শেষ থেকে শুরু পর্ব-১৮+১৯

0
486

#শেষ_থেকে_শুরু
#পর্ব_১৮
লেখিকা #Sabihatul_Sabha

চারপাশে লাইটিং করা লাল সবুজ বাতি জ্বলছে।

ফুলে ফুলে সাজিয়েছে আজ ছাদঁটা আয়ান, মৌরি সব কাজিন মিলে।

জবা নিজের রুমে বেলীর সামনে বসে আছে।
বেলীর মুখের এই জ্বলজ্বল করা হাসি দেখে জবার কিছু সময়ের জন্য সব দুঃখ কষ্ট ভুলে গেলো৷ মেয়েটা বিয়েতে এতো খুশি যে কেউ ওর মুখ দেখলেই বুঝতে পারবে।

বেলী জবার সামনে কড়া হলুদ শাড়ি নিয়ে বসে আছে।
‘ ভাবি তোমার মতো করে শাড়ি পড়িয়ে দাও’
বেলীর বাচ্চাদের মতো আবদারটা বুকে গিয়ে লাগলো জবার। মনে হলো ছোট বোন সামনে বসে আছে।

জবা শাড়ি হাতে নিয়ে বললো,’ এসো!’
বেলী খুশিতে জবাকে জড়িয়ে ধরে বললো,’ তুমি এতো ভালো কেন.? ‘
‘ তুমিও অনেক বেশি ভালো বেলী, যে যেমন তার কাছে ওপর পক্ষের মানুষটিকে তাই মনে হয়।’

বেলী হেঁসে বললো,’ তোমার জন্যও একটা গিফট এনেছি।’
জবা বেলীকে শাড়ি পড়াতে পড়াতে হেঁসে বললো, ‘ কি গিফট.? ‘
বেলী বুকে হাত দিয়ে পেছনের দিকে হেলে গিয়ে অভিনয় করে বললো,’ এভাবে হেঁসো না প্লিজ আমার হার্টবিট বেড়ে যায়! ‘
জবা বেলীর অভিনয় দেখে খিলখিল করে হেঁসে উঠলো। মুগ্ধ চোখে বেলী তাকিয়ে রইলো জবার দিকে আর মনে মনে বলে উঠলো, ‘ তোমার মুখের এই হাসি ফিরে আসুক, এমন হাসিতে তোমাকে মানায়!’

জবার দিকে বেলীকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে জবা বলে উঠলো, ‘ এভাবে কি দেখছো.?’
‘ তোমাকে!’
জবা মুচকি হেঁসে বললো,’ ইশশ কেন ছেলে হলে না টুপ করে বিয়ে করে নিতাম এই মুগ্ধ চোখের মেয়েটাকে।’
বেলী লজ্জা পাওয়ার ভঙ্গিতে বলে উঠলো, ‘ পরের জন্মে ছেলে হয়ে জন্মনিব তোমার জন্য সুন্দরী! ‘
দুইজন হাসাহাসি করে রেডি হলো। জবা সাজগোজ তেমন পারে না বেলী নিজেই সেজে নিল। বেলী রেডি হয়ে জবার দিকে একটা প্যাকেট এগিয়ে দিয়ে বললো,’ আয়ান ভাই দিতে বলে ছিল তোমাকে এটা তোমার গিফট ‘
জবা তেমন আগ্রহ দেখালো না। প্যাকেটের দিকে একবার তাকিয়ে চোখ ফিরিয়ে নিল।

বেলী আবার বলে উঠলো, ‘ একটা সিক্রেট বলি.?’
‘ হুম বলো’
‘ গিফট আয়ান ভাইয়া করলেও পছন্দ কিন্তু আমার উনি করেছে মানে অভ্র ভাই ‘
তাতেও জবার কোনো তেমন হেলদোল দেখা গেলো না। সে বেলীর দিকে তাকিয়ে গালে হাত রেখে বললো,’ কোনো কালো ছায়া এই মিষ্টি মেয়েটার জীবনে না আসুক, সব সময় এমন প্রাণোচ্ছল হাসিখুশি থেকো, সব সময় এটা মনে রাখবে নিজের সুখ নিজে আদায় করে নিতে হয়, ছিনিয়ে নিতে হয় অন্য কেউ আসবে না সুখী করতে, সবাই আসে দুঃখ দিতে তুমি সিদ্ধান্ত নিতে হবে তুমি কি চাও! দুঃখ নাকি সুখ! এভাবে সব সময় থেকো!’

বেলী আরও একবার জবাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে ফিসফিস করে বলে উঠলো, ‘ তুমি প্রেগন্যান্ট না তাই না.?’

