রদান করে যাচ্ছে। এসআই এর হুংকারে একসময় পরিবেশ স্থির হয়ে যায়। ইমতিয়াজকে ডেকে চেয়ারে বসায়। এসআই নতুন এসেছেন থানায়। একগ্লাস পানি এগিয়ে দিলেন ইমতিয়াজের দিকে। ইমতিয়াজ সাথে সাথে একগ্লাস পানি শেষ করে ফেলে। হাতের কনুইটা বেশ জ্বা*লা*পো*ড়া করছে। ভালো করে খেয়াল করতেই দেখে র*ক্ত ঝড়ছে। এসআই কাউকে ডেকে সেখানে ব্যান্ডেজ লাগিয়ে দিতে বলল।

” এবার বলুন তো তখন কী যেন বলছিলেন? কে টাকার গরমে আপনাকে মিথ্যা কে*সে ফাঁসিয়েছে?”

ইমতিয়াজ নিম্নস্বরে বলে ওঠে, ” আমার মা। মা না স্যার ওটা বা*ঘিনী আমার বাপের ছোটবউ।”

এসআই ফের প্রশ্ন করেন, ” আপনার সৎমা?”

” হ্যাঁ স্যার।”

” কী করেছেন উনি?”

” আমি বললেই কেন আপনি বিশ্বাস করবেন? পাঁচ বছর আগে কেউ বিশ্বাস করেনি। পাঁচ বছর পর সেটা শুনে আপনি আর কিই-বা করবেন বলুন তো?”

” হয়তো আসল অপরা*ধী শা*স্তি পাবে।”

” সবাই সবার মতো ভালো থাকুক। আমি নিজেই নিজের খারাপ থাকা বেছে নিয়েছি স্যার। ”

হাতে ব্যান্ডেজ করা শেষ হতেই ইমতিয়াজ উঠে দাঁড়ায়। এসআইকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে সে থানা থেকে বেরিয়ে আসে৷ পকেটে টাকা নেই, নির্দিষ্ট কোন ঠিকানা নেই। কোথায় ফিরবে সে? থানায় আগে যা যা জমা নিয়েছিল সেখানে কী কী আছে সেটাও দেখা হয়নি৷ ব্যাগ থেকে সেগুলো বের করে কিছু টাকা দেখেই মুখে হাসি ফুটে যায় তার। এটা দিয়ে অন্তত দুই থেকে তিনদিন চলে যাবে।
থানার পাশেই রেলস্টেশন, ইমতিয়াজ গিয়ে প্লাটফর্মের একপাশে এক কাপ চা আর একটা রুটি নিয়ে স্থির হয়ে বসল। চায়ের কাপে রুটি ডুবিয়ে ডুবিয়ে খেতে শুরু করল। সামনের দিকে এক পলকে তাকিয়ে কিছু একটা ভাবছে সে। সামনের দিক থেকে একটা ট্রেন আসছে, গতি ধীরে ধীরে কমছে। ট্রেনটা বোধ হয় এখানে থামবে। ইমতিয়াজ উঠে দাঁড়ায়, ট্রেন থেকে কারো জিনিসপত্র নামিয়ে দিলে কিছু টাকা পাওয়া যাবে ভেবে সামনের দিকে এসে দাঁড়ায়।

শুভ্রতা বাড়িতে ঢুকেই খেয়াল করেছিল বাড়ির পরিবেশ ভিন্নরকম। সাতমাস আগে যখন বাড়ি এসেছিল নেহার বিয়ের সময় পরিবেশ যেমন ছিল আজও ঠিক তেমন। বাড়িতে কেউ আসবে কি না বুঝতে পারছে না। আসলেও কে আসবে? অভীক নাকি সিয়াম? আবিরা আর নেহা দুজনই তো এখানে। আবিরার ছেলে হয়েছে বিয়ের তিনবছর পরই। ছেলের বয়স দুই বছর। কী সুন্দর করে মামিমা মামিমা করে ডাকে! বাচ্চাটার ডাক শুনে যেমন শান্তি লাগে তেমনই বুকটা কষ্টে ভারী হয়ে আসে।
শুভ্রতা নিজেদের রুমে ঢুকে দেখে রুমটা বেশ পরিপাটি, কেউ হয়তো পরিষ্কার করে রেখেছে। রুমে ঢুকে ব্যাগটা রেখে বিছানায় বসতেই মা আয়েশা বেগমও রুমে প্রবেশ করলেন৷ মেয়ে আসার খবরে তিনি নিজ বাড়িতে স্থির থাকতে পারেন নি। মাকে দেখেই মায়ের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে শুভ্রতা। বেশ কিছুক্ষণ এভাবে কেটে যায়। রাবেয়া বেগম শুভ্রতার জন্য চিনি,লেবুর শরবত নিয়ে রুমে প্রবেশ করে মা-মেয়ের এমন অবস্থা দেখে বলে ওঠেন, ” কই কে তো আমাকে এভাবে জড়িয়ে ধরল না? মা হয়ে উঠতে পারলাম না নাকি?”

