#শেখবাড়ির_বড়ছেলে
এ এইচ স্পর্শ
৮
রাফিদের শেষ কথাটা রিয়ার কানে যেন গলানো সিসার মতো প্রবেশ করল। ‘নির্লজ্জ’, ‘বেহায়া’, ‘সুযোগসন্ধানী’—এই শব্দগুলো তার চারপাশে প্রতিধ্বনিত হতে থাকল। যে রাফিদ একদিন তার জন্য পুরো পৃথিবীর সাথে লড়তে পারত, আজ তার চোখেই সে জগতের সবচেয়ে ঘৃণ্য প্রাণী। অপমান আর লজ্জায় রিয়ার শরীর কাঁপছিল। তার মনে হচ্ছিল, এই শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ঘরটার বরফশীতল হাওয়াও তার ভেতরের জ্বলন্ত আগুনকে নেভাতে পারছে না। সে আর এক মুহূর্তও দাঁড়াতে পারল না। প্রায় টলতে টলতে, কোনো কথা না বলে সে ঘর থেকে বেরিয়ে এলো। কাঁচের দরজা ঠেলে বাইরে আসার সময় তার মনে হলো, সে যেন এক ঝলমলে জগৎ থেকে নিকষ কালো অন্ধকারে নিক্ষিপ্ত হলো।
অফিসের করিডোর দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় তার মনে হচ্ছিল, প্রত্যেকটা মানুষ তার দিকে তাকিয়ে বিদ্রূপের হাসি হাসছে। তার সুন্দর মুখ, তার আভিজাত্য—সবকিছুই যেন রাফিদের ওই কয়েকটি কথায় ধুলোয় মিশে গেছে। মতিঝিলের ব্যস্ত রাস্তায় নেমে তার মাথাটা ফাঁকা হয়ে গেল। কোথায় যাবে, কী করবে, কিচ্ছু মাথায় আসছিল না। একদিকে এক সন্ত্রাসীর সাথে অবশ্যম্ভাবী বিয়ে, অন্যদিকে রাফিদের এই চরম প্রত্যাখ্যান—তার সামনে যেন সব পথ বন্ধ হয়ে গেছে।
অফিস থেকে বেরিয়ে গাড়িতে বসার পরও রাফিদের মাথার ভেতরটা ঝিমঝিম করছিল। রিয়ার চলে যাওয়ার পর চেয়ারে বসে সে দীর্ঘক্ষণ চোখ বন্ধ করে ছিল। প্রতিশোধ কি সত্যিই এতটা মধুর? রিয়ার অপমানিত, বিধ্বস্ত মুখটা বারবার তার চোখের সামনে ভেসে উঠছিল। যে মুখটা দেখে একসময় তার পুরো পৃথিবী রঙিন হয়ে যেত, আজ সেই মুখটা ফ্যাকাসে করে দেওয়ার পর তার ভেতরটা কেন এমন শূন্য লাগছে? এই জয় যেন এক তিক্ত পরাজয়ের চেয়েও বেশি যন্ত্রণার।
ড্রাইভার গাড়ি চালাতে শুরু করলে রাফিদ জানালার বাইরে তাকিয়ে ছিল। নিয়ন আলোয় ঝলমল করা শহরটাকে তার কাছে এক বিশাল চিড়িয়াখানা মনে হচ্ছিল, যেখানে সবাই নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য প্রতিনিয়ত লড়াই করে চলেছে। সে নিজেও তো এই লড়াইয়েরই একজন সৈনিক।
গাড়িটা যখন তার নতুন ফ্ল্যাটের দিকে যাচ্ছিল, তখন শহরের এক অপেক্ষাকৃত পুরোনো, কম আলোকিত এলাকা দিয়ে পথটা সংক্ষিপ্ত করছিল ড্রাইভার। রাস্তার ধারে টিমটিম করে জ্বলা বাতির নিচে কিছু ছিন্নমূল মানুষ জটলা পাকাচ্ছিল। রাফিদ উদাস চোখে সেদিকেই তাকিয়ে ছিল। হঠাৎ তার চোখ দুটো ফুটপাতের ধারে বসে থাকা এক महिलेকে দেখে স্থির হয়ে গেল। পরনে একটা মলিন, ভাঁজ পড়া শাড়ি। চুলগুলো অবিন্যস্ত, মুখে গভীর ক্লান্তির ছাপ। কিন্তু অন্ধকারেও ওই মুখের আদলটা, বসার ভঙ্গিটা বড় বেশি চেনা চেনা লাগল। রাফিদের বুকের ভেতরটা ধক করে উঠল। হতে পারে না!
