শেষ সূচনা পর্ব-২১

0
340

#শেষ_সূচনা
পর্বঃ ২১
লেখকঃ আরিফুর রহমান মিনহাজ

হঠাৎই একলাফে উঠে বসে দ্রুতপায়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেল স্বর্ণা। আমি পেছন থেকে শব্দ করে ডেকে বললাম,
— কী হলো? অন্ধকারে কোথায় ছুটলে?
স্বর্ণা একমুহূর্ত না দাঁড়িয়ে এগোতে এগোতে বলল,
— চলো আমার সাথে।
অপারগ হয়ে খাট থেকে নেমে স্বর্ণাকে অনুসরণ করে ছুট দিলাম আমিও। কাছাকাছি এসেই বললাম, “কই যাও?”
— আমরা যখন বিছানাকান্দি থেকে ফিরলাম তখন বারান্দার মেঝেতে রক্ত দেখতে পেয়েছিলে না?
আমি মাথা নাড়লাম। স্বর্ণা বিস্ময় প্রকাশ করে বলল,
— তাহলে এখন কোন রক্ত নেই কেন? তাছাড়া অগোছালো জিনিসপত্র তো আগের মতোই আছে। শুধু রক্তগুলো হাওয়া হলো কেন?
আমি রগড়ের গলায় বললাম,
— মনে হয় জলীয়বাষ্প হয়ে বায়ুমণ্ডলে মিশে গেছে।
স্বর্ণা মুখ বাঁকিয়ে বলল,
— ধ্যা—-ৎ সবসময় ফাজলামো!
ঘুটঘুটে অন্ধকারেও আমি স্বর্ণা মুখ বাঁকানো দৃশ্যটি মনে মনে কল্পনা করে অকারণেই পুলকিত হলাম। তবে মনে মনে আমিও খানিক চিন্তিত ও বিভ্রান্ত হলাম। এতোগুলা তরতাজা রক্ত কয়েক ঘন্টার ব্যবধানে অন্তর্হিত হওয়াটা মোটেও অকিঞ্চিৎকর ঘটনা নয়। তাছাড়া এই পাহাড়ে এমন কোন অদ্ভুত প্রাণীর বাস নেই যে, মেঝেময় ছড়ানো ছিটানো দেহনির্গত রক্ত চেটেপুটে খাবে! রক্তখেখো প্রাণী যদি থেকেও থাকে তবে মেঝে থেকে রক্ত গিলার মতো ছোটমন তাদের নেই। এর পরের ধাপের অযাচিত ভাবনায় আমার মনটা শঙ্কিত হল একটা কথা ভেবে। মনের কথা ভালো হোক কিংবা মন্দ, শুভ হোক কিংবা অশুভ, একপ্রকারে বলে দিয়ে দায়মুক্ত হওয়া শ্রেয়। সেই ভাবনা থেকেই আমি স্বর্ণা আরো কাছে ঘেঁষে ফিসফিসিয়ে বললাম,
— বলছি… ভূত-টূত এসে রক্ত খেয়ে নিল না তো?
স্বর্ণা এবার যারপরনাই বিরক্ত হয়ে মুখ কড়কে বলল,
— আরে ধ্যুরর… কোন কথা বলবে না তুমি। আমি আছি আমার চিন্তায়, আর তুমি আছো সস্তা রসিকতা নিয়ে।
আমি বিষণ্ণ মুখে বললাম,
— রসিকতা করি নি। মনের কথাটাই বললাম। নাহলে এতোগুলো তাজা রক্ত নিশ্চয় কোন মানুষে খেয়ে ফেলে নি? তাছাড়াও, এই চারিপাশ পানি ঘেরা পাহাড়ে কে আসতে পারে রক্তগুলো সরানোর জন্য?
— জানি না। তবে এটা নিশ্চয় কোন মানুষের কাজ। ঝুমুও রক্ত পড়ার মতো কোন আঘাত পায় নি পুরো ঘটনায়। তাহলে কে রক্ত দিয়ে আবার সেগুলো মুছে দিল? আর কি-ই বা বোঝাতে চাইল?