বেলীর মুখে এমন কথা শুনে জবা জেনো ফ্রিজের মতো জমে গেলো।

বেলী শাড়ি ঠিক করে বললো,’ রেডি হয়ে ছাঁদে এসো,এতো অবাক হওয়ার কিছু নেই আমি প্রথম দিন বুঝতে পেরে ছিলাম কাউকে বলবো না।’

__________

মেহেদী অনুষ্ঠান চলছে।

জবা আয়ানের দেওয়া হলুদের মধ্যে লাল পাড়ের শাড়িটা পড়ে ছাঁদে আসলো। মুখে কোনো সাজসজ্জা নেই, চুল গুলো ছেড়ে রেখেছে।

জবার দিকে সবাই হা করে তাকিয়ে আছে। প্রায় সবার চোখ ঘুরে ঘুরে বার বার জবার দিকে আঁটকে যাচ্ছে। একটা মেয়ে কেন এত সুন্দর হতে হবে.? আয়ান বেচারার অবস্থা নাই বলি। মৌরি দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করছে।

একটু পর অভ্র আসলো ছাঁদে। একবার সবার দিকে তাকিয়ে দূরে গিয়ে রেলিঙের উপর বসলো।

বেলী লজ্জায় বার বার লাল হয়ে যাচ্ছে।
পার্লার থেকে মেয়েরা বেলীকে বাকি সব মেয়েদের মেহেদী দিয়ে দিচ্ছে।
বেলীর মেহেদী আর্টিস্ট জিজ্ঞেস করলো ‘ আপু আপনার বরের নাম কি.?’
বেলী লাজুক হেঁসে তাকালো দূরে বসা অভ্রের দিকে। অভ্র মোবাইলে কি জেনো করছে।
‘ অভ্র ‘
মেয়েটা সুন্দর করে মেহেদীর মাঝ খানে ‘ অভ্র ‘ নামটা লিখলো।

বেলীর মনে হচ্ছে সবকিছু স্বপ্নের মতো। এতো সহজে সে তার সখের পুরুষ কে পেয়ে যাচ্ছে। আনন্দে চোখের কোনে পানি এসে জমা হলো। এটা দুঃখের জল নয়, সুখের আনন্দের কান্না।

আয়ান জবার পাশে এসে দাঁড়ালো।
জবার দিকে তাকিয়ে মাথার চুল চুলকে বললো,’ আপনাকে সুন্দর লাগছে।’
‘ ধন্যবাদ ‘
‘ শুধু ধন্যবাদ.? ‘
‘ ত.?’
আয়ান হতাশ হয়ে বললো,’ নাহ্ কিছু না’
জবা ঠোঁটের কোনে হাসি ঝুলিয়ে বললো,’ চলেন কাজী অফিসে ‘
আয়ান দ্রুত অবাক হয়ে জবার দিকে তাকিয়ে বললো,’ কেন.?’
‘ কি বোকা আপনি! কাজী অফিস কেন যায় মানুষ.? ‘
‘ বিয়ে করতে ‘
জবা মুচকি হাসলো।
আয়ান বলে উঠলো, ‘ সত্যি..? আমি ত রেডি এমনিতেই ছোট ভাই বড় ভাইয়ের আগে বিয়ে করে নিচ্ছে লোকে কি বলবে.? চলেন বিয়ে করে নেই’
জবা আয়ানের দিকে ঘুর দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,’ এতো তারাহুরো কিসের.? কোথাও পালিয়ে যাচ্ছি না!’
‘ তবুও বড্ড ভয় হয় যে’
‘ কিসের.? ‘
‘ আপনাকে হারানোর! মনে হয় এই বুঝি আপনাকে হারিয়ে ফেললাম, ঘুম ভাঙলেই আপনি অন্য কারো! ‘

জবা হাঁটতে হাটতে ছাঁদ থেকে নেমে গেলো।
আয়ান তাকিয়ে রইলো জবার যাওয়ার দিকে।
জবা পেছন ফিরে বললো,’ কোথাও যাচ্ছি না আমি! আপনি না গেলেই হলো’

___________

আজ বিয়ে এতো বড় আয়োজন করা হয়েছে চৌধুরী বাড়ির ছেলে মেয়ের বিয়ে বলে কথা।

বেলীকে পার্লার থেকে সাজানো হয়েছে। এক এক কাজিনের হাসি ঠাট্টা শুনে লজ্জায় বেলী মরি মরি অবস্থা!

