শেহনাজ পর্ব-০১

0
4

#শেহনাজ
#সূচনা_পর্ব
লেখনীতেঃ #বৃষ্টি_শেখ

আব্বা দ্বিতীয় বিয়ে করে নতুন বউ ঘরে আনার সাথে সাথেই আমার আম্মার লা’শ পাওয়া গেল বাড়ির পাশের বড় আম গাছটার ডালে। আমি দেখতে পেলাম আম্মার জিভ অনেকখানি বেরিয়ে এসেছে। গলায় জড়িয়ে আছে মোটা, শক্ত দড়ি। আম্মার আঁখিযুগলে ছেয়ে আছে এক রাশ দুঃখ। গলায় ফাঁস লাগার সময় আম্মা না জানি কত ছটফট করেছিল? কতই না কষ্ট পেয়ে এমন একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছিল সে? এত নির্মম ভাবে আম্মা কিভাবে ভেঙে পড়ল বুঝিনি।

হু হু করে কেঁদে উঠলাম আমি আর বুবু। বসে পড়লাম মাটিতে। হাউমাউ করে কেঁদে ফেললাম আমি। আব্বা সেসময় নির্বাক, নির্জীব। নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে আমাদের সামনে। আব্বার চোখেমুখে শোকের ছায়া নেই, আম্মার জন্য মায়াও নেই। নতুন বউ নিয়ে আব্বা যেন রয়েছেন ফুরফুরে মেজাজে। আমার আর আমার বোনদের জন্য এই দিনটা যে কতটা ভয়াবহ, তা কেউ বুঝবে না। আমার বক্ষপিঞ্জর ক্রমাগত টনটন করে উঠছে। সূক্ষ্ম ব্যথা অনুভব করছি আমি। যন্ত্রণায় কাতর হয়ে উঠছে দেহ। “আমার আম্মা আর আমাদের মাঝে নেই” – কথাটা ভাবতেই মাথাটা ঝিমঝিম করছে খুব। স্কুল থেকে বাড়ি ফিরে আম্মাকে এখন আর পাওয়া যাবে না, ডাক দিলে আম্মা আর সম্মুখে আসবে না। আমি নির্লজ্জের মতো, বেহায়ার মতো আম্মাকে ডাকতে থাকবো। আম্মা সাড়া দিবে না। ডাক দিলে আসবে না কাছে। একটা সন্তানের জন্য এর চেয়ে বড় শোক আর কি হতে পারে? তখন বয়সই বা কত আমার? সবে এস এস সি দিয়েছি। বাড়ন্ত বয়স। কৈশোর জীবনের এত বড় ধাক্কা আমাকে ভয়াবহ ভাবে একা করে দিল। এই শোক কি কাটে?

বুবুকে জড়িয়ে ধরলাম আমি। লুটিয়ে পরলাম বুবুর ধকধক করে ওঠা বুকের মাঝখানে। বুবু এখন কাঁদছে না। হাসছেও না। কেমন ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে আম্মার দিকে। অনুভূতিহীন লাগছে বুবুকে। আমায় এভাবে কান্না করতে দেখে বুবু বড় দম নিল। জিভ দ্বারা শুষ্ক ওষ্ঠাদ্বয় ভিজিয়ে নিল। আশপাশে থাকা গ্রামের কতক মানুষকে উদ্দেশ্যে করে বলল,
” আম্মাকে কবর দেওয়ার ব্যবস্থা করা হোক”।