রাবেয়া বেগমের কথায় দুজন দুজনকে ছেড়ে দাঁড়ায়। শুভ্রতা গিয়ে রাবেয়া বেগমকেও জড়িয়ে ধরে বলে, ” আমার তো দুটোই মা, দুজনই আমার। এসো দুজনই বসবে এসো।”

বেশ খানিকটা সময় তিনজনের কথাবার্তা এগোয়। রাবেয়া বেগম ঘড়ি দেখেই বলে ওঠেন, “কত বেজে গেছে দেখেছিস! তোরা মা-মেয়ে গল্প কর। আমি যাই রান্না করতে হবে।”

শুভ্রতা বলে, ” আমিও আসছি বড়মা।”

” না, অনেকদিন পর এসেছ এখন একটু বিশ্রাম নাও।”

রাবেয়া বেগম প্রস্থান করেন। শুভ্রতার মা দরজা ভেজিয়ে দিয়ে আবার এসে শুভ্রতার পাশে বসে। মেয়েটাকে খুব ক্লান্ত দেখাচ্ছে। সামনের চুলগুলো কানের পিছনে গুজে দিয়ে জিজ্ঞেস করেন, ” বিয়ের পাঁচ বছর হয়ে গেল, বাচ্চা নিচ্ছিস না কেন? অনেক তো সময় গেল এবার একটা বাচ্চা নে। মেয়েদের বয়স বাড়লে বাচ্চা হওয়ার সম্ভাবন কমে যায়।”

মায়ের কথায় কোন জবাব দিতে পারে না শুভ্রতা। শুভ্রতার মৌনতায় কিছু একটা আঁচ করতে পারেন তিনি। তিনি যা মনে করছেন সেটা সত্যি নয়তো? অন্যসময় বাচ্চা নেওয়ার কথা বললে শুভ্রতা বলত আরো কিছুদিন যাক, সময় তো চলে যাচ্ছে না তাহলে আজ সেটা না বলে চুপচাপ আছে কেন?

” কিছু বলছিস না যে?”

” কি বলব মা? এই প্রশ্নটা আমাকে ক্ষ*ত*বি*ক্ষ*ত করে ফেলে। মুখ দিয়ে কোন কথা আসে না আমার।”

” তার মানে আমি যা ভাবছি তাই?”

শুভ্রতা ওপর নিচ মাথা ঝাঁকিয়ে সম্মতি জানায়। আয়েশা বেগমের মাথায় যেন বা*জ পড়ে যায়। মেয়েটার ভাগ্য কি তবে এমনই হওয়ার ছিল! যখনই একটু সুখ মিলল তখনই আরেক বিপদ এসে হাজির।

আয়েশা বেগম গলার স্বর নিম্ন করে বললেন, ” কার সমস্যা? তোর নাকি নিহানের? ডাক্তার দেখিয়েছিস? ডাক্তার কী বলেছে? ”

” ডাক্তার দেখানো হয়নি। আমার ভয় করছে মা। ডাক্তার দেখালে যদি ডাক্তার বলে সমস্যাটা আমার তাহলে আমি কী করব বলো তো? আমি আমার এই শেষ ভালোবাসার মানুষটাকে অন্যকারো সাথে কীভাবে দেখব বলো তো মা? সবাই যখন জানবে আমরা একটা সন্তানের মুখ দেখতে পারছি না আর সমস্যাটা আমার তাহলে কী হবে? বড়মা, বড়আব্বু তো নিজেরা নাতি-নাতনি দেখতে ছেলেকে আরেক জায়গায় বিয়ে দিতে চাইতেই পারে।”

” তুই কেন ভাবছিস যে সমস্যাটা তোর? নিহানেরও তো হতে পারে। সমস্যাটা যদি নিহানের হয় তাহলে কি তুই ওকে ছেড়ে দিবি? পারবি তুই বাচ্চার জন্য আরেকটা বিয়ে করতে? ”

” কখনো না। আমি ওকে ভালোবাসি খবু ভালোবাসি।”

” তোর থেকে বেশি দিন যাবৎ ছেলেটা তোকে ভালোবাসে। তোকে পেতে কত কিছু করেছে ও। আর তুই কী না ভাবছিস নিহান আবার বিয়ে করবে? তুই কাল বের হবি আমার সাথে। আমার পরিচিত একটা ভালো ডাক্তার আছে। ওই ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাব।”

” কী দরকার বলো তো মা এসবের?”

দরজায় ঠকঠক আওয়াজ হতেই শুভ্রতা গলা ছেড়ে বলে, ” দরজা খোলা আছে।”

ভেতরে প্রবেশ করে নিহান৷ নিহানকে দেখে বেশ অবাক হয়ে যায় শুভ্রতা। নিহানের তো আসার কথা ছিল না! ও এখানে কেন তাহলে এখন?

