#শেহনাজ _____{ ৮ }
লেখনীতেঃ #বৃষ্টি_শেখ
ঢাকা শহর থেকে মানিকগঞ্জ বেশি দূরে না। দু ঘন্টার ও কম সময় লাগে বাসে। কিন্তু এমিরদের বাড়ি মানিকগঞ্জ থেকে অনেক দূরে। মানিকগঞ্জ ছেড়ে মোটামুটি দেড় ঘন্টার পথ পাড়ি দিতে হয়। শেহনাজ বাসে উঠতে পারে না। অথচ এমিরকে ফিরে পাওয়ার আশায় মেয়েটা টু শব্দ ও করল না, বাসে উঠে পরল। সাথে নিল পলিথিন। বমি পেলে এটাই একমাত্র কাজে দেবে।
আশ্চর্যজনক ভাবে শেহনাজ বাসে বমি করল না। রাস্তা থেকে কিছু আচার কিনেছিল ওরা। পুরো রাস্তায় সেই আচার খেয়েছে। বমিটমি আর পায়নি। শেহনাজরা যখন এমিরদের গ্রামে পৌঁছাল তখন দুপুর হতে চলেছে। তপ্ততা ছড়াচ্ছে রোদ। গরম পরেছে।
এমিরের বাবার নাম এরশাদ সাখাওয়াত। এমিরের ভাষ্যমতে ছ বছর আগেও এরশাদ সাখাওয়াত এর অনেক জমিজমা ছিল। গোয়াল ভরতি গরু ছিল, ঘর ভরতি ছাগল ছিল, ছিল আমের বাগান। গরুর দুধ, ছাগল বিক্রি আর আম বিক্রি করে এমিরের বাবা খুব ভালো রোজগার করতেন। তাদের এলাকার সবচেয়ে ধনী মানুষ ছিলেন এমিরের বাবা। কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় সেসব কিছুই নেই এখন। থাকার মতো আছে শুধু বাড়িটা। তবে এরশাদ সাখাওয়াত এর নাম বললেই সকলে চিনে ফেলে।
এক মহিলা এমিরদের বাড়ি অবধি পৌঁছে দিল শেহনাজ আর সাদাতকে। সাদাত সেসময় শেহনাজকে বিদায় জানাল। সে দেখা করবে না এমিরের সাথে। তার কাজ শেষ। বাকিটুকু শেহনাজকেই করতে হবে। এমিরের সাথে কথা বলবে না বলে পন করেছে সাদাত। এই পন ভাঙবে না এত সহজে।
শেহনাজ এগিয়ে এসে দেখল এমিরদের বাড়ির সামনের জায়গাটায় বস্তার উপর অনেক ধান খোসা সহ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। সেগুলোকে পা দিয়ে আরো ছড়িয়ে দিচ্ছেন একজন ভদ্রমহিলা। উনার পরণে সবুজ তাঁতের শাড়ি। বাড়ির বা পাশে বড় বড় ক্ষেত। সেখানে ভুট্টা গাছ রয়েছে অহরহ। কয়েকটা ক্ষেতে কেবল মাটি আছে। ট্রাক্টর চলছে সেখানে। ঘরের ডান পাশের বড় দেয়ালে গোবর দিয়ে দলা করে রেখে দেওয়া হয়েছে। লাঠির সাহায্যে গোবরের ঘুঁটে বানানো হয়েছে। বাড়িতে চারটা ঘর। অন্যসব বাড়ির চেয়ে এমিরদের বাড়িটা আলাদা। একদম পরিপাটি, সুন্দর বাড়ি। শহরের বাড়িদের মতোই।
শেহনাজ ভদ্রমহিলার পিছে এসে দাঁড়াল। সালাম দিল প্রথমে। মহিলা কাজ বন্ধ রাখল। সালামের উত্তর দিল। শেহনাজ জিজ্ঞেস করল,
-” এটা এমিরের বাড়ি”?
মহিলা মাথায় আঁচল টানল। বয়স নেহাতই কম। গায়ের গড়ন চমৎকার। মার্জিত কণ্ঠস্বর,
-” হ্যাঁ এমিরের বাড়ি। তুমি কে? কাকে খুঁজছো”?