পুনরায় চিৎকার করে কেঁদে উঠলাম আমি। হাত দিয়ে কিছুটা মাটি হাতের মুঠোয় নিলাম। কামড়ে ধরলাম হাতের মুঠো। বুবু কেমন করে হাসল। এমন তাচ্ছিল্যপূর্ণ হাসিতে কি ভাবনা যে আছে? জানা নেই আমার। গ্রামের নাদির কাকা চটপট করে গাছে উঠলেন। দড়িটা কেটে আম্মাকে নিচে নামালেন। দিনের আলোয় গ্রামের কয়েকজন মানুষ মিলে আম্মার কবর দিলেন জানাযা ছাড়াই। বুবু এহেন মুহূর্তেও ভেঙে পড়ল না। আব্বা যে আজ বিয়ে করবে এটা আমাদের জানাই ছিল। তাই আজ আমাদের সবার মন খারাপ ছিল। এজন্যই তো সকাল থেকে আমাদের চুলোয় ভাত বসেনি।
কবর দেওয়ার কার্যক্রম শেষ হতেই বুবু চুলায় ভাত বসাল। বটি নিয়ে আলু কুটতে বসল। আমি অবাক হলাম। চেয়ে রইলাম বুবুর পানে। বুবু গরুর মাংস রান্না করবে। বালতিতে মাংস ভিজিয়ে রেখেছে। খুশি মনেই আমাকে মাংসটুকু ধুয়ে দিতে বলল বুবু। এমন পরিস্থিতিতে বুবুকে এভাবে দেখে ঘৃণায় গা গুলিয়ে উঠল আমার। রাগে হিতাহিত জ্ঞানশূণ্য হয়ে পড়লাম। সজোরে লাথি দিলাম বটিতে। লোহার বটিটা ছিটকে খানিক দূরে গিয়ে পড়ল। বুবু শুধু আড়চোখে বটি টার দিকে তাকাল। কর্কশ গলায় আমি বলে উঠলাম,

” তুমি এখন খাইতে বইবা বুবু? আম্মা নাই। আমাগো আম্মা নাই। তোমার এখন গলা দিয়া ভাত নামবো? ”

বুবু রেগে গেল না। চোটপাট করল না। কোনো প্রতিক্রিয়াও দেখাল না। ধীর, স্থির নয়নে রয়েসয়ে থেকে বুবু বলে উঠল,

” আম্মা তো চলে যাওয়ার আগে আমাদের খাওয়া-পরার চিন্তা করেননি। তার চিন্তায় আমরা কেন খাওয়াদাওয়া ছেড়ে দিবো “?

কথাটা বোধগম্য হলো না আমার। দাঁত কিড়মিড় করে উঠলাম আমি। হঠাৎ এত রাগ হওয়ার কারণ খুঁজে পেলাম না। বললাম,

” কি বলো তুমি? মাথা হ্যাং হয়ে গেছে নাকি? ”

” মাথা আমার না, তোর হ্যাং হয়ে গেছে। পেটে দুটো দানা পড়লে ঠিক হয়ে যাবে। বোস তো আমার পাশে”।

রাগে শরীর জ্বলে উঠল আমার। পাশের ঘরে গিয়ে শব্দ করে কেঁদে ফেললাম আমি। জীবনটাকে কেমন অন্যরকম লাগতে শুরু করল। মস্তিষ্কে কেবল একটা কথাই বাজতে লাগল ” আম্মাকে ছাড়া থাকবো কি করে”?

____

দিনটা কেমন অগোছালো ভাবে চলে গেল। সারারাত ঘুমোইনি আমি। আম্মার জন্য পরান কেমন অস্থির ঠেকছিল। কবরের মতো অন্ধকার ঘরখানায় আম্মা আছে ভাবতেই আঁতকে উঠেছি আমি। বুবু আর ছোট বোনটা পাশে ছিল বলেই হয়তো ভয় পাইনি রাতে। আম্মা আর আব্বার জন্য বরাদ্দকৃত ঘরে উঁকি দিলাম আমি। নব বধুঁ বসে আছে চৌকিতে। লাল টকটকে জামদানি শাড়ি পরণে। মহিলার বয়স খানিক কম। ত্রিশের অধিক নয় বোঝা যায়। আব্বার ভুঁড়ি আছে। মাথার মাঝখানটায় তেমন চুল নেই। বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছি। গায়ের রঙ ও কালো। এত সুন্দর মহিলা আব্বাকে কেন বিয়ে করল এই নিয়ে সন্দিহান সকলে। এই বয়সে আব্বা বিয়ে করেছে বলে পাড়ার সবাই আব্বাকে ছিঃ ছিঃ করতে আরম্ভ করেছে। এ গ্রামের প্রত্যেকটা মানুষের জানা আছে আম্মার আত্মহত্যা করার কারণ। তাই সমালোচনা হচ্ছে বেশি। এহেন লোকের এত সুন্দর বউ হয়েছে এটা যেন খুব মজার ঘটনা। সবার মুখে মুখে আমাদের বাড়ির ঘটনা শোনা যাচ্ছে।

আমাকে দেখতে পেলেন আব্বার ঘরে বসে থাকা নতুন বউ। আমার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হাসলেন মহিলা। হাতের ইশারায় কাছে ডাকলেন। মহিলার প্রতি রাগে, ঘৃণায় মুখ ফিরিয়ে নিলাম আমি। ততক্ষণাৎ বারান্দায় চলে এলাম। মহিলা আমার পিছু পিছু এলেন বারান্দায়। আদর মাখা, অমায়িক কণ্ঠে বললেন,

“- কাল থেকে বোধহয় কিছু খাওনি । আমি তোমাকে খাইয়ে দিই বাবা”?