হাঁটতে হাঁটতে ঝুমুর ঘরে একবার গলা টান করে উঁকি দিল স্বর্ণা। দিব্যি ভোঁসভোঁস করে ঘুমোচ্ছে মেয়েটা। মনে হচ্ছে না সে মাত্র কয়েক ঘন্টা আগেই যমের বাড়ি থেকে ফিরে এসেছে। মানতে হবে গুরু-শিষ্য দু’জনই নিরবধি সাহসের বোঁচকা মাথায় নিয়ে বসে আছে। মুখোমুখি এই বিষয়ে আর কোন কথা হলোনা। দিনের শুরু থেকে বিশ্রামের ফুরসত না মেলায় বেজায় অবসন্ন ছিল শরীর। কারণে, কোনমতে স্বর্ণার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে এসে বিছানায় গা এলিয়ে দিলাম। ঘুম এলোনা শুরুতে। কিছুক্ষণ বিছানার এফোড়-ওফোড় করলাম মাথাভর্তি নানা ভাবনার ফল্গুধারা নিয়ে। স্বর্ণার সঙ্গে ঢাকায় আকস্মিক দেখা হওয়ার পর হতে এ পর্যন্ত সমস্ত ঘটনা নিজের শ্রান্ত মস্তিষ্ক এই মধ্যরাতে আওড়াতে শুরু করল মালিকের অনুমতি ছাড়া। যতোই ভাবনাগুলোর টিট জাল কাটছি মনে মনে।
; ততোই উদ্ধত কল্পনা আমার মস্তিষ্ককে ছেঁকে ধরছে। একটা সময় সব থেমে গেল।

…………………………………………………

ঘুম ভাঙল একটু বেলা করে। বিছানার বিপরীত পাশের জানালাটা রাতভর খোলা ছিল। সেই খোলা জানালার পাশে নাম না জানা ঢাউস গাছটির ফাঁক গলে স্বর্ণাভ প্রভাতকিরণ এসে পড়েছে তকতকে মেঝেতে। মেঝে হতে তেজদীপ্ত কাঞ্চনপ্রভা সরাসরি চোখের তারায় আঘাত হেনে চোখ ধাঁধিয়ে দিচ্ছে। আমি আড়মোড়া ভেঙে বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালাম। চোখ গেল রুমের সঙ্গে যুক্ত লতাপাতা আর গুল্ম-উদ্ভিদের জড়াজড়িতে জীর্ণশীর্ণ ঝুলে থাকা বারান্দাটার ওপর। ধীরপায়ে হেঁটে গেলাম বারান্দায়। আমার দুর্বিনীত পদচারণে বারান্দা বোধহয় একবার শিউরে উঠলো। দুটো ঝগড়ুটে হলদু চড়ুই ফুড়ুৎ করে উড়াল দিল আমার অনাহূত উপস্থিতি টের পেয়ে।
শ্রাবণের শেষ অধ্যায়ের বৃষ্টিহীন সকাল আজ। নির্মেঘ আকাশে বিগতরাত পর্যন্ত আধিপত্য করা মিশকালো মেঘের পাল শুভ্র আভা মাখিয়ে স্বাগত জানিয়ে গেল শরৎকে। তবে বর্ষা পুরোপুরি বিদায় জানায় নি। আশেপাশে কোথাও সিঁধেল চোরের মতো ঘাপটি মেরে বসে আছে সে, সুযোগ পেলেই হুটকরে শরতকে ঠেলে দিয়ে নিজের রাজত্ব স্থাপন করবে। এই তার উদ্দেশ্য! শীতল বাতাসের তোড়ে ফুরফুরে নয়নাভিরাম আবহাওয়া বাইরে। পাশেই পাহাড়ের গাত্র বেয়ে প্রবলবেগে ভলকে ভলকে ঝড়ে পড়ছে ঝর্ণাধারা। টানা বৃষ্টির ফলে এর বেগ দ্বিগুণ থেকে তিনগুণ বেড়েছে। অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইলাম সেদিকে। ঝর্ণা দেখার সৌভাগ্য আমার খুব একটা হয় নি৷ যেটুকু সময় অবসর পেতাম নিজেকে চার দেয়ালের মাঝে বন্দি করে রাখতাম। কোথাও ঘুরতে যাবার কথা মাথায়ও আসতো না। সুতরাং প্রাকৃতিক সৌন্দর্য সম্পর্কে আমার অজ্ঞতার প্রাচুর্য প্রবল।
ঝর্ণার পাদদেশে থেকে একটা মানুষ উঠে এলো হঠাৎ করে। পরিপুষ্ট মেয়েলি গড়ন। পরনের আঁটসাঁট শহুরে পোশাকে যৌবন ধরে রাখা দায়। সদ্যস্নানসিক্ত কাঁধ বেয়ে নামা এলোমেলো চুল সূর্যরশ্মিতে চিকচিক করছে। আশ্চর্য ব্যাপার হলো মেয়েটির কোমরে একটা পানিভর্তি কলসি। কলসির ভারে কটি একপাশে বেঁকে আছে। কিন্তু এই পোশাকে কোমরে কলসির দৃশ্য বড্ড বেয়াড়া এবং বেমানান। শুরুতে চেনা গেলনা মানুষটিকে। দূরত্ব কমার সঙ্গে সঙ্গে মস্তিষ্ক বাতলে দিল মানুষটির পরিচয়। হ্যাঁ এটি স্বর্ণা-ই! স্বর্ণা চঞ্চল পায়ে সেদিক থেকে আসছে! এতো সকালে? দস্তুরমতো আমি পকেট থেকে ফোনটা হাতে নিলাম সময় দেখার