-” এমির আছে বাড়িতে?
-” হ্যাঁ আছে। কিন্তু আপাতত নেই। পুকুর পাড়ে গিয়েছে। আমি যদি ভুল না হই, তুমি কি শেহনাজ”?
-” আপনি আমাকে চিনেন”?
-” হ্যাঁ এমির বলেছে তোমার কথা”।
বলেই মহিলা হাসল। শেহনাজকে একটি টুল এনে দিল বসতে। টিউবওয়েল চেপে ঠান্ডা পানি এনে দিল। হাত মুছল আঁচলে। শেহনাজ পানিটকু খেল। বলল,
-” আমার সাথে যে উনার দুদিন আগে বিয়ে হয়েছে, এ কথা উনি আপনাকে জানিয়েছে”?
-” জানিয়েছে”।
-” আপনি উনার কে হন”?
মহিলা অপ্রস্তুত হলো। এড়িয়ে গেল কথাটি। উচ্চস্বরে মহুয়া বলে ডাকল। একটি ন-দশ বছরের মেয়ে ছুটে এলো মহিলার ডাক শুনে। মেয়েটির পরণে গোলাপী রঙের ফ্রক। হাতে কাপড়ের পুতুল। মেয়েটি এসেই মহিলাকে জিজ্ঞেস করল,
-” কি জন্য ডাকো”?
-” তোমার ভাইকে নিয়ে আসো তো মা। পুকুর পাড়ে গেছে। বলো আমি ডাকছি, জরুরী”।
মেয়েটি ছুটল। শেহনাজ কেবল শুনল। ভদ্রমহিলা বলল,
-” বিয়ের পরদিনই এখানে চলে আসাটা এমিরের অন্যায় হয়েছে। তবে আমি ওকে ফিরে যেতে বলিনি। কারণ আমার মনে হয়েছিল তুমি আসবে”।
শেহনাজ বলে না কিছুই। কেবল চেয়ে দেখে আশপাশ। কিছুক্ষণ বাদে এমির আসে। এমিরের পরণে সাদা লুঙ্গি। গা উদাম। ফর্সা শরীর রোদে আরো জ্বলজ্বল করছে। শেহনাজকে দেখে এমির রেগে গেল কিনা বোঝা গেল না। কেবল ভারী স্বরে বলল,
-” তুমি তোমার বাড়ি ফিরে যাও নি”?
শেহনাজ হাসে। এগিয়ে আসে এমিরের কাছে। একদম কাছে। বুক ফুলিয়ে বলে,
-” ভেবেছিলেন পালিয়ে গেলেই আমি হার মেনে নিবো? চলে যাবো বাবার কাছে”?
-” তখন না গেলেও এখন যাবে। এ বাড়িতে তুমি থাকতে পারবে না”।
শেহনাজ বেজায় চটে যায়। নাকের পাটা ফুলায়। খামচে ধরে এমিরের ফোলা বাহুদ্বয়। বলে,
-” আমার সম্পূর্ণ অধিকার আছে এ বাড়িতে থাকার। আমি আপনার বউ। আপনার সাথেই থাকবো আমি। বেশি বেগড়বাই করলে পুরো মহল্লার মানুষকে ডেকে আপনার আমলনামা জানিয়ে দিবো”।
এমির দু পা এগিয়ে আসে। ভ্রূ বাঁকিয়ে বলে,
-” থ্রেড দিচ্ছো”?
-” হ্যাঁ তাই।
ভদ্রমহিলা এগিয়ে এসে এমিরকে দুরে সরায়। চোখ পাকিয়ে এমিরকে নিষেধ করে ঝগড়া করতে। বলে,
-” শেহনাজ এ বাড়িতেই থাকবে। তুমি ওর সাথে একদম খারাপ ব্যবহার করবে না। সময় হলে ও নিজেই চলে যাবে”।
_______
মাটিতে মাদুর বিছিয়ে দিয়েছে মহুয়া। টিউবওয়েল চেপে পানি এনেছে। ভদ্রমহিলা রান্নাঘর থেকে ভাত আর তরকারি নিয়ে রাখল শেহনাজের সামনে। খেতে দিল। শেহনাজ তাকাল বাইরে। জিজ্ঞেস করল,
-” উনি কোথায়? খাবে না”?
