শেষ সূচনা পর্ব-১৭

0
309

#শেষ_সূচনা
পর্বঃ১৭
লেখকঃ আরিফুর রহমান মিনহাজ

আমি না তাকিয়েই বললাম,
— বলুন কী চাই আপনাদের।
বুড়ো-বুড়ি সন্দিগ্ধ চোখে মুখ চাওয়াচাওয়ি করলো একবার। স্বর্ণার বাবা একটু অস্বস্তি নিয়ে গলা পরিষ্কার করে বলল,
— তোমার সঙ্গে আমার জরুরি কথা ছিল কিছু। জানি সবাই রেগে আছো আমার উপর। কিন্তু একজন বাবা-মা তো তার সন্তানের ভালোই চায়। আমরা…
তুষের আগুন বাতাসের মৃদু দোলায় ঝিমিয়ে যাওয়া আগুন যেমন করে তেঁতে ওঠে কথাটা শুনে আমার নিভু নিভু রাগটা তেমন করে জ্বলে উঠল। চেঁচিয়ে বললাম,
— ফাক অফ! কিসের ভালো চাওয়া? কোন ভালো চেয়ে উল্টিয়ে ফেলেছেন আপনারা? একটা নিরপরাধ মেয়েকে নির্বাসিত করেছেন আপনারা। এখন ভালো দেখাতে এসেছেন?
চিৎকার শুনে মা অন্দরমহল থেকে ভীত দিশাহীন হয়ে দৌড়ে এসে দাঁড়ালেন দরজার পাশে। স্বর্ণার মা প্রথমটা চমকে উঠে মাথা নুয়ালেন। কিন্তু যার উদ্দেশ্যে এই তিরস্কার, এই করাল স্বনন তাঁর মুখেই টুঁ শব্দ নেই। পরিস্থিতি সাপেক্ষে তাঁর অস্বস্তি খেলা করা চোখ জোড়া এখন অনুশোচনাযুক্ত,নিশ্চল। দরজার আড়াল থেকে মা চোখের ইশারায় আমাকে শান্ত হবার জন্য বললেন। স্বর্ণার বাবা আবার বলতে শুরু করলেন,
— দেখো, যেদিন ঘটনাটি ঘটে সেদিন সারাটা দিন স্বর্ণা বাসায় ছিলনা। জানোই আমদের রক্ষণশীল পরিবার। এর আগে তুমি চলে যাওয়ায় সে নানারকম পাগলামি শুরু করে। আমরা ভেবেই বসেছিলাম যে,সে খারাপ হয়ে গেছে। তো সেদিন পুরো দিন বাড়িতে না থাকার কারণে আমরা ভেবে নিই যে সে বাড়ি থেকে চলে গেছে তোমার কাছে। সারারাত চিন্তায় কেউ ঘুমায়নি। হাজার হোক সে আমাদের মেয়ে ছিল। সকালে কয়েকজন ছেলেপেলে এসে আমাদের বাজে কথা বলে যায়। এলাকায় ছেলেগুলোর দুর্নাম ছিল আগে থেকেই। ভেবেছিলাম সে পালিয়ে গেছে কিন্তু ছেলেগুলোর কথা শুনে…।
স্বর্ণার বাবা চুপ করে গেলেন এতটুকু বলে। আমি বললাম,
— কী বলেছিল ছেলেগুলো?
— খারাপ কথা। বুঝতেই পারছ। দুঃখের ব্যাপার হলো, আমরাও বিশ্বাস করে নিই সেই কথাগুলো। স্বর্ণা বাসায় ফিরল এলোমেলো অবস্থায়। আমাদের আর বুঝতে বাকী রইল না যে কি ঘটেছে। তাহলে ছেলেগুলোর কথাই সত্যি? সবাই তাকে দেখে মুখ ফিরিয়ে নিল। আমরা ভুল বুঝেছি নিজের মেয়েকে। বিশ্বাস করেছি ঐ ছেলেগুলোর কথা। কিন্তু বুঝতে পারিনি ছেলেগুলো নিজেদের দোষ ঢাকতে আমার মেয়ের বিরুদ্ধে এমন কলঙ্ক দিবে। সেদিন রাতেই স্বর্ণা বাড়ি ছেড়ে চলে গেল। যাবার সময় সে একটা চিঠি রেখে গেল। সেখানে সব লিখে গেল । সব বুঝতে পারলেও তখন আর মেয়েকে ফিরিয়ে আনার সময় ছিলনা। হারিয়ে গেল সে। কিন্তু আজ যখন সেই পশুগুলো মরছে একে একে তখন বুঝতে পারলাম স্বর্ণা ফিরেছে। প্রতিশোধ নিচ্ছে। বাবা, আমি জানি তুমি ওকে খুঁজে পাবে। ওকে আমাদের কাছে ফিরিয়ে দাও। অনুরোধ রইল,আমরা আমাদের পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে চাই।
আমি কিছুক্ষণ বাকশূন্য হয়ে রইলাম তাঁর কথা শুনে। দুই হাত এক করে আনমনে ঘষতে ঘষতে বাইরের দিকে তাকিয়ে আগডুম বাগডুম কি-সব ভাবলাম। এরপর একটা দীর্ঘশ্বাস বুক চিরে বের করে বললাম,
— স্বর্ণা আপনাদের কাছে ফিরবে না। ন্যাড়া বেল তলায় একবারই যায়। আপনাদের দেয়া আঘাত সে এতো তাড়াতাড়ি ভুলবে সেটা কীভাবে আশা করলেন? আপনারা আসতে পারেন। আর হ্যা, আশা করি থানায় যাবেন না আপনারা। কোন লাভ হবেনা। উলটো নিজেরাই বিপদে পড়বেন।
স্বর্ণার মা সমানে ফ্যাঁচ্ ফ্যাঁচ করে কেঁদে যাচ্ছেন বিরামহীন। আশ্চর্য! এতোদিন কোথায় ছিল এই কান্না? সব মেকি!

