#শেষ_সূচনা
পর্বঃ১৮
লেখকঃ আরিফুর রহমান মিনহাজ
— কন্টেস্টেবল সাহেব… আপনি অন্যজায়গায় গিয়ে বসুন কিছুক্ষণ। আমি আপনার জায়গায় বসে দেখি আজ।
কনস্টেবল নির্বিষ প্রকৃতির লোক। আমার হাঁক শুনে শশব্যস্ত হয়ে চেয়ার ছেড়ে আমাকে জায়গা করে দিল। ওসি সাহেব আগেই চলে গেছেন নিজ কাজে। আমি আয়েশ করে বসে পায়ের উপর পা তুলে তেরছাভাবে একচোখ খুলে তাকালাম স্বর্ণার দিকে। সঙ্গে সঙ্গে চোখ ঘুরিয়ে নিলাম টেবিলের উপর। বাপরে, জলন্ত অগ্নিপিণ্ড যেন আমার দিকে তাকিয়ে আছে! ফুঁস ফুঁস নিশ্বাস ফেলে ফুঁসছে এখনো। গণ্ডের দুই পাশের চোয়াল ইস্পাতের মতো শক্ত। চোখ দিয়ে অগ্নিফোয়ারা তাক করে আছে আমার দিকে। দুই হাতে শক্ত করে চৌদ্দ শিকের দু’টো শিক ধরা। সমস্ত জোর দিয়ে জেঁতে ধরার কাঠিন্যেই বোধহয় লোহার শিক দু’টো চিঁচিঁ করে ডাক ছাড়ছে। থানার প্রত্যেকটা কর্মকর্তা সেদিকে হাঁ করে তাকিয়ে আছে। হয়তো-বা একটা ব্যাপার কোনভাবেই মিলাতে পারছে না যে,আত্মসমর্পণই যদি করে থাকে তবে এই অহেতুক ফুঁস ফুঁস আর অস্বাভাবিক রাতুল চোখের চাউনির রহস্যটা কী? এমপ্লয়িদের উৎসুক্য লক্ষ্য করে আমি এবার ব্যস্ত গলায় বললাম,
— হয়েছে হয়েছে।নাটক সিনেমা চলছে না এখানে। এবার নিজ নিজ কাজ করতে পারেন আপনারা।
সবাই আবার নিজ নিজ কাজে লেগে পড়ল। শুধু কনস্টেবল সটান দাঁড়িয়ে রইল আমার পাশে। আমি এবার স্বর্ণার দিকে তাকালাম নির্ব্যাজ চোখে। স্বর্ণা আগের মতোই স্থির, অবিচল। শুধু চোখ দু’টো ভিন্নভাবনায় কিঞ্চিৎ ছায়াছন্ন হয়ে এসেছে। আড়চোখে একদফা তাকালাম স্বর্ণার দিকে। এরপর স্বর্ণাকে উদ্দেশ্য করে কনস্টেবল এর দিকে তাকিয়ে বললাম,
— ক’টা টাকা পয়সা জরিমানা নিয়ে ছেড়ে দিই, কী বলেন?
টোপ লাগল জায়গামতো। স্বর্ণা তার ছিরিছাঁদের মতো চেহেরাটা আমার দিকে পুনরায় ঘুরাল। আমি একটু মুচকি হেসে এগিয়ে গেলাম সেলের সামনে। স্বর্ণা চট করে কপালটা ভাঁজ করে মুখ ঘুরিয়ে নিল। আমি এবার শব্দ করে হাসলাম। স্বর্ণা আবার মুখ ফিরিয়ে চাপা গনগনে গলায় বলল,
— কী? আবার ডাকাতের মতো হাসছ কেন? অকারণেই আমাকে এখানে বন্দী করেছ!
আমি কপট ক্রূর হেসে বললাম,
— চাইলে হাজারটা কারণ দাঁড় করাতে পারি। কিন্তু সেটা করবনা। আমি অল্পেই তুষ্ট থাকি।… এখন তুমি বলো। কখন এলে? কিভাবে এলে হুট করে না জানিয়ে?
স্বর্ণা ডেম কেয়ার ভাব নিয়ে বলল,
— জানানোর প্রয়োজন মনে করিনি তাই জানাইনি। কৈফিয়ত তো দিতে পারবনা।
আমি স্বগতোক্তি করে বললাম,
— কৈফিয়ত না। জানতে চাইছি। জানতে চাওয়া আর কৈফিয়ত কি এক কথা হলো?