ভদ্রমহিলা বলল,
-” তুমি খাও, ও আসছে”।
-” ঊনি আসুক। এক সাথেই খাবো”।
ভদ্রমহিলা চুপ থেকে বলল,
-” তুমি এসেছো, মাছ-মাংস রাঁধা উচিত ছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত ঘরে মাছ-মাংস নেই। কাল হাটের দিন। সব কিনে আনবো। তুমি যাবে? গেলে কিছু জামাকাপড় পছন্দ করে কিনতে পারতে”।
শেহনাজ মাথা নাড়ে। বলে,
-” আমি যাবো। সমস্যা নেই”।
এমির হাত পা ধুয়ে এসে বসল মাদুরের উপর। নিজ হাতে ভাত বেড়ে খেতে লাগল। শেহনাজ নিজের প্লেটে দেখল। লাউয়ের তরকারি। সে আগে কখনো খায়নি। তবুও এমিরের দেখাদেখি খেতে লাগল। এমির খাওয়া শেষে প্লেট ধুতে নিয়ে গেল কলপাড়ে। পিছু পিছু গেল শেহনাজ ও। অভিমানী কণ্ঠে বলল,
-” আপনি আমার সাথে কথা বলছেন না কেন”?
এমির এক নজর শেহনাজের দিকে চায়। তার হাত থেকে প্লেট টা নিয়ে নেয়। ধুয়ে রাখে। টিউবওয়েল চাপে। শেহনাজ সে পানি দিয়ে হাত আর পা ধুয়ে নেয়। পুনরায় বলে,
-” বউয়ের সাথে কেমন ব্যবহার করতে হয় জানেন না”?
-” তুমি বাড়ি ফিরবে কবে? তোমার বাবাকে আসতে বলবো নাকি একাই যাবে”?
মুখ বাঁকায় শেহনাজ। গা ছাড়া হয়ে বলে,
-” আমার চৌদ্দ গুষ্টি এলেও আমি যাবো না। আমি আমার স্বামীর সাথেই থাকবো”।
-” বেশ। দেখি কতদিন বাবার রাজকন্যা এই কুঁড়েঘরে থাকে”।
শেহনাজ এমিরের হাত ধরে। টেনে নিয়ে আসে ক্ষেতের সামনে। এখানে অনেক ঠান্ডা। গাছের নিচে থাকতে খুব আরাম লাগছে। শেহনাজ এমিরকে নিয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে। এমির রাগে না। কেবল গম্ভীর ভাব বজায় রাখে। শেহনাজ নিজেকে ঠিক করে বলে,
-” ঘরে যিনি বসে আছেন উনি আপনার সেই মা? আপনার বাবার দ্বিতীয় স্ত্রী”?
