শেষ সূচনা পর্ব-১৯

0
326

#শেষ_সূচনা
পর্বঃ১৯
লেখকঃ আরিফুর রহমান মিনহাজ

— তুমি কি প্রতিদিন এভাবে মিনহাজের সেবা করো নাকি? বোন হিসেবে?
জুহি এভাবে প্রশ্নবিদ্ধ হওয়াটা আশা করেনি মোটেও। সে চোরা চোখে আমার দিকে তাকিয়ে ইঙ্গিতে মদত প্রার্থনা করল শুধু। আমি এগিয়ে এলাম দরজার পাশে। হটবক্সটা দুইহাতে এগিয়ে নিয়ে বললাম,
— আরে থামোনা। মেয়েটা ঝড় বাদলের দিনে কষ্ট করে ব্রেকফাস্ট রেডি করে এনেছে তা না দেখে কিসব প্রশ্ন করতে শুরু করে দিলে। এসো এসো ভেতরে এসো।
শেষে উদ্বেগ নিয়ে জুহিকে ঘরে আসার জন্য অভ্যর্থনা জানালাম আমি। স্বর্ণা মুখ কঠিন করে বলল,
— এক্ষুণি তো একপেট গিলেছ। আরো খাবে নাকি? শেষে দেখা যাবে ঐযে পেটওয়ালা পুলিশগুলোর সঙ্গে যোগ দিবে তুমি।
আমার হাসি হাসি মুখটা ফাটা বেলুনের মতো টুঁই করে চুপসে গেল। মুখে আর কোন কথা ফুটলনা। জুহিকে অপ্রসন্ন দেখাল। ভারী হতাশার গলায় বলল,
— দেরি করে ফেললাম তাহলে! উফফ, যেই বেরুতে যাব তখনি ঝুমঝুম করে বৃষ্টি নামল।
আমি তাড়া দিয়ে বললাম,
— হয়েছে ধান ভানতে শিবের গীত করে লাভ নেই আর। ভেতরে এসো।
জুহিসহ সবাই ভেতরে এলো। আমি হটবক্সটা ফ্রিজে রাখতে রাখতে বললাম,
— ভালোই হলো, সন্ধ্যার নাশতাটা মিটে গেল। পরক্ষণে আবার স্বর্ণার দিকে তাকিয়ে বললাম, তোমার ওখান থেকে ফিরতে কি বেশি দেরি হবে স্বর্ণা?
স্বর্ণা জুহির পাশে বসে লাগাতার চ্যানেল বদলাচ্ছিল। না তাকিয়েই উত্তর দিলো,
— হ্যাঁ, হলেও হতে পারে। এখনো ঠিক বলতে পারছি না।
মাঝখান থেকে জুহি অলক্ষ্যে প্রশ্ন ছুঁড়ল,
— তোমরা কোথাও বেরোচ্ছ নাকি? ঘুরাঘুরি বা…জরুরি কাজ?
স্বর্ণা দিল এর জবাব,
— দুটোই। একসঙ্গে দুই কাজ সারব।
জুহি ঠোঁট গোল করে উপরে নিচে মাথা দুলিয়ে বলল,
— ওওও আচ্ছা।

অল্পকিছুক্ষণ পর জুহি ডিউটির বাহানায় সরে পড়ল। অথচ আজ জুহির ডিউটি ছিল রাতে সেটা আমি বেশ ভালো করেই জানি। এতেই বোঝা দুষ্কর নয় যে, সে নিজের অবস্থান সম্পর্কে যথেষ্ট অবগত এবং ভবিষ্যৎ চিন্তায় স্বেচ্ছায় দূরে সরে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। । দু’জন মানুষের ভিতরে অনাধিকারচর্চা করার ইচ্ছে তার একেবারেই নেই। যদি-ও তার আচার আচরণ আমার অনুকূলে একটা ধিমা দুর্বলতা প্রকাশ করে। কিন্তু, সব দুর্বলতাকে প্রশ্রয় দেয়া মানে তো নিজের সর্বনাশ নিজেই আপন মনে করে বুকে জড়িয়ে নেওয়া। নশ্বর জীবনে যে-ই এই সাময়িক দুর্বলতাকে উপেক্ষা করে উদ্দিষ্ট লক্ষ্যে উপনীত হবার চেষ্টা করবে সে-ই জীবনে চরিতার্থ হয়। তবে ধুরন্ধর জুহিই-বা কেন সব জেনেও বাঁকা পথে আমার জন্য মুখিয়ে থাকবে? আমার মনের রাজ্যে যেখানে আমার আচরিত রাজতন্ত্র চলে সেখানে তার অবস্থান কি রাণীর মতো? না রাজার জন্য উন্মাদ হওয়া মামুলি কোন সাধারণ প্রজা সে! জানে। খুব ভালো করে জানে সে। এতোটা অবোধ সে নয়।
জুহি যখন কপট কাজের ভড়ং ধরে বেরিয়ে যাচ্ছিল তখনো বাইরে মন বেজার করা গুড়িগুড়ি বৃষ্টি পড়ছে অনবরত। ঘোরকালো মেঘপুঞ্জ ছন্নছাড়া হয়ে আকাশময় ঘুরঘুর করছিল দিকবিদিকে। একজোট হয়ে জোরালো বর্ষণে তল্লাটকে শোকাভিভূত করার পাঁয়তারা করছে কানে কানে। নির্দ্বিধায় আমার কাছ থেকে একটা ছাতা চেয়ে নিয়ে একটা বাক্যব্যয় না করেই চতুর পায়ে বেরিয়ে গেল। স্বর্ণা কিছুক্ষণ নির্নিমেষ তাকিয়ে রইলো জুহি চলে যাওয়ার পানে। দেখে মনে হলো, এই মাত্র অতি আপন কেউ বিদায় নেওয়ায় মনটা তার যারপরনাই বিষণ্ণ। একটু পর দরজার চৌকাঠ থেকে ধীরে ধীরে চোখ তুলে ছোট্ট একটা দীর্ঘশ্বাস চেপে বলল,
— চলো বেরিয়ে পড়ি।
আমি সংকোচ দূর করতে বললাম,
— এখুনি? সবে আট টা বাজে। পরিবেশটা কেমন গুম হয়ে আছে, আরেকটু পরে বেরোয়?
— নাহ, এখুনি বের হবো। চলো।
— ওমা তোমার মাথায় আবার কীসের ভূত চাপলো হঠাৎ?
— ভূত চাপেনি তো! তোমার হয়তো ভূত চেপেছে ঐ জুহিকে দেখে। নাহয় আমরা তো বের হবার জন্যই রেডি হচ্ছিলাম।
— কি যা তা বলছো। বারবার জুহি,জুহি জুহি! জানোই তো সব। বার-বার বলার কী দরকার?
স্বর্ণা একটু থমকালো। ব্যাগে কিছু প্রয়োজনীয় জিনিস পুরতে পুরতে বলল,
— তোমাকে রাগাতে পছন্দ করি এবং করতাম সেটাও দেখি ভুলতে বসেছ!
স্বর্ণার নির্ভার স্বীকারোক্তিতে আমার সব তেজ যেন মুখ থুবড়ে পড়ল। মুখে আর উত্তর জোগালো না। অন্তর্ভেদী দৃষ্টিতে একবার স্বর্ণার পুরোটা পড়ে ফেলার চেষ্টা করলাম শুধু৷ পারলাম না। মেয়ে মানুষের হৃদয়ের অন্তস্পট সরিয়ে সবকিছু পড়ে ফেলা যতোটা সোজা ভাবা যায় ততটা সোজা আসলে নয়।

