শুভ্ররাঙা ভালোবাসা পর্ব-৫৪+৫৫+৫৬

0
324

#শুভ্ররাঙা_ভালোবাসা
#তানিয়া_মাহি(নীরু)
#পর্ব_৫৪

বৃহস্পতিবারে শিক্ষাসফরের দিন করা হয়েছিল। সেই কথানুযায়ী আজ সকাল সাতটায় বাস ছাড়া হয়েছে। দুইটা বাসে করে তারা নির্দিষ্ট গন্তব্যের দিকে ছুটে চলেছে। ফাউজিয়া জানালার পাশে বসে বাহিরের পরিবেশ দেখছিল আর ভাবছিল ফেলে আসা সেই পুরোনো দিনের কথা। আগে সবাই মিলে কত ঘুরাঘুরি করা হত! আজ এতগুলো বছর সে নিজের শহর ছেড়ে বের হয় নি খুব বেশি প্রয়োজন না হলে। বলতে গেলে সে তার বেশিরভাগ সময়ই নিজের ঘরে কাটায়
“পানির বোতলটা একটু দেন তো ম্যাম।” কথায় ঘোড় কাটে ফাউজিয়ার। পাশে তাকাতেই কলেজের সে ম্যাম আবার বলে, ” পানি পিপাসা পেয়েছে।”
ফাউজিয়া ব্যাগ থেকে পানির বোতল বের করে দেয়। উনি ঢকঢক করে কিছুটা পানি খেয়ে বোতলের ক্যাপ লাগিয়ে আবার ফাউজিয়ার দিকে বাড়িয়ে দিতে দিতে বলে, ” বিয়ে করছেন কবে? বয়স তো বাড়ছে।” ফাউজিয়া জোরপূর্বক হেসে বলে, ” করব, সঠিক মানুষটা পাই। ”

” সঠিক মানুষ কি খুঁজে পাওয়া যায় ম্যাম? সঠিক বানিয়ে নিতে হয়। তাড়াতাড়ি বিয়ে করে আমাদের দাওয়াত দিন। ”

ফাউজিয়া প্রত্তুত্তরে হেসে মাথা ঝাঁকিয়ে জানালা দিয়ে বাহিরে তাকায় আবার। সেদিন সাহিলকে ফিরিয়ে দিলে হয়তো আজ তার একটা সংসার হত। সাহিলকে ফিরিয়ে দেওয়ার আফসোসে আজ অবধি আর কাউকে তার মনেই ধরেনি। মনে মনে অনেক প্রশ্নই জাগে তার সাহিল কি বিয়ে করে নিয়েছে?

কিছুক্ষণের মধ্যেই গাড়ি এসে নির্দিষ্ট গন্তব্যে থামে। একে একে বাসের সব মেয়েরা বেরিয়ে বাহিরে এসে দাঁড়ায়। নয়টা পার হয়ে গিয়েছে, প্রায় দশটা। সবার প্রথমে নাস্তাটা সেরে নেওয়া প্রয়োজন বলে মনে করল টিচাররা৷ পাশেই একটা বড় হলরুমের মতো জায়গায় সবাই গিয়ে বসে৷ সেখানেই সকালের খাবারের ব্যবস্থা করা হয়েছে।

সবাই খাওয়া দাওয়া শেষ করতে করতে এগারোটা বেজে যায়। খাওয়া শেষ করে তালিকা করা কিছু জায়গায় ঘুরতে যাবে বলে ঠিক করে সবাই। যথারীতি বারোটার দিকে বেরিয়েও যায়। আশেপাশের দুই- তিনটা জায়গায় ঘুরে আবার সবাই ফিরেও আসে দুপুরের খাবারের জন্য। প্রায় তিনটার দিকে পনেরো জনের করে কয়েকটা দলে বিভক্ত করা হয় সবাইকে। সব কয়েকটা দলের সাথে একজন করে শিক্ষক-শিক্ষিকাকে পাঠানো হয়। সে হিসেবে ফাউজিয়াও পনেরো জনকে নিয়ে সিরিয়াল অনুযায়ী ঘুরতে থাকে। রোদ মাথার ওপর থেকে পশ্চিম আকাশে হেলতে শুরু করেছে। সামনেই একটা বড় বটগাছ দেখে সবাই গিয়ে সেখানটায় গাছের শিকড়ের ওপর বসে। সবাই বসে এটা ওটা নিয়ে কথা বলছিল। ফাউজিয়া নিজেও মায়ের সাথে কথা বলে নেয়। হঠাৎ তার কানে আসে-

আমি আবার ক্লান্ত পথচারী

আমার কা*টার আঘা*ত লাগে ভারী।

গেছে জীবন দুদিকে দুজনারই

মেনে নিলেও কি মেনে নিতে পারি!

ছুঁতে গিয়েও যেন হাতের নাগালে না পাই,

এভাবে হেরে যাই, যেই ঘুরে তাকাই,

কেমন যেন আলাদা আলাদা সব।

আলগা থেকে তাই খসে পড়েছি প্রায়

কেমন যেন আলাদা আলাদা সব।

ফার্স্ট ইয়ারের একটা মেয়ে তার গিটার নিয়ে গান গাইছিল। সবাই তাকেই ঘিরে বসে গান শুনছে। একপাশেই বসে আছে ফাউজিয়া। বুকের মধ্যে লুকোনো ব্যথাগুলো যেন দম আটকে মে*রে ফেলতে চাইছে তাকে। পুরোনো মানুষটাকে খুব মনে পড়ছে আজ। মনে হচ্ছে একটাবার যদি কথা বলে সব মিটমাট করে নেওয়া যেত! কিন্তু এখন তো আসলেই দুজনের রাস্তা দুদিকে। দুই রাস্তার গন্তব্যস্থল কি আবার কখনো এক হতে পারে!
__

মাহতিম তন্ময় কারো সাথে কথা বলছে। স্নিগ্ধা ল্যাপটপ নিয়ে বসে আছে। কোন একজনের বিষয়ে তথ্য নিতে হচ্ছে বিভিন্ন জায়গা থেকে। তাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে কয়েকজন। সবার মুখেই চিন্তার ছাপ। কথা শেষ করে মাহতিম সবার কাছে এসে দাঁড়ালো। ল্যাপটপে কাজের গতি খেয়াল করে জিজ্ঞেস করল, ” কাজ কতদূর?”

পাশে থেকে একজন বলে উঠল, ” ছবি পাঠানোর কথা কিন্তু এখনো কোন খবর নেই।”

মাহতিম চুল ঠিক করতে করতে বলল, ” এত তাড়াহুড়ো করার প্রয়োজন নেই। আমার বাড়ি ফিরতে হবে। আমার মেয়ে অসুস্থ, এখানে নতুন বাসা নেওয়া হয়েছে। সবাইকে এখানেই নিয়ে আসব।”

স্নিগ্ধা কাজ ফেলে মাহতিমের দিকে তাকায়। পাশে থেকে রাইমা বলে ওঠে, ” স্যার আপনি বিবাহিত!”

