#শেহনাজ_______{ ৬ }
লেখনীতেঃ #বৃষ্টি_শেখ
এমির এলাকার মোড়ে একটা দশ বছরের ছেলেকে পড়ায়। ক্লাস ফাইভের স্টুডেন্ট। নাম ইমন। সামনেই পি এস সি পরিক্ষা ইমনের। ছেলেটার বাবা একজন রিকশা চালক। মা গৃহিণী। এমির এখান থেকে বেতন পায় সামান্য। এত কম বেতনে এখনকার সময়ে কেউ বাড়ি এসে পড়ায় না। এমির তবুও পড়ায়। টাকার তাগিদ তার ও রয়েছে। তবুও বিবেকের দায়েই ইমনকে পড়ায় ও। অন্য স্টুডেন্টদের সাথে কখনোই ইমনের কম্পেয়ার করে না। অন্যদের যেভাবে পড়ায় এই ছেলেটাকেও সেভাবেই পড়ায়।
আজ মাসের দশ তারিখ। বেতন পাওয়ার দিন। এমির আজ সব টিউশনি থেকে টাকা পেয়েছে। পকেট আপাতত গরম। চোখে মুখেও প্রশান্তি। ইমনের মা হাতে করে এমিরের বেতনের টাকাটা নিয়ে এলেন। এমির তা গ্রহণ করে পুনরায় ইমনকে পড়াতে শুরু করল। মহিলা বললেন,
-” পোলাডা তোমার কাছে ভালোই পড়ে। তুমি এত ভালো কইরা বুঝাও, অমনে নাকি কেউ বুঝাইতে পারবো না”।
এমির খানিক হাসে। কৃতজ্ঞতা জানায়,
-” ধন্যবাদ আন্টি”।
-” এত কম ট্যাকায় কেউ পড়াইবার রাজি হয় নাই। তুমি এত ভালো জায়গায় পড়াশোনা করো, এত ভালো রেজাল্ট করো রাজি হইবা আমি ভাবিও নাই”।
এমিরের মনটা হঠাৎ খারাপ হয়। দারিদ্র্যের কষাঘাতে মানুষ কেমন নুইয়ে পরে। ইমনদের কাছে টাকাপয়সা না থাকলেও তারা এক বেলা না খেয়ে অন্তত চেষ্টা করে এমিরের টাকাটা সময় মতো দেওয়ার। এমির বলে,
-” আমি যে খুব বড় জায়গা থেকে এসেছি এমনটা নয় আন্টি। আমার পরিবারের ধরতে গেলে কিছুই নেই। এই শহরে আমি এসেছিলাম শূণ্য হাতে। থাকার জায়গা নেই, খাওয়ার ব্যবস্থা নেই। হাতে সামান্য কিছু টাকা। কি থেকে কি করবো বুঝতেই পারিনি তখন। ঘুরতে ঘুরতে শেষে মেসে উঠেছি। সেখানে একমাস খাওয়াদাওয়ার পর চিন্তায় পরে গেছি যে কিভাবে টাকা দিবো? পরিক্ষার ফি দিবো কিভাবে? টাকা পাবো কোথায়? কিন্তু সৃষ্টিকর্তা আমার রিজিক লিখে রেখেছেন বলেই এখনো খেয়ে পরে বেঁচে আছি। এতদূর আসতে পেরেছি। পড়াশোনো চালিয়ে যেতে পারছি। আপনি দোয়া করবেন আন্টি, আমি যেন স্বাবলম্বী হতে পারি। পড়াশোনা শেষ করে একটা ভালো চাকরি জোগাড় করতে পারি”।
-” পারবা, অবশ্যই পারবা। চাকরি-বাকরি কইরা বিয়া-সাদি কইরা সুখে থাকবা। ভালো গো লগে সবসময় ভালোই হয়”।