গাড়ি ছুটে চলেছে বাতাস কেটে অজানা অচেনা এক গন্তব্যে। একটা চার চাকার গাড়ি ফোন করে এনেছে স্বর্ণা। গাড়ির নামটা আমার অজানা। তবে চড়ে বেশ আরাম বোধ হয়। সিলেট শহরে এর আগে আসা হয় নি কখনো, আগেই বলেছি। কারণেই, এখন কোথায়, কোন গুপ্ত জায়গায় যাচ্ছি সেটা বলা ভার। গুড়িগুড়ি বৃষ্টিটা ইস্তফা দিয়েছে একটু আগে। বাইরের সোনালী ঝলমলে রোদ উঁকি দিচ্ছে কালো মেঘের ফাঁকে। সদ্য বৃষ্টিস্নাত গাছের পাতাগুলো কাঞ্চনপ্রভায় মুক্তোর মতো আলো ছড়াচ্ছে লোকসাধারাণের চোখ ধাঁধিয়ে। দূরে ফিনফিনে কুয়াশায় আচ্ছন্ন দাঁড়িয়ে থাকা উঁচু পাহাড় দেখা যাচ্ছে ঢিবির মতো। গোলকধাঁধার মতো পাহাড়গুলো। টানা দশ মিনিট গাড়ি সামনে এগুনোর পরও পাহাড়গুলোর আয়তনে পরিবর্তন আসেনি। এটা অবশ্য নতুন কিছু নয়। এই অদ্ভুত রূপই পৃথিবীর মজ্জাগত বৈশিষ্ট্য। বাইরের তকতকে আবহাওয়াটা উল্টো পিঠের দৃশ্যটার মতোন স্বর্ণা নিষ্প্রাণ হয়ে মাথাটা সিটে ঠেকিয়ে বসে আছে। চোখযুগল সুদূর পাহাড়ের চুড়ায় গহন নিবদ্ধ। আমি ডান স্কন্ধ দিয়ে মৃদু ঠেলা দিয়ে বললাম,
— ঐ,আমরা কোথায় যাচ্ছি?
— জাহান্নামে।
এককথায় উত্তর দিয়ে কুঁকড়িমুকড়ি হয়ে দূরে সরে বসল সে। চোখমুখ একযোগে কঠিন করে আবারো বাইরে তাকাল। আমার প্রশ্নসূচক দৃষ্টি তখনো তার মুখের উপর আবদ্ধ ছিল। না সরিয়েই বললাম,
— ওমা, আবার কী হলো? সবসময় এমন এ্যাঙ্গরি মুড নিয়ে থাকো কেন বলোতো?
স্বর্ণা মুখের ভাব একটুও পরিবর্তন না করে শুধু ঠোঁট দু’টো নেড়ে বলল,
— সবসময় ভালো মুডে থাকার কোন কারণ আছে কি?
— কতকিছুই তো আছে… এটুকু বলে থামলাম। অনেক্ষণ ধরে ড্রাইভার লুকিং গ্লাসে চোরা চোখে বারবার উঁকি মারছিল। এবার তাকাতেই ড্রাইভারের দিকে তাকিয়ে ক্রূর কণ্ঠে বললাম,” কী সমস্যা আপনার? ভালো করে গাড়ি চালান। প্রয়োজনে কানে তুলো গুঁজে রাখেন। আপনি আর আপনার বউয়ের কথা কি আমরা শুনতে যাব?