মাহতিম চকিতে জবাব দেয়, ” গতমাসে পাঁচবছর হয়েছে। আমার একটা মেয়ে আছে তিন বছর বয়স।”

স্নিগ্ধা একপলকে বাক্যহীন চেয়ে আছে মাহতিমের দিকে। অফিসের সবার সাথে সেও বুঝতে পারেনি মাহতিম বিবাহিত। সবাইকে দেখে মাহতিম বুঝতে পারে সবাই তাকে অবাক চোখে দেখছে। অফিসে আসার পর থেকে কারো সাথে তেমন কথা হয়নি তার। কাজের মাঝেই ডুবে ছিল সারাক্ষণ। মাহতিমের জীবন মানের শুধু কাজ আর তার পরিবার। অফিসের সবার অবস্থা দেখে বুঝতে পারে কাজের আগে সঙ্গীদের সাথে ভালো একটা সম্পর্ক গড়ে তোলা হয়তো খুব প্রয়োজন। মাহতিম একটা চেয়ার টেনে সবার মাঝেই বসে। ফোনটা টেবিলের ওপর রেখে সবার উদ্দেশ্যে বলে, ” তোমরা কি ভেবেছিলে আমি অবিবাহিত?”

একজন আমতা আমতা করে বলে ওঠে, ” স্যার আমরা সবাই ভেবেছিলাম আপনি অবিবাহিত। ”

মাহতিম হেসে ওঠে। ওখানে থাকা সবাই একে অপরের মুখের দিকে তাকায়। কারো মুখে আর কোন কথা নেই। সবাইকে অবাক করে দিয়ে মাহতিম আবার বলে, ” আমার পরিবার বলতে আমার মা আর আমার মেয়ে।”

রাইমা এক মুহুর্ত দেরি না করেই বলে, ” ম্যাম? উনি আপনাদের সাথে থাকেন না?”

” না, আপনাদের ম্যাম আমাদের মেয়ে জন্মানোর সময় মা*রা গিয়েছেন।”

স্নিগ্ধা আগ্রহ দমাতে না পেরে বলে, ” তাহলে যে বললেন গতমাসে আপনাদের বিয়ের পাঁচ বছর হয়েছে?”

” হ্যাঁ, সে মা*রা গিয়েছে জন্য কী বিয়ের তারিখ ভুলে যাব? আচ্ছা তোমরা এগুতে থাকো দেখো কতদূর কী করতে পারো আমি এক্ষুনি বের হব।”

মাহতিম অফিস থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সাথে সাথে সবার মাঝে আলাপ-আলোচনা শুরু হয়ে যায় যার মূলকেন্দ্র মাহতিম।
___

অরু লালরঙের টকটকে শাড়ি পরে ঘাড়ের ওপর একটা হাত-খোপা করে রেখেছে। চোখে গাঢ় করে কাজল দিতে দিতে বলল, ” মা, আমাকে সত্যিই লালশাড়িতে মানিয়েছে? আমার কাছে কেমন যেন একটা লাগছে। আমি কি শুকিয়ে যাচ্ছি মা? লালশাড়িতেও যেন আমাকে আর ভালো লাগছে না। সাহিল ভাইয়ার ভালো লাগবে তো?”

অরুর মা বারবার নাক টানছেন। মেয়েকে সাজতে দেখলেই বুকের ভেতরটা হাহাকার করে ওঠে। কান্নাগুলো যেন দলা পাকিয়ে বের হয়ে আসতে চায়। মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে কান্নাও করতে পারেন না তিনি। নিজেকে শক্ত করে রাখতে হয় মেয়েকে সঙ্গ দিতে নচেৎ মেয়েটা যে আরও ভেঙে পড়বে। অরু এখন নিজের শারীরিক অবস্থা দেখে নিজেই বুঝতে পারে তার হাতে আর খুব একটা সময় নেই।

মাকে চুপ থাকতে দেখে অরু আবার বলে, ” মা কিছু বলছ না যে?”

অরুর মা এবার নিরবতা ভেঙে বলেন, ” আমার মেয়েকে কি খারাপ লাগায় উপায় আছে? আমার মেয়েকে যেকোন রঙের পোশাকেই পরীর মতো সুন্দর লাগে।

অরু চোখে কাজল দেওয়া শেষ করে নিজেকে একবার দেখে নেয়। চোখের নিচের কালো দাগের সাথে প্রায় মিশে গিয়েছে কাজল। পা থেকে মাথা পর্যন্ত নিজেই নিজেকে একবার পর্যবেক্ষণ করে নেয়। মা যতই বলুক অরু জানে তাকে আর আগের মতো সুন্দর লাগে না। এই চেহারায় আর কোন পুরুষের চোখ আটকাবে না কখনো। তার অস্তিত্বই তো কয়েকদিন বা কয়েকঘন্টা অথবা হতে পারে কয়েক মিনিটের মধ্যে বিলীন হয়ে যাবে। অরু বুকে চাপা কষ্ট নিয়ে মাকে জিজ্ঞেস করে, ” মা, তোমার মেয়েকে তো সাদা রঙের পোশাকেও দারুণ লাগবে তাই না? আমাকে সাদাকাফনে শুভ্রপরীর মতো লাগবে না বলো? মা তুমি দেখো, সমস্ত শরীর যখন শুধু শুভ্র আর শুভ্ররাঙা হবে , তখন একদম ফুটন্ত সাদা ফুল লাগবে আমায়। আমি তো তোমার রঙিন ফুল, তোমার রঙিন ফুলটাকে হয়তো শুভ্ররঙে বেশি মানাবে। ”

অরুর মা এবার নিজেকে নিয়ন্ত্রণ না করতে পেরে শব্দ করে কান্না করে ফেলে৷ সন্তানের মৃত্যু কোন মা সহ্য করতে পারে না। সেখানে অরু একটা বাচ্চা মেয়ে। অনেক সাধনার পর এই মেয়ে আল্লাহ ঘর আলো করে দিয়েছিলেন তাকে। অতি শখের আর সাধনার জিনিস যে আয়ু কম নিয়ে আসে।
অরু মায়ের কান্না দেখে বারবার চোখ মুছতে থাকে। যত্নে দেওয়া কাজল চোখের পানিতে আর অরুর ডলাডলিতে লেপ্টে গেছে। এই ছোট মেয়েটা যে আর কঠিন হয়ে থাকতে পারছে না। সব আনন্দ, ভালো থাকার অভিনয় শেষে এসে খাপছাড়া হয়ে যাচ্ছে। অরু দৌঁড়ে এসে মাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে থাকে। দুজন দুজনকে জড়িয়ে ধরে কান্না করছে। কাঁদতে অরুর ভীষণ খারাপ লাগছে দম বন্ধ হয়ে আসছে তার। হাঁপিয়ে গেছে সে, মাকে জোরে জোরে ডাকছে।

অরুদের বাড়িতে ঢুকবে তখনই মা-মেয়ের কান্না শুনতে পায় সাহিল। টানাপায়ে বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করে সোজা অরুর ঘরে চলে যায়। অরুর মা অরুর গালে আস্তে আস্তে থাপ্পড় দিচ্ছেন আর অরুকে ডাকছেন। অরু জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে। সাহিলকে দেখামাত্র অরুর চিৎকার দিয়ে বলে, ” সাহিল দেখ না অরু কেমন করছে। কথা বলছে না মেয়েটা। আমার ভালো ঠেকছে না, অরু এমন করছে কেন? ”

সাহিল এসে পাশে বসে। অরুর মাথা নিজের বুকের কাছে নিয়ে অরুকে ডাকতে থাকে। হাতের তালুতে ঘষতে থাকে।
” অরু, এই অরু কী হয়েছে? খারাপ লাগছে? অরু?”

