শুভ্ররাঙা ভালোবাসা পর্ব-৫১+৫২+৫৩

0
258

#শুভ্ররাঙা_ভালোবাসা
#তানিয়া_মাহি(নীরু)
#পর্ব_৫১

ডাক্তারের চেম্বার থেকে শুভ্রতাকে কাঁদতে কাঁদতে বের হতে দেখে আয়েশা বেগম চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ান। শুভ্রতা এসে মাকে জড়িয়ে ধরে কান্না করতে থাকে। আশেপাশের মানুষ আড়চোখে তাদের দেখছে। আয়েশা বেগম বেশ শক্ত মনের মানুষ। তিনি শক্ত হাতে সবকিছু সামলে নিতে জানেন। মেয়ের পিঠে হাত বুলিয়ে সান্ত্বনা দিয়ে যাচ্ছেন এমন সময় শুভ্রতা মাকে ছেড়ে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে হাতে থাকা রিপোর্ট মায়ের দিকে এগিয়ে দিয়ে চোখ মুছে নেয়। মুখে তার হাসির রেখা স্পষ্ট। কান্না আর হাসিতে জর্জরিত মুখ দেখে দোটানায় পড়ে যান। হাতের রিপোর্টটা বের করে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখেন তিনি৷ শেষের দিকে গোটা গোটা অক্ষরে লেখা, “পজিটিভ “। আয়েশা বেগমের মুখে হাসি ফুটে যায়।

” শুভ্রতা! শুভ্রতা তুই মা হতে চলেছিস!”

শুভ্রতা চোখে পানি থাকা সত্ত্বেও মুখে হাসি নিয়ে উপর নীচ মাথা ঝাঁকিয়ে সম্মতি জানায়। আয়েশা বেগম শুভ্রতার চোখের পানি মুছে দেন। মেয়েকে ধরে নিয়ে সাবধানে সেখান থেকে বের হয়ে একটা রিকশা নিয়ে বাড়ির দিকে রওয়ানা দেয়। রিকশায় বসেও শুভ্রতার চোখ টলমল করছে৷ কতদিনের ইচ্ছে পূরণ হলো তার। সে মা হতে চলেছে। নিহান শুনলে কতই না খুশি হবে! শুভ্রতা বারবার রাস্তায় সামনের দিকে তাকাচ্ছে। আজ যেন রাস্তাই শেষ হচ্ছে না। শুভ্রতা ধৈর্য্য ধরতে না পেরে বলেই ওঠে, ” মামা তাড়াতাড়ি চলুন না, এত আস্তে কেন যাচ্ছেন?”

স্নিগ্ধা অফিসের একপাশে মন খারাপ করে বসে আছে। যা ঘটছে বা ঘটতে যাচ্ছে সেটা কেমন হবে? স্নিগ্ধাকে বসে থাকতে দেখে মাহতিম এগিয়ে আসে। লাঞ্চের সময় হয়ে যাওয়ায় তাকে বলে, ” এখানে বসে আছেন কেন? খাবার খাবেন না?”

স্নিগ্ধা তাড়াহুড়ো করে উঠে দাঁড়াতে গিয়ে চেয়ারের কোণায় লেগে পায়ে ব্যথা পেয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলে। মাহতিম ফোনটা টেবিলের ওপর রেখে স্নিগ্ধার পায়ে হাত দিতে যাবে ঠিক তখনই স্নিগ্ধা একপা উঁচু করেই পিছিয়ে যায়।

” কি হলো?”

স্নিগ্ধা স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে বলে, ” কিছু না স্যার। আপনি আমার পায়ে স্পর্শ করবেন বিষয়টা ভালো দেখায় না।”

” ঠিক আছে পা ঝেঁড়ে ফেলুন ঠিক হয়ে যাবে। অফিসের সবাই পাশের রেস্টুরেন্টে খেতে যাবে আপনিও চলুন।”

” স্যার আমার মা খাবার দিয়ে দিয়েছে। ”

” ঠিক আছে, ওটা সবাই মিলে খেয়ে নেবে। চলুন সবাই একসাথে যাওয়া যাক।”

” ঠিক আছে।”

অফিসের সবাই অফিস থেকে বের হয়ে অফিসের দুটো গাড়ি নিয়েই বেরিয়ে পড়ে। গাড়িতে পিছনে সিট না থাকায় স্নিগ্ধাকে মাহতিমের পাশেই বসতে হয়। গাড়িতে বসার পর থেকে মাকে আর বোনকে কল করেই যাচ্ছে স্নিগ্ধা। কয়েকবার চেষ্টা করেও যখন কিছু হলো না তখন ফোনটা রেখে চুপচাপ বসে রইল সে। স্নিগ্ধার অস্থিরতা দেখে পাশে থেকে রাইমা বলে উঠলো, ” কিছু হয়েছে তোমার?”

স্নিগ্ধা চকিতে বলল, ” না গো, তেমন কিছু না। মা আর আপুকে ফোনে পাচ্ছি না।”

” কোন দরকার বাসায়? জরুরি হলে ছুটি নিয়ে চলে যাও।”

” না সেটার প্রয়োজন হবে না, তুমি ভেবো না।”

রেস্টুরেন্টে গাড়ি এসে থামলে একে একে সবাই গাড়ি থেকে নেমে যায়। স্নিগ্ধা গাড়ি থেকে নামবে ঠিক তখনই শুভ্রতার কল আসে। স্নিগ্ধা থেমে যায়। তাড়াতাড়ি করে কলটা রিসিভ করে।

” হ্যালো আপু! কী রে তোরা? কখন থেকে তোদের দুজনকে ফোন দিয়ে যাচ্ছি রিসিভ করিস না কেন?”

” রিকশাতে ছিলাম রে। মাত্র এসে বাড়ির সামনে থামলো।”

” রিকশা কেন? গাড়ি নিয়ে যাস নি?”