জবা নিজের রুমে সুন্দর দেখে একটা শাড়ি পড়ে নিল। এটা আসিফ দিয়ে ছিল জবাকে এই বাড়িতে এনে। আসিফের দেওয়া প্রথম শাড়ি ছিল! কোথায় আছে আসিফ.? জবা শাড়িটা গায়ে জড়িয়ে বলে উঠলো, ‘ আমি তোমাকে যেভাবেই হোক খুঁজে বের করবো আসিফ, তোমার কাছে যে আমি অনেক ঋণী।আমার মন বলছে তুমি বেঁচে আছো।

অভ্রকে দেখে সব সময় মনে হয়েছে সে বিয়ে নিয়ে খুশি। জবা খেয়াল করেছে বিয়ে ঠিক হওয়ার পর থেকে অভ্রের কোনো পরিবর্তন হয়নি সে নিষেধ করেনি। সে বিয়েতে রাজি এটা সব সময় বুঝিয়েছে।
বেলী অভ্র খুশি ত জবাও খুশি।
জবা খুব জলদি সবকিছু শেষ করে এই বাড়ি থেকে চলে যাবে। শুধু বিয়েটা শেষ হোক সব কয়টা পাপির মুখুশ টেনে হেঁচড়ে খুলবে।

বেলী জবাকে দেখে হাসলো। জবার মনে হলো ওর দেখা সবচেয়ে সুন্দর মেয়েটি বউ সেজে বসে আছে। কথায় আছে না ‘ বিয়ের সাজে মেয়েদের সৌন্দর্য হাজার গুণ বেড়ে যায় বেলীকে দেখে আজ তাই মনে হচ্ছে।

সামনে দুইজন পেছনে দুইজন বিয়ের ছাউনি মাথার উপর ধরে রেখেছে মাঝে বেলী।
সামনে জবা একপাশ অন্য পাশ মৌরি ধরে রেখেছে।
গান বাজছে, ক্যামেরা ম্যান ভিডিও করছে। দুই পাশে বিয়ের গেস্ট আর মাঝ খান দিয়ে বেলীকে নিয়ে আশা হচ্ছে। বেলীর চোখে মুখে খুশি উপচে পরছে।

বেলীকে স্টেজে বসিয়ে সবাই তাকিয়ে রইলো ছেলে পক্ষ আশার দিকে। সেকেন্ড, মিনিট পেরিয়ে যাচ্ছে কিন্তু কেউ আসছে না।
ছেলের সাথে আয়ান আর কাজিন, বন্ধু আশার কথা কিন্তু কারো কোনো খবর নেই।

কুলসুম বেগম কপালে হাত ঠেকিয়ে বসে আছেন। কি করবেন বুঝে পাচ্ছেন না!

শার্লিন বেগম হেঁচকি তুলে কান্না করছেন। শফিক সাহেব, শরিফ সাহেব গম্ভীর মুখে বসে আছে।

আয়ান দূরে দাঁড়িয়ে তাদের মতিগতি বুঝার চেষ্টা করছে।

__________

সবাই দেখলো ছেলে পক্ষ আসছে আবার গান বাজছে, ভিডিও হচ্ছে, কাজিন, বন্ধুরা নাচছে অথচ বর যেনো পাথর হয়ে গেছে। বরের পা চলছে না।

বেলী স্টেজে লজ্জায় মাথা নিচু করে বসে আছে, বর আসছে বলার পর থেকে লজ্জা ঘিরে ধরেছে।

বর চুপচাপ বেলীর পাশের স্টেজে বসলো।

কাজী বিয়ে পড়ানো শুধু করলো।

প্রথম বেলীকে কবুল বলতে বলা হলো। বেলী খুশিতে ‘ কবুল! কবুল! কবুল বলে চিৎকার করে উঠলো। ‘

নিজের এমন উত্তেজনায় নিজেই লজ্জা পেয়ে গেলো। হেঁসে উঠলো আশেপাশে সবাই।
কাজী হেসে বললো,’ একবার বলতে বলে ছিলাম তিনবার বলে ফেললে! ‘
বেলী মনে মনে বলে উঠলো, ‘ সখের পুরুষ বলে কথা! আর এখন ত বর!’

কাজী এইবার বর কে বলে উঠলো, ‘ শফিক সাহেবের একমাত্র ছেলে আয়ান চৌধুরী আপনি বিয়েতে রাজি হলে বিসমিল্লাহ বলে বলুন ‘ কবুল!’

বেলীর কানে কোনো নাম নয় মনে হলো কেউ আগুনের লাভা ঢেলে দিয়েছে। শরীর থরথর করে কেঁপে উঠল। কাঁপা কাঁপা শরীরে উঠে দাঁড়াতে চাইলে মনে হলো মাথা ঘুরছে।

দাঁড়িয়ে নিজের বরের দিকে তাকিয়ে ‘ এ হতে পারে না ‘ অতিরিক্ত শকটের কারনে জ্ঞান হারালো।

ঢলে নিচে পড়ার আগেই জবা ওকে ধরে ফেললো।

চলবে,
ভুলত্রুটি মার্জনীয়।

#শেষ_থেকে_শুরু
#পর্ব_১৯
লেখিকা #Sabihatul_Sabha

কি আজব! কি আজব! সারাজীবন শুনে আসলো বিয়ের আগমুহূর্তে বউ পালায় আজ দেখলো জামাই পালিয়েছে!