— জানিনা এতোকিছু। তোমার এতো জানার প্রয়োজন নেই। শুধু জেনে রাখো, আমাকে এখানে বেশিক্ষণ আটকে রাখার ক্ষমতা তুমি রাখোনা। আমি ঠিকই বেরিয়ে যাব।… বলে স্বর্ণা ঘুরে দাঁড়িয়ে আনমনে প্যান্টের পকেটে দুই হাত গলিয়ে হাঁটতে হাঁটতে ভিতরের দিকে গেল। আবার ফিরে এলো। তার পরনে ছোট ছোট ছককাটা ডিজাইনের ঢিলেঢালা শার্ট আর কালো জিন্সের প্যান্ট। মাথার কেশদাম আঁট করে বাঁধা পেছনের দিকে। চার আঙুলের নিঁভাজ কপালে কৃত্রিম আলোয় তকতক করছে। মাঝেমাঝে সুক্ষ্ম কপালের ভাঁজে সেই আলো বন্ধুর এবং দিশাহারা হয়ে শোকপ্রকাশ করছে। একটু নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করলেই বোঝা কঠিন নয়, আগের থেকে একটু স্বাস্থ্যবান দেখাচ্ছে স্বর্ণাকে। আগের মতো অগভীর দুর্বল চাউনি আর নেই। বৈদেশিক আবহাওয়া আর নির্ঝঞ্ঝাট অবাধ চলাফেরার বিবর্তনে সেই চাউনি এখন ভরাট,অধিক সম্মোহনী। কোনপ্রকারে একবার চোখ আটকে গেলে ফেরানো বড় দায়! প্রসাধনহীন চোখের গহনে হারিয়ে যেতে বাধ্য যে কেউ। আমার মুখে আর উত্তর জোগালো না। স্বপ্নাবিষ্টের ন্যায় সেখানে দাঁড়িয়ে তার নিষ্ণাত পায়চারির সংখ্যা মনে মনে গুনতে লাগলাম। ক্ষণকাল পরেই স্বর্ণা পুনরায় সেলের শিক মুঠো করে ধরে আমার অনিমেষ চাউনির উপর মুখ কড়কে বলল,
— কী? মুখ ওমন করে আছ কেন? ইচ্ছে করছে একদল মাছি ঢুকিয়ে দিই।
এই দেশে বোধকরি এই প্রথম কোন নারী পুলিশকে হাজতের ভিতর থেকে এমনভাবে যথেষ্ট ধমকাচ্ছে। আর পুলিশটা পাল্টা বাক্যব্যয় না করে তার কথা শুনে যাচ্ছে। সত্যিই অদ্ভুত!
ঠিক সেই সময়-ই জুহি সদাশিব মুখে এসে উপস্থিত হলো। জুহিকে ঝকঝকে দেখাচ্ছে আজ। পুলিশি আঁটোসাঁটো জামার সঙ্গে একটা শীতকালীন জামা পরনে তার। এই ঘোর বর্ষায় শীতকালীন জামা কেন গায়ে দিল সেই বিষয়টা আমার কাছে অননুমেয়। আমি একনিমেষ তাকালাম সে দিকে। জুহি চপল পায়ের ছন্দে আমার পাশে এসে দাঁড়িয়ে বলল,
— কী হচ্ছে এখানে?
স্বর্ণা তখনো আমার দিকে ব্যগ্র দৃষ্টি নিক্ষেপ করে তাকিয়ে ছিল। জুহির আগমনে সে চোখের তারা একবারের জন্য ঘুরাল। পরমুহূর্তেই আবার আমার দিকে ফিরিয়ে বলল,
— এ কে? দেখে তো মনে হচ্ছে তোমার জুনিয়র! কথাবার্তার ধরণ এমন কেন?
আচমকা এমন আক্রমণাত্মক উক্তিতে জুহি থতমত খেয়ে গেল। পর্যায়ক্রমে চোখ ডবডব করে তাকাল আমার আর হাজতে বন্দিনী স্বর্ণার দিকে। এরপর বোধহয় আমার চেহেরা থেকেই কিছুটা সাহস জুগিয়ে চনমনে গলায় বলল,
— তুমি কোন নবাবজাদী হয়েছ যে জেলের ভিতর থেকে এই টোনে কথা বলছো? মেয়ের সাহস তো কম না!