” হ্যাঁ নিয়ে গিয়েছিলাম। মাঝরাস্তায় কী যেন সমস্যা হয়েছিল তাই ম্যাকানিক ডেকে ঠিক করতে বলে এসেছি।”

” এসব ছাড়, ডাক্তার কী বলল সেটা বল তো।”

শুভ্রতা গম্ভীরগলায় বলে, ” তুমি খালামনি হতে চলেছ স্নিগ্ধা, তাড়াতাড়ি রেডি হও।”

স্নিগ্ধা আনন্দের চিৎকার দিয়ে ওঠে, ” সত্যি! আমি খালামনি হচ্ছি? আমার কেমন বিশ্বাসই হচ্ছে না। আমি তাড়াতাড়ি ছুটি নিয়ে বাসায় আসছি দাঁড়া। নাম কিন্তু আমি রাখব বলে দিলাম।”

শুভ্রতা হেসে বলে, ” আচ্ছা রাখিস সময় আগে হোক। আচ্ছা শোন সাবধানে বাসায় আসিস। দেখি যাই সবাইকে খবরটা দিই।”

শুভ্রতা কল কেটে দেয়। স্নিগ্ধার মুখে হাসি স্পষ্ট। সে গাড়িতে খেয়াল করে দেখে সবাই রেস্টুরেন্টের ভেতরে চলে গিয়েছে। তাড়াতাড়ি করে গাড়ি থেকে নেমে সেও সেদিকে চলে যায়।

অফিসকক্ষে আলাপ-আলোচনা হচ্ছে কলেজের প্রথম বর্ষের মেয়েদের নিয়ে শিক্ষাসফরে যাওয়া বিষয়ে। কলেজের প্রধান সিদ্ধান্ত নিয়েছেন যেহেতু দেশের অবস্থা ভালো নয় তাই বেশি দূর তিনি যাবেন না মেয়েদের নিয়ে। পার্শ্ববর্তী জেলার একটা এলাকায় নতুন একটা পর্যটককেন্দ্র হয়েছে এবং সেখানেই আশেপাশে কিছু পুরোনো মসজিদ, মন্দির আছে যেখানে মুসলমান এবং হিন্দুরা একসাথেই মিলেমিশে থাকতো। ছাত্রছাত্রীদের থেকে চাঁদা তোলা শুরু হয়েছে বেশ কয়েকদিন আগেই। কয়েকজন বাকি আছে তারা দুই একদিনের মাঝেই দিয়ে দিবে। কলেজ প্রধানের কথানুযায়ী সবাই রাজি হয়ে যায়। টিচারদের কোন অসুবিধা আছে কি না সেটা জিজ্ঞেস করতেই ফাউজিয়া বলে, ” স্যার সময়টা উল্লেখ করলেন না তো? মানে কখন যাওয়া এবং ফিরে আসা?”

” হ্যাঁ, ভোর সাড়ে ছয়টায় গাড়ি ছাড়া হবে। ফজরের নামাজ শেষ করে ওমনি তৈরি হয়ে সবাই চলে আসবেন। আপনাদের তো আগে আগেই আসতে হবে। ওখানে পৌঁছতে এক থেকে দেড়ঘণ্টা সময় লাগবে। সারাদিন ওখানে থেকে সন্ধ্যা বা সন্ধ্যার আগেই রওয়ানা দেব। রাত আটটার মধ্যেই সবাই বাড়ি পৌঁছে যাবে।”

” ঠিক আছে স্যার।”

” কারো কোন সমস্যা থাকলে জানাতে পারেন৷ শেষ মুহুর্তে গিয়ে বলবেন স্যার যেতে পারব না, তখন কিন্তু আমি কোন কথা শুনব না।”

সামনে বসা সবাই জানায় তাদের কোন সমস্যা নেই। গতবছরের মেয়েরা যেতে পারেনি তাই তাদেরও যাওয়ার সুযোগ এবার আছে বলে জানান প্রধান। স্টুডেন্টদের সেটা জানিয়ে দিতে বলেন তিনি। কথাবার্তা শেষে সবাই রুম থেকে বেড়িয়ে যান। ফাউজিয়া বারান্দায় এসে মাকে কল দেয়। দুই একবার রিং হতেই কল রিসিভ হয়ে যায়।

” মা।”

” হ্যাঁ বল।”

” তোমার ওষুধ কী সবগুলো আছে নাকি কোনটা লাগবে? লাগলে বলো আমি ফেরার সময় নিয়ে আসব। ”

” না সব আছে। তুই সাবধানে বাড়ি চলে আসিস। ছুটি কখন?”

” এইতো কিছুক্ষণ পর।”

” ঠিক আছে। ”

ফাউজিয়া ফোন রেখে টিচার্সরুম থেকে ক্লাসের বইটা নিয়ে রওয়ানা দেয় শেষ ক্লাসটা নিতে।

শুভ্রতা মায়ের সাথে নিজেদের বাড়িতেই যায়। শাহাদাত সাহেব বাহিরে বসে কিছু অফিসিয়াল কাজ করছিলেন। আয়েশা বেগম আর শুভ্রতাকে দেখে কলম রেখে দিলেন। বাহিরে এসে জিজ্ঞেস করলেন, ” খবর কী?”

আয়েশা বেগম একগাল হেসে বললেন, ” তুমি তো নানু হতে চলেছো গো।”

শাহাদাত সাহেবের মুখেও হাসি ফুটে যায়। মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বুকে টেনে নেন।
” দোয়া করি আল্লাহ যেন পৃথিবীর সব সুখ আমার মেয়েকে দেয়। আমার মেয়েটাকে আল্লাহ ভালো রাখুক সবসময়। ”

শুভ্রতা চুপচাপ বাবাকে জড়িয়ে ধরে দাঁড়িয়ে থাকে। বাবার বুকে এক অন্যরকম শান্তি, বুকে মাথা রাখলেই হৃদয় প্রশান্ত হয়ে যায়। শাহাদাত সাহেব খবরটা ও বাড়িতে দিতে বললে শুভ্রতা বলে, ” হ্যাঁ যাব। একটু বিশ্রাম নিয়ে নিই বাহিরে অনেক রোদ ছিল। খারাপ লাগছে বাবা।”

” ঠিক আছে। বাহিরে না দাঁড়িয়ে থেকে যাও রুমে যাও তাহলে৷ ”

” আচ্ছা।”

শুভ্রতা মায়ের সাথে রুমে চলে যায়। শুভ্রতাকে রুমে রেখে আয়েশা বেগম এক গ্লাস ঠান্ডা পানি নিয়ে শুভ্রতাকে দেন। শুভ্রতার পানি খাওয়া শেষ হলে গ্লাসটা যথাস্থানে রেখে পাশে বসেন। রাস্তায় তেমন কোন কথা না হওয়ায় তিনি একটা বিষয় খোলাসা হতে পারেন নি। শুভ্রতাকে জিজ্ঞেস করেন, ” মা, তুই তো বললি গতমাসে তোর পি…….”