_______
বাংলা মাসে আজ চৈত্রের পনেরো তারিখ। দিনটা অসম্ভব সুন্দর। গরম নেই আবার ঠান্ডাও নেই। মাঝামাঝির এই আবহাওয়াটা এমিরের দারুণ পছন্দের। আজকের দিনটা এমিরের জন্য খুব বিশেষ। আজ এমিরের জন্মদিন। ভার্সিটির সবাই এমনকি কলেজের সবাই এমিরের জন্মদিন সম্পর্কে জানে। এমিরদের ক্লাসের সকলে এমিরের জন্মদিন পালন করেছে কেক কেটে, শুভেচ্ছা জানিয়ে। জুনিয়ররা, ক্লাসমেইটরা অসংখ্য ফুল দিয়েছে তাকে। এমিরকে সকলেই চেনে, জানে, ভালোবাসে। শিক্ষকদের থেকে অনেক অনেক ভালোবাসায় এমিরের এই দিনটি অর্থবহ ভাবে কাটে। শেহনাজ সেসব জানে। কিন্তু আশ্চর্যজনক ভাবে শেহনাজ আজ কলেজে আসেনি। তানিয়া হকবাক, নির্বাক। কেক কাটার সময় তানিয়া বারবার শেহনাজকে খুঁজেছে। যেই এমিরের জন্য মেয়েটা পাগলের মতো ভার্সিটির চক্করে ঘোরাঘুরি করে, সেই এমিরের জন্মদিনের আয়োজনে মেয়েটা এলো না, শুভেচ্ছা জানাল না? এসে পাগলামী ও করলো না? এটা কিভাবে সম্ভব?
তানিয়া মুঠোফোন উঠাল। কল করল শেহনাজকে। শেহনাজ তখন রান্নাঘরে। বাড়ির পরিচারিকা কাজল খালার থেকে রান্নাবান্না শিখতে ব্যস্ত সে। গরুর মাংসে মসলা মাখিয়েছে সবে। গ্যাসের চুলায় বসিয়েছে। হাতে গুঁড়া মরিচ, আর মসলার আবরণ। পেঁয়াজ কাটাকাটি করায় চোখ দুটোও জ্বলছে।
রিংটোন শুনে শেহনাজ দ্রুত পানি দিয়ে হাত ধুয়ে ফেলে। শার্টে হাত মুছে নেয়। ঘরে এসে সাবধানী হাতে ফোন তোলে। কল রিসিভ হতেই তানিয়ার চিন্তিত কণ্ঠস্বর শুনতে পেল সে,
-” অ্যাই নাজ, আজ তুই কলেজে এলি না কেন? কি হয়েছে তোর?শরীর ঠিকঠাক আছে তো?”
হেসে কুটিকুটি শেহনাজ। বলে,
-” আমার কিচ্ছু হয়নি দোস্ত। চিন্তা করিস না। ঠিক আছি”।
-“আজকের দিনে তুই কলেজে আসবি না আমি ভাবতেই পারছি না। ভাবলাম তোর বোধহয় কিছু হয়েছে”।
-” ওখানে কি খুব মজা হচ্ছে রে? এমির কেক কেটেছে”?
-” হ্যাঁ একটু আগেই কেক কাটা হলো, ভাইয়াকে ফুল দেওয়া হলো। তোকে না দেখে আমি তো চিন্তায় শেষ”।
শেহনাজ ধীর সুস্থে বেলকনিতে আসে। বেলি ফুলগুলোকে ছুঁয়ে দেয়। মিষ্টি কণ্ঠে বলে,
-” আজ সময় পাইনি। সকাল থেকে ইউটিউব ঘেঁটেছি। উনার জন্য রান্নাবান্না করবো বলেই আজ যাইনি কলেজে। জানিস আমি গরুর মাংস, মুরগীর রোস্ট, ডাল আর ডিম ভুনা করেছি? দেখতে খুব সুন্দর হয়েছে। টেস্ট ও বোধহয় ভালোই হবে। এখন শুধু বাকি রুই মাছ ভাঁজা আর পায়েস”।
তানিয়া হতভম্ব। চোখ যেন কোটর থেকে বেরিয়ে আসতে চাইছে। যে মেয়েটা কখনো গ্লাসে পানি ভরে খায়নি, সে কিনা এত এত রান্না করছে? একদিনেই কেউ এত রান্না শিখে যায়?
