#শেষ_ডাক।
পর্ব:- দুই।
লেখা:- সিহাব হোসেন।
বাথরুমের মেঝেতে র*ক্তেরভয়াবহ স্রোত দেখে তৌসিফের শরীর বরফের মতো ঠাণ্ডা হয়ে গেল। সে দ্রুত পায়ে ঘর থেকে বেরিয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়াল, তার গলা দিয়ে অস্ফুট স্বরে বেরিয়ে এলো, “প্রিয়া! প্রিয়া!”
তার আতঙ্কিত ডাক শুনে প্রিয়া প্রায় ছুটে এলো। তার চোখেমুখে চিন্তার ভাব,
– “কী হয়েছে? তোকে এমন ফ্যাকাসে লাগছে কেন?”
– “বা-বাথরুমে… রক্ত…”
তৌসিফ কোনোমতে কথাটা শেষ করলো। প্রিয়া অবাক হয়ে বলল,
– “কই দেখি?”
সে দ্রুত বাথরুমে ঢুকে পড়ল। কিন্তু ভেতরে ঢুকে সে যা দেখল, তাতে তার মুখ থেকে স্বস্তির নিঃশ্বাস বেরিয়ে এলো। সে বাইরে এসে তৌসিফের দিকে তাকিয়ে বলল,
– “কই রক্ত? কিচ্ছু তো নেই। গাড়িতে সারা রাত ঘুম হয়নি, তাই এখন এসব আবোল-তাবোল দেখছিস।”
তৌসিফ নিজেও ভেতরে গিয়ে দেখল, জায়গাটা একদম শুকনো, পরিষ্কার। রক্তের বিন্দুমাত্র চিহ্নও নেই। যেন একটু আগে সে যা দেখেছে, তা ছিল তার মনের বিভ্রম। প্রিয়া তার কাঁধে হাত রেখে নরম গলায় বলল,
– “যা, গোসল করে নে। দেখবি শরীরটা ঝরঝরে লাগবে।”
তৌসিফ দ্বিধাগ্রস্ত মন নিয়ে গোসলে ঢুকল। প্রিয়া তার ঘর থেকে বেরিয়ে আসার সময় তার ঠোঁটের কোণে খেলে গেল এক রহস্যময়, দুর্বোধ্য হাসি।
গোসল সেরে নিচে নামতেই নাকে এলো বিরিয়ানির মন মাতানো সুগন্ধ। রান্নাঘরে প্রিয়াকে রান্না করতে দেখা গেল। তৌসিফকে দেখে সে বলল,
– “টেবিলে রুটি আর বিস্কুট রাখা আছে, আপাতত ওগুলো খেয়ে নে। রান্না হয়ে গেলে আমরা একসাথে খাবো।”
তৌসিফ একটা রুটি নিয়ে খেতে খেতে প্রিয়ার পাশে এসে দাঁড়াল। তারপর নাক টেনে একটা লম্বা শ্বাস নিয়ে বলল,
– “আহা! কতদিন পর তোর হাতের সেই বিখ্যাত বিরিয়ানি খাবো। ভাবতেই জিভে জল চলে আসছে।”
– “আপাতত জলটা গিলে ফেল। রান্না হোক, তারপর চেটেপুটে খাস, ঠিক আগের মতো। জানিস, খুব মিস করি সে সময়গুলো। আজ যদি সেদিন তোর হাতটা ধরে চলে যেতাম, তাহলে হয়তো আমার জীবনটা অন্যরকম হতো।”
– “আমি তো বলেছিলাম, কিন্তু তুই-ই তো রাজি হলি না। তোর জীবনে কী ঘটেছে, বলবি না?”
