#শেহনাজ ____{ ৫ }
লেখনীতেঃ #বৃষ্টি_শেখ
বাস চলছে আপন গতিতে। রাস্তায় জ্যাম নেই তেমন। ইতিমধ্যে বক্সে গান বাজতে শুরু করেছে। সকালের নাস্তা দেওয়া হয়েছে। নাস্তা করার পর থেকেই শেহনাজের শরীরটা খারাপ লাগছে। তার বাসে ওঠা তেমন হয় না। বাবার নিজস্ব গাড়িতেই চলাফেরা করে সে। হুট করে বাসে কিছুটা পথ আসতেই তার গা গুলাচ্ছে। বিষয়টা খুবই লজ্জাজনক। সবাই সুন্দর হাসছে, নাচছে, আনন্দ করছে। অথচ তার গা গুলিয়ে উঠছে, অস্বস্তি ঠেকছে।
এমির বাসের ড্রাইভারের পাশেই বসেছে। ফর্মাল ড্রেস আপে এমিরকে আজ অন্যরকম লাগছে। ব্রাউন শেডের শার্টটা কিছুটা পাতলা। এমিরের ফোলা বাহুদ্বয় ভিষণ আকর্ষণীয় লাগছে। এমিরের সাথে বসেছে দুজন শিক্ষক আর সাদাত ভাই। সবার নজর বাইরে। শেহনাজ আর নিজেকে স্থির রাখতে পারল না। এক্ষুণি একটা দুর্ঘটনা ঘটিয়ে ফেলবে সে। বক্সের আওয়াজের মধ্যেই উচ্চস্বরে ডেকে উঠল এমিরকে। এমির শুনেও কোনো উত্তর দিল না। শেহনাজ তখন উচ্চস্বরেই বলে উঠল,
-” বাসটা একটু থামাতে বলুন প্লিজ। আমার বমি পাচ্ছে”।
এমির শুনল। বাকিরাও শেহনাজের অবস্থা বুঝতে পারল। ততক্ষণাৎ ড্রাইভারকে বাস থামাতে বলল এমির। এমিরের সাথে আরো দুজন শিক্ষক শেহনাজের কাছে এগিয়ে এলো। শেহনাজকে তারা ভালোমতোই চেনে, জানে। কলেজের বিভিন্ন কার্যে শেহনাজের বাবার গুরুত্বপূর্ণ অবদান তারা মনে রাখে। চিন্তিত ভঙিতে শিক্ষক আজিজ মোর্শেদ জিজ্ঞেস করলেন,
-” বেশি খারাপ লাগছে শেহনাজ”?
শেহনাজ ঢেকুর তোলে। হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ে। শেহনাজের মুখটা কেমন শুষ্ক। বাস থামে। এমির শেহনাজকে একটি পানির বোতল এগিয়ে দেয়। শেহনাজ দ্রুত নামে বাস থেকে। চোখেমুখে পানি ছিটায়। হড়হড় করে বমি করে রাস্তার ধারে। ঝাঁঝে শেহনাজের চোখে পানি জমে। মাথা ঘোরায়। পুরো বোতলের পানি শেষ করে শেহনাজ বাসের সামনে আসে। আজিজ মোর্শেদ স্নেহ সূলভ ভঙিতে জিজ্ঞেস করে,
-” এখন কেমন লাগছে”?
শেহনাজের চোখ রক্তিম। ভালো লাগছে না কিছুই। মাথাটা ঘোরাচ্ছে। বমি করার পর শরীর ক্লান্ত লাগছে। আক্ষেপের সুরে সে বলে,
-” আমি বোধহয় আর বাসে উঠতে পারবো না স্যার। আমার অভ্যেস নেই। এতটা পথ যেতে পারবো না”।
আজিজ মোর্শেদ এমির আর অপর শিক্ষকের দিকে তাকালেন। শেহনাজকে এভাবে বাড়িতে ফিরে যেতে বলা অন্যায়ই বটে। ওর বাবা যখন বিষয়টা জানতে পারবেন তখন তিনি কিরূপ আচরণ করবেন এ নিয়ে সকলে আশঙ্কায় ভুগল। পিকনিকের জন্য তিনি যথেষ্ট সাহায্য করেছেন। এ এলাকার একজন সম্মানীয় ব্যক্তিও তিনি। তার মেয়েকে এভাবে পিকনিক থেকে বাদ দেওয়া যাবেই না। এমতাবস্থায় শেহনাজের ফিরে যাওয়া খুবই অস্বস্তিকর ব্যাপার সবার জন্য।
আজিজ মোর্শেদ কালবিলম্ব করে জিজ্ঞেস করলেন,
-” বাইকে যেতে পারবে নাকি মাইক্রো ছাড়া যেতে পারবে না”?
