#শেহনাজ
পর্ব সংখ্যা ( ৩ )
লেখনীতেঃ #বৃষ্টি_শেখ
মেসের পাশ দিয়েই একটি রাস্তা গিয়েছে। শাই শাই শব্দ আছে সেখান থেকে। মশার উপদ্রব খানিক বেড়েছে। গরম বাড়ার সাথে সাথে মশার দলবল সব হাজির যেন। কয়েলেও কাজ হয় না এখন। গ্রীষ্মের দাবদাহ সরে শীতলতা আসার অপেক্ষায় উদগ্রীব সকলে।
ক্যারাম খেলতে গিয়ে এমির খেয়াল করে সাদাত বেশ উদাসীন। উদ্বিগ্নতা সারা মুখে। খেলায় আজকে মন নেই সাদাতের। হেলদোল নেই যেন। কথাও বলছে কম। এমিরকে বিষয়টা ভাবায়। বন্ধুর এহেন রুপ ভালো লাগে না তার। বড় গোলাকার গুটিটাকে টোকা দিয়ে কন্ঠ খাদে নামিয়ে নয়নকে জিজ্ঞেস করে,
” সাদাতের কি হয়েছে? খেলায় একদম মন নেই দেখছি”।
নয়ন বোকা হাসে। অগোচরে বলে,
” ওর আজকে ব্রেকআপ হইছে। এই জন্যে মন মরা। দ্যাখ মুখটা কেমন প্যাঁচার মতো কইরা রাখছে”।
এমির ফিসফিসিয়ে বলে,
-” রিজন?
-” ওয় আজকে কোন বান্ধবীর বাড়ি গেছিল। হ্যার লাইগা”।
নয়ন হো হো করে হাসে। চমকে উঠে সাদাত। হাসি পায় এমিরের ও। মুচকি হাসে সে। সাদাতের পাশে এসে বসে। সাদাত তখনও বেখেয়ালে ডুবে আছে। এমির কাঁধে হাত রেখে বলে,
-” রিলেশনশীপে থাকলে মাসে হাজারবার এমন ব্রেকআপ হবে। আবার প্যাচআপও হবে। এজন্যে মন খারাপ করে থাকবি বলদ? কতক্ষণ রাগ করে থাকবে? একটু পরেই তোকে ফোন দিবে দেখিস”।
বিমর্ষ হয়ে সাদাত সন্দিহান কণ্ঠে বলে,
-” যদি না দেয়”?
-“তাহলে আমি নিজে ওর সাথে দেখা করে কথা বলবো এ বিষয়ে”।
এবারে যেন সাদাত প্রাণ ফিরে পেল। এমির ছেলেটা দারুণ। যে কেউ এমিরের কথাবার্তায় গলে যেতে পারে। সাদাতের মনে হয় এমিরের মতো মানুষ যদি একবার তাদের সম্পর্কটা নিয়ে ভাবে তবে যেকোনো সমস্যাই সমাধান হওয়া সম্ভব। তাই আগের মতো খেলায় মনোযোগ দিল সাদাত। খেলা শেষে সকলে খাওয়াদাওয়া করার জন্য রান্নাঘরে গেল। আজ মেসের খালা রান্না করেছেন আলু ভাজি আর ডিম ভাঁজা। আলু ভাজিটা মাঝে মাঝে একটু পুড়ে যায়। ডিম ভাজায় কখনো কখনো ডিমের সাদা খোঁসাটা পাওয়া যায়। এছাড়া রান্নায় আর সমস্যা নেই। তবে মেসের খাবার সবাই যতটা ভালো ভাবে ততটা ভালো লাগে না কারো। নিয়মে চলা বুঝি কারোই পছন্দ না। রাত দশটার আগে মেসে ফিরো, আটটায় খেতে বসো, দশটার পর কোথাও বের হওয়া নিষেধ। বেশি আওয়াজ করা যাবে না, জোরে গান গাওয়া যাবে না, পানি কম খরচ করতে হবে। আরো কত কি! সব মিলিয়ে মনে হয় এটা এক জেলখানা। স্বাদহীন খাবার খেয়ে জিহ্বা কেমন তেতো হয়ে গেছে সবার।
এমির শুতে এলো বিছানায়। মাঝারি আকারের চারটে খাট এখানে। এমিরের পাশে শুয়েছে হাসান। মাঝখানে জায়গা নেই। বাইরে থেকে আওয়াজ আসছে। এমিরের ঘুম আসে না। জানালা খুলে একটি চেয়ার টেনে আপন মনে বসে থাকে সে। জানালা ভেদ করে প্রচণ্ড বাতাস আসে ঘরে। তন্দ্রা লেগে যাওয়ার আগমুহুর্তে এমিরের মুঠোফোন বেজে ওঠে। সচরাচর এই নম্বর থেকে কল আসে না। এমির নিজেই উক্ত নম্বরটিতে কল দেয়। এত রাতে তো কখনোই কল আসার কথা না।
এমির চিন্তিত ভঙ্গিতে মুঠোফোন কানে তুলে। বলে,
” হ্যালো’।
ওপাশ থেকে মোলায়েম নারী কণ্ঠ ভেসে আসে।
-” কেমন আছো এমির”।
-” আলহামদুলিল্লাহ্, ভালো আছি। আপনি কেমন আছেন”?
