শেষ থেকে শুরু পর্ব-২২+২৩

0
322

#শেষ_থেকে_শুরু
কলমে: লাবণ্য ইয়াসমিন
পর্ব:২২

পায়ের উপরে পা তুলে শরবতের গ্লাসে চুমুক দিলো আবির। মেয়ে দেখতে আসলে প্রথমে মেয়েকে দিয়ে নবাগত অতিথিদেরকে শরবত দেওয়ার প্রচলন বাংলার অতি প্রাচিন প্রথা নাকি আধুনিক বিষয়টা ওকে বেশ ভাবাচ্ছে। কিছুক্ষণ আগেই অনিমা সবাইকে এক গ্লাস করে শরবত পরিবেশ করেছে। শাড়ি পড়ে লজ্জা লজ্জা মুখে শরবত পরিবেশনের সময় আবির থতমত খেয়ে গিয়েছিল এই মেয়ের কাজকর্ম দেখে। কে বলবে এই মেয়েটাই ওয়েস্টার্ন ড্রেস পড়ে ইউনিভার্সিটির ছেলেগুলার মাথা থেকে মন সব কাঁপিয়ে দিতে উস্তাদ। আবির নিজেকে শান্ত রেখে বসে আছে। আপাতত ভূলে গেছে সামনে শাড়ি পরিহিত লজ্জাবতী লতা মেয়েটা ওর প্রিয় বন্ধু অনিমা। যার ছয় মাস বয়সী ছোট্ট একটা পুতুলের মতো মেয়ে আছে। অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে যার পিতা রোহান শেখ। কথাটা ভাবলেই মেজাজ বিগড়ে যায় আবিরের। একটা মেয়েকে এই অবস্থায় ফেলে আবারও বিয়ের কথা ভাবছে নরপিশাচটা। হঠাৎ পাশ থেকে ফিসফিস আওয়াজ শুনে আবিরের ধ‍্যান ভাঙলো। পাশ থেকে রোহানের মা চাপা কন্ঠে ওকে বলল,

> মেয়ের বয়সের সঙ্গে রোহানের বয়সটা মিলিয়ে নিলে ভালো হতো না? সম বয়সী লাগছে একটু।

আবির চোখ গোলগোল করে ঢোক গিলে বলল,

> আন্টি সুন্দরী মেয়েদের বয়সের কথা জিঞ্জাসা করতে নেই। এতো সুন্দর একটা মেয়ে পাচ্ছেন এটাই কি কম কথা? ভালো পরিবার সঙ্গে সুন্দরী মেয়ে আর কি চাই বলুন? যদি রোহানের জন্য না পছন্দ হয় তাহলে ছেড়ে দেন এই মেয়ের পাত্রের অভাব হবে না।

আবিরের কথার মানে ভদ্রমহিলা বুঝতে পেরে নড়াচড়া করে বসে দ্রুতকন্ঠে বলল,

> আরে না অপছন্দের প্রশ্নই আসে না। মেয়েটাকে আমার খুব পছন্দ। বাবা তাহলে কি আংটি পরিয়ে দেবো?

> সে আর বলতে? পরিয়ে দিন। আর আপা দুলাভাইকে একটু জিঞ্জাসা করেন যদি কোনো সমস্যা থাকে।

> আচ্ছা।

ভদ্রমহিলা আবিরের নির্দেশ অনুযায়ী রাজীব আর চয়নিকার থেকে জেনে নিলো ওদের পছন্দ হয়েছে কিনা। চয়নিকা মিশুক মানুষ সহজে মানুষের সঙ্গে ওর ভাব জমে যায়। এখানেও তাই হয়েছে। অনিমার সঙ্গে এটা ওটা নিয়ে বসে বসে গল্প করছে। আবির শুধু মুগ্ধ হয়ে দেখছে সবাইকে। এতোটা সহজে প্লানমাফিক কাজ হবে ভাবতেই পারেনি। রোহান যদি আসতে রাজি হতো এখানে প্লান বি রেডি ছিল। সেখানে একটু ঝামেলা ছিল তবে এখন আর কোনো ঝামেলা নেই। আপাতত নেই। রোহানকে ওর চেনা আছে বিয়ের দিন ছাড়া বউকে দেখতে চাইবে না। ব‍্যবসা নিয়ে বিজি আছে। কিছুবছর পরে বড় একটা ভুড়ি হবে আবির ওকে অভিশাপ দিয়েছে। নড়াচড়া করতে হলে লোকজনের সাহায্য নিতে হয় এমন ভুড়ি। চয়নিকার বেশ পছন্দ হয়েছে অনিমাকে দেখে। সব কিছুই ঠিকঠাক হয়ে গেলো। আংটি পরিয়ে দিন তারিখ ঠিক করা হলো। আবির বলে দিল সামনে ওর একটা মিটিং আছে যদি বিয়েটা তাড়াতাড়ি না হয় তবে ও থাকতে পারবে না। রোহানের মা আবিরের উপরে কৃতজ্ঞতার খাতিরে সত্যি বিয়েটা এক সপ্তাহের মধ্যেই রাখলো। এখনকার যুগে টাকা পয়সা থাকলে আয়োজন করতে বাধে না। তাছাড়া কমিউনিটি সেন্টারে বিয়ে হবে সমস্যা কোথায়? সব ঠিকঠাক করে সবাই বেরিয়ে আসলো। আসার আগে চয়নিকা ছবি উঠাতে চেয়েছিল কিন্তু আবির বলল রোহানকে সবাই চমকে দিবে। আধুনিক যুগে মেয়ে না দেখে বিয়ে হয়না বললেই চলে যদি হয় তাহলে কেমন হবে এটা ওটা বুঝিয়েছে আবির। পুরো ঝড় গেছে ওর উপর দিয়ে। মাথার চুলগুলো এলোমেলো হয়ে আছে। টেনশন হলেই ও মাথার চুলধরে টানাটানি করে। বাড়িতে ফিরে ও হাপ ছেড়ে বাঁচলো। মনে মনে বিড়বিড় করলো, পাত্রী দেখতে গিয়েই তোর এই হাল!এখনো বিয়ে, গায়ে হলুদতো বাকী। কি হবে তোর?। চারদিকে হাজারো ক‍্যামেরা গায়ে হলুদের দিন রোহান যদি বউয়ের ছবি দেখে তখন কি হবে? ঘাবড়ালে চলবে না। বন্ধুদের সঙ্গে নিয়ে প্লান করতে হবে ভেবে ফ্রেস হয়ে বিছানায় সোজা হয়ে শুয়ে পড়লো। একটু ঘুমানোর দরকার ছিল রাতে হাসপাতালে যেতে হবে। কথাগুলো ভেবে ও গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলো।
_______________________