স্বর্ণা কোন কথা বলল না। জ্বাজ্জল্যমান উনুনের মতো চোখ করে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল জুহির দিকে। বাগে পেলেই হাড়গোড়সহ চিবিয়ে খাবে এই বুঝি উদ্দেশ্য! স্বর্ণার কাছ থেকে কোন প্রকার উত্তর না পেয়ে জুহি সহসা আমার বাম বাহুপাশে নিজের ডানহাত ঢুকিয়ে দিয়ে বলল,
— আর আমি আমার স্যার এর সাথে যা খুশি করব,যেভাবে খুশি কথা বলব তাতে তোমার কী? যাও ভেতরে ঢুকে ঘুম দাও একটা।
আমি শঙ্কিত চোখে আশেপাশে একবার চোখ বোলালাম। নাহ কেউ দেখেনি, সবাই যার যার কাজে ব্যস্ত। জুহির হাত তখনো আমার হাতে আবদ্ধ। স্বর্ণা রাগে ফুঁসছে। আচানক একটা বিষম কাণ্ড ঘটিয়ে বসল স্বর্ণা। সেলের ভিতর থেকে দুয়েক পা সামনে এগিয়ে এসে অসম রাগে অধরোষ্ঠ দাঁতে চেপে ধরে সেলের দুই শিকের ফাঁকে হাত গলিয়ে দিল সে। জুহি কাছাকাছিই দাঁড়িয়ে ছিল। ফলে স্বর্ণা দুই হাতে জুহির গ্রীবা আঁকড়ে ধরে সেলের শিকের সঙ্গে ঠেসে ধরল। জুহি প্রাণপণে ঋজু অথচ কঠিন দুই হাত থেকে মুক্তি পাবার জন্য ছটফট করতে লাগল। আমি মুহূর্তের জন্য কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেলাম। পরক্ষণে একছুটে এগিয়ে জুহির গলা থেকে স্বর্ণার হাতটা একচোট ধস্তাধস্তির পর ছাড়িয়ে নিলাম। গটগট জুতোর শব্দ করে শাড়ি পরা কয়েকজন মহিলা পুলিশ কর্মী ছুটে এলো জুহির সাপোর্টে। জুহি তাদের সেবাযত্নের উদ্দেশ্যে এগিয়ে আসা বাঁ হাতে থামিয়ে দিয়ে নিজের গলা কিছুক্ষণ দুই হাতে ছেঁকে ধরে কয়েকটা শুষ্ক কাশি দিয়ে ধাতস্থ হলো। চোখের পলকে একটা অনভিপ্রেত পরিস্থিতির সৃষ্টি হলো। সবার কর্মমনোযোগ তখন চ্যুত হয়ে অকুস্থলে পতিত হলো। জুহি সেদিকে লক্ষ্য করে অনুচ্চস্বরে বলল,
— কিছু হয়নি। আপনারা কাজ করতে পারেন।
অথচ তখনো তার ডনহাত গলদেশে মৃদুভাবে সঞ্চালন করছিল। সবাই যখন ঘটনাটা মানিয়ে নিয়ে যে যার মতো চলে গেলো জুহি তখন আমার কানে চিঁচিঁ করে বলল,
— এই চিজ কোত্থেকে জোগাড় করলে? মহিলা তো পুরাই পাগল।
আমি গলাটা খাদে নামিয়ে বললাম,
— আরে চুপ থাকো। আবার গলা টিপা খেতে চাও নাকি হ্যাঁ? এ তো স্বর্ণা। জেলে আটকে রেখেছি বলে মেজাজ বিগড়ে গেছে।
জুহি ভ্রু কুঁচকে রিনরিনে গলায় স্বগতোক্তি করল,
— স্বর্ণা?