– “পরে বলবো। আগে খেয়ে একটু ঘুমিয়ে নে। তারপর সব বলব।”
কিছুক্ষণ পর রান্না শেষ হলে দুজন একসাথে খেতে বসল। প্রিয়ার রান্নার হাত একটুও বদলায়নি। সেই পুরোনো স্বাদ, পুরোনো গন্ধ, সবকিছু তৌসিফকে যেন পাঁচ বছর আগের সেই দিনগুলোতে ফিরিয়ে নিয়ে গেল। খেতে খেতে হঠাৎ তৌসিফের চোখ পড়ল পাশের জানালার কাচে। তার মনে হলো, জানালার ওপাশে আবছা অন্ধকারে মানুষের মতো একটা অবয়ব দাঁড়িয়ে আছে। কাচের ওপর তার প্রতিবিম্বটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। সে দেখেও না দেখার ভান করে খেতে থাকল, কিন্তু অস্বস্তিটা বাড়তে লাগল। নিজেকে সামলাতে না পেরে সে হঠাৎ বলে উঠলো,
– “প্রিয়া, মনে হচ্ছে জানালার ওপাশে কেউ একজন দাঁড়িয়ে আছে।”
প্রিয়া চট করে পেছনে ঘুরে দেখল, কিন্তু সেখানে কেউ ছিল না। তৌসিফ অবাক হয়ে দেখল, কাচের ওপর থেকে সেই রহস্যময় প্রতিবিম্বটাও উধাও হয়ে গেছে। প্রিয়া বলল,
– “তুই সত্যিই আজ ভুলভাল দেখছিস। খেয়ে তাড়াতাড়ি ঘুমা তো।”
তৌসিফ আর কথা বাড়াল না। চুপচাপ খাওয়া শেষ করল। প্রিয়া তাকে তার ঘর পর্যন্ত এগিয়ে দিল। তার নিজের ঘরটা ঠিক পাশেরটাই। তৌসিফ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে বলল,
– “আমি তো ঘুমাবো, তুই কী করবি?”
– “স্কুলের কিছু খাতা দেখতে হবে। তারপর সব গুছিয়ে তোকে বলব, কেন ডেকেছি।”
– “ঠিক আছে।”
তৌসিফ ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল। বাইরের আবহাওয়াটা বেশ ঠাণ্ডা, তাই কম্বলটা ভালো করে গায়ে জড়িয়ে শুয়ে পড়ল। তখন দুপুর গড়িয়ে বিকেল, ঘড়িতে প্রায় তিনটা বাজে। দীর্ঘ যাত্রার ক্লান্তি আর মানসিক চাপে তার শরীর ভেঙে আসছিল। কিছুক্ষণের মধ্যেই সে গভীর ঘুমে তলিয়ে গেল।
যখন তৌসিফের ঘুম ভাঙল, বাইরে তখন নিকষ কালো অন্ধকার। চারদিকে পিনপতন নীরবতা। সে কয়েক মুহূর্ত ঠাহর করার চেষ্টা করল সে এখন কোথায় আছে? তারপর সব মনে পড়তেই ধড়মড়িয়ে উঠে বসল। সে হাতড়ে হাতড়ে দেওয়ালের সুইচবোর্ডটা খুঁজে বের করল। লাইটটা জ্বালাতেই সে দেখল, তার বিছানার ওপর কুচকুচে কালো একটা বিড়াল বসে আছে। তার চোখ দুটো অন্ধকারে জ্বলজ্বল করছে। লাইটের আলো পড়তেই বিড়ালটা “ম্যাও” করে একটা তীক্ষ্ণ চিৎকার দিয়ে বিছানা থেকে লাফিয়ে নামল এবং খোলা জানালা দিয়ে এক লাফে অন্ধকারে মিলিয়ে গেল।
তৌসিফ জানালার কাছে ছুটে গিয়ে নিচে তাকাল, কিন্তু বিড়ালটার কোনো চিহ্নও দেখতে পেল না। তার পুরো শরীর ভয়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। এতক্ষণ ধরে তার বিছানায় একটা বিড়াল ছিল, অথচ সে কিছুই টের পায়নি! এই নির্জন বাড়িতে ঘটে চলা অদ্ভুত ঘটনাগুলো তার মনের মধ্যে এক অজানা ভয়ের জন্ম দিচ্ছিল।
সে কাঁপা কাঁপা পায়ে ঘর থেকে বেরিয়ে প্রিয়ার ঘরের দিকে এগিয়ে গেল। দরজাটা সামান্য ভেজানো ছিল। ভেতরে উঁকি দিয়ে দেখল, প্রিয়া বিছানায় হেলান দিয়ে বসে একটা বইয়ে ডুবে আছে। বই পড়াটা ছিল ওর পুরোনো অভ্যাস, একধরনের নেশা। তৌসিফকে দরজায় দাঁড়ানো দেখে সে বই থেকে মুখ তুলে বলল,
– “আরে, ঘুম থেকে কখন উঠলি?”
