#শেহনাজ ______ { ১০ }
লেখনীতেঃ #বৃষ্টি_শেখ
রোদের তেজ বাড়ছে। পাখির কলরব শোনা যাচ্ছে। মুরগী গুলো তাদের আওয়াজে ডাকছে। কাক অবিরত কা কা করে চলেছে। কোথা থেকে যেন ইট ভাঙার শব্দ আসছে। জানালা থেকে আসছে ফুরফুরে বাতাস। গ্রীষ্মের আমেজ। বাড়ির বাইরের আম গাছটায় বোল এসেছে। জাম গাছে ধরেছে অসংখ্য ফুল। আশপাশের নেতিয়ে পরা গাছগুলোকে কেটে কাঠ উদ্ধার করা হয়েছে।
হাত মুখ ধুয়ে শেহনাজ রান্নাঘরে আসে। ফারজানা ভাত রান্না করছেন। তরকারি রান্না শেষ। শেহনাজ ভেবে পায় না সবাই এত দ্রুত কেন ওঠে? ফারজানা উঠেছেন পাঁচটার দিক। আযানের পর ছাগলকে খাইয়েছেন। মুরগিকে খাইয়েছেন। ঘর আর বারান্দা ঝাড়ু দিয়ে এখন রান্না করছেন। শেহনাজ এই সকালে কি করবে ভেবে পায় না। ছোট্ট টুল নিয়ে টিনের তৈরী রান্নাঘরের দরজার সম্মুখে বসে। তাকে দেখে সহজ ভাবে হাসে ফারজানা।
-” কিছু লাগবে শেহনাজ”?
-” না কিছু লাগবে না। আপনি এত সকালে কেন উঠেছেন? সবাই তো দেরি করে ওঠে। আপনার ঘুম নষ্ট হয়”।
ফারজানা হাসেন। বলেন,
-” আমার অভ্যেস আছে। যত তাড়াতাড়ি উঠবো তত কাজ এগোবে”।
শেহনাজ এবার নড়েচড়ে বসে। বলে,
-” এমিরের বাবা মানে আপনার স্বামী কোথায়? আসার পর একদিন ও দেখিনি”।
ফারজানা অপ্রস্তুত হলেও তা দ্রুত সরিয়ে ফেললেন। স্বাভাবিক ভঙিতে বললেন,
-” আছে কোথাও। সময় হলে ঠিক আসবে”।
শেহনাজ বুঝতে পারে ফারজানা এড়িয়ে যাচ্ছে কথাটা। যেমন ভাবে নিজেকে এমিরের মা হিসেবে পরিচয় দিতে উনি কুন্ঠা বোধ করছিলেন, ঠিক তেমন ভাবে। শেহনাজ পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে চাইল। বলল,
-” আপনার মতো মা খুব কম মানুষ পায়। এমির আপনাকে অনেক ভালোবাসে”।
-” হ্যাঁ আমার ছেলেমেয়ে গুলো আমাকে সত্যিই অনেক ভালোবাসে”।
-” শুধু সাবিহা আপু ছাড়া। উনি আপনাকে এ বাড়িতে দেখার পরই চলে যান। অথচ আপনি তা চাননি”।
ফারজানা বিস্মিত চোখে চাইলেন। উত্তেজিত হলেন খানিক।
ভাত রাধা শেষ। মার গালতে হবে। ফারজানা চটপট তার কাজ সারল। মলিন কণ্ঠে বলল,
-” এ জীবনে সবাই আমাকে কেবল ভুল বুঝেই গেল। আমার কথা কেউ শুনতে চাইল না”।
শেহনাজের মন খারাপ হয়। এমিরের ভাষ্য মতে উনি না জেনেই এ সংসারে এসেছিলেন। উনি জানতেন না এমিরের মা জীবিত আছেন। সে অনুযায়ী উনার কোনো দোষ নেই বললেই চলে। তার এমন আক্ষেপ দেখে শেহনাজ দুঃখ পেল। খানিক হেসে বলে উঠল,