জন্য। কিন্তু ফোন অফ। চার্জের চালিকা শক্তি শূন্যের ঘরে। একছুটে বালিশের পাশ থেকে ঘড়ি এনে দেখলাম সাড়ে ন’টা বাজে। পুনরায় বারান্দায় পৌঁছুতে পৌঁছুতে স্বর্ণা যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেল। নিরাশ হয়ে রুমে চলে এলাম। জানি সে এখন আমার ঘরেই আসবে। কাজেই অকারণে উৎকণ্ঠা দেখানো ভালো নয়। তাই হলো। ঠিক তিন মিনিট পর স্বর্ণা রুমে এসে প্রবেশ করল। আমি তখন পুনরায় শুয়ে পড়ার ভড়ং ধরেছি। স্বর্ণা মাথার পাশে এসে দাঁড়াল। ঈষৎ ঝুঁকে মাথায় হাত দিয়ে ঘুমভাঙানিয়া প্রথম ডাকটা দিতেই খপ করে হাতটা ধরে ফেললাম আমি। এরপর হাত মুখের ওপর রেখে আরেকটু নড়েচড়ে ঘুমের ভং ধরলাম। স্বর্ণা ফোঁস করে একটা নিশ্বাস ফেলে হাতটা আমার মুখের ওপরেই ছেড়ে দিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। চোখটা লেগে এসেছিল খানিক। সেকেন্ড কয়েক পর বাম কানে প্রখর টান অনুভব করলাম এবং ধীরে ধীরে সেই টানের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বিছানায় উঠে বসলাম। পরক্ষণেই আমি বাহ্যজ্ঞান হারিয়ে চাপা চিৎকার দিলাম,
— ও… মাগো। কান ছিঁড়ে গেল।
স্বর্ণা কান ছেড়ে দিয়ে দুই হাত কোমরে ঠেকিয়ে ঠোঁট কুণ্ঠিত করে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকাল। নিমেষেই আস্ফালন করে বলে উঠল,
— ঐ,আমি কি তোমার বউ লাগি যে সকাল সকাল এসব ঢং করবে আর আমি সেটা চেয়ে চেয়ে দেখব? ঝোঁকের মাথায় কাল কিসব বললাম, ওমনিই মাথায় উঠে গেলে। হু!… চলো খেয়েদেয়ে বিদেয় হও। পরে তোমার গন্ধ শুঁকতে শুঁকতে পুলিশ এখানে চলে আসবে।
আমি জানি, আমি এখন অভিমান করে মুখ ফেরালেই স্বর্ণার আদর উতলে পড়বে আবার। আইঢাই করবে সে। কিন্তু স্বেচ্ছায় যদি সেসব মন থেকে উদগিরণ না হয় সেখানে ছলনার সাহায্য নিতে রাজি নই আমি। তাই একটু হেসে বললাম,
— সকাল সকাল চটে গেলে কেন?
— আমার খুশি তোমার কী? – কেতলি থেকে চা ঢালতে ঢালতে বলল স্বর্ণা। রুমে আসার সময়ই নিয়ে এসেছিল সে। ঘুমের ভড়ং ধরার কারণে টের পাই নি।
আমি খাটে পা ঝুলিয়ে দিয়ে বসলাম। টিপ্পনি কেটে বললাম,
— পুলিশকে ভয় পাও নাকি?
— নিজের জন্য পাচ্ছি না। তোমার জন্য পাচ্ছি। সবাই যদি জানতে পারে আমার সঙ্গে তোমার হাত আছে তাহলে কি হবে ভাবতে পারছ?
— কী হবে? আমিতো আর তোমার সঙ্গে কাজ করছি না।
স্বর্ণা বিরক্তিমাখা চোখে তাকাল একবার৷ একটু পর বলল,
— এই দেশের জনগণ তিলকে তাল বানায়। জিহ্বা বলতে আলজিহ্বা বুঝে। কুৎসা রটানোতে এরা কুণ্ঠা বোধ করে না। সাংবাদিকদের কথা না-ই বললাম। একেকটা বেজন্মা কীট। বুঝতেই পারছ। সো… দূরে থাকো। তোমার সুন্দর একটা ভবিষ্যৎ আছে।

আবার সেই ঘুরেফিরে একই কথা, একই একঘেয়ে উপলক্ষ! নতুন করে কিছু বলার জন্য মুখ রুচলো না আমার। স্বর্ণার চা বানানো শেষ। এককাপ আমার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে নিজে এককাপ নিয়ে একটা চেয়ার টেনে বসল অনতিদূরে। শুষ্ক ঠোঁট চায়ের কাপে নিমজ্জিত করে দিগন্তহীন ভাবনায় ডুব দিল স্বর্ণা। চা খাওয়া শেষে আমি বললাম,
— আজ গিয়ে আর ডিউটিতে অংশগ্রহণ সম্ভব না। আশেপাশে একটু ঘুরে বিকালের দিকে চলে যাব।
স্বর্ণা নির্মল হেসে দক্ষিণ দিকে হাত দেখিয়ে বলল,
— ওদিকে একটা সুন্দর ঝর্ণা আছে। ঘুরে আসতে পার।
আমি হঠাৎ মনে পড়ার ঢংয়ে বললাম,
— ও হ্যাঁ সকালে তুমি গিয়েছিল ওদিকে? গোসল করেছ মনে হয়?