মাকে থামিয়ে দিয়ে শুভ্রতা বলে, ” ডাক্তার বললেন, এরকম নাকি অনেকের হয়। এটাকে মিড-সাইকেল বা ওভিউ*লেটরি ব্লি*ডিং বলে।”

” ওহ আচ্ছা বুঝেছি এবার। কিছু খাবি? বানিয়ে দেব?”

” না, মা। এখন কিছু খাব না। বাসায় যাই, দেখি গিয়ে উনি এখনো ঘুমাচ্ছেন নাকি?”

” আচ্ছা ঠিক আছে যা। সিড়ি দিয়ে সাবধানে উঠবি। এখন থেকে কিন্তু খুব সাবধানে থাকবি। আমি নিহানের সাথে কথা বলব, এবার যেন তোকে এখানেই রেখে যায়। ওখানে তুই একা একা থাকতে পারবি না।”

” হ্যাঁ, আমি এখানেই থাকেব এবার সবার সাথে। ”

” এগিয়ে দিয়ে আসব তোকে?”

” আমি একদম ঠিক আছি মা। আমি একাই যেতে পারব। থাকো আসছি আমি।”

” ঠিক আছে সাবধানে যাবি। ”

শুভ্রতা নিজ বাড়ি থেকে বেড়িয়ে শ্বশুরবাড়ির দিকে পা বাড়ায়। সদর দরজা তখনও খোলা। ভেতরে প্রবেশ করতেই দেখে আমির সাহেব ড্রয়িংরুমে সোফায় বসে চা নিয়ে বসে বসে টিভি দেখছেন।
শুভ্রতাকে দেখেই বলেন, ” কী রে মা, কোথায় গিয়েছিলি?

দুপুরবেলায় চা নিয়ে বসে দেখে শুভ্রতা বলে ওঠে, ” দুপুর বেলা কেউ চা খায় সেটা আগে আমাকে বলা হোক।”

” বস এখানে, খাবার খাওয়ার পর এক কাপ খাওয়া যেতেই পারে অসম্ভব কিছু না।”

” বড়আম্মু কোথায়? আবিরা আপু কোথায়? নেহা এসেছে কি?”

” হ্যাঁ এসেছে। সবাই তোদের রুমেই আছে গল্প করছে বসে বসে। তুই নাকি ডাক্তারের কাছে গিয়েছিলি রে মা? কিছু হয়েছে?”

” এমনিই চেকআপ করাতে গেছিলাম বড়আব্বু। তেমন কিছু না।” শুভ্রতা ভেবেছিল খুশির খবরটা দিয়েই দিবে কিন্তু বলার আগ মুহুর্তে কেমন লজ্জা লাগছিল তার। আমির সাহেব তাকে ফ্রেশ হওয়ার জন্য বলেন৷ দুই একটা কথা বলেই শুভ্রতা সেখান থেকে চলে যায়। সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠে নিজের রুমের দিকে যেতে থাকে। মনে আনন্দ আর লজ্জা দুটোই কাজ করছে। এতগুলো বছর পর একটা খুশির খবর সবাইকে দিতে পারবে।

#চলবে………….

#শুভ্ররাঙা_ভালোবাসা
#তানিয়া_মাহি(নীরু)
#পর্ব_৫২

“আজকে আমাকে কেমন লাগছে বললেন না তো ভাইয়া? আপনি আমার দিকে দেখেন না কেন?”

অরুর এমন উদ্ভট প্রশ্নে সাহিল বলে, ” তুই কোন ক্লাসে যেন পড়ছিস?”

” ক্লাস নাইন, কেন?”

” তোর বয়স কত হবে সর্বোচ্চ পনেরো। সেটাও হবে না হয়তো।”

” দুইবার ফেল করেছিলাম বয়স ষোলো। আমি ষোলো পেরিয়ে গেছি। ও আমি ষো…..”

সাহিল তাকে থামিয়ে দিয়ে বলে, ” আমার বয়স বত্রিশ বছর। তোর বয়সের দ্বিগুণ। আমার সাথে তোর কীভাবে কথা বলা উচিৎ বল?”

” আপনার বয়স বত্রিশ হলেও পঁচিশ বছরের হ্যান্ডসাম যুবকদের মতোই লাগে। আ’ম ইন লাভ উইথ ইউ সাহিল ভাইয়া। ”

অরুর কথা শুনে মেজাজ চরম খারাপ হয়ে যায় সাহিলের। সে ভেবেছিল অরুর ওপর সে আর রাগ করবে না। নিজের কথা সে রক্ষা করতে পারল না। সাহিল এবার হুঙ্কার দিয়ে ওঠে, ” অরু, আমি কিন্তু তোকে পড়ানো বাদ দিয়ে দিব। তোর বাবাকে এসব কথা আমি আজই জানাবো অপেক্ষা কর। ”

বাবাকে জানানোর কথা শুনে একটু ভয় পেয়ে যায় অরু৷ তবুও মাথা নিচু করে বলে, ” আমি সত্যিই আপনাকে ভালোবাসি৷ আমি একবর্ণও মিথ্যে বলছি না বিশ্বাস করুন৷ আমাকে একটু ভালোবাসলে কী হবে? শুধু ভালোবাসাই তো চেয়েছি আর কিছু না।”

