#শেষ_ডাক।
পর্ব:- পাঁচ।(শেষ)
লেখা:- সিহাব হোসেন।
পুলিশ স্টেশন থেকে ফিরে আসার পর তৌসিফের মনটা পাথরের মতো ভারি হয়ে ছিল। স্কেচটা দেখার পর তার আর কোনো সন্দেহ ছিল না। সে দ্রুত বাসায় ফিরে এলো এবং দেখল, প্রিয়া রান্নাঘরে কাজ করছে। এক মুহূর্ত দেরি না করে সে প্রিয়ার হাত ধরে হিড়হিড় করে টেনে বসার ঘরে নিয়ে এলো এবং সশব্দে দরজাটা বন্ধ করে দিল।
মারিয়া ছুটে এসে অবাক হয়ে বলল,
– “কী হয়েছে?”
প্রিয়া হতভম্ব হয়ে জিজ্ঞেস করল,
– “কী হলো তোর? এভাবে দরজা বন্ধ করলি কেন?”
– “সত্যি করে বল, কে তুই?”
তৌসিফের কণ্ঠে তীব্র ঘৃণা আর অবিশ্বাস।
– “আমি প্রিয়া। কী যা-তা বলছিস?”
– “তুই প্রিয়া নোস! তুই সেই শয়*তান, যে একের পর এক নিষ্পাপ বাচ্চাদের খু*ন করছে!”
– “আমি কেন মা*রতে যাব? তোর মাথা খারাপ হয়ে গেছে!”
– “সেটা তুই ভালো জানিস। কিন্তু তোর ব্যাপারে আমি সব জেনে গেছি। কাল রাতে আমি তোকে ওই বাড়ির পেছনে বসে মানুষের হাড় চি*বিয়ে খেতে দেখেছি। এই সবকিছুর পেছনে তুই আছিস!”
তৌসিফের কথা শেষ হতেই মারিয়াও যোগ করল,
– “হ্যাঁ ভাইয়া, আপনি ঠিকই বলেছেন। এই সবকিছুর পেছনে প্রিয়াই দায়ী। দেখুন না, ওর শরীরটা কেমন বরফের মতো ঠাণ্ডা। একটা মানুষের শরীর তখনই এমন ঠাণ্ডা হয়, যখন সে মা*রা যায় অথবা তার মধ্যে কোনো পিশাচ ভর করে।”
প্রিয়া অবাক চোখে একবার তৌসিফ আর একবার মারিয়ার দিকে তাকাচ্ছিল। সে কী বলবে বা কী করবে, কিছুই ভেবে পাচ্ছিল না। ঠিক তখনই বাইরে পুলিশের গাড়ির সাইরেন শোনা গেল। পুলিশ ততক্ষণে বাড়ির পেছনের ঝোপ থেকে মানুষের শরীরের বিভিন্ন অংশ আর হাড়গোড় খুঁজে পেয়েছে।
তারা প্রিয়াকে গ্রেফতার করতে এগিয়ে এলো। প্রিয়া কান্নায় ভেঙে পড়ে তৌসিফের দিকে তাকিয়ে বলল,
– “বিশ্বাস কর, তৌসিফ, আমি এসবের কিছুই জানি না। আমার শরীর কেন এত ঠাণ্ডা থাকে, সেটাও আমি জানি না।”
কিন্তু তৌসিফ মুখ ফিরিয়ে নিল। তার ভালোবাসা, তার বিশ্বাস, সবকিছু যেন এক মুহূর্তে চুরমার হয়ে গেছে। পুলিশ যখন প্রিয়াকে নিয়ে যাচ্ছিল, গ্রামের উত্তেজিত জনতা তাকে ছিনিয়ে নিয়ে মেরে ফেলার চেষ্টা করছিল। পুলিশ কোনোমতে তাকে বাঁচিয়ে নিয়ে গেল।
সন্ধ্যার পর তৌসিফ মাথায় হাত দিয়ে সোফায় বসেছিল। মারিয়া তার পাশে এসে বসল। তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
– “ভালোবাসার মানুষের এমন রূপ মেনে নেওয়া সত্যিই খুব কঠিন। কিন্তু যেটা সত্যি, সেটা তো মেনে নিতেই হবে, তাই না?”
– “হুম।”
– “তাহলে এখন কী করবেন?”
– “বাসায় ফিরে যাব। এছাড়া আর কিছু করার নেই। আপনি কী করবেন?”