-” তুই তো রান্নায় লবণের পরিমাণ ও জানিস না। কিভাবে রাঁধলি এতসব”?
-” আরে কাজল খালা সব দেখিয়ে দিয়েছে। সব কিছুর পরিমাণ দেখিয়ে বলে বলে দিয়েছে। আমি শুধু খালার কথা অনুযায়ী রান্নায় সবকিছু দিয়েছি”।
উচ্চ শব্দে হাসে তানিয়া। থেমে বলে,
-” এটাও তো কম নয় নাজু। যেই মেয়েটা কখনো গ্লাসে পানি ভরে খায়নি, রান্নাঘরের ধারে কাছে ঘেঁষেনি, ভাত রাঁধতে হলে চালে কতটুকু পানি দিতে হয় তাও জানে না, রান্নার কোনোকিছু সম্পর্কে যার ধারণাই নেই, সেই মেয়েটা তার ভালোবাসার মানুষটাকে খুশি করতে এত কিছু করার উদ্যোগ নিয়েছে। এটাই বা কম কিসের? এমির ভাইয়া এবার সত্যিই গলবে”।
শেহনাজের মুখটা শুকিয়ে যায়। এত কিছু করেও যে সে অপমানিত হবে এটা তার জানা। তবুও এমিরের জন্য কিছু করতে ওর ভালোই লাগে।
-” কোন জামাটা পরে উনার সামনে যাই বল তো? বুঝতে পারছি না”।
-” শাড়ি পড়িস নাজু। তোকে কেউ কখনো শাড়িতে দেখেনি। আমার মনে হয় তোকে শাড়ি পরলে দারুণ লাগবে। ছেলেরা শাড়ি পরিহিত মেয়ে দেখলেই ফিদা হয়ে যায় বুঝলি”?
-” আমাকে মানাবে তো? [শেহনাজের মনে দ্বিধা] ।
-” খুউউব মানাবে। এমির ভাইয়া এবার নিশ্চিত তোর প্রেমে পরবে”।
-” উনি ভালোবাসে না তবুও আমি উনার জন্য পাগল। উনি আমাকে ভালোবাসলে আমি মনে হয় খুশিতে মরেই যাবো তানু”।
বলেই খিলখিল করে হাসে শেহনাজ। কত প্রাণোচ্ছল সেই হাসি। তানিয়া সেই শব্দটাকে শোনে। ভিষণ ভালো লাগে ওর। তবে শেহনাজের এই হাসি, এই সুখ কতক্ষণ চিরস্থায়ী থাকবে জানা নেই তানিয়ার। তবে বন্ধুর এমন সুন্দর সময়কে সে রাঙিয়ে তোলে। শেহনাজকে ভরসা দেয়, আরু প্রাণবন্ত করে তোলে।
_____
এমিরের ঘর জুড়ে ফুলের ছড়াছড়ি। গোলাপ আর রজনীগন্ধা ফুলের ঘ্রাণে ঘরটা ভরে গেছে। এমিরদের ঘরে ছোট ছোট চারটে চৌকি। একটা আলনা আছে ঘরটায়। রশি বাঁধা আছে দুটো। একটা ছোট ড়্যাক আর পড়ার দুটো টেবিল রয়েছে।
এমির ফুলগুলোকে গুছিয়ে রেখেছে মেঝের এক কোণে। নয়ন তা দেখে ব্যথিত হৃদয়ে বলে উঠল,
-” আইজ সেলিব্রিটি নই বইলা এত এত ফুল পাই না”।
ভ্রূ কুঁচকায় এমির। কিল বসায় নয়নের পিঠে।
-” আমি আবার সেলিব্রিটি হলাম কবে থেকে”?
সাদাত বলে,
-” সেলিব্রিটিদের চেয়ে কম ও নোস। তোর বার্থডেতে সবাই যা আয়োজন করেছে, যেন সেলিব্রিটিই”।
হাসান এসব ফাজলামিতে নেই। বলে,
-” তোরাও এমিরের মতো ভালো রেজাল্ট কর। তোদেরকেও সেলিব্রিটিদের মতো ট্রিট করা হবে”।
নয়নের ফোন বেজে ওঠে। শেহনাজের নাম্বার দেখে মনে হাসে। একটু সরে এসে কল ধরে,
-” হ্যালো, নয়ন ভাই”?
