#শেষ_সূচনা
পর্বঃ২৯
লেখকঃ আরিফুর রহমান মিনহাজ
স্বর্ণার অকল্পনীয় অমর্ষে বাবা-মা দু’জনেই ব্যথিতচিত্তে একবার মুখ তুলে তাকিয়ে ধীরে ধীরে চোখ নামিয়ে নিলেন। জুহির চোখে-মুখে একসঙ্গে উদ্বেগ এবং কিঞ্চিৎ সহানুভূতি প্রকাশ পাচ্ছে স্বর্ণার বাবা মায়ের জন্য। ওষ্ঠপুট-সমেত নাক সামান্য কুঁচকে পরবর্তী কথোপকথন শোনতে উন্মুখ সে। অথচ আমি পূর্ব-পশ্চিম করে হাত গুঁজে অবিচল দাঁড়িয়ে আছি। স্বর্ণার মা-ই আবার বলল,
— আমাদের জায়গায় তুই থাকলে ঠিক…
কথাটা মুখ দিয়ে বেরোনোর আগেই স্বর্ণা ‘টক’ করে চায়ের কাপটা রেখে স্বাভাবিক গলায় বলল,
— না ঠিক এমনটাই করতাম না! আমি আগে সন্তানের কথা শুনতাম। বিশ্বাস করতাম। কই আমিতো তোমাদের বিশ্বাস ভাঙার মতো কোন কাজ করিনি! তাহলে কেন এমন শাস্তি দিলে? অবশ্য দিয়ে একপ্রকার ভালোই করেছ। একদিক দিয়ে তোমাদের ওপর কৃতজ্ঞ আমি। তোমরা ওমন ব্যবহার না করলে আজকে আমি প্রতিশোধ নিতে পারতাম না। ভালো মানুষ হয়ে দোষীরা সমাজে আনাচে-কানাচেতে দাপিয়ে বেড়াতো। যেটা আমাকে আমরণ যন্ত্রণা দিয়ে বেড়াতো।… থ্যাংক্স!
শেষের শব্দটি ফিসফিস করে উচ্চারণ করে কপট ওষ্ঠাধর প্রশস্ত করে হাসল স্বর্ণা। কয়েকমুহূর্ত কোন বাক্যবিনিময় হল না। দু’জনেই অপ্রতিভ হয়ে বসে রইলেন। স্বর্ণার বাবা এবার অনুতাপের স্বরে বললেন,
— স্বর্ণা, আমরা আমাদের ভুল বুঝতে পেরেছি। তুই ফিরে আয় মা!
স্বর্ণা দাঁতে ঠোঁট কামড়াতে কামড়াতে একটু ভাবে। এরপর শান্ত-স্বাভাবিক কণ্ঠে বলল,
— শুনে ভালো লাগল যে, তোমরা তোমাদের ভুল বুঝতে পেরেছ। কিন্তু ফেরানোর চিন্তাটা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেল। কী বলে পরিচয় দিবে সমাজে? এতদিন পর মেয়ে কোত্থেকে এলো?… আর… তাছাড়া, তোমাদের আমি যতদিন সামনে দেখব ততদিন আমার সেই দিনগুলোর কথা মনে পড়ে যাবে। তোমাদের বিরুদ্ধে আমার আর কোন খেদ নেই। ক্ষমা করে দিলাম। মেয়ের ভালো চাও তো দূর থেকে দোয়া করো। কাছে টানার চেষ্টা করো না। আমার ভেতরে যে আগুন দিবানিশি দাউ দাউ করে জ্বলছে সেই আগুনে জ্বলে পুড়ে ছাড়খাড় হয়ে যাবে।
বলে আর উত্তরের অপেক্ষা করে না স্বর্ণা। যথার্থ সম্মান দেখিয়েই সেই স্থান হতে ধীরে ধীরে বিদায় নিল। জুহি আর আমি বুলিশূন্য হয়ে পাথরের মতো দাঁড়িয়ে রইলাম। নিজেদের সমুচিত করণীয় চিন্তা করতে পারলাম না। স্বর্ণার মা স্বামীর বুকে মাথা গুঁজে ঝরঝর করে কেঁদে ফেললেন। সেই কান্না আর থামে না। স্বর্ণার বাবার চোখদুটোও ঘোরলাগা আদ্র হয়ে এলো। স্ত্রীর পিঠে হাত বোলাতে বোলাতে দুই চোখের পাতায় যেন তিনি সমস্ত পাপের বোঝা বহন করে পক্ষ্মযুগল গহন নিমীলিত করে নোনা জল হয়ে গালের উপর গড়িয়ে দিলেন। মানুষের একটা ভুল তাকে আজীবন পীড়া দেয়। কখনো হাজার বছর পর সেই ভুলের ক্ষমা মঞ্জুর হলেও মনে শান্তি মেলে না খুব সহজেই। ভুলের ফলে যে ক্ষতটা হৃদয়ের গূঢ় কোনো স্থানে দগদগে হয়ে রয়,সেই স্থানটা যে বিনা চিকিৎসায় পঁচন ধরে সময়ের বিবর্তনে। চিকিৎসক রূপে যদি কাঙ্ক্ষিত মানুষটা ফিরে না এসে ব্যামো শুনে শুধু ঔষধ লিখে দেয় তবে তো বৃথা এই চিকিৎসা! ক্ষত যে রয়েই যায় আজীবন। কি লাভ তাতে?
