#শেখবাড়ির_বড়ছেলে
#এ_এইচ_স্পর্শ
৩
রিয়ার বাড়ির ধাতব গেটটা বিকট শব্দ করে বন্ধ হয়ে যাওয়ার পরও আমি বহুক্ষণ সেখানে দাঁড়িয়ে রইলাম। আমার মনে হচ্ছিল, ওটা শুধু একটা গেট নয়, আমার সমগ্র অতীত, বর্তমান আর ভবিষ্যতের ওপর কেউ সশব্দে দরজাটা বন্ধ করে দিল। আমার চারপাশের পৃথিবীটা আমার পায়ের নিচে ঘুরছিল না, বরং স্থির হয়ে গিয়েছিল। ভোরের সূর্যটা তখন পুরোপুরি আকাশে উঠে এসেছে। তার সোনালি আলোয় চারপাশ ঝলমল করছে, কিন্তু আমার চোখের সামনে কেবল নিকষ অন্ধকার। মানুষের কোলাহল, গাড়ির হর্ন, জীবনের স্বাভাবিক ছন্দ—সবকিছু আমার কানে ঢুকছিল, কিন্তু মস্তিষ্ক কোনো কিছুর অর্থ তৈরি করতে পারছিল না। আমি যেন এক কাঁচের দেয়ালের ওপারে দাঁড়িয়েছিলাম, যেখানে বাইরের পৃথিবীর সাথে আমার সমস্ত সংযোগ বিচ্ছিন্ন।
রিয়ার বলা শেষ কথাগুলো আমার কানে অবিরাম প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল— “অভাব যখন দরজা দিয়ে আসে, ভালোবাসা তখন জানালা দিয়ে পালায়, রাফিদ। আবেগ দিয়ে জীবন চলে না।”
ভালোবাসা! কী অদ্ভুত ঠুনকো একটা শব্দ! এই ভালোবাসার জন্যই তো আমি আমার পরিবার, আমার সম্মান, আমার চাকরি—সবকিছুকে বাজি রেখেছিলাম। আর সেই ভালোবাসাই আজ আমাকে পথের ভিখারি বানিয়ে উপহাসের হাসি হাসছে। আমার ভাই রাহাত আমাকে ‘ফকিন্নি’ বলেছিল। তখন আমার আত্মসম্মানে লেগেছিল, প্রচণ্ড ক্রোধ হয়েছিল। কিন্তু রিয়া যখন তার মিষ্টি গলায়, ভালোবাসার মোড়কে মুড়ে আমাকে আমার চাল-চুলোহীনতার কথা মনে করিয়ে দিল, তখন ক্রোধ নয়, আমার ভেতরটা ভেঙে গুঁড়িয়ে গেল। রাহাতের আঘাত ছিল বাইরের, কিন্তু রিয়ার আঘাতটা ছিল আমার আত্মার গভীরে।
আকাশের দিকে তাকালাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই উজ্জ্বল আকাশটার মুখ কালো মেঘের চাদরে ঢেকে গেল। বাতাসটা কেমন যেন ভারী হয়ে উঠল। একটু আগের সোনালি সকালটা মুহূর্তেই এক বিষণ্ণ দুপুরে পরিণত হলো। দু-এক ফোঁটা বৃষ্টি আমার তপ্ত গালে এসে পড়ল। আমি প্রথমে বুঝতেই পারলাম না, এটা কি আকাশের কান্না নাকি আমার নিজের চোখ থেকে গড়িয়ে পড়া জল। কিন্তু আমার চোখ তো কবেই শুকিয়ে গেছে।