পুনরায় কান্না পেল আমার। আম্মা এমন আদুরে কণ্ঠে আমায় ডাকতো। রোজ খাইয়ে দিত। ঘুম পাড়িয়ে দিত প্রায় সময়। আম্মার অনুপস্থিতিতে নতুন মানুষ এসেছে। নতুন মানুষ জায়গা করে নিচ্ছে এ ঘরে। এমন ঘটনা একটি সন্তানের উপর কিরূপ প্রভাব ফেলে তখনও জানা নেই আমার। মহিলাকে দেখে রাগ তিরতির করে বেড়ে গেল আমার। আম্মার খু”নি বলে মনে হলো। এতটাই রাগ হলো আমার যে কথা বলার রুচিটুকু হারিয়ে ফেললাম আমি। বিবেকে বাঁধল। মহিলা নেহাৎ সরল মানুষ। আমার চুপ থাকাটাকে সম্মতির লক্ষণ বলে ধরে নিলেন তিনি। ছোট গামলায় ডাল আর ডিম ভাজি এনে আমার সম্মুখে এসে দাঁড়ালেন। চোখ পাকিয়ে তাকালাম আমি। ভষ্ম করে দিতে ইচ্ছে করল সবকিছু। মহিলা সেই রাগের ধার ধারলেন না। নিজের হাতের তালুতে ডিম ভাঁজা আর ভাত তুলে আমার মুখের কাছে আনলেন। সরল, দুঃখিত কণ্ঠে বললেন,

” তোমার আম্মাকে আমি মারতে চাইনি। আমি বুঝিনি উনি এত বড় সিদ্ধান্ত নিবেন”।

আমায় কিছু বলতে হলো না। বুবু সেসময় হন্তদন্ত হয়ে বারান্দায় এলো। মহিলার হাতে থাকা খাবারটুকু ফেলে দিল। বুবুর রাগে গা কাঁপছে। যেকোনো মুহুর্তে ভয়ানক কাজ করে ফেলতে পারে। ভয় পেলাম আমিও। গুটিয়ে নিলাম নিজেকে। হিংস্র কণ্ঠে মহিলার পানে তাকিয়ে বুবু বলে উঠল,

” আমার আম্মাকে মেরে ফেললেন। এখন আমার ভাইটাকেও মেরে ফেলতে চাইছেন? এত বড় স্পর্ধা আপনার”?

মহিলা অবাক। হা করে তাকিয়ে রয় বুবুর পানে। অশ্রুতে ভরে উঠল উনার চোখ। নোনা পানিতে গাল দুটো ভিজে ওঠে মুহুর্তেই। হাঁসফাঁস কণ্ঠে বললেন,

” আমি এমনটা কেন করবো মা”?

” কারণ আমরা না থাকলে আপনার সুবিধা। আব্বার সম্পত্তির মালিক হবেন আপনি। সৎ ছেলেমেয়ে বলে আমাদের আপনি সহ্য করতে পারছেন না”।

বুবু আমাকে নিয়ে ঘরে চলে এলো। বুবুর এহেন হিংস্র রুপ আগে দেখিনি আমি। ভয়ে আমি গুটিয়ে নিলাম। রাতের দিকে আমি বেরিয়ে আসলাম নতুন মায়ের ঘরের সামনে। আব্বা এসেছেন কিছুক্ষণ আগে। ঘরের ভেতর থেকে কথার শব্দ আছে। মনে হচ্ছে আব্বা আর নতুন মা ঝগড়া করছেন। আমি আড়ি পাতলাম। মেয়েলি কণ্ঠে মহিলা বলে উঠলেন,

” আপনার স্ত্রী যে বেঁচে আছে, আপনি তো তা আমায় বলেননি। আপনি বলেছিলেন আপনার স্ত্রী মারা গেছেন। মিথ্যে কথা বলে কেন আমাকে বিয়ে করলেন? কেন ঠকালেন?