দীর্ঘ দশটি বছর পর আকস্মিকভাবে মা-বাবার সঙ্গে এভাবে দেখা মোটেও সহজ ছিল না স্বর্ণার পক্ষে। তবুও সে দাঁতে দাঁত চেপে অভিনয় করে কথা শুনিয়ে বিদেয় করেছে তাদের। বাস্তবিকই স্বর্ণার পক্ষে পুনশ্চ বাবা মা’য়ের সঙ্গে বসবাস করা অসম্ভব নয় অকল্পনীয়ও বটে! কিন্তু আমার ভাবনাকে অর্থহীন,অমূলক প্রমাণিত করে দিয়ে স্বর্ণা শুধু একটা সিগারেটের ধোঁয়াতেই বাবা মায়ের দুশ্চিন্তাকে আবদ্ধ করে বায়ুমণ্ডলে উড়িয়ে দিল।
আমার রুমের-ই বারান্দায় বসে প্রায় অর্ধরাত্রি পর্যন্ত গুনগুন করে আড্ডা দিল স্বর্ণা আর জুহি৷ এর আগে অবশ্য আমার রুমে ছিল সবাই। কিন্তু আমি ঘুম আসছে বলাতে নয়া দুই সখী বারান্দায় গিয়ে গুনগুন শুরু করল। ঘুমের ভারে দু-চোখ এক করে রাখলেও অজানা কারণে ঘুম ধরা দিল না আমার কাছে। পাশের বারান্দা থেকে দু’জনের কথোপকথন মৃদু ভেসে আসছে সেগুলোই চুপিসারে শোনার কারণেই বোধহয় ঘুম মান করে পালিয়েছে। করুক। অজ্ঞাতসারেই আমি আবার তাদের কথোপকথনে কান খাড়া করলাম।
— তোমার বাবা-মা এলো।কত কান্নাকাটি করল, তোমার মায়া হল না? -জুহির কণ্ঠ
— নাঃ মায়া আর কি।
— আমি তো ইমোশনাল হয়ে গিয়েছিলাম পুরো।
স্বর্ণার ক্ষীণ হাসি শোনা। বলল,
— তোমার মন নরম তাই।
স্বর্ণা বোধহয় সিগারেট ধরিয়েছিল। জুহির উৎকণ্ঠিত কণ্ঠ শোনা গেল,
— এ কি সিগারেট খাচ্ছ? গন্ধ না?
— উঁহু, সুগন্ধ। এটা দামী সিগারেট।
— আমায় দেবে?
— ধ্যুর, আমি খাই মনের দুঃখে। তুমি কেন খাবে?