সাহিল অরুর খাতা দেখে, সে এখনো কিছুই লেখে নি৷

সাহিল রেগে বলে ওঠে, ” খাতায় এখনো কিছু লেখিস না কেন? আগে ফেল করেছিস পড়াশোনা না করে। এখানেও পড়তে এসে প্রেমের প্রস্তাব দিয়ে বেড়াচ্ছিস তাই না? প্রাইভেট পড়েও যখন ফেল করবি তখন আমার মান সম্মান থাকবে? আমি এদিকে খুব স্বার্থপর, আমি আমার সম্মানেও দাগ লাগতে দিই না, কারো কাছে মাথা নিচুও করি না। তাড়াতাড়ি লেখা শেষ কর, নতুন পড়া নিয়ে বাড়ি যা।”

অরু কলম ছুড়ে ফেলে দেয়। খাতা বন্ধ করে বলে, ” আমি লিখব না কী করবেন? আমি ভালোবাসার কথা বললেই আপনার আত্নসম্মান মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। আমি তো শুধু ভালোবাসার কথাই বলেছি, অন্যকিছু তো বলি নি। ”

সাহিল এবার নিজেকে আয়ত্ত্বে রাখতে পারে না। টেবিলে রাখা বে*ত দিয়ে অরুর হাতের তালুতে ইচ্ছেমতো কয়েকটা বা*রি দেয়। অরুর চোখে পানি টলমল করছে আর সাহিলের চোখে হিং*স্র*তা। সাহিল থেমে যায়। অরু হাত নিচে নিয়ে নেয়। হাত গরম হয়ে গিয়েছে, খুব জ্ব*ল*ছে তার। মনে হচ্ছে হাতে মধ্যে লা*ভা সৃষ্টি হয়েছে। অরু নিজের চোখের পানি কিছুতেই আটকে রাখতে পারে না। এক পলকে সাহিলের দিকে তাকিয়ে আছে। সাহিল বইয়ের পৃষ্টা উল্টাচ্ছে। অরু বসা থেকে উঠে দাঁড়ায়। ” আপনি আমার জা*ন নিয়ে নেওয়ার আগ অব্ধিও আমি আপনাকেই ভালোবাসব সাহিল ভাই। এইটা তো কিছুই না। হাত শুধু র*ক্তিমবর্ণ ধারণ করেছে বেশি কিছু না।” বলেই বই,খাতা,নিজের ব্যাগ সবকিছু ওভাবেই রেখে দৌঁড়ে রুম থেকে বেরিয়ে যায়।


শুভ্রতা মন খারাপের ভঙ্গিতে রুমে প্রবেশ করে। শুভ্রতাকে দেখে নেহা চেয়ার থেকে উঠে শুভ্রতার দিকে এগিয়ে আসে। ডাক্তার কী বলল সেটা জানতে চায়। শুভ্রতা ঠিক আগের মতোই দাঁড়িয়ে আছে। সবাই চুপচাপ বসে আছে। নিহান নিজেও এবার এগিয়ে আসে। শুভ্রতাকে উদ্দেশ্য করে বলে, ” আমার সাথে ডাক্তারের কাছে গেলে হতো না?”

” আপনি তো ঘুমাচ্ছিলেন তাই আর ডাকিনি।”

” ঘুম থেকে ডাকতে কখনো নিষেধ করেছি? প্রয়োজন হলে ডাকবে না? দেখি রিপো*র্ট দাও।”

শুভ্রতা হাসি চেপে রেখে নিহানের হাতে রিপো*র্ট ধরিয়ে দেয়। নিহান সেটা দেখতে থাকে। পেপারের ঠিক নিচে এসে চোখ আটকে যায়। চোখ তুলে শুভ্রতার দিকে তাকায়। শুভ্রতার চোখ টলমল করছে। নিহানের মুখেও কোন ভাষা নেই, সেও চুপচাপ শুভ্রতার দিকে তাকিয়ে আছে। কেউ কিছু বুঝতে পেরে উঠে তাদের দিকে এসে দাঁড়ায়। রাবেয়া বেগম নিহানের হাত থেকে রিপো*র্টের কাগজটা নিয়ে নেয়। ” পজেটিভ” দেখে তিনি উচ্চস্বরে হেসে উঠেন। ” আমার ঘরে নতুন মানুষ আসতে চলেছে।” বলে চিৎকার দিয়ে ওঠেন তিনি। সাথে সাথে আবিরা আর নেহার মুখে হাসি ফুটে যায়। দুজনে শুভ্রতাকে জড়িয়ে ধরে। রাবেয়া বেগম উত্তেজনার বশে সোজা বাহিরে চলে যায় মিষ্টির ব্যবস্থা করতে। কিছুক্ষণের মধ্যে আবিরা আর নেহাও বের হয়ে যায়। নিহান ততক্ষণে শুভ্রতাকে জড়িয়ে ধরেছে৷ শক্ত করে জড়িয়ে ধরে আছে সে। শুভ্রতাও নিহানের বুকে মাথা গুজে দাঁড়িয়ে আছে। নিহান ওভাবে দাঁড়িয়ে থেকেই বলতে থাকে, ” তোমাকে ডাক্তারের কাছে পাঠাতে আমার কেমন যেন ভয় লাগছিল। যদি ডাক্তার অন্যরকম কিছু বলে!”

” বলেনি তো, চিন্তা করবেন না।”

নিহান শুভ্রতাকে ছেড়ে হাত ধরে নিয়ে বিছানায় বসিয়ে দেয়। গ্লাসে করে পানি এগিয়ে দিয়ে বলে, ” আজ থেকে কোন রকম কাজ করা চলবে না। আমি ওখানে কাউকে ঠিক করে দিব।”

শুভ্রতা ভয়ে ভয়ে বলে, ” মা বলছিল আমাকে এখানে থাকতে। এখানে সবাই আছে, সবার সাথে থাকলে আমার মন ভালো থাকবে। সবাই দেখাশোনা করতে পারবে। ”

নিহান কোন কথা না বলে চুপ করে কিছু ভাবতে থাকে। তারপর বলে, ” তোমার কোন অসুবিধা হবে না তো?”