স্বর্ণা একটু ভিতরেই ইতস্ততঃ উদ্দেশ্যহীন হাঁটাহাঁটি করছিল। জুহির মুখে স্বর্ণা নিজের নাম শুনে খ্যাঁচম্যাচ করে বলল,
— এই কুত্তি আমার নাম জানল কীভাবে? তলে তলে সব বলা হয়ে গেছে দেখছি।
প্রতুত্তরে কেউ কিছু বললাম না। যা বুঝলাম, একে বেশিক্ষণ আটকে রাখা কোনমতেই সমীচীন নয়। হাজার হোক, থানা এটা ;পাগলা গারদ নয়।
———————————-
সমান্তরাল ফুটপাত ধরে হাঁটছি তিনটি প্রাণী। আমি মধ্যিখানে, ডানপাশে স্বর্ণা আর বাঁ পাশে জুহি। কারোর মুখে রা নেই,নিরুদ্যমে সামানে চোখ রেখে হেঁটে যাচ্ছে নিরন্তর। আশপাশ চতুষ্কোণে নীরন্ধ্র নীরবতা। রাস্তাঘাট জনবিরল। একটু আগেই শ্রাবণের বারিধারা নিজের আধিপত্য দেখিয়ে গেল টানা বৃষ্টিতে। এখন পরিবেশটা সদ্য যুদ্ধবিধ্বস্ত এলাকার মতোই নির্জীব ও নিস্তব্ধ। মাথার উপরে বিশাল আকাশের ঈষাণ কোন হতে ঘোরকালো মেঘ জমতে শুরু করেছে একে একে। একটু পরেই যে আবার দীর্ঘস্থায়ী বরিষন তল্লাটের বুকের পরে আছড়ে পড়বে এতে রত্তি পরিমাণ সন্দেহ নেই। এরিমধ্যেই এর সংকেত হিসেবে মেঘেদের ঝরে পড়ার শোকে শোকাকুল গুডুরগুডুর কান্না ভেসে আসছে আকাশের অনির্দেশ্য কোণ থেকে। আপাততঃ সবাই আমার বাসার দিকেই যাচ্ছি। জুহির বাসা আর আমার বাসা একি রোডে হওয়ায় জুহি চলে যেতে পারে নিজ বাসায়। থানা থেকে দেওয়া গাড়িতে তিনজন বহন করা অসম্ভব বটে। তাছাড়াও স্বর্ণা যে জুহির সাথে একই গাড়িতো চড়ার মত দেবে না সেটা আমার খুব ভালো করেই জানা আছে। রাস্তাঘাটেও এই প্রতিকূল পরিবেশে গাড়িঘোড়া তেমন একটা নেই। এই কারণেই হেঁটে চলতে হচ্ছে সবাইকে। স্বর্ণা ইতিমধ্যে বুঝে গেছে যে এই মেয়েটিই জুহি, যে সেদিন রাতে দেখা করার সময় ফোন দিয়েছিল।
থানায় জুহির সঙ্গে সেই অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার পর জুহি এই নিয়ে একটা কথা বলেনি। সারাদিন যে যার মতো কর্মস্থলে ব্যস্ত থাকার পর বাড়ি ফেরার সময়েই দেখা হয়ে গেল। স্বর্ণা তখন আমার সঙ্গে। আর একটা রাত থানায় আটকে রাখলে সাজানো গোছানো থানার অবস্থা যে নাকাল হবে সেটা আমার অজানা নয়। সেই নিমিত্তেই একসঙ্গে নিয়ে আসা। স্বর্ণা তখন নিজের অপরাধ বুঝতে পারলেও নিজের বরফট্টাই থেকে জুহিকে স্যরি বলেনি। আমার একসঙ্গে বাড়ি ফেরার প্রস্তাবে জুহিকে ডাকতেই জুহি স্বর্ণার দিকে একপলক তাকিয়ে ইতস্তত করল। সঙ্গে সঙ্গেই স্বর্ণা প্রশ্রয়ের হাসি দিয়ে মাথা নাড়লো। সেই হাসিতেই বুঝি দুজনের মধ্যকার সমস্ত আবিলতা মিমাংসা হয়ে গিয়েছিল।
অনেক্ষণ হাঁটার পর আমি নীরবতার জাল গুটিয়ে বললাম,
— কী হলো? সবাই এমন থমথমে ভাব নিয়ে আছ কেন? কিছু তো বলো!
কথাটা বললাম ঠিকই। কিন্তু মনে মনে আওড়ালাম,”সতীনের সামনে সতীন কি খোশমেজাজে কথা বলতে পারে?”মনের কথা মনেই সুপ্ত রইল।
দুজনে আমার দিকে তাকাল একবার। স্বর্ণা একটা নিঃশ্বাস উড়িয়ে দিয়ে বলল,
— স্যরি জুহি। আসলে আমার মাথা ঠিক ছিলনা। তুমি নিশ্চয় জানো আমাদের মধ্যে সম্পর্কটা কিসের ছিল। হঠাৎ কি যেন মনে হলো… এনিওয়ে বেশি ব্যথা পেয়েছ তুমি?