মেয়েকে কোলে নিয়ে বসে আছে হৈমন্তী। মেয়েটা ঘুম থেকে উঠেই পাপা পাপা করছে। হৈমন্তী ভ্রু কুচকে আছে। পাপাকে ডাকছে কিন্তু কেনো বুঝতে পারছে না। চয়নিকা বাড়িতে নেই। রোহানের জন্য মেয়ে দেখতে গিয়ে মায়ের সঙ্গে ও বাড়িতেই আছে। রুনিও নেই। আরাফাত অফিসে গিয়েছিল ফিরবে হাসপাতাল হয়ে। অরিনকে বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে ফিরবে। বাড়িটা কেমন শুনশান হয়ে আছে। বহুকাল লোকজনের সঙ্গে থেকে একা থাকাটা কেমন বিরক্তিকর লাগছে। আমেনা বেগম ঘরে আছে। সে বিশেষ দরকার ছাড়া ঘরের বাইরে আসেনা। খলিল মির্জ সারাক্ষণ খবরের কাগজ নয়তো বইয়ের পাতায় মুখ গুজে বসে থাকে। হৈমন্তী মেয়েকে কোলে নিয়ে বাইরে বেরিয়ে আসলো। মেয়েটা মাঝেমাঝেই মামা পাপা যাবো বলছে। হৈমন্তী মেয়েকে আদুরে গলাই বলল,

> পাপা অনেক দূরে মাম্মা। এখন যাওয়া যাবে না।

মেয়েটা মিনমিন কন্ঠে বলল,

> পাপা গুড় তুমি পচা।

হৈমন্তী মলিন হাসলো। মেয়েটা হঠাৎ পাপা পাপা কেনো করছে এটা ওর বোধগম্য হচ্ছে না। হৈমন্তী মেয়েকে আবিরের ছবি দেখিয়েছে সেই সঙ্গে জানিয়েছে এটাই ওর পাপা। সকলে জিঞ্জাসা করতো জান্নাতের বাবা কোথায় আছে। হৈমন্তী কৌশলে এড়িয়ে গেছে বিষয়টা। তবে মেয়েকে দত্তক নিয়েছে এটা বলতে হৃদয় কেঁপে উঠে। জীবনে কখনও কারো কাছে স্বীকার করবে না এই নিষ্ঠুর সত্যিটা। জান্নাত ওর বাবাকে চিনে এটাই অনেক। মেয়েকে নিয়ে হৈমন্তী আজীবন কাটিয়ে দিতে পারবে। এটা তো সামান্য সুখ না। মা হওয়ার পরে নারীর জীবনে আর কি বাকী থাকে। সকল সুখ সন্তানের মায়াময় মুখে আটকে থাকে। হৈমন্তী আবিরের আবদার অনুযায়ী ওর ছবি নিয়মিত দেখিয়েছে। কথা দিয়েছিল সেই কথা ও রেখেছে এর বেশিকিছু না। তবে পরে ওর মনে হয়েছিল আবির এখন আবেগে ভেসে মেয়ে নিয়ে বাড়বাড়ি করছে কিন্তু পরবর্তীকালে যখন ও আবার বিয়ে করবে তখন কি পারবে এই দত্তক নেওয়া মেয়েকে স্বীকার করতে? এটা ভেবে ও সিদ্ধান্ত নিয়েছিল কখনও মেয়েকে আবিরের ধারেকাছেও ঘেঁসতে দিবে না। হৈমন্তীর মেয়েকে অবহেলা করার সুযোগ কেউ কখনও পাবেনা। কথাগুলো ভাবতে ভাবতে হৈমন্তী রান্নাঘরের দিকে এগিয়ে গেলো। কাজের মেয়েকে বাচ্চার খাবার গরম করে দিতে বলতেই জান্নাত আধো আধো করে বলল,

> থাবো না মাম্মা। পাপা যাবো

হৈমন্তী ওকে নিয়ে সোফায় গিয়ে বসলো। শরীর প্রচণ্ড ক্লান্ত। ঘুমাতে পারলে কিছুটা শান্তি পেতো কিন্তু মেয়েকে খাওয়াতে হবে। পাপার জন্য এমন উতলা হতে দেওয়া চলবে না। হৈমন্তী জান্নাতকে এটা ওটা বলে শান্ত করছিল এমন সময় আরাফাত অরিনকে নিয়ে ভেতরে আসলো। হৈমন্তী অরিনকে দেখে আবেগাপ্লুত হয়ে কেঁদে ফেলল। জান্নাতকে সোফায় বসিয়ে দৌড়ে গিয়ে ওকে জড়িয়ে নিয়ে বলল,

> কতদিন পরে দেখা হলো। কেমন ছিলে?

> আলহামদুলিল্লাহ্ আল্লাহ্ যেমন রেখেছেন তেমনই আছি। তুমি পালিয়ে গেলে একবারও খোঁজ নিলে না। কতটা ঝামেলায় ছিলাম যদি জানতে।

হৈমন্তী হেঁসে বলল,

> খুব সরি,স্বার্থপর হয়ে গিয়েছিলাম জীবন বাঁচাতে। ভেবেছিলাম মেয়েকে নিয়ে কখনও তোমাদের মুখটা দেখতে পাবো না। তবুও দেখলাম।

হৈমন্তী জান্নাতকে নিয়ে ওর কোলে দিয়ে বলল,

> আমার মেয়ে জান্নাত। জান্নাত এটা তোমার আরেকটা মাম্মা।

জান্নাত ফ‍্যাল ফ‍্যাল করে তাকিয়ে থাকলো। আরাফাত এসে জান্নাতকে নিয়ে গেলো। হৈমন্তী পুরাতন বন্ধুকে পেয়ে ক্লান্তি ভুলে গিয়ে গল্প জুড়ে দিলো। অরিন চেষ্টা করছে জান্নাতের বাবার পরিচয় বের করতে কিন্তু হৈমন্তী কথা ঘুরিয়ে দিচ্ছে। এটা ওটা বলে। অরিন মুখটা মলিন করে বলল,

