#শেখবাড়ির_বড়ছেলে
এ এইচ স্পর্শ
৯
রিয়ার কান্নায় ভেজা আকুতি রাফিদের বিধ্বস্ত মনকে যেন আরও একবার তীব্রভাবে ঝাঁকিয়ে দিল। তার পায়ের কাছে বসে থাকা এই নারীটি আর শেখবাড়ির সেই দাপুটে, অভিমানী রাজকন্যা নয়। এ যেন এক সর্বস্ব হারানো শরণার্থী, যে তার শেষ আশ্রয়টুকু খুঁজছে।
রাফিদের সামনে এখন দুই নারী—একজন জন্মদাত্রী মা, অন্যজন একসময়ের ভালোবাসার স্ত্রী। দুজনই আজ ভাগ্যের পরিহাসে তার দয়ার প্রার্থী। দুজনকেই সে তার জীবন থেকে মুছে ফেলতে চেয়েছিল, অথচ দুজনই আজ তার দরজায় এসে দাঁড়িয়েছে। রাফিদের মনে হলো, সে যেন এক বিশাল ঝড়ের কেন্দ্রবিন্দুতে দাঁড়িয়ে আছে, যেখান থেকে বের হওয়ার কোনো পথ নেই।
গফুর চাচা এতক্ষণ হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন। রিয়ার এই অবস্থা দেখে তার মায়া হচ্ছিল, কিন্তু রাফিদের বিধ্বস্ত মুখের দিকে তাকিয়ে তিনি বুঝতে পারছিলেন, ছেলেটা আর ভার নিতে পারছে না।
রাফিদ দীর্ঘশ্বাস ফেলে চোখ খুলল। তার দৃষ্টি শান্ত, কিন্তু সেই শান্ততার গভীরে এক প্রচণ্ড তোলপাড় চলছে। সে রিয়ার দিকে না তাকিয়েই নিচু গলায় বলল, “ওঠো, রিয়া। এভাবে পায়ের কাছে পড়ে থেকে নিজেকে আর ছোটো কোরো না।”
রিয়া ফোঁপাতে ফোঁপাতে মুখ তুলল। তার চোখে আশা-নিরাশার দোলাচল।
রাফিদ সোফা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “তোমাকে ওই সন্ত্রাসীর হাত থেকে বাঁচানোর দায়িত্ব আমার। তুমি আমার প্রাক্তন স্ত্রী, তার আগে ছিলে আমার ভালোবাসা। সেই সম্পর্কের কোনো দাম না দিলেও, একজন মানুষ হিসেবে আরেকজন মানুষের চরম বিপদে আমি মুখ ফিরিয়ে নিতে পারব না।”
কথাগুলো বলতে গিয়ে রাফিদের গলাটা ধরে এলো। সে গফুর চাচার দিকে ফিরে বলল, “চাচা, গেস্টরুমটা গুছিয়ে দিন। উনি আজ রাতটা এখানেই থাকবেন। আর কাল সকালে উনাকে উনার বাবার বাড়িতে নিরাপদে পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা আমি করব।”
তারপর সে রিয়ার দিকে তাকিয়ে বলল, “তোমার ভয়ের কোনো কারণ নেই। যতক্ষণ তুমি আমার আশ্রয়ে আছো, তোমার কোনো ক্ষতি হবে না। এখন যাও, বিশ্রাম নাও।”
আর ঐ সন্ত্রাসীর সাথে তোমার বিয়ে হবেনা। চিন্তা করোনা।
রিয়া হয়তো আরও কিছু বলতে চেয়েছিল, কিন্তু রাফিদের কঠোর , দূরত্ব মেশানো কণ্ঠস্বরে সে আর সাহস পেল না। সে শুধু কৃতজ্ঞ দৃষ্টিতে একবার তাকিয়ে গফুর চাচার সাথে গেস্টরুমের দিকে চলে গেল।
ঘরটা আবার নীরব হয়ে গেল। রাফিদ ধপ করে সোফায় বসে দুই হাতে মাথা চেপে ধরল। তার পৃথিবীটা যেন বনবন করে ঘুরছে। মা আর রিয়া—তার অতীতের এই দুই অধ্যায় আজ একসাথে ফিরে এসে তাকে কোন পরীক্ষার মুখে ফেলল?