এমির সামনের দিকে চেয়ে রয়। দীর্ঘশ্বাস ফেলে। শেহনাজের দিকে তাকায়। মেয়েটার মাঝে অদম্য কৌতুহল।
-” হু। উনিই সেই”।
-” আপনি উনাকে মেনে নিয়েছেন? আমি ভেবেছি আপনার বুবু চলে গিয়েছিল বলে আপনি উনাকে মেনে নেন নি”।
শেহনাজের চুল গুলো উড়ছে। কালো ড্রেস টায় মানিয়েছে ওকে। এমিরের কি হলো জানা নেই। শেহনাজের উড়তে থাকা চুলগুলোকে সে হাত দিয়ে কানের পিছনে গুঁজে দিল। সম্মোহনী চোখে চেয়ে রইল শুধু।
এতটুকু ভালোবাসায় গলে গেল শেহনাজ। এমিরের হাতটা জড়িয়ে মাথা রাখল এমিরের কাঁধে। অজানা সুখ অনুভব করল। ভালো লাগায় ছেয়ে গেল মুহুর্তটা। এমির বলল,
-” আমার অতিত আমাকে বারবার যন্ত্রণা দিয়েছে। এই যন্ত্রণা কেউ কখনো দেখেনি। আমি দেখাইনি। তুমি ভুল করেছো শেহনাজ, মস্ত বড় ভুল। এ ভুলের শাস্তি তুমি সইতে পারবে না”।
শেহনাজ মাথা উচায়। আরো জড়িয়ে ধরে নিবিড় ভাবে।
-” আপনার অতিত, আপনার যন্ত্রণা সব মুছে দিতেই আমি এসেছি। এ জন্য যে শাস্তি আমাকে দিবেন, আমি মাথা পেতে নিবো”।
______
বৈশাখ মাস এসে গেছে। কাল বৈশাখীর ঝড় উঠবে। বাতাসের ঝাপটায় গাছপালা নড়ছে বাজে ভাবে। ধুলোকণা উড়ে বেড়াচ্ছে। এমিরের মা বাইরে থাকা ধান গুলো ঘরে তুলছে হন্তদন্ত হয়ে। এমির ছাগল গুলোকে ঘরে এনে বাঁধছে। মহুয়া বাড়ি নেই। আকাশের মেঘ গর্জে উঠছে। তীব্র হাওয়ায় ওলটপালট হচ্ছে সব। বৃষ্টি নামল বলে।
শেহনাজ সব ঘরের জানালায় খিল তোলে। এমিরের মা’য়ের সাথে হাতে হাতে ধান তোলে ঘরে। অতঃপর তিনি মুরগী গুলোকে তাদের আওয়াজে ডাকে। খামারে ঢুকিয়ে রাখে। শেহনাজের ভয় বাড়ে। আকাশ ঘন কালো মেঘে ছেয়ে গেছে। বাজ পরে না সব লণ্ডভণ্ড হয়ে যায়। এমিরের মা সব কাজ করে ডাকল এমিরকে। বলল,
-” মহুয়া খেলতে গেছে। এখনো ফিরছে না। আমি যাচ্ছি ওকে খুঁজতে। তুমি মেয়েটার পাশে থেকো। ও ভয় পাচ্ছে। একা ছেড়ো না”।
এমির মাথা নাড়ে। বজ্রপাত শুরু হয়েছে। মহুয়াকে খুঁজতে বের হবার কিছুক্ষণ বাদেই ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি পরতে আরম্ভ করেছে। অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়েছে গ্রাম। বাজ পরছে। শব্দে আর বাতাসে ছোট ছোট ঘরবাড়ি গুলো কেঁপে উঠছে। শেহনাজ ভয়ে দিশেহারা। বিদ্যুত নেই। অন্ধকারে আরো বেশি ভয় বাড়ছে ওর। এমির শেহনাজের ঘরে এলো। শেহনাজ খাটে বসে। বালিশ কানে ধরে আছে। ভয়ের রেশ ফুটে উঠেছে মুখে। এমিরের হাতে হ্যারিকেন। ঘর কিছুটা আলোকিত হয়েছে এখন। এমিরকে দেখে ভয় কমল শেহনাজের। এমির বলল,
-” ভয় পেও না। রাতটা এমন থাকবে। সকালে সব ঠিক হয়ে যাবে”।
শেহনাজের ভিত চোখ। বলে,
-” আন্টি মহুয়াকে খুঁজতে গেলেন। এই অবস্থায় কিভাবে বাড়ি ফিরবেন”?