” তা হবে না। কিন্তু…”

” কিন্তু?”

” তোমাকে ছাড়া থাকতে খারাপ লাগবে। খুব খারাপ লাগবে, খুব খুব খুব।”

” আমার শুভ্রাকে ছেড়ে থাকতে কি আমার ভালো লাগবে নাকি? তাকে ছাড়া কি আমার ভালো থাকার কথা? কী আর করার, আমাকে যে যেতেই হবে। আমার ওপর কত দায়িত্ব! আমি তো শুধু আমার মানুষটার জন্য এতবড় দায়িত্ব এড়িয়ে যেতে পারি না। আমরা চাইলেও অনেককিছুই পারি না৷ শতকষ্ট বুকে চেপে রেখে দেশ রক্ষার্থে ল*ড়ে যেতে হয়। সেটা যদি দেশের কিছু মানুষ বুঝতো তাহলে দেশে এত অনৈ*তিক কাজ হতো না।”

” আপনি প্রতি সপ্তাহে আসতে পারবে না?”

” প্রতি সপ্তাহে আসা কি সম্ভব হবে? পারলে আসব আর না পারলে দুই সপ্তাহ পরপর চলে আসব ইন শা আল্লাহ। ”

” আমি তোমাকে ভীষণ মিস করব। ”

” ঠিক আছে। এখন বলো বাবু ঠিক আছে তো? কখনো খারাপ লাগলে কিন্তু অবশ্যই অন্তত মাকে আর আমাকে জানাতেই হবে বুঝেছ?”

শুভ্রতা মাথা ঝাঁকিয়ে সম্মতি জানায়। নিহান আবারও শুভ্রতাকে বুকে জড়িয়ে নেয়। শুভ্রতা নির্দ্বিধায় এবার স্বস্তির শ্বাস ফেলে।

ইমতিয়াজ বেশ কিছুক্ষণ যাবৎ একটা ব্রিজের ওপর বসে বসে জীবনে পাওয়া- না পাওয়ার হিসেব কষছে। যেভাবেই হিসেব করছে শেষে এসে প্রাপ্তির খাতা শূন্য। ইমতিয়াজ ব্রিজের নিচের বয়ে যাওয়া খরস্রোতা পানির দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। মনে মনে ভাবে, ” এখানে লাফ দিলেই হয়তো সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। আশেপাশে সেরকম মানুষও তো দেখা যাচ্ছে না। আমি তো সাঁতার জানি না, গভীরতা বেশি হলেই আজ সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।”
ইমতিয়াজের নিজসত্ত্বা বলে ওঠে, ” তুই পৃথিবীর সবচেয়ে নিকৃ*ষ্ট মানুষ। জন্মের সময় মাকে হারিয়েছিস, যে মেয়েটা তোকে ভালোবেসে আজীবন তোর সাথে থাকতে চেয়েছিল বাহ্যিক আকর্ষণে সে মেয়েটাকেও খুইয়ে ফেললি। তোর বেঁচে থাকার অধিকার নেই।” ভেতরটা দুমড়ে মুচড়ে ওঠে ইমতিয়াজের। মা*রা গেলেও আজ তার জন্য কান্না করার একটা মানুষ পর্যন্ত নেই তার জীবনে।
ইমতিয়াজ ব্রিজের ওপর উঠে দাঁড়ায়। ভীষণ কান্না পাচ্ছে তার আজ। চোখ দুটো ছলছল করছে। আর কোন ভাবনাচিন্তা করে না সে। তাকে ব্রিজের ওপর দাঁড়াতে দেখে চারপাশের মানুষ তার দিকে এগিয়ে আসতে থাকে। ইমতিয়াজ আর ভালো কিছুর অপেক্ষা না করে ব্রিজের নিচে পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে। চারপাশের দৌঁড়ে সেখানে এসে জড়ো হয়ে যায়। ইমতিয়াজের সেদিকে কোন খেয়াল নেই। সে পানিতে হাবুডুবু খাচ্ছে। কেউ কেউ ফোন বের করে ভিডিয়ো করছে, ন*ষ্ট প্রজ*ন্ম। পানিতে ঝাঁপ দেওয়ার পর থেকে কী ভেবে বাঁচার চেষ্টা করে যাচ্ছে সে অন্যসবাই ও হয়তো এ পথে এগিয়ে কোন একসময়ে বাঁচার চেষ্টা করে কিন্তু, কিন্তু নিজেকে শেষ রক্ষা করতে পারে না। ইমতিয়াজ ও কি এভাবেই বিদায় নেবে!

#চলবে….

#শুভ্ররাঙা_ভালোবাসা
#তানিয়া_মাহি(নীরু)
#পর্ব_৫৩

নিহান রান্নাঘরে শুভ্রতার জন্য রান্না করছিল। আবিরা নিজের ছেলের জন্য খাবার বানাতে এসে দেখে নিহান রান্নাঘরে কিছু একটা করছে। তার দিকে এগিয়ে যেতেই দেখে নিহান চিকেন স্যুপ রান্না করছে। আবিরাকে দেখে বলে, ” দেখ তো রান্না ঠিক আছে কি না?”

আবিরা নিহানের হাত থেকে চামচ নিয়ে পাতিলের খাবারটুকু নেড়ে বলে, ” সবই তো ঠিকঠাকই আছে মনে হচ্ছে। রান্নাটাও হয়ে গেছে। আমি বেড়ে দেব?”

” না আমিই নিচ্ছি।”

নিহান চিকেন স্যুপ্টুকু নিয়ে নিজের রুমের দিকে যায়। শুভ্রতা বসে বসে শাকিরার সাথে কথা বলছিল। অনেকদিন পর বাড়িতে এসেছে। শাকিরার চার বছরের মেয়ে আছে একটা। মেয়েটা বাবার মতো ইংরেজি বলায় ভীষণ পটু। মেয়ে যখন শাকিরার কথা শোনে না তখন ইংরেজের বাচ্চা বলে মেয়েকে সম্বোধন করে সে। শাকিরা বসে শুভ্রতার সাথে গল্প করছে আর সে নানুবাড়ি যাওয়ার জন্য টানাটানি করছে। মেয়ের জন্য আর বসে থাকতে না পেরে চলে যাওয়ার জন্য উঠে দাঁড়াতেই নিহানের সাথে দেখা হয়ে যায় তার। হাস্সোজ্জ্বল মুখেই বলে, ” কেমন আছো ভাইয়া?”