বুড়ো বুড়ি চলে গেলেন নিরাশ হয়ে। আমি বসে রইলাম সোফায়; উঠার ইচ্ছে হলোনা। অবাক করা হলেও সত্য যে আজ আমার সম্পূর্ণ অন্তঃকরণ স্বর্ণার সকল কাজের জন্য স্তবগান করে ফিরছে। চিত্তের যে অর্ধ শতাংশ তার বিরুদ্ধে বলে গেছে অনবরত, আজ তারাই আবার সসম্ভ্রমে স্বর্ণাকে গ্রহণ করে নিচ্ছে। কেন জানিনা, পুরো মনটাই আজ স্বর্ণার অনুকূলে। এই বিষণ্ন মুহূর্তেও তার কোকিলকণ্ঠী গলাটা শোনার জন্য মনটা বড়ো আঁকুপাঁকু করছে। স্বর্ণার এই ছোট্ট পরিসরের জীবনে তেমন সুখস্মৃতি নেই বললেই চলে। পুরো জীবনটা কেটেছে আপন দুঃখের ভারে ভারাতুর হয়ে। তার জীবনের শ্রাবণের মিশকালো মেঘ বুঝি সরবেনা এই জনমে? শরৎ কি আসবেনা? বসন্তের বাতাসে কি সে দোল খাবেনা? এভাবেই আমৃত্যু কলুষিত শ্রাবণকে আঁকড়ে ধরে বাঁচবে সে? সে তো আমার চেয়েও বড় দুখী! আমার না-হয় বোঝ হবার পর থেকেই এমন মদতহীন জীবনযাপনে অভ্যস্ত। কিন্তু পেয়েও যে হারায় তার মতো দুঃখী কে আছো এই বিশ্বভ্রহ্মাণ্ডে? আপনজনগুলো কেন অপরের কথা বিশ্বাস করে আপনজনদের কষ্ট দেয়? কেন নিজের ছেলেমেয়েদের উপর আস্থা হারায়? ভরসা হারায়? বিশ্বাস হারায়? এই যে অদিব্য ক্লেশের ভার, সে কি মানুষগুলোর অনুমানের বাইরে? কাউকে ভুল বোঝার আগে একটা মানুষের অন্তত দশবার ভাবা উচিত। কাউকে নষ্ট বলে বিবেচনা করার আগে হাজারবার ভেবে নেওয়া উচিত। নয়তো পৃথিবী অচিরেই প্লাবিত হবে মানুষগুলোর অশ্রুবন্যায়।

কয়েক সপ্তাহ অতিবাহিত হলো তেমন উল্লেখযোগ্য ঘটনাবিহীন। স্বর্ণা এখনো চট্টগ্রামেই আছে। জোড়া খুনের ঘটনায় দেশের সর্বস্তরের জনগনের চঞ্চলতা কমেছে। বদলে মানুষগুলো স্বর্ণার কার্যক্রমে স্বর্নাকে প্রসংশায় ভাসাচ্ছে। তবে কতিপয় লোকজন বিষয়টিকে উপেক্ষা করে সম্পূর্ণ বানোয়াট, মিথ্যাচার ও বাঁচার ফন্দি বলে সমালোচনা করছে। যদিও এই সংখ্যা খুবই নগণ্য। তা সত্ত্বেও তদন্ত কমিটি থেমে নেই। ব্যর্থ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে খুনি পর্যন্ত পৌঁছানোর। কিন্তু খুনি লাগামহীন, ধরাছোঁয়ার বাইরে। এই পর্যন্ত খুনির আসল নামটা পর্যন্ত উদ্ধার করতে পারলোনা। ঐ এক চিহ্ন রেখে যাওয়া DONT বাদে। এতোই অথর্ব!
গত সপ্তাহে ডাক্তার স্বর্ণাকে বিদেশে গিয়ে চিকিৎসা করানোর পরামর্শ দিয়েছে। গুলি লেগে আঘাতপ্রাপ্ত স্থানের ক্ষতটা উপরে শুকালেও ভিতরে একটা ইনফেকশন রয়েই গেছে৷ সিঙ্গাপুরে গিয়ে সার্জারী করালে সম্পূর্ণ ভালো হবে বলে জানিয়েছে ডাক্তার। কিন্তু স্বর্ণা যেতে নারাজ। তার মতে,দেশে হলে হবে, নাহলে নেই। থাকুক ওভাবে। বহুকষ্টে ইনিয়েবিনিয়ে স্বর্ণাকে রাজী করালাম। কথায় আছেনা? চাচা আপন প্রাণ বাঁচা; এই কথাই কাজে দিয়েছে। আগে নিজের নিরাপত্তা পরে বাকিসব।

আজ সূর্যটা অস্তমিত প্রায়। বেলা হয়ে গেলেও কুয়াশা কাটেনি এখনো। ঘন কুয়াশার জাল নেমেছে পুরো পৃথিবীজুড়ে। পাখিদের কিচিরমিচির কলতানেও ভাটা পড়েছে আজ।ঈশান কোণ থেকে প্রবল বেগে ধেয়ে আসা হিমজড়ানো বাতাসের দোলায় এয়ারপোর্টের বটগাছের পাতাগুলো নড়ছে তিরতির করে। বরফের মতো শীতল বাতাস মোটা চাদর কেটে গায়ে আক্রমণ করছে। দু’জনে বসে আছি চট্টগ্রাম এয়ারপোর্টে। বটতলায়। স্বর্ণার পরনে একটা মোটা উলের জ্যাকেট। মাথায় শীতের টুপি। মসৃণ চুলগুলো টুপির ভেতর দিয়ে বেরিয়ে পিঠময় ছড়ানো। বাতাসের শিথিলতায় চোখদুটো ঈষৎ কুঁচকানো আর তীক্ষ্ণ। শীতে অযত্নে অবহেলায় ঠোঁটজোড়া নাজেহাল। এয়ারপোর্ট ধরতে গেলে জনশূন্য। মাঝে মধ্যে দু-একজন হেঁটে যাচ্ছে ভিতরের দিকে৷ স্বর্ণার ফ্লাইট আরো দেরীতে। একটু তাড়াতাড়িই এসে পড়েছি। আমি নীরবতা ভেঙে বললাম,
— ঠোঁটে কিছু লাগাওনি কেন?