-” হ। শেহনাজ নাকি? হঠাৎ? কি মনে কইরা”?
শেহনাজ লাজে মরে। কথাটা নয়নকে বলতে দ্বিধা হয় ওর। লাজে চিবুক বুকে ঠেকায়। হাঁসফাঁস করে। এদিক ওদিক তাকিয়ে নিজের লজ্জা কমায়। ধাতস্থ হয়ে বলে,
-” উনাকে নিয়ে একটু রাস্তার পাশের পার্কটাকে আসুন না। একটু দেখা করতে চাই”।
নয়ন সময় দেখে। সন্ধ্যা ছয়টা বেজে আঠারো মিনিট। বাইরে এখন ও আলো আছে। তবে এই সময়ে শেহনাজ এখানে কেন?
-” তুমি এদিকে কি করতাছো? আর এমিররে নিয়া যাইতে বলো যে? আমারে বকা খাওয়াইবা?
বহুত চেইতা যাইবো কিন্তু”।
ঠোঁট উল্টায় শেহনাজ। মিছে কান্নার ভঙ্গি করে। নাক কানে। আহ্লাদি কণ্ঠে বলে,
-” আপনি উনার রাগটা দেখছেন, বোনের কষ্টটা দেখতে পাচ্ছেন না”?
-” আচ্ছা আচ্ছা। কাইন্দো না বোইন। আমি ওরে নিয়া আসতাছি”।
নয়ন এমিরের কাছে আসে। বলে,
-” এমির, চল তো ভাই। রাস্তার পাশের ওই পার্কটায় যাই। আমার পার্সেল আইবো। পার্সেল নিয়া ওইখানে কিছুক্ষণ আড্ডা দিমুনি। এক ঢিলে দুই পাখি”।
এমির রাজি হয়। আজকের দিনটা তার বন্ধুদের সাথেই কাটাতে চায় ও। হাসান আর সাদাত কেও সাথে নেয় এমির। মেস থেকে পার্কে যেতে পাঁচ মিনিট লাগে। এমির আর ওরা আসে পার্কে। এখন তেমন মানুষ নেই। আগে জায়গাটায় পার্ক ছিল। এখন শুধু মাঠ। পার্কের কোনো সরঞ্জাম ও নেই এখানে। তবুও জায়গাটাকে সবাই পার্ক নামেই চিনে। কয়েকটা বেঞ্চ পরে আছে পার্কে। মাঝে মাঝে দলবদ্ধ ভাবে ছেলেমেয়েরা এসে বসে থাকে। কোনো সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হলে এই স্থানটিকে নির্বাচন করা হয়।
আজ মাঠ খালি। ওরা গোল হয়ে বসতে নিতেই শেহনাজ ডাকল পেছন থেকে। এমির কণ্ঠ শুনেই পিছু ফিরল। কিন্তু শেহনাজকে চিনতে বেগ পেতে হলো ওর। শেহনাজের পরণে টকটকে লাল শাড়ি। শাড়ির পাড়ে সোনালী সুতোর কাজ করা। হাতে লাল রঙের কাঁচের চুড়ি। কপালে ছোট্ট টিপ। ঠোঁটে হালকা লাল রঙের লিপস্টিক। প্রসাধনী ও রয়েছে মুখে। হাতে বড় কেকের বক্স। এমির তাকিয়ে থাকে পলকহীন। এভাবে শেহনাজ কখনো তার সামনে আসেনি। শাড়ি পরে শেহনাজকে পরিপূর্ণ নারী বলে মনে হচ্ছে। কিছুটা বড় বড় লাগছে ওকে। শেহনাজকে ভ্রম বলে মনে হয় এমিরের। চোখ বুজে আবার খোলে। ততক্ষণে শেহনাজ ওদের কাছে আসে। হাসি হাসি মুখে পাশের বেঞ্চে দুটো বড় বড় লাঞ্চ বক্স রাখে। কেকটা এমিরের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে উজ্বল হেসে বলে,
-” শুভ জন্মদিন এমির ভাই। মেনি মেনি হ্যাপি রিটার্নস অফ দি ডে”।
এমিরের ঘোর কাটে। ঠাহর করতে পারে সে ফাঁদে পরতে চলেছে। শেহনাজের গভীর ফাঁদ। গলা শুকিয়ে আসে এমিরের। সম্মুখে দাঁড়িয়ে থাকা অপরূপ সুন্দর মেয়েটির দিক থেকে নজর সরাতে ইচ্ছে হয় না। আশ্চর্য, এত ভালো লাগছে কেন শেহনাজকে? এমির নিজেকে সামলায়। হাত দিয়ে চুল ঠিক করে। জেদী রূপ টাকে টেনে হিঁচড়ে বের করে। চোখ পাকিয়ে কঠোর, কাঠকাঠ কণ্ঠে বলে,
-” তুমি এখানে কি করছো”?
