শেহনাজ পর্ব-০২

0
1

#শেহনাজ
পর্ব সংখ্যা (২)
লেখনীতেঃ #বৃষ্টি_শেখ

দিনটি বেশ অনুজ্জ্বল। মেঘের দেখা মিলেছে। বৃষ্টি নামবে বোধহয়। দমকা বাতাস ও বইছে। মনে হচ্ছে পৃথিবী তার রুপ বদলাচ্ছে। গরম কমে এসেছে এখন।
শেহনাজ প্রথমে ভয় পেলেও পরবর্তীতে খুশি মনে শ্রেণীকক্ষের কাছে গেল। বিশাল বড় এই কক্ষটি অনার্স চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থীদের জন্য বরাদ্দ। কক্ষটি বেশ পরিপাটি। এখন এই কক্ষটিতে রয়েছে মোট ছ’জন মানুষ। নয়ন, সাদাত, হাসান, এমির আর প্রথম বর্ষের দুজন ছাত্র। এমির, হাসান, নয়ন আর সাদাত সবচেয়ে কাছের বন্ধু। ওদের প্রায় একসাথেই দেখা যায়। গোটা ভবন জুড়ে চলে ওদের রাজত্ব।

শেহনাজ আশপাশ দেখে। কক্ষের সকলেই বর্তমানে বিভিন্ন কাজে ব্যস্ত। এমির হোয়াইট বোর্ডে কিছু লিখছে। কাগজেও কিছু আঁকছে। হাতের আঙুলের ফাঁকে রেখেছে নীল রঙের কলম। গোটা গোটা অক্ষরে খাতার নিচে এমিরের নাম। এমিরের লেখাগুলো সুন্দর। দেখে মনে হবে যেন কোনো মেয়ের লেখা। এমিরের লেখা নিয়ে মাঝে মাঝে হিংসা হয় শেহনাজের। ওর লেখা অত সুন্দর নয়। মাঝে মাঝে নিজের হাতের লেখা নিজেই বুঝতে পারে না শেহনাজ। ওর ইচ্ছে করে এমিরের গুনগুলো পেতে। এমিরের মতো অন্যদের মনে নিজের জন্য আকর্ষণ বাড়াতে।

শেহনাজ অনুমতি নিয়ে প্রবেশ করে কক্ষে। বিনীত ভঙ্গিতে একটি বেঞ্চের সামনে এসে দাঁড়িয়ে থাকে। এমিরের দিকে তাকায় আড়চোখে। ছেলেটা তাকে পাত্তা দেয় না। তাকায় ও না তার দিকে। দেখে মনে হয় ভারী ব্যস্ত। ওর দিকে তাকালেই বুঝি সময় নষ্ট হয়ে যাবে। ওই সময়টা আর ফিরে পাবে না বোধহয়। বিশাল ক্ষতিটতিও হয়ে যেতে পারে। অথচ শেহনাজ এই মানুষটার প্রত্যেকটা পদক্ষেপ জানে, পর্যবেক্ষণ করে। সবসময় এঁটে থাকতে চায় এই মানুষটার সাথে। একটু গুরুত্ব চায়, যত্ন চায়।

বুকে সূক্ষ্ম ব্যথা অনুভব করে শেহনাজ। সে যাকে বারবার অবিরত চেয়ে চলেছে, তার মনের একাংশেও সে নেই। কোথাও নেই।
আগ বাড়িয়ে এমিরকে জিজ্ঞেস করে,

” আমায় ডেকেছিলেন”?

এমির নজর সরায় বোর্ড থেকে। অবাক হয়। সে শেহনাজকে ডাকেনি। এটা বলার কারণ কি? শেহনাজ ক্লাসের ভিতরে কেন? প্রশ্ন জাগে এমিরের মনে। বিষয়টা খানিক বোধগম্য হয়। বন্ধুদের দিকে সন্দেহের দৃষ্টিতে চেয়ে প্রশ্ন করার পূর্বেই এমিরকে থামায় নয়ন। ভূবন ভোলানো হাসি দিয়ে বলে,