স্বর্ণা মুচকি হেসে বলল,
— তুমি এসব সাজসজ্জা পছন্দ করোনা বলেই তো কিছু করলাম না।
— সাজসজ্জা পছন্দ করি না ঠিক। কিন্তু শরীরের অযত্ন করতে তো আর বলিনি? ভেসলিন কিংবা জেলি দিলেই পারতে… কেমন বিশ্রি দেখাচ্ছে!
— আমি বিশ্রী তাই বিশ্রী দেখাচ্ছে থাকুক না… সমস্যা নেই তো। দায়সারা জবাব স্বর্ণার।
আমি মুখ ঝামটে বললাম,
— তুমি বেশি বাজে বকো। দেখি এদিকে তাকাও আমার পকেটে একটা ছোট ভেসলিন আছে ওখান লাগিয়ে দিই একটু।
স্বর্ণা দ্বিরুক্তি না করে দূর থেকে একটু কাছে ঘেঁষে মুখটা বাড়িয়ে দিল আমার দিকে৷
দুঁদে মেয়েটার এই আচরণ সত্যিই মুগ্ধ করল আমাকে। সচরাচর আমার কোন কথাই যে তেমন প্রাধান্য দেয় না বরং উলটো কথা বলে বসে প্রায়সঃই। কিন্তু আজ দীর্ঘদিন দেখা না হবার শোকেই মুহ্যমান হয়ে এই অনাকাঙ্ক্ষিত আচরণ? হতে পারে অসম্ভব কিছু নয়। আমি পকেট থেকে ভেসলিনে কৌটোটা বের করে আলতো করে আঙুলের মাথায় নিয়ে বললাম,
— কই আবার ফিরলে কেন? এদিকে তাকাও?
স্বর্ণা তাকাল। তার চোখ ছলছল। শরীর কাঁপছে দুলে দুলে। আমাকে বুঝতে না দেয়ার মিথ্যা প্রয়াসে মুখটা বাড়িয়ে দিল স্বর্ণা। কিন্তু চোখের জল লুকবে কি দিয়ে? আমি দেখেও কিছু বললাম না। আঙুলের ডগায় লাগানো ভেসলিন দিয়ে স্বর্ণার শুষ্ক ঠোঁটে আলতো করে লাগাতে লাগাতে বললাম,
— যতোদিন থাকবে সাবধানে থাকবে। ছুটি পেলে আমি যেতাম সঙ্গে, কিন্তু উপায় নেই। আমি একটা বাসা ঠিক করে রেখেছি ওখানে। আমার বাবার পরিচিত। একজন মহিলা আছে ওখানে,তোমার খুব কেয়ার করবে। জানো একবার আমি দশদিনের জন্য গিয়েছিলাম, পারেনা শুধু কলজেটা কেটে খাওয়াতে। দেখো তোমার কোন অসুবিধে হবেনা। আর হ্যাঁ প্রতিদিন ফোন দিবে৷ আর…
কথা শেষ হলোনা। স্বর্ণা চোখের টলটলে উষ্ণ জল শ্রাবণের বারিধারায় পাড় উছলে কপোল বেয়ে গড়িয়ে পড়ল আমার হাতে। ইশ্ এই কনকনে শীতেও চোখের জলগুলো উষ্ণ রয়ে যায় কেন? এটাই কি চোখের জ্বলের বিশেষত্ব? হয়তো-বা। আমি দুই হাতের বৃদ্ধাঙ্গুলে চোখের জ্বল মুছে দিয়ে বললাম,
— কেঁদে কী হবে? তোমায় সুস্থ হতে হবে। না-হয় বাকী দু’জনকে টপকাবে কে? হু?
শুনে স্বর্ণা তৃপ্তি নিয়ে হাসল। হাসি কান্না দুইয়ের সংমিশ্রণে অদ্ভুত ঐন্দ্রজালিক দেখাল স্বর্ণাকে। চোখে মুখে ভেসে উঠল অদূর ভবিষ্যতে অবশ্যম্ভাবী কোন ঘটনার অগ্রিম তৃপ্তি।
ফ্লাইটের সময় হয়ে গেলে স্বর্ণাকে এগিয়ে দিলাম। ইমিগ্রেশন কক্ষের ঢুকার আজ পর্যন্ত বারবার পেছনে ফিরে তাকাল সে। আমি প্রতিবারই হাত নেড়ে বিদায় জানালাম।
……………………………………………….