জুহি স্বর্ণার কথা ভালো করে বুঝে নিয়ে একটু ভেবেচিন্তে বলল,
— স্যরি হবার কিছু নেই। আমি তোমার সমস্ত জানি। তোমার জায়গায় আমি হলেও তাই করতাম। যদিও আমার অতো রাগ নেই। কিন্তু ভেতরে তোমার মতো মারমুখী মনোভাবই তৎক্ষনাৎ পোষতাম আমি।
— হ্যাঁ আমার রাগটা একটু বেশিই। তুমি কিছু মনে করোনা। এক্সট্রিমলি স্যরি।
জুহি উত্তরে ঠোঁট টেনে হাসলো।
তখন সন্ধ্যায় হয় হয়। আকাশ ভীষণ অপ্রসন্ন। শেষ বিকেলটাও ঘোর সন্ধ্যা বলে ভ্রম হচ্ছে। আমরা থামলাম বাড়ির ফটকের সামনে। দারওয়ান আমাদের দেখেই ফোকলা দাঁতে হাসল। স্বর্ণা জুহির হাতটা ধরে বলল,
— আজকে থেকে যাওনা আমাদের সাথে। আমার মনে কেমন জানি খচখচ করছে সকালের কাণ্ডটার জন্য। আমি সত্যিই আমিতে ছিলাম না।
জুহি স্বর্ণার রাখা হাতটা আলতো করে চাপ দিয়ে বলল,
— আজ না। অন্যদিন। কাবাব মে হাড্ডি হয়ে কী হবে?
স্বর্ণা শাসনের ঢংয়ে বলল,
— আরে ধুরর, কাবাব মে হাড্ডি আবার কী? চলো ভেতরে বৃষ্টি নামবে এখন। আমিতো কালই চলে যাব,সময় আর হবে না যে… বোন হিসেবে কথাটা রাখো! – শেষের দিকের কথাটা কোমল ও আদুরে শোনাল স্বর্ণার।
জুহি হাতটা ছাড়ালো ধীরে ধীরে। এরপর ধিমা একটা হাসি দিয়ে বিশদ কণ্ঠে বলল,
— আজ নাহোক অন্যদিন হবে। খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা কাজ আছে। আসি হ্যাঁ, টাটা।
বলে আর দাঁড়ায় না জুহি। বুটের জুতোই টক টক শব্দ তুলে পাকা রাস্তার পাড় ধরে এগোয় সে। একবারও পেছনে ফিরে তাকায় না। তাকানোর ইচ্ছেও বোধহয় অন্তর্হিত! অর্ধেক পথ যেতেই সুদূরের অাকণ্ঠ-নিমজ্জিত ধানক্ষেতের টলটলে পানির উপর খর বৃষ্টির আভাস দেখা দিল। কুয়াশার মতো ধূসর দেখাচ্ছে সেই দৃশ্য। ধীরে ধীরে ধানক্ষেতে বৃষ্টির গালিচা বিছানো শেষে রাস্তায় এসে পড়ল বৃষ্টির ছাঁট। জুহি এক নিমেষ দাঁড়াল। একবার ডানে বাঁয়ে তাকিয়ে রাস্তার পাশের মানকচু গাছ থেকে একটা বড় পাতা ছিঁড়ে নিয়ে সেটার তলদেশে আশ্রয় নিল। এরপর ডানহাতে সেটি ধরে রেখে লম্বা লম্বা পা ফেলে সাপের শরীরের মতো বাঁকানো পথের বাঁকে দ্রুত অদৃশ্য হয়ে গেল।
ঘরে এসে জামা কাপড় ছেড়ে নিলাম। স্বর্ণা অনেক্ক্ষণ সময় নিয়ে রান্নাঘর সহ বেডরুম গোছালো আর পাক্কা গিন্নিবান্নির মতো এটা ওটা বলে তিরস্কার করতে লাগলো। থানা থেকে বেরোনোর সময়ই কথা হয়েছিল আজকের রাতটা সে আমার এখানে থাকবে এবং সমস্ত ঘটনা আমাকে খুলে বলবে। যদিও কোন ঘটনাই আমার অবিদিত নয় ; খুলে বলার মতো গুহ্য কিছু এখন নেই। তা সত্ত্বেও কাছে রেখে দেওয়ার একটা বাহানা তো চাই! অল্পক্ষণের মধ্যেই এলোমেলো ঘরটাকে সাজিয়ে গুছিয়ে মানুষ করে তুলল স্বর্ণা এবং কিছু নাশতা বানিয়ে খাবার টেবিলে থরে থরে সাজাল ঘন্টা দুয়েকের মধ্যে। এতোকিছুর কোনটিই আমার বলা নয়। ঘরে ঢুকতেই নিজ থেকে সব করা শুরু করেছে সে। স্বর্ণার তরিবতের প্রশংসা করতে হয় অবশ্য!
বাইরে ঝুম বৃষ্টিটা থেমে নেই এক মুহূর্তের জন্যও। গোঁ ধরে মেঘের বুক থেকে সমস্ত জল যে আজই বর্ষণ করে ছাড়বে। মিশকালো মেঘও বরাতজোরে নিজের স্ব সর্বস্ব বিলিয়ে দিচ্ছে মেদিনীকে।
— কী এতো ভাবছ? এতো কষ্ট করে নাশতা বানালাম, মুখে না দিয়ে তুমি আন্যমনস্ক হয়ে বসে আছো?