— দাওনা। ইচ্ছে করছে খাব।
এই নিয়ে কিছুক্ষণ বাগবিতণ্ডা, হাতাহাতি, কাড়াকাড়ি হলো দু’জনের মধ্যে৷ স্বর্ণা কিছুতেই সিগারেটের প্যাকেট জুহির হাতে দিতে নারাজ। শেষে জুহি নিজেই কেড়ে নিয়ে আনাড়ি হাতে কীভাবে সিগারেট ধরাল সেটা ভেবেই আমি কাঁথার নিচে থাকতে ইচ্ছে হল না। ইচ্ছে হল একদাপটে গিয়ে ঢুঁ মেরে আসি। একটু পরই কুহ্ কুহ্ কাশির শব্দ শোনা গেল। বোঝলাম জুহি জোর করেই সিগারেটের ধোঁয়া গিলছে। আমার আর শুনতে ইচ্ছে হল না তাদের কথাবার্তা। কিন্তু রাতের নির্জনতা এতো প্রগাঢ় যে পিঁপড়ে হাঁটার শব্দও বুঝি কানে এসে লাগে। অগত্যা না শুনে উপায় নেই। কিছুক্ষণ কোনো কথা হল না। আমার চোখও লেগে এলো খানিক। আবার স্বর্ণার কণ্ঠ,
— তুমি মিনহাজকে না পাওয়ার কষ্টে সিগারেট খাচ্ছ তাই না?
জুহির চমকে উঠাটা আমি অনুধাবন করলাম।
— ধ্যুর কী বলছ। শখ হলো তাই খাচ্ছি।
— আমি জানি তুমি এমনি খাচ্ছ না। তুমি ভীষণ স্বাস্থ্যসচেতন মেয়ে সেটা আমি জানি। সেখানে সিগারেট খাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। বলে ফেলো। সত্যি কথা বললে তোমাকে গুলি করে মারছি না আমি।
খানিক সময় পর জুহির কণ্ঠ,
— হ্যাঁ,ভাবলাম তুমি একটা কারণে খাচ্ছ। আমিও খাই মনকে একটা কারণ দেখিয়ে। মন আর নিষেধ করতে পারবে না। তবে অতোটা বিবাগী আমি হয়ে যাইনি বুঝলে? মিনহাজ তোমারি থাকবে।
— আমার থাকা না থাকা সময় বলে দিবে। কি সুন্দর একটা ভবিষ্যৎ হতো ওর আমি সব শেষ করে দিলাম।
— নিজেকে দোষারোপ করছ কেন? কী হতো ওর ভবিষ্যৎ দিয়ে যদি না সে মনের দিকে শান্তি না পেত? পৃথিবীতে দুইজন মানুষ তার আপন ছিল। তুমি আর তার মা। একজন তো চলে গেল। বাকি আছ তুমি। তুমিই যদি না থাকো তাহলে তার ভবিষ্যৎ দিয়ে কী হবে? মানুষের জীবন আর কতদিনের?
স্বর্ণা পুরো প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে বল,
— তুমি এখনো ভালোবাসো মিনহাজকে?
— বাসি তো বটে। তবে একজন ফ্রেন্ড হিসেবে। একটা সময় হয়তো কায়মনে তাকে চাইতাম। কিন্তু সেটা মনের ভুলে। ভালোবাসাটা ভুল ছিল না। মানুষ চিহ্নিত করাটা ভুল ছিল। আমি চিরকালই মানুষ চিনতে ভুল করি।কলেজ লাইফে একজনকে খুব বিশ্বাস করতাম কিন্তু সেও ধোঁকা দিল। একটা ব্যপার কি জানো স্বর্ণা। একজন প্রজা যতোই শক্তিধর হোক, রানির জন্য তাকে সেক্রিফাইস করতেই হয়। নয়তো পস্তাতে হয়। তুমি হলে সেই রানি।
একটা দীর্ঘশ্বাস মোচন করে স্বর্ণা বলে,
— ভালোই কথা জানো।
এরপর আরো কিছুক্ষণ হাস্যরসাত্মক বাক্যবিনিময় চলল দু’জন সখীর মাঝে।