সাত কি আট মাস পরের কথা। আগষ্টের শুরুর দিকে। আমাকে বলদি করা হলো সিলেটে। একেবারে মূল শহরের একটি থানায়। বলা বাহুল্য, এরি মধ্যে জুহির সঙ্গে প্রায়ই ফোনালাপ হতো। কখনোই আমি নিজ থেকে ফোন দেবার চেষ্টা করিনি। বারবার সে-ই খোঁজখবর নিতো। কাজেই আমি নিজ থেকে তার অবস্থান জানার চেষ্টাও করিনি। এমনকি আমি চাইলাম আমার সিলেটের বদলি হবার কথাও সে না জানুক। চাইনা আবার মায়াজালে বেড়াতে। এভাবেই তো ভালো আছি! লম্বা একটা ভ্রমনের পর সিলেটের মাটিতে পা রাখার সঙ্গে সঙ্গে আমার ভিতরে অদ্ভুত এক অনুভূতি কাজ করল। মা যদিও সঙ্গে আসতে চেয়েছিল,কিন্তু থাকা খাওয়ার অসুবিধেই আনার সাহস হয় নি। তবুও মনে হলো,এই শহরে আমি একলা নই। এই শহরে জুহি আছে, এই শহরেরই স্বর্ণার মূল আস্তানা। সিঙ্গাপুর থেকে ফিরে স্বর্ণা হয়তো এখানেই আসবে। আমার কাছে পরে থাকে তার মূল উদ্দেশ্যও সফল হবেনা। বরং তার ভাষ্যমতে আমার উপস্থিতি সে মোমের মতো গলে গিয়ে তার নিজস্বতা হারাবে। এমনকি স্বর্ণাকেও বলিনি সিলেটে আমার আসার কথা। সবাইকে একটা চমক লাগানোর মনোবাঞ্ছা হয়েছে হঠাৎ। কিন্তু চটক যেন উল্টো আমার জন্যই অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিল এবং তা শুরুর দিনেই! শুরুর দিনেই সবাই আমাকে সসম্মানে গ্রহণ করে নিল। ভালোভাবেই শুরু হলো দিনটা। নিজের টেবিলে বসে একটা ফাইল ঘাটাঘাটি করছিলাম। হ্যাঁ, এটাই স্বর্ণার গ্যাং এর বিস্তারিত ফাইল। কিন্তু প্রচুর দাপটে থাকার কারণে পুলিশকে নাকে দড়ি দিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে লোকসম্মুখে। সবার নামসহ বিস্তারিত থাকলেই স্বর্ণার শুধু নামটাই আছে ফাইলে। ছবি কিংবা কোন তথ্য ফাইলে নেই। এতেই বোঝা শক্ত নয় স্বর্ণা আসলে কতোটা দুর্ধর্ষ। নাহয় একাই একজন মেয়ে সম্যক বাংলাদেশে আতঙ্ক সৃষ্টি করা অতোটা সহজ কাজ নয়।
— আসতে পারি স্যার?- মেয়েলী কণ্ঠে শোনা গেল দরজার ওপাশে।
আমি মুখ না তুলেই বললাম,
— হ্যাঁ আসুন।… বসুন।
কয়েক সেকেন্ড পর চেয়ার টানার শব্দ হলো। আমার দৃষ্টি তখনো ফাইলটার উপর গভীর অভিনিবিষ্টে নিবদ্ধ।
— বাহ! বদলি হলেন। চলেও এলেন অথচ একবারো জানালেন না! কেমন পাষাণ আপনি?
আমি চমকে মাথা তুললাম। সঙ্গে সঙ্গে আমার শিরদাঁড়া বেয়ে একটা শীতল শিহরণ মাজার দিকে নেমে গেল পলকে। জুহির চিরপরিচিত মুখ চোখের তারায় দৃশ্যমান হলো। বিস্ময়-বিহ্বল চোখে হাঁ করে তাকিয়ে রইলাম। না বলে আসার দরুন অস্বস্তিতে কাদা হয়ে একটা অপ্রতিভ মুচকি হাসি খেলে গেল আমার চোখে মুখে। জুহি বলল,
— আপনি হাসছেন? আমাকে একবার বলার প্রয়োজন মনে করলেন না? নাকি আপনি চাননা আমি আপনার সঙ্গে থাকি বা কথা বলি…
এই শুরু হয়েছে ঘ্যানরঘ্যানর! এবার সামলাবে কে? এমন নাকাল হবো কে জানতো? জানলে তো ঠিকি জানিয়ে আসতাম। সমুচিত জবাব খুঁজে না পেয়ে ইতস্তত করে বললাম,
— আচ্ছা, জানানো হয়নি। হুট করেই সব হয়ে গেল?
— কাল রাতেই না আপনার সঙ্গে কথা বললাম?… যাক আপনার কাছ থেকে কৈফিয়ত চাইনা আমি। ওসি সাহেব বলেছেন নতুন এস আই এর সঙ্গে দেখা করতে, তাই এসেছিলাম, এসে দেখি আপনি।
আমি কঠোর গলায় বললাম,
— ঠিকাছে এখন নিজের কাজ করে নাও।
জুহি দুই হাত টেবিলের উপর রেখক একটা নিশ্বাস ফেলল। বলল,
— যাচ্ছি। আপনি স্পষ্টই আমাকে এড়িয়ে যেতে চাইছেন। এতোদিন পর দেখা হলো…
আমি কথায় বাঁধা দিয়ে বললাম,
— ডিওটির সময় আমি তোমার সিনিয়র। সো… রেসপেক্ট নিয়ে কথা বলো। তোমার সঙ্গে আমার কি সম্পর্ক সেটা ডিওটির বাইরে।
জুহি হাঁড়িমুখ করে ফিরে যাচ্ছিল। আমি পিছন থেকে ডাক দিলাম,
— জুহি…
জুহি পেশাদার ভঙ্গিতে ঘুরে দাঁড়িয়ে বলল,
— স্যার!