ড্রাইভার কেবলা হাকিমের মতো সিগারেট পোড়া কালো ঠোঁট দু’টো প্রসস্থ করে হাসল। পরক্ষণেই লুকিং গ্লাসে তাকিয়ে প্রশ্ন করল,
— মেডাম বিয়া করলেন কখন?
স্বর্ণার ভাবান্তর ঘটল না। চেহারায় আগের নিস্পৃহ রূপটা প্রলম্বিত রেখে শীতল গলায় বলল,
— সেটা জেনে তোমার কাজ নেই। গাড়ি চালাচ্ছ গাড়ি চালাও।
ড্রাইভার চুপ করে গেল। আমি খুশি হলাম বটে। কিন্তু আর কথা বললাম না। অকারণ অভিমানের ফাঁকা ঝুলিটা টইটম্বুর হয়ে উঠল হঠাৎ।

বেলা দশটা নাগাদ আমরা গন্তব্যে পৌঁছে গেলাম। গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়ালাম একটা ঘাট থেকে অল্প দূরে। জায়গাটা নির্জন। অদূরের ঘাট থেকে ভেসে আসছে লোকারণ্যে গমগম করা পর্যটকদের কোলাহল, হাঁকাহাঁকি, ডাকাডাকি। এখান থেকে লঞ্চ ইস্টিমারে ঘাটটা দেখা গেলেও গাছপালায় নিঝুম অরণ্যের কারণে ঘাট থেকে এদিকটা দেখা যাবে না সেটা নিশ্চিত। জায়গাটা হতে পারে কোন হ্রদ কিংবা কোন নদী। জানাশোনা না থাকলে খালি চোখে এর সঠিক নামটি বলা শক্ত। ড্রাইবার আমাদের নামিয়ে দিয়ে শাঁ করে গাড়ি ছুটে চলে গেল। আকাশে ঝুলে থাকা সূর্যের তেজ বাড়লেও উষ্ণতা বর্ষার বরফশীতল বাতাসের দুরন্তপনায় ম্লান হয়ে আছে। আমি কপাল কুঁচকে স্বর্ণাকে বললাম,
— ঐ ঘাটে না গিয়ে এখানে এলে যে?
— সমস্যা আছে। আসো নিচে নামো। নিচে নৌকা রেডি আছে। আমি ব্যবস্থা করে রেখেছি। আশা করি সমস্যা হবে না।
রাস্তার পাড় থেকে নিচের দিকে বাঁকাভাবে পাকদণ্ডীর মতো একটা সরু পথ নেমে গেছে। স্বর্ণা পূর্বভিজ্ঞ। সে আগে আগে নামল। আমি পিছু পিছু গেলাম তার। সত্যি সত্যিই নিচে একটা নৌকা প্রস্তুত ছিল। ছোটবেলা থেকেই নৌকা চড়া নিয়ে আমার যথেষ্ট আপত্তি আছে। এর পেছনে সুপ্ত একটা কারণও যদিও রয়েছে, যেটার কারণে আমাকে আক্কেলসেলামি দিতে হয়েছিল। যাক,সেদিকে নাই-বা গেলাম। আহি মুখ পাংশু করে বললাম,
— চারদিকে এতো এতো যান্ত্রিক নৌকা থাকতে এই হাত চালিত নৌকা আনতে হলো কেন?
স্বর্ণা বিরক্ত হয়ে চোখদুটো আশাহীন করে বলল,
— আরে বাবা। আমরা অন্য সবার মতো ঘুরতে যাচ্ছি না। উই নীড সেফটি।… একটা গোপন জায়গায় যাচ্ছি, সেখানে এসব যান্ত্রিক জিনিস বয়ে বেড়ানোর কী দরকার? গেলে এসো,নাহয় চলে যাও।
শেষ কথাটা বলে নৌকায় ডান পা এগিয়ে দিয়ে ছইয়ের ভিতর গিয়ে বসল স্বর্ণা। অগত্যা আমিও ছুটে গিয়ে স্বর্ণার বিপরীতে ছইয়ের ভিতর গিয়ে বসলাম। মাঝি হাঁ করে তাকিয়ে আমাদের কথোপকথন গিলছিল। স্বর্ণা বলল,” মাঝি, নোঙর তুলে এগোও তাড়াতাড়ি। সময় খুব কম।”
মাঝি আতালিপাতালি করে নোঙর তুলে নৌকায় একটা ঠেলা দিয়ে লিকলিকে শরীরে একলাফে নৌকায় উঠে এলো। এরপর ছপছপ করে দাঁড় টানতে লাগল। দেখলে পরিক্ষীণ বলে ভ্রম হলেও মাঝির কবজিতে দারুণ জোর। রোদে পোড়া তামাটে শরীর। খালি গা। পেটের সঙ্গে পিট লেগে আছে টানটান হয়ে। আমি শব্দ করে বললাম,
— মাঝি, খাওয়াদাওয়া করোনি নাকি?
মাঝি বিচিত্র ঝকঝকে দাঁত কপাটি দেখিয়ে হেসে না সূচক মাথা নাড়ল। স্বর্ণা ব্যাগ থেকে একটা পাউরুটি হাতে নিয়ে ছই থেকে বেরোল।
— নাও মাঝি খাও। ততক্ষণে আমি দাঁড় টানি।
মাঝি আবার সেই হাসিটা দিয়ে দাঁড়টা স্বর্ণার হাতে তুলে দিল। এরপর গপগপ করে শুকনো পাউরুটি চিবোতে শুরু করল। একাই পুরো প্যাকেট উদরস্থ করার পর অঞ্জলি ভরে পানি খেল জলাশয় থেকে। একটা তৃপ্তির ঢেকুর তুলে পুনরায় দাঁড়টা হাতে তুলে নিল মাঝি।
পুরো দৃশ্যটা আমি বিস্ময়াভিভূত হয়ে অবলোকন করলাম। অদ্ভুত এক ভালোলাগা মনের অলিন্দে বসন্তের শেফালী ফুলের গন্ধে মতোন ম- ম করলো। কিন্তু শেফালী ফুলের ক্ষণস্থায়ী সুভাষের মতো অল্পক্ষণেই কল্পিত মনের অলিন্দের সুভাষ ও বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না। বেসামাল ভাবনাগুলো প্রতিশোধ উন্মুখ জীবের মতো ধারালো নখের আঁচড় কাটে হৃদয়ে। যে মেয়েটা সংকোচবিহীন মানুষ মারতে পারে সেই মেয়েটা মানবসেবাও করতে পারে। আনাহারে থাকা মাঝির খাবার মুখে তুলে দিতে পারে। স্বর্ণার ভিতরেও একটা পবিত্র কোমল মন আছে যেটা খালি চোখে ধরা পড়েনা। এরজন্য প্রয়োজন আলাদা এক দৃষ্টি। ভালোবাসার দৃষ্টি। যে দৃষ্টিতে কলুষতা ক্ষণিকের জন্যও ভর করে না। সময় শুধু মানুষের উপরেরটা বদলে দেয়।পাকেচক্রে নানাবিধ কুকর্মের দ্বারা মনের উপরের স্তরে যে কালো আস্তরণ পড়ে কখনো সেই আস্তরণ ফুঁড়ে তার আসল রূপটাও উদ্ভাস হয়। তখন সেই মনশ্চক্ষে তা স্পষ্ট প্রমূর্ত হয়।