> বিয়ে করতেই হলো তাহলে আমার ভাইয়া কি দোষ করেছিল হৈমি? ছেলেটা এখনো দুঃখ পাচ্ছে। তোমাকে মনে করে।

হৈমন্তী চমকে উঠলো। গলা শুকিয়ে যাচ্ছে। আবির কথা রেখেছে কাউকে ওদের সত্যিটা বলেনি এটা ভেবে কিছুটা স্বস্তি পেলো। ও কোনোরকম ঢোক গিলে বলল,

> বিয়ে বিষয়টা আমার কাছে বিষাক্ত কাটার মতো ছিলো। বিয়ে আমাকে সামান্য পরিমাণ সুখও দেয়নি বরং বাধ ভাঙা দুঃখ দিয়েছে। আমাকে বেঁচে থাকতে মৃত বানিয়ে দিয়েছিল সেই অবস্থায় কিভাবে পারতাম আরেকজন মানুষকে সুখী করতে? বারবার নিজের খারাপ অতীত আমাকে যন্ত্রণা দিতো। না নিজে ভালো থাকতাম না মিস্টার আবিরকে ভালো রাখতে পারতাম। উনাকে বলবা মেয়ে দেখে বিয়ে করে ফেলতে।

অরিন কিছু বললো না। শুধু দীর্ঘনিশ্বাস ফেলল। আবিরের সম্পর্কে ওর ভালো ধারণা আছে। হৈমন্তীর আশেপাশে ঘেঁষবে না তবুও জিদ করে থাকবে। অযথা ওর কথা বলা ঠিক হয়নি। হৈমন্তী মেয়েকে নিয়ে ভালো আছে এটাই অনেক। আরাফাত রাজীব আর চয়নিকা হৈমন্তীর সত্যিটা জানে। বাকীদের বলা হয়নি। অরিন ভেবেছে হৈমন্তীর বিয়ে হয়েছে।
___________
আবির বন্ধুদের সঙ্গে কথাবার্তা মোটামুটি বলে নিয়েছে। রোহানের মায়ের সঙ্গে কথা বলে বিয়ের দিন গায়ে হলুদের ব‍্যবস্থা করেছে। আর যাইহোক ঘটা করে গায়ে হলুদ দিলে ঝামেলা আছে অনেক। কোনরকম রিস্ক নেওয়া ঠিক হবে না। জান্নাতকে দেখতে ইচ্ছা করছিল বহুকষ্টে তা দমিয়ে রেখেছে। জান্নাতকে ফিরিয়ে দেওয়ার আগে একশো ছবি উঠেছে বাপ মেয়ে মিলে। চমৎকার সেই ছবি। ছবিগুলো মনোযোগ দিয়ে দেখছিল সেই মূহুর্তে ফোন আসলো। আবির বিরক্ত হলো তবুও রিসিভ করলো কারণ রোহান ফোন করেছে। আবির কানে ধরতেই ওপাশ থেকে বলে উঠলো,
> বন্ধুর বিয়েতে বন্ধু থাকবে না এমনকি কখনও হয়েছে? পরশুদিন আমার বিয়ে। পুরাতন শত্রুতা ভূলে যা বন্ধু।
আবিরের দম আটকে আসছে হাসিতে তবুও নিজেকে শান্ত রেখে বলল,
> সত্যিই বিয়ে করছিস? অনিমাকে ছেড়ে দিলি তাহলে?
> এক লক্ষ টাকা দিয়েছিলাম। এই টাকায় হাসপাতালের খরচ হয়ে গিয়েছিল। দেখ হয়তো নতুন করে জীবন শুরু করেছে। আমার মা মেয়ে দেখেছে এখানে আমার কিছু বলার নেই আবির। বুঝিসতো মা কেমন মানুষ?
আবিরের ইচ্ছে হলো ব‍্যাটাকে দুটো লাথি দিতে। কত মায়ের কথা ভাবে এটা আবিরের জানা আছে। সময়ের অপেক্ষা শুধু। আবিরকে চুপ থাকতে দেখে রোহান তাড়া দিয়ে বলল,
> কিরে আসবি না?
> আসবো আমি। বিয়ের গায়েহলুদ থেকে শুরু করে শপিং সব কিছুতেই অংশগ্রহণ করবো আমি চিন্তা করিস না। আসতেই হতো আমাকে। যাইহোক মেহুল এসেছে ওকেও ডেকে নিবো কিন্তু।
রোহান খুশীতে আটখানা হয়ে বলল,
> নতুন পুরাতন সব বন্ধুদেরকে আমার বিয়েতে বলে দিব আসতে।
আবির টুকটাক কথা বল‍ে রেখে দিল। বন্ধুদের মধ্যে আগে থেকেই পরিকল্পনা হয়ে গিয়েছে। ওরা জানতো রোহান ওদেরকে বলবে। তাছাড়া গায়ে হলুদের দায়িত্ব বন্ধুদের নিতে হবে। এ বাড়ির কোনো আত্মীয় হলুদের সকালবেলায় মেয়েকে দেখবে না। ছবি টবি তুললে ঝামেলা হবে। আবির কোনো কাচা কাজ করবে না। তাছাড়া মেয়ের পরিচয়ে যথেষ্ট গোলমাল করেছে। অনিমার জায়গাই শুধু অনি বলে পরিচয় দিয়েছে। এভাবেই দুদিন পার হলো। আবির বন্ধুদের নিয়ে রোহানের বিয়ের আয়োজনে ব‍্যস্তদিন পার করছে। চয়নিকা ও বাড়ি থেকে হৈমন্তীকে আসতে বলেছিল কিন্তু ওর এখন ছুটি নেই। বলেছে বিয়ের দিন যাবে কমিউনিটি সেন্টারে। তাছাড়া অরিনের অবস্থাও সেম। অরিন আর আরাফাত পালা করে আবিরের অনুপস্থিতে হাসপাতাল সামলাচ্ছে।
____________