-” চলে যাচ্ছে। তোমার পড়াশোনার কি খবর”?
-” সবকিছু ঠিকঠাক চলছে। পরিক্ষা শেষ হলেই গ্রামে যাবো একবার। টাকা-পয়সা আছে তো কাছে? পাঠাবো?
ওপ্রান্তে থাকা মহিলা সংকোচ বোধ করল কথা বলতে। যে কারণে ফোন করা সে কথা বলার মতো সাহস কিংবা পরিস্থিতি তার নেই। এমির এখনও ছাত্র। নিজের থাকা-পরার খরচ সামলাতেই ছেলেটা হিমশিম খায়। এ বয়সী ছেলেদের হাত খরচ ও লাগে। কোন মুখে টাকা চাইবে বুঝতে পারে না ভদ্রমহিলা। পাশ থেকে ফোনখানা ছো মেরে নিয়ে যায় একটি মেয়ে। কানে তুলে বলে,
“- ভাইয়া।
এমিরের কণ্ঠনালী শুকিয়ে আসে। মহুয়া তার আপন ছোটবোন। এক সাথে অনেকটা সময় কাটিয়েছে তারা। মহুয়ার সাথে গায়ে গা মিলিয়ে শুয়েছে কতবার। যখন এমির এখানে চলে এলো, তখন মহুয়ার কতই বা বয়স? তবুও এখন বোনটার সাথে কথা বলতে অসস্তি বোধ হয় এমিরের। মনে হয় মনের দুরত্ব যেন যোজন যোজন। চোখ তুলে মেয়েটার দিকে তাকাতেও কেমন দ্বিধাবোধ করে। মনে হয় ও বাড়ির সকলের সাথে সে অন্যায় করছে। সবাইকে ছেড়ে এসে সে স্বার্থপরের মতো কাজ করেছে।
সময় নিয়ে এমির সাড়া দেয়।
-” বল।
-” কেমন আছো ভাইয়া?
“- ভালো আছি। তুমি”?
“তুমি” শব্দটা বলতে গিয়ে হোঁচট খেল এমির। মহুয়ার বয়স কত হবে এখন? নয় কি দশ। এই বয়সি মেয়েদেরকে বড় ভাইয়েরা তুই বলে সম্বোধন করে। নইলে কেমন পর পর দেখায়। কিন্তু সময়ের ব্যবধানে দুরত্ব এত বেড়েছে যে “তুই” শব্দটা আটকে আসছে। মুখ থেকে বের হতেই চাইছে না।
-” ভালো আছি”।
মহুয়া ফের প্রশ্ন করে,
-” গ্রামে আসবে কবে”?
-” পরিক্ষা শেষ হলেই ফিরবো। তোমার কিছু লাগবে? গেলে নিয়ে যাবো”।
থামে মহুয়া। ভাইয়ের সাথে তার অত গলায় গলায় ভাব নেই। সামনে এলে জড়িয়ে ধরার মুরোদ নেই। সেই ছয় বছর আগে ঢাকায় চলে গেছে ভাইটা। তখন এমির ও ছোট ছিল। এখন বড় হয়েছে। কথা বলতে হয় ভেবেচিন্তে। কখন রাগ করে বসে। মাঝে দু একবার এমির এসে থেকেছে তাদের সাথে। তবে সখ্যতা বাড়েনি তেমন।
-” আমার কিছু লাগবে না ভাইয়া। কিন্তু মা খুব অসুস্থ। ওষুধপাতি কেনার টাকা নেই”।
মুচরে উঠে এমিরের হৃদয়। ব্যতিব্যস্ত হয়ে বলে,
-” কি হয়েছে?