গফুর চাচা এক গ্লাস পানি নিয়ে এসে রাফিদের পাশে বসলেন। স্নেহের সুরে বললেন, “বাবা, পানিটা খাও। মাথাটা ঠান্ডা করো।”
রাফিদ পানিটা এক চুমুকে শেষ করে অসহায়ভাবে গফুর চাচার দিকে তাকাল। তার শক্ত খোলসটা যেন এবার ভেঙে পড়ছিল।
“চাচা, আমার কী করা উচিৎ? আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। একদিকে রিয়া, তার জীবনটাও সংকটে। আরেকদিকে আমার মা… জন্মদাত্রী মা, যাকে আমি রাস্তায় খুঁজে পেয়েছি। যার সাথে আমার নাড়ির যোগসূত্র, সেই মা যখন পথের ধারে ওভাবে বসেছিল, আমার ভেতরটা ফেটে যাচ্ছিল চাচা। আমার সহ্য হয়নি।”
গফুর চাচা রাফিদের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন, “আমি জানি বাবা, আমি সব জানি। তোমার মনের অবস্থা আমি বুঝতে পারতেছি।”
রাফিদের চোখ ছলছল করে উঠল। “কিন্তু ওই মা-ই তো আমার জীবনটা শেষ করে দিয়েছিল। তার জন্যই তো আমাকে বাড়ি ছাড়তে হয়েছিল। তার জন্যই তো আমার ছোটবেলাটা দুঃস্বপ্নের মতো কেটেছে। আজ তাকে নিজের বাড়িতে আশ্রয় দিতে আমার মন সায় দিচ্ছে না। এই শান্তির জীবনে আমি আর অশান্তি চাই না।”
গফুর চাচা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। তারপর দৃঢ় গলায় বললেন, “বাবা, একটা কথা বলি, মন দিয়া শোনো। মায়েরা হইল আসমানের লাহান। আসমানে মেঘ জমে, বৃষ্টি হয়, বজ্রপাতও হয়। কিন্তু দিন শেষে ওই আসমানটাই ছায়া দিয়া রাখে। মায়েরা ভুল করে, বাবা। রাগের মাথায় ছেলেমেয়েদের গায়ে হাত তুলতে পারে, লাগলে দুই-চাইরটা চড়ও দিতে পারে। কিন্তু তুমিই কও, কোনো সন্তান কি পারে তার বাপ-মায়ের গায়ে হাত তুলতে? পারে তারে বাড়ি থাইকা বের করে দিতে?”
রাফিদ চুপ করে শুনছিল। গফুর চাচার প্রতিটি কথা তার বুকে গিয়ে বিঁধছিল।
গফুর চাচা বলে চললেন, “লোকে কয়, মায়ের কান্দনে নাকি আল্লাহর আরশ কাঁপে। উনি যা-ই করে থাকুক, দিন শেষে সে তোমার মা। জন্ম দিছে তোমারে। এই দুনিয়ার আলো-বাতাস তার জন্যই দেখছ। তারে রাস্তায় ফেলে রাখলে তুমি কোনোদিন শান্তি পাইবা না, বাবা। স্রষ্টাও তোমারে ক্ষমা করব না।”
একটু থেমে তিনি রাফিদের চোখের দিকে তাকিয়ে বললেন, “আমার কথা যদি শোনো, তাইলে দুইটা কাজ করতে পারো। হয় উনাকে এই ফ্ল্যাটে নিয়া আসো, নিজের কাছে রাখো। নাহলে, যেখান থেকে উনার ছোট ছেলে উনাকে বের করে দিছে, সেই বাড়িতে সসম্মানে ফিরায়া দিয়া আসো। সেই আগের মর্যাদায়, যেখানে উনি রানি হইয়া ছিলেন।”
গফুর চাচার কথাগুলো রাফিদের ভেতরের সব দ্বিধা, সব দ্বন্দ্ব ধুয়ে মুছে দিল। সে বুঝতে পারল, প্রতিশোধের আগুন যতই জ্বলুক, মায়ের অপমানের কাছে তা কিছুই নয়। তার মা শেখবাড়ির রানি ছিলেন, তাকে পথের ভিখারিনী হয়ে থাকতে দেওয়া যায় না। এটা তার সন্তানের জন্য সবচেয়ে বড় পরাজয়।
রাফিদ উঠে দাঁড়াল। তার চোখে এক নতুন দৃঢ়তা। “চাচা, গাড়ি বের করতে বলো। আমি এখনই বেরোব।”
“এত রাতে কই যাইবা, বাবা?”