-” যাদের দোষ থাকে না, তারা দোষী হয়ে ঘুরে বেড়ায়। আর যারা দোষী তারা বুক ফুলিয়ে বাঁচে। এ দায় তো আমাদের নয়। এ দায় আমাদের বোঝাপড়ায়”।
ফারজানা এবার হাসলেন। বললেন,
-” প্রকৃতি সব দেখেন। যে আসল দোষী, সে শাস্তি পেয়েছে। প্রকৃতি তাকে উন্মাদ বানিয়ে দিয়েছে”।
________
বিকেলের দিকে শেহনাজ পুরো গ্রাম ঘুরে বেড়াল মহুয়ার সাথে। মহুয়া আর তার সম্পর্কে ঘনিষ্ঠতা বেড়েছে। তারা একত্রে থাকলে আর কোনো কিছুতে মাথায় থাকে না। পুরো গ্রাম ঘুরে শেহনাজ আর মহুয়া লুডু খেলেছে। গ্রামের আরো কয়েকটা পিচ্চির সাথে শেহনাজ লুকোচুরি ও খেলেছে। দিনটা তার কেটেছে আনন্দে। ভেতরে যে শূন্যতা পুষে রেখেছিল তা হারিয়ে গেছে মিছে হাসির আড়ালে।
বাঁশের রোয়াকে পা উঠিয়ে বসে আছে শেহনাজ। রাত হয়েছে। বারান্দার লাইটের আলোতে পুরো জায়গাটা আলোকিত হয়ে আছে। শেহনাজ আর মহুয়া ফোনে লুডু খেলছে। গতবার শেহনাজ জিতেছিল বলে মহুয়ার সে কি রাগ। তাই পুনরায় খেলছে ওরা।
এমির বের হচ্ছে। গায়ে ছাই রঙা শার্ট আর সাদা জিন্স। চুলগুলো পরিপাটি। এমিরের দাঁড়ি গজিয়েছে ছোট ছোট। দেখতে ভিষণ ভালো দেখায়। এখন তাকে শেহনাজের কাছে সবচেয়ে সুদর্শন লাগছে। এমিরের পেটানো শরীর, ব্যক্তিত্ব সব যেন শেহনাজের নিকট মুগ্ধতা।
এমিরকে বের হতে দেখে শেহনাজ রোয়াক থেকে নামে। জুতো পরে নেয় চটজলদি। ওড়নাটা পেঁচিয়ে এগিয়ে আসে। উজ্জ্বল কণ্ঠে বলে,
-” কোথায় যাচ্ছেন এমির? রাত হয়েছে তো”।
এমির আগের মতোই সাবলীল। গতরাতে শেহনাজের বাক্য, কান্না কোনো কিছুই এমিরের উপর প্রভাব ফেলেনি। আবার ও শেহনাজকে উপেক্ষা করছে সে। যেন গত রাতে কিছুই হয়নি। আর শেহনাজ? সে যে নির্লজ্জ, বেহায়া। প্রত্যেকদিনের মতো আজও সেধে সেধে ভাব জমাতে চাইছে। চাইছে স্বামীর থেকে ভালো ব্যবহার।
এমির শেহনাজের কথা শুনলোই না যেন। ফারজানা ঘরে ছিলেন। তার উদ্দেশ্যে উচ্চস্বরে বলল,
-” আমি সভায় যাচ্ছি। আমার জন্য অপেক্ষা করবেন না। আজ ফিরবো না”।
শেহনাজ কিংকর্তব্যবিমূঢ়। চেয়ে রয় এমিরের পানে। আজ রাতে কি তারা একসাথে ঘুমোবে না? এমির কি তার উপর রাগ করে এমন অবিচার করতে চাইছে?