সে নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিল না। মস্তিষ্ক বলছিল, এটা তার মনের ভুল। কিন্তু তার ভেতরটা চিৎকার করে বলছিল, সে ভুল দেখছে না।
“গাড়ি থামাও!”
রাফিদের আকস্মিক চিৎকারে ড্রাইভার সজোরে ব্রেক কষল। “স্যার, কিছু লাগবে?”
রাফিদ কোনো উত্তর না দিয়ে প্রায় ছিটকে গাড়ি থেকে নামল। তার পা দুটো মনে হচ্ছে আটকে গেলো, কিন্তু সে দ্রুত পায়ে ওই মহিলার দিকে এগিয়ে গেল। যত কাছে যাচ্ছিল, তার হৃৎস্পন্দন ততই বাড়ছিল। এ তো কোনো ভুল নয়! এই তো সেই মুখ, যে মুখে একসময় ক্ষমতার দম্ভ আর আভিজাত্যের অহংকার ঝরে পড়ত।
তার চোখের সামনে নিমেষে ভেসে উঠল শেখবাড়ির সেইসব দিনের কথা। এই মহিলাই ছিলেন সেই বাড়ির রানি। যার এক কথায় পুরো বাড়িটা চলত। যার মেজাজের ভয়ে বাড়ির কাজের লোক থেকে শুরু করে সবাই তটস্থ থাকত। যার হুকুম অমান্য করার সাহস খোদ শেখ সাহেবেরও ছিল না। সেই প্রতাপশালী, দাপুটে মহিলা আজ পথের ধারে এমন অসহায়ভাবে বসে আছেন? যার আলমারি ভর্তি থাকত দামী জামদানি আর সিল্কের শাড়িতে, তার পরনে আজ এমন মলিন এক বস্ত্র?
রাফিদ আর নিজেকে সামলাতে পারল না। তার গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গিয়েছিল। অনেক কষ্টে সে কাঁপা কাঁপা গলায় ডাকল, “মা!”
ডাকটা শুনেই মহিলা চমকে উঠলেন। তিনি মুখ তুলে তাকালেন এবং রাফিদকে দেখামাত্রই তার চোখ দুটোয় নেমে এলো রাজ্যের বিস্ময় আর তীব্র লজ্জা। তিনি সাথে সাথে শাড়ির আঁচল টেনে নিজের মুখটা ঢাকার একটা ব্যর্থ চেষ্টা করলেন। তার এই ভঙ্গিটা রাফিদের বুকে ছুরির মতো বিঁধল। যে মা একসময় চোখে চোখ রেখে শাসন করত, আজ সে ছেলের সামনে মুখ লুকাচ্ছে!
রাফিদ কয়েক পা এগিয়ে গিয়ে তার সামনে প্রায় বসে পড়ল। “মা, কী হয়েছে তোমার? তুমি এখানে? এই অবস্থায় রাস্তায় রাস্তায় ঘুরছো কেন?”