পরেরদিন জুহি বিদায় নিল সিলেটের উদ্দেশ্যে। ঘন্টা কয়েকের ব্যবধানে আমরাও ঢাকার উদ্দেশ্য বাড়ি ছাড়লাম। চাইলেই একসঙ্গে বের হওয়া যেতো। কিন্তু আমরা হলাম ফেরার আসামি, আমাদের সঙ্গে জুহির হাঁটা চলাটা যথেষ্ট ঝুঁকিপূর্ণ তথা আইনের দৃষ্টিতে অনুচিত! বাবার সঙ্গে বিশেষ কথা হয়নি। কি বা বলার আছ?তিনি নিজের মতো করেই ছিলেন। আজো আছেন। ভবিষ্যতেও তাই থাকবেন। স্ত্রীর মৃত্যুতে তাঁর সামান্য অনুশোচনা বৈ আর কিছু হয়নি তা দেখলেই বোঝা যায়। অবশ্য মনের ঝড়ের প্রাদুর্ভাব মুখবয়বে ভেসে ওঠে না। ভিতরেই কালান্তক বাতাবর্তে সমস্ত অন্তঃকরণ গুড়িয়ে, দুমড়ে-মুচড়ে পঙ্কিল থকথকে মাটিতে মিশিয়ে দেয়। মুখে মেদুর হাসি আর দরাজ কণ্ঠে সেই ঘূর্ণিতে ক্ষয়প্রাপ্ত স্থান আচ্ছাদিত হয়। বিধায় বাইরে থেকে তা সহজ সাবলীল মনে হয়।
স্বর্ণার পরবর্তী এবং শেষ শিকার বর্তমানে ঢাকায় সেটা আগেই জানিয়েছি। আগামীকাল ঢাকা মেডিকেল থেকে তার ছাড়পত্র পাওয়ার কথা। গোপনে সব সংবাদ সংগ্রহ করতো স্বর্ণা। স্বর্ণার পরিকল্পনা হল, স্টেশনে নেমেই সে ঢাকা মেডিকেলের দিকে যাবে এবং শেষ আর সব পরিকল্পনার নকশাকারী রাজিবকে পাকড়াও করবে। সেই প্ল্যান মাথায় রেখেই আমরা বাসে চড়লাম। দস্তুরমতো আমার উত্তরোত্তর ঘুম আর জাগরণে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকার ভ্রমণটা নিঃশেষ হল। বাংলাদেশের সুবিখ্যাত যানজটের পরাকাষ্ঠা আরো ঘন্টা দুয়েক সময় বেশি ব্যয় হল। সে নিয়ে আমার মাথা ব্যথা নেই। যা করার স্বর্ণাই করবে। আমি কেবল নীরব দর্শক।
তবে আমারও যে হাবাগঙ্গারাম হয়ে না চলে একটু সতর্ক হয়ে চলার উচিত ছিল সেটা বুঝতে পারলাম বিষয়টি ঘটে যাবার পর। ঢাকা মেডিকেলের অল্প দূরে গাড়ি হতে নেমে ভাড়া মিটিয়ে দেবার পর স্বর্ণাকে দাঁড় করিয়ে আমি রাস্তার ওপারে গেলাম কিছু শুকনো খাবার কিনতে। স্বর্ণার গুপ্তচর এখনো ফোন দেয়নি। ফোন দিলেই পরিকল্পনা মোতাবেক কাজ করা যাবে। আমাকে রাস্তার ওপারে পাঠিয়ে স্বর্ণা টং দোকানে বেঞ্চিতে বসল। সেই টং দোকানের চা মুখরোচক হলেও বন পাউরুটিগুলো প্রায় বাসি হয়ে গেছে। এ কারণেই রাস্তা পার হয়ে টাটকা কিছু আনতে গিয়েছিলাম। কিন্তু রাস্তা পার হতেই সাইরেন বাজিয়ে দু’টি র্যাবের কালো গাড়ি এসে দাঁড়াল। প্রথমটা আমি খেয়াল করলাম না। কিন্তু যখন দেখলাম কালো পোশাকধারী র্যাব আমাকে বন-রুটি ভেবে চতুর্দিকে পিঁপড়ের মতো ছেঁকে ধরছে ধীরে ধীরে তখনি আমি সজ্ঞানে ফিরলাম। পালানোর সব রাস্তা তখন সংরুদ্ধ। সামনের একজন পিঁপড়ে ঈষৎ হাঁটু ভেঙে বন্দুক ধরে এগিয়ে আসতে আসতে অকিটকিতে বার্তা পাঠাল, মিশন এপ্রোচ! ডান।