” হ্যাঁ হ্যাঁ এমির ডেকেছিল তোমায়। আসলে কলেজের প্রগ্রামে একটু সমস্যা হয়েছে। তাই তোমার একটু হেল্প দরকার”।

এমির শেহনাজকে প্রয়োজনের খাতিরে হলেও ডেকেছে, বিষয়টা ভেবে মনে মনে ভারী খুশি হয় শেহনাজ। নিজেকে হঠাৎই ভিষণ গুরুত্বপূর্ণ মনে হলো ওর। কিশোরীর ন্যায় লাফিয়ে উঠল শেহনাজের হৃদয়। সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো উথলে উঠে আবেগ। পুষ্প ফুটলে যেমন সুন্দর দেখায়, তেমনি প্রাণবন্ত আর সুন্দর হয়ে উঠল শেহনাজের আঁখিদ্বয়। তৎক্ষণাৎ বলে উঠল,

” সাহায্য? আপনাদের জন্য কি করতে পারি বলুন? আমি সব করতে পারবো। সমস্যা নেই”।

এমির কাগজে কিছু লিখতে গিয়ে থামল। শেহনাজের দিকে না তাকিয়েই নিচু অথচ ধারাল কণ্ঠে বলল,

” তোমাকে কিছু করতে হবে না। ক্লাসে যাও। ঘন্টা পরেছে”।

শেহনাজের মন খারাপ হলো না। এসবে যেন সে অভ্যস্ত। এমিরের দিকে এগিয়ে আসল সে। পুনরায় আরেকটি বেঞ্চে বসে পরল। বিষয়টা দৃষ্টিকটু হলেও শেহনাজ এ কাজটা করে ফেলল। চোখ ঘুরিয়ে দেখে নিল ক্লাসটাকে। বলল,

” কি জন্য ডেকেছিলেন? বলুন না”।

নয়ন বলল,
” তুমি তো জানোই শেহনাজ সামনে তোমাদের এইচএসসি পরিক্ষা। অনেক স্টুডেন্টই এখান থেকে চলে যাবে। অনেকে এখানে থাকলেও অন্য ক্লাসে ট্রান্সফার হবে। আবার আমরাও অন্য ক্লাসে উঠবো। তাই এইচএসসির আগে আমরা একটা বড়সড় পিকনিকের আয়োজন করতে চাইছিলাম। এমির আর আমাদের উপর সব দায়িত্ব পড়েছে। প্রতিষ্ঠানের কর্তৃপক্ষ যে টাকা দিয়েছে তাতে আমরা আমাদের মন মতো আয়োজন করতে পারছি না। তাই বলছিলাম তুমি যদি একটু ফাইনান্সিয়ালি হেল্প করতে, তাহলে সবটা খুব গুছিয়ে করতে পারতাম”।

মনোযোগ দিয়ে শুনল শেহনাজ। তাদের ব্যাচের স্টুডেন্টদেরকে ঘুরতে নিয়ে যাওয়া হবে ভেবেই আনন্দিত হলো সে। বন্ধুদের সাথে ঘুরতে যাওয়ার অভিজ্ঞতা তার তেমন নেই। মিষ্টি হেসে সে বলে উঠল,
” আমি আব্বুকে আজই বলবো। আপনারা একদম চিন্তা করবেন না ভাইয়া”।

এমির অভিব্যক্তি দেখায় না। তীক্ষ্ম, তুখোড় চোখ দ্বারা পর্যবেক্ষণ করে শেহনাজকে। ওদের কথোপকথন শুনে খানিক বিরক্ত হয় এমির। বন্ধুদের এহেন অবিবেচকের মতো নেয়া সিদ্ধান্ত মেনে নিতে পারে না সে। এগিয়ে আসে সবার মাঝে। ঘর্মাক্ত শার্টটা টেনে দেয় ঘাড়ে। চুলগুলোকে গোছাতে গোছাতে শেহনাজের উদ্দেশ্যে বলে,

” ক্লাসে যাও শেহনাজ। ওরা যা বললো সব ভুলে যাবে। কোনো সাহায্যের প্রয়োজন নেই। ওরা মজা করেছে তোমার সাথে”।