শেহনাজ লজ্জা পেল ভিষণ। নত মুখে বলল,
‘- বাইকে যেতে পারবো”।
-” আমার বাইক আছে। কিন্তু এতটা পথ তো আমি ড্রাইভ করতে পারবো না। তুমি আমার ছেলের সাথে যাবে? ওকে আমি বাইক নিয়ে আসতে বলি”?
শেহনাজ কি বলবে ভেবে পায় না। আচমকা তার মনে অন্য চিন্তা আসে। মিটিমিটি হাসে মনে। মলিন এবং নত হয়ে বলে,
-” আপনার ছেলেকে তো আমি তেমন চিনি না। একটু অস্বস্তি হবে। আমাদের সবার চেনাজানা আর বিশ্বস্ত কোনো মানুষ গেলে ভালো হয়”।
সবাই পড়ল চিন্তায়। শেহনাজের বন্ধুবান্ধব রাও চিন্তায় পড়ল। ওকে না নিয়ে গেলে আরো অনেকেই যাবে না বলে বাঁধ সাধল। পরিশেষে আজিজ মোর্শেদ এমিরকে নির্বাচন করলেন। এমিরকে তিনি অনুরোধ করলেন শেহনাজকে তাদের সাথেই পৌঁছে দেয়ার জন্য। এমির শিক্ষকদের অনুরোধ ফেলল না। ইচ্ছে না থাকলেও কিছুটা বাধ্য হয়েই বাইক আসার অপেক্ষা করল।
______
-” একটু বাইকের গতিটা বাড়ান”।
এমিরের চোখেমুখে ভয়ানক রাগের রেশ। এক্ষুণি যেন গিলে ফেলে শেহনাজকে। শেহনাজের কথাবার্তায়ও সে বিরক্ত। গাম্ভীর্যপূর্ণ কণ্ঠে বলে উঠল,
-” আর একটা টু শব্দ করলে এখানেই ফেলে রেখে দিয়ে যাবো। সো নো মোর ওয়ার্ডস”।
শেহনাজ ভেংচি কাটে। হাসি হাসি মুখে দু হাত মেলে ধরে দু দিকে। সহজ সরল কণ্ঠে বলে,
-” কথা না বললে জার্নি খুব বোরিং লাগে। আর সাথে যদি প্রিয় মানুষ থাকে তাহলে তো চুপ থাকার প্রশ্নই আসে না”।
এমিরের রাগ তরতর করে বেড়ে ওঠে। দাঁতে দাঁত চেপে ধরে সে। শেহনাজের লাগামহীন কথাবার্তা তাকে খেপিয়ে তোলে। এমির বাইকে ব্রেক কষে। চেঁচিয়ে বলে,
-” নামো।
অবাক শেহনাজ। দ্বিধা মনে। বাইক থেকে নামতে নামতে জিজ্ঞেস করে,
-” কেন? কি হয়েছে”?
এমির নিজেও বাইক থেকে নামে। নিজেকে যথাসম্ভব শান্ত করে সে। কাঠিন্য ভাবটাকে ঝেরে ফেলার প্রয়াস করে। কিন্তু পারে না। অতঃপর খানিক উচ্চস্বরে নাকের পাটা ফুলিয়ে বলে,
-” তোমার কাছে জীবনটাকে ভিষণ সুন্দর, নির্মল মনে হতে পারে। আমার কাছে তা নয়। তুমি জীবনকে যেমন ভাবে দেখো আমি সেভাবে দেখতে পারি না। আমাদের দুজনের পথ, গতি, সীমানা আলাদা। আমাদের আচার-আচরণ, শ্রেনী, জীবনযাপনের ধারা সম্পূর্ণ ভিন্ন”।
তাচ্ছিল্য ফুটে উঠে এমিরের মুখে। নিজের শার্টের দিকে সে তাকায়। খানিকটা রাগ কমে। থেমে পুনরায় বলে,
-” আমার গায়ে যে শার্টটা দেখছো, এটার বয়স দু বছর। এই শার্টটা এতদিন ধরে বারবার ধোয়ার কারণে এটার রং অবধি ঝলসে গেছে। আমার পায়ের জুতোটা দেখো। সাদাতের থেকে ধার করেছি। এত দামী একটা দিনে আমার গায়ে দু বছরের পুরোনো এই শার্ট, ধার করা জুতো। ভাবতে পারছো আমার জীবন যাপন আসলে কতটা কঠিন?
