#শেষ_ডাক।
পর্ব:- চার।
লেখা:- সিহাব হোসেন।
নাকফুলটা হাতে নিয়ে তৌসিফের মাথা ঘুরছিল। প্রিয়াকে ঘিরে সন্দেহের যে জালটা তার মনে বোনা শুরু হয়েছিল, তা আরও ঘন হয়ে উঠল। সে দ্রুত প্রিয়ার ঘরে এসে সবকিছু তন্ন তন্ন করে খুঁজতে লাগল। আলমারি, ড্রয়ার, বিছানার নিচ, কোথাও কিছু বাকি রাখল না। কিন্তু সন্দেহ করার মতো কিছুই পেল না সে।
আশ্চর্যজনকভাবে, সেই কালো বিড়ালটা তখনও তার পিছু ছাড়েনি। সে ঘরের এক কোণে বসে তীক্ষ্ণ চোখে তৌসিফের কার্যকলাপ লক্ষ করছিল। তৌসিফ তার এই অদ্ভুত আচরণে বেশ অবাক হলো। মনে হচ্ছে, বিড়ালটা তাকে কিছু একটা বোঝাতে চাইছে। সে বিড়ালের সামনে হাঁটু গেড়ে বসে ফিসফিস করে বলল,
– “তোর কি মনে হয়, প্রিয়া এসব করছে?”
বিড়ালটা শুধু শান্তভাবে একবার “ম্যাও” করল।
তৌসিফ হতাশ হয়ে বলল,
– “ধুর! তোকে বলে আর কী হবে? তুই তো ‘ম্যাও’ ছাড়া আর কিছুই বলতে পারিস না।”
তৌসিফের মনের মধ্যে সন্দেহের কাঁটা খচখচ করছিল। কিন্তু বিকেলে প্রিয়া যখন স্কুল থেকে ফিরল, তখন সব হিসেব ওলটপালট হয়ে গেল। তৌসিফ দেখল, প্রিয়ার নাকে সেই নাকফুলটা আগের মতোই জ্বলজ্বল করছে। সে হতভম্ব হয়ে গেল। যদি প্রিয়ার নাকফুল তার নাকে থাকে, তাহলে বাড়ির পেছনে সে যেটা পেয়েছে, সেটা কার?
প্রিয়া তার অবাক চাহনি লক্ষ করে বলল,
– “কী রে, ওভাবে তাকিয়ে আছিস কেন? কিছু হয়েছে?”
– “না, কিছু না।”
– “খেয়েছিস?”
– “না। ভাবলাম, আমরা দুজন একসাথেই খাব।”
– “দুইজন না, বল তিনজন একসাথে খাব। আমার বান্ধবীর কথা ভুলে গেছিস নাকি?”
– “ওহ, সরি। একদম মনে ছিল না।”
– “ব্যাপার না। তুই বোস, আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি। মারিয়া একটু বাইরে গেছে, এখনই চলে আসবে।”
– “ঠিক আছে।”
একটু পরেই মারিয়া ফিরে এলো। ঘরে ঢুকেই কোণে বসে থাকা কালো বিড়ালটার ওপর তার চোখ পড়ল। দেখামাত্রই সে রেগে গিয়ে মারার জন্য তেড়ে গেল। বিড়ালটা ভয়ে এক লাফে পালিয়ে গেল। তৌসিফ অবাক হয়ে বলল,
– “ওর সাথে এমন করলেন কেন?”
– “আর বলবেন না! এই শ*য়তানটা খালি মাছ চুরি করে খায়, আবার যখন তখন বিছানায় উঠে বসে। দেখলে গা জ্বলে যায়।”
– “ওহ।”
কিছুক্ষণ পর প্রিয়া ফ্রেশ হয়ে এলে তারা তিনজন একসাথে খেতে বসল। খাওয়া শেষে যখন গল্পের আসর বসল, তৌসিফ উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
– “আমি একটু বাইরে থেকে ঘুরে আসি।”
প্রিয়া জিজ্ঞেস করল,
– “কোনো জরুরি দরকার?”
– “ওই, একটু স্কুলের ব্যাপারে খোঁজখবর নিতে যাব।”
– “ঠিক আছে, যা। তবে সন্ধ্যার আগে ফিরে আসিস। কাল থেকে গ্রামের একজন লোক নিখোঁজ, তাকে কেউ খুঁজে পাচ্ছে না।”
এই কথাটা শোনার পর তৌসিফের বুকের ভেতরটা আবার কেঁপে উঠল। বাড়ির পেছনে পড়ে থাকা ওই হাড়গুলো কি তাহলে সেই নিখোঁজ লোকটির? প্রিয়া কি তাকেও মেরে ফেলেছে? হাজারটা প্রশ্ন তার মাথায় ঘুরপাক খেতে লাগল।
সে বাড়ি থেকে বেরিয়ে বৃষ্টিভেজা পাহাড়ি গ্রামের দিকে হাঁটতে লাগল। চারদিকে মানুষের আনাগোনা খুব কম। একটা মুদির দোকানের সামনে এসে দেখল, একজন বয়স্ক লোক একা বসে আছে। তৌসিফ তার সামনে রাখা বেঞ্চিতে গিয়ে বসল। দোকানদার তাকে দেখে একটু হাসল। তৌসিফের মনে হলো, এই লোকটি তাকে সাহায্য করতে পারবে, কারণ তাকে দেখে গ্রামের পুরোনো বাসিন্দা বলেই মনে হচ্ছে।
দোকানদার এক কাপ গরম চা এগিয়ে দিয়ে বলল,
– “তুমি মনে হয় ওই ম্যাডামের স্বামী, তাই না?”