অরু কোন কথা বলছে না, সাহিল অরুর মাকে উদ্দেশ্য করে বলে, ” কাকি, অবস্থা ভালো বুঝছি না। ওকে তাড়াতাড়ি হাসপাতালে নিতে হবে। তাড়াতাড়ি বের হন। আর এক মুহুর্ত দেরি করাও বোকামি হবে। ”

সাহিল অরুকে কোলে তুলে নিয়ে বেরিয়ে যায় ঘর থেকে। অরু চোখ খুলছে আর বন্ধ করছে। চোখ নিস্তেজ হয়ে এসেছে। বাঁধা বাঁধা গলাতেই বলে, ” সাহিল ভাইয়া আপনার সাথে আমার লালশাড়ি পরে মেলায় যাওয়া হলো না। আপনাকে পাওয়াও হলো না। জীবন তো একটাই, এই ছোট্টো জীবনটাও কেন এত অপূর্ণতায় পূর্ণ বলেন তো? ”

অরুর কথাগুলো সাহিলের কানে পৌঁছায় কিন্তু সে তাকে কোলে নিয়ে দৌঁড়াতেই থাকে আর বলতে থাকে, ” তোর কিছু হবে না অরু। এই তো এখনই গাড়ি পেয়ে যাব তারপরই হাসপাতাল। তুই তাকিয়ে থাকার চেষ্টা কর অরু। চোখ বন্ধ করবি না একদম। ”

অরু নিজের শরীরের ভর একদম ছেড়ে দেয়। নিস্তেজ হয়ে পড়ে। সাহিল কিছু একটা বুঝতে পেরে অরুর দিকে তাকায়। অরুর মাঝে আর কোন অস্থিরতা নেই, চোখের পলকও পড়ছে না। একপলকে সাহিলের দিকেই তাকিয়ে আছে। সাহিল দাঁড়িয়ে যায়। নরমস্বরে ডাক দেয়, ” অরু!”

#চলবে…….

#শুভ্ররাঙা_ভালোবাসা
#তানিয়া_মাহি(নীরু)
#পর্ব_৫৫

” কোথায় যাচ্ছেন আপনি? আপনি যে বাড়ি থেকে বের হচ্ছেন আব্বা জানে?”

ইমতিয়াজ ঘর থেকে বেরিয়ে আসছিল এমন সময় ফারজানার কথায় দাঁড়িয়ে যায়। তাকে দেখেই অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নেয় সে। মেয়েটা বেশ রগচটা, সবগুলো কথাতেই কেমন অস্বাভাবিক আচরণ।

” হ্যাঁ, আপনার বাবা জানেন। অনুমতিও দিয়েছেন।”

কোমর থেকে খড়িগুলো উঠোনে নামিয়ে বলতে থাকে, ” তো এখন যাবেন কোথায়? ঠিক করেছেন কিছু?”

” সেটা আপনার জানতে হবে না। ”

” জানতে হবে না মানে? আবার যে কোথাও গিয়ে ম*রতে বসবেন না সেটার কোন গ্যারান্টি আছে নাকি?”

” ম*রলে কেউ আপনাকে ধরতে আসবে না। এতদিন খাইয়েছেন তার জন্য আমি কৃতজ্ঞ থাকব। আমার ব্যাপারে আর কোন আগ্রহ না দেখালেও খুশি হব।”

” আপনার বাড়িতে কেউ আছে? আপনি কিছুই বলেন নি। এই কয়েকদিন এখানে ছিলেন… ”

ফারজানাকে থামিয়ে দিয়ে ইমতিয়াজ বলে, ” তার জন্য কৃতজ্ঞ থাকব। আসছি..”

” আপনি চাইলে এখানে থেকে যেতে পারেন। বাবার সাথে কাজ করলে….”

ইমতিয়াজ আবারও ফারজানাকে থামিয়ে দেয়। বেশ আক্রো*শ নিয়ে বলে, ” আপনার উপার্জনের টাকায় ক’দিন খেয়েছি, তাই বলে কি এখন আপনি ঠিক করবেন আমি কী করব, কোথায় থাকব?”

ফারজানা কিছু বলে না। চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। কম কথা শোনায় নি তো সে ইমতিয়াজকে। কাউকে দুবেলা দুমুঠো খেতে দিয়ে কত কথা শুনিয়েছে সে। উপায়ও তো কিছু ছিল না৷ তবে এখন ইমতিয়াজের যাওয়ার সময় বুঝতে পারছে সে একটু অতিরিক্তই করেছে। ফারজানাকে চুপ থাকতে দেখে ইমতিয়াজ বলে, ” আপনারা সবাই ভালো থাকবেন। আমি কোথায় যাব আমি নিজেও জানি না। কীভাবে থাকব, দিন চলবে সেটাও জানি না। তবে আমি কারো সাথে পাশে থাকব না। সৃষ্টিকর্তা হয়তো আমাকে একা থাকার জন্যই পাঠিয়েছেন। তিনি যেমনটা চান তেমনটাই হবে। ”

ইমতিয়াজ ফারজানাকে পাশ কাটিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়। ইমতিয়াজ নিজেও জানে না সে কোথায় যাবে,কী করবে! শুধু জানে যাদের যাদের জন্য আজ তার এই দশা তাদের শান্তি নষ্ট করে, নিজের প্রাপ্য বুঝে নিয়ে তারপর পরিচিত বি*ষধর মানুষের কাছে থেকে সারাজীবন দূরে থাকবে। তাকে যে খোঁজার কেউ নেই, ভালোবাসারও কেউ নেই।
রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে কয়েকজন ছবি উঠছিল। ইমতিয়াজ গুণে দেখলো সেখানে পাঁচজন মেয়ে আছে সাথে দুইটা বাচ্চা। তার হাতে তো কোন টাকা নেই তাদের থেকে চাইলে হয়তো কিছু টাকা পেতে পারে এই আশায় ইমতিয়াজ সেদিকেই এগুতে থাকে। হঠাৎ রাস্তার ঢাল থেকে একজনকে কিছুটা সামনেই উঠে আসতে দেখে ইমতিয়াজের মুখে শয়তানি হাসি ফুটে যায়। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করে এগিয়ে যায়। মেয়েগুলোকেও এখন স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। এরা যে আর কেউ নয়, শুভ্রতা আর তার পরিবার। ইমতিয়াজ আশা করে এখান থেকে এবার মোটা অংকের কিছু টাকা পাওয়া যাবে। নিহান রাস্তায় উঠতেই সামনে ইমতিয়াজকে দেখে স্থীর হয়ে যায়। ইমতিয়াজের মুখে ভুবনভুলানো হাসি। নিহান একবার শুভ্রতার দিকে তাকায় সে এখনো ইমতিয়াজকে দেখেনি। সে ইমতিয়াজকে জিজ্ঞেস করে, ” কী চাই এখানে?”