এমির শেহনাজের সামনে থাকা জানালার এক অংশ খুলে দেয়। সাথে সাথে হু হু করে বাতাস ঢোকে ঘরে। বৃষ্টির পানি ছিটে আসে। শেহনাজের চিন্তা দূর করতে বলে,
-” উনাকে এ গ্রামের সবাই চিনে। ফিরতে না পারলে কারো বাড়িতে রাতটা কাটিয়ে আসবে। চিন্তা করো না”।
শেহনাজ বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে জানালার দিকে। বাইরের এমন তাণ্ডব সে মনোযোগ দিয়ে দেখে। এমন ঝড় সে আগে দেখেনি। ঝড় এলে ওদের পরিবারের সবাই ঘরে নিরাপদে থাকতো। বিদ্যুত যাওয়ার ভয় ছিল না কারণ জেনারেটর আছে। ঘর থেকে বাইরের বৃষ্টির এমন ভয়ঙ্কর শব্দ শোনাও যেত না। বোঝা যেত না বাহিরে ঠিক কতটা ঝড় উঠেছে।
শেহনাজ এখন ভয় পাচ্ছে না। পাশেই এমির বসে। শেহনাজ হ্যারিকেনের হলদেটে আলোতে এমিরকে পরখ করে। মুগ্ধ চাহনি নিক্ষেপ করে। বাহিরের শীতল বাতাসে গা ঠান্ডা হয়ে আসে ওর। চুলগুলো উড়ে বেড়ায় অবাধ্যতায়। এমিরকে শান্ত, নির্মল দেখাচ্ছে। শেহনাজের প্রতি বিরক্তিবোধ আপাতত নেই। এ সময়টার সুযোগ নিল শেহনাজ।
-” আপনি কখনো কাউকে ভালোবেসেছেন এমির? কখনো কারো প্রেমে পরেছেন”?
এমিরের চোখে কেমন মায়া। সে নজর সরায় না শেহনাজের থেকে। আজকাল কেন এত ভালো লাগে শেহনাজকে? বুঝে উঠতে পারে না এমির। যেদিন শেহনাজ এলার্জির কারণে অসুস্থ হয়ে পরল, ঠিক সেদিন থেকে শেহনাজকে দেখলে মায়া হয়। ইচ্ছে হয় মেয়েটাকে বক্ষপিঞ্জরে আগলে নিতে।
খুব সময় নিয়ে এমির উত্তর দেয়,
-” ভালোবাসা কিংবা প্রেম কোনোটাই জীবনে আসেনি। সে সুযোগ-ই পায়নি। আম্মার মৃত্যুর পর থেকে শুধু বেঁচে থাকার সংগ্রাম করে গেছি। কারো সাথে নিজেকে গোছানোর সময় হয়নি”।
শেহনাজ নড়েচড়ে বসে। এমিরের উক্ত কথা গুলো কেমন আবেগী, নরম। কত যে কান্না, হাহাকার লুকিয়ে আছে কথাটায়, তা শেহনাজ টের পেল। বলল,
-” আপনি সেদিন বলেছিলেন আপনার বুবু আপনার আব্বুর বিয়ের পর দিনই হারিয়ে গিয়েছিল। তাকে কি খুঁজে পেয়েছেন? পেলে আপু এখন কোথায় আছে? দেখলাম না তো”।
এমির দু পা এক করে বুকের সাথে ঠেকায়। বাহিরের অন্ধকার অবলোকন করে। বলে,
-” বুবুকে আর খুঁজে পাইনি। শহরে আসার পর অনেক গুলো বিজ্ঞাপন দিয়েছিলাম। কাজ হয়নি। যে স্বেচ্ছায় হারিয়ে যায়, তাকে খুঁজে পাওয়া কঠিন”।
এমিরের এহেন বাচনভঙ্গি, শব্দচয়ন শুনে শেহনাজের হৃদয়ে শীতল স্রোত বয়ে যায়। এমিরকে এমন সে আগে কখনো দেখেনি। রাগী, দাম্ভিক, শক্ত প্রকৃতির মানুষ এমির। প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাসী। সুদর্শন দেখতে। প্রশস্ত দেহ, চওড়া গায়ের গড়ন। সবসময় ছেলেটা তার ব্যক্তিত্ব, মর্যাদা বজায় রাখে। শেহনাজকে দেখলেই এমিরের বুঝি গা জ্বলে। সে রেগে যায়। কিন্তু এখন এমির রাগছে না। সে প্রকৃতির মতো শীতল। এই প্রকৃতি যেন তাকে নরম করে ফেলেছে। শেহনাজ ভরসা দেয় এমিরকে, স্বান্ত্বনা দেয়,