— তুমি কীভাবে জানলে?
— বারান্দা থেকে দেখেছিলাম কলসি কোমরে করে ফিরছ।
— হ্যাঁ, এসব কাজ ঝুমু করে সচরাচর। আজ ও একটু অসুস্থ। তাই আমাকে করতে হল। কিন্তু তুমি তাহলে আগেই জেগে গিয়েছিলে?
— হ্যাঁ।
স্বর্ণা ঠোঁট মেলে দিয়ে মাথা নাড়ল, “হুমমম বুঝলাম”
— কী বুঝলে?
— কিছু না। ঠিক আছে তুমি ঘুরে আসো। স্বর্ণা ব্যস্ততা দেখিয়ে রুমের বাইরে যাবার চেষ্টা করল।
আমি তড়িঘড়ি করে বাঁধা দিয়ে বললাম,
— কী হলো? কোথায় যাও? তুমিও এসো একসাথে ঘুরি!
স্বর্ণা দুর্বোধ্য হাসির রেখা টানল মুখে। বলল,
— সময় নেই। কাজটা সেরে নিই।
” কী কাজ?” বলতে গিয়েও থমকে গেলাম আমি। মুখ দিয়ে শুধু অস্ফুট “ও” ধ্বনি বেরিয়ে নিরুচ্চার হয়ে রইলাম। কয়েকমুহূর্ত অতিবাহিত হল পিনপতন নিস্তব্ধতায়। একসময় স্বর্ণা উড়ুক্কু পায়ে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। খানিক পর পা টিপে টিপে স্বর্ণার অলক্ষ্যে আমিও গেলাম পিছু পিছু। প্রতিশোধের নেশায় প্রমত্ত স্বর্ণা তখন আমার ক্ষীণ পদশব্দ টের পেল না। আলতাফকে বন্দি করা বিশাল ঘরটায় প্রবেশ করল সে। দরজা ঈষৎ খোলা। আমি মন্থরগতিতে এসে দাঁড়ালাম দরজার সামনে। স্বর্ণাকে দেখামাত্রই আলতাফ হিংস্র বাঘের মতো কোপদৃষ্টিতে তাকিয়ে ফোঁসফোঁস করা শুরু করল। যার অর্থ এই,”আমাকে মেরে তুই টিকে থাকতে পারবি না। ” বিপরীত পক্ষের উল্টো স্বভাব ধারণ করে চলা স্বর্ণার জন্মগত অভ্যাস। নিজের ঠাট বজায় রেখে স্বর্ণা হেঁটে একটা পুরোনো খর্বাকৃতির আলমারির সামনে গেল। আলমারির ছোট দরজার একটা পার্ট খুলে দুইটি ছুরি বের করল আর কিছু বড় পেরেক। ছুরি দু’টো একটির গায়ে অন্যটি বারকয়েক ঘর্ষণ করে ক্রূর হাসল স্বর্ণা। শব্দ পেয়ে চকিতে চোরের মতো আশেপাশে তাকাল আলতাফ। তার প্রাণাতঙ্ক চোখদুটো বিস্ফারিত হয়ে চারিদিকে ঘুরে বেড়াচ্ছে মুক্তির স্বাদ নিতে। নিজের সর্বশক্তি দিয়ে নড়ার চেষ্টা করছে সে। স্বর্ণা নির্ভার হয়ে তার কাণ্ডকারখানা অবলোকন করছে আলমারির সঙ্গে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে। আলতাফ মুক্তি পেল না; বদলে চেয়ারসমেত কাত হয়ে মেঝেতে আছড়ে পড়ল ধপাস করে। তবুও চেষ্টার কমতি নেই। হাতে পায়ে নাইলনের দড়ি দিয়ে বাঁধা জায়গায় গা দেবে যাচ্ছে ব্যর্থ টানাহেঁচড়ায়। স্বর্ণা টকটক জুতোর শব্দে দুয়েক পা এগিয়ে এসে আলতাফের মাথায় চুল ধরে টেনে চেয়াসহ পূর্ববৎ বসাল। প্রকাণ্ড ঘরের এক কোণা থেকে একটা চেয়ার শব্দ করে টেনে আনল সে। এরপর নিশ্চেষ্ট হয়ে বসে পড়ল সেই চেয়ারে। আমি দরজার আবডালে দাঁড়িয়ে প্রত্যেকটি ঘটনা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি। স্বর্ণা খলনায়কের ন্যায় হেসে বলল,
— মৃত্যুর জন্য প্রস্তত হ।
আলতাফ গর্জন করে বলে উঠল,
— আমাকে মারবিনা খবরদার। আমি কিছু করি নি৷ সব ওরা…