কিছুক্ষণের মধ্যেই ঝমঝম করে বৃষ্টি নামল। এমন বৃষ্টি, যেন আকাশ তার সমস্ত অভিমান আর কষ্ট আজ একসাথে ঝরিয়ে দেবে। রাস্তার মানুষগুলো মুহূর্তেই ছত্রভঙ্গ হয়ে গেল। সবাই দৌড়ে যে যার মতো আশ্রয়ের খোঁজে ছুটছে। শুধু আমি দাঁড়িয়ে রইলাম। বৃষ্টির প্রতিটি ফোঁটা আমার শরীরে ছুরির ফলার মতো বিঁধছিল। আমার শার্ট, প্যান্ট ভিজে জবজবে হয়ে গেল। শরীর বেয়ে জলের ধারা নামছে, কিন্তু আমার ভেতরের আগুন নেভানোর ক্ষমতা এই বৃষ্টির নেই।
আমি হাঁটতে শুরু করলাম। কোনো গন্তব্য ছাড়াই। ভেজা রাস্তায় আমার ছায়া পড়ছে না, কারণ আমার নিজের ছায়াও হয়তো এই দুর্ভাগাকে ত্যাগ করে চলে গেছে। শহরের অলিগলিতে ঘুরতে ঘুরতে কখন যে দিন গড়িয়ে সন্ধ্যা নামল, আর সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত হলো, আমার কোনো হুঁশ ছিল না। বৃষ্টির তেজ কিছুটা কমেছে, কিন্তু থামেনি। টিপটিপ করে ঝরেই চলেছে। আমার শরীর ঠাণ্ডায় কাঁপছিল, কিন্তু তার চেয়েও বেশি কাঁপছিল আমার ভেতরটা—একাকিত্বের শীতে।
রাত গভীর হলো। রাস্তাঘাট প্রায় জনশূন্য। চারপাশ নিস্তব্ধ, শুধু দূর থেকে কয়েকটা কুকুরের ঘেউঘেউ শব্দ ভেসে আসছে আমার কানে। ওরা কি আমার মতোই একা? আমার মতোই কি ওদেরও কোনো আশ্রয় নেই? পেটের ভেতর ক্ষুধার আগুন জ্বলছে, কিন্তু তার চেয়েও বড় প্রয়োজন এখন একটু মাথা গোঁজার ঠাঁই। এই ঠাণ্ডায়, এই ভেজা কাপড়ে আর এক মুহূর্তও রাস্তায় থাকা সম্ভব নয়।
পকেট থেকে মোবাইলটা বের করলাম। ভাগ্যিস প্লাস্টিকের প্যাকেটে রাখায় ওটা বৃষ্টির হাত থেকে বেঁচে গেছে। ফ্ল্যাশলাইটটা জ্বালিয়ে আমি এই অন্ধকার রাতে একটু আশ্রয়ের জন্য চারপাশ দেখতে লাগলাম। হাঁটতে হাঁটতে একটু দূরে যেতেই দেখলাম, আমার মতোই আরও কয়েকজন বৃষ্টিতে ভেজা মানুষ একটা বন্ধ দোকানের চালার নিচে জড়ো হওয়ার চেষ্টা করছে। ওরা রাস্তা থেকে তড়িঘড়ি করে উঠে একে অপরের সাথে জায়গা ভাগাভাগি করে নিচ্ছে। ওদের চোখেমুখেও আমার মতোই একরাশ অসহায়ত্ব আর অনিশ্চয়তা। দৃশ্যটা দেখে আমার বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠল। এই বিশাল শহরে ওরাও আমার মতোই বড্ড একা। ওদেরও কেউ নেই। শেখ বাড়ির বড় ছেলে আজ রাস্তার আর পাঁচটা গৃহহীন মানুষের একজন। নিয়তির কী অদ্ভুত পরিহাস!