আব্বা খ্যাপা মানুষ। কথায় কথায় রেগে যান। গালিগালাজ করেন। গায়ে হাত তুলতে দ্বিধা বোধ করেন না। নতুন মায়ের কথা শুনে আব্বা রাগলেন না। শান্ত ভঙ্গিতে বললেন,
” তোমার মামারে কইছি। হ্যায় যদি তোমারে না কয়। আমার কি করার আছে”?

বিধ্বস্ত হয়ে উঠল মহিলার মন। আঁচল ঠোঁটে চেপে কেঁদে উঠলেন উনি। বসে পড়লেন খাটে। কণ্ঠ খাদে নামিয়ে বললেন,

” আপনার জন্য ছেলেমেয়ে গুলো আমাকে দোষারোপ করছে। ওরা ভাবছে ওদের আম্মার মৃত্যুর জন্য আমিই দায়ী। আপনি আমাকে ঠকিয়েছেন। বাজে ভাবে ঠকিয়েছেন। এখন আমি কি করবো? এত বড় পাপ নিয়ে কিভাবে বেঁচে থাকবো?

আব্বা কিছু না বলে মাথা নিচু করে রইলেন।
এবার সবটা বোধগম্য হলো আমার। ওখান থেকে সরে এলাম তখনই। ভাবলাম বুবুকে সবটা বলবো। বলবো এই মহিলার কোনো দোষ নেই। উনি জানতেন না আব্বা বিবাহিত। উনাকে আব্বা ঠকিয়ে বিয়ে করেছেন। কিন্তু তা আর বলা হলো না আমার। বুবু ততক্ষণে গভীর নিদ্রায় তলিয়ে পড়েছে। বুবুর গায়ের সাথে লেপ্টে আছে আমাদের ছোট বোন মহুয়া। ভেবে নিলাম সকালে বুবুর ঘুম ভাঙার সাথে সাথেই বুবুকে কথাগুলো জানাবো। কিন্তু ভাগ্য কাকে কোথায় নিয়ে যায় তা আমরা পূর্বে অনুমান করতে পারি না। এর পরদিন সকালেই বুবু হারিয়ে গেল। বুবুকে আর কোথাও পাওয়া গেল না। পুরো গ্রামে তন্ন তন্ন করে খুঁজেও বুবুর হদিশ পেলাম না আমরা। আব্বা মাথায় হাত দিয়ে বসে রইলেন। নতুন মায়ের চোখে দেখা গেল সৎ মেয়ের প্রতি মায়া। আমি দিক্বিদিক হারিয়ে ঘরে ফিরে বুবুর টেবিলটাতে হাত রাখলাম। ঠিক সেই মুহূর্তে একটা রঙিন কাগজ পেলাম আমি। কাগজের উপরে গোটা গোটা অক্ষরে লেখা আমার নাম। আগ্রহ বাড়লো আমার। কাগজটা খুলে দেখতে মরিয়া হয়ে উঠলাম। ছো মেরে কাগজটা হাতে নিয়ে পড়তে আরম্ভ করলাম আমি। সেথায় লেখা,

এমির,

চিঠিটা যখন পড়ছিস তখন আমি গ্রাম ছেড়ে অনেকটা পথ চলে এসেছি। তুই ভাবছিস আমি আম্মাকে ভালোবাসি না। আম্মা চলে যাওয়ায় আমি দুঃখ পাইনি। কিন্তু বিশ্বাস কর এমির, আমি আম্মাকে খুব ভালোবাসি। আম্মা আমার জীবনের সবচেয়ে প্রিয় মানুষ ছিল। আম্মাকে হারিয়ে আমি নিজেকে স্থির রাখতে পারছি না।ভেতরটা যন্ত্রণায় ছটফট করছে জানিস? আব্বাকে আর ওই মহিলাকে একসাথে দেখে আমার গা জ্বলছে। ইচ্ছে করছে সবকিছু জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দিই। ওই মহিলাকে বের করে দিই বাড়ি থেকে। কিন্তু আমি তো তা পারবো না। এই ঘটনার পর আব্বাকে আমি কখনো নিজের পিতা হিসেবে মানতে পারবো না। উনি আমার আম্মার খুনি। আব্বার জন্যেই আমাদের নিষ্পাপ আম্মা এত বড় ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তাই আব্বার সাথে এক বাড়িতে আমি থাকতে পারবো না। ওই মহিলার ন্যাকামিও সহ্য করতে পারবো না। তাই চলে যাচ্ছি। কোথায় যাচ্ছি জানি না। আমার জন্য চিন্তা করিস না। কাজ করে আমি নিজেই নিজের দায়িত্ব নিতে পারবো। পারলে তুই ওই মহিলার থেকে দূরে থাকিস। মনে রাখিস সৎ মা কখনো মা হতে পারে না। অন্যায়কে প্রশ্রয় দিস না কখনো। মহুয়াকে দেখে রাখিস। তোর ভবিষ্যত আমি নষ্ট করতে চাই না। তাই তোকে সাথে নিচ্ছি না। তুই ভালো করে পড়াশোনা করিস। সময় হলে তোকে আর মহুয়াকে নিয়ে আসবো আমার কাছে। মন খারাপ করিস না। সুখে থাকিস।

