শেষ ডাক পর্ব-০৩

0
51

#শেষ_ডাক।
পর্ব:- তিন।
লেখা:- সিহাব হোসেন।

হাড় চিবা*নোর শব্দটা ক্রমশ বেড়েই চলেছে। তৌসিফের মনে হলো, তার হৃদপিণ্ডটা যেন গলার কাছে এসে আটকে গেছে। সে ভাবল, না, এভাবে আর শুয়ে থাকা যাবে না। দেখতেই হবে, শব্দটা কোথা থেকে আসছে। সে সাহস সঞ্চয় করে বিছানা থেকে উঠে দাঁড়াল এবং সুইচ টিপে লাইটটা জ্বালিয়ে দিল।
সাথে সাথেই সব নিস্তব্ধ। সেই ভয়ঙ্কর শব্দটা যেন এক মুহূর্তে বাতাসে মিলিয়ে গেল। তৌসিফ কান পেতে রইল, কিন্তু আর কোনো আওয়াজ নেই। সে ভাবতে লাগল, এতক্ষণ যে শব্দটা সে শুনছিল, তা কি সত্যিই ছিল, নাকি তার ক্লান্ত মনের বিভ্রম? কিন্তু তার মন কিছুতেই মানতে চাইল না যে এটা মনের ভুল। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল, সবে রাত দেড়টা বাজে।

সে ধীর পায়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এলো। পুরো বাড়িটা ঘুটঘুটে অন্ধকারে ঢাকা। কিছুই ঠিকমতো চোখে পড়ছে না। তৌসিফ ফোনের ফ্ল্যাশলাইট জ্বালিয়ে দেওয়ালের সুইচবোর্ডটা খুঁজে বের করল এবং আলো জ্বালাল। নিচে নেমে দেখল, সবকিছু আগের মতোই শান্ত, পরিপাটি। প্রিয়া ঠিক আছে কিনা দেখার জন্য সে ওর ঘরের দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। ভেতর থেকে কোনো শব্দ আসছে না। হয়তো গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন।
তৌসিফ নিজের ঘরে ফিরে যেতে উদ্যত হলো, ঠিক তখনই তার পাশ দিয়ে ছায়ার মতো কিছু একটা সাঁ করে চলে গেল। সে চমকে ঘুরে তাকাতেই দেখল, মানুষের মতো একটা ছায়ামূর্তি খুব দ্রুত সিঁড়ি বেয়ে ছাদে মিলিয়ে গেল। এবার তৌসিফের আর বুঝতে বাকি রইল না যে এই বাড়িতে সত্যিই কিছু একটা আছে। আর প্রিয়া জেনেশুনেই ব্যাপারটা তার কাছে গোপন করছে। কিন্তু কেন? এর পেছনে কী কারণ থাকতে পারে?

সেই রাতে তার আর ঘুম হলো না। ভোরের দিকে একটু চোখ লেগেছিল মাত্র। সকালে ঘুম থেকে বেরিয়ে আসতেই সে প্রিয়ার কথা বলার শব্দ শুনতে পেল। সে বেশ হাসিখুশি মেজাজে কারো সাথে কথা বলছে। তৌসিফ নিচে নামতেই দেখল, রান্নাঘরে প্রিয়ার সাথে আরেকজন মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। প্রিয়া তাকে দেখে বলল,
– “ওহ, উঠে পড়েছিস? এর সাথে পরিচয় হ। ওর নাম মারিয়া। আমরা দুজন ওই স্কুলেই একসাথে চাকরি করি। আর হ্যাঁ, আমরা দুজন এই বাড়িতেই থাকি।”
মারিয়া মিষ্টি হেসে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল,
– “হাই।”
– “হ্যালো। আমি তৌসিফ, প্রিয়ার বেস্টফ্রেন্ড।”
তৌসিফও হাত মেলাল।
– “আপনার কথা প্রিয়ার কাছে এত শুনেছি যে গুনে শেষ করা যাবে না।”
প্রিয়া তাড়া দিয়ে বলল,
– “তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে আয়, আমাদের স্কুলে যেতে হবে।”