— বাহ! গুড চেঞ্জ! তোমার ডিওটি শেষ ক’টায়?
— পাঁচটায় স্যার!
— ওকে আমারো সেইম টাইম। যাওয়ার সময় দেখা করে যেও।
— ওকে স্যার।
জুহি বেরিয়ে গেলে ফোনটা বের করে স্বর্ণাকে ফোন দিলাম। স্বর্ণা সিঙ্গাপুর থাকায় এখন আর ফোন করা নিয়ে আগের মতো বিধিনিষেধ নেই। যেকোন সময় ফোন করতে বাঁধা নেই। এখন সে সম্পূর্ণ সুস্থ। তবুও ভিসা সংক্রান্ত কিছু জটিলতার কারণে এখনো আটকে আছে সেখানে। কিছুদিনের মধ্যেই ফিরবে বলে জানিয়েছে। দু’বার রিং পড়তেই ফোন তুলল স্বর্ণা। আমি মুখবন্ধ ছাড়াই শুরু করলাম,
— আচ্ছা স্বর্ণা, সিলেটে তোমার গ্যাং এর বিরুদ্ধে কেস ফাইলে তোমার কোন ডিটেইলস নেই কেন?
স্বর্ণা সন্দিগ্ধ গলায় বলল,
— মানে? সিলেটের কেস ফাইলের খবর তুমি কী করে পেলে?
এই প্রশ্নের জন্য আমি প্রস্তুত ছিলাম না মোটেও। আমি কিছুক্ষণ আমতা আমতা করে চট করে বলে ফেললাম,
— কীভাবে আবার? খোঁজ নিয়েছি। এটা কোন ব্যাপার হলো?
— ওহহ আচ্ছা। থাক ওসব জানার কী দরকার? আর আমি কি এতোই বোকা যে পুলিশকে আমার ইনফরমেশন দিয়ে বসে থাকব? একবার গ্রেফতার করেছিল। সবার জায়গা বারবার লাথি দিয়ে কোন ঝামেলা ছাড়াই পালিয়ে এসেছি।
— তুমি ঐ জায়গা বরাবর ছাড়া আর কোন পথ দেখোনা বুঝি? আমার ভবিষ্যৎ অন্ধকার করে ছাড়বে দেখি তুমি।
স্বর্ণা খিলখিল শব্দ করে হাসল। হাত দিয়ে বোধহয় আটকানোরও সমীহা করল।ক্ষণিক পর বাঁধভাঙা হাসিটা ধিমে হয়ে এলে হাসি নিয়েই থেমে থেমে বলল,
— তোমার ভবিষ্যৎ অন্ধকার কেমনে?
— ভবিষ্যতে তোমাকে বিয়ে করব কিনা তাই।…- স্বর্ণার হাসি থেমে গেল। ফোনের এপাশ ওপাশ উভয়ই নিশ্ছিদ্র নৈঃশব্দ্য। অপরপ্রান্ত হতে স্বর্ণা একটা দীর্ঘশ্বাসসমেত গম্ভীরস্বরে বলল,
— সেটা তখনই সম্ভব হবে যখন গোটা পৃথিবীতে তুমি আর আমি ছাড়া আর একটা কাকপক্ষীও থাকবেনা। হবে কখনো এমনটা? হবেনা। তাই অযথা স্বপ্ন দেখোনা।
— ঠিকাছে আগে তুমি দেশে এসো। পরে সেসব নিয়ে কথা হবে।

শ্রাবণ মাসের বিকেল। ঘোর বর্ষা চলছে। দিগন্ত থেকে দিগন্তে ভেসে বেড়াচ্ছে নিবিড় কালো মেঘ। আকাশের কোথাও ছিটে পরিমাণ জায়গা নেই। সূর্য আজ বুকভার নিঃসীম কষ্ট নিয়ে অকালেই অদৃশ্য হয়েছে। বদলে আকাসময় মেঘপুঞ্জের একচ্ছত্র রাজত্য। গগনের অনির্দেশ্য কোণ থেকে উদ্ধত মেঘ গুড়মগুড়ুম করে হেঁকে চলেছে নিরবচ্ছিন্ন। পক্ষীকূল সন্ত্রস্ত চিত্তে এ ডাল ও ডাল করে ঘুরঘুর করছে। থানা থেকেই আমাকে একটা বাইক দেয়া হয়েছে যাতায়াতের সুবিধার্থে। কোয়াটারে থাকার সুবিধা যদিও ছিল কিন্তু সিলেট নেমেই একটা বাসা পছন্দ হওয়ায় সেটাতে উঠে গেছি। বাইক নিয়েই দাঁড়িয়ে আছি এমন প্রতিকূল পরিবেশে। একটু পর জুহি বেরিয়ে এলো৷ থানার ফটক পেরিয়ে আমার সামনে এসে বলল,
— জ্বি স্যার, কেন দেখা করতে বলেছেন?
আমি মুচকি হেসে বাইকের পিছনের সিট ইশারা করে বললাম,
— বসো, এখন আউট ডিওটি। স্যার স্যার করতে হবেনা।
জুহি মুখ ফিরিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে মুখ টিপে কিছু একটা দমন করল। পূনরায় আমার দিকে তাকিয়ে বলল,
— ওকে। কিন্তু আমি বসব না। আমি গাড়িতে করে যাব। কী কথা ছিল যেন?
— এই দেখো, রাগ করার কী আছে? আর তোমাকে বললে তা কী হতো? এখানে তো আর নিজের বাসা নেই যে আদর যত্ন করে খাওয়াবে!