সত্যি পৃথিবী উল্টে গেছে না হলে জামাই কেন পালাবে.?
জামাই পালিয়েছে এটা ধামাচাপা দেওয়া এতো চেষ্টা করেওকোনো লাভ হলো না। মুহূর্তের মধ্যে ছড়িয়ে পড়লো চৌধুরী বাড়ির ছোট ছেলে বিয়ের আগমুহূর্তে পালিয়ে গেছে, ডাক্তার রাফসান চৌধুরী অভ্র বউ রেখে বিয়ের আগমুহূর্তে পালিয়ে গেছে। নিউজ চ্যানেলের ছড়িয়ে পড়লো।

কুলসুম বেগম কপালে হাত দিয়ে বসে আছেন পাশেই চশমাটা পরে আছে। হাত বাড়িয়ে চশমা হাতে নিলেন। ভেতর থেকে একদম ভেঙে পরেছেন আজ, অভ্র এমনটা করবে কল্পনাও করেননি। খুব যত্নে চোখের কোনের জলটা লুকিয়ে ফেললো।

উনি নিজের ভাবনায় নিজেই হেঁসে উঠলেন। বলে উঠলেন, ‘ কল্পনা ত কিছুই করি না অথচ হয়ে যায়! ‘

জবা কুলসুম বেগমের রুমের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় থেমে গেলো। দরজা হাল্কা ভিড়ানো।
জবা একবার ভাবলো উনি ঠিক আছে ত.? পরে নিজেই নিজেকে বলে উঠলো, ‘ যা ইচ্ছে হোক তাতে আমার কি!.?’

__________________

বেলী পিটপিট করে চোখ খুলে আশেপাশে তাকালো।
শার্লিন বেগম মেয়ের বালিশের পাশে বসে আছে। ভয়ে চুপসে আছে মুখখানা।

শরিফ সাহেব মেয়ের জ্ঞান ফিরতে দেখে খুশিতে এসে আস্তে করে বসালো।

ডাক্তার বলেছে রুমে জেনো বেশি কেউ না থাকে তাই শুধু শার্লিন বেগম আর শফিক সাহেব বসে আছেন।

শফিক সাহেব মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘ এখন কেমন লাগছে আম্মু!.?’
শার্লিন বেগম উত্তেজিত হয়ে বলে উঠলো, ‘ বেলী মা আমার তোর কি হয়ে ছিল.? আমি কতো ভয় পেয়ে ছিলাম জানিস.?’
শার্লিন বেগম আঁচল দিয়ে চোখ মুছলেন। দেখেই বুঝা যাচ্ছে মেয়ের টেনশনে কেমন অস্থির হয়ে ছিলেন।

বেলী কারো কথার উত্তর দিচ্ছে না। কারো কোনো কথাই যেনো ওর মাথায় ঢুকছে না। সে আলতু করে মাথায় হাত রেখে চোখ বন্ধ করে সবকিছু মনে করার চেষ্টা করছে।

চোখের সামনে ঝাপসা হয়ে সবকিছু ভেসে উঠলো।

বেলী শফিক সাহেবের দিকে তাকিয়ে বললো,’ সব কিছু স্বপ্ন ছিল তাই না আব্বু.? আজ ত আমার বিয়ে অভ্র ত আমার জন্য অপেক্ষা করছে! ‘

শার্লিন মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন।
বেলী আবার বলে উঠলো, ‘ আমাকে ত রেডি হতে হবে। ভাগ্যিস সবকিছু স্বপ্ন ছিল না হয় কি হতো বলো ত আব্বু.? এতো ভয়ংকর স্বপ্ন কেন আজই দেখতে হলো.? আমার জন্য অভ্র অপেক্ষা করছে আমি রেডি হচ্ছি।’

বেলী উঠতে নিলে শার্লিন বেগম আলতু করে বেলীর হাতটা ধরতেই বেলী বলে উঠলো, ‘ আম্মু আজ আমার বিয়ে আর তুমি নিজের কি হাল করে ফেলেছো.? এই বাড়িতেই ত আছি কোথাও যাচ্ছি না ত!’