নৌকা একটা ছোট খালে প্রবেশ করল। এটা পিয়াইন নদীর একটা উপশাখা। এতক্ষণে জানতে পারলাম আমরা পিয়াইন নদীর বুকের উপর দিয়েই আসছিলাম। খালটা খুব একটা বড় নয়। চারপাশে জনবিরল অনিবিড় অরণ্য। বন্য এলোমেলো গাছপালা বয়সের ভারে খালের উপর মাথা নুইয়ে পড়েছে খালের জলের উপর। ঘন বনের গাছ-পালা,লতাপাতায় একে অপেরর সঙ্গে জড়াজড়ি করে আছে। তিল ধারণের ঠাই নেই। পাখির দল কিচকিচ করছে এডাল ওডাল করে বেড়িয়ে। আকাশটা আবার মেঘলা হয়ে এলো। আমি সেদিকে তাকিয়ে মনে মনে বললাম এই জঙ্গলে কীভাবে থাকতো স্বর্ণা? ভাবতেই দম বন্ধ হয়ে আসে।
স্বর্ণা বোধহয় আবার ভেতরের কথাটা বুঝতে পেরে বলল,
— জায়গাটা সুন্দর না? আর বেশিদূর নেই। পনের থেকে বিশ মিনিট লাগবে।
— হুঁ, খুব সুন্দর। এখানে থাকতে তুমি? আর নৌকায় আসা-যাওয়া?
— হ্যাঁ, ঘরে অবশ্য একজন হিন্দু মেয়ে আছে। বাচ্চা মেয়ে। বয়স পনের কি ষোল হবে। সবকিছু গুছিয়ে রাখে। বাবা মা নেই। পড়ালেখা করাতে চেয়েছিলাম। কিন্তু পড়তে চায় না। বসের আত্মীয় হয়।
— সে যদি সব ফাঁস করে দেয়? উৎসুক কণ্ঠে বললাম আমি।
— মরে গেলেও করবেনা। অতটুকু বিশ্বাস আছে।
আমি সুর করে বললাম
— আচ্ছা… তাই?
স্বর্ণা চোখ টিপে মাথা নাড়ল। আমি বললাম,
— আর কে কে আছে ওখানে?
— আর কেউ নেই। তবে আজকে কিছু লোক আসার কথা। এতক্ষণে হয়তো এসেও গেছে।
আমি বললাম,
— কারা আসার কথা?
— গেলেই দেখবে।