আমার আশকারায় জুহির অভিমানের ঘটিতে যেন আরেকটু জল পড়ে ভারী হলো। সে মুখ গোঁজ করে বলল,
— নাই-বা খাওয়ালাম! কিন্তু একবার জানালে কি এমন হতো? যান, চলে যান আপনি।
আমি মুখটা কাছে এনে ফিসফিস করে বললাম,
— দেখো তোমার বাচ্চার মতো কাণ্ড সবাই হাঁ করে দেখছে। উঠে এসো।
অগত্যা জুহি বাইকে উঠে এলো। আমার গায়ে হাত দিলনা। পেছনের স্ট্যান্ড ধরে বসল। আমি বললাম,
— তোমার বাসা কোন জায়গায় বলো। নামিয়ে দিচ্ছি তোমাকে।
জুহি জায়গার নাম বলে চুপ করে গেল। অনেক্ক্ষণ দু’জনেই চুপ করে রইলো। বাতাসে শীতল ভাব। বৃষ্টি নামবে নামবে করছে। ফেরেস্তার অনুমতির অপেক্ষায়। একটু পরপর পথ চিনিয়ে দেওয়া ছাড়া আর কোন কথা হচ্ছে না আমাদের। আমি কিছু একটা বলতে গিয়েই নিজের প্রেস্টিজের কারণে বলতে পারছিনা। কী সুত্র ধরে কথা শুরু করব সেটাই বুঝে উঠতে পারছিনা। একটু পর বললাম,
— ধরে বসো, পেছনের হাতলতা একটু নড়বড়ে। (আদতে হাতল শক্তপোক্তই ছিল)
জুহি বাক্যব্যয় না করে আমার উদর পেঁচিয়ে ধরল ধীরে ধীরে। আবার বললাম,
— কথা বলছো না কেন?
— কী বলব?
আমি উত্তর খুঁজে পেলাম না। ঠিক তখনি ঝমঝম করে বৃষ্টি নামল। কি বড়বড় একেকটা ফোঁটা! সূচের মতো তীক্ষ্ণ বৃষ্টিফোঁটা একেবারে শরীর ভেদ করে রক্তে মিশে যেতে চাইছে। মুহূর্তেই পরিবেশটা রাস্তার পাশের ভেজা মাটির সোঁদা গন্ধে ভরে গেল। আমি তড়িঘড়ি করে বাইকের গতি কমিয়ে গাড়ি সাইড করার চেষ্টা করলাম। তখুনি জুহি চাপ জোর গলায় বলল,
—- আরে আরে… সাইড করছেন কে? চালান সমস্যা নেই।
ইতিমধ্যেই গাড়ি একটা পরিত্যক্ত ছাউনি দেখে সাইড করে ফেলেছি। আমি বললাম,
— আমার তো সমস্যা আছে। আমি ঠাণ্ডা সহ্য করতে পারি না।
— একদিন না-হয় করলেন। আমার অনেকদিনের স্বপ্ন প্রিয় কারো সাথে এভাবে বাইকে চড়ে বৃষ্টিতে ভেজা। প্রিয় কাউকে না-ই পেলাম। আপনাকে তো পেয়েছি। চলে যাবে…
আমি বাইক নিয়ে ছুটলাম পিচঢালা রাস্তার বুকে। যাক বৃষ্টিকে অসংখ্য ধন্যবাদ দেয়া দরকার এই মুহূর্তে নামার জন্য। তবে জুহি রাগ করে থাকলে আমিও যে আহ্লাদ করে ভাঙাতে যেতাম তাও কিন্তু না। তবুও কেউ আমার রাগ করে আছে জানলে, আমার উপর বিরূপ হয়ে আছে জানলে নিজের ভিতরে এলটা গিল্টি ফিল কাজ করে। সেটা থেকে মুক্তি পেয়ে নিজেকে হালকা লাগছে। জুহি বকবক করে যাচ্ছে অনবরত। আমি মাঝেমধ্যে হু হা উত্তর দিচ্ছি৷ আমার বাসা পেরিয়েই অল্প দূরে জুহির বাসা। এতোক্ষণ চিনতান না। এইমাত্র আমার বাসাটা পেরোতেই সেটা জানতে পারলাম। সিলেটের রাস্তাঘাট আমার কাছে অপরিচিত। আগে কখনো আসা হয় নি। এবারই প্রথম।
বাইক থামালাম জুহির বাসার সামনে। আসতে আসতে জানতে পারলাম ছোট্ট একটা ফ্লাটে একাই থাকে । কখনো সময় কাটাতে ওভার ডিওটিও করে। বৃষ্টিতে কাকভেজা হয়ে বাইকের পিছন থেকে নামল জুহি। এদিকে আমার অবস্থাও নাজেহাল। জুহির পুলিশী পোশাক ভিজে জবজবে হয়ে গায়ের সঙ্গে লেপ্টে আছে। চুলগুলো এলেমেলো হয়ে কিছু কপালে আর কিছু দুই কাঁধে ছড়িয়ে পড়েছে। সেই আসিক্ত চুল থেকে টপটপ করে পানি ঝড়ছে। গৌর বর্ণের মুখে বিন্দু বিন্দু বৃষ্টিজল টলটল করছে।টোকা দিলেই নিখুঁতভাবে ছড়িয়ে পড়বে। জুহি একগাল হেসে বলল,
— অনেল ধন্যবাদ আপনাকে এমন একটা সময় উপহার দেবার জন্য। সত্যি বৃষ্টি আমার খুউউব পছন্দের।
প্রতুত্তরে আমিও হেসে বললাম,
— এখনো দাঁড়িয়ে ভিজবে নাকি? যাও ঘরে কাপড় ছেড়ে ঘুম দাও একটা।
জুহি মুখে হাসিটা ঝুলিয়ে রেখে কিশোরী বালিকার মতো গোড়ালি আলগিয়ে আলগিয়ে সর্বাঙ্গে একটা ঝংকার তুলে বলল,
— ঠিক আছে। কাল দেখা হচ্ছে তাহলে?