তার মা আঁচলের ভেতর থেকেই চাপা, ভাঙা গলায় উত্তর দিলেন, “আমার পাপের শাস্তি, বাবা। আমার পাপের শাস্তি পাচ্ছি।”
“পাপ? কিসের পাপ?” রাফিদের কণ্ঠে বিস্ময় আর যন্ত্রণা মিলেমিশে একাকার।
তার মা এবার আঁচলটা সামান্য সরালেন। তার চোখ দিয়ে অঝোরে জল গড়িয়ে পড়ছে। “একজনকে বুকভরা ভালোবাসা দিয়েছি, আরেকজনকে সারা জীবন বিষনজরে দেখেছি। স্রষ্টা তো সবই দেখেন। আমি তার শাস্তিই পাচ্ছি।”
রাফিদের ভেতরটা দুমড়ে-মুচড়ে যাচ্ছিল। সে মায়ের হাতটা ধরে নরম গলায় জিজ্ঞেস করল, “কী হয়েছে, আমাকে খুলে বলো? রাহাত কোথায়? বাড়ির এই অবস্থা কে করেছে?”
“তোর ছোট ভাই রাহাত…” বলতে গিয়ে কান্নায় তার গলা বুজে এলো। “আমার কাছে জমানো যা কিছু টাকা-পয়সা ছিল, সব কেড়ে নিয়ে আমাকে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে।”
রাফিদের মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ল। “রাহাত? কিন্তু কেন?”
“ওর যার সাথে বিয়ে ঠিক হয়েছে, সেই মেয়ে নাকি বিয়ের পর শাশুড়ি নিয়ে এক বাড়িতে ঘর করতে পারবে না। তাই… তাই রাহাত আমাকে…” কথাটা তিনি আর শেষ করতে পারলেন না। কান্নায় ভেঙে পড়লেন।
রাফিদের বিশ্বাস হচ্ছিল না। সে হতভম্ব হয়ে বলল, “কিন্তু সে তো তোমার আদরের ছেলে ছিল! তার সব আবদার, সব অন্যায় তো তুমি মুখ বুজে সহ্য করতে। আমার চেয়েও তো তাকেই বেশি ভালোবাসতে তুমি!”
এই কথার উত্তরে তার মা আর কোনো কথা বললেন না। শুধু ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলেন। তার সেই দৃষ্টিতে ছিল এক গভীর অপরাধবোধ আর অসহায়ত্ব। এই নীরবতাই ছিল তার সব ভুলের স্বীকারোক্তি। রাফিদ এর আগে তার মাকে কখনো এতটা অসহায়, এতটা পরাজিত দেখেনি। যে নারী ছিলেন তার কাছে কঠোরতার প্রতিমূর্তি, আজ তিনি এক অসহায়, আশ্রয়হীনা।
রাফিদের মনটা হাহাকার করে উঠল। মা তার সাথে যা-ই করে থাকুক, দিনের শেষে তো সে তার মা-ই। কিন্তু পরমুহূর্তেই তার মনে পড়ল সেই দিনগুলোর কথা। মায়ের উপেক্ষা, তার তাচ্ছিল্য, তার প্রতিটা কথায় অপমান। এই মায়ের জন্যই তাকে শেখবাড়ি ছাড়তে হয়েছিল। এই নতুন জীবন, এই ছোট্ট স্বাধীন সাম্রাজ্য সে অনেক কষ্টে গড়ে তুলেছে। এখানে গফুর চাচার স্নেহমাখা আশ্রয় আছে, শান্তি আছে। এই শান্তির জীবনে সে তার অতীতের সেই যন্ত্রণাকে ফিরিয়ে আনতে পারবে না।
এক অদ্ভুত দোটানায় তার ভেতরটা ছিন্নভিন্ন হয়ে যাচ্ছিল। মা তার সাথে যা করেছে, তারপর সেই মাকে সে তার নিজের বাড়িতে ঠাঁই দিতে পারছিল না। মন সায় দিচ্ছিল না।
অন্যদিকে, তার মা-ও যেন তার মনের কথা বুঝতে পারছিলেন। তিনি চোখ মুছে, ভাঙা গলায় বললেন, “না বাবা, তোকে কিছু করতে হবে না। আমি আর তোর ঘাড়ে বোঝা হয়ে থাকতে চাই না। সারাজীবন তোকে কষ্টই দিয়েছি, আর না।”
রাফিদের বুকটা ফেটে যাচ্ছিল। সে পকেট থেকে ওয়ালেট বের করে কিছু টাকা মায়ের হাতে গুঁজে দিতে চাইল। কিন্তু তার মা হাত সরিয়ে নিলেন। “না। তোর করুণা নিয়ে আমি বাঁচতে চাই না।
রাফিদ ড্রাইভারকে ইশারা করে কাছে ডাকল। তার হাতে কিছু টাকা দিয়ে বলল, “এনাকে কোনো একটা ভালো হোটেলে নিয়ে যাও। আপাতত ওখানেই থাকবেন। আর কাল সকালে আমার সাথে দেখা করবে।”
সে আর দাঁড়াল না। বিধ্বস্ত মন আর ভারী পা নিয়ে গাড়িতে উঠে বসল। গাড়িটা যখন চলতে শুরু করল, সে রিয়ার-ভিউ মিররে দেখল, তার মা পথের ধারে মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছেন। শেখবাড়ির রানি আজ পথের ভিখারিনী। নিয়তির কী আশ্চর্য পরিহাস!