মেয়ের এমন অবস্থা দেখে শার্লিন বেগম হুহু করে কেঁদে উঠলেন।

বেলী মায়ের হঠাৎ এমন কান্না দেখে দ্রুত কাছে এসে বললো,’ কাঁদছ কেন.? প্লিজ কেঁদো না আমার কষ্ট হয়’

জবা দরজা ঠেলে রুমে এসে দেখলো বেলী জেগে গেছে।
জবা শার্লিন বেগমের দিকে একবার তাকিয়ে ইশারা করলো রুম থেকে বেরিয়ে যেতে সবটা ও সামলে নিবে।

এই প্রথম শার্লিন বেগমের জবাকে অনেক আপন মনে হলো। মনে মনে আকুতি করে বলে উঠলো, ‘ আমার মেয়েটা কে বুঝাও’

শার্লিন বেগম আর শফিক সাহেব রুম থেকে বেরিয়ে গেলো।
জবা ভেতর থেকে দরজা লাগিয়ে এসে জবার পাশে বসলো।
বেলী জবার দিকে তাকিয়ে বললো,’ সবার কি হয়েছে.? জবা অভ্র কে আমার বর সাজে কেমন লাগছে.?’

জবা হাতে ইশারা করে বেলীকে নিজের কাছে ডাকলো।
বেলী ওর কাছে আসতেই জবা ইশারা করলো ওর কোলে মাথা রাখতে।
বেলী হাসফাস করে বললো,’ জবা আমার জন্য অভ্র অপেক্ষা করছে আজ ত আমার বিয়ে! ‘

জবা বেলীর দিকে তাকিয়ে বললো, ‘ তোমার কি কিছুই মনে নেই..?’

বেলী জিজ্ঞেস করলো কি.?
জবা বলে উঠলো, ‘ আগে কোলে মাথা রেখে শুয়ে পরো বলছি।’

বেলী লক্ষী মেয়ের মতো শুয়ে পরতেই জবা ওর মাথায় হাত বুলিয়ে বলে উঠলো, ‘ বেলী অভ্র তোমার জন্য আর কখনো অপেক্ষা করবে না’

বেলী বলে উঠলো , ‘ আমি ত আর তাকে অপেক্ষা করার সুযোগ ও দিব না ভাবি আজকের পর ত আমি তার’

জবা দীর্ঘ শ্বাস লুকিয়ে বললো,’ বেলী তোমার বিয়ে হয়ে গেছে আয়ানের সাথে তোমার কি কিচ্ছু মনে নেই.? অভ্র আসেনি বেলী!’

বেলী আস্তে আস্তে করে জবার কোল থেকে মাথা তুলে জবার দিকে তাকিয়ে বললো,’ তুমি আমার স্বপ্নের খবর কিভাবে জানলে.?’
জবা করুন দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো, ‘ এটা স্বপ্ন নয় বেলী সবকিছু সত্যি। তুমি অতিরিক্ত শকটে অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার জন্য মনে হচ্ছে সবকিছু স্বপ্ন। ‘

বেলীর মনে হলো কেউ ওর থেকে ওর সবচেয়ে দামী জিনিসটা নিয়ে গেছে, শ্বাস নিতেও কষ্ট হচ্ছে। সেই ছোট থেকে যখন থেকে সে ভালোবাসা কি বুঝতে শিখে তখন থেকে একটা নামই মনে লিখা তা হলো ‘ অভ্র ভাই’ আজ সেই অভ্র ভাই যখন ওর হতে যাচ্ছিল তখন অভ্র ভাই হারিয়ে গেল কেন.? সে কোথায় আছে.? ঠিক আছে ত.?

এমন একটা সিচুয়েশনেও বেলীর অভ্রের জন্য চিন্তা হচ্ছে ভাবতেই তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলো জবা।

জবা রেগে বলে উঠলো, ‘ সে পালিয়ে গেছে বেলী, তোমাকে সে ঠকিয়েছে।’
বেলী এই পর্যন্ত নিজেকে সামলে রাখতে না পেরে বিয়ের শাড়িটা খামচে ধরে চিৎকার করে কাঁদতে শুরু করলো। হারিয়ে গেছে, সবকিছু হারিয়ে গেছে, আজ তার সকল স্বপ্ন হারিয়ে গেছে! অভ্র ভাই তার সাথে এমন কেন করলো.? ভালো না বাসুক পায়ের কাছে ঠাই দিত পালিয়ে কেন গেল.? বেলী কি এতোটাই অযোগ্য.?

জবা বেলীকে রুমে রেখে বেরিয়ে গেলো। কান্না করে নিক ইচ্ছে মতো ভেতর হাল্কা হবে।

শায়েলা সিদ্দিকী নিজের রুমে রাগে গজগজ করছে। মৌরি এক কোনায় বসে ফ্যাচফ্যাচ করে কান্না করে যাচ্ছে।

শায়েলা সিদ্দিকী ওকে ধমক দিয়ে বলে উঠলো,’ তুমি চুপ করবে.? আমি আমার চিন্তায় বাঁচছি না মাথা খেয়ো না!’