বিয়ের দিন সকালবেলা,
গায়ে হলুদ আর বিয়ে যেহেতু একদিনে সেহেতু লোকজন সব চলে এসেছে। আবিরের কাজকর্মে প্রচণ্ড খুশী রোহান। বন্ধ মহল পাম দিচ্ছে রোহানকে যে এই যুগে এসেও সে মায়ের পছন্দের মেয়েকে না দেখে বিয়ে করছে। রোহান ভাব নিচ্ছে আর ফুলছে। আবির চেয়েছে এবারের বাসরঘরে গিয়ে রোহান নিজের বউয়ের মুখটা দেখুক। ঝটকা খেয়ে যখন মাটিতে থুবড়ে পড়বে সেই মূহুর্ত্তের একটা ভিডিও আবির অবশ‍্যই ধারণ করবে। বন্ধুদের মধ্যে চাপা উত্তেজনা কাজ করছে। গায়ে হলুদ শেষ হওয়ার পরে আবির দুটো মদের বতল নিয়ে রোহানের ঘরে এসে হাজির হলো। রোহান ওর হাতে মদের বোতল দেখে হতবাক। তাছাড়া আবির বা রোহান কারোরি ড্রিঙ্কস সহ‍্য হয়না। একবার খেয়েছিল ইউনিভার্সিটিতে থাকতে। বমি হয় সেই সঙ্গে মাথা ঝিমঝিম করে চোখে ঝাপসা দেখে। বিরক্তিকর অনুভূতি। রোহান আতঙ্কে ফিসফিস করে বলল,
> পাগল হয়েছিস আজকের দিনে এসব কি?
> শোন বিয়ে মানুষ একবারই করে একটু মজা মাস্তি না করলে চলে? বন্ধুদের সঙ্গে শেষ আড্ডাটা দিয়ে যা না ভাই। সবাই চাইছে। বউ আসলে কি আর তুই সিঙ্গেল থাকবি? তাছাড়া এটা খুব ভালো ড্রিঙ্কস। কোনো সমস্যা হবে না।শুধু মনটা খুশী খুশী থাকবে। প্রেম প্রেম পাবে আরকি।

রোহান মুখটা কুচকে ফেলল। কিন্তু বন্ধুরা সবাই মিলে জোরজবরদস্তি শুরু করলো। বাধ্য হয়ে রোহান বন্ধুদের সঙ্গে বসে ড্রিঙ্কস করলো কিন্তু ঝামেলা হলো আবির নিজেও খেয়ে নিয়েছে। দুবোতল ছিল। ওরা রোহানকে বেশিটা দিয়ে নিজেরা সামান্য নিলো। রোহানের অবস্থা মোটামুটি নাজেহাল। দুবার বমি করে ক্লান্ত হয়ে শুয়ে পড়লো। বেহুশ হয়নি টনটনে জ্ঞান আছে। তবে বেশিক্ষণ থাকবে না আবির এটা শিউর। সবাই রেডি হয়ে বিয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লো।

****
কিছুক্ষণ আগে অনিমার সঙ্গে রোহানের বিয়ে শেষ হয়েছে। রোহান প্রশ্ন ছাড়াই সব করছে। মনে হচ্ছে কাঠের পুতুল।সোফায় পা তুলে আবির বসে বসে ঝিমুচ্ছে। দূর থেকে হৈমন্তী ওকে লক্ষ করছে। ওর ভ্রু কুচকে আছে। ছেলেটার এমন ব‍্যবহার ওকে ভাবাচ্ছে। জান্নাত পাপা পাপা করে ওকে ডাকছে। হৈমন্তী মেয়েকে নিয়ে আবিরের পাশে গিয়ে বলল,
> মিস্টার আবির আপনি ঠিক আছেন?
আবির ঝাপসা চোখে তাকিয়ে কিছুই বুঝতে পারলো না। চোখ বন্ধ হয়ে আসছে। অনেক কষ্টে এতক্ষণ নিজের সামলে রেখেছে আর হচ্ছে না। কেমন বমি বমি পাচ্ছে। হৈমন্তীকে সামনে দেখে ও আনমনে বলল,

>কে আপনি?

হৈমন্তীর মেজাজ খারাপ হলো। একদিন ওর জন্য এই ছেলের প্রেম উথলে পড়ছিল আর আজকে চিনতেই পারছে না। মুখোশধারি লোকজন। ও বিরক্তি নিয়ে চলে আসতে গেলো কিন্তু হলো না। জান্নাত চিৎকার করছে। আবির জান্নাতের দিকে হাত বাড়িয়ে বলল,
> আমার মেয়ের মতো আপনার মেয়েটা। মাম্মা আসবে আমার কাছে?
জান্নাত আবিরের কাছে চলে গেলো। হৈমন্তীর বোধগম্য হচ্ছে না কিছুই। তবুও নিজেকে শান্ত রেখে বলল আপনার শরীর ঠিক নেই বাড়িতে যান। ওকে দিন আমাকে। আবির জান্নাতকে ওর কোলে দিয়ে মুখ চেপে দৌড়ে বাথরুমে চলে গেলো। আবিরের মস্তিষ্কে হৈমন্তী এইটুকু স্মৃতি আটকে থাকতে পারলো না। বাথরুমে গিয়ে বমি করে ক্লান্ত হয়ে রোহানের মায়ের পাশে বসে পড়লো। এখুনি বাড়িতে ফিরবে সবাই। রোহান স্টিলের মতো বসে আছে। সুযোগ খুঁজছে শুয়ে পড়ার। ছটফট করছে কখন বাড়িতে ফিরবে। বমি করার পর আবিরের বেশ ভালো লাগছে। সুস্থ সুস্থ লাগছে। জীবনে আর এসব মুখে তুলবে না। বন্ধুদের মধ্যে শুধু ওদের দুজনের সমস্যা হয়। তাছাড়া সবগুলো একদম ফিট আছে। আগামীকাল অনুষ্ঠান আছে। আবির রোহানের মায়ের পাশে বসেছিল। ভদ্রমহিলা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছে। আবির আনমনেই বলে ফলল,
> আন্টি আপনার ছেলে দারুণ চতুর। কি করেছে জানেন বিয়ের আগেই বাবা…..
আবির আর বলতে পারলো না। ওর বন্ধু সজীব হন্তদন্ত দৌড়ে এসে ওর মুখ চেপে ধরে বলল,
> আন্টি ওর শরীর ভালো নেই। আপনারা আসুন আমরা বরং যায়। অনেক কাজকর্ম করেছে ক্লান্ত আছে।
ভদ্রমহিলার সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। আবিরের অবস্থা দেখে উনি মোটামুটি সন্দেহ করছে কিছু খেয়েছে কিন্তু তাই বলে রোহানের নামে এতবড় কথা বলবে? উনি প্রশ্ন করতে চাইলো কিন্তু হলো না। সজিব ওকে জোরকরে নিয়ে আসলো। একবারে গাড়িতে গিয়ে বসলো। সজিবের বারোটা বেজে গেছে এই দুটোকে সামলাতে গিয়ে। রোহান উদ্ভুট কাজকর্ম করছে। বউয়ের মুখের দিকে উঁকি দিয়ে দেখার চেষ্টা করছে। কিন্তু ঝাপসা চোখের জন্য দেখতে পারছে না। অনিমা হাসিখুশি মুখ নিয়ে ছবি উঠেছে। আজকেতো ওর দিন। আগামীকালের জন্য সবাই অপেক্ষা করছে। চাপা উত্তেজনা সকলের মধ্যে।
(চলবে)