-” আপনি ফিরবেন না কেন? আমার রাতে একা ভয় করে”।
এমির একটু নরম হলো। কিন্তু গাম্ভীর্য স্বভাব বদলাল না। বলল,
-” মা আর মহুয়াকে সাথে নিয়ে ঘুমিও। আর বাতি নিভিও না”।
শেহনাজ ঠোঁট কামড়ে ধরে। ভয়ে ঢোক গিলে। নিভু নিভু কণ্ঠে বলে,
-” আমিও মাহফিলে যাবো। আমাকে নিয়ে যাবেন”?
ভ্রু কুচকায় এমির। শার্টের হাতা গোটাতে গোটাতে বলে,
-” আমি ফিরবো না। মাহফিলে থাকবো। তোমায় নিয়ে বিপাকে পরতে চাই না”।
শেহনাজ দ্রুত সমাধান দিল,
-” আমি দোলনায় চড়বো। নিয়ে চলুন না আমায়”।
ফারজানা ঘর থেকে বের হলেন। বললেন,
-” নিয়ে যাও। এত করে যেতে চাইছে। কেনাকাটা করবে কিছু। ঘুরাঘুরি শেষ হলে আমাকে ফোন দিও। আমি ওকে নিয়ে আসবো”।
এ কথার পর এমিরের আর কোনো কথাই সাজে না। শেহনাজ খেয়াল করেছে ফারজানার কোনো কথা এমির ফেলে না। অথচ এই মানুষটার উপস্থিতির জন্যই এমির সব হারিয়েছে। তবুও এত ভালোবাসা কি করে থাকে এই সম্পর্কে?
____
বিশাল বড় মাঠ। মাঠের এক পাশে শুধু খাবারদাবার। স্ট্রিট ফুড থেকে শুরু করে দামী দামী সব খাবারের স্টল বসেছে। মিষ্টান্নের অভাব নেই। আরেকপাশে কেবল কাঠের জিনিসপত্র আর স্টিলের আসবাবপত্র। মাঠের মাঝখানে কসমেটিক্স এর অনেক অনেক দোকান। ছোটদের খেলনা থেকে শুরু করে বড়দের নকল চুল ও রয়েছে। শেহনাজ হা হয়ে তাকিয়ে থাকে। তাদের ওখানে মেলা বসে, সভা-মাহফিল বসে। তবে এত বড় করে নয়। স্কুলের মাঠের এই সভা দেখতে শহর থেকেও অনেক মানুষ গ্রামে এসেছে।
এমিরের শার্টের কোণা ধরে হাঁটে শেহনাজ। ভিড়ের জন্য পা ফেলা মুশকিল। ভিড় দেখে অটো থেমেছে রাস্তায়। বাকিটা পথ হেঁটে আসতে হয়েছে। শেহনাজ হাসি হাসি মুখে বলে,
-” আয়োজন তো অনেক বড় করে করা হয়েছে। এটা কতদিন থাকবে”?