ফ্ল্যাটে ফিরে রাফিদ সোফায় শরীরটা এলিয়ে দিল। গফুর চাচা ছুটে এলেন।
“সাহেব, আপনার শরীর খারাপ নাকি? মুখটা এমন শুকনা লাগতেছে ক্যান?”
রাফিদ কিছু না বলে চোখ বুজে রইল। আজ একদিনে তার জীবনে দুটো ঝড় বয়ে গেল। একদিকে রিয়া, অন্যদিকে তার মা। তার অতীতের দুজন গুরুত্বপূর্ণ নারীই আজ তার সামনে পরাজিত, বিধ্বস্ত। কিন্তু এই দৃশ্য দেখে তার মনে কোনো শান্তি নেই, আছে কেবল এক গভীর ক্লান্তি।
ঠিক তখনই দরজায় কলিংবেল বেজে উঠল। গফুর চাচা কিছুটা অবাক হয়ে দরজা খুলতে গেলেন। এত রাতে আবার কে আসতে পারে?
দরজা খুলতেই তিনি দেখলেন, এক নারী দাঁড়িয়ে আছেন। চোখ-মুখ ফোলা, চুলগুলো এলোমেলো। পরনের সালোয়ার-কামিজটা ধুলোমাখা। মহিলাটি তাকে পাশ কাটিয়ে প্রায় জোর করেই ভেতরে ঢুকলেন।
রাফিদ চোখ খুলে দেখল, তার সামনে রিয়া দাঁড়িয়ে। তার চোখেমুখে এখন আর কোনো অভিমান বা অধিকারের দাবি নেই। আছে কেবল শেষ আশ্রয়টুকু খুঁজে পাওয়ার আকুতি। রাফিদ কিছু বলার আগেই রিয়া তার সামনে এসে কান্নায় ভেঙে পড়ল।
“রাফিদ, আমি জানি তুমি আমাকে আর তোমার জীবনে চাও না। আমি সেই অধিকার অনেক আগেই হারিয়েছি। কিন্তু দোহাই লাগে তোমার, আমাকে শুধু এই বিপদ থেকে বাঁচাও। ওই সন্ত্রাসীর হাত থেকে আমাকে উদ্ধার করো। তারপর আমি তোমার জীবন থেকে চিরদিনের জন্য চলে যাব, কোনোদিন তোমার সামনে আসব না। প্লিজ রাফিদ, আমাকে তোমার জীবনে নিতে হবে না, শুধু আমাকে বাঁচিয়ে দাও।”
রিয়ার এই আকুতি রাফিদের বিধ্বস্ত মনকে যেন নতুন করে আরেকটা ধাক্কা দিল। তার সামনে এখন দুই নারী—একজন জন্মদাত্রী মা, অন্যজন একসময়ের ভালোবাসার স্ত্রী। দুজনই আজ তার দয়ার প্রার্থী। রাফিদ কার হাত ধরবে, আর কার হাত ছেড়ে দেবে?
চলবে..