আরো কয়েক কদম এগিয়ে এলো তারা। আমি বিমূঢ়ের ন্যায় চেয়ে রইলাম তাদের দিকে। এবার সামনের জন আমাকে উদ্দেশ্য করে বলল,
— পালানোর চেষ্টা করো না। তাহলে গুলি চালাতে বাধ্য হব।
আমি দুইহাত তুলে আত্মসমর্পণ করলাম। এরপর? এরপরের কথা বাহুল্য। আমাকে জিপে পুরা হলো। দিকবিদিকে উৎসুক জনতা কয়েক মিনিটের ব্যবধানেই জায়গাটাতে হাট বসিয়েছে। ওপারে বিরক্তিতে ডুবে থাকা স্বর্ণারও দৃষ্টিগোচর হল এই দৃশ্য। ভোঁ করে কালো গাড়ি ছেড়ে দিল। স্বর্ণা নিঃশ্বাস রুদ্ধ করে এগুতে চাইল। আমি চোখের ইশারায় নিষেধ করলাম। আজীবন আমার অবাধ্য স্বর্ণা আজ শুধু চোখের ইশারায় থমকে দাঁড়াল। শরতের অত্যুজ্জল তেজী সূর্য তখন মাথার ওপর। স্বর্ণার চোখের কোণের ডগমগ করা নোনতা জলে সূর্যকিরণের অনাহূত পদস্খলনে জ্যোতি ছড়িয়ে আমার চোখে যুক্ত করল নিমেষের জন্য।
তিনদিন পর। কারাগারের চৌদ্দ শিকের ভিতরে কখনো আমার স্থান হবে সেটা আমি কস্মিনকালেও ভাবতে পারিনি৷ দুইদিন কোন কার্যক্রম ছাড়াই কারাগারে রাখা হলো আমাকে। তৃতীয়দিন আদালতে হাজির করা হল এবং দরখাস্ত মতো তিনদিনের রিমান্ড মঞ্জুর করা হল। তবুও আমি আশ্চর্য হলাম এতোকিছু হয়ে গেলেও কোথাও কিছু প্রকাশ পেল না। পুলিশের ওপর দেশের সাধারণ জনগণের ক্ষয়িষ্ণু আস্থাটা পুরোপুরি বিলুপ্ত না হবার জন্যই কি এই লুকোছাপা? নাকি একসঙ্গে সব প্রকাশ করে নিজেদের কনীয়ান ক্ষমতাটাকে মানুষের চোখে বৃহৎ করে উদ্ভাস করার পাঁয়তারা? হতে পারে, সঠিক জানা নেই আমার।
সেলের ছোট দরজা দিয়ে দু’জন বলিষ্ঠ লোক প্রবেশ করল। গায়ে তাঁদের আইনি পোশাক নেই। বুঝতে পারলাম না লোকটা কি সত্যিই র্যাব কিংবা পুলিশের কেউ? নাকি বাইরের! চঞ্চল পদক্ষেপে একজন আমার সামনের চেয়ারে এসে বসল।আর সবচেয়ে কুৎসিত লোকটা হাত পিছনে দিয়ে প্রস্তরের ন্যায় দাঁড়াল। এসময় দিন কি রাত বোঝা বড় দায়। চারিদিকে মিশমিশে কালো অন্ধকারের জাল ভেদিয়ে টেবিলের উপর ঝোলানো একটা সাদা বাতিতে তথাকথিত চোর-পুলিশের মুখ উজালা হয়েছে। লোকটি ধীরে সুস্থে বলল,
— যা যা জিজ্ঞেস করব। ঠিক ঠিক উত্তর দিবে।
আমি মুচকি হেসে মাথা নাড়লাম।
লোকটি গালের খোঁচা খোঁচা দাড়ি খসখস করে চুলকাতে চুলকাতে বলল,
— ঐ মেয়েটার সঙ্গে তোমার সম্পর্ক কী? সিলেটে আলতাফ খুনের সময় তুমি সেখানে ছিলে কেন?
আমি সব সত্যি বলার ইচ্ছাতেই বসে ছিলাম। তবু আমি জানি রিমান্ডে যতোই মধুকথা মুখ দিয়ে নিঃসৃত হয় না কেন। আসল কথা উদঘাটনের নিমিত্তে চপেটাঘাত কিংবা নির্যাতন তার জন্য বরাদ্দ। বললাম,
— মেয়েটি আমার গার্লফ্রেন্ড হয়। সেদিন…
লোকটা কথা শেষ করতে দিল না। রসিক গলায় বলল,
— তাই? কতদিনের সম্পর্ক?