অল্পকিছুক্ষণ পরেই নৌকা ভিড়ল একটা জায়গায়। এদিকটা মোটামুটি পরিষ্কার। গাছগাছালির অতো ভিড় নেই। বোঝা দুঃসাধ্য নয় যে জনমনুষ্যের বাস আছে এদিকে। খালে তখন ভাটার টান পড়েছে। কুলকুল করে পানি বইতে শুরু করেছে উল্টোদিকে । নৌকা থেকে নামতে হলো থিকথিকে কাদা পানিতে। দুইপা কাদা পানিতে দেওয়ার সাথে সাথে ভটভট করে কব্জি অবধি গলে গেল পঙ্কিল মাটিতে। পাহাড়ি গা বেয়ে একজন বালিকা নেমে এলো দুরন্ত পায়ে। গায়ে থ্রিপিচ,আর পায়জামা। বোঝা গেল, এই সেই মেয়েটা। মেয়েটা এসে আমাদের উঠতে সাহায্য করলো। স্বর্ণা ওকে দেখামাত্র গালদুটো টেনে দিয়ে বলল,
— বড় হয়ে গেছিস দেখি। চল উপরে।
— দিদি তুমি এতোদিন আসোনি কেন? তীক্ষ্ণ দৃষ্টিপাত করল বালিকা।
— কাজে ছিলাম রে। বলেছিলাম না ছয়জনকে কাত করতে হবে? চারজনকে করা শেষ। আরো দুইজন বাকি।
— হাড়গোড় ভেঙে দিয়েছ? ঘাড় কাত করে শিশুসুলভ ঢংয়ে বলল মেয়েটা।
স্বর্ণা মুখ বাঁকিয়ে মাথা নেড়ে বলল,
— হ্যাঁ,একদম।
— মরে টরে গেলে?
—- না না মরবে কেন? ওভাবে কাত করি নাকি?

স্বর্ণা মেয়েটির সঙ্গে গল্প জুড়ে দিলো হাত নেড়ে নেড়ে। হেসে হেসে। মেয়েটা ভীষণ টরটরে। আমার অন্তরিক্ষ থেকে একটা কালো মেঘ যেন কাটা পড়ল তার হাস্যরসাত্মক রূপ দেখে। যাক, তার অন্তত একজন কথা বলার মানুষ ছিল! ভেতরে ভেতরে একটা অস্বস্তি কাটলো আমার।
খাড়া পাহাড়। কিন্তু হাঁটার সুবিধার্থে খাঁজ কাটা হয়েছে ছোট ছোট করে। সেই খাঁজে পা রেখে রেখে আঙুল দিয়ে ভেজা মাটি আঁকড়ে ধরে মাটির সোপান বেয়ে উঠছি উপরে। বর্ষায় পাহাড়ে মাটি পিচ্ছিল,স্যাঁতসেতে। যেকোন সময় পা পিছলে পড়ার আশঙ্কা আছে। মিনিট পাঁচেক পাকদণ্ডী বেয়ে উঠার পর একটা আধাখেঁচড়া অসমতল ভূমির দেখা মিলল। তার উপর দাঁড়িয়ে আছে একটি দ্বিতল বাড়ি। আশেপাশে ঘন জঙ্গলের ডালপালা এসে ঝুঁকেছে বাড়িটার উপর। বাড়ির দেয়ালগুলো রংচটা। বিস্ময়ে আমার মুখ হাঁ হয়ে গেল। স্বর্ণা আমার দিকে তাকিয়ে সুস্মিতে বলল,
— অবাক হলে? অনেক পুরোনো বাড়িটা। ব্রিটিশদের তৈরি। এরপর যখন ওরা পালাল এ দেশ থেকে তখন কিভাবে কিভাবে যেন স্থানীয় একজনে দখল করে নিলো বাড়িটা। ওনার ছেলে থেকেই আমি কিনেছি বেশ সস্তা দামে। এরপর রংচং করে তাও একটু জাতে এনেছিলাম,এখন দেখি আবার শ্যাওলা পড়ে সবুজ হয়ে গেছে।
—- বোঝলাম! দারুণ বাড়ি তো! এরকম বাড়িতে আজীবন কাটিয়ে দেওয়া যায়!
মেয়েটি এতক্ষণ পর্যন্ত কোন কথা বলেনি আমার সঙ্গে। এবার খুশিতে গদগদ হয়ে বলল,
— তুমি থেকে যাও আমার সঙ্গে। আমি শুধু খাই দাই, ছবি আঁকি আর ঘুমাই। কয়েকদিন পরপর একটা বুড়া এসে থেকে যায়। কথাও বলেনা বেশি।
আমি হেসে বললাম,
— কথা আমিও তেমন বলি না। তোমার ছবি আঁকা দেখব আমি। চলো।