এমির উত্তর দিতে চায়নি। তবে এই মাহফিল তাদের গ্রামের আলাদা একটা সুনাম। তাদের গ্রামের একটি বিশেষত্ব ও বলা যায়। বাধ্য হয়ে বলে,
-” প্রত্যেক বছর একটি নির্দিষ্ট তারিখে এ গ্রামে এই মাহফিল হয়। অনেক দুরের গ্রাম থেকেও মানুষ এ মাহফিল দেখতে আসে। এটা কেবল এক দিন থাকে। গ্রামের মানুষজন তাদের তৈরিকৃত পণ্য বিক্রির উদ্দেশ্যে এখানে আসে। এজন্য নির্দিষ্ট একটি টাকাও সভাপতিকে দিতে হয়। শুধু গ্রাম নয়, শহর থেকেও বিভিন্ন ধর্মের মানুষ এখানে আসে। হয়তো ওয়াজ শোনে না কিন্তু কেনাকাটা করতেই আসে। এখানে এমন কিছু নেই যা পাওয়া যাবে না। এটা মানিকগঞ্জের মানুষর একটা মিলন মেলা। অনেক আগে এ মাহফিলের উদ্ভব ঘটেছে”।
শেহনাজ মনোযোগ দিয়ে শোনে। ভিড়ে পা ফেলা যাচ্ছে না। ধাক্কাধাক্কি করছে সকলে। রাতে মানুষের যাতায়াত আরো বেরেছে। এমির শেহনাজের এমন অপ্রস্তুত ভঙ্গি বুঝতে পারে। পেছনে হাত দিয়ে সামলে নেয় শেহনাজকে। ভিড়বাট্টা কম এমন একটি জায়গায় এসে ওরা দাঁড়ায়। শেহনাজ পুতুলের দোকানের সামনে দাঁড়ায়। তার ঘরে কত্ত পুতুল ছিল। সেগুলোকে সে কতই না আগলে রাখতো। এখন তাদের ছাড়াই ঘুমোতে হয়।
বড় একটি ডোরেমনের পুতুল দেখে শেহনাজের খুব পছন্দ হয়। ঝলমলে কণ্ঠে বলে,
-” এটা কিনে দিন না। আমার খুব পছন্দ হয়েছে”।
এমির মানিব্যাগ বের করল। টিউশনির টাকা প্রায় শেষের পথে। এসেই মহুয়ার প্রাইভেট আর স্কুলের বেতন পরিশোধ করেছে, নয়নের থেকে ধার করা এক্সাম ফি পরিশোধ করেছে, মেসের যাবতীয় খরচ দিয়েছে। শেহনাজের জন্য জামাকাপড় আর বাজার করতে গিয়ে পকেট ফাঁকা। মাহফিলে সব কিছুর মূল্য বেশি নেয়। কেননা দোকান দেওয়ার জন্য সভাপতিকে তাদের নির্দিষ্ট মুনাফা দিতে হয়। পকেট হাতড়ে এমির এক হাজার টাকার নোট পেল। আর কিছু টাকা খুচরো। এটা তার ঢাকায় যাওয়ার যাতায়াত ভাড়া। ভেঙে ফেললে আর থাকবে না।
এমির তবুও টাকাটা বের করে। দোকানিকে দিতে গেলে বাঁধ সাধে শেহনাজ। কি ভেবে বলে,
-” থাক এটা না নিই। খুচরো যা আছে তাই দিয়ে মহুয়া আর আন্টির জন্য ফুচকা নিয়ে যাই। ওরা খুব খুশি হবে”।
এমির অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে শেহনাজের পানে। মেয়েটা এত বদলে গেল কিভাবে? এমিরের এক মাসে যা আয়, শেহনাজের তা দুদিনের হাত খরচ। শেহনাজ কখনো কোনোকিছুতে স্যাক্রিফাইজ করেনি। যেটা তার প্রয়োজন সে তাই নিয়েছে। অনেক সময় প্রয়োজনের বাইরেও অনেক কিছু নিজের দখলে রেখেছে। অথচ আজ মেয়েটা কেমন পছন্দ গুলোকে ছুঁড়ে ফেলছে। সে নিশ্চিত এমিরের ফাইনান্সিয়াল ক্রাইসিস বুঝেছে।
এমির আর শেহনাজ অনেকক্ষণ ঘুরপাক খেল। শেহনাজ কমদামি ফুচকা খেল। নাগরদোলায় চড়ল, রাইডে চড়ল। ফারজানা আর মহুয়ার জন্য খাবার প্যাক করতে ভুলল না। ফেরার পথে ঠোসায় ঝালমুড়ি খেতে খেতে বাড়ি ফিরল শেহনাজ। এমির কেবল দেখল শেহনাজের আচরণ। মেয়েটা এমন কেন? এরকম মেয়েকে কি ভালো না বেসে থাকা যায়?