সবাই একে অপরের দিকে দৃষ্টি মেলে। হতাশ হয় নয়ন। একটু রাগ ও হয় না এমিরের প্রতি। শুধু অভিমান জমে। একটু সাহায্য নিলে ক্ষতি কি? শেহনাজের বাবার তো টাকা পয়সার অভাব নেই। মেয়ের কলেজের জন্য কিছু টাকা ব্যয় করলে উনার খুব ক্ষতি হতো না। এমির এমনভাবে না করে দেওয়ায় সকলে মুখ ফ্যাকাশে করে ফেলল। সাদাত সবটা সামলাতে বলল,

” আচ্ছা ঠিক আছে শেহনাজ। আঙ্কেলকে তাহলে কিছু বলো না। এমির চাইছে না যখন”।

হাসি উবে যায় শেহনাজের। ভেবেছিল কোনোভাবে সাহায্য করে এমিরের মনে সে জায়গা করে নিতে পারবে। এমিরের নজরে থাকতে পারবে। এমির তার গুরুত্ব বুঝবে, উদ্দেশ্য পূরণের জন্য হলেও তার সাথে হেসে কথা বলবে । কিন্তু এটা যে খুব সহজ নয় তা এক মুহুর্তের জন্য ভুলে গিয়েছিল শেহনাজ।
পুরো বিষয়টা বুঝতে পারে সে। সে জানে বাকি সবাই তার কাছে সাহায্য চাইলেও এমির চাইবে না। কারো কাছে হাত পাততে নারাজ এই মানুষটা। সবসময় সামর্থ্য অনুযায়ীই চলতে চায় এমির। নিজের ব্যক্তিত্ব বজায় রাখে সর্বদা। আর এমিরের এমন ব্যক্তিত্বই মুগ্ধ করে শেহনাজকে। মেয়েটা যেন বারংবার গলে যায় বরফের ন্যায়। এমিরের প্রতি ভালো লাগা বেড়ে যায়। কিশোরীর হৃদয়ে অজানা মায়া কাজ করে। আলতো হেসে শেহনাজ বলে,

” আমি আব্বুকে বলবো নয়ন ভাই। চিন্তা করবেন না। উনাকে ভয় পাওয়ার কিচ্ছু নেই”।

অভিব্যক্তি না দেখালেও সবাই খুশি হয় মনে মনে। এমিরের রাগ বাড়ে। কলেজের এক ছাত্রীর বাবার থেকে টাকা নিয়ে পিকনিক করবে? তাদের কোনো দায় নেই? বিষয়টা ভাবতেই খারাপ লাগে এমিরের। তুচ্ছ লাগে নিজেদের। সে ধমকে বলে,

” টাকাপয়সা আছে বলে সব কিনে নিবে নাকি? বলছি যখন তোমাকে দরকার নেই তখন তোমাকে দরকার নেই। কথা বুঝো না তুমি? টাকার গরম দেখাও”?

পুনরায় নয়নকে উদ্দেশ্যে করে বলে,
“আমাদের কারো কোনো হেল্প লাগবে না। যতটুকু সম্ভব আমরা ততটুকুই আয়োজন করবো। কারো কাছে হেল্প চাওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই”।

শেহনাজ কেঁপে ওঠে। ভয় পায়। সলজ্জ চোখে বলে,

” আমি তো শুধু সাহায্য করতে..

বাকিটুকু বলতে পারল না শেহনাজ। হাতের নাগালে থাকা স্কেলটা মাটিতে ছুঁড়ে মারে এমির। দ্রুত সেখান থেকে বেরিয়ে আসে। শেহনাজ চমকায়। খারাপ লাগে খুব। হাসিখুশি মুখটা মলিন হয় তার। নিষ্প্রাণ লাগে নিজেকে। বেহায়া মনে হয় নিজের সত্তাকে। তবুও কি মন মানে? বারংবার ছুটে যেতে চায় প্রিয় মানুষের নিকটে। অবাধ্য হৃদয় বড্ড বেহায়া, বড্ড নির্লজ্জ।