-” শ্বাসকষ্ট বেড়েছে। দম নিতে পারে না। একটু কাজ করলেই হাঁপিয়ে যায়, পেটের ডান দিকে ব্যথা করে, রাতে ঘুমোতে পারে না।
-” কবে থেকে এমন হচ্ছে?
-” কয়েকমাস আগে থেকেই। উনি তোমাকে বলতে নিষেধ করেছিলেন। তাই বলতে পারিনি।
-” আমি কাল টাকা পাঠাবো। তোমার মামাকে বলবে উনাকে যেন ডক্টর দেখায়। আর উনাকে বলো টাকাপয়সা নিয়ে ভাবতে হবে না”।
-” ঠিক আছে।
ফোন কেটে যায়। এমির চোখ বন্ধ করে ভারী শ্বাস ফেলে। মস্তিষ্ক অসাড় হয়ে আসে। মহুয়া বা ওই মহিলা কখনোই এমিরের কাছে কিছু চায় না। খুব জোর করলে নেহাত ছোটখাটো জিনিস চেয়ে ফেলে। এমন কিছু চায় যা যে কারো সাধ্যেই কুলোয়। এখন কেবল মাসের শুরু। পনেরো তারিখের আগে টিউশনির বেতন পাওয়া সম্ভব না। টাকাটা কিভাবে ম্যানেজ করবে ভেবে পায় না এমির। বন্ধুদের কাছে চাইবে? নিজেকে প্রশ্ন করে। তৎক্ষণাৎ মাথায় আসে ওদের কারো কাছেই বর্তমানে টাকা থাকার কথা নয়। ওদের অবস্থা এমিরেরই মতো। ওরাও এক আকাশ সমান স্বপ্ন নিয়ে গ্রাম ছেড়ে শহরে এসেছে চাষাভূষা উপাধি ফেলে। তাহলে কি করবে? রাতটা কেটে গেলেই টাকা পাঠাবে বলে দিয়েছে। পকেটে কেবল খুচরো টাকা। হাজার তিনেক টাকা এ মুহুর্তে না পাঠালেই নয়। ভাবতে ভাবতে মাথা ধরে এমিরের। রাতে আর ঘুম আসে না তার। “মানুষটা অসুস্থ” কথাটা মস্তিষ্কে প্রহার করে। নিদ্রাহীন রাত কেটে যায়।
____
কলেজের মাঠটা বিশাল বড়। এর উত্তর পাশে বড় আর মোটা একটা আম গাছ আছে। প্রত্যেক বছর ভালো আম ধরে গাছটাতে। ছায়াও দেয় মনমতো। বলা যায় গাছটি ভিষণ উপকারী।
এমির গাছটার নিচে ক্লান্ত হয়ে বসল। দীর্ঘক্ষণ ক্লাস করার পর এখানে এসেই তার শান্তি মিলে। শেহনাজের ক্লাস শেষ হয় বারোটা দশে। এখন বাজে সাড়ে এগারোটা। এতক্ষণ অপেক্ষা করতে ইচ্ছে হয় না এমিরের। ব্রেক টাইমে নিজে কলেজের ভবনে ঢুকে। শেহনাজ বন্ধুদের সাথে আড্ডায় তখন। কাগজ দিয়ে কি সব খেলছে। এমিরকে দেখে শেহনাজের এক বন্ধু চিমটি কাটল। ঘাড় ঘুরিয়ে এমিরকে দেখে শেহনাজের হাসি দীর্ঘ হলো। সারা মুখে ছড়িয়ে পড়ল খুশি। সে এগিয়ে আসার পূর্বেই এমির বলল,
” একটু বাইরে এসো তো শেহনাজ”।
কথাটুকু বলে এমির চলে গেল তড়তড়িয়ে। যেন বাধ্য হয়ে ডেকছে শেহনাজকে। খুশিতে লাফিয়ে উঠল শেহনাজ। তানিয়াকে গিয়ে জড়িয়ে ধরল। বলল,
-” উনি নিজে এসে আমাকে ডাকল। ভাবতে পারছিস তানু”?