নিহান স্যুপের বোল টেবিলের ওপর রাখতে রাখতে বলে, ” এই তো আলহামদুলিল্লাহ, তুই কেমন আছিস? আর এই যে আমার বিচ্ছু মামনিটা কেমন আছে?”

” ওর কথা আর বলো না। সারাদিন কী পরিমাণে যে জ্বা*লায় কী বলব! ”

নিহান হাসতে হাসতে একটা কৌটা থেকে কেক বের করে মেয়ের হাতে দেয়। ওদিক থেকে শুভ্রতা বলে, ” বাচ্চা মেয়ে জ্বা*লাবেই একটু। মা হয়েছিস আর সহ্য করবি না?”

মেয়ে আবার টানতে থাকলে কোলে নিয়ে বলবে, ” দেখেছিস কীভাবে টানছিল? থাক এখন আসছি। পরে আবার আসব। ভাইয়া থাকো আসছি।”

শাকিরা চলে যেতেই নিহান শুভ্রতার সামনে বসে। স্যুপ বোল হাতে নিয়ে ফু দিয়ে চামচে করে শুভ্রতার মুখের সামনে ধরতেই বলে, ” এটা আপনি বানিয়েছেন? ”

” হ্যাঁ আপনার বর বানিয়েছে। খাবেন না?”

” আমার বর রাধুনী হলো কবে থেকে?”

” বউ প্রেগন্যান্ট হলে বরদের একটু রাধুনী হতে হয়, ধোপা হতে হয় আরও কত কী হতে হয়! নাও এখন খেয়ে নাও একটু। ”

” কিন্তু আমার তো ক্ষুধা পায় নি।”

” বাবুর খুব ক্ষুধা পেয়েছে আমাকে বলেছে।”

” কখন বলল? কই আমাকে তো বলেনি!”

” তুমি যে খেতে চাও না তাই বাবুর কথা শুনতে পাওনি। আমাকে ডেকে ডেকে বলল বাবা আমার খুব ক্ষুধা পেয়েছে চিকেন স্যুপ খাওয়াও।”

শুভ্রতা হাসতে থাকে। হাসতে হাসতে বলে, ” তোমাকে এটা বলেছে ও?”

” হ্যাঁ বলেছে। এই যে এখনো বলেছে যে বাবা বসে আছো কেন খাইয়ে দাও তাড়াতাড়ি। ”

শুভ্রতা উচ্চস্বরে হাসতে থাকে। নিহান খাবারটা ফু দিয়ে আর বারবার নেড়ে ঠান্ডা করতে থাকে। শুভ্রতাকে এক চামচ করে দিচ্ছে আর সে খেয়ে নিচ্ছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই পুরো খাবার শেষ করে ফেলে। শুভ্রতাকে পানি খাইয়ে দিয়ে নিহান বাহিরে যেতে থাকলে শুভ্রতা বলে ওঠে, ” রান্নার হাত কিন্তু খারাপ না তোমার, মাঝেমধ্যে রান্না করে খাওয়াতেই পারো।”
___

” আব্বা, যারে তুলে আনছো রাস্তা থেকে তারে আর কয়দিন বসিয়ে বসিয়ে খাওয়াবে? উনার কী মনে হয় আমরা কিছুই বুঝি না? আর তোমারই বা কেমন জ্ঞান? বাড়িতে দুই দুইটা অবিবাহিত মেয়ে তোমার। এই বাড়িতে অপরিচিত পুরুষ মানুষরে ক্যামনে আনতে পারলা? বাড়ির আশেপাশে ফাঁকা, কোন বাড়ি নাই দেখে বেঁচে গেলে। জনবহুল জায়গা হইলে সম্মান টিকতো তোমার?”

বড় মেয়ে ফারজানার মুখে এমন কথা শুনে বাবা ফাহাদ মিয়া বারবার মেয়েকে থামতে বলছেন৷ মেয়েটা ঠোঁটকা*টা স্বভাবের। যখন যা বলা উচিৎ বলে মনে করে সেটাই বলে। তারই বা দোষ হবে কেন? ছোটবেলা থেকে দিনগুলো যে অতিকষ্টে কা*টছে তাদের। নুন আনতে পান্তা ফুরানোর মতো অবস্থা। পনেরো বছর বয়স থেকে টানা সাতটা বছর মেয়েটা সেলাইয়ের কাজ করে বাবাকে সংসার চালাতে সাহায্য করছে। ছোটবোনটার পড়াশোনার খরচও চালাতে হয়। নিজেদের দিনই চলতে চায় না তার ওপর বাবা এরকম একটা অপরিচিত পুরুষ মানুষকে ধরে নিয়ে এসেছে। সে নাকি ম*র*তে গিয়েছিল। ফারজানা বিলাপ করতে করতে বলে, ” মরে গেলেই ভালো হতো, তাদের সংসার আরও দুই ধাপ এগিয়ে রশা*তলে যেত না।”

ফারজানার বাবা তাকে থামিয়ে বলে, ” মা রে একটু থাম। ছেলেটা শুনলে কষ্ট পাবে। মানুষ কি কম দুঃখে ম*রতে যায় ক’? ”

ফারজানা বাবার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলে, ” পাঁচদিন, পাঁচদিন কম সময় না আব্বা। তিনি চুপচাপ ঘরের কোণে কেন পড়ে আছে বলতে পারো? উনার কি মনে হয় উনাকে আজীবনের জন্য এখানে রাখা হবে?”