– “কাল থেকে একটা নতুন বাড়ি খুঁজব। তারপর সেখানে উঠে যাব।”
– “আচ্ছা। ভালো থাকবেন।”
– “আপনি খেয়ে শুয়ে পড়ুন। আজ আমার খেতে ইচ্ছে করছে না। আমি ঘুমাতে গেলাম।”
– “ওকে।”
মারিয়া উঠে চলে গেল। তৌসিফ তার যাওয়ার পথের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসল। তার চোখে ছিল এক গভীর রহস্য। সে শুধু গভীর রাত হওয়ার অপেক্ষা করছিল।
তৌসিফ নিজের ঘরে ঢুকতেই দেখল, সেই কালো বিড়ালটা তার বিছানার ওপর বসে আছে। সে কাছে গিয়ে বিড়ালটাকে কোলে তুলে নিল। তারপর ফিসফিস করে বলল,
– “তুই সাহায্য না করলে আসল সত্যিটা হয়তো কখনোই জানতে পারতাম না। চল, তোকে নিয়ে একটু ঘুরে আসি।”
এই বলে সে বিড়ালটাকে কোলে নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পেছনের জঙ্গলের দিকে হাঁটতে লাগল। হঠাৎ এক বয়স্ক লোক তার পথ আগলে দাঁড়াল। বিড়ালটা তাকে দেখা মাত্রই হিংস্র হয়ে উঠল এবং তৌসিফের কোল থেকে লাফ দিয়ে লোকটির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। কিন্তু লোকটি ছিল প্রস্তুত। সে এক ঝটকায় বিড়ালটার গলা চেপে ধরে তাকে মেরে ফেলল।
লোকটির নাম রুবেল, তিনি একজন কবিরাজ। সে বলল,
– “এই বিড়ালটাই ছিল ওই শয়তানের প্রধান অস্ত্র।”
– “তা না হয় বুঝলাম, কিন্তু প্রধান অ*স্ত্র কীভাবে?”
– “এই বিড়ালের মধ্যে অশুভ শক্তি ছিল। ও যেদিন যার বাসায় যেত, সেই লোকই স্বপ্নে ওই পিশাচিনীকে দেখত। আর ওর মধ্যে মানুষকে টেলিপোর্ট করার ক্ষমতা ছিল। এভাবেই রাতের আঁধারে মানুষ নিখোঁজ হতো। আর ওই পিশাচিনী জঙ্গলের মধ্যে তাদের রক্ত শুষে খেত, তাদের মাংস খেত।”
– “আমি জানি, ওটা প্রিয়া ছিল না।”
– “সেটা আমিও জানি। প্রিয়া নির্দোষ।”
কবিরাজের কথাগুলো শুনে তৌসিফের মুখের সেই রহস্যময় হাসিটা আরও গভীর হলো। সে জানত, আসল খেলাটা এখনও বাকি।
রুবেল মাটিতে একটা বিশাল বৃত্ত আঁকল। তার এই অদ্ভুত কার্যকলাপের কারণ তৌসিফ বুঝতে পারছিল না। তারপর সে তৌসিফের দিকে তাকিয়ে বলল,
– “এই দাগের বাইরে এক পা-ও দেবে না। সে এখানে এলে আটকা পড়বে।”
এই বলে সাদা পাউডারের মতো কিছু একটা দিয়ে সে বৃত্তের চারপাশটা ঘিরে দিল। তৌসিফ জিজ্ঞেস করল,
– “আমি জানি, এই সবকিছু মারিয়া করছে। কিন্তু সবাই প্রিয়ার চেহারা দেখতে পেল কেন?”
– “কারণ সে প্রিয়ার রূপ ধারণ করে সবার স্বপ্নে যেত, যাতে সবাই প্রিয়াকে সন্দেহ করে এবং তাকেই মে*রে ফেলে। আর ওর দিকে কেউ যেন আঙুল তুলতে না পারে। প্রিয়ার শরীরটাও সে তার কালো জাদুর মাধ্যমে ঠাণ্ডা করে রাখত।”
– “কিন্তু মারিয়া কেন এসব করতে চায়?”
– “মারিয়াই হলো সেই জাদুকরের মেয়ে, যাকে পঁচিশ বছর আগে এই গ্রামের মানুষরা মিলে পু*ড়িয়ে মে*রেছিল।”
– “এটা কী করে সম্ভব? আমি তো শুনেছি, বাচ্চা সহ সে মারা গিয়েছিল।”
– “না। তার মা বুঝতে পেরেছিল যে তাকে মেরে ফেলা হবে, তাই সে মৃত্যুর আগে নিজের মেয়েকে এক এতিমখানায় রেখে এসেছিল। মায়ের মৃ*ত্যুর পর সেই পিশাচের আত্মা ওর মেয়ের মধ্যে আশ্রয় নেয়। বড় হওয়ার পর তাকে আর কেউ চিনত না। তাই সে খুব সহজেই প্রতিশোধ নিতে এখানে ফিরে এসেছে।”
ঠিক তখনই তাদের সামনে এসে উপস্থিত হলো মারিয়া। তার সেই রূপ দেখে তৌসিফ চমকে উঠল। শরীরে কুচকুচে কালো একটা গাউন, চোখ দুটো টকটকে লাল, মুখে তাজা রক্তের দাগ। চুলগুলো খোলা, আর মুখের দুপাশে বেরিয়ে এসেছে বিশাল আকারের দুটো সুচালো দাঁত। সে হিসহিসিয়ে বলল,
– “আমার বিড়ালটাকে মেরে ভেবেছিস তোরা বেঁচে যাবি?”