ইতি
সাবিহা।

কথাটুকু বলে থামল এমির। অপর প্রান্তে বসে থাকা মেয়েটি উদগ্রীব হয়ে চেয়ে রইল এমিরের পানে। ফের আগ্রহ নিয়ে প্রশ্ন করল,

” তারপর কি হলো”?

এমির উঠে দাঁড়াল। পকেট থেকে বের করলো পুরোনো, কমদামি মুঠোফোন। সময়টা দেখে নিয়ে বলল,

” তা জেনে তোমার লাভ নেই। ক্লাসে যাও। আমাকে পড়াতে যেতে হবে”।

শেহনাজের স্থির দৃষ্টি মুহুর্তেই অগোছালো ভাবে এদিক ওদিক তাকাল। এমিরের বাদামি রঙের চোখের মণির দিকে চেয়ে রইল কয়েক মুহুর্ত। এমির বাক্য ব্যয় করল না। মানুষটা চলে যেতে নিলে উত্তেজনা বেড়ে গেল শেহনাজের। এমিরকে আটকাতে আগ্রহী হলো শেহনাজের মন। চাঞ্চল্যকর কণ্ঠে বলে উঠল,

” পুরোটা না জানতে পারলে আমার ঘুম হবে না। বাকিটুকু বলে যান প্লিজ”।

হাসল এমির। মৃদ্যু হাসি। চোখটাও হেসে উঠল সাথে সাথে। ঠোঁটের কোণটা চমৎকার ভাবে দুলে উঠল যেন। শেহনাজের এমন আচরণ তার কাছে নতুন নয়। মেয়েটা এমন ভাবে পিছু লেগে আছে। ছাড়তেই চাইছে না। অথচ এমিরের এইসব কোনোকালেই পছন্দ ছিল না। বড় দম ফেলে এমির শান্ত অথচ গম্ভীর কণ্ঠে বলল,

-“জেদ করো না শেহনাজ”।
-” আমি জেদ করছি না এমির ভাই”।
-” এত আবেগ ভালো নয়”।

কথাটুকু শ্রবণ হতেই তাচ্ছিল্যের সাথে হাসল শেহনাজ। কেঁপে উঠল মেয়েটার বক্ষস্থল। বুক ক্রমান্বয়ে ধকধক করে উঠল। চোখে অশ্রু জমল মুহুর্তেই। ভিজে উঠল চোখের ঘন পাপড়ি। দাঁত দিয়ে ওষ্ঠ চেপে ধরল শেহনাজ। কান্না আটকানোর চেষ্টা করল। মিছে হাসি ফুঁটিয়ে বলল,

-” এসব আবেগ নয় এমির। আমি আপনাকে ভালোবাসি। ভিষণ বাড়াবাড়ি রকমের ভালোবাসি”।

এমির হতবাক। ক্ষুদ্ধ নয়নে চাইল শেহনাজের পানে। তীক্ষ্ম, ধারালো চোখ দ্বারা ভষ্ম করে দিতে চাইল শেহনাজকে। কঠোর হয়ে তেজী কণ্ঠে বলে উঠল,

-” এই তুমি নাম ধরে ডাকছো আমাকে? বেয়াদব মেয়ে। আমি তোমায় লাস্ট টাইম ওয়ার্ন করছি। আমার পিছু ছেড়ে দাও। আমি তোমাকে বিন্দুমাত্র পছন্দ করি না। ভালোওবাসি না”।