ইমতিয়াজ গাল চুলকাতে চুলকাতে বলে, ” টাকা। অনে-ক টাকা। ”

” মানে? আমি তোমাকে টাকা কেন দিতে যাব? ভিক্ষে চাইছো সবকিছু হারিয়ে?”

” ভিক্ষে!” বলেই ইমতিয়াজ শব্দ করে হাসতে থাকে। আবার বলে, ” আপনার বর্তমান আর আমার অতীত ওখানেই দাঁড়িয়ে আছে। আমার সময় খারাপ যাচ্ছে, আপনারও সময় খারাপ যাক এটা আমি চাই না। আগে যে বিশ লাখ টাকার বিনিময়ে আমার শুভ্রতাকে আপনাকে দিয়েছিলাম সেই খবর চাপা রাখতে আমার এখন পনেরো লাখ টাকা লাগবে। আমাকে টাকা দিয়ে দিন আমি একেবারে আপনাদের জীবন থেকে চলে যাব৷ আমি আর এইদেশে থাকার রিস্ক-ই নেব না। শুধু পনেরো লাখ টাকা চাই।”

নিহান ইমতিয়াজের শার্টের কলার ধরে চোয়াল শক্ত করে বলে, ” ওকে একদম আমার শুভ্রতা বলবি না। ও শুধু আমার, আগেও আমার ছিল এখনও আমার আর ভবিষ্যতেও আমার। ওর দিকে নজর দিলে চোখ তুলে নেব।”

” অন্যকারো বউয়ের দিকে নজর দেওয়ার ইচ্ছে আমার নেই৷ আমাকে টাকা দিয়ে দেন আমি চলে যাচ্ছি। সারাজীবনের জন্য আমি চলে যাব। যদি বেশি বুদ্ধিমান সাজার চেষ্টা করেন সংসার শেষ করে দেব আপনার। আমি এত ভালো মানুষ না যে নিজে খারাপ থেকে অন্যের ভালো চাইব।”

” তোমার কি মনে হয় আমি পনেরো লাখ টাকা নিয়ে বেড়াতে আসছি।”

” আমাকে আপাতত কিছু টাকা দেন কালকে সব টাকা দিলেই চলবে। আজকের টাকা হিসেব করে কেটে রেখে দিবেন। আমি ওতটাও খারাপ না। ”

নিহান রেগে চ’ উচ্চারণ করল। না পারছে কিছু বলতে আর না পারছে কিছু সহ্য করতে৷ ছোট খাটো একটা ব্যাপারে মানুষ খু*ন তো আর করতে পারবে না। ইমতিয়াজ নিহানের নম্বরটা নিয়ে সেখান থেকে চলে যায়। নিহান ইমতিয়াজের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে, নতুন কোন বিপদ আসছে না তো!
____

সফর শেষ করে সবাই গাড়িতে উঠে বসেছে। দুজন শিক্ষক বাসের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত শিক্ষার্থী গুণে গুণে দেখছে সবাই ঠিকঠাকমতো বাসে উঠেছে কি না। সবাই যখন জানালো প্রত্যেকটা স্টুডেন্ট বাসে উঠে বসেছে তখন সব শিক্ষক-শিক্ষিকাও নিজেদের সিটে বসেন। বাস চলতে শুরু করে। শিক্ষার্থীরা সবাই একসাথে জোরে চিৎকার দিয়ে ওঠে। তাদের আরও পরে ফেরার কথা ছিল কিন্তু প্রিন্সিপাল একটু অসুস্থতা বোধ করলে কেউ আর দেরি করতে চায় নি। বাস চলছে, সামনের সিটে প্রিন্সিপাল একা বসেছেন। ফাউজিয়া ফোনে গান ছেড়ে হেডফোনটা লাগিয়ে বাসের সিটে হেলান দিয়ে বসে। চোখ বন্ধ করে গানের প্রতিটা লাইন অনুভব করতে থাকে।

Lag ja gale………….
Ki fir yee………
Hasin raat……………
Ho na ho………
Shayed is janam main…….
Mulakaat ho na hoo……
Lag ja gale………….
Ki fir yee………
Hasin raat……………
Ho na ho………

হঠাৎ বাস ব্রেক কষতেই সামনের দিকে ঝুঁকে পড়ে সবাই। বাসের সামনে দিয়ে একটা বাচ্চা দৌঁড়ে আসায় ব্রেক কষতে হয়েছে। কী হয়েছে জানার জন্য সবাই আশেপাশে এবং সামনের দিকে দেখছে। বাস তখনও থেমে আছে। ফাউজিয়া সামনে থেকে চোখ সরিয়ে ডানপাশে তাকাতেই চোখের সাথে তার হৃৎস্পন্দনটাও যেন থেমে যায়। বাহিরে রাস্তার পাশে কেউ তার দিকে পূর্ণ চাহনিতে তাকিয়ে আছে। ফাউজিয়ার মধ্যেও আড়ষ্টভাব চেপে বসে। কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে বাহিরের পুরুষের দিকে তাকিয়ে আছে সে। হঠাৎ বুঝতে পারে বাস আবার চলতে শুরু করেছে। ফাউজিয়া সাথে সাথে বিদ্যুৎ গতিতে দাঁড়িয়ে যায়। ড্রাইভারকে গাড়ি থামাতে বলে সে। সিট থেকে নিজের ব্যাগটা নিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে আসে৷ ড্রাইভার গাড়ি থামিয়ে ফাউজিয়ার দিকে হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছে। ড্রাইভারের সাথে সাথে বাসের সকলে তার দিকেই তাকিয়ে আছে। পাশে থেকে একজন বলে ওঠে, ” কী হয়েছে ম্যাম?”
ফাউজিয়া কোন জবাব দিতে পারে না। সে সোজা প্রিন্সিপালের কাছে গিয়ে দাঁড়ায়।

” স্যার।”

প্রিন্সিপাল তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে ফাউজিয়ার দিকে তাকায়, ” কী হয়েছে?”