হাসে তানিয়া। শেহনাজের ফোলা গাল দুটো টেনে বলে,
” দেরি না করে দেখা করে আয় যা। উনার মুড মনে হয় ভালো”।
শেহনাজ দেরি করে না। হাত দিয়ে চুলগুলোকে ঠিক করে সে। কলেজ ইউনিফর্মের সাথে উঁচু করে ঝুঁটি বাঁধে শেহনাজ। কিশোরীদের ন্যায় সামনে কয়েকটা চুল কেটে রাখা। ভ্রূর উপর চুলগুলো পড়ে থাকে। কপাল বোঝা যায় না, চুল দ্বারা ঢেকে থাকে। আম গাছটার নিচে এসে দাঁড়ায় শেহনাজ। এমির ততক্ষণে গাছের নিচে থাকা বেঞ্চটায় আরাম করে বসেছে। শেহনাজকে দেখে খাপছাড়া কণ্ঠে ছেলেটা বলল,
-” আমি তোমাকে পড়াবো”।
হতবাক হয়ে তাকায় শেহনাজ। পলক ফেলে বারবার। নিরুত্তর হয়ে তাকিয়ে থাকে এমিরের পানে। খুশিতে কাঁদতে ইচ্ছে করে তার। বলে,
-” সত্যিই পড়াবেন?
ভ্রূ দ্বয় কুঁচকে ফেলে এমির। কঠিন চাহনি নিক্ষেপ করে। গম্ভীরতা বজায় রেখে ঝাঁঝাল কণ্ঠে বলে,
-” কানে শুনতে পাও না নাকি”?
” শুনেছি বলেই বিশ্বাস হচ্ছে না”। তৎক্ষণাৎ উত্তর দেয় শেহনাজ।
” আজ সন্ধ্যে থেকেই পড়াবো। বাট আই হ্যাভ আ কন্ডিশন”।
-” হ্যাঁ বলুন না?
-” দু মাসের বেতন অগ্রিম দিতে হবে। তবেই পড়াবো”।
সস্তির নিঃশ্বাস ফেলে শেহনাজ। বুক থেকে বোঝা নেমে যায় তার। হাস্যজ্জ্বল কণ্ঠে বলে,
“সমস্যা নেই। আমি আব্বুকে এক্ষুণি জানাচ্ছি”।
” এবার আসতে পারো। ফের কঠোরতা বজায় রেখে এমির বলে”।
শেহনাজ ভেংচি কাটে। চলে আসে সেখান থেকে। মনে অসংখ্য প্রজাপতি উড়ে বেড়ায়। নতুনভাবে প্রেমে পড়ে মানুষটার। অনুভূতি আর উত্তেজনা মিশিয়ে শেহনাজ দিক্বিদিক হারিয়ে ফেলে। এত খুশি তো তার আগে লাগেনি। তার মনে হচ্ছে এমির তাকে টিউশনি পড়াতে রাজি হয়নি, বিয়ের প্রস্তাবে রাজি হয়েছে।
অপর দিকে এমিরের মন শান্ত হয় খানিক। শেহনাজকে সে ভালোমতোই চিনে। মেয়েটা নিশ্চয় দশ মিনিটের মাথায় তার একাউন্টে টাকা পাঠাবে। কারণ শেহনাজের মনে এমিরের মতামত বদলে ফেলার ভয় আছে। মত বদলে ফেলার আগেই শেহনাজ টিউশনির বিষয়টা পাকাপাকি করতে চাইবে।
এমির মুঠোফোন তুলে কল করে মহুয়াকে। ওদের বাড়িতে একটি মাত্র বাটন ফোন আছে। ওটা ছাড়া যোগাযোগ বোধহয় এত সহজ হতো না। ফোন তুললে এমির বলে ” ছয় হাজার টাকা পাঠিয়েছি। উনাকে ভালো ডাক্তার দেখাবে। আর বাকি টাকা দিয়ে ফলমূল, দুধ আর ডিম কিনে খাওয়াবে”।