— ওকে।
বলে আর দেরি না করে আমার একি পথে আমার সদ্য ভাড়া করা বাসায় গিয়ে পৌঁছালাম।
বাড়িটা তিনতলা। আমি একদম উপরের ফ্লাটেই থাকি। গেটে ঢুকতেই দারোয়ান বলে ওঠল,
— আপনারে অনেক ডাকিছিলাম স্যার। কিন্তু বিষ্টির মধ্যি আপনি বোধহয় আমার কথা শুনলেন না। সাঁ করে চলি গেলেন। ভাবলাম বিষ্টিতে পত-ঘাট ভুলি যান নি তো আবার!
আমি বললাম,
— না না, ভুলব কেন? ঐদিকে একজনকে পৌঁছে দিতে গিয়েছিলাম।
দারোয়ান ঠোঁট গোল করে স্বগোতক্তি করল,
— ও আচ্ছা… বুঝতি পারিচি।
এই দারোয়ান লোকটার বাড়ি খুলনায়। কথাবার্তা ধরণে ঐ দেশি টান আছে। বড্ড সরলমনা। প্রথমদিন আমার জিনিসপত্র নিয়ে বেশ সাহায্য করেছিল। পরে যখন জানতে পারল আমি পুলিশের লোক তারপর থেকে শুরু হল তার স্যার ডাকা।

পরেরদিন গভীর রাতে ওসি সাহেবের আদেশে আমার নেতৃত্বে একটা সশস্ত্র টীম অপারেশনের জন্য প্রস্তুতি নিল। এতোদিন পুলিশ তাদের ধরার ছাতি দেখায় নি উপযুক্ত প্রমাণের অভাবে। আজ সারাদিনে নানাভাবে তাদের বিভিন্ন অপকর্মের একটা লিস্ট তৈরি করলাম। এবং এ্যারেস্ট ওয়ারেন্ট নিয়ে গোপন সংবাদের ভিত্তিতে তাদের আস্তানায় হানা দিলাম পুরো টীম নিয়ে।আমার মনে হলো এটিই উপযুক্ত সময়। স্বর্ণা থাকলে সেও বন্দি হতো তাদের দলের সাথে। এখন সে দেশের বাইরে। কারণেই, এখন অপারেশন চালানোটাই বুদ্ধিমানের কাজ। তাছাড়া স্বর্ণা তো বলেছেই বাকী দু’টো প্রতিশোধের পর সে সব ছেড়ে সে নিষ্কলুষ হবে। সুতরাং এই গ্যাংকে আর প্রভাব বিস্তার করতে দেওয়াও অনুচিত কাজ। তাছাড়া আমার সংগ্রহকৃত তথ্যানুযায়ী স্বর্ণার রেকর্ডে ঐ প্রতিশোধের খুনগুলো বাদে অন্য কোন নৈরাজ্য নেই। এই গ্যাং এর সঙ্গে সে শুধু ওঠাবসা করতো একটা শক্তি পেছনে থাকার জন্য। তাছাড়া আর কিছু না। মাঝে মধ্যে পুলিশের জায়গায় বসে নিজেকে নিরেট অপরাধী মনে হয়। মনে হয়,একজন অপরাধী আমার চোখের সামনে বারবার সঞ্চরণ করে ফিরছে অথচ আমি তাকে বাঁধা দেওয়ার বদলে একপ্রকার সাপোর্ট দিয়ে যাচ্ছি। মনে হয়, এই পোশাকের সঙ্গে বেওয়াফা করা হচ্ছে। হয়তো কোন সময় এজন্য আমাকে এর চরম মূল্য দিতে হবে।

অপারেশন শুরু হলো মধ্যরাতে। গোপন আস্তানার গাড়ি পৌঁছানো মাত্রই চারিদিক হতে বিক্ষিপ্তভাবে বৃষ্টির মতো গুলিবর্ষণ শুরু হলো। টীমের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সদস্যরা বিচক্ষণতার সাথে আক্রমণ উপেক্ষা করে পাল্টা আক্রমণ শুরু করে এগিয়ে যেতে লাগলো মূল আস্তানার দিকে। অপরদিকে আসামীপক্ষ বেপরোয়াভাবে গুলি ছুঁড়তে ছুঁড়তে পিছিয়ে যাচ্ছে। বুঝতে পেরে আমিসহ আরো দক্ষ দু’জনকে নিয়ে ভিন্ন পথ অবলম্বন করলাম এবং বাকীদের গুলি ছুঁড়ে শত্রুপক্ষকে ব্যস্ত রাখার নির্দেশ দিলাম। আধপকা টিনের ছাউনি দ্বারা বাঁধানো বিশাল পরিত্যক্ত বাড়িটার পিছনে দিকে এগিয়ে গেলাম তিনজনে৷ একটা ভাঙা দেয়াল টপকে ঢুকে পড়লাম ঘরের ভিতর। এবার কয়েকজন আমাদের আগমন লক্ষ্য করে ছুটে এলো। আমি রিভলভার দিয়ে একজনের পায়ে গুলি করলাম। বাকী দু’জন বিবেচক ফাইটারের মতো হাত পা চালিয়ে মুহূর্তে তাদের জব্দ করে ফেলল। গুলি ছোড়া দলটিও আমাদের পেছন থেকে আচমকা আক্রমণে খেই হারিয়ে ফেলল। সঙ্গে সঙ্গে সবাইকে ঘিরে ফেললাম আমরা। মিনিট কয়েক ধরে গমগম করা পরিবেশটা নিমিষেই নিস্তব্ধ হয়ে গেল। আস্তানা থেকে অনেকগুলো দেশি-বিদেশি অস্ত্রসহ বেশ কিছু বিভিন্ন ধরণের মাদকদ্রব্য পাওয়া গেল। আসামিদের কারাগারে পুরে গভীর রাতেই আবার বাড়ি ফিরে এলাম। পরেরদিন বিভিন্ন চ্যানেল প্রশংসায় ভাসালো আমাকে। হেডলাইন হলো এরূপ,