____

বাড়িটির রং ধূসর। প্রায় পাঁচ কাঠা জায়গা জুড়ে বাড়িটির বিচরণ। পাঁচ তলা পর্যন্ত। বাড়ির গেটে রঙিন গেট ফুল গাছ। বাইরের অংশে হরেক রকম ফুল গাছ। বারান্দাটা বিশাল। রঙ গুলো বেশ টেকসই বলেই ঝলসে যায়নি এতদিনেও। বাড়ির বাইরে ঝুলছে সাদা রঙের নেমপ্লেট। গোটা মাঝারি অক্ষরে লেখা ” শেহনাজ মঞ্জিল” । শেহনাজের বাবা বেশ ধনী ব্যক্তি। শহরের তিনটি স্থানে শেহনাজের বাবা সাইফুল আলমের তিনটা রেস্টুরেন্ট রয়েছে। বাড়ি ছাড়াও সাইফুল আলমের আরো রয়েছে নিজস্ব দুটো গাড়ি। শেহনাজ সাইফুল আলমের একটি মাত্র কন্যা সন্তান। শেহনাজের মা শিমলা বেগমের জরায়ুর জটিলতায় পরবর্তীতে তিনি আর সন্তান জন্ম দিতে পারেননি। শেহনাজকে ঘিরেই তাদের সকল আশা-প্রত্যাশা।

শিমলা বেগম রিমোট চেপে এসি ছাড়লেন। কফিতে চুমুক দিতে দিতে স্বামীর উদ্দেশ্যে বললেন,
” শেহনাজ পড়াশোনা ঠিকমতো করছে না। সামনে তো ফাইনাল এক্সাম। ওকে কিছু বলো না কেন?

সাইফুল আলম ফোন থেকে চোখ সরালেন। হাসিমুখে বললেন,
” আমার মা টা পাস করলেই আমি খুশি। এতো চাপ আমার বাচ্চা মেয়ে নিতে পারবে না”।

ভেংচি কাটলেন শিমলা বেগম। বললেন,
” আমার বোনের ছেলে এসএসসি তে গোল্ডেন পেয়েছিল। এইচএসসিতে নির্ঘাত এ প্লাস পাবে। আর আমার মেয়ে কিনা শুধু পাস-এ আটকে থাকবে। কিসের কমতি আছে ওর”?

শেহনাজ উঁকি দিল। ঘর থেকে সে শুনেছে সবটা। কি মনে করে বের হলো ঘর থেকে। মেয়েটার পরণে একটি ডেনিম শার্ট আর প্লাজু। চুলগুলো খোঁপা করেছে। নিতান্তই বাচ্চাদের ভঙ্গিতে সোফাতে এসে বসল শেহনাজ। সোফার সামনে থাকা টেবিল থেকে টকটকে আপেলটা নিয়ে তাতে কামড় বসাল। মিষ্টি হেসে বলল,

” আমার একজন হোম টিউটর লাগবে আব্বু। এক্সামের আগে একটু ভালোমতো পড়তে চাই। এইবার আমি সিরিয়াস হয়ে পড়াশোনা করবো। দেখে নিও। আর অবাধ্য হবো না”।

শিমলা বেগম অবাক হলেন খানিক। মুখের অভিব্যক্তি দ্বারা নিজের বিস্মিত ভাব বুঝিয়ে দিলেন তিনি। সাইফুল আলমও খানিক ভড়কে গেলেন মেয়ের এমন কথায়। শেহনাজ কখনোই পড়াকু ছিল না। পড়াশোনায় মেয়েটা বড্ড অমনোযোগী। কলেজের পড়াশোনার বাইরেও আলাদা করে পড়াশোনা নিয়ে শেহনাজ ভাবছে জেনে তিনি খুব খুশি হলেন। থেমে হাসি মুখে বললেন,

” আমার মা যা চায় তাই হবে। কালই বাড়িতে টিউটরের লাইন লেগে যাবে। যাকে তোমার পার্ফেক্ট মনে হবে তাকেই সিলেক্ট করা হবে”।