শেহনাজ আজ খুব হাসছে। মেয়েটার এমন হাসিখুশি মুখ দেখতেও ভালো লাগছে। দাঁত বের করে সে বলে,
-” আপনাকে শুভেচ্ছা জানাতে এসেছি”।
-” আমার তোমার থেকে শুভেচ্ছা পাওয়ার কোনো ইচ্ছে নেই। বাড়ি যাও। সন্ধ্যা হয়েছে। এইসব ঝামেলা আর ভালো লাগছে না। আজকের দিনটা অন্তত মুক্তি দাও”।
বন্ধুদের সামনে এমন অপমান শেহনাজকে ক্ষত বিক্ষত করল। কিন্তু সে সয়ে গেল সব। তবুও মুখে হাসি বজায় রাখে শেহনাজ। যেন সে কাঁদবে না বলে আজ পণ করেছে।
-” কিন্তু আমার ইচ্ছে হয়েছে। আজ আমায় প্লিজ ফিরিয়ে দিয়েন না”।
এমির এবার রাগে। সব জায়গায় এই মেয়েটাই কেন? কেন এভাবে এমিরের পিছু লেগে আছে? মান সম্মান হারানোর ভয় নেই ওর? বেকার, খুনির ভালোবাসা পাওয়ার এত সাধ কেন মেয়েটার?
এমির নয়নের দিকে রাগি দৃষ্টিতে তাকায়। নয়ন বোকা হাসে। এমির তুখোড় দৃষ্টি মেলে ভষ্ম করে দিতে চায় সবাইকে। ওদের উপর রাগ দেখিয়ে লাভ নেই বুঝে সেখান থেকে চলে আসতে চায় এমির। শেহনাজ ততক্ষণাৎ বক্সটা সাদাতের হাতে দিয়ে এমিরের সামনে গিয়ে দু হাত মেলে দাঁড়ায়। আটকায় এমিরকে। উতলা কণ্ঠে অনুরোধ জানায়,
-” দয়া করে যাবেন না। শুধু কেকটা কাটুন প্লিজ”।
এমিরের কি হলো সে নিজেও জানে না। শেহনাজের এহেন কাতর কণ্ঠ তার হৃদয় তোলপাড় করে দিল। এমির ভুলতে বসল নিজেকে, তার কঠিন, পাষণ্ড সত্তাকে। চিনচিন ব্যথা হলো হৃদয়ে। তাকাল বন্ধুদের দিকে। তাদের দৃষ্টি, চাওয়া বুঝতে পেরে পা থামাল। দাঁড়িয়ে রইল সেখানেই। এমিরকে থামতে দেখে শেহনাজ খুব খুশি হলো। লাফাতে গিয়েও শাড়ি পরেছে ভেবে থেমে গেল। তবে হাসতে ভুলল না। সাদাতের থেকে কেকের বক্সটা নিয়ে খুলল। চকলেট কেকে কতগুলো মোমবাতি জ্বালিয়ে দিল। অবশেষে এমিরের হাতে গুঁজে দিল ছুরি। এমিরের হাত কাঁপছে। দম নিয়ে ফু দিয়ে মোমবাতি নেভাল সে। ছুরি দিয়ে কেক কাটল। প্রথম কেকের টুকরোটা সাদাতকে খাইয়ে দিল। সাদাত কেকের সামান্য ক্রিম লাগিয়ে দিল এমিরের মুখে। একে একে সবাইকে এমির কেক খাওয়াল। সবাই ওকে ক্রিম