” জয়েন করতে না করতেই বাজিমাত, গভীর রাতের অভিযানে অস্ত্রসস্ত্র হয় মাদকদ্রব্য উদ্ধার। নিহত ৩ আহত ৭ এবং আরো অনেকেই আটক ”

এই ঘটনার পর দুই দিন ধরেই স্বর্ণার কোন খোঁজখবর নেই। ফোন দিলে টুক টুক করে কেটে দিচ্ছে বারবার। তিনদিন গেলো, চারদিন গেলো, পঞ্চমদিনের মাথায় এক দুন্দুমার কাণ্ড ঘটে গেল। আমার বাইরে ডিওটি ছিলনা, থানায় বসেই নিমগ্ন হয়ে একটা জরুরি কাজ সারছিলাম। বাইরে ঘন্টাখানেক ধরেই প্রলুব্ধ বজ্রপাতসমেত নিরন্তর বৃষ্টি ঝরে চলেছে। থামবার জো নেই। কালো মেঘের কোলের জলগুলো সব উপুড় করা ছাড়া বুঝি আজ আর থামাথামি নেই। এমন সময় আচমকা আমাকে অবাক করে স্বর্ণা এসে হাজির হলো। প্রথমটা আমি খেয়াল করিনি। যখন অনুমতি ব্যতিত ধুপ করে সুমুখের চেয়ারে বসে পড়ল তখনই আমি চোখ তুলে তাকালাম;এবং সঙ্গে সঙ্গেই আমার বুকের ভেতরর উদ্দাম রক্ত যেন আছাড় খেয়ে পড়ল। পরক্ষণেই হৃদপিণ্ডটা যেন ধক করে লাফিয়ে উঠে স্বর্ণার হৃদপিণ্ডের সঙ্গে করমর্দন করতে চাইল। কিন্তু স্বর্ণার ক্রোধে ফেটে পড়া চেহারা দেখে সেই ইচ্ছে থিতিয়ে এলো। পুরো এক মিনিট হতবাক হয়ে রইলাম আমি। স্বর্ণা দুই হাতে টেবিলে ঠেকিয়ে ঈষৎ ঝুঁকে চাপা গলায় গড়গড় করে বলল,
— এসবের মানে কী? আমার পুরো গ্যাংকে তুমি এ্যারেস্ট করে নিয়েছ। হচ্ছেটা কি?
আমি অনেক কষ্টে স্বর্ণার অনাহূত আগমনের ভার সয়ে বললাম,
— কেন? গ্যাংকে দিয়ে তোমার কাজ কী,গ্যাং লিডারকেও তো পাওয়া যায়নি? আর দায়িত্বটা আমার উপর ন্যাস্ত ছিল তাই করেছি।
স্বর্ণা দু’হাতে টেবিল চাপড়ে হতাশার সুরে বলল,
— উফফ্ তুমি জানো যারা নিহত হয়েছে তাদের কাছে কি আছে?
আমি নির্ভারভাবে দাঁড়িয়ে বললাম,
— আমার জানার দরকার নেই। তুমি এসো আমার সঙ্গে।
বলে হাতটা ধরে দাঁড় করিয়ে একপ্রকার জোর করে কক্ষের বাইরে নিয়ে গেলাম। স্বর্ণা চাপা স্বরে চিবিয়ে চিবিয়ে বলেই চলেছে, ” আরে কোথায় নিয়ে যাচ্ছ!
স্বর্ণাকে আলাদা একটা হাজতে নিয়ে গেলাম। ওসি সাহেব নিজের রুম থেকে বের হচ্ছিলেন। আমাকে একটা মেয়ে টেনে নিয়ে যেতে দেখে হেঁকে বললেন,
— কী ব্যাপার? কই নিয়ে যাচ্ছো মেয়েটাকে। ও না তোমার সঙ্গে দেখা করবে বলল?
আমি একবার স্বর্ণার দিকে তাকিয়ে বললাম,
— এক ভদ্রলোকের মানিব্যাগ চুরি করেছে স্যার। আমাকে আগে থেকেই চিনে তো, তাই আমার কাছে আত্মসমর্পণ করতে এসেছে।
আশেপাশে প্রত্যেক সদস্য হো হো করে হেসে উঠলো।
হাজতে ঢুকাতেই স্বর্ণা দু’হাতে শিক ধরে দাঁত খিঁচিয়ে বলল,
— এটা কী হলো?
আমি রহস্যের হাসি হেসে বললাম,
— অনেকদিন তোমায় দেখিনা তো। তাই আজ হাজতে পুরে ইচ্ছেমতো দেখব।
বলেই মুখ ফিরিয়ে হেঁকে বললাম,
— কন্টেস্টেবল সাহেব… আপনি অন্যজায়গায় গিয়ে বসুন কিছুক্ষণ । আমি আপনার জায়গায় বসে দেখি আজ।

চলবে…