তুমি কখনো এক ড্রেস দু মাস ইউস করেছো বলে আমার মনে হয় না। নিত্যনতুন ভাবে তুমি নিজেকে রিপ্রেজেন্ট করতে ভালোবাসো। শেহনাজ, তোমার বয়স কম। ভিষণ আবেগী তুমি। জীবন সম্পর্কে তোমার কোনো ধারণা নেই। ধারণা নেই নিম্নবিত্ত মানুষদের যন্ত্রণা সম্পর্কে। আজ যাকে তুমি ভালোবাসা, ভালোবাসা বলে কান ঝালাপালা করে দিচ্ছো এটা আসলে ভালোবাসা না। এটা স্রেফ মোহ, আবেগ। এই মোহ সময়ের ব্যবধানে কেটে যাবে। তাই বলছি, সময় গুলোকে নষ্ট করো না”।
শেহনাজ নিঃশব্দে সব শোনে। মন খারাপ হয় খুব। গলা শুকিয়ে আসে। জিভ দ্বারা ওষ্ঠদ্বয় ভেজায় সে। বুকটা কেমন কেঁপে ওঠে। বলে,
-” এসব মোহ নয়। বিশ্বাস করুন। আমি সত্যিই…
বাকিটুকু বলার সুযোগ পেল না শেহনাজ। এমির বাইকে বসে বাইক স্টার্ট দিল। শেহনাজ দ্রুত উঠে পড়ল বাইকে। এমির বাইকের গতি বাড়াল। খুব দ্রুত বাইক চলল। এত দ্রুত যেন চোখের পলক ফেললেই অনেক পথ অতিক্রম হয়ে যাচ্ছে। এলোমেলো ভাবে চলছে যেন সব। রাস্তা দেখাই কষ্টসাধ্য। শেহনাজ ভয় পেল না মোটেও। এমিরের এক পাশের কাঁধ ধরে রাখল স্বাভাবিক ভাবেই। এমির ভ্রূ কুঁচকাল। এত গতি দেখে শেহনাজর ভয় পাবার কথা, কান্নাকাটি করার কথা। কিন্তু শেহনাজ একটুও ভয় পাচ্ছে না। অ্যাক্সিডেন্ট করার আশঙ্কা ও নেই ওর মনে। স্থির, সুন্দর ভাবে বসে আছে। ওর কি প্রাণের মায়া নেই? ভাবনা দেখা দিল এমিরের মস্তিষ্কে।
শেহনাজকে আয়নায় দেখল এমির। শেহনাজ ও দেখল এমিরকে। সে বুঝল এমিরের চোখের ভাষা। মৃদ্যু হাসল।
-” কি ভেবেছেন ভয় পাবো? আমায় ভয় দেখাতেই তো চেয়েছিলেন? আমি জানি আপনি আমার কোনো ক্ষতি হতে দিবেন না। আপনি থাকতে আমি কোনো বিপদেও পরবো না”।
থেমে আবেগী কণ্ঠে পুনরায় বলে,
আপনি পাশে থাকলে আমি কোনোকিছুতেই ভয় পাই না। কোনো কিছুই আমাকে দুর্বল করতে পারে না। আপনি আমার শক্তি এমির ভাই, আপনি আমার সাহস”।
________
পিকনিকের পর দুদিন কলেজ বন্ধ ছিল। এমিরের সাথে দেখা হয়নি এ দুদিন। শেহনাজ নিজেকে বদলে ফেলার চেষ্টা করছে। আভিজাত্য, বিলাসবহুল জীবনযাপন থেকে বের হবার প্রয়াস চালাচ্ছে। তাই সে আজ তার নিজস্ব গাড়ি না বের করে রিকশায় উঠেছে। শেহনাজ যাবে নার্সারিতে। আজ তার কিছুই ভালো লাগছে না। তাই ফুল কেনার পরিকল্পনা করেছে সে। শেহনাজের পরণে কাঁচা হলুদ রঙের থ্রিপিস। হাতে দামী ফোন। রোদের আলোতে জ্বলজ্বল করছে শেহনাজের মুখশ্রী। গরমে ঘেমে একাকার হয়ে গেছে। গায়ের জামাটা লেপ্টে আছে শরীরে।
রাস্তায় জ্যাম লেগেছে। বসে থাকতে হবে কিছুক্ষণ। শেহনাজ আশপাশে তাকাল। ফোন বের করে দুটো ছবি তুলল নিজের। বিনুনির ফিতে ঘোরাতে ঘোরাতে সে বা পাশের রেস্টুরেন্টটার দিকে তাকাল। হঠাৎ শেহনাজ এমিরকে দেখতে পেল। শেহনাজের মুখটা হাস্যজ্জ্বল হলো এমিরকে দেখে। রেস্টুরেন্টের নীলচে কাঁচের ভিতরে থাকা এমিরকে পরখ করতে গিয়ে শেহনাজের চোখ পড়ল এমিরের সম্মুখে থাকা মেয়েটির দিকে। ঠোঁট কামড়ে ধরল শেহনাজ। মেয়েটি কে? এমিরের সাথে এখানে কি করছে? এমির কি প্রেম করছে?