কথাটা শেষ করতে পারল না আলতাফ। স্বর্ণা এক লাফে উঠে দাঁড়িয়ে ঠাঁই করে একটা চড় বসিয়ে দিলে অনবরত বাক্যফোটা মুখে। আসবাবশূন্য ঘরে কয়েকবার অনুরণিত হলো ঠাস করে চড়ের শব্দটি। আলতাফের চোখদুটো লাল হয়ে গেল। দরদর করে লালা বেরিয়ে এলো ঠোঁট গড়িয়ে থুতনি বেয়ে। স্বর্ণা সযত্নে টিসু সেগুলো দিয়ে মুছে দিতে দিতে বলল,
— মিথ্যা বললে চড় খেতে হয়। আর এভাবে মেরে মজা নেই। তাই যত্ন করে মুছে দিচ্ছি। চাইলে একটা গুলি খরচ করে কাজ শেষ করতে পারি। কিন্তু এতো সহজে মরতে তো তোকে দিচ্ছি না।
মোছা শেষে স্বর্ণা আবার চেয়ারে বসে পড়ল। আলতাফ কাঁইমাই করে প্রাণ ভিক্ষা চাইতে লাগল এবার,
— আমাকে মাফ করে দে স্বর্ণা। জীবনে আর এরকম ভুল হবে না। পায়ে ধরি তোর।

স্বর্ণা মোঝেতে রাখা একটা চাকু হাতে নিল খানিক ঝুঁকে। মৃদু অথচ কঠিন গলায় বলল,
— ক্ষমা করার মতো মহৎ গুণের অধিকারী আমি না। ক্ষমা তুই উপরওয়ালার কাছে গিয়েও পাবি না, যদি-না আমি ক্ষমা না করি। কারণ ব্যভিচারটা আমার ওপর হয়েছে। কথাটা শেষ করেই একটানে পকেট হতে একটা ছেঁড়া কাপড়ের টুকরো বের করে আলতাফের মুখে গুঁজে দিল স্বর্ণা। এরপর চাকুটা শক্ত করে ধরে চেয়ারের হাতলে বাঁধা হাতে বসালো আলগোছে। আলতাফ তেরছাভাবে সেদিকে তাকিয়ে ঘোঁৎঘোঁৎ করতে লাগল। স্বর্ণা চাপ বাড়াল ধীরে ধীরে। খরশান চাকুর সুতীক্ষ্ণ ধারে দেবে যাচ্ছে হাতের চামড়া। সাদা অংশ দেখা গেল, পরক্ষণেই চিরিক করে রক্তবিন্দু বেরিয়ে এলো শরীর ফুঁড়ে। চাপা আর্তনাদের মাত্রাটা গাঢ় থেকে গাঢ়তর হলো। পর্যায়ক্রমে ডান বাম উভয় হাতে চাকুর দাগ বসল। খালের আশেপাশে ছোটগর্ত হতে যেভাবে ভলকে ভলকে পানি উদগিরণ হয় ঠিক সেভাবে আলতাফের হাতের শিরা কেটে রক্তের স্রোতস্বিনী বইতে লাগল মেঝেময়। স্বর্ণা উদ্যমহীনভাবে তাকাল আহাজারি করা আলতাফের দিকে। বলল,
— খুব কষ্ট হচ্ছে তাই না? এর চেয়ে বেশি কষ্ট পেয়ে যাচ্ছে আমি প্রতিটা দিন। শুধুমাত্র তোদের শাস্তি দেবার বাসনা নিয়ে আমি মরতে মরতে বেঁচে আছি।
আলতাফের পৌরুষদীপ্ত সুশ্রী মুখমণ্ডল যন্ত্রণায় লোহিতবর্ণ ধারণ করেছে। চোখদুটো যেন এক্ষুনি কোটর ছেড়ে দৌড়ে বেরিয়ে আসতে চায়। শরীরে সমস্ত আঘাতের অভ্রভেদী যন্ত্রণা বোধহয় সেই চোখে কোটরে গিয়ে ঠেকেছে। স্বর্ণা চেয়ার ছেড়ে মেঝেয় বসল। তার মুখে কোনপ্রকার উত্তেজনা নেই। অন্য ছুরিটা হাতে নিয়ে ক্রমে আলতাফের দুই পায়ের পাতায় পোঁচ দিল আস্তে আস্তে। অর্ধ-নিস্তেজ আলতাফ নড়ে উঠলো এবং বেহদ্দ ছাড়ানোর চেষ্টা করতে লাগল নিজেকে। পারলো না। মুখের কাপড়টা নিতে নিতে স্বর্ণা শ্লেষোক্তি করল,
— আওয়াজ না শুনলে মেরে মজা আছে না মরে মজা আছে? এবার ইচ্ছেমতো চেঁচা।