আমি স্বর্ণার কথা শুনে জানালায় বিন্দু বিন্দু জমে থাকা বাষ্পের দিক থেকে ঘাড় ঘুরিয়ে পাটিসাপটা পিঠা মুখে পুরলাম। নতুন স্বাদের সঙ্গে পরিচয় হলাম। ফট বলে বসলাম,
— বাহ্! দারুণ তো! কোত্থেকে শিখলে?
স্বর্ণার পুরো মুখমণ্ডলে একটা মেদুর ছায়া পড়ল। এক টুকরো পাটিসাপটা পিঠা হাতে ছিঁড়ে মুখে গলিয়ে উদাস কণ্ঠে বলল,
— ছোটবেলাতেই শিখেছি মায়ের পাশে বসে বসে। বাসায় নিজ হাতে করেও খাইয়েছিলাম কয়েকবার।
ঠিক তখনি আমার মনে পড়ল সেই দিনটার কথা৷ যেদিন স্বর্ণার বাবা মা এসেছিল আমার কাছে। এখনো সেই ব্যাপারে কিছু বলা হয়নি স্বর্ণাকে। মনে মনে স্থির করলাম, সময়-সুযোগ বুঝেই বলতে হবে এই বিষয়ে। আপাতত সেই বিষয়টা আলোচনার শেষ প্রান্তে রাখলাম। স্বর্ণার উদাসীন মনের একঘেয়ে বেগার্ত ভাব দূর করতে বললাম,
— আচ্ছা স্বর্ণা ইদানীং কি তোমার মাথায় প্রবলেম দেখা দিচ্ছে? মানে… পাগল টাগল হচ্ছো না তো?
স্বর্ণা ফিক করে হেসে দিয়ে বলল,
— কেন এমনটা মনে হলো তোমার?
আমি মুখে থাকা নাশতার অবশিষ্ট অংশটা গিলে নিয়ে বললাম,
— না মানে, আজকে জুহির সঙ্গে সকালে এক রূপ আবার বিকেলে আরেক রূপ! যে কেউ এমন মনে করবে!
— আসলে… সকালে একটু বেশিই বাড়াবাড়ি করে ফেলেছি। অতোটা রেগে যাওয়ার কিছু হয় নি।
— ঠিক, ঠিক অতোটা রাগের তো কিছু হয় নি।
— হ্যাঁ, তার মানে প্রায়শই ঐ জুহি তোমার সঙ্গে ঘেঁষাঘেঁষি করে তাইতো? — টেনে টেনে কথাগুলো বলল স্বর্ণা।
আমি আমতা আমতা করে বললাম,
— ধ্যুর, তোমরা মেয়েদের এই একটা সমস্যা। সাধারণ কথাকে জিলাপি প্যাঁচ দিতে তোমরা পটু।
— তারমানে তুমি মেয়ে বিশারদ! অনেক অনেক মেয়েকে খেয়ে ছেড়ে দিয়েছ তুমি। যার ফলে এতো মেয়ে অভিজ্ঞ তুমি। তাই না?
—- ছিঃ ছিঃ কি খারাপ ভাষা! এগুলো কী ধরনের কথা হ্যাঁ?
—- এখন তো খারাপ লাগবেই। আমিতো খারাপ মেয়ে। খারাপ কথা বলি। ভালোদের কাছে যাওনা কেন? আমাকে কেন নিয়ে এলে? আর তোমাকে আমি ভালো করে চিনি। তোমার বন্ধু নাহিদকে গালি দেবার কারণে আমার কানমলা খেয়েছ সেটা ভুলে গেছ? এখন সভ্যতা দেখাচ্ছে।
— আচ্ছা তোমার কি হয়েছে বলোতো? মাথায় সমস্যা হয়েছে? নাকি আট ন মাস অনবরত মিষ্টি কথার কারণে একঘেয়ে লাগছে? ঝগড়া করবে বলে সংকল্প করলে নাকি?
— তারমানে আমি সবসময় ঝগড়ার ইনটেনশন নিয়ে থাকি না?