ভুলত্রুটি মার্জনা করবেন

#শেষ_থেকে_শুরু
কলমে: লাবণ্য ইয়াসমিন
পর্ব:২৩

আবিরকে বিছানায় রেখে ধপ করে সোফায় গা এলিয়ে দিলো সজীব। শরীরে শক্তি নেই সব ক্ষয় হয়ে গেছে আবিরকে গাড়ি থেকে টেনে বের করতে গিয়ে। আরশী বারবার জিঞ্জাসা করছিলো ওকে বলা হয়নি আবিরের কি হয়েছে। ওকে শুধু বলা হলো আবিরের শরীর খারাপ একটু বিশ্রাম দরকার। ফারজানা হক স্বামীর কাছে গিয়েছেন। বাড়িতে আরশী আর কাজের দুজন মানুষ। সজীব চলে যেতে চেয়েছিল কিন্তু ফিরে যেয়ে আর ইচ্ছে করছে না। সারাদিন প্রচুর খাটতে হয়েছে। তারপর আবার আবির আর রোহানের অদ্ভূত কাণ্ডকারখানা ওকেই সামলাতে হয়েছে। সজীব বিড়বিড় করে বলল,”দুটোই একরকম আস্ত মিটকে শয়তানের নানা। “আবির গভীর ঘুমে তলিয়ে গেছে। সজীব উঠে গিয়ে দরজা ভালো করে বন্ধ করে আবিরের পাশে ঘুমিয়ে গেলো। দরজার ওপাশে কৌতূহলী দৃষ্টি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আরশী। আবিরের কি হয়েছে জানাটা ওর খুব দরকার। খালামনিকে সব বলতে হবে। নেশা টেশা করে নাকি এসব জানাটাও জরুরি। দুদিন পরে যার সঙ্গে ওর বিয়ে সে কিনা মদ খেয়ে টাল হয়ে বাড়িতে ফিরে এটা ও সহ‍্য করবে না। কিছুতেই না। কথাগুলো ভেবে ও দুবার দরজায় ধাক্কা দিলো কিন্তু ভেতরে যারা আছে তাদের কান পযর্ন্ত পৌচ্ছালো না। শেষমেশ রেগে চলে গেলো।
**
বাসর ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে আছে রোহান। ভাইবোনেরা আর বন্ধুরা মিলে ওকে আটকে দিয়েছে। পকেটে কোনো ক‍্যাশ টাকা পয়সা নেই যে সেগুলো দিয়ে ও ঘরে ঢুকবে। কারো থেকে যে নিবে এটাও মাথায় আসছে না। ইচ্ছে করছে মেঝেতেই গড়িয়ে পড়তে। ক্লান্ত শরীর সঙ্গে ঘুম ওকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরেছে। না পেরে দরজার সামনে পা মেলে বসে পড়লো। সকলে হৈচৈ শুরু করেছে। রোহানের এমন অদ্ভুত ব‍্যবহারে সকলে বিরক্ত। বোনেরা বলল যেহেতু ও কথা বলার পর্যায়ে নেই সেহেতু আজ না নিয়ে সকালবেলায় নিলেই হবে। ও তো আর পালিয়ে যাচ্ছে না। কিন্তু বন্ধুরা একদম অনড় বদ্ধপরিকর কোনোরক বাকী চলবে না। তাছাড়া ওরা তো জানে আগামীকাল কি হতে চলেছে। রিস্ক নেওয়া যাবে না। শেষমেশ রাজীব এসে সমস্যার সমাধান করলো। রোহানের একাউন্ট থেকে নিজের একাউন্টে টাকা নিয়ে ওদেরকে ক‍্যাশ দিয়ে দিল। রাজীব বলেছিল নিজেই দিবে কিন্তু কেউ মানতে চাইলো না। যার বিয়ে সেই টাকা দিবে। কোনো দুলাভাইয়ে আজ ঘাসজল খাবে না। দরজা খোলা দেখে রোহানের চোখদুচো আরও বন্ধ হয়ে আসতে চাইলো। কিসের বউ দেখা বিছানায় গিয়ে ধম করে শুয়ে পড়লো। টুপিটা ফ্লোরে গড়াগড়ি খাচ্ছে। অনিমা ভ্রু কুচকে আবিরকে বকছে। এতো খাওয়ানোর কি দরকার ছিল। একটু খেলে অন্ততপক্ষে রাতেই ড্রামাটা দেখা যেতো। সজিবটা আবার ইচ্ছে করে রুমে ক‍্যামেরা রেখে গেছে। কেমন লাগে। এসব ভেবে ও বিড়বিড় করে পাইচারি করছে। রোহান নাক ডাকছে। অনিমা কানে হাত দিয়ে সোফায় গিয়ে বসলো। বিয়ের ঝামেলায় প্রায় অর্ধেক রাত পেরিয়ে গেছে বাকীরাতটুকু বসেই কাটিয়ে দিতে হবে। তাছাড়া রোহান ওকে দেখে কেমন রিয়েক্ট করে ভেবে একটু টেনশন হচ্ছে। রোহান যদি না মানে লোকজন জানাজানি হবে। সম্মান যাবে। এসব চিন্তা করতে করতে ওর চোখদুটো বন্ধ হয়ে আসলো।