‘ আন্টি আয়ান ভাইয়ার বিরুদ্ধে এভাবে তাকে বিয়ে করতে বাধ্য করা একদম উচিত হয়নি ভাইয়া না কিছু করে বসে।’
‘ তোমাকে একবার বলেছি মাথা খেয়ো না ‘

শায়েলা সিদ্দিকী নিজের রুম থেকে বের হয়ে বাহিরে এসে দেখলো সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে হয়তো বাড়ির।

কিছু মেহমান রয়ে গেছে তারা গেস্ট রুমে ঘুমিয়ে আছে।

ঘুম নেই বাড়ির কোনো সদস্যের চোখে। নিজেদের রুমে দরজা বন্ধ করে চিন্তায় ডুবে আছে সবাই।
কুলসুম বেগম কিভাবে মিডিয়ার মুখ বন্ধ করবেন সেই চিন্তায় ঘুম নেই চোখে।

শার্লিন বেগম মেয়ের চিন্তায় ঘুমাতে পারছেন না। কয়েকবার গিয়ে ছিলেন কথা বলতে অথচ বেলী দরজা খুলছে না। মেয়ে না আবার উল্টাপাল্টা কিছু করে বসে সেই চিন্তায় আছেন।

শায়েলা সিদ্দিকী আয়ানের সব বন্ধুর কাছে কল দিয়েছেন আয়ান কোথাও যায়নি। কবুল বলে যে বাড়ি থেকে বেড়িয়ে গেলো আর কোনো খোঁজ খবর নেই ওর। চিন্তায় উনার পেশার বেড়ে যাচ্ছে।

জবা পাশে তাকিয়ে দেখলো জগে পানি নেই। গ্লাস হাতে নিয়ে রুম থেকে বের হয়ে নিচে আসলো।

গ্লাসে পানি ঢেলে চেয়ার টেনে বসে পানি খেয়ে নিল। উঠে দাঁড়াতেই মনে হলো ড্রয়িং রুমে ও ছাড়াও আরও কেউ আছে।
জবা গ্লাসটা সাবধানে হাতে নিয়ে আস্তে করে পেছন ফিরলো।
আবছা ছায়া দেখতেই জবা গ্লাস দিয়ে এট্যাক করতে গেলে ছায়ার মালিক শক্ত হাতে জবার হাত চেপে ধরে ফিসফিস করে বলে উঠলো, ‘ মেরে ফেলবে নাকি.?’

কন্ঠের মালিক কে চিনতে ভুল হলো না জবার। জবা রেগে পা দিয়ে আঘাত করতে চাইলে অভ্র খুব সাবধানে সরে গেলো না হয় আজ তার গোপন জায়গায় জবার এক লাথিয়ে ঘন্টা বেজে যেত।

অভ্র জবার হাত ঘুরিয়ে ওর এক পা দিয়ে ওর পা আর হাত দিয়ে দুইহাত চেপে ধরে নিজের সাথে মিশিয়ে নিলো।
জবার পিঠ অভ্রের বুকের সাথে লেপ্টে আছে।
অভ্র জবার কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলে উঠলো, ‘ তুমি আমার কাছে একটা মশা ছাড়া আর কিছুই না জবারাণী, আমাকে আঘাত করতে এসো না নিজেই ক্ষত বিক্ষত হয়ে যাবে।’

জবা নিজেকে ছাড়ানোর জন্য ছটফট করতে করতে বলে উঠলো, ‘ আমাকে ছাড়ো অসভ্য ছেলে, কোন সাহসে আমার শরীরে টার্চ করেছো.? শুধু একবার সুযোগ পেলে তোমার বুকে ছুরি বসাতে আমি দ্বিতীয় বার ভাববো না!’
অভ্র জবার কথা শুনে মুচকি হেঁসে উঠলো,’ যেই বুকে আজ ছুরি বসাতে চাচ্ছ খুব জলদি সেই বুকে ভালোবাসার গোলাপ ফুটাতে ছটফট করবে!’

,’ তোমার এমন ফালতু চিন্তা ভাবনা দেখে আমার ঘৃণা আসছে আর কিছুই না’

অভ্র আস্তে করে জবার হাত ছেড়ে দিয়ে বললো,’ মানুষ ত ঘৃণা তাকে করে যাকে সে ভালোবাসে তাহলে কি তুমি… ‘
‘ ছিঃ এমন চিন্তা কল্পনায়ও এনো না! তোমার মতো একজন কাপুরুষ কে ভালোবাসার চেয়ে রাস্তার এক বদ্ধ পাগল কে ভালোবাসা ভালো। ‘
অভ্র গম্ভীর মুখে বলে উঠলো, ‘ এই চিন্তা দ্বিতীয় বার ভুলেও মাথায় এনো না। এই মন, মস্তিষ্ক সব জায়গায় আমি থাকবো কোনো বদ্ধ পাগল কেও আমি কল্পনায় সহ্য করবো না!’