– “এই মাত্র। আচ্ছা, তুই এই ভূতের বাড়িতে একা থাকিস কী করে?”
তৌসিফের কণ্ঠে তখনও ভয়ের রেশ। প্রিয়া মুখ টিপে হেসে বলল,
– “কেন, কী হয়েছে?”
– “আমার বিছানার ওপর একটা কালো বিড়াল বসে ছিল! আর একটু হলে তো আমি ভয়েই ম*রে যেতাম।”
তৌসিফের কথা শুনে প্রিয়া এবার খিলখিল করে শব্দ করে হেসে উঠল। তার হাসিটা এই নিস্তব্ধ বাড়িতে কেমন যেন বেমানান শোনাল। হাসি থামিয়ে সে বলল,
– “শোন, ওই বিড়ালটা এমনই। কোথা থেকে যে ঘরে ঢুকে পড়ে, আমি নিজেও জানি না। কিন্তু ও কোনো ক্ষতি করে না। তুই বোস, আমি চা করে আনছি।”
তৌসিফ লক্ষ করছিল, প্রিয়া যেন সচেতনভাবে তার মূল প্রশ্নগুলো এড়িয়ে যাচ্ছে। কেন তাকে এখানে ডেকেছে, সেদিন রাতে কেন সেভাবে ফোন করেছিল, এইসব প্রসঙ্গ উঠলেই সে অন্য কথা বলছে। সেদিন রাতের সেই অসহায়, কান্নাভেজা কণ্ঠস্বরের সাথে আজকের এই হাসিখুশি, নিশ্চিন্ত প্রিয়ার কোনো মিলই খুঁজে পাচ্ছে না সে।
কিছুক্ষণ পর প্রিয়া একটা ট্রেতে করে চা আর বিস্কুট নিয়ে এসে তার পাশে বসল। তৌসিফ আর অপেক্ষা না করে সরাসরি জিজ্ঞেস করল,
– “তোর স্বামীর সাথে ডিভোর্স হলো কেন?”
– “অতিরিক্ত অবহেলা, কোনো সম্মান করত না। তাছাড়া বয়স অনেক বেশি ছিল। জানতে পারলাম, সে কখনো বাবাও হতে পারবে না। তাই ডিভোর্স নিয়ে নিলাম।”
প্রিয়া খুব সহজভাবে কথাগুলো বললেও তৌসিফের মনে হলো, তার চোখের গভীরে অন্য কোনো গল্প লুকিয়ে আছে, যা সে বলতে চাইছে না। তৌসিফ তার চোখের দিকে তাকিয়ে বলল,
– “তাহলে আমাকে এখানে ডাকার কারণটা কী?”
– “শোন তাহলে, বলি।”
প্রিয়া এবার একটু গম্ভীর হয়ে বলতে লাগল,
– “আমাদের স্কুলে খুব ভয়ানক একটা সমস্যা দেখা দিয়েছে। যেটা শুধু স্কুল নয়, পুরো গ্রামের মানুষের মধ্যে একটা মহামারির মতো ছড়িয়ে পড়ছে।”
– “কী সমস্যা?”