সকালের নাস্তা শেষ করে তৌসিফ, প্রিয়া আর মারিয়া স্কুলের জন্য বেরিয়ে পড়ল। বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে তারা গাড়ির জন্য অপেক্ষা করছিল। ঝিরিঝিরি বৃষ্টি আর পাহাড়ি শীতল হাওয়ায় পরিবেশটা মনোরম হলেও তৌসিফের মনের ভেতরটা ছিল অশান্ত। একটু পর একটা গাড়ি আসতেই তারা তিনজন উঠে পড়ল।
গাড়িতে বসে প্রিয়া আর মারিয়া নিজেদের মধ্যে গল্প জুড়ে দিল। তৌসিফ চুপচাপ তাদের কথা শুনছিল। সে ড্রাইভারের পাশের সিটে বসেছিল, তাই সুযোগ বুঝে জিজ্ঞেস করল,
– “আচ্ছা ভাই, শুনলাম এখানকার স্কুলে নাকি বাচ্চারা খুব ভয়ানক স্বপ্ন দেখে?”
কথাটা শোনা মাত্রই ড্রাইভার ভয়ার্ত দৃষ্টিতে তৌসিফের দিকে তাকাল। তার মুখটা ফ্যাকাসে হয়ে গেল। সে কিছু একটা বলতে যাবে, ঠিক সেই মুহূর্তে তার চোখ পড়ল গাড়ির ভেতরের রিয়ার-ভিউ মিররে। আয়নায় কিছু একটা দেখেই সে যেন পাথর হয়ে গেল। তার হাত-পা কাঁপতে শুরু করল। সে হঠাৎ গাড়িটা ব্রেক কষে থামিয়ে দিয়ে আতঙ্কিত গলায় বলল,
– “আপনারা তাড়াতাড়ি নেমে পড়ুন! প্লিজ, নেমে যান!”
তৌসিফ অবাক হলো। প্রিয়া পেছন থেকে চেঁচিয়ে বলল,
– “এই যে ভাই! নেমে পড়ব মানে? এখনও তো অর্ধেক রাস্তাও আসিনি!”
কিন্তু ড্রাইভার তাদের কোনো কথাই শুনছিল না। সে প্রায় কাকুতিমিনতি করে তাদের নামতে বলল। বাধ্য হয়ে তারা তিনজন গাড়ি থেকে নেমে পড়ল। ড্রাইভার ভাড়ার টাকা না নিয়েই তীব্র গতিতে গাড়ি চালিয়ে চোখের নিমেষে মিলিয়ে গেল। প্রিয়া হতভম্ব হয়ে তৌসিফের পাশে এসে দাঁড়াল।
– “অদ্ভুত তো! লোকটা এমন করল কেন?”
– “বুঝতে পারছি না। কিন্তু আমার মন বলছে, উনি কিছু একটা জানেন এবং সেটা দেখেই ভয় পেয়েছেন।”
– “আমারও তাই মনে হচ্ছে।”

তৌসিফ মনে মনে ভাবতে লাগল, গাড়ির ভেতরের ওই ছোট্ট আয়নায় ড্রাইভার এমন কী দেখতে পারে, যা তাকে এতটা ভয় পাইয়ে দিল? ঠিক সেই মুহূর্তে অন্য একটি গাড়ি এসে তাদের সামনে দাঁড়াল। তারা আর দেরি না করে সেটাতেই উঠে পড়ল, কিন্তু ড্রাইভারের সেই ভয়ার্ত চাহনি আর আতঙ্কিত মুখটা তৌসিফের মন থেকে কিছুতেই সরছিল না।
গাড়ি থেকে নেমে স্কুলের গেট দিয়ে ভেতরে পা রাখতেই তৌসিফের সারা শরীর দিয়ে যেন একটা হিমশীতল স্রোত বয়ে গেল। ভেতরে শত শত শিক্ষার্থীর কোলাহল, কিন্তু তবুও পুরো পরিবেশটা কেমন যেন প্রাণহীন, নির্জীব। চারদিকে একটা চাপা আতঙ্ক আর বিষণ্ণতা খেলা করছে।

এমন সময় এক বাচ্চার কান্নার শব্দে তার মনোযোগ ভাঙল। সে তাকিয়ে দেখল, একটি ছোট ছেলে তার মায়ের শাড়ির আঁচল ধরে হাউমাউ করে কাঁদছে, আর তার মা তাকে ধমকাচ্ছে। তৌসিফ ব্যাপারটা বোঝার জন্য তাদের কাছে এগিয়ে গেল। বাচ্চাটি ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলছে,
– “ওই মহিলাটা আমাকে স্কুলে আসতে বারণ করেছে। ওর কথা না শুনলে আমাকে মে*রে ফেলবে।”
– “প্রতিদিন স্কুলে না আসার জন্য নতুন নতুন বাহানা! এসব স্বপ্ন কখনো সত্যি হয় না, চল বলছি।”
তৌসিফ নিচু হয়ে বাচ্চাটির মাথায় হাত রেখে নরম গলায় জিজ্ঞেস করল,
– “আচ্ছা বাবু, তুমি স্বপ্নে কী দেখেছ, আমাকে একটু বলবে?”
– “প্রতিদিন স্বপ্নে দেখি, একটা মহিলা আমাকে স্কুলে আসতে মানা করে। বলে, এই স্কুলটা নাকি অভিশপ্ত। যদি ওর কথা না শুনি, তাহলে আমাকে মেরে ফেলবে।”
– “সে দেখতে কেমন ছিল?”
– “জানি না। তার মুখটা কখনো দেখতে পাই না। শুধু তার হাত দুটো দেখি, রক্তে ভেজা।”