কয়েকজন এদিক-ওদিক খুঁজে কিছু দোকানের ছাউনিতে আশ্রয় পেলো। আমিও মরিয়া হয়ে একটা মাথা গোঁজার জায়গা খুঁজতে লাগলাম। অবশেষে, একটা পুরোনো মার্কেটের বারান্দায় একটু শুকনো জায়গা পেয়ে গেলাম। জায়গাটা আবর্জনায় ভরা, স্যাঁতসেঁতে একটা গন্ধ নাকে আসছে। কিন্তু এই মুহূর্তে এটাই আমার কাছে রাজপ্রাসাদের চেয়ে কম কিছু নয়। আমি দেয়াল ঘেঁষে শরীরটাকে এলিয়ে দিলাম। ভেজা কাপড়ের ঠাণ্ডাটা সরাসরি কংক্রিটের মেঝে থেকে আমার শরীরে ছড়িয়ে পড়ছিল।
আমার ঘুম আসছিল না। আসার কথাও নয়। নরম বিছানা, মাথার নিচে দুটো বালিশ ছাড়া আমার কোনোদিন ঘুমোনোর অভ্যাসই ছিল না। আর আজ? বালিশ তো দূরের কথা, মাথার নিচে রাখার মতো একটা শুকনো ইটও নেই। শক্ত, ঠাণ্ডা মেঝেতে পিঠটা যেন গেঁথে যাচ্ছিল। মনে মনে নিজেকে বললাম, ‘রাফিদ, এটাই তোর নতুন জীবন। অভ্যাস করতে হবে। এখন থেকে এটাই তোর বাস্তবতা।’
আমি চোখ বুজেও ঘুমাতে পারছিলাম না। চোখের সামনে ভাসছিল মায়ের কঠিন মুখ, রাহাতের বিশ্বাসঘাতকতা আর রিয়ার সেই তাচ্ছিল্যের হাসি। সমস্ত ঘটনাগুলো সিনেমার রিলের মতো আমার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল। আমি রাত জেগে বৃষ্টি পড়া দেখতে লাগলাম। ঝুম বৃষ্টি আবার শুরু হলো। মনে হচ্ছিল, আকাশটার মনেও আজ ভীষণ কষ্ট, তাই সে তার সমস্ত চোখের জল এভাবে বিসর্জন দিয়ে নিজেকে হালকা করছে। কিন্তু আমার কষ্টগুলো? সেগুলো পাথরের মতো জমে আমার বুকের ভেতর বসে আছে। আমি কাঁদতে পারছি না। আমার সব কান্না যেন শুকিয়ে বরফ হয়ে গেছে।
ওদিকে, সেই ধাতব গেটের ওপারে তখন চলছিল অন্য এক নাটক।
রিয়া দ্রুত পায়ে বাড়ির ভেতরে ঢুকেই তার মাকে ড্রয়িংরুমে দেখতে পেল। ওর মা সোফায় বসে পত্রিকা পড়ছিলেন। রিয়াকে ওই অবস্থায় দেখে তিনি চমকে উঠলেন। রিয়া আর এক মুহূর্তও অপেক্ষা করল না। ছুটে গিয়ে মাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে ফেলল। তার কান্নার দমকে পুরো শরীরটা থরথর করে কাঁপছিল।
ওর মা, মিসেস আফরিন, মেয়ের মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে উদ্বিগ্ন গলায় বললেন, “কী হয়েছে, মা? তুই কাঁদছিস কেন? আর রাফিদ কোথায়? তোরা না আজ একসাথে…”
রিয়া কান্নারত অবস্থাতেই মুখ তুলে বলল, “মা, আমি ভুল করেছি! আমি অনেক বড় ভুল করে ফেলেছি। আমি তোমাদের অবাধ্য হয়ে ওকে বিয়ে করে ঠকেছি, মা। আমি ঠকে গেছি।”
মিসেস আফরিন মেয়ের কথা শুনে আরও অবাক হলেন। তিনি রিয়াকে সোফায় বসিয়ে এক গ্লাস জল এগিয়ে দিলেন। রিয়া ঢকঢক করে জলটা খেয়ে নিয়ে আবার বলতে শুরু করল, “আজ সকালে রাফিদের মা সালিশ বসিয়েছিল। সেখানে সবার সামনে আমাদের অপমান করে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে। রাফিদের এখন কিচ্ছু নেই। চাকরি নেই, থাকার জায়গা নেই, কিচ্ছু না।”