জবা রাগে দাঁতে দাঁত চেপে বললো,’ তোমার ডাক্তার দেখানো উচিত তুমি অসুস্থ প্রাণী! একটুও খারাপ লাগছে না আজ তুমি যা করেছো তার জন্য.? ‘

অভ্র আয়েশ করে চেয়ার টেনে বসে বললো,’ কি করেছি.? কই আমার ত কোনো খারাপ লাগছে না!’

জবা রাগে অভ্রের দিকে ঝুঁকে ওর শার্টের কলার চেপে ধরে বললো,’ তুমি আজ একটা নিষ্পাপ মাসুম একটা মেয়ের স্বপ্ন ভেঙে দিয়েছো! তাকে একদম শেষ করে দিয়েছো! এতো মানুষের সামনে ওকে অপমান করতে তোমার কলিজা কাঁপলো না.? ওতো তোমার কোনো ক্ষতি করেনি!’

‘ আমি তোমার কাছে এইসবের জন্য কৈফিঅত দিব না! মাথা ধরে আছে এক কাপ চা বানিয়ে দাও ত’

‘ একজন পাপীরও ত নিজের কাজের জন্য একটু লজ্জা বোদ হয়, খারাপ লাগে, অপরাধ বোধ ভেতর ভেতর শেষ করে দেয় তোমার মধ্যে ত মানুষের কোনো হৃদয় নেই। সেই আগের মতো তোমার হৃদয় নোংরা রয়ে গেছে। নারীদের সম্মান করতে আগেও পারতে না আজও শিখনি।’

অভ্র ঠোঁটের কোনে হাসি ঝুলিয়ে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে রাগে লাল হয়ে যাওয়া জবার দিকে।
চুল হাত খোঁপা করা, ঝগড়া করতে করতে কখন যে শাড়ির আঁচল কোমরে পেঁচিয়ে রেখেছে, কানে ছোট এক জোড়া ঝুমকা, রাগে লাল হয়ে যাওয়া নাক, গাল, চোখ।

অভ্রকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে জবা রেগে চলে যেতে নেয়। মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয় সে বেলীর সাথে হওয়া অন্যাের জন্য অভ্র কে কঠিন থেকে কঠিন শাস্তি দিবে। এরা নারীদের কি মনে করে.? খেলনা.? এতো দূর এনে একা ছেড়ে পালিয়ে যাবে, অপমানে ঝর্ঝরিত হয়ে নারী তখন ভেঙে পরবে! নিজেকে গুটিয়ে নিবে.? আর এরা সমাজে বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়াবে! হাহ্ এদের এভাবে নয় এদের কৌশলে শাস্তি দেওয়া উচিত।

অভ্র পেছন থেকে করুন কন্ঠে বলে উঠলো, ‘ আমি অনেক ক্লান্ত জবা এক কাপ চা বানাতে কতক্ষণ লাগবে.?’
জবা পেছন ফিরে বললো,’ জবা নয়, জবা ভাবি। বড় ভাইয়ের বউ হই ভুলে যান কেন.? অবশ্য আপনার মতো নোংরা মনের মানুষের থেকে আর কি এই বা আশা করা যায়!.’

‘ যেখানে বিয়ে নেই সেখানে ভাইয়ের বউ হাস্যকর না.?’
অভ্রের কথা শুনে জবা চোখ মুখ শক্ত করে বলে উঠলো, ‘ ফালতু কথা কম বলুন, আপনার একটা ভালো ডাক্তার খুব জলদি দেখানো উচিত! ‘

‘ আচ্ছা তুমি হয়ে গেলেই পারো! ‘
জবা বিরক্তিকর দৃষ্টিতে অভ্রের দিকে তাকিয়ে মনে মনে জঘন্য কয়টা গালি দিল।

অভ্র জবার মুখের রিয়াকশন দেখে বলে উঠলো, ‘ গালি দিচ্ছে.? নাকি ভালোবাসার তসবি গুনছো.? ‘
জবা কে কোনো উত্তর দিতে না দেখে অভ্র আবার বলে উঠলো, ‘ তোমার আশিক কাল রাতে বললো ‘ তার ভয় হয়, মনে হয় ঘুম ভাঙলেই সে দেখবে তুমি অন্য কারো হয়ে গেছো অথচ আজ তোমার ঘুম ভাঙতেই সে অন্য কারো হয়ে গেল.? ‘

অভ্র হাসতে হাসতে আবার মুখে দুঃখী দুঃখী ভাব এনে বললো,’ ভীষণ কষ্ট পেলাম জবারাণী তোমার কষ্ট দেখে, এভাবে কথা দিয়ে কথা রাখতে পারলো না.? ‘

জবা দাঁতে দাঁত চেপে বললো, ‘ সে বাধ্য হয়ে করেছে আপনার মতো কাপুরুষের পরিচয় দেয়নি! আর আপনি লুকিয়ে আমাদের সকল কথা শুনে ছিলেন!.?’