বাড়িতে ঢুকে মেয়েটা চলে গেল রান্নাঘরের দিকে। স্বর্ণা আর আমি দোতলায় উঠে এলাম। বিশাল আলিশান বাড়ি। এতোবড় ঘরে মেয়েটা একলা থাকে? তাও অরণ্যে ঘেরা এই জঙ্গলে! মানতে হবে সাহস আছে। স্বর্ণা ব্যাগ থেকে একটা চাবি বের করে একটা আবদ্ধ দরজা খোলার চেষ্টা করতে লাগল। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। ফলাফল শূন্যের ঘরে। দীর্ঘদিন যাবৎ তালা খোলা-বাঁধা না হওয়ার ফল এই। রান্নাঘর থেকে কেরোসিন আনা হলো। এরপর অনেক কষ্টে একসময় ঠুস করে তালা খুলে গেল। কক্ষটার দরজা খুলতেই একটা দমবন্ধ করা বাতাস বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। দুজনেরই হাত চলে গেল নাকে। অনেকদিন আবদ্ধ থাকার ফলে কক্ষটা বেশ নোংরা আর অপরিচ্ছন্ন। সোলারের লাইটটা জ্বালাতেই দৃশ্যমান হলো শয়ে শয়ে সাজানো গোছানো নানান দেশি বিদেশি অাগ্নেয়াস্ত্র। দেখে আমার চক্ষু চড়কগাছ। এযাবৎকালে আমি এতোগুলা অস্ত্র একসঙ্গে দেখি নি। জিজ্ঞেস করলাম,
— এতোগুলা অস্ত্র কার?
স্বর্ণা হেসে বলল,
— আমার বাড়িতে কার অস্ত্র থাকবে? ভাবছি এখন এগুলো কী করবে?
— কেন?
— কাজে লাগবেনা এতোগুলা।
— তাহলে নিলে কেন?
— একসময় ভেবেছিলাম লাগবে। ভেবেছিলাম আজীবন এভাবে কাটিয়ে দিব। কিন্তু এখন বুঝতে পারছি, ভুল যারা করে তাদের শাস্তি পাওয়া উচিত। সাধারণ মানুষকে অকারণে হয়রানি করার অধিকার আমার নেই।
— তাহলে?
স্বর্ণা কথা বলে বলে অস্ত্রগুলো উলটে-পালটে দেখছিল। এবার আমার দিকে ফিরে বলল,
— তাহলে? ভালো হবার যদি কোন সুযোগ থাকে তবে এপথ ছেড়ে দিবো। কিন্তু সুযোগ নেই। দেশে আইন আছে না? হু!
শেষের কথাটা তাচ্ছিল্যভরে কুটিল হেসে বলল স্বর্ণা। আমি বললাম,
— আমি আছি তোমার সঙ্গে। তোমাকে ভালো করার জন্য যদি আমার সব ছাড়তে হয় তবে ছাড়ব। খোদার কাছে সেই প্রতিদানও আমি পাব।
স্বর্ণা দুই পা সামনে এগিয়ে আমার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে তাকাল নির্নিমেষ চোখে। কয়েক সেকেন্ড ওভাবেই তাকিয়ে থেকে শুধু ভুরু আর ঠোঁট দুটো নাচিয়ে প্রশ্ন করল,
— আমার জন্য নিজের কেরিয়ার নষ্ট করবে? তোমার ডিপার্টমেন্ট যদি জানতে পারে আমার সঙ্গে তোমার যোগাযোগ আছে তাহলে কী হবে ভাবতে পারছ?
— আমি অতো ভাবতে চাইনা।
— ভাবতে হবে। কারণ আমার জীবনটা এলোমেলো হয়ে গেছে। তোমারটা না। তোমার জন্য অনেক ভালো কিছু আশা করছে। আমার পিছনে পড়ে থাকলে কীভাবে হবে?
আকুল গলায় বলল স্বর্ণা।
আমি কথাটা গ্রাহ্য করলাম না। অন্য প্রসঙ্গ ধরে বললাম,
— খিদে পেয়েছে। কিছু খেতে পাব কি?
স্বর্ণা আমার অগ্রাহ্যটা স্পষ্টতর বুঝতে পেরে কড়া চোখে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে বলল,” নিশ্চয়”

যে লোকগুলো আসার কথা ছিল তারা আসেনি এখনো। স্বর্ণা তাদের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে অনেক্ষণ ধরে। কারণ, তারা টাকার বিনিময়ে বাকীদুইজনের ডিটেইলস স্থানান্তর করবে স্বর্ণার হাতে। যে দুইজন বেঁচে আছে তারা বর্তমানে মামুলি কেউ নয়। গ্রামে নৈরাজ্য সৃষ্টির পর গ্রাম থেকে দু’জনকে বিতাড়িত করা হয়। এরপর তারা দেশের বিভিন্ন জায়গায় তৎপরতা চালায় এবং একসময় তারা দু’জনে মিলে একটা সন্ত্রাসী দল গঠন করে। আপাততঃ এতটুকুই স্বর্ণার অবগত। বিস্তারিত কিছুই জানে না এখনো। অবশেষে দুপুর পেরিয়ে দুপুরের শেষ প্রহরে কয়েকজন লোক এসে হাজির হলো। সংখ্যায় তারা পাঁচজন। কথাবার্তার ধরণ আর চলনে বলছে, এদের মধ্যে দুইজন প্রধান আর বাকি তিনজন সহচর। আমি অল্প দূরে একটা চেয়ারে বসে ছিলাম। কানে হেডফোন গুঁজে গান শুনছিলাম। স্বর্ণা তাদের আলাপ-আলোচনা করছিল। আলোচনার একপর্যায়ে আচমকাই আমাকে দেখেই চড়াও হয়ে তেড়েফুঁড়ে এগিয়ে এলো একজন। স্বর্ণা অনেক কষ্টে লোকটাকে সামলে নিয়ে বলল,
— কী হয়েছে আমাকে বলুন। পরে না-হয় দেখা যাবে।
লোকটা পুনরায় তেড়ে আসতে চাইল যুগপৎ চিৎকার করে বলল,
— ঐ শালা তো পুলিশ। কতবড় সাহস আমাকে গ্রেফতার করে! আপনি ওর সঙ্গে কী করেন?
আমি কিন্তু তখনো নির্বাক হয়ে বসে আছি চেয়ারে। স্বর্ণা লোকটাকে কথঞ্চিৎ বুঝিয়ে- সুঝিয়ে আগের জায়গায় নিয়ে গিয়ে কি-সব আগডুম বাগডুম বোঝাল। আমি সেদিকে কর্ণপাত মাত্র করলাম না। পরে লক্ষ্য করলাম, এই লোকটাই দু’দিন আগে আমাকে হুমকিধামকি দিয়ে গিয়েছিল আমাকে। কিন্তু তার একটা কথাও আমি আমলে নিই নি।
আরো মিনিট ত্রিশেক পর লোকগুলো চলে গেল। যাওয়ার সময় ঐ লোকটা একবারের জন্য ক্রূর দৃষ্টি উপহার দিয়ে বেরিয়ে গেল। মনে হলো যেন,লোকটার সঙ্গে আমার জন্মজন্মান্তরের অহি-নকুল সম্বন্ধ।।