এমির শেহনাজের সাথেই ফিরল। ফিরে কলপাড়ে গিয়ে হাত পা ধুয়ে শুয়ে পরল বিছানায়। শেহনাজ জামাকাপড় ছারল। আলস্য ভঙ্গিতে বসল বিছানায়। এখন তার ঘুম আসবে না। কি করবে? নেটওয়ার্ক নেই বলে অনলাইনে ঢুকতে পারল না শেহনাজ। গ্যালারি ঘাটতে থাকল। বিরক্ত হলো বেশ। ঘুম আসছে না কেন?
_______
সকাল দশটার সময় ফারজানা হন্তদন্ত হয়ে শেহনাজকে ডাকলেন। শেহনাজের হাতে দুশো টাকার নোট ধরিয়ে আলগোছে বললেন,
-” আজ দুপুরে তোমরা একটু ঘুরাঘুরি করো। আমি ফোন দিলে তবেই বাড়ি ফিরবে”।
শেহনাজ প্রশ্নাতুর চোখে চায়। ফারজানা কথা বাড়ায় না। বলে,
-” এমিরের বাবা আসছে। তোমাদের দেখলে ও খুশি হবে না। ও চলে যাবে ঘন্টা দুয়েকের মধ্যে। এটুকু সময় তোমাদের বাইরে থাকতে হবে”।
এমিরকে বলা মাত্রই এমির বেরিয়ে পরল বাইরে। ফারজানা শেহনাজকে তাড়া দিল এমিরের সাথে যাওয়ার জন্য। প্রশ্ন করার আর সময় পেল না শেহনাজ। এমিরের পিছু পিছু চলতে থাকল। কিছু প্রশ্ন জমল মনে। উত্তর মিলল না।
ধান ক্ষেতের ভিতর দিয়ে হাঁটছে ওরা। এমিরের পরণে ছাই রঙের লুঙ্গি। লুঙ্গির কোণা ধরে সে চলছে নিজের মতো। শেহনাজ আছে কি নেই সে নিয়ে বিন্দুমাত্র ভ্রূক্ষেপ নেই। শেহনাজ এমিরের পাশে হাঁটে। এমিরকে পর্যবেক্ষণ করে। এমিরের ভালোবাসা সে কখনো হয়তো পাবে না, কিংবা শেহনাজের এই একপাক্ষিক প্রেম কখনো সফলতা পাবে না। তবুও শেহনাজের মনে এমিরের প্রতি গভীর মায়া। মানুষটার চালচলন, আচার-আচরণ, ব্যক্তিত্ব বরাবরই মুগ্ধ করে ওকে। শেহনাজ বারবার ভাবে এমিরকে ভুলে যাবে, এমিরের থেকে দুরে থাকবে। তা ভাবনাই থেকে যায়। শেহনাজ এত কিছুর পর ও এমিরকে ছাড়তে পারে না। এত অবহেলা, উপেক্ষা সে যত্নের সাথে উপভোগ করে।
শেহনাজ পাশে হেঁটে হেঁটে প্রশ্ন করে,
-” শ্বশুর বাবার সাথে দেখা না করে কেন চলে এলাম? উনি কি উনার ছেলের বউকে দেখবেন না”?
এমির পাশে তাকায়। কপাল কুঁচকে ফেলে। রাগ হু হু করে বেড়ে যায়। বলে,
-” থাকতে তুমি, এলে কেন”?
-” আন্টিই তো আমাকে জোর করে পাঠালো”।
এমিরের ক্ষোভ উপচে পরে। ধৈর্যহারা হয়ে পড়ে সে। নিজের ক্ষোভ, অভিযোগ উগড়ে দিতে চায়।
-” কি চাও তুমি? আমাকে ভেঙেচুরে দিতে চাও? যার কারণে আমি খুনী হয়ে দীর্ঘ ছয় মাস কারাগারে বন্দী ছিলাম, তার জন্য তোমার এত বাড়াবাড়ি রকমের আগ্রহ কেন? ওর কথা তুমি দ্বিতীয় বার মুখে আনবে না। নইলে তোমাকে এখানেই রেখে চলে যাবো”।
শেহনাজ চমকায়। ভারী অবাক হয় সে। এমির ছ মাস কারাগারে ছিল? কাকে খুন করেছিল? আদৌ করেছিল? শেহনাজ ততক্ষণাৎ প্রশ্ন করে,
-” আপনি কারাগারে ছিলেন? কেন?