আমি আর জবাব দিলাম না। মেয়েটাকে আজকে ‘তারমানে ‘ রোগে পেয়েছে। সাধারণ কথাকে প্যাঁচাচ্ছে। তবে এটা সত্যি যে স্বর্ণার আজকের ব্যবহারে আমি যথেষ্ট অভিভূত হয়েছি। আজকের দিনটা বিবেচনায় আনলেই দেখা যায় স্বর্ণার বাইরের মুখটা বজ্রকঠিন আর কলুষতায় ভরপুর হলেও ভিতরের মনটা স্ফটিকের মতো স্বচ্ছ আর অনাবিল। অথচ জগতের মানুষ ভিতরটা দেখতে পায়না। ভিতরটা সেই দেখতে পায় যার সঙ্গে মানুষটার হৃদয়ের সম্পর্ক রয়েছে। জবাব না পেয়ে স্বর্ণা শক্ত কণ্ঠে বলল,
— আচ্ছা, সত্যি করে বলোতো জুহির সঙ্গে তোমার কী চলে?
স্বর্ণার গলার এই সুর আমার অপরিচিত নয়। এই সুরের দৃঢ় কথা হেলাফেলা করে এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। বললাম,
— সত্যি কিছু না। সেই ক্যাম্প থেকে আমরা পরিচিত। এজন্যই একটু বেশি আশেপাশে থাকতে চায়।
স্বর্ণার গভীর অভিনিবেশে তাকাল আমার দিকে। বেশকিছুক্ষণ চোখের দিকে তাকিয়ে থেকে নিশ্চিন্ত হবার ঢংয়ে চোখ ঘুরিয়ে কৌতুকের সুরে বলল,
— না… থাকলে কিন্তু বলতে পার। মেয়েটাও একলা আছে, তুমিও একলা আছো। সময় নষ্ট করে কী লাভ?
আমি বললাম,
— আমার অতো ইচ্ছে নেই। হঠাৎ জুহির জন্য এতো দরদ উৎলে উঠল কেন?
— তারমানে জুহির জন্য শুধু তুমি….
আমি আর শোনলাম না। দুই হাতের তর্জনী আঙুল কানে পুরে দিয়ে দিলাম। স্বর্ণার ঠোঁট নড়তে দেখা গেল শুধু।
রাতে স্বর্ণা রান্না করল বেশ যত্ন করে। এর আগে দারোয়ানকে দিয়ে সমস্ত বাজার করিয়ে নিজে কিছুক্ষণ দারোয়ানের দায়িত্ব পালন করে এলো গেটের সামনে। খাওয়া-দাওয়া শেষ হতে রাত্রি দশটা পার হলো। তখন ক্ষণিকের জন্য রগচটা বৃষ্টি শান্ত হয়ে পৃথিবীকে নিশ্বাস ফেলার সুযোগ করে দিয়েছে। পরিবেশ থমথমে। টিভি দেখতে দেখতেই স্বর্ণা সুষুপ্তিকে আপন করে নিল। এয়ারপোর্ট থেকে সরাসরি থানায় এসেছিল সে। বেজায় অবসন্ন সে। একমনে টিভি দেখতে দেখতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়ল সে নিজেও জানেনা। আমি মায়ের তৈরি করা একটা কাঁথা স্বর্ণার গায়ে জড়িয়ে দিয়ে নিজের রুমে ফিরে এলাম।
মাঝরাতে হঠাৎ ঘুমের রাজ্য ভেঙে খানখান হলো চোখেমুখে অনাহূত বৃষ্টির ছাঁটে। চোখ মেলেই দেখলাম খাটের পাশের জানালাটা আটকানো হয়নি। জানালার গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে বৃহদাকার আমগাছ। জোলো হাওয়ায় তেরছাভাবে পতনন্মুখ বৃষ্টি এসে পড়ছে সোজা বিছানায়। তড়িৎ উঠে গিয়ে জানালাটা একটানে বন্ধ করে দিলাম। আচমকা কোন কিছুর শব্দে ছিঁচকে প্রাণী যেমন ত্রস্ত হয়ে পালায় আমার ঘুমটাও ঠিক সেভাবে পালিয়ে গেল। রাতের গভীরতায় আর বৃষ্টির তীব্রতায় ঘুমের রাজ্যের সোপান বোধহয় হারিয়ে ফেললাম আমি। কি মনে করে ধীরপায়ে রুম থেকে বেরিয়ে এলাম। চপল চোখে পুরো বারান্দার একোণ-ওকোণ চোখ বোলালাম। কোথাও স্বর্ণা নেই। হঠাৎই আমার নিভু