বিকালে ডিওটি ছিল আমার। কিন্তু আজ আর যাওয়া হবেনা। বোধহয় কালও না! আপাততঃ কি জবাবদিহি করতে হবে সেটা না ভেবে অন্য চিন্তায় পড়লাম। অযথা ঘরে বসে থাকার কোন মানে হয় না। আসার সময় নৌকাতে স্বর্ণা বলেছিল আশেপাশে কোথাও একটা পর্যটন এলাকা আছে। নাম বিছানাকন্দি। নাম শুনেছিলাম অনেকের কাছে। কিন্তু ঘুরে দেখার সময় এবং সুযোগ কোনটিই হয় নি। স্বর্ণার পক্ষ থেকে ঘুরে আসার প্রস্তাব শুনে আর না করতে পারলাম না। লোকগুলো চলে যাবার পরপরই আমরা বেড়িয়ে পড়লাম বিছানাকান্দির উদ্দেশ্যে। স্বর্ণার কথামতো মাঝি সেখানেই বসে ছিল যেখানটায় আমরা নেমেছিলাম নৌকা থেকে। আমরা আবার নৌকায় চড়ে সেই ঘাটে গেলাম। ঘাটে সকালের মতো লোকের সমাগম নেই। বিধায়, স্বর্ণার মতে এখন কোন নিরাপত্তার প্রয়োজন নেই। ঘাট থেকে আমরা একটা স্টিমার নিয়ে ছুটে চললাম বিছানাকান্দির উদ্দেশ্যে। বাষ্পচালিত স্টিমার পানির বুক চিরে এগুচ্ছে প্রকৃতির এক মনোজ্ঞ দৃশ্য উপভোগ করানোর নিমিত্তে।