বাচ্চাটির কথা শুনে তৌসিফের বুকের ভেতরটা ছ্যাঁৎ করে উঠল। সে উঠে দাঁড়াল। তার মনে হলো, এই স্কুলের মাটিতে কোনো এক গভীর অভিশাপ লুকিয়ে আছে। নইলে এতগুলো মানুষ একই ধরনের ভয়ঙ্কর স্বপ্ন দেখবে কেন? সে সোজা প্রিয়ার কাছে গিয়ে বলল,
– “আমাকে এই স্কুলের হেডস্যারের কাছে নিয়ে চল।”
– “হুম, চল।”
প্রিয়া তাকে হেডস্যারের কক্ষে নিয়ে গেল। ভদ্রলোকের নাম নজরুল ইসলাম, বয়স পঞ্চাশের কোঠায়। চোখেমুখে গভীর চিন্তার ছাপ। প্রিয়া তাকে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বলল,
– “উনার কথাই আপনাকে বলেছিলাম, স্যার।”
– “ওহ, আচ্ছা। আপনি বসুন।”

প্রিয়া ইশারায় তৌসিফকে কথা বলতে বলে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। তৌসিফ বলল,
– “আপনি তো এখানে অনেকদিন ধরে আছেন। এমন কোনো মহিলাকে কি চেনেন, যার এই স্কুলের সাথে কোনো তিক্ত অতীত জড়িয়ে আছে?”
– “আমি প্রায় পনেরো বছর ধরে এখানে আছি, কিন্তু আমার জানা মতে এমন কোনো ঘটনা ঘটেনি।”
– “বাচ্চাদের মধ্যে এই স্বপ্নের ব্যাপারটা কতদিন ধরে চলছে?”
– “মাস ছয়েক হবে। এর মধ্যে কয়েকজন মা*রাও গেছে। সবচেয়ে অবাক করা বিষয় হলো, তাদের সবাইকে এত নৃশংসভাবে কে মারল, সেটাই বুঝতে পারছি না। সবার লা*শ পাওয়া যেত ওই পেছনের পাহাড়টার ধারে।”
– “সত্যিই অদ্ভুত! দেখি, আমি কোনো রহস্য উদঘাটন করতে পারি কিনা।”
– “চেষ্টা করে দেখুন। পুলিশ যেখানে হাল ছেড়ে দিয়েছে, সেখানে আমাদের মতো সাধারণ মানুষ আর কী-ই বা করতে পারে।”
হেডস্যারের ঘর থেকে বেরিয়ে আসতেই প্রিয়া তার হাতে বাড়ির চাবিটা দিয়ে বলল,
– “তুই বাড়িতে যা। সব রান্না করা আছে। আমার ফিরতে দুপুর তিনটা বাজবে। ঠিকমতো খেয়ে নিস।”
– “আচ্ছা।”

তৌসিফ আর কোনো উপায় না দেখে একাই বাড়ির দিকে রওনা হলো। বাড়ির ভেতরে ঢুকতেই সেই কুচকুচে কালো বিড়ালটা আবার তার সামনে এসে দাঁড়াল। এবার তার চোখেমুখে এক হিং*স্র ভঙ্গি, যেন এই মুহূর্তে সে তৌসিফের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে। হঠাৎ বিড়ালটা তার পাশ কাটিয়ে সদর দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়াল। তৌসিফ অবাক হয়ে তার দিকে তাকাল। বিড়ালটা কয়েক পা এগিয়ে গিয়ে আবার পেছন ফিরে তার দিকে তাকাচ্ছে। তৌসিফের মনে হলো, বিড়ালটা যেন ইশারায় তাকে অনুসরণ করতে বলছে।
এই অদ্ভুত পরিস্থিতিতে এভাবে একটা বিড়ালের পিছু নেওয়া কি ঠিক হবে? মন সায় না দিলেও এক অজানা কৌতূহলে সে বিড়ালটার পিছু নিল। বিড়ালটা বাড়ি থেকে বেরিয়ে পেছনের দিকে যেতে লাগল। একেবারে বাড়ির পেছনে, ঝোপঝাড়ের আড়ালে একটা জায়গায় এসে সে থামল।
তৌসিফ সেখানে পৌঁছে যা দেখল, তাতে তার র*ক্ত হিম হয়ে গেল। মাটিতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে অসংখ্য হাড়। কয়েকটা হা*ড়ের গায়ে তখনও তাজা র*ক্ত আর মাংস লেগে আছে। তৌসিফের মনে পড়ল, গত রাতে শোনা সেই হা*ড় চিবা*নোর কড়*মড় শব্দের কথা। তাহলে কি আওয়াজটা এখান থেকেই আসছিল?

সে আর এক মুহূর্তও সেখানে দেরি না করে ফিরে আসতে যাবে, ঠিক তখনই মাটিতে চকচক করতে থাকা একটা জিনিসের ওপর তার চোখ পড়ল। নিচু হয়ে তুলে নিতেই দেখল, ওটা একটা নাকফুল। ডিজাইনটা খুব চেনা চেনা লাগছে। আর তখনই তার মনে পড়ল, এই নাকফুলটা তো সে প্রিয়ার নাকে দেখেছে! কিন্তু আজ সকালে তো ওর নাকে কোনো ফুল ছিল না।
তাহলে কি প্রিয়া… এই সবকিছুর পেছনে? তার মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ল। তার সবচেয়ে কাছের বন্ধু, তার ভালোবাসা, সে-ই কি এই ভয়ঙ্কর রহস্যের মূলে রয়েছে?

চলবে…..।