শেষ ডাক পর্ব-০১

0
47

শেষ_ডাক।
পর্ব:- এক।
লেখা:- সিহাব হোসেন।

“কাল রাতে প্রিয়া ফোন করেছিল। সে আমার কাছে ফিরে আসতে চায়। ওর স্বামী ওকে খুব মারধর করে।”

সকালের খাবার টেবিলে নাদিয়া যখন তৌসিফের প্লেটে গরম ভাত বেড়ে দিচ্ছিল, ঠিক তখনই নীরবতা ভেঙে তৌসিফ কথাটা বলে উঠলো।
কথাটা শুনে নাদিয়ার হাতটা এক মুহূর্তের জন্য থমকে গেল। প্লেটের ওপর ঝুঁকে থাকা মুখটা তুলে সে তৌসিফের দিকে তাকালো। তার চোখেমুখে স্পষ্ট বিস্ময়। দীর্ঘশ্বাস ফেলে নরম গলায় বলল,
– “তো তুমি কি বললে?”
– “আমি কথা বলার সুযোগ পাইনি। শুধু এতটুকু বলে ফোন কেটে দেয়। তারপর থেকে ফোন বন্ধ।”
– “ওহ।”
নাদিয়া কয়েক মুহূর্ত চুপ করে রইলো। তারপর একটু ইতস্তত করে বলল,
– “আমি তোমায় একটা কথা বলি?”
– “জ্বি ভাবি, বলো।”
– “ওর স্বামী যতই মা*রধর করুক না কেন, দিনশেষে কিন্তু তারা একই হবে। মাঝখানে তৃতীয় পক্ষ হিসেবে ওদের মধ্যে গিয়ে তুমি হবে দোষী।”
– “প্রিয়া খুব কান্না করছিল ভাবি। তাই খুব চিন্তা হচ্ছে। তুমি তো জানো সে কতটা হাসিখুশি একটা মেয়ে ছিল।”
– “হ্যাঁ জানি। কিন্তু… আচ্ছা যাইহোক, সে যেহেতু কিছুই ঠিকভাবে বলেনি তাই আরেকবার কথা বলার চেষ্টা করো।”
– “ফোনটাই তো বন্ধ।”

নাদিয়া আর কোনো কথা বাড়ালো না। হয়তো সে বুঝতে পারছিল, এই মুহূর্তে কোনো যুক্তিই তৌসিফের মনকে শান্ত করতে পারবে না। তৌসিফ সকালের খাবার শেষ করে ভারাক্রান্ত মন নিয়ে কাজের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে গেল।
তৌসিফ আর তার ভাই সায়ন একসাথে মিলে তাদের পারিবারিক ব্যবসা সামলায়। মা-বাবা কিছুদিন হলো গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে গেছেন, তাই বাসায় এখন ওরা চারজন, তৌসিফ, সায়ন, সায়নের স্ত্রী নাদিয়া আর তাদের একমাত্র ছেলে সৌমিক।
অফিসে এসেও তৌসিফের মনটা কিছুতেই কাজে বসছিল না। কম্পিউটারের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থাকলেও তার চোখের সামনে ভাসছিল শুধু প্রিয়ার মুখ। প্রিয়া তার সবচেয়ে কাছের বন্ধু, যাকে খুব ভালোবাসতো।

আজ থেকে পাঁচ বছর আগের কথা। তাদের সম্পর্কটা ছিল অদ্ভুত এক বাঁধনে বাঁধা। কেউ কাউকে ছাড়া এক মুহূর্ত থাকতে পারত না। প্রিয়া যেমন তৌসিফকে অন্য কোনো মেয়ের সাথে মিশতে দিত না, তেমনি তৌসিফও প্রিয়াকে কোনো ছেলের সাথে মিশতে দিত না। লোকে বলে, ছেলে আর মেয়ে কখনো শুধুই বন্ধু হতে পারে না। ওদের ক্ষেত্রেও কথাটা সত্যি হয়ে গিয়েছিল। তৌসিফ নিজের অজান্তেই প্রিয়াকে খুব গভীরভাবে ভালোবেসে ফেলে।