” আমি কথা বলে দেখব মা, ছেলেটা মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছে। একটু ওর দিকটাও ভাব।”

ফারজানা আর কোন কথা না বলে ভাত রান্না করার জন্য চাউল ধুতে কলপাড় চলে যায়।
ফাহাদ মিয়া উঠান থেকে উঠে ইমতিয়াজের ঘরে যায়। ইমতিয়াজ ঘরে বসে জানালা দিয়ে বাহিরে তাকিয়ে ছিল। কারো উপস্থিতি বুঝতে পেরে পিছনে ঘরতেই ফাহাদ মিয়াকে দেখে। তিনি গিয়ে ইমতিয়াজের পাশে বসে বলেন, ” বাবা নিজের ব্যাপারে কিছু ভাবছো? কোথায় যাবা, কী করবা এসব কিছু?”

ইমতিয়াজ কিছুক্ষণ মৌন থেকে বলে, ” আমি ফিরব চাচা, বাড়ি ফিরব আমি।”

” তোমার বাড়ি আছে?”

ইমতিয়াজ কিছু ভেবে তারপর আবার বলে, ” হ্যাঁ আছে। আমার সবকিছু আমার ছোটমা দখলে রাখছে, নিজের করে নেওয়ার জন্য আমারে খু*নের দায়ে জেলে পাঠিয়েছিল। ভালোবাসার মানুষটাও আমারে ছেড়ে চলে গেছে। অতি নির্মম ছিলাম আমি তার ওপর। এখন সবটা বুঝি কত পাপ করেছি আমি।”
দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে ইমতিয়াজ। ফাহাদ সাহেব বলেন, ” নিজের ভুল যেহেতু বুঝছ তাইলে এইবার ভালোবাসার মানুষটারে আপন কইরা লও। ভালোবাসার মানুষরে দূরে রাখতে হয় না বাবা।”
ব্যথাতুর দৃষ্টিতে তাকায় ইমতিয়াজ। বলে, ” সে আমার ভালোবাসার মানুষ ছিল এখন নাই আর তাছাড়া তার তো মানুষ আছে। চাচা আমি বিকেলেই চলে যাব। অনেক কষ্ট দিয়েছি তাই না? সেদিন আমাকে না বাঁচালেই পারতেন। বড় একটা সমস্যা বিদায় নিত।”

” আত্মহ*ত্যার মাধ্যমে কোন সমস্যার সমাধান হয় না বাবা। ম*রলে ওই একজনই শুধু বিদায় বাকি কারও কোন যায় আসে না। তোমার আব্বা নাই? তিনি তোমার খোঁজ নেন না?”

” আব্বা! ” ইমতিয়াজ কিয়ৎপরিমাণ কষ্ট আর আক্ষেপ বের করতে চেয়েও যেন গিলে নেয়। বলে, ” মা ম*র*লে বাপ আর বাপ থাকে না চাচা।”
_____

সাহিল অরুদের বাড়ি এসেছিল অরুর অসুস্থতার খবর শুনে কিন্তু অরু তো অসুস্থতায়ও চুপচাপ বসে বা শুয়ে থাকার মেয়ে নয়। সাহিল এসেছে শুনেই জামা পাল্টে বাসন্তী রঙের শাড়ি পরে চুলটা ঠিক করে বাধছে সে। অরুর মা চুপচাপ বসে মেয়ের কান্ড দেখছে। সাহিল এসেছে বলে অরুকে ঘুম থেকে ডাকতে এসেছিলেন তিনি। সাহিল এসেছে শুনে অরু জিদ ধরে সে এরকম হয়ে সাহিলের সামনে যাবে না। মা ও মেয়ের কথা ফেলতে পারে না তাই আলমারি থেকে একটা শাড়ি বের করে দিতেই অরু সেটা খুব যত্নে পরে নেয়। সাহিল বাহিরে বসে অপেক্ষা করছে। অবশেষে অরু তার সামনে আসে। অরুকে এক নজর দেখে চোখ নামিয়ে নেয় সে। এই মেয়েটা বড্ড পাজি। অসুস্থতাও তাকে কোনভাবেই দমাতে পারে নি। আজ দিয়ে যে কয়েকবার অরুদের বাড়ি এসেছে সাহিল, সেই কয়েকবারই শাড়ি পরেই সামনে এসেছে অরু। অরুর মা আর সেখানে যায় না। কী দরকার মেয়ের সাময়িক সুখের অনুভূতি নষ্ট করে! আর কয়দিনই বা সাহিলের জন্য অতিসুন্দর করে নিজেকে সাজাবে সে?
অরু গিয়ে সাহিলের সামনে টেবিলে হেলান দিয়ে দাঁড়ায় অরু। পিটপিট করে তার দিকে চেয়ে বলে, ” আমাকে কেমন লাগছে সাহিল ভাইয়া?”

অরুর দিকে না তাকিয়েই সে বলে দেয়, ” সুন্দর লাগছে।”

অরু অভিমানী গলায় বলে, আপনি আমাকে না দেখেই কীভাবে বললেন?”

” তুই সুন্দর তাই তোকে সবকিছুতেই সুন্দর লাগবে এটাই স্বাভাবিক।”

অরু সাহিলের কথায় মুচকি হাসে। সাহিল তাকে সুন্দর বলেছে! তাড়াতাড়ি করে সাহিলের পাশে গিয়ে বসে সে। আবদার করার সুরেই বলে, ” আমাকে মেলায় নিয়ে যাবেন? গতকাল থেকে গ্রামের মাথায় ওই নতুন পার্কের সামনের যে ফাঁকা জায়গাটা আছে ওখানে মেলা শুরু হয়েছে। আমার খুব শখ হয়েছে মেলায় যাওয়ার। নিয়ে যাবেন আমাকে?”