**
অনিমার ঘুম ভাঙলো পরদিন সকালবেলায়। তখনও রোহান ঘুমে বিভোর। ও তাড়াতাড়ি ফ্রেস হয়ে রুমে আসলো। এখনো আবিরের খোঁজ নেই। বলেছিল ভোরবেলায় চলে আসবে। আর রোহানের আক্কেল দেখে মেজাজ খারাপ হচ্ছে। অনিমা অনেক ভেবে চিন্তা করে রোহানের পাশে গিয়ে বসলো। আস্তে করে ওর কাধে ধাক্কা দিয়ে বলল,

> রোহান আর কতো ঘুমাবে? উঠো না প্লিজ।

রোহান অনিমার হাত ঝাড়া দিয়ে সরিয়ে দিয়ে নড়াচড়া করে পাশ ফিরে ঘুমিয়ে গেলো। অনিমা হতাশ হলো। রেগে গিয়ে দুহাত দিয়ে রোহানের গলা চেপে ধরতে গিয়ে হাত ফিরিয়ে আনলো। এভাবে হবে না ভেবে টেবিলের উপর থেকে পানির গ্লাস নিয়ে রোহানের চোখেমুখে ছিটিয়ে দিলো। রোমান ঘুমের মধ্যেই হাত দিয়ে মুখটা মুছে নিয়ে আবার ঘুম। ওর মেজাজ এবার চরম খারাপ হচ্ছে। হুট করে জগপূর্ণ পানি রোহানের মুখের উপরে ঢেলে দিলো। রোহান হুড়মুড় করে উঠে বসলো। মনে হলো আকাশ থেকে পড়েছে। চারপাশে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে সোজাসুজি অনিমার দিকে তাঁকিয়ে হুড়মুড় করে বিছানা থেকে পড়ে গেলো। সব কিছু মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে। এই মেয়েটা এখানে কি করছে বুঝতে পারছে না। অনিমার গায়ে লাল রঙের একটা সুতি সিল্কের শাড়ি। মেয়েটা ঘোমটা টেনে লজ্জা লজ্জা মুখে বলল,

> সরি বেবি,কতক্ষণ অপেক্ষা করছি এই তোমার উঠার সময় হলো? আমি কিন্তু ভীষণ রাগ করেছি।

রোহানের কান আর চোখ দিয়ে ধোয়া উঠছে। বুকের মধ্যে হাতুড়ি পিটাচ্ছে। অনিমা এখানে কিভাবে আসলো বুঝতে পারছে না। আশেপাশে তাকিয়ে আরেকজনকে খোঁজ করছে। অনিমা বুঝতে পেরে ভ্রু কুচকে বলল,

< তোমার বউ সামনে রোহান। তুমি কাকে খোঁজ করছো? আমাকে পছন্দ হয়নি বুঝি? রোহান মেজাজ ঠিক রাখতে পারছে না। মনে হলো অনিমার কথাবার্তা নেকামির চরম মাত্রা অতিক্রম করেছে। বেহুদা মেয়ে মানুষ। রোহান ফ্লর থেকে উঠে কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলল, > তুমি এখানে কি করছো? আমার বউকে ভুল বুঝিয়ে তাড়িয়ে দিয়েছো তাইনা? আমি কখনও তোমাকে মেনে নিবো না। কখনও না। বের হও আমার বাড়ি থেকে।

অরিন সামান্য কেঁপে উঠলো তবে সাহস হারালো না। ওষ্ঠে হাসি এনে বলল,

> বেবি আমি কিন্তু একা আসিনি। তোমার আম্মু আমাকে পছন্দ করে ছেলের বউ করে এনেছে। তুমি তো মাল খেয়ে টাল হয়ে রোবট হয়ে গিয়েছিলে। বিয়ের ছবি যদি একটুও খারাপ হয়েছে না। তোমার খবর আছে।

রোহান ওর কথার উত্তর করলো না দৌড়ে গিয়ে ওর গলা চেপে ধরলো। অনিমা চেষ্টা করছে ছাড়িয়ে নিতে কিন্তু ওর শক্তির সঙ্গে পারছে না। মনে হলো প্রাণ বুঝী এখুনি বেরিয়ে গেলো। বাঁচার শেষ চেষ্টা হিসেবে রোহানকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়ে হাফ ছেড়ে বাঁচলো। গ্লাসে পানি ঢেলে ঢকঢক করে খেয়ে হাপাতে হাপাতে বলল,

> তুমি মানুষ না একটা অমানুষ। আমাকে মেরে ফেলবে তো ফেলো বাধা দিবো না তবে মরার আগে তোমাকে দূটো কথা বলতে চাই। সেই সুযোগটা আশাকরি তুমি আমাকে দেবে।

রোহানের রাগ আরও বৃদ্ধি হলো। একে তো ওর সঙ্গে চিট করা হয়েছে তারপর আবার এই মেয়েটা এখন ভনিতা করছে। সহ‍্য করতে না পেরে ছুটে গিয়ে অনিমার গালে থাপ্পড় বসিয়ে দিলো। মেয়েটা ছুটে গিয়ে খাটের সঙ্গে বাড়ি খেয়ে ফ্লোরে পড়ে গেলো। কপাল কেটে গেছে তবে অনিমার সামান্যতম ব‍্যাথাও অনুভব হচ্ছে না। চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে তবুও নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে দাঁড়িয়ে অগ্নি দৃষ্টিতে বলল,
> আমাকে খুন করলে তিলতিল করে যে অর্থসম্পদের পাহাড় তৈরী করেছিস সেসব ভোগ করার অধিকার কিন্তু হারিয়ে ফেলবি। তোর কি মনে হয় আমি অবলা স্ত্রীদের মতো তোর সংসার করতে এসেছি? তোর ধারণা ভুল। যে আমার সঙ্গে রাত কাটিয়ে নিজের সন্তানকে খুন করতে চাই তার সঙ্গে আমি? কখনও না। গতকাল তুই বেহুশ হয়ে কাবিনের সঙ্গে তোর সম্পত্তির সবটা আমার মেয়ে রুহী শেখ কে লিখে দিয়েছিস।ওর আঠারো বছর পযর্ন্ত সেসবের দায়িত্ব আমার উপরে থাকবে। তাছাড়া বাচ্চার কিছু হলে সেসব সরকারি ফান্ডে জমা হয়ে যাবে। আমাকে মেরে ফেল আমি মরে যায়, তোর ফাঁসি হোক তারপর এই বাড়িতে আমার মেয়ে রুহী এসে রাজত্ব করুক। আমি মরে গিয়েও শান্তি পাবো। আমি ইচ্ছে করলেই বাচ্চা এবোট করে অন‍্য কাউকে বিয়ে করে সংসার করতে পারতাম কিন্তু আমি পারিনি। সন্তানের মায়া তোর মতো পিশাচ কখনও বুঝতে পারবে না। তবে আজ থেকে তোর যা ইচ্ছা করে বেড়া তুই স্বাধীন। আমি ঝামেলা করবো না।