মাখাল, মজা করল। শেষমেশ এমির শেহনাজের মুখের সামনে কেকের টুকরোটা ধরল। শেহনাজ হতভম্ব। খুশিতে প্রাণ যায় যায় অবস্থা। অশ্রু গড়িয়ে পড়ে কপোল বেয়ে। খুশিতে বাকশক্তি হারায়। কেকটুকু মুখে নেয় তৃপ্তি সহকারে। এমির শেহনাজের খুশি দেখে আলতো হাসে। কেন যেন শেহনাজের খুশিটাকে বাড়িয়ে দিতে ইচ্ছে করে ওর। মস্তিষ্ককে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে মনের কথা শোনে। কেক থেকে ক্রিম তুলে শেহনাজের দু গালে আর নাকে ক্রিম লাগিয়ে দেয়। শেহনাজ কেবল পলকহীন তাকিয়ে রয়। ভিষণ আবেগী হয়ে। খুশিতে অসাড় হয়ে যায় ওর গা।
বেঞ্চ থেকে লাঞ্চ বক্স হাতে নিয়ে এমিরের হাতে দেয়। বলে,
-” এগুলো আমি রান্না করেছি। আপনার জন্য। খেয়ে জানাবেন কেমন হয়েছে”।
পিছন থেকে নয়ন হামলে পরে লাঞ্চ বক্সের উপর। বলে,
-” শুধু এমিরের জন্যে”?
মাথা দু পাশে নাড়ায় শেহনাজ,
-” না না। বেশি করে এনেছি। আপনারাও খাবেন”।
এমির দীর্ঘশ্বাস ফেলে। মেয়েটা আসলেই পাগল। কেন এতসব করতে গেল? এতে ওর লাভ কি? এমির কখনোই ভালোবাসবে না শেহনাজকে। এতকিছু করেও ওর মন গলাতে পারবে না। এসব করা যে বৃথা। ক্লান্ত চোখে শেহনাজের সুখ পর্যবেক্ষণ করে এমির। বিরক্তিকর কণ্ঠে বলে,
-” এতসব কেন করতে গেলে? আমি বলেছি এসব করতে? আগ বাড়িয়ে এত দরদ কেন দেখাতে আসো”?
শেহনাজ উত্তর দেয় না। কি বলবে ভেবে পায় না। হুট করে নয়ন আঁতকে ওঠে শেহনাজের ডান হাত দেখে। শেহনাজের হাতের কনুই অবধি ফোঁটা ফোঁটা লালচে দাগ। রক্ত যেন জমাট বেঁধেছে। কেমন জ্বলজ্বল করছে দাগ গুলো। নয়ন জিজ্ঞেস করে,
-” এগুলা কেমনে হইল”?
আঁচল দিয়ে হাত ঢাকে শেহনাজ। হাসে সামান্য,
-” তেমন কিছু না। রুই মাছ ভাজতে গিয়ে তেল ছিটে এসেছে”।
এমির কি বলবে ভেবে পায় না। শেহনাজের প্রতি রাগ বাড়ে ওর। পেয়েছেটা কি? ভালোবাসার খেলা খেলা হচ্ছে? ঢং করে, এসব করে কি প্রমাণ করতে চায় ও? এমিরকে কি দংশনে পুরিয়ে মারার পরিকল্পনা এটেছে? নাকি ফাঁদে ফেলে মরণ নিশ্চিত করতে চাইছে?