তৌসিফ বুঝতে পারল, সে প্রিয়ার কথা বলছে। এখন ‘না’ বললে হয়তো ব্যাপারটা অন্য দিকে মোড় নেবে, তাই সে চুপ করে রইল। লোকটি আবার বলল,
– “ওই মেয়েটা আমার এখান থেকেই জিনিসপত্র নেয়। মাঝেমধ্যে চা খায়। দুদিন আগে বলছিল, তার স্বামী নাকি আসবে। কাল তোমাকে ওর সাথে আসতে দেখলাম, তাই ভাবলাম তুমিই ওর স্বামী।”
– “ওহ হ্যাঁ, ঠিকই ধরেছেন।”
– “অনেকদিন বিদেশে ছিলে বুঝি?”
– “জি। আচ্ছা আঙ্কেল, আমার স্ত্রী যে স্কুলে চাকরি করে, সেই স্কুলের কি কোনো পুরোনো ইতিহাস আছে, যা ভোলার মতো নয়?”
প্রশ্নটা শুনেই লোকটির মুখের হাসি মিলিয়ে গেল। তিনি কিছুক্ষণ চুপ থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,
– “হ্যাঁ বাবা, আছে। পঁচিশ বছর আগের কথা। ওই স্কুলে এক মেয়ে চাকরি করত। সে ছিল জাদুকর, বাচ্চাদের জাদু দেখিয়ে খুব আনন্দ দিত। কিন্তু স্কুলের তৎকালীন প্রধান শিক্ষক এসব পছন্দ করতেন না। তিনি মনে করতেন, এসব কালা জাদু। তাই তিনি মেয়েটাকে বরখাস্ত করে দেন।”
– “তারপর?”
– “এর কিছুদিন পরেই হঠাৎ করে ওই প্রধান শিক্ষক মারা যান। এমন নৃশংসভাবে তাকে মারা হয়েছিল যে, দেখে মনে হচ্ছিল কেউ তার শরীরের সব রক্ত শুষে নিয়েছে। সবার সন্দেহ গিয়ে পড়ল ওই মহিলার ওপর, কারণ সে নাকি পিশাচ সাধনা করত। এরপর থেকেই স্কুলের সবাই স্বপ্নে দেখতে শুরু করে যে, ওই মহিলা তাদের স্কুলে যেতে নিষেধ করছে। যারা ওর কথা অমান্য করত, তাদেরই মৃত্যু হতো। তাই একদিন গ্রামের সব লোক মিলে তার ঘরে আগুন লাগিয়ে তাকে পুড়িয়ে মারে। তার ছোট বাচ্চাটাও সেদিন তার সাথে পুড়ে মারা যায়।”
– “ওহ আচ্ছা। কিন্তু এখন তো সবাই আবার সেই একই স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছে। মানুষও মারা যাচ্ছে।”
– “আমার তো মনে হয়, ওর অতৃপ্ত আ*ত্মা কোনোভাবে প্রতি*শোধ নিতে ফিরে এসেছে।”
দোকানদারের কথাগুলো শুনে তৌসিফের শরীরের রক্ত হিম হয়ে গেল। তাহলে এই ভয়ঙ্কর রহস্যের জাল পঁচিশ বছর পুরোনো এক প্রতিশোধের গল্পের সাথে জড়িয়ে আছে।
দোকানদারের কাছ থেকে শোনা সেই ভয়ঙ্কর অতীত কাহিনিটা তৌসিফের মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল। সে প্রিয়ার সাথে এই বিষয়ে কোনো আলোচনা না করার সিদ্ধান্ত নিল। স্বাভাবিকভাবেই রাতে নিজের ঘরে এসে শুয়ে পড়ল। কিন্তু তার মনে হাজারো প্রশ্ন, ওই মহিলার অতৃপ্ত আ*ত্মা কি তবে প্রিয়ার শরীরকে ব্যবহার করে প্রতিশোধ নিতে চাইছে? আর যদি তাই হয়, তাহলে এত মানুষ থাকতে প্রিয়াই কেন? কিছুই তার মাথায় আসছিল না। এসব ভাবতে ভাবতেই একসময় সে গভীর ঘুমে তলিয়ে গেল।
মাঝরাতে আবার সেই হাড় চিবা*নোর কড়মড় শব্দে তার ঘুম ভেঙে গেল। এবার শব্দটা আরও স্পষ্ট, আরও ভয়ঙ্কর। সে বিছানায় উঠে বসল, কান পেতে বোঝার চেষ্টা করল আওয়াজটা কোথা থেকে আসছে। বুঝতে পারল, শব্দটা বাড়ির পেছন দিক থেকেই আসছে। সে ঘরের লাইট না জ্বালিয়ে, নিঃশব্দে বিছানা থেকে নামল। মোবাইলের স্ক্রিনের আবছা আলোয় সে ঘর থেকে বেরিয়ে প্রিয়ার ঘরের দিকে উঁকি দিল। যা দেখল, তাতে তার বুকের ভেতরটা ধক করে উঠল।