শেহনাজের বুকে জ্বলন শুরু হলো। আরো ঘামতে শুরু করল সে। ভাড়া মিটিয়ে তখনই নেমে পরল রিকশা থেকে। বুকে সাহস নিয়ে রেস্টুরেন্টে ঢুকেই সে এমিরদের টেবিলের পাশে এসে দাঁড়াল। এমির সেসময় সামনের মেয়েটির সাথে হাস্যজ্জ্বল ভঙিতে কথা বলতে ব্যস্ত। শেহনাজের উপস্থিতি টের পায়নি সে। মেয়েটি শেহনাজের দিকে তাকাল। শেহনাজ আগ বাড়িয়ে এমিরের উদ্দেশ্যে বলল,
-” এমির ভাই, আপনি এখানে”?
এমির দৃষ্টি সরিয়ে শেহনাজকে দেখল। শেহনাজকে দেখে অবাক হলো ভিষণ। শেহনাজ কি ওকে অনুসরণ করছে? বিরক্তি দেখা দিল এমিরের মুখে। ত্যক্ত কণ্ঠে বলল,
” তুমি এখানে কি করছো”?
-” আপনি যেখানে থাকবেন আমিও তো সেখানেই থাকবো তাইনা”?
এমির নিজের মাথা চেপে ধরল। সামনের মেয়েটিকে বিদায় জানিয়ে শেহনাজকে নিয়ে সেখান থেকে দ্রুত চলে এলো রাস্তায়। হাত বাড়িয়ে রিকশা ডাকল এমির। রিকশায় উঠে বসল। ইশারায় শেহনাজকেও বসতে বলল। শেহনাজ খুশি হলো বেশ। সময় ব্যয় না করে ততক্ষণাৎ উঠে পরল রিকশায়। হাসিমুখে তাকাল এমিরের দিকে।
-” আমরা কোথায় যাচ্ছি “?
এমির নড়চড়ে সরে বসল। তেজী, বাঁজখাই কণ্ঠে বলল,
-” তুমি আমাকে ফলো করা শুরু করেছো”?
শেহনাজ ভেংচি কাটল। অভিমানী কণ্ঠে বলল,
-” আমি মোটেই আপনাকে ফলো করি না। এদিক দিয়েই যাচ্ছিলাম। আপনাকে ওই মেয়েটার সাথে দেখলাম, তাই চলে এলাম। যাই হোক, মেয়েটা কে”?