আবারো বইতে থাকে রক্তের অবারিত স্রোতধারা। সঙ্গে আবদ্ধ ঘরে বারবার প্রতিধ্বনি হতে থাকে আলতাফের মরণ-চিৎকার। স্বর্ণা প্রতিশোধের নেশায় উন্মত্ত হয়ে কখনো মৃদু আর কখনো শব্দ করে হাসে। ধারালো দু’টো পেরেক বেশ জোরে বসিয়ে দেয় আলতাফের বাঁধা দুই হাতে। আরো জোর আর্তনাদ করে সে। তিমির মতো হাঁ করে থাকা মুখে আরো একটি পেরেক গলিয়ে দেয় স্বর্ণা। এবার চোখ উল্টে ভকভক করে তরতাজা রক্ত সুমুখে ছেড়ে দেয় আলতাফ। স্বর্ণার চোখ আদ্র হয়ে এলো। এবার তার শেষ কাজটা বাকি। আলতাফের হাত-পায়ের বাঁধন খুলে দিল স্বর্ণা। ঠেস দেয়া গলায় বলল,
— যা…
আলতাফ বহুকষ্টেও চেয়ার আর হাতের সঙ্গে গাঁথা পেরেক থেকে নিজেকে ছাড়াতে পারলনা। প্রাণের মায়া কার না আছে? সেই আবিল প্রাণের মায়াতেই ঝরঝর করে চোখের জল ফেলে চলেছে সে। স্বর্ণা সটান দাঁড়িয়ে হাত থেকে পেরেকমুক্ত করে দিল আলতাফের। আলতাফ খোঁড়া পায়ে দরজার পানে দুই তিন পা এগোল পালানোর উদ্দেশ্যে। অর্ধেক গিয়েই ধিড়িম করে মুখ থুবড়ে পড়ল সে। স্বর্ণা ছুরি হাতে লঘুপদে এগিয়ে আলতাফের নিম্নাংশের বস্ত্র একটানে খুলে নাঙ্গা কর আলতাফকে। আমি অশ্মীভূতের ন্যায় নিশ্চল হয়ে তাকিয়ে রইলাম। স্বর্ণা এগোতো লাগল। আর উলঙ্গ আলতাফ খুড়িয়ে খুড়িয়ে পিছু হটতে লাগল ক্ষমাভিক্ষা চাইতে চাইতে। একসময় অর্ধন্মুক্ত দরজায় পিঠ ঠেকাল আলতাফ। কটাস করে দরজা বন্ধ হয়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে একটা মর্মন্তুদ ঘটনার যবনিকা টানা হলো আমার চোখের পর্দায়। এর চেয়ে বেশিকিছু জানার বা দেখার প্রয়োজন ছিল না আমার। কয়েকমুহূর্ত পরে একটা মর্মভেদী মরণ-চিৎকার আমার কানটাকে যেন কোন অশ্রাব্য বেয়াড়া সুরে ঝনঝন শব্দে ছেঁচে ফেলল এবং কয়েক মুহূর্ত পরই তা স্তব্ধ হয়ে গেল।
স্বর্ণা যখন রক্তামাখা কাপড়ে বেরিয়ে এলো আমি তখনো নিষ্ক্রিয় মুহ্যমানের মতো স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছি দরজার সামনে। স্বর্ণা আমাকে দেখে দাঁড়াল। আমি জিজ্ঞেস করলাম,
— ঝুমু কোথায়?
— মাঝির সাথে বাজারে পাঠিয়েছি। – বলে আর দাঁড়াল না স্বর্ণা। আমাকে পাশ কাটিয়ে হনহন করে সিঁড়ি বেয়ে নেমে বাড়ির বাইরে চলে গেল।
খাঁচার ভেতর থেকে কলুষিত পাখিটি উড়াল দিল জমের কাছে। সেখানেও তার জন্য অপেক্ষা করছে অনন্তকালের জন্য অবিরাম সাজা। প্রাণভিক্ষা চেয়েছিল আলতাফ। কিন্তু চাইলেই কি দেয়া সম্ভব যদি না সেই বস্তুটি তার কাছে না থাকে?কখনোই না। নিজের আত্মসম্ভ্রমের ভিক্ষা স্বর্ণাও চেয়েছিল প্রতিজনের পায়ে পড়ে। মাথা খুড়ে! ভাই বলে সম্মোধন করে! কই? কেউ তো কর্ণপাত করেনি সেদিন! শুধু নিজের বেলায় ষোলআনা কেন?