প্রিয়ার ঘরের দরজা খোলা। ভেতরে মারিয়া গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন, কিন্তু প্রিয়া বিছানায় নেই। শুধু তাই নয়, বাড়ির সদর দরজাও হাট করে খোলা। তৌসিফের মনে অশুভ আশঙ্কা দানা বাঁধল। সে আর এক মুহূর্তও দেরি না করে দ্রুত পায়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পেছনের দিকে এগিয়ে গেল। যত এগোচ্ছে, সেই হাড় চিবা*নোর শব্দটা ততই প্রকট হচ্ছে।
বাড়ির পেছনের দেয়ালের আড়ালে দাঁড়িয়ে সে উঁকি দিল। আবছা চাঁদের আলোয় যা দেখল, তাতে তার শরীরের সমস্ত রক্ত যেন বরফ হয়ে গেল।
প্রিয়া মাটিতে বসে আছে। তার সামনে পড়ে আছে একটা মানুষের নিথর দেহ। আর প্রিয়া… সে সেই শরীরটা ছিঁড়ে, হাড়সহ কাঁচা মাংস কড়মড় করে চিবিয়ে খাচ্ছে। তার মুখটা রক্তে মাখামাখি, চোখ দুটো অন্ধকারে অস্বাভাবিকভাবে জ্বলজ্বল করছে। কিন্তু সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ব্যাপার হলো, সেই নিথর দেহটা আর কারো নয়, আজ সকালে স্কুলে দেখা সেই ছোট্ট বাচ্চাটির। তার চোখ দুটো তখনও খোলা, কিন্তু তাতে কোনো প্রাণ নেই।
তৌসিফ আর এক মুহূর্তও সেখানে দাঁড়াতে পারল না। সে প্রায় ছুটে নিজের ঘরে ফিরে এসে দরজা বন্ধ করে দিল। তার সারা শরীর কাঁপছে, মনে হচ্ছে যেন রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। যাকে সে এত কাছ থেকে চেনে, যার হাসিতে সে নিজের পৃথিবী খুঁজে পেত, তার এমন নারকীয় রূপ সে সহ্য করতে পারছিল না। এটা কিছুতেই তার সেই প্রিয়া হতে পারে না, যাকে সে মনেপ্রাণে ভালোবাসে।
সেই রাতে তার আর ঘুম হলো না। তার বারবার মনে হতে লাগল, এটা তার প্রিয়া নয়, অন্য কেউ। কোনো এক অশুভ শক্তি তার শরীরটাকে নিয়ন্ত্রণ করছে।
পরদিন সকালে সে প্রিয়ার সাথে এমনভাবে স্বাভাবিক আচরণ করল, যেন কিছুই হয়নি। কিন্তু তার মনের ভেতরটা পুড়ছিল। সে দ্রুত একটা সুযোগ খুঁজে নিয়ে সোজা থানায় চলে গেল এবং পুলিশ ইন্সপেক্টর ইমরানের সাথে দেখা করল।
– “স্যার, এই রহস্য সমাধান করার জন্য আমার মাথায় একটা উপায় এসেছে।”
– “কী উপায়?”
– “আমাদের এমন একজন শিক্ষার্থীকে ডেকে আনা উচিত, যে ওই স্বপ্নটা দেখেছে। তার বর্ণনা অনুযায়ী যদি আমরা মহিলার একটা স্কেচ আঁকতে পারি, তাহলে হয়তো এই রহস্যের মূল হোতাকে খুঁজে পাওয়া যাবে।”
– “দারুণ বুদ্ধি! ঠিক বলেছেন।”
পুলিশ দ্রুত দশম শ্রেণির একজন শিক্ষার্থীকে ডেকে আনল। তার বর্ণনা অনুযায়ী একজন দক্ষ আর্টিস্ট মহিলার একটি স্কেচ তৈরি করল। স্কেচটা হাতে নিয়ে তৌসিফ হতবাক হয়ে গেল।
মেয়েটির মুখটা অস্পষ্ট, ধোঁয়ায় ঢাকা। কিন্তু তার শারীরিক গঠন, তার দাঁড়ানোর ভঙ্গি, সবকিছু দেখে সে পুরোপুরি নিশ্চিত হলো যে, এটা আর কেউ নয়, তারই প্রিয়া। তার ভালোবাসা, তার বন্ধু, একই সাথে এক ভয়ঙ্কর খু*নি।
চলবে….!