— কলেজ লাইফ থেকেই। কিন্তু ওর সঙ্গে আমার যোগাযোগ ছিল না আট বছর। দুই বছর আগে ওর দেখা পাই৷ কিন্তু সেই আট বছরের অনেক কিছু হয়ে গেছে। এখন তারই প্রতিশোধ নিচ্ছে সে।
এর বিষয়ে আর কিছু বলার প্রবৃত্তি হল না আমার। লোকটা বিজ্ঞের ন্যায় মাথা নাড়তে নাড়তে বলল,
— হুমমম, সিলেটে কী হয়েছিল?
— সিলেটে আমি ওর সঙ্গে পাহাড়ে ঘুরতে যাই। সেখানে তার বাড়ির একটা কাজের মেয়েকে আলতাফ ধরে নিয়ে যায়। আমরা মেয়েটাকে বাঁচিয়ে নিয়ে আসি। কিন্তু স্বর্ণা আলতাফকেও ধরে আনে। শিকার যখন নিজে এসে ধরা দেয় তখন শিকারি নিশ্চয় বসে থাকবে না! কিন্তু এটা সত্যি যে আলতাফের পুরো ঘটনার সঙ্গে আমার কোন যোগসূত্র নেই।
— তারমানে তুমি বলছে চাইছ বাকি খুনগুলার সঙ্গেও তুমি যুক্ত নেই?
আমি প্রবল বিশ্বাসে মাথা ঝাঁকিয়ে বললাম,
— একদম না! আপনি রেকর্ডস চেক করতে পারেন তখন আমি কোথায় ছিলাম।
— যাক, ধরে নিলাম রেকর্ডস চেক করলাম, তুমি যুক্ত নেই! কিন্তু আলতাফের খুন তোমার সামনেই হয়েছে। যেখানে পুলিশ হিসেবে তোমার বাঁধা দেওয়াটা কর্তব্য ছিল। এর জন্য তোমাকে শাস্তি পোহাতে হবে সেটা জানো?
—জানি।
— যাইহোক শাস্তি আদালত দিবে এবং বহিষ্কারও আদালত করবে।
আমি মুখ বিকৃত করে ফিচেল হেসে বললাম,
— আমি নিজেই তো বহিষ্কৃত হলাম। নতুন করে করার কী আছে?
লোকটা মাথা কিঞ্চিৎ ঝুঁকিয়ে দুইহাত দিয়ে থামিয়ে দেবার ঢং-এ বলল,
— ঠিক আছে। এবার মেয়েটার নামধাম বলে আমাদের কাজে সাহায্য কর।
— আপনারা তার পিছনে কেন পড়লেন? কয়দিন আগেই তো লাগাতার ধর্ষক মেরে গেল একটা দল। সবাই তাদের বাহ্বা দিলো। হারকিউলিস নাম দিল। তারা যদি ছাড়া পায় তাহলে মেয়েটা পাবে না কেন?
— সেই কেইস ধামাচাপা পড়েনি৷ ক্লো পাওয়া যাচ্ছে না বলেই তদন্তে আছে।
— তদন্ত করে আপনারা কিছু পাবেনও না। আপনারা ধর্ষকদের বাঁচিয়ে রাখতে চান। যারা নিধন করছে তাদের পিছনেও লেগেছেন।
— ধর্ষণকারীদের জন্য আইন আছে। সাধারণ মানুষ কী?
— আইনের চোখ যখন অন্ধ হয় সাধারণ মানুষ তখন কিছু একটা করে দেখিয়ে দিতে হয়।
— যাক,তোমার সঙ্গে তর্ক করার রুচি আর ইচ্ছে কোনটাই নেই, তুমি মেয়েটার ইনফরমেশন দাও। নাম কী মেয়েটার?