নিভু পঞ্চইন্দ্রীয় সক্রিয় হয়ে উঠলো। বিক্ষিপ্ত পায়ে এঘর-ওঘর আঁতিপাঁতি করে খুঁজতে শুরু করলাম। কিন্তু স্বর্ণা নেই। শেষতক বারান্দায় গিয়ে আবিষ্কার করলাম একটি নারী ছায়ামূর্তি ঠায় দাঁড়িয়ে প্রস্তরীভূতের ন্যায়। কোন নড়চড় নেই। বারান্দার সিলিং এ জ্বলছে একটা টিমটিমে রঙিন ডীম লাইট। আমি দক্ষিণ হাত বাড়ি সেটা বন্ধ করে সোলারের লাইটটা জ্বালালাম। তাও স্বর্ণার ভাবান্তর ঘটল না। দু’কদম এগিয়ে গেলাম। দুই হাতে কাঁধ ধরে ঘুরিয়ে এমুখো করলাম স্বর্ণাকে।
একটু চমকালাম আমি। মুখ দিয়ে কথা বেরোলো না। বাইরের অনবরত বরিষনে তাল মিলিয়ে নিঃশব্দ রোদনে অভিপ্লুত হয়ে পড়ছে লোনা জ্বল। অঝোর ধারায় বইতে থাকা চোখের খালিজুলি থেকে গালে দাগ বসেছে কান্নার। আমার প্রশ্নসূচক দৃষ্টি বুঝতে পেরে স্বর্ণা দু’হাতে কপোলের পানি মুছে বলল,
— কিছু হইনি। প্রতিরাত আমার এভাবেই কাটে। একজন ধর্ষিতার আর্তনাদ লোকসাধারণ কী করে বুঝবে বলো? মানুষেরা শুধু দিনের বেলায় সহমর্মিতা দেখায়। সব ভুলে এগিয়ে যাওয়ার জন্য উৎসাহিত করে। কিন্তু দিনরাত কতটা কলঙ্ক সে বয়ে বেড়ায় সেটাই সে-ই জানে। সে-ই বুঝে। যে এর স্বীকার হয়েছে। সেই কলঙ্কটা যে রাতের ঘুম কেড়ে নেয়! উপহার দেয় একটা নির্ঘুম রাত। সেটা কে বুঝবে? আমার না বুঝে আসেনা, এই মেয়েরা আত্মহনন করে কেন? যে বা যারা তাদের জীবনের সমস্ত আলো,সমস্ত আশা-ভরসা, সমস্ত সুগঠিত স্বপ্নগুলোর সূর্য অকালে অস্তমিত করেছে তারা কেন নির্দ্বিধায় ঘুরে বেড়াবে? ধর্ষিতাই যদি পৃথিবীর সুখ উপভোগ করতে না পেরে অস্তপাড়ের সন্ধ্যাতারায় মিলিয়ে যাবে। ধর্ষক কেন সেখানে দম্ভভরে সেই সন্ধ্যাতারার আলোতে পৃথিবীর নেয়ামত উপভোগ করবে? এটা তো হতে পারেন! নারীজাতী আজীবন নিজেদের হীন মনে করেছে। আর কতো পুরুষদের এই অমানুষিক দৌরাত্ম চলবে? আর না! দেখে নিও! আর না! এই ছয়টি খুনের পর এই দৌরাত্ম কিছুটা হলেও স্থির হবে। আমি হয়তো তখন এই পৃথিবীতে থাকবনা। কিন্তু তুমি আমার কথা মিলিয়ে নিও।
স্বর্ণা থামল। তার চোখ আবার জোয়ারের জ্বলে ভেসে উঠেছে, এতো পানি বুকে ধরতে না পেরে ফুলে ফেঁপে উপছে পড়ছে পাড়ে। স্বর্ণা আবার বলল,
— নেক্সট মিশন খুব শীগ্রই হবে। হঠাৎ অদৃশ্য হলে আফসোস করোনা!
পরেরদিন সকাল সকাল জুহি এসে হাজির হলো। তার হাতে হটবক্স। আমার ডিওটি ছিলনা সকালে। আমরা তখন চা বাগানে স্বর্ণার গোপন আস্তানায় যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছিলাম। যেখানে স্বর্ণা গত এক বছর ধরে যায় নি। স্বর্ণা দরজা খুলে দিয়েই সূচালো দৃষ্টি মেলে প্রশ্ন করল,
— তুমি কি প্রতিদিন এভাবে মিনহাজের সেবা করো নাকি? বোন হিসেবে?
জুহি এভাবে প্রশ্নবিদ্ধ হওয়াটা আশা করেনি মোটেও। সে চোরা চোখে আমার দিকে তাকিয়ে ইঙ্গিতে মদত প্রার্থনা করল শুধু। আমি এগিয়ে এলাম দরজার পাশে।
চলবে…