শেহনাজের মুখ শুকিয়ে গেল। খানিক ভেবে দ্রুত বলে উঠল,

” আমি টিউটর ঠিক করে ফেলেছি আব্বু। আমাদের কলেজের। অনার্স ফোর্থ ইয়ারের ছাত্র এমির সাখাওয়াত। তুমি জানো আব্বু? উনি খুব ভালো টিউটর। পড়াশোনায় উনি অনেক ভালো। উনার পড়ানো আমি খুব ভালো বুঝি। এক টিচার আমাকে এমির ভাইয়ার কাছে পড়ার জন্য সাজেস্ট করেছে। আমি উনার কাছেই পড়তে চাই আব্বু। প্লিজ”।

শেহনাজ ঠোঁট উল্টাল। সাইফুল আলম মেয়েকে বড্ড ভালোবাসেন। মেয়ের কোনো চাওয়াই অপূর্ণ রাখেন না তিনি। উক্ত কথাতেও তিনি বিনাবাক্যে সায় জানালেন। মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে আদুরে কণ্ঠে বললেন,
” তোমার যেভাবে ভালো হয় সেভাবেই পড়ো। আমি তোমায় বারণ করবো না। তবে মন দিয়ে পড়তে হবে”।

শেহনাজ খুশি হলো খুব। জড়িয়ে ধরলো বাবাকে। মনে মনে এমিরকে নিজের কাছে কল্পনা করল। অনেকদিনের আশা বুঝি এবার পূর্ণ হবে তার।

____

পরদিন এমিরের মেসে উপস্থিত হলো মোটা এক বেঁটে লোক। গায়ের রঙ খানিক শ্যামলা। পরণে সাদা পোশাক। মাথায় সাদা ক্যাপ। ঘরে ঢুকেই ভদ্রলোক অপেক্ষা করল এমিরের জন্য। এমির তখন গোসলখানায়। বেরিয়ে এসে লোকটাকে এভাবে বসে থাকতে দেখে ভারী অবাক হলো এমির। বলল,

– “আমাকে খুঁজছেন কেন”?
– ” আমার স্যার সাইফুল আলম আমাকে পাঠিয়েছে আপনাকে নিয়ে যেতে। শেহনাজ মামনি বলেছে আপনি এখানে থাকেন”।

এমির ঠোঁট বাঁকায়। শেহনাজ কাকে পাঠিয়েছে এখানে? আর কেন? অদ্ভুত ঝামেলায় ফেঁসে যাচ্ছে মনে হচ্ছে। বলে,

– ” কেন ডেকেছে”?
-” শেহনাজ মামনির হোম টিউটর লাগবে তাই”।

-” কিন্তু আমার সময় নেই। আমি পড়াতে পারবো না”।

লোকটা মুখ শুকনো করল,
-” আপনাকে নিয়ে যাওয়ার আদেশ আমাকে দেওয়া হয়েছে। আমি ঝামেলা করতে চাই না। আপনি একবার দেখা করে আসুন স্যারের সাথে। নইলে আমি ফ্যাসাদে পরবো”।

দীর্ঘশ্বাস ফেলে এমির। বিরক্তিতে কুঁচকে আসে মুখ। চুল ভালোভাবে না মুছেই একটি সাদা শার্ট গায়ে জড়ায় সে। ঝামেলা নেহাতই পছন্দ নয় তার। নইলে লোকটার মাথা ফাটিয়ে দিতে খুব বেশি সময় লাগতো না ওর। এতক্ষণে এমির বুঝেছে লোকটা শেহনাজের ড্রাইভার। আচরণ বেশ মার্জিত। অন্তত নিজের মান রাখতে লোকটার সাথে শেহনাজ মঞ্জিলে যেতে রাজি হলো এমির। পকেটে মুঠোফোন গুঁজে বেরিয়ে পড়ল।

___

মুখোমুখি বসে আছে এমির আর সাইফুল আলম। সাইফুল আলমের পরণে দামি স্যুট। চেহারায় আভিজাত্য ফুটে উঠছে। এসির ঠান্ডা বাতাসে শীত শীত করতে এমিরের। এতসব বিলাসীতা ছেলেটার বোধহয় সহ্য হচ্ছে না। কেমন অসহ্যকর ঠেকছে।