– “স্কুলের শিক্ষার্থীরা প্রায় সবাই স্বপ্নে এক ভয়ংকর চেহারার মহিলাকে দেখছে, যে তাদের ধরতে আসছে। কেউ কেউ তো এমনও দেখেছে যে, মহিলাটি তাদের খুব নৃশংসভাবে হ*ত্যা করছে আর বারবার বলছে, তারা যেন আর স্কুলে না আসে।”
– “হুম, বুঝলাম। কিন্তু এটা তো সাধারণ একটা স্বপ্নও হতে পারে। বাচ্চারা স্কুলে না যাওয়ার জন্য এমন বাহানা করতেই পারে। আমরাও তো ছোটবেলায় এমন কতকিছু করেছি।”
– “আমরা করতাম, মানছি। ছোট বাচ্চাদের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা স্বাভাবিক হিসেবেই ধরা হতো। কিন্তু যখন স্কুলের নবম-দশম শ্রেণির ছেলে-মেয়েরাও হুবহু একই স্বপ্ন দেখছে, তখন এটাকে কী বলবি? তারা তো আর বাচ্চা নয়। আর সবচেয়ে ভয়ের কথা কী জানিস? কিছুদিন আগে এই যে পেছনের পাহাড়টা দেখছিস, সেখানে কয়েকটা বাচ্চার সাথে বড়দেরও লাশ পাওয়া গেছে। প্রত্যেকটা লাশের অবস্থা ঠিক তেমনই, যেমনটা বাচ্চারা তাদের স্বপ্নে দেখেছে।”
– “পুলিশ এই ব্যাপারে তদন্ত করেনি?”
– “অনেক করেছে। কিন্তু তারা এখন পর্যন্ত কোনো সূত্রই খুঁজে পায়নি। সবকিছু যেন ধোঁয়াশার মধ্যে।”
– “তাহলে আমি কীভাবে সাহায্য করতে পারি?”
– “তুই কি ভুলে গেছিস, যেকোনো রহস্যময় জায়গার পেছনের গল্প খুঁজে বের করতে তুই কতটা পটু?”
– “হুম। কিন্তু তখন তো তুই আমার সঙ্গে থাকতি। তাই ব্যাপারটা সহজ হতো।”
– “এবারও আমি তোর পাশেই আছি। আর এবার যেটা হবে, সেটা একদম বাস্তব। তুই তৈরি তো?”
– “হুম তুই আমার পাশে থাকলে আমি যেকোনো কিছুর জন্য সব সময় তৈরি। চিন্তা করবি না যতদুর পারি আমি চেষ্টা করবো।”
প্রিয়া তার হাতটা তৌসিফের দিকে বাড়িয়ে দিল। তৌসিফ ওর হাতটা ধরতেই আবারও সেই তীব্র শীতল অনুভূতিতে চমকে উঠল। বরফের মতো ঠাণ্ডা একটা হাত, যার মধ্যে জীবনের কোনো উষ্ণতা নেই। ব্যাপারটা তার কাছে কেমন যেন অস্বাভাবিক লাগল।
বাইরে মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছে। তারা প্রায় এগারোটা পর্যন্ত গল্প করল। প্রিয়া জানতে চাইল তৌসিফের জীবনটা এখন কেমন চলছে। সে সব বললো৷ তারপর দুইজন বসে লুডু খেলল। পুরোনো দিনের মতো খুনসুটি করতে করতে সময়টা যে কিভাবে কেটে গেল তা টেরই পেল না। তারপর তৌসিফ নিজের ঘরে এসে শুয়ে পড়ল।
মাঝরাতে হঠাৎ একটা অদ্ভুত শব্দে তার ঘুম ভেঙে গেল।কড়*মড়… কড়*মড়…
শব্দটা এমন, যেন কেউ খুব আয়েশ করে শুকনো হা*ড় চি*বিয়ে খাচ্ছে। আর সবচেয়ে ভয়ের ব্যাপার হলো, আওয়াজটা খুব কাছ থেকে আসছে। মনে হচ্ছে, তার এই ঘরের ভেতরেই কেউ আছে। তৌসিফ ভয়ে জমে গেল, কম্বলের নিচে নিজেকে আরও গুটিয়ে নিয়ে কান পেতে রইল। শব্দটা থামছে না, বরং আরও স্পষ্ট হচ্ছে। এই নির্জন, অন্ধকার ঘরে সে একা নয়।
চলবে….?