-” সাদাতের গালফ্রেন্ড। একটা সমস্যা হয়েছিল ওদের মাঝে। তাই মিটমাট করতে এসেছিলাম। আরেকটু হলেই তো তুমি আমার ইজ্জতের ফালুদা বানাতে”।
খিলখিলিয়ে হাসে শেহনাজ। এমিরের পানে তাকিয়ে থাকে।
এমির সতর্ক চোখে আশপাশে তাকায়। রিকশা এসে থামে তাদের মেসের সামনে। এমির নেমে পরে। ভাড়া দিতে দিতে শেহনাজের উদ্দেশ্যে বলে,
-” এবারের মতো মাফ করলাম। ভবিষ্যতে আমার পার্সোনাল লাইফে ইন্টাফেয়ার করার চেষ্টা করলে আমি কিন্তু ছেড়ে দিবো না”।
মুচকি হাসে শেহনাজ। গালে হাত রেখে বলে,
-” আমি চাইও না আপনি আমাকে ছেড়ে দিন”।
বিক্ষিপ্তভাবে এমির পা ফেলে চোখের আড়াল হয়। রিকশা চলে। শেহনাজের হৃদয় এমিরের সাথেই রয়ে যায়। যতক্ষণ দেখা যায় ততক্ষণই এমিরকে দেখে শেহনাজ। এই মুগ্ধতা তার কাটে না, ভাঙে না।
________
হাসান বাসে বসে। মনে মনে কবিতা আওড়াচ্ছে। চোখ দুটো বন্ধ। উদ্দেশ্যে একটা ভালো প্রকাশনীতে গিয়ে তার বই প্রকাশ সম্পর্কে কথা বলা। একটা প্রকাশনীর সাথে কথা হয়েছিল মাস চারেক আগে। বই প্রকাশ করতে কিছু টাকা চেয়েছিল প্রকাশনী থেকে। হাসান ভোলাভালা মানুষ। নিজের লেখা ছুঁয়ে দেখার স্বপ্ন তার। তাই সাতপাঁচ না ভেবেই সে টাকাটা দিয়েছিল প্রকাশককে। মাস তিনেক পার হবার পরও বই প্রকাশ হবার নামগন্ধ নেই। কল দিলে প্রকাশক ধরছে না, দেখা করতে গেলেও পাওয়া যাচ্ছে না। সে যে ঠকেছে এটা সে ভালোমতোই বুঝতে পারছে এখন। কিন্তু কিচ্ছু করার নেই। কেস করতে গেলে এখন অনেক ঝামেলা। তার মতো সহজ সরল মানুষের যে এই পৃথিবীতে টিকে থাকা কষ্টের।
বাস ভরতি লোকজন। সিট খালি নেই। তবুও কিছু লোক উঠছে। দাঁড়িয়ে থেকে যাচ্ছে গন্তব্যে। স্ট্যান্ডে বাস থামতেই ঊর্মি নামের মেয়েটি বাসে উঠে। ঊর্মিকে দেখে হাসান অবাক। চেয়ে রইল কয়েক পল। নিয়তি তাদের আবার সাক্ষাত্ করিয়েছে। ঊর্মি উঠেএ আশপাশে সিট খুঁজল। হাসানকে চোখে পরল ওর। হাসান কে চিনতে ভুল করল না ঊর্মি। ভদ্রতাসূচক হাসল। হাসানের সামনের সিট টা ধরে দাঁড়াল। জিজ্ঞেস করল,
-” আরেহ্, আপনি যে? কেমন আছেন”?
হাসান লাজুক হাসে। প্রশান্তির গাঢ় হেসে উত্তর দেয়,
-” আলহামদুলিল্লাহ্। আপনি কেমন আছেন”?
-” সব ফিটফাট”।
বলেই ঘাড় উচাল ঊর্মি। হাসান নিজের সিট ছেড়ে দেয়। আন্তরিকভাবে, বিনয়ের সাথে ঊর্মিকে বসতে দেয় নিজের সিটে। ঊর্মি বাঁধ সাধল না। ব্যাগ কোলে চেপে বসে পরল সিটে। কৃতজ্ঞতা দেখাতে ভুলল না। বলল,
-” কোথায় যাচ্ছেন আপনি”?
-” শিমুলতলী। আপনি”?
– “আমিও তো শিমুলতলী যাচ্ছি, বই কিনতে”।
-” চলুন তবে এক সাথেই যাই”।
ঊর্মি রাজি হলো। গন্তব্যে পৌঁছানোর পর দুজন একসাথেই নামল বাস থেকে। ঊর্মি মেয়েটা শালীন হলেও একটু দুষ্টু স্বভাবের। কোনো কিছুতেই তার রাখঢাক নেই। স্বাধীন ভাবে চলাফেরায় অভ্যস্ত। হাসানের এরকম মেয়ে পছন্দ না হলেও ঊর্মিকে তার কিছুপা পছন্দ। সেদিন ঊর্মির দেওয়া চায়ের অফার হাসানকে কাবু করেছে। ঋণ শোধ করতে গিয়ে সে ঊর্মিকে হৃদয়ে জায়গা দিয়েছে। কিন্তু এ কথা মেয়েটাকে বলা বেশ কঠিন। ঊর্মির মতো মেয়েরা সহজে প্রেমে পড়ে না। সহজে প্রেম নিবেদন গ্রহণ ও করে না। তারা কেবল নিজের মতো বাঁচতে চায়।
_____
সন্ধ্যের দিকে এমির পড়াতে এসেছে। দুটো টিউশনি করে এদিকে এসেছে সে। শিমলা বেগমকে সালাম দিয়ে এমির শেহনাজের পড়ার ঘরে গেল। শেহনাজ বই পড়ছিল। এমিরকে দেখে দাঁড়িয়ে সালাম জানাল। এমির সালামের উত্তর নিয়ে বসল চেয়ারে। বসার সাথে সাথেই পড়াশোনার টপিকে গেল,
-” হিসাব বিজ্ঞানের দুটো ম্যাথ করিয়েছিলাম। মনে আছে? ওরকম আরো দুটো করতে দিলে পারবে”?