হন হন করে হেঁটে দ্রুত সেখান থেকে চলে গেল এমির। শেহনাজের অশ্রু এবার আর বাঁধ মানল না। গাল বেয়ে গড়িয়ে পরল অশ্রুকণা। ফুঁপিয়ে উঠল সে। ক্রমাগত সূক্ষ্ম ব্যথায় নেতিয়ে পরল শেহনাজ। এমির কেন তাকে ভালোবাসে না, এই প্রশ্ন করার পর এমির তার ফেলে আসা অতিত বলতে আরম্ভ করেছিল। কিন্তু পুরোটা বললো না। তাহলে কেন শোনাল এতকিছু?
ঝিমঝিম করে ওঠা শরীরটাকে টেনে নিয়ে দামী প্রাইভেট কারে উঠে বসল। লুটিয়ে রইল সিটে। শেহনাজের পার্সোনাল ড্রাইভার ততক্ষণাৎ বিনয়ী কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল,

” কোথায় যাবো মামনি”?

শেহনাজ চোখ মুছে। নিজেকে সংযত করে। থমথমে কণ্ঠে বলে ওঠে,

” বাড়ি নিয়ে চলুন আঙ্কেল”।

” আপনাকে অসুস্থ লাগছে মামনি। ডক্টরকে ডাকবো”?

” প্রয়োজন নেই আঙ্কেল। বাসায় যাবো। রেস্ট নিলেই ঠিক হয়ে যাবো”।

_______

দশম শ্রেণীর এক ছাত্রকে পড়িয়ে মেসে ফিরে এমির। ঘড়িতে বাজে নয়টা পনেরো। চার জন মিলে এক রুম শেয়ার করে থাকে তারা। এমির, নয়ন, সাদাত আর হাসান। এর মধ্যে সাদাত হলো প্রেমিক পুরুষ। প্রেম আর প্রেমিকা ব্যতিত মাথাতে কিছুই থাকে না তার। প্রেমিকাকে কিভাবে কেয়ার করতে হয়, হ্যাপি রাখতে হয় ছেলেটা ভালোমতো জানে। লাভ টিপস পেতে অনেকে আসে বড় ভাই সাদাতের কাছে । এদিকে হাসান প্রচণ্ড সিরিয়াস টাইপের মানুষ। কবিতা, উপন্যাস খুব ভালো লিখে ছেলেটা। ওর হাতের কলম যেন কথা বলে। হাসানের লেখাগুলোতে প্রাণ আছে। বেশ বড় পরিচালক, লেখক কিংবা নাট্যকার হবার শখ হাসানের। অপর দিকে নয়ন পড়াশোনার আগেপিছে কোথাও নেই। টেনেটুনে পাশ করা ছাত্র হলো নয়ন। আড্ডা, হইচই আর খেলাধুলায় ছেলেটা ভালো। বাঁচাল টাইপের এই ছেলেটা হই হুল্লোরে মেতে থাকে সর্বদা। আর এমির? এমির কেমন? বোঝা দায়। এমির যেন কাঠের পুতুল। সহজে হাসে না, সহজে রাগে না। কারো সাথে প্রাণ খুলে কথা বলতে চায় না এমির। কোথাও যেন একটা কাঠিন্যতা আছে এমিরের মাঝে। তবে বন্ধুদের সাথে এমির তার সব সুখ খুঁজে পায়। মাঝে মাঝে ভাড়া করে আনা গিটারে টুনটান আওয়াজ তুলে। কখনো রাতের অন্ধকারে হেঁটে হেঁটে টহল দেয় এলাকা। কখনো খুব ভোরে টংয়ের দোকানের বেঞ্চে চুপচাপ বসে থাকতে দেখা যায় এমিরকে।

এমির মেসে ফিরে ওয়াশরুমে যায়। মাথায় দু মগ পানি ঢেলে ঘরে ফিরে। নয়ন তাস খেলতে বসেছে। ওর সাথে বাকিরাও এক হয়েছে। প্রায় রাত জেগে বিভিন্ন ধরনের খেলা খেলে ওরা, আড্ডা দেয়। এমিরকে দেখে নয়ন উৎফুল্ল চোখে তাকাল।হাসিমুখে বলল,
” মাম্মাহ্, খেলবি নাকি এক দান? আয় বস।

এমির গামছা দিয়ে চুল মুছে। বলে,
” কাল সকালে ক্লাস আছে। এখন খেলতে বসলি কোন আক্কেলে”?