_____
টংয়ের দোকানে নিরলস ভঙ্গিতে বসে আছে হাসান। মুখে হাসি নেই। খামখেয়ালি ভাব লেগে আছে। কাঁধে কলেজের ব্যাগ। পকেটে টাকা আছে। তবে গাড়ি ভাড়া করে মেসে ফেরার জন্য এই টাকা বরাদ্দ। খিদেয় পেট গুরুম গুরুম করছে হাসানের। এক চাপ চা আর বিস্কিট খেলে বোধহয় ভালো লাগতো। দোকানদার তাকে বাকি দিবে না। কেন দিবে? সে তো এই এলাকার না। কেউ তাকে চিনেও না। একটা কাজে এসেছিল এখানে।
ব্যাগটা কোলে নিয়ে টাকার পরিমাণ দেখল হাসান। চা খাবার জন্য যদি পাঁচ টাকা পাওয়া যায় ব্যাগের কোণায়। কিন্তু হায়! গাড়ি ভাড়া ছাড়া আর কোনো টাকা নেই তার কাছে। গ্রামে বসবাস করা মায়ের কাছে টাকা চাওয়া যেতে পারে। কিন্তু অত বড় ছেলে যদি শহরে এসে কাজটাজ করার পর ও মায়ের কাছে টাকা চায় তবে বেশ অপমানজনক পরিস্থিতি হবে। তার কাছে যে টাকা ছিল না এমনটা নয়। তার বাবা-মায়ের ও অত খারাপ অবস্থা না। তবুও দ্বিধা কাজ করে। প্রায় অনেক টাকাই ছিল হাসানের কাছে। সেই টাকা দিয়ে দু-চার মাস আরামসে বসে বসে কাটিয়ে দিতে পারতো। বাবা-মা কেও পাঠাতে পারতো কিছু টাকা। কিন্তু নিজের বোকামিতে আজ টাকাগুলো সে হারিয়েছে। হারানোর পর এখন ব্যথিত হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
বসা থেকে উঠতে উদ্যত হতেই হাসানের পাশে একটি মেয়ে এসে বসল। ধপ করে পাশে বসে পরায় হকচকিয়ে উঠল হাসান। চশমা ঠিক করে তাকাল মেয়েটার পানে। পরণে কালো কামিজ। হাতে ছোট্ট ব্যাগ। চুলগুলো খোঁপা করে মাথায় কাপড় দেওয়া। চায়ের অর্ডার দিয়ে মেয়েটি হাসানের দিকে চাইল। বলল,
-” চা বা রুটি খাবেন? আপনাকে ক্ষুধার্ত মনে হচ্ছে”।
হাসান মাথা নাড়ে। বলে,
-“ধন্যবাদ। খাবো না”।
হাসে মেয়েটি। বলে,
-” আরে খেয়েই দেখুন। এই দোকানের চা টা খুব ভালো হয়। আজ আমার মনটা ভালো। তাই আপনাকে চা খাওয়াতে চাইছি”।
” ঠিক আছে। এক কাপ দিবেন”।
-” নাম কি আপনার? প্রশ্ন করল হাসান।
-” ঊর্মি। ঊর্মি মানে জানেন তো? ঢেউ। আপনার নাম কি?
-” হাসান রহমান।
হাসান নামের অর্থ কি বলুন তো?