সাহিল অরুর মুখের দিকে তাকায়। মাত্র ক’দিনে মুখের কি অবস্থা হয়েছে অরুর! চোখটা যেন গর্তে চলে গিয়েছে। রাতে হয়তো ঘুমাতে পারে না বিধায় চোখের নিচে কালো দাগ পড়েছে। সাহিল মলিন গলায় বলে, ” সেদিন খুব জোরে লেগেছিল না রে? আমি তোকে মারতে চাই নি বিশ্বাস কর। কেন জানি না হুট করেই মাথা গরম হয়ে গিয়েছিল। পরে তুই চলে আসার পর বুঝেছিলাম, আমার ওরকম করা উচিৎ হয় নি। আ’ম স্যরি রে।”

অরু একগাল হেসে বলে, ” কি যে বলেন না! এরকম মা*ইর আমি কতদিন খেয়েছি! স্কুলে তো এর চেয়েও অনেক জোরে জোরে মা’র খেয়েছি আগে। একটুও হাতে ব্যথা পাই নি সেদিন৷ মনে ব্যথা পেয়েছিলাম।” বলেই ফিক করে হেসে দেয় অরু। কিয়ৎক্ষণ চুপ থেকে আবার বলে,” আমি আপনাকে সত্যিই ভালোবাসি, এটা আমার ছেলেমানুষি না সাহিল ভাইয়া। আমি তেরো, চৌদ্দ বছর বয়স থেকে প্রেমের প্রস্তাব পেয়েছি। আমার সব বান্ধবীর বয়ফ্রেন্ড আছে। আমি অবুঝ নই। আপনার জন্য আমার কাউকে ভালোই লাগে না৷ ভেবেছিলাম আর দুইটা বছর আমি এ বাড়িতে থাকব। আঠারো হলেই আপনাকে বিয়ে করে নেব। ”

চোখ দুটো ছলছল করছে অরুর। সাহিলের মুখে কোন কথা নেই। কুলুপ এঁটে বসে আছে। সাহিল জানে অরু এবার চরম সত্যিটাও গড়গড় করে বলে দেবে। সাহিলের ভাবনাকে সত্যি করে দিয়ে অরু বলে, ” আমি সেদিন খুব অসুস্থ হয়ে যাই। মা আর মামা মিলে যখন আমাকে শহরে হাসপাতালে নিয়ে যায় তখন আমার খুব খারাপ লাগছিল। হাসপাতালে নানারকম টেস্ট করানোর পর যখন আমি খুব ক্লান্ত ছিলাম তখন বেডে চোখ বন্ধ করে শুয়ে ছিলাম। নার্স এসে আমার সব রিপোর্ট মামার হাতে ধরিয়ে দিয়ে নার্স আমার মাকে একটু দূরে নিয়ে গিয়ে জানায় আমার এইচআইভি পজেটিভ। এই রোগ নাকি অনেকদিন ধরেই হয়েছে। মা আর মামা দৌঁড়ে ডাক্তারের কাছে যায় আসল ঘটনা জানতে। আমি তো তখনই বুঝেছি আমার আসলে কী হয়েছে। আমি তো স্কুলের বই পড়ে এসব বিষয়ে আগে থেকেই জেনেছিলাম। আগে আমি প্রায়ই অসুস্থ থাকতাম ডাক্তার কীসের কীসের ইনজেকশন দিত। ওখান থেকেই বোধ হয়….” গলা আটকে যায় অরুর। আর এসব বলতে ইচ্ছে করছে না তার। এসব বলতে একদম ভালো লাগছে না। নিজের আয়ু যে শেষ, তলানিতে ঠেকেছে এসব কথা কারই বা বলতে ভালো লাগে? অরু নিজেকে সামলে নেয়। আবার বলে, ” আপনি আমাকে একটা কথা দিবেন সাহিল ভাই?”

সাহিল এতক্ষণে গলা ঠিক করে বলে, ” কী?”

” আপনি আপনার প্রেমিকাকে খুঁজে বের করবেন আর তারপর দুজন বিয়ে করবেন। আরেকটা কথা, আপনারা দুজন কিন্তু অবশ্যই একদিন আমার কবর জিয়ারত করতে যাবেন। বেঁচে থাকতে আপনার বউকে দেখতে পারব কি না সেটা তো জানি না।”

সাহিল অরুর কথায় অবাক হয়। কী আশ্চর্য, মেয়েটা হাসছে! ষোলো বছর বয়সী মেয়ে এতটা স্ট্রং হয়! সাহিল অরুর দিকে তাকিয়ে নির্জীব কণ্ঠে বলে, ” অরু, মেলায় যাবি বললি না? পরশু আমরা মেলায় যাব। তোর ওই যে লালশাড়ি আছে না? ওটা পরবি, ঠিক আছে?”

” আপনি আমাকে কথা দিলেন না তো?”

” সে হয়তো এতদিনে বিয়ে করে নিয়েছে। আমাকে যেন বিয়ে না করতে হয় তার জন্যই তো সবকিছু নিজের মতো করে নিয়েছিল সে। এতগুলো বছর পর সে কেন আমাকে বিয়ে করার জন্য বসে থাকবে? এসব এখন বাদ দে। তুই অনেক ছোট এসব বুঝবি না।”

” আর দুই বছর বেঁচে থাকলে আমিই আপনাকে বিয়ে করাতাম সাহিল ভাইয়া। অন্য কোন মেয়ে বা প্রাক্তনকে আপনার কাছে ঘেষতেই দিতাম না, কিছুতেই দিতাম না।”

অরুর গালে আলতো করে হাত রাখে সাহিল। মেয়েটার চেহারা এই কয়েকটা দিনে কেমন হয়ে গিয়েছে কিন্তু মুখ থেকে মায়া কাটেনি। এত ভালো মেয়েদের এত তাড়াতাড়ি চলে যেতে নেই। অথচ ভালো মানুষ আর ভালো জিনিসই বেশিদিন টিকে না। সাহিল অরুর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে, ” আমি বিকেলে আসব আবার, এখন যাই?”

” আপনার আসতে হবে না। আমিই নাহয় যাব আপনাদের বাড়িতে।”

” না, আমিই বিকেলে কাজ সেরে একবার আসব। একদম মন খারাপ করে থাকবি না, বুঝেছিস?”

” আমার মন খারাপ হয়না। বিকেলে কখন আসবেন?”

” সময় বলতে পারছি না।”

” আমি অপেক্ষা করব আপনার জন্য। ”

#চলবে……