কথাগুলো বলতে বলতে রিয়ার গলা আবার ধরে এলো। সে শাড়ির আঁচলে চোখ মুছে বলল, “আমি ওকে ছেড়ে চলে এসেছি, মা। আমি আর ওর সাথে থাকতে পারব না। আমি আবার নতুন করে সব শুরু করতে চাই। তুমি বাবাকে একটু বুঝিয়ে বোলো, মা। বাবা যেন আমাকে ক্ষমা করে দেয়। আমি আর কোনোদিন তোমাদের কথার অবাধ্য হব না।”
মেয়ের মুখে সবটা শুনে মিসেস আফরিনের মুখের উদ্বেগ মুহূর্তেই মিলিয়ে গিয়ে এক ধরনের স্বস্তি ফুটে উঠল। তিনি রিয়াকে নিজের বুকের কাছে টেনে নিয়ে বললেন, “তুই একদম ঠিক কাজ করেছিস, মা। একদম ঠিক করেছিস। ওই ফকিন্নিটাকে ছেড়ে এসে তুই তোর জীবন বাঁচিয়েছিস।”
‘ফকিন্নি’—যে শব্দটা রাফিদকে তার ভাই বলেছিল, সেই একই শব্দ রিয়ার মা-ও উচ্চারণ করলেন অবলীলায়।
মিসেস আফরিন মেয়ের চুলে বিলি কেটে দিতে দিতে বললেন, “যে ছেলের নিজের পায়ে দাঁড়ানোর ক্ষমতা নেই, যার পরিবার তাকে রাস্তায় ছুড়ে ফেলে দেয়, তার সাথে জীবন কাটানোর স্বপ্ন দেখাটাই তো বোকামি। আবেগ দিয়ে সংসার চলে না। আমি তোকে আগেই বলেছিলাম। যাক, যা হওয়ার হয়ে গেছে। এখন আর এসব নিয়ে এক ফোঁটাও চিন্তা করবি না। তোর বাবার ব্যাপারটা আমি সামলে নেব। তুই শুধু নিজের দিকে খেয়াল রাখ। কয়েকদিনেই সব ঠিক হয়ে যাবে।”
মায়ের কথায় রিয়া যেন নতুন করে শক্তি পেল। তার চোখের জল শুকিয়ে গেল। তার মনে হলো, সে একটা দুঃস্বপ্ন থেকে জেগে উঠেছে। রাফিদের জন্য তার মনে যেটুকু মায়া বা অপরাধবোধ ছিল, মায়ের কথায় সেটাও ধুয়ে মুছে গেল। সে এখন শুধু নিজের ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাববে, যেখানে রাফিদের কোনো অস্তিত্ব থাকবে না।
আর আমি, রাফিদ, সেই মার্কেটের ঠাণ্ডা বারান্দায় শুয়ে বৃষ্টির শব্দ শুনছিলাম। আমার কানে তখন মায়ের কথা, ভাইয়ের কথা বা রিয়ার কোনো কথাই বাজছিল না। আমার ভেতরটা এক অদ্ভুত শূন্যতায় ভরে গিয়েছিল। আমি আমার ভেজা হাতের দিকে তাকালাম। যে হাতটা একদিন রিয়ার হাত ধরে বাঁচার স্বপ্ন দেখত, সেই হাত আজ শূন্য।
আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। এই শহরের আকাশ আজ আমার দুঃখে কাঁদছে, কিন্তু এই শহরের কোনো মানুষ আমার পাশে নেই। শেখ বাড়ির বড় ছেলে আজ পরিচয়হীন, আশ্রয়হীন। আমার পুরোনো আমি-টা আজ এই বৃষ্টির জলে পুরোপুরি ধুয়ে মুছে গেছে।
আমার চোখের সামনে একটা ভেজা কুকুর এসে দাঁড়াল। তার করুণ চোখ দুটো আমার দিকে স্থির। হয়তো সেও আমার মধ্যে নিজের প্রতিচ্ছবি খুঁজছে। আমি জানি না, কালকের সকালটা আমার জন্য কী নিয়ে আসবে। কিন্তু একটা জিনিস আমি বুঝতে পারছিলাম—আমার ভেতর জন্ম নিচ্ছিল নতুন এক মানুষ। যে ভালোবাসতে জানে না, বিশ্বাস করতে ভয় পায়। যে জানে, এই পৃথিবীতে টিকে থাকতে হলে আবেগের কোনো দাম নেই, আছে শুধু টিকে থাকার লড়াই।
চলবে…
ভুল ত্রুটি মাফ করবেন।