অনেক দ্বিধা আর ভয় কাটিয়ে সে ঠিক করে, প্রিয়াকে তার মনের কথা জানাবে। যেদিন সে প্রিয়াকে দেখা করতে বলল, সেদিনই প্রিয়া তাকে জীবনের সবচেয়ে বড় দুঃসংবাদটা দিল। ম্লান মুখে সে বলল,
– “কাল জানতে পারলাম বাবা আমার বিয়ে ঠিক করেছে। কিন্তু বিশ্বাস কর, এই বিয়ে করার কোনো ইচ্ছা আমার নাই।”
কথাটা শোনার পর তৌসিফের পায়ের নিচের মাটি যেন সরে গেল। কোনোমতে নিজেকে সামলে নিয়ে সে জিজ্ঞেস করলো,
– “হঠাৎ এত তাড়াতাড়ি বিয়ে ঠিক করলো কেন?”
– “জানি না। বিশেষ করে আমার চাচার জন্য। সে-ই নাকি ছেলে পছন্দ করেছে।”
– “তাহলে সত্যি তোর বিয়ে হয়ে যাবে?”
– “হুম।”

তৌসিফ অসহায় চোখে আকাশের দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। যা হওয়ার হবে ভেবে সে শেষ চেষ্টা হিসেবে বলেই দিল,
– “কিন্তু আমি যে তোকে ভালোবেসে ফেলেছি। তুই চলে গেলে আমার কী হবে?”
প্রিয়া অবাক চোখে তাকালো। যে কথাটা শোনার জন্য তার মন এতদিন অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিল, সেই কথাটা এমন এক সময়ে শুনতে হলো যখন আর কিছুই করার নেই। তার চোখে অভিমান আর কষ্ট মিলেমিশে একাকার হয়ে গেল। কিছুটা রেগে কান্নাভেজা কন্ঠে সে বলল,
– “ভালো যখন বাসিস তাহলে এখন বলছিস কেন? এতদিন কী হয়েছিল?”
– “ভয় হতো। যদি তুই রাগ করিস, আমার থেকে দূরে চলে যাস?”
প্রিয়া আর নিজেকে সামলাতে পারলো না। তৌসিফকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়ল। ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলল,
– “তোর থেকে দূরে যাওয়ার কোনো ইচ্ছা আমার নেই। কিন্তু আমার যে কিছু করার নাই।”
– “চল আমরা পালিয়ে যাই।”
– “না না। তুই তো জানিস আমার পরিবার কেমন? ওরা একদম তোকে শেষ করে দেবে।”
– “তাই বলে আমাদের পথচলা এখানেই শেষ?”
– “যদি ভাগ্যে থাকে তাহলে আবার কোনো এক অজানা গন্তব্যে তোর আমার দেখা হবে। ভালো থাকিস।”

সেদিন ছিল তাদের শেষ দেখা। তৌসিফ পরে শুনেছিল, খুব ঘরোয়াভাবে, কোনো অনুষ্ঠান ছাড়াই প্রিয়ার বিয়ে হয়ে গেছে। তারপর থেকে তার সাথে সব ধরনের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন।
দীর্ঘ পাঁচ বছর পর কাল রাতের সেই একটা ফোন সবকিছু আবার ওলটপালট করে দিল। প্রিয়ার কান্নার শব্দ আর অসহায় আর্তি তৌসিফের বুকের ভেতরটা দুমড়েমুচড়ে দিচ্ছে। সে বারবার নিজের ফোনটার দিকে তাকাচ্ছে, যদি একবার, শুধু একবারের জন্য ওপাশ থেকে প্রিয়ার ফোন আসে। কিন্তু ফোনটা তখনো বন্ধ।

তৌসিফের বুকের ভেতরটা তখনও ধড়ফড় করছিল। প্রিয়ার সেই কান্নাভেজা কণ্ঠস্বরের রেশটা যেন মাথার মধ্যে গেঁথে আছে। সে আনমনে চেয়ারে বসে ভাবছিল, ঠিক তখনই ফোনটা তীক্ষ্ণস্বরে বেজে উঠলো। স্ক্রিনে ‘প্রিয়া’ নামটা ভাসতেই এক মুহূর্ত দেরি না করে রিসিভ করলো সে। কিন্তু ফোনের ওপাশ থেকে ভেসে আসা কণ্ঠস্বরটা রাতের মতো অসহায় বা ভীত ছিল না। বরং তাতে ছিল এক অদ্ভুত উচ্ছলতা। প্রিয়া হেসে উঠে বলল,
– “তো কেমন আছিস? এখনো দেখছি আমায় ভুলে যাসনি?”