সাদাত হাই তোলে। ঘুমু ঘুমু কণ্ঠে বলে,

” নয়ন এত এনার্জি পায় কোথা থেকে? আমার তো খুব ঘুম পাচ্ছে”।

খিলখিল করে হেসে ওঠে নয়ন আর হাসান। সাথে একটু মুচকি হাসে এমির। নয়ন মুখ ভেঙিয়ে বলে,

” সারা রাত যখন তোমার সুনয়নার সাথে কথা বলো, তখন তো ঘুম পায় না। এহন খেলতে কইছি তাই কত বাহানা। শালা লুতুপুতু।

সাদাত রাগ দেখায়। বিছানা থেকে বালিশটা ছুঁড়ে দেয় নয়নের দিকে। নয়ন সরে দাঁড়ায়। বালিশ এসে লাগে এমিরের পায়ে। হাসে এমির। ততক্ষণাৎ বালিশটা ছুঁড়ে দেয় সাদাতের দিকে। বলে,

” সত্য বললেই দোষ না? নয়ন ভুল তো বলেনি। আজ তোর ঘুম পায় কিভাবে”?

এমিরের মুখে এ কথা শুনে হতাশ হয় সাদাত। কাঁচুমাচু হয়ে খেলতে বসে। এমির খুব একটা রসিকতা করে না। যখন করে তখন সবাইকে নির্বাক করে ফেলে। আজ ও তার ব্যতিক্রম নয়। সকলে মিলে খেলতে বসল ওরা। এমির খেলা শুরু করল প্রথমে।

____

ক্যান্টিনের ছোট্ট চেয়ার আর টেবিল জুড়ে কলেজের শিক্ষার্থীরা আড্ডা দিচ্ছে। চারপাশে কথার ছড়াছড়ি। মৃদ্যু বাতাস বইছে। এখানে ভার্সিটি আর কলেজ দুটোই রয়েছে। দুটো আলাদা আলাদা ভবনে শিক্ষার্থীরা শ্রেণী অনুযায়ী ক্লাস করে। পাশাপাশি হওয়ায় কলেজ আর ভার্সিটির সকলেই মিলে থাকে। কলেজ শেষ করে অনেকেই এই ভার্সিটিতেই ভর্তি হয়। কলেজ আর ভার্সিটির নামডাক বেশ ভালোই। পুরো শহরে এমন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কমই আছে।

শেহনাজ বসে আছে নিরলস ভঙ্গিতে। মেয়েটার চুলগুলো বেশ অগোছালো। সকালে চিরুনি পরেনি বোধহয়। ফ্রক টাও ইস্ত্রি করা হয়নি। কলেজ ড্রেসে শেহনাজকে ভালো দেখায়। মায়াবি লাগে। রোদে যখন শেহনাজের ফর্সা মুখটা লাল রঙ ধারণ করে, তখনও চমৎকার লাগে। কখনোই মেয়েটাকে দেখতে খারাপ লাগে না। মোহনীয় লাগে সর্বদা। ওর উজ্জ্বল মুখ দেখলেই যেন শান্তি লাগে।

শেহনাজের সাথে বসে আছে তার বান্ধবী তানিয়া। মেয়েটার হাস্যজ্জ্বল মুখখানা শেহনাজকে দেখে পরিবর্তিত হয়েছে। খারাপ লাগছে তার। শেহনাজকে এভাবে মন খারাপ করে বসে থাকতে দেখে তানিয়া বলল,

” এমির ভাইয়া বকেছে তাইনা”?

শেহনাজ চোখ উপরে তোলে। থমথমে মুখে তাকায় তানিশার দিকে। মুখ ভার করে জিজ্ঞেস করে,

” তুই কিভাবে জানলি”?

হাসে তানিয়া। মায়া মুখে বলে,

” এমির ভাই ছাড়া আর কেউ তোকে দুঃখ দেয় না রে নাজ, দিতে পারেও না। ওই একটা মানুষের জন্যই তুই এত দুঃখ পাস, কাঁদিস”।

” এমির বোঝে না। আমি ওকে সত্যিই ভালোবাসি। ও বোঝে না। কেন বোঝে না? কেন আমার কাছে ধরা দেয় না”?