আমি তৎক্ষনাৎ চোখ নামিয়ে ঘাড় ঘুরালাম। কঠিনভাবে বললাম,
— জানি না।
লোকটার চোখমুখ এবার কঠোর হয়ে এলো। দাঁতে দাঁত দংশনে চোয়াল ফুলে ইস্পাতকঠিন করে বলল,
— তোমাকে বলতেই হবে। লাস্ট যে জনকে মেয়েটা মারবে তাঁকে তুমি চেন? সে মরলে কেমন কুরুক্ষেত্র চলবে সেটা অনুমান করা যাবে না।
আমি মনে মনে বললাম, অনুমান আমি করতে চাইও না। আমি চাই স্বর্ণার সর্বোচ্চ নিরাপত্তা। কিন্তু মুখে কিছু বললাম না।
এই চারদেয়ালের মাঝখানে যদি স্বর্ণার বেফাঁস কোনো তথ্য ভুল করেও বিনির্গত হয় দিয়ে তবে স্বর্ণার জন্য ঝুঁকি হয়ে যাবে। এঁদের হাত কতদূর তা আমার ভালো করেই জানা আছে। সোজা আঙুলে ঘি না উঠলে আঙুল বাঁকা করতে তারা পিছপা হবে না। তাছাড়া একা কতক্ষণই বা লড়বে স্বর্ণা? সেও একজন মানুষ, দৈবশক্তিবলে শত্রুকে ধরাশায়ী করার ক্ষমতা নিশ্চয় তার নেই! কিন্তু গুহ্য একটা বিষয় এতক্ষণে টের পেলাম, কেন প্রশাসন এতো উতলা? ঐ রাজিব নিশ্চয় বড় কেউ যার কারণে তার মৃত্যুতে মানুষ তাকে ধর্ষক বলে জানবে এবং মরার পরও ছিঃ ছিঃ করবে। যাক জেলে এসে অন্তত এইটুকু তথ্য পেলাম যা স্বর্ণার বিশদ কাজে লাগবে। এবার কোন উপায়ে কথাটা স্বর্ণার কাছে পৌঁছে দিতে পারলেই সিদ্ধিলাভ হবে। বীর্যবান লোকটা আবার টেবিলে শব্দ করে চাপড় দিয়ে বলল,
— চুপ করে আছ কেন?
আমি পুনরায় কাঠ গলায় বললাম,
— আমি কিছু জানি না মেয়েটার ব্যাপারে।
— তোমার গার্লফ্রেন্ড, তুমি জান না? এটা বিশ্বাস করতে বলো আমাকে?
— বিশ্বাস করা না করা আপনার ব্যাপার।
— এখনো নরম নরম কথা বলছি বলে এভাবে গা ছেড়ে কথা বলছ। কঠিন হতে বাধ্য করো না।
সঙ্গে সঙ্গে পাশে দাঁড়িয়ে থাকা কুৎসিত লোকটা বলল,
— এরা দেশের শত্রু স্যার। খানকিরপোলাকে আমার হাতে ছেড়ে দিন। দেখুন কীভাবে কথা বের করি।
সুদর্শন ‘স্যার’ চোখ পাকিয়ে বলল, – তুমি তোমার মুখ সামলাও জালাল।
আমি তখন আমাতে নেই। হোঁদলের মতো কুৎসিত কদাকার লোকটার মুখনিঃসৃত কদর্য বাক্যটির আমার হৃদয়তটে যেন তীরের মতো এসে বিঁধল। সদ্য মাতৃবিয়োগে মনটা যে কতটা ভারাক্রান্ত সেটা কাউকে দেখানোর অপেক্ষা রাখে না। এরমধ্যেই আচম্বিতে লোকটার এই গালি আমার আঁতে সইল না। প্রখর তাপের সংস্পর্শে কেরোসিনের পাত্র যেভাবে ধক করে জ্বলে ওঠে, আমার ভেতরটাও ঠিক সেভাবে জ্বলে ওঠল। প্রথমটা তড়িৎ গতিতে ঘাড় ঘুরিয়ে রোষদৃষ্টিতে তাকালাম লোকটার দিকে। এরপর আচানক দিকবিদিকজ্ঞানশুন্য হয়ে চোখের নিমিষেই ঝাঁপিয়ে পড়লাম লোকটার ওপর। বুনো হাতির ন্যায় শক্তি এসে গেল আমার সর্বাঙ্গের মজ্জায়। দুই হাতে মাটি থেকে আলগা করে বাঁইবাঁই করে পাঁক খাইয়ে দেয়ালের দিকে ছুঁড়ে মারলাম সরোষে। কয়েক ন্যানো সেকেন্ড শূন্যে ভেসে ধড়াম করে দেয়ালের ‘পরে গিয়ে পড়ল সে। ঠাস করে মাথা ফেটে গেল। গগনবিদারী এক অশ্রাব্য চিৎকার করে পুরো কারাগার মাথায় তুলে ফেলার জোগাড় করল লোকটা। কাটা দেশি মুরগির মতো ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরোল এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই কয়েকজোড়া বুট জুতোর খটখট শব্দ ধীরে ধীরে কাছে আসতে লাগল।
চলবে…