শেহনাজ মাথা নাড়ায়। সে পারবে না। এমির ভারী শ্বাস ফেলে। বই বের করে খুব সুন্দর মতো বুঝিয়ে দিতে থাকে। অঙ্ক গুলো করে দেয় খাতায়। শেহনাজের মা দু কাপ চা নিয়ে আসে। সাথে বিস্কিট আরো তিনটা মিষ্টি। এমির তা দেখে। প্রতিদিন উনারা এমিরকে নতুন নতুন খাবার দেন। অন্যান্য টিউটরের কাছে বিষয়টা খুব ভালো লাগলেও শেহনাজদের বাড়ির কোনো কিছুই খেতে চায় না এমির। ওর অস্বস্তি হয়। শেহনাজের সামনে খেতেও বিবেকে বাঁধে। শেহনাজর আভিজাত্য, জীবনযাপন কোনো কিছুই যে তার পছন্দ না।
এমির কিছুটা হেসে শিমলা বেগমকে বলে,
-” আমি খেয়ে এসেছি আন্টি। এসবের প্রয়োজন নেই। কাল থেকে আর এসব দিবেন না প্লিজ”।
হাসেন শিমলা বেগম। শেহনাজের পাশে আরেকটা চেয়ার টেনে বসেন। শেহনাজের মা কিছুটা আধুনিক। চালচলন, কথা বলার ভঙ্গি বর্তমানের মায়েদের মতো আধুনিক। তিনি শেহনাজের মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন,
-” প্রয়োজন তো আছেই। তোমার পড়ানো শেহনাজ ভালো বুঝতে পারে। পড়াশোনায় এখন মনোযোগী হয়েছে ও। এসব তো তোমার জন্যই সম্ভব হয়েছে”।
এমির গর্বিত হয়ে আলতো হাসে। শেহনাজ তখন ও অঙ্ক করতে ব্যস্ত। সুযোগের সদ্ব্যবহার করল এমির। শেহনাজকে খানিকটা ভড়কাতে বলল,
-” শেহনাজ ছাত্রী হিসেবে যথেষ্ট ভালো। কিন্তু মাথায় অন্য চিন্তা ঘোরে বিধায় মনোযোগী হতে পারে না”।
-” তাই নাকি? কিসের চিন্তা ওর”?
-” আপনি শেহনাজের থেকেই জেনে নিবেন। আশা করি সমাধান ও দিবেন। এই বয়সী মেয়েদের মাথায় অন্যরকম চিন্তাভাবনা বেশি ঘুরে। তাই সাবধান হওয়া জরুরী”।
শিমলা বেগম অবাক হলেন। কিছুটা আঁচ করতে পারলেন কিনা তা বোঝা গেল না অভিব্যক্তিতে। এমির গেলেই বোধহয় শেহনাজকে ধরবে। ভেবেই মনে মনে হাসল এমির। শেহনাজ সব শুনল তবে মাথা উঁচিয়ে দেখল না। অঙ্ক করল আপন মনে। যেন কিছুই হয়নি, কিছুই শোনেনি। এমির নিজেই ভড়কাল, ভ্রূ বাঁকাল। মেয়েটার কি একটুও ভয় নেই? এখন যদি ও সবটা বলে দিতো? ওর মুভমেন্ট সম্পর্কে সব জানিয়ে দিতো? একটুও অপ্রস্তুত হলো না কেন মেয়েটা? নাকি ভালোবাসলে ভয়-ডর উধাও হয়ে যায়? এমিরের সেদিনের কথা মনে পরে। এমিরের কাঁধ ধরে শেহনাজ কত সুন্দর, মোলায়েম কণ্ঠে বলেছিল,
-” আপনি পাশে থাকলে আমি কোনোকিছুতেই ভয় পাই না এমির ভাই। কোনো কিছুই আমাকে দুর্বল করতে পারে না। আপনি আমার শক্তি এমির ভাই, আপনি আমার সাহস”।
চলবে?