এমির বসে আছে আলস্য ভঙ্গিতে। কোনো প্রকার ছল নেই ছেলেটার মুখে। বলিষ্ঠ, সুঠাম দেহে শার্টটা কেমন টাইট হয়ে লেগে আছে। ফর্সা মুখখানা হলদে রঙ ধারণ করেছে। এমিরের সামনে রয়েছে ফলের ঝুড়ি। গরম চা, লোভনীয় বিস্কিট আর ফলের ঘ্রাণে ম ম করছে ঘরটা। অতিথি আপ্যায়নে ত্রুটি নেই যেন। হেসে সাইফুল আলম বললেন,

-” স্যালারি মাসের এক তারিখেই পাবে। যত চাইবে ততই। আমার মেয়েকে মন দিয়ে পড়াতে হবে। এতদিনে মেয়েটা আমার আলাদা করে পড়তে চেয়েছে। তাই তোমাকে ডেকেছি”।

এমির ভদ্র ছেলের ন্যায় বলে,
-” আমি আরো অনেককে পড়াই আঙ্কেল। সময় হবে না আমার। আপনি অন্য কাউকে দেখুন”।

” আমার মা টা তোমার কাছে পড়তে চেয়েছে। ওর জন্য তোমাকে সময় বের করতে হবে। এটুকু আমি তোমার কাছে চাইতেই পারি”।

এমির চুপ থাকে। সামনের ঘর থেকে শেহনাজের কণ্ঠ ভেসে আসে। ভিতর থেকে শেহনাজ বলে ওঠে,
” আব্বু উনাকে ভিতরে আসতে বলো। যাচাই বাছাই করতে হবে না? কেমন পড়াবে আগে যাচাই করে নিই”।

এমির কি বলবে ভেবে পায় না। ছেলেটার চোয়াল শক্ত হয়। রাগ হয় শেহনাজের প্রতি। বিতৃষ্ণা ফুটে উঠে । অন্তত এ বাড়িতে এসে তার দাপট দেখানো উচিত নয়। এটা এমির খুব ভালো মতো বুঝে। তাই সাইফুল আলম যখন এমিরকে শেহনাজের রুমে যেতে বললেন তখন এমির বারণ করেনি। সে বাধ্য হলো শেহনাজের সাথে সাক্ষাত্ করতে। ঘরটার কাছে এসে এমির অনুমতির ধার ধারল না। সোজা ঘরে ঢুকে সে শেহনাজকে খুঁজল। শেহনাজ ঘরে নেই। এমির পেল না মেয়েটাকে। সামনে বেলকনির দরজা দেখে কৌতুহলী চোখে তাকাল এমির। থাই গ্লাসটা বেশ চকচক করছে। শেহনাজ ওখানে থাকতে পারে। এমির প্রশ্ন করল,

“- আছো তুমি?

শেহনাজের মিষ্টি কণ্ঠস্বর ভেসে এলো,

-” আছি। এদিকে আসুন”।

রাগে গা কাঁপে এমিরের। বিরক্তিতে ছেয়ে যায় মুখ। তৎক্ষণাৎ ব্যালকনিতে আসে সে। শেহনাজ গোলাপ গাছে পানি দিচ্ছে। বিভিন্ন রঙের সন্ধ্যামালতী ফুল ফুটে আছে সারা বেলকনি জুড়ে। অদ্ভুত সুন্দর ঘ্রাণ বের হচ্ছে। শেহনাজের কানে গুঁজে আছে বড় জবা ফুল। এমির চারপাশে জবা ফুল খুঁজল। গাছ পেলেও ফুল দেখতে পেল না। একটিই হয়তো ফুঁটেছিল। আগে থেকেই গুঁজে রেখেছে মেয়েটা। বাজঁখাই গলায় এমির বলে উঠল,

“সমস্যা কি তোমার? জ্বালাচ্ছো কেন আমায়? তোমার জন্য এই ভর দুপুর বেলায় আমাকে এখানে আসতে হলো। বুঝতে পারছো তোমার প্রতি কত ঘৃণা জন্মাচ্ছে আমার মনে”?