” স্যার আমি এখানে নেমে যাব।”

” মানে? কেন?”

” স্যার এখানে আমার ব্যক্তিগত কিছু কাজ আছে। আমার এখানেই নামতে হবে আর এক্ষুণি।”

” আগে তো কিছু বলেন নি?”

” স্যরি স্যার আমার মনে ছিল না। ভুলে গিয়েছিলাম আমি। আমি কি নেমে যাব?”

” একা এক মহিলা মানুষকে কীভাবে রেখে যাই বলুন তো?”

” স্যার শুক্রবার আর শনিবার তো ছুটি আমি রবিবারে ঠিক কলেজে চলে আসব। ”

ফাউজিয়া বাস থেকে নেমে বাহিরে চলে আসে। শাড়ির আঁচলের নীচের অংশে দ্বিতীয় ভাজ দিয়ে কাধের ওপর তুলে নেয়। ব্যাগ হাতে নিয়ে রাস্তার পাশে দাঁড়াতেই বাস ছেড়ে দেয়। রাস্তার ডানপাশে থাকা পুরুষটি এবার তার দিকে অগ্রসর হতে শুরু করেছে। ফাউজিয়াও সেদিকে এগুতে থাকে। দুটো পুরোনো মানুষ আজ সামনাসামনি, পুরোনো দু’জোড়া চোখ সামনে দাঁড়ানো একে অপরকে দেখছে। ফাউজিয়া দীর্ঘশ্বাস ফেলে, চোখ দুটো আজ তার ছলছল করছে, হৃৎস্পন্দন বেড়েছে। ব্যথাতুর দৃষ্টি
ফেলে বলে ওঠে, ” স্যার!”

#চলবে…..

#শুভ্ররাঙা_ভালোবাসা
#তানিয়া_মাহি(নীরু)
#পর্ব_৫৬

দুটো পুরোনো মানুষ আজ সামনাসামনি, পুরোনো দু’জোড়া চোখ সামনে দাঁড়ানো একে অপরকে দেখছে। ফাউজিয়া দীর্ঘশ্বাস ফেলে, চোখ দুটো আজ তার ছলছল করছে, হৃৎস্পন্দন বেড়েছে। ব্যথাতুর দৃষ্টি ফেলে বলে ওঠে, ” স্যার!”

সাহিল ফাউজিয়ার দিক থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে বলে,” আসুন আমার সাথে।”

” কোথায় যাবেন?”

” ভরসা করতে পারেন। নাকি আমাকে ভরসা করতেও ভুলে গেছেন?”

ফাউজিয়া কিছু বলে না। সাহিল হাটা শুরু করলে ফাউজিয়াও তার পিছু নেয়। কিছুক্ষণের মধ্যেই একটা বাড়ির মধ্যে প্রবেশ করে তারা দুজনে।

সাহিল আর ফাউজিয়া মুখোমুখি বসে আছে। সাহিলের মা একগ্লাস ঠাণ্ডা পানি নিয়ে ঘরে প্রবেশ করেন। পানির গ্লাসটা ফাউজিয়ার দিকে বারিয়ে দিলে ফাউজিয়া সেটা নেয়।
সাহিলের মা সাহিলকে উদ্দেশ্য করে বলে, ” তোরা কথা বল আমি আসছি।”
ফাউজিয়া মাথানিচু করে চুপচাপ বসে আছে। কিছুক্ষণ পরপর জোরে জোরে শ্বাস ফেলছে। ফাউজিয়াকে চুপ থাকতে দেখে সাহিল দ্বিধা কাটিয়ে বলে, ” আপনি হঠাৎ এখানে?”

” আসলে এখানেই সামনের পার্কটায় কলেজ থেকে শিক্ষাসফরে এসেছিল।”

” ওহ আচ্ছা।”

” নামলেন যে?”

” আপনাকে দেখে। ভুল করলাম?”

” আপনার হাজবেন্ড?”

ফাউজিয়া অসহায় চোখে উল্টো প্রশ্ন করে বসে, ” বিয়ে করেছেন?”

সাহিল সোজাসাপটা জবাব দেয়, ” একজন ফিরিয়ে দেওয়ার পর আর কাউকে ভালো লাগে নি। কারও কাছে নিজেকে সমর্পন করতে ইচ্ছেও করে নি। ”

হাফ ছেড়ে বাঁচে ফাউজিয়া। বুকের ওপর থেকে যেন ভারী একটা পাথর নেমে যায়। ফাউজিয়ার এই বিষয়টাও সাহিলের নজর এড়ায় না। ঘড়িতে সময় দেখে উঠে দাঁড়ায় সে। সাহিলকে দাঁড়াতে দেখে ফাউজিয়া উৎসুক চোখে তাকায়।

” কোথাও যাচ্ছেন?”

” হ্যাঁ আমার এখন বের হতে হবে।”

” কোথায়?”

” তখন রাস্তার পাশের বাড়িটায় ভিড় দেখেন নি? ওটা আমার চাচার বাসা। আমার চাচাতো বোন মারা গিয়েছে। আমার ওখানে থাকা খুব প্রয়োজন। আপনি মা’র কাছে থাকুন। বাসায় যাবেন কখন? আমার কি এগিয়ে দিয়ে আসতে হবে?”

” আপনি বাসায় ফিরলে কথা বলব।”

সাহিল আর কোন কথা না বলে সেখান থেকে বেরিয়ে যায়। ফাউজিয়া কোন একটা আশার আলো দেখতে পায়।
_____

মাহতিম তন্ময় তার মা এবং মেয়েসহ বাসার প্রয়োজনীয় সব জিনিসপত্র নিয়ে এসেছেন। গাড়ি থেকে জিনিসপত্র নামিয়ে বাসায় পৌঁছে দেওয়ার জন্য লোক রাখা হলেও বাসায় সব ঠিকঠাক করার জন্য মহিলা প্রয়োজন। মাহতিমের যেহেতু এদিকে তেমনকিছু পরিচিত নেই তাই তিনি অফিসের একজনকে বলেছেন ব্যবস্থা করে দিতে কিন্তু তেমন কাউকে পাওয়া যায়নি। তাই অফিসের সবাই সিদ্ধান্ত নেয় তারা নিজেরাই মাহতিমের বাসা গুছিয়ে দেবে যেহেতু উনার মায়েরও বয়স হয়েছে। মাহতিম নিজেই আপাতত একটা রুম ঠিক করছিল যেন এখানে অন্তত বিশ্রামটা নেওয়া যায়। কলিংবেলের আওয়াজ হতেই মাহতিমের মা মোহনা বেগম গিয়ে দরজা খুলে দেন। রাইমা, স্নিগ্ধাসহ অফিসের আরও দুজন বাঁধন আর মেহেদি এসে দরজায় দাঁড়িয়েছে। মোহনা বেগমের সাথে পরিচয় নেই বিধায় তাদের সম্পর্কে জানতে চাইলে রাইমা বলে ওঠে, ” আমরা স্যারের অফিস থেকে এসেছি। আমরা একই সাথে আছি ওখানে। স্যারের জন্য বাসা গোছানোর মানুষ পেলাম না তাই ভাবলাম আমরা নিজেরাই হাতে হাতে সাহায্য করি।”
মোহনা বেগম সবাইকে ভেতরে আসতে বললেন। তারা ভেতরে ঢুকতেই মাহতিম এগিয়ে আসে তাদের দিকে। বাহিরে অফিসের সবাইকে দেখে সামনে রাখা সোফাতেই বসতে বলে। বাঁধন বলে ওঠে, ” স্যার আমরা অলরেডি লেট। আজকে আমরা সবাই মিলে আপনাকে যতটুকু সাহায্য করতে পারি, করব। বাকিটা আগামীকালের মধ্যেই শেষ করব।”