-“জানি না।
-” আমিও জানি না।
বলেই খিলখিল করে হেসে উঠল ঊর্মি। ঊর্মির হাসিটা দারুণ। গালে টোল পরে। আরো কিছু টুকটাক কথা হলো ওদের মাঝে। ঊর্মি পাশের এলাকায় থাকে। বাবা প্রবাসী। মা মারা গেছেন দীর্ঘদিন হয়েছে। আপন খালার কাছে মানুষ হয়েছে ঊর্মি।
এক চাপ চা প্রায় আধঘন্টা সময় নিয়ে পান করল ওরা। বিদায় বেলায় হাসান বলল,
-” সময়টা দারুণ কাটল। আশা করি আবার দেখা হবে”।
-” কিভাবে বুঝলেন দেখা হবে? ঠোঁট বাঁকিয়ে হেসে প্রশ্ন করে ঊর্মি।
মুচকি অথচ গাঢ় ভাবে হাসল হাসান। এমনভাবে সে কখনোই হাসতো না। আজ কেন হাসলো কে জানে? বলল,
-“মনে হলো।
_____
সন্ধ্যের দিকে শেহনাজের আলিশান বাড়ির দরজায় পা রাখল এমির। সন্ধ্যে সাড়ে ছ’টা বাজে তখন। বাইরে এখনো পর্যাপ্ত আলো রয়েছে। গরমে হাঁসফাঁস করছে এমির। ক্লান্ত ভঙ্গিতে কলিং বেল বাজানোর সাথে সাথেই শেহনাজ দরজা খুলল। মেয়েটা বোধহয় এমিরের জন্যই অপেক্ষা করছিল। বিষয়টা বুঝতে বেগ পেতে হয়নি এমিরের। যথাযথ ভাবে মুখটা গম্ভীর রেখে বাড়িতে ঢুকল এমির। শেহনাজের দিকে ঠিকভাবে তাকাল না। শেহনাজের পা অনুসরণ করে নির্দিষ্ট একটি ঘরে প্রবেশ করল এমির। এমির বুঝতে পারল এটা শেহনাজের সেই ঘরটা নয় যে ঘরে সে আগে এসেছিল। ঘরটা রঙিন কাগজ দিয়ে বিভিন্ন ধরনের ফুল, গাছ, পাখি বানিয়ে সুন্দর ভাবে ডেকোরেশন করেছে শেহনাজ। খাটে রয়েছে কয়েকটা টেডি বিয়ার। খাটের পাশে প্লাস্টিকের আর মাটির ফুলের টব। এসির শীতল বাতাসে ঠান্ডা হয়ে আছে ঘরটা। ঘরে রয়েছে একটা সোফা, ড্রেসিং টেবিল, একটা বিশাল খাট আর চেয়ার টেবিল। এমির চেয়ারে গিয়ে বসল। বাড়িতে শেহনাজ আর কাজের লোক ছাড়া কেউ নেই। সাইফুল আলম এবং তার স্ত্রী একটা পার্টিতে গেছেন। শেহনাজকে তারা নিতে চেয়েছিলেন। শেহনাজ যায়নি। পড়বে বলে থেকে গেছে বাড়িতে।
শেহনাজ বই নিয়ে এমিরের মুখোমুখি বসল। এমিরের পরনে জলপাই রঙের শার্ট। একটু আধটু কুঁচকে আছে শার্টটা। আয়রণ করা হয়নি বোধহয়। বাহুদ্বয় ফুলেফেপে আছে। চুলগুলো পিছনে ঠেলে দেওয়া। এত সুন্দর ছেলেও হয়? এমিরকে না দেখলে বুঝতেই পারতো না। এমিরের প্রশস্ত, চওড়া বুকটা শেহনাজকে ভিষণ ভাবে টানে। আনন্দিত কণ্ঠে শেহনাজ বলল,
“এই ঘরটা কেমন লাগছে স্যার”? এটা আমার স্টাডি হাউস”।
এমির ভ্রূ দ্বয় কুঁচকে ফেলে। ভাবলেশহীন হয়ে বইয়ের পাতা উল্টে বলে,
-” হুহ্! ভালো”।
-” কেমন ভালো? একটু না বেশি”?
এমির পাত্তা দিল না শেহনাজের কথায়। বইয়ে একটি অঙ্ক বের করে লাল কলম দিয়ে দাগ দিল। বইটা শেহনাজের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,
-” এই ম্যাথটা করো। না পারলে আমি আছি”।
শেহনাজের কথাটা ভালো লাগল না। চুপচাপ বইয়ের দিকে তাকাল সে। একটু পরই দুষ্টুমি মাখা কণ্ঠে ফের প্রশ্ন করল,
-” আপনার কোন রঙ পছন্দ স্যার?
বিরক্ত হলো এমির। এত আজাইরা কথা বলে কেন মেয়েটা? সমস্যা কি? তেজ দেখিয়ে এমির বলল,
-” এত প্রশ্ন করো কেন শেহনাজ? অঙ্ক টা করো”।
পা দুলিয়ে শেহনাজ বলে,
-” বলুন না। কোন রঙ পছন্দ”?