রোহানের মাথা ঘুরছে। নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না কি থেকে কি হয়ে গেলো। ও অবিশ্বাসের সঙ্গে বলল,

> তুই বললেই আমি বিশ্বাস করবো? কিসের সম্পত্তি আর কিসের দলিল। ওসব আমি বিশ্বাস করিনা। তোকে আর তোর মেয়েকে আমি স্বীকার করছি না। ওটা যে আমার মেয়ে কেউ বিশ্বাস করবে না। সবাই জানে আমি ভালো ছেলে।

রোহানের বোকা বোকা কথা শুনে অনিমা হাসলো। তারপর বলল,

> তুখোড় ব‍্যবসায়ী রোহান শেখ আজকাল দেখি সব ভুল গেছে। বাচ্চাটা কার এটা টেস্ট করতে আহামরি কষ্ট করতে হয়নি আমার। হাসপাতাল ডাক্তার এসব কি জন্য আছে রোহান? এটা তোর নিজের রক্ত। আমি ওকে এমনভাবে তৈরী করবো কখনও তোকে বাপ বলে স্বীকার করাতো দূর তোর মুখ দেখতে ঘৃণা করবে। তুই আফসোস করবি।

অনিম একটু থেমে আবারও শুরু করলো,

>আমার মধ্যে কিসের কমতি ছিল জানিনা। আমি সুন্দরী, শিক্ষিতা, ভালো পরিবারের মেয়ে। তুই ইচ্ছে করলে আমাকে নিয়ে সুখে থাকতে পারতি। আমি তো তোর জন্য পাগল ছিলাম। যেই আমাকে দিয়ে তোর ইচ্ছে পূরণ হয়ে গেলো আর অমনি তুই আরেক নারীর প্রতি আকৃষ্ট হলি। আসলে কি জানিস তোর যে চরিত্র ভালো করে সাবান দিয়ে আছড়ে আছড়ে পরিস্কার করলেও জীবাণু থেকে যাবে। তোরা এক নারীতে সন্তুষ্ট থাকতেই পারিস না।

রোহান নিজের সম্পর্কে আর খারাপ কথা শুনতে পারলো না। অনিমাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিলো। মেয়েটা হুড়মুড় করে বিছানায় গিয়ে পড়লো। এতক্ষণ মুখ জোর করে ঝগড়া করলেও এবার আর পারলো না। হুহু করে কেঁদে ফেলল। রোহানের মাথায় আগুন জ্বলছে। ওর একটু একটু করে সকলের উপরে সন্দেহ হচ্ছে। গতকাল আবির ওকে নেশা করিয়েছিল। ও
এসবের জন‍্যই ওরা এমন করলো। কাউকে ছাড়বে না রোহান।
____________________
রোহানের মায়ের সামনে মুখ ভার করে বসে আছে আবির। মুখটা ওর থমথমে হয়ে আছে। রুমে এখনো অনিমা আর রোহানের ঝগড়া চলছে যেটা কিছুক্ষণ আগে ল‍্যাপটপে দেখেই এই বাড়িতে হুড়মুড় করে ছুটেছে। ঘরে ক‍্যামেরা সেট করেছিল প্রমাণ রাখার জন্য। রোহান সহজে হার মানবে না তাই এই ব‍্যবস্থা। মিসেস শেখ আবিরের প্রশংসা করছে এতো সুন্দর একটা মেয়ের খোঁজ দেওয়ার জন্য। উনি এতো এত কথা বলছে আবির শুধু হু হ‍্যা করছে ওকে এমন করতে দেখে ভদ্রমহিলা ভ্রু কুচকে বলল,

> আবির মন খারাপ কেনো? কোনো অসুবিধা হয়েছে? আন্টিকে বলো।

আবির মন খারাপ করে মাথা চুলকিয়ে বলল,

> আমি মহা পাপ করেছি আন্টি। আপনার মতো এমন সাদা সরল মানুষের সঙ্গে পাপ করেছি। আপনি আমাকে ফাসি দেন। ফাঁসি না গুলি করেন। প্লিজ আন্টি।

মিসেস শেখ ঘাবড়ে গেলো আবিরের এমন কথাবার্তা শুনে। ছেলের মাথাটা গেছে নাকি বুঝতে পারছেন না। কৌতূহলী হয়ে বললেন,

> এসব কি কথা আবির? বিস্তারিত বলো আমি টেনশন করছি।

> আন্টি অনি রোহানের পরিচিত। ওরা দুজন দুজনকে পছন্দ করতো। কিন্তু মাঝখানে একটা ঝামেলা হয়ে গেছে। রোহান আর অনিমা বাবা মা হয়ে গেছে। ওদের ছয় মাসের একটা কিউট বেবি আছে। বিয়ের আগে বেবি হয়েছে বলে আপনার ছেলে বাচ্চাকে মানছে না। আপনিই বলুন এই শেখ বাড়ির ইতিহাসে এমন ঘটনা কি কখনও ঘটেছে? বাড়ির মেয়ে বড় হবে এতিমখানা বা বস্তিতে। শুনেছিলাম আপনার শশুরের বাবা না শশুর জানি জমিদার ছিলেন। জমিদারদের রক্ত পথে পথে ঘুরবে তাই কৌশলে আমি বন্ধুদের সঙ্গে মিলে রোহানকে বাধ্য করেছি বিয়ে করতে। আপনাকে আগে কিছু বললে আপনি রোহানকে যদি বলতেন তখন ও পালিয়ে যেতো। আমার অন‍্যায় হয়েছে এবার আমাকে আপনি ফাঁসি দেন। প্লিজ দেন।