-” একদিন ঠিক আপু ফিরে আসবে। আপনার জন্য হলেও উনি ফিরবেন”।
এরপর দুজন চুপ হয়ে যায়। শেহনাজ এমিরকে খাবার বেড়ে দেয়। এ অল্প আলোতেই দুজন রাতের খাবার খেয়ে নেয়। পুনরায় বসে থাকে দুজন। রাত বাড়ে। ঝড় থামে না। মহুয়া আর তার মা ফেরে না। শেহনাজ ফোনের ফ্ল্যাশ অন করে। দেখতে পায় দূরের চিকন গাছপালা গুলো হেলে পরেছে। কিছু গাছ আবার লুটিয়ে পরেছে মাটিতে। ছোট ছোট ঘরের টিনগুলো নড়ছে। এই বুঝি ধসে পরে। কি বিভৎস সেই দৃশ্য। শেহনাজের অন্তর নাড়িয়ে দেয়। ক্ষেত গুলো বৃষ্টির পানিতে ডুবে গেছে প্রায়। ফসল গুলো নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এক ঝড় কিভাবে প্রকৃতিকে বদলে দিতে পারে তা শেহনাজ আজ ভালো করে দেখল। অচেনা, অজানা এক বাড়িতে, আপনজন ছেড়ে শেহনাজ এই দুরের গ্রামে এসেছে। এটা খুব আশ্চর্যের। এমিরের প্রতি ভালোবাসা শেহনাজকে এত দুর টেনে এনেছে?
মাঝ রাতে শেহনাজের চোখে ঘুম এলো। এমির ঘুমোয়নি। শেহনাজ বালিশে মাথা গুঁজে। প্রশ্ন করে,
-” ঘুমোচ্ছেন না কেন এমির? অনেক রাত হয়েছে”।
এমির শুনল। একটা কাঁথা নিল। অন্য ঘরের উদ্দেশ্যে পা বাড়াল। চেঁচিয়ে উঠল শেহনাজ,
-” কোথায় যাচ্ছেন? এখানে ঘুমান”।
এমির অবাক। বলে,
-” এক ঘরে ঘুমোবো? পাগল হয়ে গেছো”?
শেহনাজ উঠে বসে। এমিরের থেকে কাঁথাটা নিয়ে ছুঁড়ে মারে বিছানায়। বলে,
-” আমরা যে স্বামী-স্ত্রী, ভুলে গেছেন? আমরা এক ঘরেই ঘুমোতে পারি। তাছাড়া একা একা আমার ভয় করবে। থেকে যান প্লিজ”।
এমির বাধ্য হয়ে এ ঘরেই রইল। মাঝখানে কোলবালিশ দিয়ে শেহনাজের সাথে দুরত্ব সৃষ্টি করল। শেহনাজ তা দেখে মিটিমিটি হাসল। ততক্ষণাৎ সরিয়ে ফেলল কোলবালিশ। এমিরের বুকে গিয়ে মাথা ঠেকাল। এমির ক্ষুব্ধ। ঠেলে দুরে সরাতে চায় শেহনাজকে। কপাল কুঁচকে ফেলে। শেহনাজ ভিষণ দুষ্টু। শক্ত করে জড়িয়ে ধরে এমিরকে। ছাড়ে না কোনোমতেই। এমির ঘাবড়ায়। শরীর অসাড় হয়ে আসে ওর। মেয়েলী নরম দেহের স্পর্শ তাকে কাবু করে। উন্মাদ করে তোলে ভিতরে ভিতরে। ভিষণ তেজী কণ্ঠে বলে,
-” ছাড়ো শেহনাজ। বাড়বাড়ি করছো”।
শেহনাজ ছাড়ে না। এমিরের সাথে নিজের শরীরকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে রাখে। লজ্জা, শরম সব ভুলে যেতে চায় মেয়েটা। তবুও অন্তরে লাজ থাকে। এমিরের বুকে মুখ গুঁজে বলে,
-” আমার খুব লজ্জা লাগছে। তবুও আমি আপনাকে জড়িয়ে ধরে আছি। কারণ আপনি একজন আনরোমান্টিক হাসব্যান্ড”।
চলবে?