এমির উত্তর দিল না কোনো। শেহনাজ পরবর্তীতে আর কোনো প্রশ্ন করল না। ওরা গিয়ে বসল ধান ক্ষেতের মাঝের উঁচু মাটির স্তরে। দুজনের মাঝে তৈরী হলো অবিচ্ছেদ্য দ্বন্দ্ব। শেহনাজ মাথা রাখল এমিরের কাঁধে। এমির তা দেখেও নীরব রইল। এমির বলল,
-” আমি আব্বাকে খুন করতে গিয়েছিলাম। তাই আব্বা আমার নামে মামলা করেছিল”।
শেহনাজ মাথা তোলে। কৌতুহল আর সন্দেহী চোখে চেয়ে বলে,
-” উনি দ্বিতীয় বিয়ে করেছিলেন বলেই কি আপনি উনাকে খুন করতে চেয়েছিলেন”?
-” উঁহু”।
-” তাহলে?
-” তুমি আমার অতিত জানতে চাও নাজ? আজ আমি তোমাকে সে গল্প শোনাব। তবে আমার একটা শর্ত রয়েছে”।
-” কি শর্ত?
-” আমায় ছেড়ে দিতে হবে তোমাকে। তোমায় তোমার পরিবারের কাছে ফিরে যেতে হবে”।
শেহনাজের আত্মবিশ্বাস অনেক। তার ধারণা মতে এমিরের কোনো কালো অতিত শেহনাজকে দমাতে পারবে না। তার ভালোবাসাকে ক্ষীণ করতে পারবে না। গাঢ় কণ্ঠে সে বলে,
-” যদি আমার মনে হয় আপনার এই অতীত আমাদের জীবনে বিরাট প্রভাব ফেলবে, তাহলে সত্যিই চলে যাবো। কথা দিচ্ছি”।
ধান ক্ষেতের আইল ধরে এক হাজার বয়স্ক লোক যাচ্ছিল। এমির আর শেহনাজকে এখানে বসে থাকতে দেখে এগিয়ে এলো লোকটা। এমির তাকে দেখে অবিলম্বে সালাম জানাল। লোকটা বলল,
-” এইখানে কি করো? অনেকদিন পর দেখলাম তোমারে”।
এমির বলল,
-” বসে আছি কাকা। ভালো আছেন”?
-” ভালো আছি। আল্লাহ্ রাখছে ভালোই। তোমার বাপরে দেখলাম একটু আগে বাড়ি ফিরল”।
এমির কিছু বলল না। সেই লোকটা শেহনাজের পানে তাকাল। শুধাল,
-” তোমার বউ নাকি”?