নিহানকে দেখে আয়েশা বেগম কুশলাদি জিজ্ঞেস করেন। কথা শেষ করে শুভ্রতাকে বলে, ” বাসায় আসিস। তোর বাবা তোর জন্য অপেক্ষা করছে।”

” হ্যাঁ মা আমি আসছি।”

” ঠিক আছে আমি আসছি তবে।”

আয়েশা বেগম চলে গেলে নিহান এসে শুভ্রতাকে জড়িয়ে ধরে। শুভ্রতাও নিশ্চিন্তে নিহানের বুকে মাথা রেখে দাঁড়ায়। আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে রাখে দুজন দুজনকে।

অরু আজ সকাল সকাল লালশাড়ি পড়েছে। চুলটা ছেড়ে বারবার আয়নার সামনে যাচ্ছে আর আসছে। এপাশ ওপাশ ঘুরে ঘুরে নিজেকে দেখছে। লালশাড়িতে বেশ মানিয়েছে তাকে। নিজেই নিজের ওপর থেকে চোখ ফেরাতে পারছে না। আচ্ছা নিজের ওপর কি নিজের নজর লাগে? লাগতেও পারে বলা তো যায় না। ঠোঁট নাড়িয়ে কতক্ষণ কিছু বিড়বিড় করে পড়ে হাতে ফু দিয়ে সারা শরীরে হাত বুলিয়ে নেয়। একটা জোরে শ্বাস ছাড়ে। যেন নিজেকে নজর লাগা থেকে বাঁচিয়ে নিল সে।
সামনের চুলগুলো কানে গুজে লজ্জা পাওয়ার ভঙ্গি করতেই অরুর মা ফিক করে হেসে ফেলে। মায়ের হাসির শব্দে লজ্জা পেয়ে যায় অরু। মায়ের সাথে যদিও সে ফ্রি, বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক তবুও আয়নার সামনে রংঢং করার সময় কারো সামনে পড়লে কেমন লজ্জা লাগে, যে এই লজ্জায় পড়েছে সে জানে। অরু মাথা নিচু করে পিছনের দিকে তাকিয়ে দেখে তার মা দরজায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে তখনো হাসছে।

মেয়েকে আর লজ্জায় না ফেলে অরুর মা নিজেই বলে ওঠেন, ” সাহিল এসেছে। এত কষ্ট করে রান্না করেছিস খেতে দিবি না? নাকি আমারই খেতে দিতে হবে?”

” তুমিই খেতে দাও। আমার লজ্জা করছে শাড়ি পরে সামনে যেতে।”

অরুর মা হেসে ওখান থেকে প্রস্থান ঘটান। অরু বিছানায় বসে কিছুক্ষণ আগে ঘটে যাওয়া ঘটনা মনে করে জিহ্বায় কামড় দিয়ে ভাবে, ” ইশ কী যে একটা অবস্থা! মাকে কেন তখনই আসতে হলো!”

অরুর মা সাহিলকে খেতে দিয়েছেন। সামনে তিন-চার ধরণের খাবার রাখা। সাহিল খাবার খেতে খেতে সামনে দরজার দিকে তাকাতেই কিছু একটা সরে যায়। দরজার পর্দার ওপাশে কেউ দাঁড়িয়ে ছিল এতক্ষণ। সাহিল নজর সরিয়ে আবার খাওয়ায় মন দেয়। অরুর মা মাংসের পিস তুলে দিতে দিতে বলে, ” রান্না কেমন হয়েছে সাহিল?”

সাহিল খেতে খেতেই জবাব দেয়, ” বেশ হয়েছে। দেখছেন না খেয়েই যাচ্ছি!”

” অরু রান্না করেছে। বলল তোমাকে দাওয়াত করে খাওয়াতে। ”

কথাটা শুনে যেন খাবার গলায় ঠেকে গেল। অরুর মা পানি এগিয়ে দিতে গিয়ে দেখলেন গ্লাস রাখা হয়েছে ঠিকই কিন্তু পানি নেই। অরুকে বলতেই অরু তাড়াহুড়ো করে গ্লাসভর্তি পানি এনে সাহিলের দিকে এগিয়ে দিল। সাহিল গ্লাসটা না নিয়েই অরুর ওপর চোখ বুলিয়ে নিল। লাল শাড়িতে অরু! কিছুক্ষণ আগেই পর্দার ওপাশে অরু দাঁড়িয়ে ছিল?

” গ্লাসটা নিন। ”

অরুর কথায় চোখ নামিয়ে নিয়ে গ্লাসটা নিল সাহিল। লালশাড়িতে অরুকে দেখে বছর কয়েক আগের লাল শাড়িতে আবেদনময়ী একটা নারীর কথা মনে পড়ল তার। কী অসম্ভব সুন্দর, স্নিগ্ধ ছিল মেয়েটি। তাদের প্রেম কখনো হয়নি, হয়েছিল একপাক্ষিক ভালোবাসা আর সেই ভালোবাসার প্রত্যাখ্যান। দীর্ঘশ্বাস ফেলে সাহিল।

#চলবে……