শেহনাজ ঢোক গিলে। হাসিখুশি মুখটা নিমিষেই অন্ধকার হয়ে আসে। সে ভেবেছিল এখানে এসে অন্তত এমির তার সাথে খারাপ ব্যবহার করবে না। কিন্তু তা হলো না দেখে শেহনাজ কষ্ট পেল খুব। তবুও হাসি বজায় রেখে বলল,

” ভালোবাসি বলেই তো এত জ্বালা”ই।

রাগে এমিরের ললাটের রগ ফুলে ফেপে ওঠে। নিজের রাগকে নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হয় সে। মেয়ে মানুষের এমন ন্যাকামি তার সহ্য হয় না,

-” গালে দুটো টেনে কষিয়ে চড় দিলে ভালোবাসা বেরিয়ে যাবে। ফাইজলামি করো আমার সাথে”?

-” দিন চড়। তবুও তো আপনার স্পর্শ পাবো এমির। ভালোবাসা না পাই, কঠিন স্পর্শই সই”। অশ্রুসজল চোখে বলে ওঠে শেহনাজ।

এমিরের মাথা গরম হয়। গত এক বছর ধরে একই কাহিনী দেখতে দেখতে তিক্ততা আসে তার মনোভাবে। কঠিন হতে বাধ্য হয় এমির। পাশে থাকা সাদা গোলাপ ফুলের টপটা হাতে নিয়ে সজোরে ফেলে দেয় ব্যালকনি থেকে। পাঁচ তলা থেকে পড়ে গিয়ে মাটির টপটি টুকরো টুকরো হয়ে ছড়িয়ে পড়ে রাস্তায়। ভয়ঙ্কর শব্দ ঝংকার তুলে। শেহনাজ হকচকিয়ে যায়। ভয়ে কেঁপে ওঠে সর্বাঙ্গ
পরিশেষে নির্বাক দৃষ্টিতে তাকায় এমিরের পানে। প্রিয় গাছটাকে এভাবে লুটিয়ে পড়ে থাকতে দেখে কঠিন হয় শেহনাজ। দ্রুত মাথা ঝুঁকিয়ে উপর থেকে নিচে তাকিয়ে ব্যথিত কণ্ঠে বলে,

-” ওটা আমার প্রিয় গাছ ছিল এমির ভাই। কি করলেন আপনি? কেন করলেন”?

” নারীর গায়ে হাত দেওয়ার মতো কাপুরুষ আমি নই শেহনাজ। তাই গাছের উপর শোধ নিলাম। এজন্য দায়ী শুধু আর শুধু মাত্র তুমি। আমার থেকে দূরে থাকো। নইলে তোমাকেও এভাবেই ফেলে দিবো একদিন। আমাকে ভয়ঙ্কর হতে বাধ্য করো না”।

শেহনাজ হেসে ফেলে। প্রাণ খোলা হাসি। হাসতে হাসতে লুটিয়ে পড়ে গ্রিলে। চকচকে দাঁত গুলি হাসির উদ্বেগ ছড়ায়। বলে,

-” আপনার থেকে যন্ত্রণা পাওয়াটাও ভাগ্যের এমির ভাই। এখন আর আমার সুখ ভালো লাগে না। দুঃখে ভেসে যাওয়া এখন আমার অভ্যেসে পরিণত হয়েছে”।

এমির বেরিয়ে আসে। শেহনাজের মতো বেহায়া মেয়ের সাথে তর্ক করাটা নিতান্তই বোকামো মনে হয় এমিরের নিকট। গম্ভীর ভঙ্গিতে সেখান থেকে
চলে আসতে নিলে শেহনাজের আকুতি মেশানো কন্ঠস্বর শুনতে পায়,

-” আপনার চোখে কেন আমার জন্য এত বিতৃষ্ণা, এত ঘৃণা দেখি? কথা দিচ্ছি, একদিন ওই চোখে আমার জন্য একরাশ ভালোবাসা আমি দেখবো। এক মুহুর্তের জন্য হলেও আপনি আমায় ভালোবাসবেন”।