_____
শুক্র আর শনিবার এমির একদম ফ্রি থাকে। সারাদিন বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেয়, ঠিকঠাক ভাবে খাওয়াদাওয়া করে। এ দুদিন ওর কোনো টিউশনি থাকে না। রাতে ঘুম হয় ভালো।
শেহনাজের সাথে এ দুদিন দেখা হয়নি এমিরের। দেখা না হওয়াই স্বাভাবিক। দুদিন শেহনাজকে পড়াতে যেতে হয়নি কিনা। এ দুদিন এমিরের মনটা নিজের আয়ত্বে ছিল না। নিয়ন্ত্রণ বিহীন ভেবে চলেছে শেহনাজের কথা। লাল টকটকে শাড়ি পরে মেয়েটি যখন এলো, মনে হচ্ছিল পৃথিবী থমকে গেছে। শেহনাজের চোখের দিকে কেবল চেয়ে থাকতে ইচ্ছে করেছে। নিষিদ্ধ ইচ্ছে গুলো উঁকি মেরেছে বারবার। নারী এত সুন্দর হয়? এত মোহনীয় লাগে কোনো মেয়েকে?
শেহনাজদের ঘরের সামনে এসে কলিং বেল বাজায় এমির। দরজা খোলে শিমলা বেগম। খানিক অবাক হয় এমির। রোজ শেহনাজ দরজা খোলে। এমিরকে দেখেই স্বভাবসুলভ হাসে। মেয়েটা বোধহয় এমিরের জন্য অপেক্ষা করে দরজার কাছে এসে। কলিং বেল বাজার সাথে সাথেই দরজা খুলে দেয়। আজ শিমলা বেগম দরজা খুললেন। এমিরের বুকটা ধক করে উঠল যেন। শেহনাজ যেন তার নিত্যনৈমিত্তিক অভ্যেস।
শিমলা বেগম দরজা খুলেই মলিন মুখে বললেন,
-” শেহনাজ তো আজ পড়তে পারবে না। ওর শরীরটা ভালো নেই। তোমাকে ফোন দিতে চেয়েছিলাম। ও নিষেধ করল”।
এমির নিজের উৎকণ্ঠা চেপে গেল,
-” কি হয়েছে শেহনাজের”।
-” দুদিন আগে ওর কোনো এক বান্ধবীর জন্মদিন ছিল। গেল ঠিকঠাক ভাবেই, খুশি মনে। ফিরল অসুস্থ হয়ে। বারবার বলে দিয়েছিলাম আনন্দ কর কিন্তু ক্রিমটিম মাখবি না গায়ে। কে শোনে কার কথা? এলার্জিতে মেয়েটা আমার এখনও ভুগছে। গায়েও জ্বর”।
এমিরের বুকে কম্পন ধরে। মেয়েটা কি ওকে বিভীষিকার অন্তজ্বালে পুড়িয়ে মারতে চাইছে? নাকি অনুতাপে দ্বগ্ধ করতে চাইছে?
-” আমি তবে যাই আন্টি”।
– ” না যাবে কেন? এসো, বসো। শেহনাজকে দেখে যাও। কবে থেকে পড়তে পারবে জানিয়ে দিক”।
এমির পা বাড়ায়। তার অস্থির অস্থির ঠেকছে। পা দুটো টলছে। বুকের মাঝে কেমন হাহাকার। হৃদয়ে জ্বলন। শেহনাজের ঘরে প্রবেশ করল এমির। শেহনাজ শুয়ে আছে। গায়ে মোটাসোটা কম্বল। এমিরকে দেখতে পেয়ে ধীরে উঠে বসল শেহনাজ। বালিশে হেলান দিয়ে বসে রইল। কাজল খালা এসে চেয়ার দিয়ে গেল। এমির চেয়ার টেনে বসল শেহনাজের খাটের পাশে। শেহনাজ জিজ্ঞেস করল,
-” কেমন আছেন”?