ঝরঝর করে কাঁদে শেহনাজ। গাল ভিজে ওঠে নোনাজলে। তানিয়ার প্রাণ কাঁদে। মায়া হয় সামনে বসে থাকা মেয়েটাকে দেখে। প্রায় দু বছর ধরে একটা মানুষের জন্য ব্যাকুল হয়ে অপেক্ষা করে শেহনাজ। একটা মানুষকে ঘিরে স্বপ্ন সাজায় মেয়েটা। অথচ সেই পুরুষ শেহনাজের ধরা ছোঁয়ার বাইরে থাকে। সেই পুরুষটার চোখে শেহনাজের সৌন্দর্য ধরা পরে না, শেহনাজের অশ্রুসিক্ত চোখ দেখে মায়া হয় না ছেলেটার, শেহনাজের আভিজাত্যের লোভ ও ছেলেটার গায়ে লাগে না। খুব সহজেই শেহনাজকে উপেক্ষা করে ছেলেটি। শেহনাজ যখন বারবার ছুটে যায় ছেলেটার সম্মুখে, তাকে অপমান করে। তাড়িয়ে দেয়। এমন অপমান করে যে শেহনাজ ভেঙে পরে, কাঁদে। তবুও পরদিন বেহায়ার মতো আবার ছুটে যায়। লজ্জা ভুলে ভালোবাসার দাবি জানায়। তানিয়া কষ্ট পায় বন্ধুর এহেন অবস্থা দেখে। সান্ত্বনা দিয়ে বলে,

” কাঁদিস না নাজু। সব ঠিক হয়ে যাবে। এমির ভাই তোকে ঠিকই একদিন মানবে। আর নয়তো তুই উনাকে ঠিকই একদিন ভুলে যাবি দেখিস”।

চমকায় শেহনাজ। আচমকা উত্তেজিত কণ্ঠে বলে,

” আমার প্রাণ চলে যেতে পারে তানু, তবুও উনাকে আমি ভুলবো না। কখ্খনো না”।

তানিয়া আর কথা বাড়ায় না। এই বিষয়ে শেহনাজকে কিছু বোঝালেও সে বুঝে না। কিংবা বুঝলেও ওর মন মানতে চায় না। তাই এসব বলা বৃথা। শ্বাস টেনে সে বলে,

” বেশ। ক্লাসে চল। মন খারাপ করে থাকিস না”।

ক্লাস অবধি এগুতে পারে না ওরা। ডাক আসে। ওদের কলেজ আর এমিরের ভার্সিটি পাশাপাশি। হওয়ায় খুব শীঘ্রই এমিরের দেখা পায় শেহনাজ। ফোর্থ ইয়ারের ছাত্র এমির। খুবই ভালো ছাত্র বলা চলে। টিচাররা বড্ড ভালোবাসে এমিরকে। প্রত্যেকটা ছাত্র-ছাত্রী চিনে ছেলেটাকে। কলেজ কিংবা ভার্সিটির যেকোনো বড় অনুষ্ঠানের দায়িত্ব অনায়াসে এমিরকে দেওয়া হয়। ফোর্থ ইয়ারের ছাত্র বিধায় সিনিয়র হিসেবে অনেকেই বেশ সম্মান প্রদর্শন করে ওকে। দায়িত্ববান, পড়াকু, আর সুদর্শন এই এমিরের প্রেমে মজেছে শেহনাজ। এত তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে, তবুও পিছু ছাড়ে না। এমিরের ঠিক উল্টো এই শেহনাজ। পড়াশোনা করতে ওর একদমই ভালো লাগে না। একদম চঞ্চল, প্রাণবন্ত মেয়েটা। হাসলে যেন আশপাশ ও হাসে। বাবার একমাত্র কন্যা শেহনাজ ইফফাত। আভিজাত্যের শিকলে বন্দী এই মেয়েটা হুট করে প্রেমে পড়বে কে জানতো? বিপরীত এই দুই সত্তার মিলন চায় অনেকেই। তবে তা কি এত সহজ?

ভাবনা কাটে শেহনাজের। উৎফুল্ল হয় তার হৃদয়। এমির তাকে ডেকেছে। নিশ্চয়ই কিছু বলতে চায় তাকে। ভাবতেই আনন্দ হচ্ছে শেহনাজের। তর সইছে না যেন। মনে হচ্ছে আশার প্রদীপ জ্বলে উঠছে। সময় ব্যয় করে না শেহনাজ। দ্রুত ছুটে যায় এমিরের কাছে। ভয় হয় তানিয়ার। মেয়েটা কি এমন হাসিমুখেই ফিরবে? কে জানে।

চলবে?