মাহতিম অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে, ” তোমরা সাহায্য করবে মানে? আমি তো মানুষ ঠিক করে দিতে বলেছিলাম। ”

” স্যার কাউকে পাওয়া যায় নি তাই আমরাই চলে এসেছি। ”

মাহতিম কিছু বলতে যাবে তখনই রাইমা বলে ওঠে, ” স্যার আর কোন কথা না। আপনি আমাদের সাথে থেকে বুঝিয়ে দেন কোনটা কোন রুমে যাবে। আমরা সবাই মিলে করে নিতে পারব। ”

মাহতিমের সাথে সবাই কথা বলছে কিন্তু মোহনা বেগম খেয়াল করেন সেখানে শুধু স্নিগ্ধা চুপচাপ আছে আর মাঝে মাঝে মুচকি হাসছে ঘরের দিকে তাকিয়ে। তিনি স্নিগ্ধার চোখ অনুসরণ করে ঘরের দিকে তাকাতেই দেখেন সেখানে মাহতিমের মেয়ে আয়রা কিছুক্ষণ পরপর উঁকি দিচ্ছে। মোহনা বেগম আয়রা ডাকতেই সে ছুটে এসে উনার পাশে দাঁড়ায়। আয়রাকে কোলে নিয়ে স্নিগ্ধা আর রাইমাকে দেখিয়ে বলে, ” তুমি উনাদের চেনো? ওরা তোমার আন্টি হয়।”

আয়রা মোহনা বেগমের দিকে তাকিয়ে বলে, ” আন্টি হয়? আমার সাথে খেলবে?”

মোহনা বেগম হেসে বলে, ” তুমি খেলবে আন্টিদের সাথে? ”

আয়রা সম্মতিসূচক মাথা নাড়ায়। স্নিগ্ধা হাত বাড়িয়ে আয়রাকে ডাকলে আয়রা মোহনা বেগমের কোলে থেকে নেমে স্নিগ্ধার দিকে আসে। মোহনা বেগম বেশ অবাক হন আয়রাকে দেখে কারণ আয়রা খুব একটা মিশুক না।

সবাই কাজে হাত লাগিয়েছে। আয়রা ঘুমিয়ে গেলে স্নিগ্ধা আয়রাকে মোহনা বেগমের কাছে দিয়ে নিজেও কাজে লেগে পড়ে। রাইমার কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই রাইমা বলে, ” আয়রা খুব কিউট একটা বাচ্চা তাই না। তোর সাথে কী সুন্দর করে গল্প করছিল। স্যার তো মাঝে মাঝেই তোকে দেখছিল। আমার মনে হয় স্যার তোকে পছন্দ করে।”

স্নিগ্ধা চারপাশে একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে বলে, ” রাইমা এসব কথা তোর মুখে যদি আর শুনেছি! ”

রাইমা ভেঙচি কেটে বলে, ” তোর কি মনে হয় আমি তোকে বুঝি না? নিজে তো ডুবে ডুবে ঠিকই জল খাচ্ছিস। তুই চাস না স্যার ও তোকে পছন্দ করুক? বাচ্চা আছে তো কী হয়েছে, বউ তো আর নেই। ”

” উল্টাপাল্টা কথা বলবি না, কাজ কর।”

” দেখা যাবে কতদিন আর এভাবে থাকতে পারো।”

স্নিগ্ধা আর কিছু বলে না। রাইমা স্নিগ্ধার মুখের দিকে তাকিয়ে আবার কাজে মন দেয়।
_____

বাহির থেকে আসার পর নিহানকে বেশ এলোমেলো দেখাচ্ছে। বেলকনিতে গিয়ে এপাশ থেকে ওপাশে পায়চারি করছে। শুভ্রতা ফ্রেশ হয়ে নিজেও বেলকনিতে আসে। নিহান তখনও ইমতিয়াজের বিষয়টা নিয়ে চিন্তিত। শুভ্রতা গিয়ে একপাশে দাঁড়ায়। নিহান শুভ্রতাকে দেখে মুখে হাসি ফোটানোর চেষ্টা করে। শুভ্রতার পাশে এসে দাঁড়িয়ে বলে, ” মন ভালো হয়েছে আজ ঘুরে?”

” তুমি কি আমাকে কিছু বলতে চাও?”

শুভ্রতার পাল্টা প্রশ্নে কিছুটা ঘাবড়ে যায় নিহান। কিছু কথা যে বুকে চেপে আছে সেটা শুভ্রতা বুঝল কি করে? কিন্তু কথাগুলো শুভ্রতাকে জানানো ঠিক হবে কি না বুঝতে পারছে না নিহান। সবটা জানার পর শুভ্রতা তাকে ভুল বুঝবে না তো!

নিহান বেশ মলিনমুখে শুভতার দিকে তাকায়, ” আমাকে একটু জড়িয়ে ধরবি শুভ্রা? বুকের ভেতরটা কেমন যেন লাগছে।”

” জড়িয়ে ধরলে ভালো লাগবে?”

” হয়তো একটু শান্তি মিলবে। ”

শুভ্রতা মুচকি হেসে নিহানের বুকে মাথা রাখে। দুই হাত দিয়ে বেশ শক্তা করে বুকের সাথে মিশিয়ে নেয় তাকে। হঠাৎ নিহানের ফোন বেজে উঠতে পকেট থেকে ফোনটা বের করে সে। অচেনা নম্বর দেখে খটকা লাগে ইমতিয়াজ কল করেনি তো! নিহান কল রিসিভ করছে না দেখে শুভ্রতা ছো মেরে নিহানের হাত থেকে ফোনটা নিয়ে নিজেই রিসিভ করে। ওপাশ থেকে মোটা ভারী গলায় ইমতিয়াজ বলে ওঠে, ” কী ব্যাপার নিহান ভাই, বউ নিয়ে ব্যস্ত নাকি? আমার টাকার কথা কি ভুলে গেলেন নাকি? টাকা না পাঠালে সংসার যে ভেঙে যাবে তখন কাকে নিয়ে ব্যস্ত থাকবেন?”