“আমার মাকে তার সম্মান ফিরিয়ে দিতে,” বলেই রাফিদ নিজের ঘরের দিকে পা বাড়াল।
পরদিন সকালে রাফিদ ড্রাইভারকে নিয়ে সেই হোটেলে পৌঁছাল, যেখানে তার মা ছিলেন। হোটেলের ঘরে ঢুকে দেখল, তার মা একটা চেয়ারে বসে শূন্য দৃষ্টিতে বাইরে তাকিয়ে আছেন। মলিন শাড়িটা তখনও তার পরনে। রাফিদকে দেখে তিনি চমকে উঠে দাঁড়ালেন, চোখে সেই পুরোনো লজ্জা আর সংকোচ।
রাফিদ এগিয়ে গিয়ে মায়ের পায়ের কাছে বসে পড়ল। “মা, চলো।”
“কোথায়?” তার মায়ের কণ্ঠে বিস্ময়।
“তোমার বাড়িতে,” রাফিদ শান্তভাবে উত্তর দিল। “কিন্তু তার আগে তোমাকে আমার সাথে এক জায়গায় যেতে হবে।”
রাফিদ তার মাকে নিয়ে শহরের সবচেয়ে নামকরা এক শাড়ির দোকানে এলো। দোকানের ঝলমলে আলো, সারি সারি দামী শাড়ি দেখে তার মা ইতস্তত করছিলেন। তিনি যেন এই জগতের সাথে নিজেকে মেলাতে পারছিলেন না।
রাফিদ তার হাত ধরে ভেতরে নিয়ে গেল। সেলসম্যানদের বলল সবচেয়ে ভালো জামদানি আর সিল্কের শাড়ি দেখাতে।
“এসবের কী দরকার, বাবা?” তার মা ফিসফিস করে বললেন।
রাফিদ মায়ের চোখের দিকে তাকিয়ে নরম গলায় বলল, “শেখবাড়ির রানির পরনে মলিন শাড়ি মানায় না, মা।”
এই একটা কথাতেই যেন সব দ্বিধা কেটে গেল। রাফিদ নিজের হাতে মায়ের জন্য দুটো সুন্দর শাড়ি পছন্দ করল। একটা গাঢ় নীল রঙের জামদানি, আরেকটা ছাইরঙা সিল্ক। বিল দেওয়ার পর যখন শাড়ির ব্যাগ দুটো মায়ের হাতে দিল, রাফিদ দেখল, বহুদিন পর তার মায়ের চোখে পানি। তবে এ জল লজ্জার বা অপমানের নয়, এ জল খুশির, প্রাপ্তির। খুশিতে মায়ের চোখ দুটো চিকচিক করছিল। যে সন্তানের মুখদর্শনও তিনি একসময় করতেন না, আজ সেই ছেলেই তার হারিয়ে যাওয়া সম্মান ফিরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে।
গাড়িটা যখন শেখবাড়ির বিশাল গেটের সামনে এসে থামল, রাফিদের বুকের ভেতরটা ধক করে উঠল। কত দিন পর সে এই বাড়িতে পা রাখছে! কত স্মৃতি, কত অপমান, কত যন্ত্রণা জড়িয়ে আছে এই বাড়ির প্রতিটি ইঁটের সাথে।
সে গাড়ি থেকে নেমে মায়ের জন্য দরজা খুলে দিল। তার হাত ধরে গাড়ি থেকে নামিয়ে যখন গেটের দিকে এগোচ্ছিল, ঠিক তখনই ভেতর থেকে দ্রুত পায়ে বেরিয়ে এলো রাহাত। তার চোখেমুখে বিস্ময় আর তীব্র বিরক্তি।
মায়ের দিকে একবার তাচ্ছিল্যের দৃষ্টি ফেলে সে রাফিদের দিকে তাকিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বলল, “তুই? তুই কোন অধিকারে এই বাড়িতে এসেছিস?”
রাফিদের ভেতরটা মুহূর্তে জমে বরফ হয়ে গেল। কিন্তু সে বাইরে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাল না। তার চেহারা ভাবলেশহীন, কণ্ঠস্বর হিমশীতল। এই রাফিদকে রাহাত চেনে না। এ সেই পুরোনো ভীতু, অত্যাচারিত বড় ভাই নয়। এ এক অন্য মানুষ। তার চোখেমুখে ক্ষমতার ছাপ, তার চলনে আত্মবিশ্বাসের ঝংকার। রাফিদের এই ভয়ংকর পরিবর্তন দেখে রাহাত এক মুহূর্তের জন্য থমকে গেল।
রাফিদ রাহাতের চোখের দিকে সরাসরি তাকাল। তার দৃষ্টিতে কোনো রাগ নেই, ঘৃণা নেই, আছে কেবল এক শীতল ঔদাসীন্য। সে শান্ত কিন্তু দৃঢ় গলায় উত্তর দিল, “তোর যে অধিকার, সেই অধিকারেই।”
এই একটি বাক্যই যথেষ্ট ছিল। রাহাত যেন বাকরুদ্ধ হয়ে গেল। সে কী বলবে, ভেবে পেল না। যে ভাইকে সে তাড়িয়ে দিয়েছিল, সেই ভাই আজ তার সামনে দাঁড়িয়ে তারই অধিকারের কথা বলছে!
রাফিদ আর এক মুহূর্তও দাঁড়াল না। সে রাহাতের দিকে আর ফিরেও তাকাল না। মায়ের হাতটা শক্ত করে ধরে, তাকে পাশ কাটিয়ে সে বাড়ির ভেতরে পা রাখল। তার প্রতিটি পদক্ষেপ ছিল দৃঢ় এবং স্থির। যেন এক নির্বাসিত রাজা বহু বছর পর তার রাজ্যে ফিরে এসেছে নিজের সিংহাসন পুনরুদ্ধার করতে।
শেখবাড়ির পরিত্যক্ত সিংহাসনে আজ তার নির্বাসিত রানির প্রত্যাবর্তন ঘটল, আর সেই প্রত্যাবর্তন ঘটাল নির্বাসিত রাজপুত্র নিজেই। পেছনে হতভম্ব, পরাজিত সৈনিকের মতো দাঁড়িয়ে রইল রাহাত। সে বুঝতে পারছিল, শেখবাড়িতে ক্ষমতার খেলাটা আজ থেকে নতুন করে শুরু হতে চলেছে।
চলবে…