এই বলে সে তার দুই হাত দিয়ে তৌসিফ আর রুবেলের গলা চেপে ধরে শূন্যে তুলে ফেলল। তারা ছাড়ানোর জন্য ছটফট করতে লাগল, কিন্তু পারল না। মারিয়া বলতে লাগল,
– “আমার মাকে তোরা কী জঘন্য ভাবে পু*ড়িয়ে মে*রেছিলি! এর শাস্তি এই গ্রামের সবাইকে পেতে হবে।”
এমন সময় পেছন থেকে পুলিশ ইন্সপেক্টর ইমরানের কণ্ঠস্বর ভেসে এলো,
– “ওদের ছেড়ে দে, নইলে আমি গু*লি চালাতে বাধ্য হব!”
মারিয়া ওদের ছেড়ে দিয়ে পেছনে ঘুরল। ইমরান কিছু বুঝে ওঠার আগেই মাটির নিচ থেকে কঙ্কালের হাত বেরিয়ে এসে তার এবং আরও তিনজন কনস্টেবলের পা এমনভাবে চেপে ধরল যে, নখ বসে র*ক্ত বেরিয়ে এলো। যন্ত্র*ণায় তারা কা*তরাতে লাগল, ক*ঙ্কালগুলো তাদের ক্রমশ মাটির নিচে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল।
এই সুযোগে রুবেল আর তৌসিফ কোনোমতে সেই সাদা বৃত্তের ভেতরে ঢুকে পড়ল। মারিয়া যখন আবার তাদের দিকে এগিয়ে এলো, তখন সে অদৃশ্য এক দেয়ালে ধাক্কা খেয়ে ছিটকে পড়ল। রুবেল চিৎকার করে বলল,
– “তুই এই বৃত্ত থেকে আর বের হতে পারবি না!”
ঠিক তখনই গ্রামের মানুষ মশাল হাতে ছুটে এলো। তারা আর দেরি না করে মারিয়ার শরীরে আগুন ধরিয়ে দিল। ইমরান অনেক চেষ্টা করল তাদের থামাতে, কিন্তু উত্তেজিত জনতার সামনে তার কোনো কথাই টিকল না। মারিয়ার শরীরটা আগুনে পুড়তে লাগল, আর তার শরীর থেকে পিশাচের এক কালো কুণ্ডলী বেরিয়ে এসে রাতের অন্ধকারে মিলিয়ে গেল।
এদিকে পুলিশ প্রিয়াকে ছেড়ে দিল।
সে মারিয়ার ব্যাপারে সব শুনে কান্নায় ভেঙে পড়ল। এতদিন সে যার সাথে একসাথে থেকেছে, তাকে নিজের বোনের মতো ভেবেছে, সে-ই তাকে এভাবে ব্যবহার করছিল! প্রিয়া তৌসিফকে জিজ্ঞেস করল,
– “তুই কীভাবে জানলি যে মারিয়া আমার রূপ নিয়েছিল?”
– “ওর হাতে থাকা ট্যাটুর মতো একটা চিহ্ন দেখে।”
– “মানে?”
– “শোন, সে তোর রূপ ধারণ করলেও তার কব্জির ওই ট্যাটুটা কখনো মুছতে পারত না। স্বপ্নে তোর রূপ নিয়ে গেলেও ওই ট্যাটুটা দেখা যেত। পুলিশ যে স্কেচটা এঁকেছিল, তাতে তোর মুখের আদল থাকলেও কব্জির ট্যাটুটা স্পষ্ট ছিল। আর সেই ট্যাটুটা আমি মারিয়ার হাতে দেখেছিলাম। তোর নিরাপত্তার জন্যই আমি রুবেল আর পুলিশের সাথে মিলে তোকে আটকে রাখার পরিকল্পনা করি, যাতে সে তোর কোনো ক্ষতি করতে না পারে এবং নিশ্চিন্ত থাকে যে সবাই তোকেই সন্দেহ করছে। আর গ্রামবাসীকেও আমি আগেই খবর দিয়ে রেখেছিলাম।”
– “মাত্র অল্প সময়ে তুই এত কিছু করেছিস?”
– “হুম।”
– “সত্যি, তোর মাথায় অনেক বুদ্ধি।”
– “হুম। এখন কী করবি?”
– “কী আর করব? যা করছিলাম, তাই করব।”
– “সেদিন তো আমাকে ফিরিয়ে দিয়েছিলি, কিন্তু বিশ্বাস কর, আমি এখনও তোকে আগের মতোই ভালোবাসি। তোকে বিয়ে করতে চাই।”
প্রিয়া চুপ করে রইল। তৌসিফ ওর হাতটা শক্ত করে ধরে বলল,
– “তুই কতটা কষ্ট পেয়েছিস, আমি জানি। কিন্তু আজকের পর থেকে আমি তোকে আর কোনো কষ্ট পেতে দেব না।”
প্রিয়া আর কিছু না বলে তৌসিফকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। তৌসিফ আকাশের দিকে তাকাল। আজ সে যেন তার ভালোবাসার মানুষটিকে ফিরে পেয়ে একেবারে পরিপূর্ণ হয়ে গেল। সমস্ত ভয়, কষ্ট আর অনিশ্চয়তা পেছনে ফেলে তারা দুজন এক নতুন জীবনের উদ্দেশ্যে পাড়ি দিল।
(সমাপ্ত)