শেষ সময়ে এসে কেন অনুতপ্ত হয়ে আরেকটা সুযোগের আশায় থাকে মানুশ? উত্তরগুলো নেই বিধায় প্রাণবিসর্জন দিতে হয়েছে ধর্ষকদের। জীবনটা একটা নাগরদোলা, কেউ জীবনের স্বাদ বেশি নিতে গিয়ে নাগারদোলার দোলুনিতে ছিটকে পড়, আর কেউ বরাতের উপরে বিশ্বাস রেখে যেনতেন করে কাটিয়ে দেয় নশ্বর জীবন। চাওয়াপাওয়ার ভারটা যখন বেশি হয়ে দাঁড়িপাল্লা খারাপের দিকে ঝুলে পড়ে তখনই জীবনে অন্ধকার নেমে আসে। সর্বগ্রাসী অন্ধকারে মানুষের পা চোরাবালিতে আটকে যায়। বেরোনো দুঃসাধ্য হয়ে পড়ে। যেটুকু ভাবশুদ্ধি হৃদয়ে তলানিতে চাপা পড়ে থাকে সেগুলোও তখন তিরোধান করে। এই মানুষগুলোর শাস্তি হওয়া উচিত এই ধরিত্রীতেই। কিন্তু আফসোস! সেটা হয় না। যেখানে আইন নেই সেখানে আইন নিজ হাতে তুলে নেওয়া বলে কোন বাক্যের অস্তিত্বও নেই পৃথিবীতে। পুলিশের একজন কর্মচারী হিসেবে এই কথা আমাকে অকপটে স্বীকার করতেই হচ্ছে! খুনি হত্যা করছে আর পুলিশ পাথরের মতো দাঁড়িয়ে তা দেখছে এমন ঘটনা পৃথিবীতে বিরল না হলেও আমার জন্য নতুন অভিজ্ঞতা।
…..…………………….………………………
কাকচক্ষু ঝর্ণার পানির ধারা নামছে কুলকুল করে। একটা বিশালাকার পাথরের দুই প্রান্তে বসে জলে ভিজছি আমি আর স্বর্ণা। স্বর্ণার পোশাকে লেগে থাকা ছোপছোপ রক্তের দাগগুলো ঝর্ণার বেগে জলের সঙ্গে মিশ্রিত হয়ে মিলিয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। আলতাফের প্রাণপাখি উড়াল দেবার পর আমি দরজার সামনে দাঁড়িয়ে এলোমেলো চিন্তায় নিমগ্ন ছিলাম। ঠিক সেসময় কয়েকজন বিশাল-দেহী লোক আমার পাশ কাটিয়ে দরজা ঠেলে অকুস্থলে প্রবেশ করল। খানিক পরেই আমার তৎক্ষনাৎ অসাড় মস্তিষ্ক জানান দিল এগুলো স্বর্ণার চামচাগুলো। যারা সবসময় স্বর্ণার সঙ্গে থাকতো। আর এটা ওটা করে সাহায্য করতো। কুমিল্লায় গভীর রাতে এদের সঙ্গে একপ্রকার কুরুক্ষেত্র হয়েছিল আমার। সংখ্যায় তারা পাঁচজন। আমি উঁকি দিয়ে দেখলাম ভেতরে। সবাই মিলে ধরাধরি করে আলতাফের ক্ষতবিক্ষত দেহ ঘরের বাইরে আনছে। আমি সরে দাঁড়ালাম। ওরা আমায় পরোয়াই করল না। এমন ভাব করল যেন আমার মতো জলজ্যান্ত মানুষটাকে তারা দেখেই নি! এরপর স্বর্ণার মুখে শুনেছি, লাশটাকে কোন নির্জন জায়গায় ফেলে আসবে তারা;সেখানে কদাচিত মানুষের চলাচল আছে। আমি স্বর্ণাকে বললাম, “লাশটা গুম করে ফেললেই পার। এই পাহাড়-জঙ্গলে কে জানবে?
স্বর্ণা শুধু হেসে জবাব দিয়েছিল, ” গুম করার ইচ্ছে থাকলে মারার প্রয়োজন হতো না। আমি চাই মানুষ তার মরার কারণ জানুক। এতে অনন্ত একজন ধর্ষক সতর্ক হবে।
আমি আর কোন কথা বলিনি। স্বর্ণার সমাকীর্ণ মনন আমার মুখের রা কেড়ে নিল। এরপর স্বর্ণার পিছু পিছু এই ঝর্ণায় আসা। কিন্তু তার আকস্মিক বিষণ্নতার হেতুটা ঠিক স্পষ্ট নয় আমার কাছে। স্বর্ণার অলোকসুন্দর মুখ আজ বড়ো পাণ্ডুর। ঝাঁকড়ামাকড়া চুল। সুদূরবিস্তৃত শোকাকুল চাউনি। আমি অনেক্ষণ কোন কথা বললাম না। একসময় ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেল। বিরক্তির ‘চ’ কারান্ত শব্দ করে বললাম,
— কী হয়েছে স্বর্ণা? এটাও তো অন্যসব ঘটনার মতো একটা। এভাবে ভেঙে পড়ছ কেন?