শেহনাজ মাথা নাড়ল। সালাম জানাল। লোকটা ব্যথিত কণ্ঠে বলে উঠল,
-” তোমার শ্বশুরের কত কিছুই না ছিল। একেবারে খানদানি পরিবার। কোনো কিছুর অভাব ছিল না। নিজের দোষে, নিজের ভুলে এহন সব হারাই পথের ফকির। মাঝখান দিয়া এই পোলাডার জীবন নষ্ট কইরা দিল।
শেহনাজ বুঝল না কিছু। কিছুটা আচ করতে পারল বোধহয়। স্বামীকে ছোট হতে দিতে চায় না সে। মিষ্টি হেসে বলে,
-” উনার জীবন নষ্ট হয়নি। বরং অতীতের ঘাত-প্রতিঘাত উনাকে আরো শক্ত আর মজবুত বানিয়েছে। দোয়া করবেন, অতীত যেন কখনো ফিরে না আসে”।
______
ঊর্মির খোঁজ খবর নেই। সেদিনের পর হাসানের সাথে দেখা হয়নি আর। হাসান চায় ঊর্মির সাথে যোগাযোগ করতে। কিন্তু যোগাযোগ করার কোনো উপায় নেই। ঊর্মির ঠিকানা বা ফোন নম্বর চাওয়ার মতো সাহস হয়নি হাসানের। তাই শিমুলতলীর সেই বইয়ের দোকান গুলোতে ঘুরে বেড়ায় সে। যদি মেয়েটার সাথে দেখা হয়ে যায় এই ভেবে। কিন্তু ঊর্মির তরফ থেকে বোধ করি সে চেষ্টা নেই। দু পক্ষ সমান ভাবে চাইলে এ ছোট্ট এলাকায় একে অপরের সাথে দেখা হওয়া সম্ভব।
সেদিন ঊর্মির সাথে বইয়ের দোকানগুলো ঘুরে দেখেছে হাসান। কফি খেয়েছে একসাথে। কিছুটা সময় কাটিয়েছে। এ সময়টা আসলে কিসের ভিত্তিতে, কোন সম্পর্কের টানে কাটিয়েছে সে প্রশ্ন করা অবান্তর। হাসানের বুকে যে গভীর ঢেউ খেলে যাচ্ছে তা যেকোনো নারীর বুঝে ফেলা নিতান্তই সহজ।
ফেসবুক স্ক্রল করতে গিয়ে শেহনাজের আইডি দেখতে পেল হাসান। পরিচিত মানুষের আইডিতে ঢুকে খানিক ঘাঁটাঘাঁটি করতে গিয়েই একটি প্রফাইলে নজর আটকাল ওর। ইংলিশে “তানিয়া সরকার” নামের একটি আইডিতে ঊর্মির ছবি। ঊর্মির পাশের মেয়েটি সম্ভবত তানিয়া। জুম করে ছবিখানা দেখল হাসান। তানিয়াকে সে চিনতে পেরেছে। শেহনাজের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। তাদের জুনিয়র। শেহনাজের সাথে কয়েকবার দেখেছে মেয়েটাকে। তার সাথে ঊর্মির ছবি দেখে হাসান বুঝি প্রাণ ফিরে পেল। ততক্ষণাৎ মেসেজ করল,
-” ঊর্মিকে তুমি চেন”?
___
আজ অমাবস্যা। চাঁদের আলোয় আলোকিত আশপাশ। এ আলো শেহনাজের হৃদয়কে আলোকিত করে রেখেছে। শেহনাজ চায় এ আলো অক্ষত থাকুক। আজ এমিরের কালো অধ্যায় জেনে যেন সে ঠিক থাকে এ প্রার্থনা করছে সে। সে জানে এমিরকে সে কখনোই মন থেকে ঝেরে ফেলতে পারবে না।
মহুয়া বই খুলে পড়তে বসেছে। শেহনাজ পাশেই বসে মহুয়ার বইগুলো দেখছে। মহুয়ার পড়াশোনায় কিছুটা সাহায্য করল শেহনাজ। বাংলা বইয়ের মাঝের পৃষ্ঠায় শেহনাজ একটি ছবি খুঁজে পেল। চার বাই দু ইঞ্চির ছবিটা ভিষণ যত্নের সাথে বইয়ের ভাঁজে রেখে দেওয়া হয়েছে বলে মনে হলো শেহনাজের। সে ছবিটা মেলে ধরল চোখের সামনে। পরখ করল। একটি মেয়ের ছবি। পরণে গোলাপী রঙের কাতান শাড়ি। লম্বা বেনুনী। হাত ভর্তি কাঁচের চুড়ি। মেয়েটাকে খুব চেনা লাগল শেহনাজের নিকট। মহুয়াকে প্রশ্ন করল,
-” এই মেয়েটা কে? খুব সুন্দর তো”।
মহুয়া অঙ্ক কষছিল। ছবিটির দিকে না তাকিয়েই উত্তর দিল “আমার বড় আপু”।
শেহনাজ পুনরায় ছবিটি দেখল। এই মেয়েটিকে সে বোধহয় চিনে। তানিয়ার গ্যালারিতে এই মেয়েটার ছবি সে দেখেছিল। এই কি তবে সাবিহা আপু? শেহনাজ দ্বিধা দুর করতে বলল,
-” তোমার সাবিহা আপু? তোমার মনে আছে আপুকে”?