তৌসিফ বিভ্রান্ত হলো। এই কি সেই প্রিয়া যে কাল রাতে সাহায্যের জন্য কাঁদছিল? সে ধীর গলায় জবাব দিল,
– “তোকে হয়তো এই জন্মেও ভুলতে পারবো না।”
– “তাই তো দেখছি। এজন্য বোধহয় বিয়েটা অব্দি করিস নি।”
– “হয়তো বা। কিন্তু তুই কাল ওভাবে কথা বললি কেন? সে কি তোকে খুব মা*রধর করে?”
ফোনের ওপাশে এক মুহূর্তের নীরবতা। তারপর প্রিয়ার একটা দীর্ঘশ্বাস ভেসে এলো।
– “ওসব কথা এখন বাদ দে। এভাবে সব বলা যাবে না। তুই বরং আমার সাথে দেখা কর। বল, পারবি তো দেখা করতে?”
– “কখন কোথায় আসতে হবে সেটা বল।”
তৌসিফের মনে হাজারটা প্রশ্ন, কিন্তু প্রিয়ার সাথে দেখা করার সুযোগটা সে হারাতে চাইল না।
প্রিয়া যে ঠিকানাটা দিল, সেটা শুনে তৌসিফ চমকে উঠলো। এখান থেকে প্রায় সাতশ কিলোমিটার দূরে, এক দুর্গম পাহাড়ি এলাকার নাম। জায়গাটা মফস্বল শহর থেকেও অনেক ভেতরে। প্রিয়া এতদূরে কী করছে?
বাসায় ফিরে সে নাদিয়াকে সবটা খুলে বলল। সব শুনে নাদিয়ার কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ল।
– “এতদূর যাওয়া কি ঠিক হবে? আমার কিন্তু ব্যাপারটা ভালো লাগছে না।”
– “না গিয়েও উপায় নেই, ভাবি। ওর সাথে কথা না বলা পর্যন্ত আমার মন শান্ত হচ্ছে না।”
– “ঠিক আছে, তবে খুব সাবধানে থাকিস।”

তৌসিফের দেখা করার কথায় প্রিয়া যেন আরও খুশি হলো। দুইদিন পর সন্ধ্যায় সে বাসে উঠল। দীর্ঘ যাত্রাপথে বাইরের অন্ধকার আর তার মনের ভেতরের অন্ধকার মিলেমিশে একাকার হয়ে যাচ্ছিল। পরিচিত পৃথিবীটা যেন ক্রমশ পেছনে মিলিয়ে যাচ্ছে।
পরদিন দুপুরে বাস যখন তার গন্তব্যে পৌঁছাল, আকাশ ছিল মেঘলা। টিপটিপ করে বৃষ্টি পড়ছিল, চারপাশের পাহাড় আর জঙ্গলে কেমন যেন এক বিষণ্ণতার চাদর বিছিয়ে দিয়েছে। বাস থেকে নামতেই তৌসিফ দেখল, স্ট্যান্ডের এক কোণে ছাতা মাথায় দিয়ে প্রিয়া দাঁড়িয়ে আছে। তার পরনে গোলাপি রঙের জামা, যা এই ধূসর পরিবেশে বড্ড বেমানান লাগছিল। চেহারায় আগের সেই উজ্জ্বল ভাবটা থাকলেও শরীরটা কেমন যেন শুকিয়ে গেছে, চোখের নিচে স্পষ্ট কালির ছাপ।
প্রিয়া ম্লান হেসে তার দিকে হাত বাড়িয়ে দিল।
– “কেমন আছিস?”
তৌসিফ প্রিয়ার হাতটা ধরতেই বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো চমকে উঠলো। বরফের মতো ঠাণ্ডা সে হাত। এই ভেজা আবহাওয়ার স্বাভাবিক শীতলতা নয়, এ যেন এক বরফের মতো শীতলতা।
– “ভালো। তোর এই অবস্থা কেন?”
– “এমনি। এখন চল। বাসায় গিয়ে সব বলবো।”
– “তোর স্বামী…”
; “ডিভোর্স হয়ে গেছে।”
প্রিয়া কথাটা এমনভাবে বলল, যেন এটা খুবই সাধারণ একটা ঘটনা। তৌসিফ অবাক হয়ে বলল,
– “তাহলে সেদিন রাতে যে বললি?”
– “আরে বাবা, সব বলবো। আগে চল তো।”
প্রিয়ার কথায় অধৈর্য ফুটে উঠল।