স্বর্ণা নিচের খাদের দিকে তাকাল একপলক। আবার চোখ ঘুরিয়ে বলল,
— ভেঙে পড়া আমার সাথে যায় না। আমি আসলে অন্য কথা ভাবছি। কিন্তু ভেঙে পড়ছি এটা ভুল।
— ভুল কি সঠিক সেটাই তে বুঝতে পারছি না। কী অন্য চিন্তা?
স্বর্ণাকে চিন্তিত দেখাল অল্পএকটু। একটু দ্বিধা করে ফস্ করে বলে ফেলল,
— সত্যি করে বলবে? জুহি তোমাকে কোন প্রস্তাব দিয়েছে?
আমি একটা নিশ্বাস চেপে অন্যদিকে তাকিয়ে বললাম,
— হ্যাঁ দিয়েছে।
— কবে?
— অনেক আগে। ট্রেনিংয়ে থাকাকালীন।
— রাজি হওনি?
— পাগল নাকি? ইচ্ছাকৃত বিস্ময় দেখালাম আমি।
—- পাগলের কী আছে? রাজি হয়ে যাও তুমি। বড়ো ভালো মেয়ে। কি সুন্দর নির্মল চাহনি না? আর আমারটা দেখো… কলঙ্কে ভরা। চোখ বন্ধ করলে আমি সব দেখতে পাই…
আমি হাত ঝাড়া দিয়ে বললাম,
— বাদ দাও। আমার এতো ভালো কিছু চাই না।
— কিন্তু আমি তো চাই তুমি ভালো থাকো। সুখে থাকো। আমি চাইনা আমার জন্য তোমার চাকরি টা চলে যাক। আমি চাইনা আমার জন্য তুমি ক্রিমিনালের খাতায় নাম উঠাও। একটা কথা কতো শুনেছ। সৎ সঙ্গে সর্গবাস অসৎসঙ্গে সর্বনাশ। ইদানীং আমার সঙ্গ তোমার জন্য সর্বনাশ ডেকে আনছে সেটা তুমি বুঝতে পারছ না। মানুষ নিজের ভুল নিজে দেখতে পায় না। তোমার সঙ্গে আমার দেখা হাওয়ায়টাই একটা বড় মিস্টেক। সেটা না হলে এতোকিছু হতো না।

স্বর্ণা থামলো। আমি কিছুক্ষণ ওর দিকে তাকিয়ে থেকে বললাম,
— তোমার কথা শেষ?
এতক্ষণের সব কথা শূন্যগর্ভ বকবক করা মনে করে স্বর্ণা নাকের পাটা ফুলিয়ে জলন্ত উনুনের মতো তাকাল। আমি সেই দৃষ্টি একচিলতে হাসির ছটায় উড়িয়ে দিয়ে প্রসঙ্গ উল্টে বললাম,
— তোমার বস লোকটাকে তো দেখলাম না এখনো। কোথায় সে?
স্বর্ণার এবার পুরোনো রাগ জেঁকে বসল। সে চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,
— কেন? গ্রেফতার করবে বলে?
আমি কৌতুকের ছলে বললাম
— হ্যাঁ বেটাকে সেজন্যই খুঁজছি।
স্বর্ণা আমার কথা আমলেই নিল না। পুনরায় আগের প্রসঙ্গকে কান ধরে টেনে এনে বলল,
— তুমি কি রাজি হচ্ছ এখন?
আমি গোঁ ধরে বললাম,
— কেন রাতে কি বলেছিলে মনে নেই তোমার?
— ওসব ভুলে যাও। সব কথা মনে রাখতে নেই। বলতে বলতে পাথর থেকে উঠে দাঁড়িয়ে দুয়েক পা এগোল সামনে। নিচে সুবিশাল খাদ। তাকালেই বুকটা হুহু করে কেঁপে ওঠে। স্বর্ণা চরণকমল পা দুটো টিপটিপ করে সেই খাদের কার্নিশ ঘেঁষে দাঁড়াল। হাস্যোজ্জল মুখে তাকিয়ে বলল,
— বলো রাজি কি না?
আমি ব্যতিব্যস্ত হয়ে সটান দাঁড়িয়ে গেলাম। বললাম,
— এটা কী ধরনের ফাজলামো? সরে আসো তাড়াতাড়ি। পা পিছলে পড়বে স্বর্ণা!
শেষের কথাটা বেশ জোর দিয়ে বললাম আমি। স্বর্ণা ধীরে ধীরে নিচের দিকে ঝুঁকে বলল,
— ঝাপ দিলাম কিন্তু…
আমার কপালে অনুচ্চারিত চিন্তার সুক্ষ্ম ভাঁজ পড়ল। দেঁতো হেসে বললাম,
— পাগলামি করেনা স্বর্ণা। জায়গাটা কিন্তু স্যাঁতসেতে…
আমার কথার শেষ শব্দটি পূর্ণ হবার আগেই স্বর্ণা খিলখিল করে হেসে ঝপাং করে লাফিয়ে পড়ল সুগভীর খাদে। আমি কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পাথরে বসে পড়লাম পুনরায়।

চলবে…