-” সব রঙই আমার ভালো লাগে”।
-“কিন্তু আমি তো শুনেছি স্কাই ব্লু রঙটা আপনার খুব পছন্দের।”
-“জানো যখন প্রশ্ন করছো কেন? পড়ায় মন দাও। পিটিয়ে একদম সোজা বানিয়ে দিবো। খালি ফাইজলামি”।
দাঁত কিড়মিড় করে কথা বলায় আর শেষের কথাটা শুনে ভয় পায় শেহনাজ। পড়ায় মন দেয়। এক ঘন্টা বেশ ভালো ভাবেই অঙ্ক বুঝতে থাকে সে। বাড়ির পরিচারিকা নাস্তা নিয়ে আসে এমিরের জন্য। এমির খাওয়ার পাশাপাশি সব পড়া বুঝিয়ে দেয়। দেড় ঘন্টার মাথায় এমির উঠে দাঁড়ায়। যাবার সময় হয়েছে তার। ভদ্রতাসূচক উঠে দাঁড়ায় শেহনাজও। বই বন্ধ করে এমিরকে এগিয়ে দিতে পিছু পিছু আসে। জানালার দিকে চোখ পরায় শেহনাজ পিছন থেকে ডাকে। বলে,
-” এখন তো আপনি যেতে পারবেন না স্যার। বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে। যেনতেন বৃষ্টি নয়। মুষলধারে বৃষ্টি। শিলাও পড়ছে বোধহয়”।
এমির ড্রয়িংরুমের জানালা দিয়ে বাইরে তাকায়। আসলেই বৃষ্টি পড়ছে। অবাক হলো এমির। কখন বৃষ্টি এলো? দেখে মনে হচ্ছে অনেকক্ষণ ধরেই বৃষ্টি পড়ছে। রাস্তায় হাঁটু অবধি পানি জমেছে। কই, সে তো টের পেল না। পরমুহূর্তে মনে পড়ল এটা তার বাড়ি কিংবা মেস নয়। শেহনাজের বাড়ি এটা। বাইরের আওয়াজ এ বাড়িতে প্রবেশ করে না। উপরে ছাদ বলে বৃষ্টির শব্দও শোনা যায় না। বাইরে কি হচ্ছে তা ঘরে বসে জানা খুব কঠিন কাজ।
এমির প্যান্টের নিচ ভাগের অংশ গুটিয়ে নিল উপরে। যেতে উদ্যত হলেও বৃষ্টির তাণ্ডব দেখে যেতে পারল না। বিরক্তিতে গা রি রি করে উঠল এমিরের। বৃষ্টিটা এখনই আসতে হলো?বাড়ি যাবে কি করে?
-” তোমাদের একটা ছাতা দাও। আমি আগামীকাল দিয়ে দিবো”।
শেহনাজ ঠোঁট বাঁকায়। হাসিমুখে দুষ্টুমির স্বরে বলে,
-” আমাদের ঘরে তো ছাতা নেই স্যার”।
-” এত বড়লোক হয়ে কি লাভ? যদি একটা ছাতাই না থাকে। কণ্ঠে ঝাঁঝ মিশিয়ে বলে এমির”।
হাসে শেহনাজ। মনে মনে খুব খুশি হয়। অসংখ্য ধন্যবাদ জানায় বিধাতাকে। মুখে বলে,
-” বৃষ্টি এলে আমরা কোথাও বের হই না। গাড়ি তো আছেই। ছাতা লাগে না”।
তাচ্ছিল্যের হাসি হাসে এমির। সেই তো। বড়লোকদের নিয়মকানুন-ই আলাদা। শেহনাজ এমিরকে নিজ ঘরে নিয়ে এসে বসায়। বলে,
-” চা খাবেন”?
বেলকনির দিকে তাকিয়ে থাকে এমির। বলে,
-” না। খাবো না”।
-“আমি খুব ভালো চা বানাই। আপনি বসুন। আমি এক্ষুণি আনছি”।
শেহনাজ ছুটে বেরিয়ে যায়। মেয়েটাকে নিতান্তই বাচ্চাদের মতো দেখায়। কাজকর্মও কিছুটা বাচ্চাদের মতোই। ধনী হলেও বিন্দুমাত্র অহংকার নেই, গৌরব নেই। কত সহজ ভাবে মিশে থাকে সবার সাথে। বাচ্চা না হলে কি আর এমিরের মতো ছেলের প্রেমে পড়ে? আলিশান প্রাসাদ ছেড়ে বেকার এক ছেলের হাত ধরতে চায়? অবুঝের মতো পিছু পিছু ঘুড়ে?