একটা পুরনো ট্যাক্সি ডেকে তারা উঠে পড়ল। গাড়িটা ধীরে ধীরে শহরের সীমানা পেরিয়ে এক পাহাড়ি রাস্তায় প্রবেশ করল। বৃষ্টির পরিমাণ বাড়তে শুরু করেছে। রাস্তার দুই ধারে ঘন সবুজ গাছপালা এমনভাবে ঝুঁকে আছে যে, দিনের বেলাতেও ভেতরটা অন্ধকার লাগছে। চারদিকে সুনসান নীরবতা, কেবল গাড়ির ইঞ্জিনের শব্দ আর বৃষ্টির একটানা রিমঝিম আওয়াজ।
প্রিয়া হঠাৎ নীরবতা ভেঙে বাইরের দিকে আঙুল তুলে বলল,
– “ওই যে সামনে তিনতলা স্কুলটা দেখছিস, এখানে আমি শিক্ষকতা করছি এক বছর ধরে। এখানেই একটা বাংলো বাড়িতে থাকি। বাবা কিনে দিয়েছে। একদম একা।”
– “তাহলে আমায় ডাকার কারণ কী?”

প্রশ্নটা শুনেই প্রিয়ার হাসিমাখা মুখটা কঠিন হয়ে গেল। সে এমনভাবে তাকাল যে তৌসিফ আর কথা বাড়াতে সাহস পেল না, চুপচাপ বসে রইল।
কিছুক্ষণ পর একটা পুরনো ধাঁচের বাংলো বাড়ির সামনে এসে গাড়িটা থামল। রাস্তার ধারেই বাড়িটা, সামনে অযত্নে বেড়ে ওঠা কিছু ফুলের গাছ। দেয়ালের গায়ে শ্যাওলা ধরেছে। পেছনে বহুদূরে বিশাল সব পাহাড় মেঘের চাদরে মুখ ঢেকে রেখেছে। অপূর্ব সুন্দর দৃশ্য, কিন্তু পুরো জায়গাটাকে নির্জনতার এক গা ছমছমে আবরণ ঘিরে রেখেছে।
প্রিয়া তৌসিফকে নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করল। বাড়ির ভেতরে ঢুকতেই বিশাল এক ড্রয়িংরুম। আসবাবপত্র বলতে তেমন কিছুই নেই। একপাশে একটা পুরনো সোফা, অন্য কোণে ওপরতলায় ওঠার সিঁড়ি। বাড়িটার ভেতরটা কেমন স্যাঁতসেঁতে আর ঠাণ্ডা।
প্রিয়া তাকে নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠল। একটা ঘরের দরজা খুলে বলল,
– “এখানে তুই থাকবি। এখন যা, ফ্রেশ হয়ে নে। আমি খাবার তৈরি করছি।”

তৌসিফ তার ব্যাগটা বিছানার ওপর রেখে প্রচণ্ড ক্লান্ত শরীরে বাথরুমের দিকে এগিয়ে গেল। ভেতরের ছিটকিনিটা খুলতেই তার শরীর হিম হয়ে গেল।

বাথরুমের সাদা টাইলসের মেঝে রক্তে ভেসে যাচ্ছে। তাজা, টকটকে লাল রক্ত। মনে হচ্ছে যেন একটু আগেই কেউ এখানে…। তৌসিফের গলা শুকিয়ে গেল, আতঙ্কে তার মুখ দিয়ে কোনো শব্দ বের হলো না।

চলবে…!