‘ লুকিয়ে শুনতে যাব কেন! তোমাদের লাইলি মজলু টাইপ আলাপ সবাই শুনেছে শুধু আমি না’

‘ মিথ্যা কথা কম বলুন! এক ত লুকিয়ে আমাদের কথা শুনেছেন দ্বিতীয় কাপুরুষের মতো পালিয়ে গিয়ে একটা মেয়ের স্বপ্ন, আশা, সম্পূর্ণ তাকেই ভেঙে দিয়েছেন আর এখন এখানে বসে বেহায়া নির্লজ্জের মতো হাসছেন!’

‘ আজ তোমার সব কথা হজম করে নিচ্ছি জবারাণী ভুলেও আর কোনোদিন এই শব্দ আমার সামনে উচ্চারণ করো না। আমি এতোটাও ভালো ছেলে নই।’

‘ তা ত দেখতেই পাচ্ছি, পৃথিবীর সবচেয়ে জঘন্য পুরুষ, পুরুষ নামের কলঙ্ক আপনি! ‘

‘ জবারাণী শান্ত হও, মনের মানুষ পাল্টানো যায় কিন্তু ভাগ্যে যে থাকে তাকে কি পাল্টানো যায়.? বেলীর ভাগ্যে আয়ান ছিল আমি কিভাবে ওকে বিয়ে করতাম.?’

জবা কিছু বলতে গিয়েও বললো না।

‘ এক কাপ চা দিয়ে চলে যাও না হয় তোমার কপালে সত্যি আজ শনি রবি সবকিছু আছে। ‘

জবা নিজেও কথা বাড়াতে চাইলো না। কথা বাড়ালেই কথা বাড়ে।

চুপচাপ চা বানিয়ে অভ্রের সামনে ধরলো।
অভ্র এতোক্ষণ মাথা নিচু করে কিছু ভাবছিল।
জবার ডাকে ওর দিকে তাকিয়ে চা হাতে নিতে হাত বাড়ালে জবা চায়ের কাপ ছেড়ে দিল।
অভ্র চায়ের কাপ ধরার আগেই জবা কাপ ছেড়ে দিয়ে ছিল যার ধরুন গরম চা গিয়ে পরে অভ্রের হাঁটুতে।

অভ্র যন্ত্রণায় চোখ মুখ খিঁচে চেয়ার শক্ত করে চেপে ধরে যন্ত্রণা সহ্য করে নিচ্ছে।

জবা ঠোঁটের কোনে হাসি ঝুলিয়ে তাকিয়ে আছে ব্যাথার যন্ত্রণায় রক্তিম হয়ে যাওয়া অভ্রের মুখের দিকে।

_________

মধ্য রাত বেলী ফ্যালফ্যাল চোখে তাকিয়ে আছে অন্ধকার বাহিরের দিকে।
জানালায় মাথা ঠেকিয়ে তাকিয়ে আছে চোখ থেকে এখনো এক ফোঁটা এক ফোঁটা জল গড়িয়ে পরছে, থেমে থেমে বেলীর শরীর কেঁপে উঠছে। দার অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে জেনো নিজের ভবিষ্যত দেখতে পাচ্ছে, এই অন্ধকারের মতো নিজের জীবনটা মনে হচ্ছে।

যে ছেলে কখনো সিগারেট হাতে নিয়ে চায়নি আজ সেই ছেলে নেশা করে রাস্তার মোড়ে উল্টে পড়ে আছে! হঠাৎ করে সেকেন্ডে বুঝি জীবন এভাবে পাল্টে যায়.? পৃথিবীর সবচেয়ে বড় যন্ত্রণা কি জানো.? প্রিয় মানুষ হারানোর যন্ত্রণা! এই যে আজ দুইটা হৃদয় ভেঙে গেলো! সাজানো স্বপ্ন তাদের সেকেন্ডে মিথ্যা হয়ে গেলো এর থেকে বড় যন্ত্রণা আর কি হতে পারে.? মানুষটা নিজের হতে গিয়েও নিজের না এর থেকে বড় যন্ত্রণার কি হতে পারে.?

চলবে,
ভুলত্রুটি মার্জনীয়।