রান্নাঘর থেকে এক মহিলার কণ্ঠ শোনা যায়। বাড়ির কোনো পরিচারিকা হবে। তিনি জোর কণ্ঠে শেহনাজকে বলছেন,
-” আপামনি আপনে আইছেন ক্যান রান্নাঘরে? আমারে কন কি লাগবো। আমি দিতাছি। সাহেব জানলে আমারে আস্ত রাখবো না।
শেহনাজের মিষ্টি কণ্ঠ শোনা যাচ্ছে। সে বলছে,
-” চিন্তা করবেন না খালা। আমি নিজে থেকে কাজ করতে এসেছি। আব্বু আম্মু কিচ্ছু জানবে না”।
-” আমারে তো বেতন দেয় এর লাইগা। আপনে কষ্ট করবেন ক্যান”?
-” আপনি ঘরে যান। আমি আমার টিচারকে চা দিয়ে আসি।
দু মিনিটের মাথায় শেহনাজ দু কাপ চা নিয়ে আসে। দুটোই রঙ চা। একটি নিজের জন্য। অপরটি এমিরের জন্য। গরম ধোঁয়া উড়ছে চা থেকে। খুব গরম কাপটা সন্তপর্ণে এমিরের দিকে এগিয়ে দিল শেহনাজ। বলল,
‘ কড়া করে করেছি। চিনি দিয়েছি এক চামচ। লবঙ্গ, আদা দিয়েছি। আপনার পছন্দ যে”।
এমির নির্বাক থাকে। ঠোঁটে চায়ের কাপ ছোঁয়ায়। এই ছোট্ট কাজটাও শেহনাজ মনোযোগ দিয়ে দেখে। শৈল্পিক লাগে। এমির এবার খেয়াল করে শেহনাজকে। শেহনাজ আকাশি রঙের জর্জেট থ্রিপিস পড়েছে। এমিরের পছন্দ এজন্য । উন্মুক্ত চুলগুলো ছড়িয়ে আছে কোমড়ে। চোখে চিকন আইলাইনার দিয়েছে। ঠোঁটটা কেমন লালচে লাগছে। এমিরকে এভাবে তাকাতে দেখে অসস্তিতে পড়ে শেহনাজ। লজ্জা লাগে খুব। বিভ্রান্ত হয়ে এমির বলে,
-” তোমার আব্বু আম্মু কখন ফিরবে”?
-” জানি না। আজ নাও ফিরতে পারে”।
এরপর দুজনেই চুপ থাকে। শেহনাজ বেলকনির গ্রিলে এসে হাত রাখে। বলে,
-” বৃষ্টি আপনার ভালো লাগে”?
-” না। উত্তর দেয় এমির।
-” কেন? কেন ভালো লাগে না? আমার তো খুব ভালো লাগে”।
হাসে এমির। বলে,
-” তোমরা এখান থেকে ওখানে যাও চার চাকার গাড়ি চড়ে। বৃষ্টি হওয়ার অসুবিধা কি করে বুঝবে? মেসে ফেরার পথে কি দেখবো জানো? মেসের রাস্তায় হাঁটু সমান পানি জমেছে। কাঁদায় পা রাখা যাচ্ছে না। কুকুর গুলো বৃষ্টিতে ভিজছে। ঘরের জানালা বোধহয় খোলা রয়েছে। তোষক ভিজে নিশ্চয় একাকার অবস্থা”।
শেহনাজ বুঝতে পারে বিষয়টা। বলে,
-” এটা তো ভাবিনি।
বৃষ্টি কিছুটা থামে। ঝিরঝির করে ঝরে পানির কণা। বাতাস ও মৃদ্যু। বিদায় নেয় এমির। ছোট ছোট পানির কণাকে অগ্রাহ্য করে এগিয়ে যায়। শেহনাজ বেলকনিতে দাঁড়িয়ে যতক্ষণ দেখা যায় ততক্ষণ এমিরকে দেখে যায়। ছেলেটা হেঁটে যাচ্ছে। ভাড়া নেই বোধহয়। হেঁটে যেতে প্রায় চল্লিশ মিনিট লাগবে। এতক্ষণ মানুষটাকে হাঁটতে হবে? ভেবে কিছুটা কষ্ট পেল শেহনাজ।
চলবে?