ঘন্টাখানেকের মধ্যে আমরা সেখানে পৌঁছে গেলাম। থরে থরে রংবেরঙের বিচিত্র পাথর বিছানো মনোহর রূপ- বিশিষ্ট অকৃত্রিম একটি হৃদ। যেটি পিয়াইন নদীর সঙ্গে গিয়ে মিলেছে। সুমুখে তাকালেই চোখার পর্দায় দৃশ্যমান হয়, বিশাল দুই পাহাড় দাঁড়িয়ে আছে বিপরীতমুখী হয়ে। নিচে জলধারা বইছে কলকলিয়ে। টানা বর্ষণে পর্যটকের সংখ্যা কমে এসেছে কয়েকদিন ধরে। আশেপাশে খুব কমসংখ্যক পর্যটক ঘুরাঘুরি করছে। বর্ষায় বিছানাকান্দি লাবণ্যে ভরপুর হয়ে উঠেছে। পাথরের এই সমারোহ বহুদূর পর্যন্ত পরিকীর্ণ। স্বর্ণা পানিতে ডুবানো একটা পাথরের উপর পা ছড়িয়ে বসে পড়ল আশপাশটা উপভোগ করতে করতে। দেখাদেখি আমিও বসে পড়লাম তার পাশে। কোমর অবধি জলে ডুবে গেল আমাদের। একবার মুখ চাওয়াচাওয়ি করে ফিক করে হেসে দিলাম দু’জনে। স্বর্ণা আমার পানিতে নিমজ্জিত হাতটা নিজের ডান হাতের মুঠোয় নিল। মুষ্টিবদ্ধ হাতদুটো পানিতে চুবে রইল। স্বর্ণা মোহাচ্ছন্ন গলায় বলল,
— কেমন লাগছে জায়গাটা?
— দারুণ। আগে কখনো আসো নি তুমি? বলে স্বর্ণার দিকে তাকালাম আমি।
স্বর্ণা নির্মল হাসল। বলল,
— একা আসব? আসার মতো কাউকে পাইনি তাই এতো কাছে থেকেও আসা হয় নি।
— আমাকে পেয়ে আসার কথা মনে হলো?
স্বর্ণা আশেপাশে তাকাতে তাকাতে মুখের ভিতর শব্দ করল,”হুমম”
আমি কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলাম স্বর্ণা নিষ্কলুষ মুখখানার পানে। তার চুলগুলো খোলা। মৃদু বাতাসে ডিগডিগ করে আন্দোলিত হচ্ছে মসৃণ কেশপাশ। মাথার উপরের বিকেলের পেলব তেছরা রোদ চোখে পড়ায় কপালটা কুঁচকে আছে। প্রকৃতির এই মনোরম দৃশ্য উপভোগ করা ভিন্ন আপাতত অন্য কোন উদ্দেশ্য নেই চোখে। আমার অনিমেষ চাউনি দেখে স্বর্ণা খিক করে হেসে গাঁট্টা মেরে বলল,
— অমন শয়তানের মতো চেয়ে থেকো না তো। ভয় করে।
আমি কপট অবাক হওয়ার ঢংয়ে বললাম,
— ওরি বাবা, তোমার ভয়ও করে?
— করেনা আবার? আমার সকল ভয় তো তোমাকে ঘিরে। – স্বর্ণার রাখঢাকহীন স্বীকারোক্তি।
— আমাকে ঘিরে?…কেন?
— থাক, এতোকিছু জানতে হবে না তোমার।
— ওকে, নাই জানলাম।
অনেক্ষণ নীরবে কাটল বোধহয় কথার অভাবেই। দুজনের দুইহাত তখনো পানির নিচেই আলিঙ্গন করে আছে। স্বর্ণা কি ভেবে ছোট একটা নিশ্বাস ফেলে বলল,
— তারপর… বিয়ে করছ কবে? চাকরি হলো, সেটেল হলে। শুধু শুধু বয়স খেয়ে লাভ কী? মানুষের হায়াত কম।
আমি বঙ্কিম চোখে কয়েক মুহূর্ত স্বর্ণার দিকে তাকিয়ে সহসা হাতদুটো ঝাড়া দিয়ে উঠে দাড়িয়ে বললাম,
— এতক্ষণ অামার সঙ্গে হাতধরাধরি করে এখন বলছ কবে বিয়ে করবে কবে? গুল্লি মারি তোমার বিয়ের।
— চিরকুমার থাকবে? মুখটা উঁচিয়ে প্রশ্ন করল স্বর্ণা।
— দরকার হয় তাই থাকব।
স্বর্ণাও উঠে দাঁড়াল। কৌতুকের স্বরে বলল,
— তাহলে তোমাদের বংশের বাতি জ্বালাবে কে বলোতো?
আমি চিবিয়ে চিবিয়ে বললাম,
— বংশে আমার লালাবাতি জ্বলুক তোমার কী?
স্বর্ণা মুখে হাত দিয়ে খিলখিল করে হাসা শুরু করল। অনেকদিন পর স্বর্ণাকে এভাবে হাসতে দেখে আমার রাগটা নিমেষে জল হয়ে গেলেও উপরের ঠাট বজায় রেখে মুখে কিছু বললাম না। মানুষ প্রকৃতির সংস্পর্শে এলে ভেতরের সব আবিলতা প্রচণ্ড তাপমাত্রায় হিমালয়ের বরফের মতো গলতে শুরু করে। স্বর্ণার ক্ষেত্রেও ঠিক তাই হয়েছে। স্বর্ণা হাসি থামিয়ে বলল,
— রাগ করলে?
আমি সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিলাম,
— তা রাগ করার মতো কথা কি তুমি বলোনি?
স্বর্ণা টেনে টেনে বলল,
— তা না হয় একটু বলেছি। তাতে কি এমন মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে গেল!
কিছুক্ষণ নিশ্চুপ পাথরের উপর হাঁটলাম দু’জনে। স্বর্ণা উবু হয়ে কিছু ছোট পাথর কুড়িয়ে নিয়ে সেগুলো নিয়ে খেলা করতে লাগল। ফাঁকে ফাঁকে আমার দিকেও আড় দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে বারবার। আমি খানিকটা বিরক্ত প্রকাশ করে বললাম,
— পাথর নিয়ে খেলা করার জন্য এসেছ, পাশে একটা জলজ্যান্ত মানুষ দাঁড়িয়ে, তার দিকে কোন ভ্রুক্ষেপ নেই?
স্বর্ণা তৎক্ষণাৎ পাথর ফেলে গভীর চোখে তাকিয়ে বলল,
— বলুন কী করতে হবে?
আমি মৃদুহাস্যে বললাম,
— একটা জিনিস পাওনা ছিল তোমার ;সেটা ফেরত দিবো।
স্বর্ণা নিচের ঠোঁট প্রসারিত করে বলল,
— উহু! এসব জিনিস বলেকয়ে দেয়া যায়না। পাওনা জিনিস আচমকা দিয়ে চমকে দিতে হয়। লাভ নেই…
কথা শেষ হবার আগেই স্বর্ণার দুই স্কন্ধ দু’হাতে ধরে বুকের কাছে জাপটে ধরলাম। স্বর্ণা বুকের কাছ থেকে মাথা উঁচু করে ঋজুর চাউনিতে তাকাল আমার দিকে। বিড়বিড় করে বললাম, আচমকাই দিচ্ছি। সামলে নিও।
বলেই স্বর্ণার স্নিগ্ধ, তিরতির করে অনবরত কম্পিত অধরে আমার দুই ঠোঁট মিলিয়ে দিলাম ক্ষণিকের জন্য। দেখে আশেপাশের কয়েকজন পর্যটক কিম্ভুত আনন্দে হৈহৈ করে উঠলো। কেউ কেউ উচ্চস্বরে শিস দিল। ছাড়ানোর পর স্বর্ণা চাপা গনগনে গলায় মুখ কুঁচকে বলল, গেল গেল,মানসম্মান সব গেল।

জঙ্গলের বাড়িতে ফিরে এলাম রাত আটটার দিকে। যেই যানে করে যাওয়া সেই বাহনে করেই আবার ফিরে আসা। কিন্তু বাড়িতে ঢুকেই দুজনের মুখ অনভিপ্রেত ঘটনার বিস্ময়ে হাঁ হয়ে গেল। বাড়ির মূল দরজা খোলা। ঘরের মেয়েটি উধাও,বারংবার ডাকাডাকিতেও কোন সাড়া পাওয়া গেলনা। মেঝেময় তাজা রক্তসমেত ছড়াছড়ি করছে মেয়েটির অঙ্কিত নানান ধাঁচের পেইন্ট। একপাশে পড়ে আছে একটি চিঠি। চিঠির উল্টো পিঠে বড়বড় অক্ষরে লেখা DONT.

চলবে…