শুভ্রতা কল কেটে দিয়ে ফোনটা সাইলেন্ট করে আবার নিহানের পকেটে রেখে দেয়। নিহান শুভ্রতার কর্মকান্ডে কিছু বুঝে উঠতে পারছে না। উৎসুকভাবে তাকিয়ে আছে। প্রিয়তা জিজ্ঞেস করে, ” কী হয়েছে? এভাবে তাকিয়ে আছো কেন?”

” ক কে কল করেছিল? আমার ফোন তুই এভাবে কেড়ে নিলি কেন?”

” কারণ তোমার সাহস নেই ওই লোকের সাথে আমার সামনে কথা বলার?”

শুভ্রতার কথায় আরেকবার চমকে যায় নিহান। শুভ্রতা রহস্যময় হাসি দিয়ে বলে, ” তোমার কি মনে হয় আমি ধোঁয়াশার মধ্যে থেকেই তোমাকে বিয়ে করেছি? এত বোকা আমি নই। একবার সংসার ভাঙার পর মেয়েরা আর বোকা থাকে না তাদের চতুর হতে হয়। যাকে বিয়ে করব তার ব্যাপারে সবটা না জেনে কীভাবে বিয়ে করি বলো? ”

” সবটা জানিস মানে? ”

” সবটা মানে সবটা। বাবা আমাকে সব বলেছে। তুমি কি না ওই কাপুরুষটাকে ভয় পাচ্ছিলে? ”

” আমি কিছুই বুঝতে পারছি না শুভ্রা। ক্লিয়ারলি বলবি?”

” তুমি যখন ইমতিয়াজের সাথে কথা বলছিলে তার আগে আমি তোমাকে কল দিয়েছিলাম ভুলে গেছ? রাস্তায় ওঠার সময় আমাকে ফোন হোল্ড করতে বলে নিজেই ভুলে গেলে। আমি তোমার আর ইমতিয়াজের সব কথা শুনেছি। তুমি তাকে টাকা দিয়েছিলে।”

নিহান এবার শুভ্রতার দুই হাত নিজের দুই হাতের মাঝে নিয়ে বলে, ” বিশ্বাস কর শুভ্রা আমি তোর আগের সংসার ভাঙতে টাকা দেই নি। তোর বাবা আর আমি টাকা জমিয়ে বিশ লাখ টাকা ওকে দিয়েছিলাম ব্যবসা করতে। শুধু তুই যেন ভালো থাকিস, ভালোবাসার মানুষকে যে সবসময় স্বার্থপরের মতো নিজের কাছেই রাখতে হবে এমন কোন ব্যাপার না। ভালোবাসার মানুষকে ভালো থাকতে দেখাই তো ভালোবাসা। ”

” আমি সব জানি, ছয় বছর আগেই এসব জেনেছি আমি। ”

” আমাকে বলিস নি তো?”

” নিজের পছন্দকে আর ছোট করতে ইচ্ছে হয় নি আমার। ”

” যখন তুই নিজে জব করছিলি সামান্য টাকায় তখন ইমতিয়াজ একদিন তোর বাবাকে কল করে টাকা চায়। বলে সে নাকি নতুন ব্যবসা করবে। অনেক কথা বলে সে কাকাকে। কাকার হাতে তখন এত টাকা ছিল না। আর তুই তো জানিস কাকা আমার সাথে অনেক আগে থেকেই সব কথা শেয়ার করত। ইমতিয়াজের কথাও তিনি আমার সাথে শেয়ার করেন। আমি নিজে পনেরো লাখ আর কাকা পাঁচ লাখ টাকা দিয়ে ইমতিয়াজকে সাহায্য করি৷ তুই জানলে নিজেকে ছোট মনে করবি, টাকা নিবি না তাই এই কথা তোকে জানাতে নিষেধ করি। প্রিয় মানুষের কষ্ট সহ্য করা যায় না আমিও সহ্য করতে পারি নি।”

” তারপর সেই টাকা দিয়ে সে বিভিন্নভাবে উড়াতে থাকে। সেই টাকার মাধ্যমেই সৎমায়ের ভাইয়ের মেয়েকে প্রেমিকা বানিয়ে নেয়৷ বিয়ের কথাও হয়, যখন সবাই জানতে পারে ইমতিয়াজের টাকা শেষ তখনই বিয়েটা ভেঙে যায়। ”
শুভ্রতা কিছুক্ষণ থেমে নিহানকে বলে, ” ফোন বের করো, দেখ হয়তো তোমাকে কল করেই যাচ্ছে। ফোন রিসিভ করে বলো কাল তুমি তার সাথে দেখা করে টাকা দিবে। কাল শেষবারের মতো আমি তার সাথে দেখা করব। ”

” আমি তোদের দুজনকে সামনাসামনি সহ্য করতে পারব না।”

শুভ্রতা নিহানের গালে হাত দিয়ে বলে, ” আমি তোমাকে ভালোবাসি, এটাই যথেষ্ট নয় কি আমাকে বিশ্বাস করতে?”

নিহান কিছু বলতে পারে না। শুভ্রতা আবার বলে, ” আমি আমার সংসারে আর কোন আঘাত আসতে দেব না। কিছুতেই দেব না।”

নিহান নির্জীব চোখে শুভ্রতার দিকে তাকিয়ে বলে, ” আমার কিছুতেই এই সময়টা বিশ্বাস হচ্ছে না শুভ্রা।”

” জীবনে খারাপ সময় আসবে। প্লিজ চেষ্টা করবে সবটা আমাকে জানাতে। আমাদের মাঝে কোন অন্ধকার রাখবে না। কোন কথা অন্যকারো থেকে শুনতে খুব খারাপ লাগে। আমি জানি আমার মানুষটা কেমন। এই মানুষটাকে অবিশ্বাস করা যায় না। ”

” শুভ্রা!”

শুভ্রতা মুচকি হেসে বলে, ” আপনার কি মনে হয় আমি অন্য কাউকে বিশ্বাস করে আপনাকে অবিশ্বাস করব? মোটেও না সাহেব। আপনার সব খারাপ সময়ে আপনি আমাকে পাশে পাবেন, পাবেনই৷ ”

” কখনো আমাকে ভুল বুঝবি না কথা দে?”

” আমি সত্য-মিথ্যা যাচাই করতে পারি, তাই কথা দিতে পারছি না। অন্যা*য় না করলে সবসময় আমি পাশে আছি।”

” এটুকুই যথেষ্ট। শুধু ভালো করে যাচাই না করে ভুল না বুঝলেই হলো।”

শুভ্রতা নিজেই এবার নিহানকে জড়িয়ে ধরে। কেমন একটা প্রশান্তি কাজ করছে নিহানের মাঝে। মনের অশান্তি প্রিয় মানুষগুলোই শেষ করে দিতে পারে।
নেহা এসে দরজায় নক করতেই তাড়াতাড়ি করে নিহানকে ছেড়ে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে যায় শুভ্রতা। নিহান পাশে থেকে বলে, ” বারান্দায় আছি, এখানে আয়।”

নেহা দরজা ধাক্কা দিয়ে খুলে হেটে সোজা বারান্দার দরজায় এসে দাঁড়ায়। দুজনকে পাশাপাশি দেখে বলে, ” তোমরা দুজন কি প্রেম করছিলে?”