-” মনে নাই। এই ছবি আমাদের ঘরে আরও আছে। একটা ভাইয়ার মানিব্যাগে, একটা মায়ের কাছে। মা প্রতিদিন ছবিটা দেখে। আর একটা আছে আমার বইয়ে”।
শেহনাজ আলগোছে ফোনের ক্যামেরা বের করে ছবিটি ফোনে বন্দী করল। ছুটে নিজের ঘরে এলো। তানিয়াকে কল করে বলল ” মেসেঞ্জারে তোকে একটা ফটো দিয়েছি। দেখ তো চিনিস কিনা”।
তানিয়া মেসেঞ্জারের ছবিটি দেখে দ্রুত কল করল। শেহনাজ ভিষণ উত্তেজিত। এমিরের কাছের মানুষকে সে যদি খুঁজে দিতে পারে এমির নিশ্চয়ই খুব খুশি হবে। এতদিন যাকে ওরা খুঁজে বেড়াচ্ছে তাকে পেলে নিশ্চিত এ বাড়ির সবাই আনন্দে মেতে উঠবে।
-” এই মেয়েটার ছবি আমি তোর ফোনে দেখেছিলাম”।
তানিয়া বলল,
-” হ্যাঁ উনি আমার ছোট চাচ্চুর বউ। এই ফটো তুই কোথায় পেলি”?
শেহনাজ সবটা বলল না। বলল,
-” সে কথা পরে বলবো। আগে বল এই মেয়েটা কোথায় আছে? উনার সম্পর্কে কি কি জানিস তুই”?
তানিয়া বলে উঠল,
-” উনি আমার ছোট্ট চাচ্চুর স্ত্রী। উনার নাম সাবিহা। চাচ্চুর সাথে চাচির লাভ ম্যারেজ হয়েছিল। কিন্তু চার বছর আগে উনি মারা গেছেন ক্যান্সারে”।
শেষের কথাটুকু শুনেই কেঁপে উঠল শেহনাজ। এতক্ষণের আগ্রহ, উত্তেজনা নিমিষেই মুছে গেল। শীতল স্রোত বয়ে গেল হৃদয়ে। নিঃশ্বাস ভারী হলো ওর। দ্বিধান্বিত কণ্ঠে বলল,
-” মারা গেছেন? উনি নেই”?
-” না রে। রোগটা যে বড়সড়। বাঁচানো সম্ভব হয়নি। কিন্তু তুই এ কথা জিজ্ঞেস করছিস কেন নাজু? কি হয়েছে”?
-” তোকে সবটা বলবো। কিন্তু কথা দে উনার মৃত্যুর কথাটা তুই আর কাউকে বলবি না। এমনকি তুই যে উনাকে চিনিস এ কথাও কাউকে জানাবি না”।
ফোন কেটে শেহনাজ ধীর পায়ে বসল খাটে। হৃদয় ভার হয়ে উঠল ওর। ব্যথা অনুভব করল। এমিরকে এ কথা কি করে জানাবে ও? কি করে বলবে সাবিহা আপু আর এ পৃথিবীতে নেই। এমির তো কষ্ট পাবে।
শেহনাজ এ কথা লুকিয়ে গেল। কাউকে বলল না। ছবিটাও ডিলিট করে দিল ফোন থেকে। কেউ কখনো হয়তো জানবে না যে সাবিহা নামের মেয়েটি হারিয়ে যায়নি। সৃষ্টিকর্তা তাকে নিয়ে গেছেন।
চলবে?