আবির মুখে হাত দিয়ে কাঁদার নাটক করে আঙ্গুলের ফাঁক দিয়ে ভদ্রমহিলার মুখের ভাবমূর্তি বোঝার চেষ্টা করছে। এতগুলো কথা নিজের ছেলের সম্পর্কে শুনে সহজে কেউ হজম করবে না এটাই স্বাভাবিক। আবির এবার চিন্তা করছে যদি হার্টএটাক হয়ে যায়? এই রে এটাতো ভাবেনি। ও হন্তদন্ত হয়ে মিসেস শেখের পাশে গিয়ে বসলো। উনি এখনো চুপচাপ আছে। কথাগুলো হজম হচ্ছে না হয়তো। আবির উত্তর শোনার আশায় মুখের দিকে তাঁকিয়ে বসে আছে। কিছুই বলছে না দেখে ভয়ে ভয়ে বলল,

> প্রমাণ আছে আন্টি আপনি চাইলে দেখতে পারেন। দেখবেন?

ভদ্রমহিলা কিছু না বলে উঠে গেলো। আবির উনার পিছনে পিছনে দৌড় দিলো। ওরা একবারে রোহানের ঘরের সামনে এসে থামল সেই মূহুর্তে রোহান দরজা খুলে বেরিয়ে আসলো। ভেতর থেকে কান্নাকাটির আওয়াজ আসছে। আবির সোজা ভেতরে গিয়ে তাড়াতাড়ি অনিমাকে তুলে সোফায় বসিয়ে পানি এগিয়ে দিলো। কপালে রোমাল ভিজিয়ে মুছে দিতে দিতে বলল,

> সরি আসতে দেরী হয়ে গেলো। তবে প্রমিজ তোর দুঃখ দূর করতে না পারলেও সম্মান ফিরিয়ে দিতে পারবো। এই বাড়িতে তোর রাজত্ব কায়েম করিয়ে দিয়ে যাবো ইনশাআল্লাহ।

অনিমা ফুপিয়ে যাচ্ছে। আবিরকে ও চোখ বন্ধ করে ভরসা করে। অন‍্যদিকে রোহান মায়ের সামনে মাথা নিচু করে বলল,

> সব মিথ্যা আম্মা। ওরা আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করেছে। ওই বাচ্চা আমার না। এই মেয়ে আর ওর বাচ্চাকে লাথি দিয়ে বের করে দিবো একটু সময় দাও।

রোহানের কথা শেষ হলো না কষিয়ে একটা থাপ্পড় দিলেন উনি। এই বাড়ির বংশধরকে মানতে ওর অসুবিধা হচ্ছে তাহলে উনি কেনো রোহানকে মানবে? উনি পরপর আরও দুটো থাপ্পড় দিয়ে বললেন,

> ওকে না মানলে আমিও আর তোমাকে নিজের ছেলে হিসেবে মানছি না। তুমি ওকে মানলে তবেই আমি তোমাকে নিজের ছেলে হিসেবে মানবো। এখন ভাবনা চিন্তা করে দেখো যাও। দূর হও আমার চোখের সামনে থেকে।

কথাটা বলে উনি অনিমার পাশে গিয়ে গম্ভীর কন্ঠে বললেন,

> বিয়ের আগে এসব করা ঠিক না তবুও তুমি করেছো। ছেলেরা বললেই সব করতে হবে কেনো? ভালোবাসার উপরে ভরসা রাখতে পারো না তেমন ভালোবাসার দরকার কি ছিল। তোমরা দুজনেই দোষী। মাঝখানে আমার নাতনিটা সাজা পাচ্ছে। তোমাদের দুজনকেই আমি ক্ষমা করবো না। আবির আমার নাতনিকে আনার ব‍্যবস্থা করো। আমি চাইছি না সে দাদা বাড়ি ছেড়ে পরের বাড়িতে গিয়ে উঠুক।

আবিরের ওষ্ঠে হাসি ফুটে উঠলো। ঝামেলা মোটামুটি শেষ। রোহান যা ইচ্ছা করুক সমস্যা নেই। ওর নামের সম্পত্তির সবটা উকিল ডেকে বিয়ের রেজিস্ট্রির সঙ্গে মেয়ের নামে রেজিস্ট্রি হয়ে গেছে। ও চাইলেও বাচ্চা বা অনিমার ক্ষতি করতে পারবে না। কথাগুলো ভেবে ও মলিন হেসে উঠে আসলো। সজীব গাড়িতে বসে ভিডিও দেখছে। আবির হন্তদন্ত হয়ে ওর পাশে গিয়ে বসলো। গাড়ির ছিটে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে বলল,

> পরিকল্পনা সফল হয়েছে সজীব। রোহানের বিয়েটা হলো অবশেষে।

> এবার আমার পালা। তোর বাসাই যে মেয়েটা আছে ওর সঙ্গে আমার পাকাদেখা করিয়ে দে ভাই। বিয়ে করে সংসার করি।

আবির চোখ বন্ধ রেখেই বলল,

> ওটা মেয়ে না অগ্নিগিরী লাভা। তোকে পুড়িয়ে দিবে।

> মাঝেমাঝে পুড়তেও মজা।

> তাহলে আর কি ঘনঘন আবিরের বাড়িতে ঘুরঘুর কর। লাভ কিছুই হবে না। ওর শকুনের দৃষ্টি আগেই আবিরের উপরে পড়ছে। আবির পালাবে এবার বুঝলি?

সজীব মাথা নাড়িয়ে বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে বলল,
> সত্যিই?

আবির ওর কথার উত্তর দিলো না। এই মূহুর্তে খুব জান্নাতকে দেখতে মন চাইছে। ফোন বের করে মেয়ের ছবিতে ঠোঁটের স্পর্শ দিয়ে গাড়ি ছাড়লো। সজীব চুপচাপ বসে ছিল। ওর চোখেমুখে কৌতূহল।

(চলবে)
ভুলত্রুটি মার্জনা করবেন।