নিহান ধমকের সুরে বলে, ” বোন হোস তুই আমার।”

নেহা মুখ বেজার করে বলে, ” আমি কখন বললাম তুমি আমার ভাই হও না? কখনো বলতে শুনেছ?”

নিহান কিছু বলতে যাবে তখনই শুভ্রতা দুজনকে থামিয়ে দেয়। নেহাকে বলে, ” কী হয়েছে? ডাকছিস কেন সেটা বল।”

” আম্মু তোমাকে ডাকছিল।”

শুভ্রতা নিহানের দিকে ফিরে বলে, ” তুমি তাহলে ফ্রেশ হয়ে নাও। আমি যাই দেখি বড়আম্মু কী বলে!”

” আচ্ছা।”

শুভ্রতা নেহার সাথে বারান্দা থেকে বেরিয়ে যায়। নিহানও তাদের পিছন পিছন রুমে আসে। শার্টের বোতাম খুলতে খুলতে বলে, ” সাবধানে নিয়ে যাস আমার বউকে।”

নেহা পিছনে নিহানের দিকে তাকিয়ে বলে, ” হ্যাঁ তোমার বউ তো আমার কিছু হয় না। ”
_____

সাহিলের বাড়ি ফিরতে ফিরতে রাত দশটা। নয়টা পনেরোতে অরুকে কবরস্থ করা হয়। সাহিলের মা ফাউজিয়াকে বাড়িতে নিয়েই কিছুক্ষণের জন্য অরুকে দেখতে গিয়েছিলেন। অরুকে নিয়ে যাওয়ার পর তারা দুজন বাসায় ফিরে আসে। বিছানায় বসে দুজন কথা বলার সময় সাহিল রুমে প্রবেশ করেই ফাউজিয়াকে বলে, আপনি তৈরি হন, বাসায় পৌঁছে দিয়ে আসছি।”

সাহিলের কথা শুনে সোজা হয়ে বসে সাহিলের মা। ছেলেকে উদ্দেশ্য করে বলেন, ” এতরাতে কেন ওকে রাখতে যেতে হবে? কাল সকালে পৌঁছে দিয়ে আসলেই হবে। এতরাতে মেয়েটাকে নিয়ে বের হতে হবে না, আমি ওর মায়ের সাথে কথা বলেছি। ”

সাহিল পাঞ্জাবির হাতা গোছাতে গোছাতে বলে, ” উনার নিশ্চয়ই এখানে থাকতে ভালো লাগবে না। আমার বাইকটা নিয়ে বের হই, ঘণ্টাখানেকের মাঝে বাসায় পৌঁছে দেওয়া যাবে। এখন রাস্তা অনেকটা ফাঁ…।”

” আমি এখন যাব না।” বলে ফাউজিয়া।

” কেন? আপনার এখানে ভালো লাগছে?”

” হ্যাঁ লাগছে।”

সাহিল মায়ের রুম থেকে বেরিয়ে যায়। সোজা নিজের রুমে চলে যায় সে। পাঞ্জাবি পাল্টে গোসলটাও শেষ করে। রুমে এসেই শুনতে পায় দরজা নক করার শব্দ। মাথা মুছতে মুছতে বলে,” মা আমি খাব না, ক্ষিধে নেই। তোমরা খেয়ে নাও, আমি ঘুমোবো।”

দরজার ওপাশ থেকে তবুও দরজা নক করে যাচ্ছে। সাহিল তোয়ালেটা রেখে একটা টিশার্ট পরে নেয়। দরজা খুলতেই দেখে খাবারে প্লেট হাতে নিয়ে ফাউজিয়া দাঁড়িয়ে আছে। সাহিল দরজার সামনেই দাঁড়িয়ে বলে, ” আপনাকে খাবার আনতে বলেছে কে? নিজের রুমে যান অনেক রাত হয়েছে।”

” সরুন, খাবারটা রাখতে দিন।”

সাহিল সরে দাঁড়ালে ফাউজিয়া খাবারের প্লেট রেখে বলে, ” খেয়ে নিন।”

” আপনি নিজের রুমে যান, আমি খেয়ে নেব।”

” আপনি বলেছিলেন ফিরে এসে আমার সাথে কথা বলবেন।”

” ফিরে এসে রাতেই কথা বলব এটা বলিনি। আর কিই বা কথা বলব? আমাদের কী আর কোন কথা আছে?”

” থাকতে পারে না?”

” বোধ হয় না।”

” কোনভাবে আপনিও অরুকে…”

” কী?”

” না, কিছু না। ”

” কথা শেষ করুন।”

” কিছু না।”

” ঠিক আছে রুমে যান। মা ঘুমিয়েছে?”

” হ্যাঁ, উনি তো ঘুমের ওষুধ খেয়েছেন।”

” তাহলে এবার রুম থেকে যান। এটা শহর না, গ্রামে এতরাতে একটা রুমে থাকা খারাপ দেখায়।”

” ঠিক আছে।”

ফাউজিয়া রুম থেকে বেরিয়ে যাবে এমন সময় সাহিল বলে ওঠে, ” মনের মতো কাউকে পান নি, যাকে বিয়ে করা যায়?”

ফাউজিয়া পিছনে না ফিরেই বলে ওঠে, ” আমারও আপনার মতোই অবস্থা, আপনার পর আর কাউকে ভালো লাগে নি। নিজের জন্য আর কাউকে সঠিক মনে হয় নি।”

” ভালোবাসলে কাউকে ফিরিয়ে দেওয়া যায়?”

” ওই যে কথায় আছে না, চোর পালালে বুদ্ধি বাড়ে? আমারও হয়েছে এমন। আপনি ছেড়ে আসার পরই আপনার প্রতি আমার…”

ফাউজিয়া কথা শেষ না করেই থেমে যায়। সাহিল পুরো কথাটা শুনতে আনমনেই বলে ওঠে, ” কী?”

ফাউজিয়া এবার সাহিলের দিকে ফিরে তাকায়। চোখ দুটো টলমল করছে। নিম্নস্বরে বলে, ” ভালোবাসি আপনাকে।”

সাহিলের মুখে হাসি দেখে অজানা ভয় হয় ফাউজিয়ার। তবে কি তার এই ভালোবাসা শেষ সময় সর্ব*নাশ ডেকে আনবে। সাহিল ফাউজিয়ার কাছে এগিয়ে এসে বলে, ” এবার যদি আমি প্রতিশোধ-পরায়ন হয়ে আপনাকে ফিরিয়ে দিই?”

#চলবে………..