কণ্ঠ কাঁপল শেহনাজের। মুখটা রুক্ষ্ম। ঘাড়ে আর কপালে গুটি গুটি ফোস্কা পরার মতো চিহ্ন। চুলগুলো এলোমেলো। অসুস্থতায় কেমন নুইয়ে পরেছে। দুষ্টুমির রেশ ও নেই।
-” আমাকে ভালো থাকতে দিচ্ছো তুমি? কেকের ক্রিমে তোমার এলার্জি। এ কথা সেদিন আমাকে বলোনি কেন? তাহলে এত বড় দুর্ঘটনা ঘটতো না”।
শেহনাজ মলিন হাসে। চোখ চুইয়ে গড়ায় পানি। চোখ বুজে ফেলে। মাথাটা এত ব্যথা করছে। এক্ষুণি মনে হচ্ছে জ্ঞান হারাবে।
-” আপনি এই প্রথম আমাকে খাইয়ে দিয়েছেন, আমায় স্পর্শ করেছেন, আমার সাথে হেসে দুদণ্ড কথা বলেছেন। এমন সুখকর মুহুর্ত থেকে আমি কিভাবে বঞ্চিত হই বলেন”?
হতভম্ব এমির। দু চোখ জ্বলে ওঠে ওর। শেহনাজের হাতের উপর স্পর্শ করে। জ্বর আছে এখনো। শেহনাজকে ভিষণ ক্লান্ত, বিধ্বস্ত লাগছে। এত হাসিখুশি মেয়েটার এমন অবস্থা মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছে। শুধুমাত্র এমিরের সান্নিধ্য পেতে এত বড় ঝুঁকি নিল কেন শেহনাজ? ভালোবাসা কি এতই পোড়ায়? শেহনাজ নিজের এত বড় ক্ষতি করার সাহস কিভাবে পেল? বোধগম্য হয় না এমিরের। দৃঢ় অবয়ব ধরে রাখতে পারে না সে। বোঝানোর চেষ্টা করে,
-” এমন পাগলামি করো না শেহনাজ। তোমাকে এভাবে দেখতে আমার খারাপ লাগছে। আমাকে তুমি অনুতাপে পোড়াচ্ছো”।
-” প্রেমে পরলে মানুষ এমন ছোটখাটো পাগলামি করেই”।
এমির সতর্ক হয়ে আশেপাশে তাকায়। বাড়িতে মানুষজন আছে। এসব শুনলে খুব খারাপ হবে। নিজের মান যায় যাবে, শেহনাজের ক্ষতি হতে দিতে সে পারে না। শিমলা বেগম এভাবে ওদের কথা বলতে দেখলে সন্দেহ করতে পারে।
-” এসব বলো না। কেউ শুনে ফেলবে”।
-” শুনুক, জানুক। দেখুক আপনার প্রেমে আমি ঠিক কতটা উন্মাদ হয়েছি”।
এমির হাল ছেড়ে দেয়। এত বোঝানোর চেষ্টা তার বৃথা। এ মেয়ে তাকে এত সহজে ছাড়বে না। কিন্তু এমির কি ধরতে পারবে ওকে? এমির ভালো প্রেমিক হতে চায় না। হতে চায় একজশ পার্ফেক্ট হাসব্যান্ড। কিন্তু শেহনাজের সাথে আদৌ তার মিলন ঘটবে? শেহনাজের বাবা-মা মানবে তাকে? এমন অযোগ্য, বেকার ছেলের হাতে নিজের একমাত্র মেয়েকে তুলে দিবে? কি আছে এমিরের? কিচ্ছু নেই। শেহনাজকে খাওয়াবে কি? পরাবে কি? ও কি এমিরের এই নিম্নবিত্ত জীবনে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারবে?
এমিরের ভিতরটা ধসে পড়ে। নিদারুণ মায়ায় আটকে যাচ্ছে সে। ছাড়া পাচ্ছে না কোনোভাবেই। সামনের পথ গুলো খুব কঠিন হবে বুঝতে পারে এমির। শেহনাজকে উপদেশ দেয়,
-” নিজের খেয়াল রেখো। ঔষধ ঠিক মতো খেয়ো। পরশু আমার পরিক্ষা। পড়াতে আসতে পারবো না। সিলেবাস শেষ করার চেষ্টা করো”।
এমির দাঁড়ায় না। পা বাড়ায়। মেয়েটার করুণ মুখ দেখলে এমিরের হৃদপিণ্ড ছলকে ওঠে। তার মতো অভাগার জন্য কেউ এভাবেও পাগল হয়?
চলবে?