____

কবিতা আর উপন্যাস লেখায় ব্যস্ত হাসান। সাদাত চ্যাটিং করছে প্রেমিকার সাথে। এমিরকে ফিরতে দেখে উঠে বসল সাদাত। এমিরের জন্য রাতের খাবারটা ঘরে এনে রেখেছে সে। আটটার আগেই বাকি সবাই সব টিউশনি শেষ করে বাড়ি ফিরে। এমির ফিরে আরো দেরি করে। তাই মাঝেই মাঝেই ঘরে খাবার এনে রাখতে হয় ওর জন্য।

এমির ফিরতেই নয়ন খাবারটা এমিরের কাছে এনে রাখল। খুব হতাশ কণ্ঠে বলল,

‘ আইজকার খাওন একটু ভালো হয় নাই। কি বিশ্রী কি বিশ্রী! আমি তেলাপিয়া মাছ খাই না। ওই তেলাপিয়াই রানছে”।

হাসল সাদাত বলল,
-” তোর জন্যে কি খালা আলাদা করে রাঁধবে ? এত উচ্চাকাঙ্খা কবে থেকে হলো তোর? কি করেই বা হয়?

এমির সবই খায়। বাছবিছার করে না কোনো সময়। মাছের টুকরো গিয়েই ভাত খেল সে। খাওয়া শেষে গামছায় হাত মুছতে মুছতে সে বলল,
-” একদিন আমার মায়ের হাতের রান্না খাওয়াবো তোদের। খুব ভালো রাঁধেন উনি”।

নয়ন প্রশ্ন করল,
-” কবে খাওয়াবি? তুই তো গ্রামে যাসই না”।

-” ভাবছি যাবো। গেলেই তোদের জন্য খাবার প্যাক করে নিয়ে আসবো”।

হাসান কলম রাখে। চেয়ার ঘুরিয়ে এমিরের দিকে তাকায়। বলে,

-” শেহনাজ আমাকে ফোন করেছিল।

এমিরের অভিব্যক্তি বদলে গেল ঠিক তখনই। শেহনাজের নামটা শুনলেই ছেলেটা বদলে যায়। রেগে উঠে। বাজঁখাই গলায় কথা বলে। এত মিষ্টি মেয়েটাকে যেন সহ্যই করতে পারে না এমির। কেন পারে না? প্রশ্নটার উত্তর অযৌক্তিক। বিরক্তিসূচক কণ্ঠে এমির জিজ্ঞেস করে,
-” তোকে কল করেছে? নম্বর পেল কোথায়?

মাথা নিচু করে হাসান। বলে,
-” আমিই দিয়েছিলাম।
-” কি বলেছে?
-” জিজ্ঞেস করল তুই ফিরেছিস কিনা? মেসে আজকে কি রান্না হয়েছে? তুই খেয়েছিস কি না? এসবই”।

-” ওর জন্য দুটো সিম বদলে তিন নম্বর সিম ব্যবহার করছি। এখন তোদের ও কল করছে। ওর বাঁদরামি একদম ছুটাবো আমি। মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছে দিনদিন। কি পেয়েছে কি হ্যাঁ”?

নয়ন বলে উঠল,
-” শেহনাজের লগে একটু স্বাভাবিক আচরণ করতে পারস না”?

-“অস্বাভাবিক কি করেছি? ভ্রূ কুঁচকে বলে এমির।

সাদাত হাসিমুখে বলে,
-“মেয়েটা তো দেখতে মাশাআল্লাহ্, ব্যবহার আন্তরিক। চলাফেরা ভালো। তোকে মন প্রাণ উজার করে ভালোবাসে। আজকালকার মেয়েদের মতো জটিল না। আর তুই কিনা ওকে পাত্তা দিস না”?

ঠুনকো, মলিনভাবে হাসে এমির। বলে,
-” বাচ্চা মেয়ে। আবেগে ভেসে বেড়াচ্ছে। শেহনাজ বুঝছে না অট্টালিকা ছেড়ে কুঁড়েঘরে এসে কেউ কখনো সুখী হয় না। আমি চাই না ও ওর সিদ্ধান্ত নিয়ে আফসোস করুক। দেখিস বয়সের সাথে সাথে এসব আবেগ কেটে যাবে”।

চলবে?