শেহনাজ পর্ব -১২

0
53

#শেহনাজ ____{১২}
লেখনীতেঃ #বৃষ্টি_শেখ

দুপুর বারোটা বেজে সাতান্ন মিনিট। সূর্য মাথার উপরেই। ঘেমে নেয়ে একাকার অবস্থা। পরণের কাপড় লেপ্টে আছে শরীরে। পিপাসা পেয়েছে ভিষণ। বাঁধা চুলগুলোর উপরিভাগ উড়ে বেড়াচ্ছে নিশ্চিন্তে। এমিরের হাতে শক্ত কাপড়ের ব্যাগ। অন্য হাতের মুঠোয় শেহনাজের হাত। ভীড় নেই তেমন। তবুও নিজের বউকে আগলে রেখেছে এমির। এভাবে চলাফেরা করার অভ্যেস নেই যে মেয়েটার।

ঘরে ঢুকতেই ভোটকা গন্ধ বের হলো ঘর থেকে। দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ কিনা। ঘরের দরজা জানালা খুলে জামাকাপড় ছাড়ল শেহনাজ। এমির ঢুকল গোসলখানায়। বেরিয়ে এসে জামাকাপড় সব গুছিয়ে রাখল দড়িতে। মুঠোফোন বেজে উঠল সেসময়। নয়ন কল করেছে। এমির ধরল ফোনটা। ওপ্রান্তের উচ্ছ্বসিত কণ্ঠ শোনা গেল,

-” দোস্ত, অভিনন্দন, তুই তো ভাই খেল দেখাই দিছোত”।

এমির সময় দেখল। অতঃপর স্বাভাবিক স্বরেই বলল,
-” রেজাল্ট পাবলিশ হয়েছে”?

নয়ন আরো প্রাণবন্ত কন্ঠে বলল,
-” হ ব্যাটা। তুই জেলার মধ্যে প্রথম হইছোস। সিজিপিএ থ্রি পয়েন্ট নাইন সিক্স”।

এমির থমকাল। বুক থেকে ভারি বোঝাটা নেমে গেল। প্রশান্তির শ্বাস ফেলল এমির। শীতল হলো বুকের ভেতরটা। এতদিনের পরিশ্রমের সার্থকতা খুঁজে পেল। মনে মনে আল্লাহ্ তায়ালার নিকট শুকরিয়া আদায় করল।

কোমল স্বরে জিজ্ঞেস করল,
-” তোদের রেজাল্ট”?

-” আমার আর রেজাল্ট, টু পয়েন্ট সেভেন টু। হাসান ভালো করছে। কড়কড়া থ্রি পয়েন্ট টুয়েন্টি পাইয়া পাশ”।

-” আর সাদাত”?

-” সাদাত এক পয়েন্টের লাইগা থ্রি পয়েন্ট মিস হইয়া গেছে। তুই আয় তাড়াতাড়ি। ট্রিট দিবি”।

কল কাটল এমির। পাশ থেকে শেহনাজ জিজ্ঞেস করল,

– কে কল করেছিল?

এমির শার্টের ভাঁজ খুলল। শার্টটিকে গায়ে জড়িয়ে আয়নার সামনে এসে শার্টের হাতা গুটিয়ে নিল। বলল,
-” নয়ন”।

-” নয়ন ভাই কি বলল? আজকে আপনার রেজাল্ট দিবে না”?

এমির তাকাল শেহনাজের পানে। মেয়েটা চাতক পাখির ন্যায় চেয়ে আছে তার দিকে। একটি খুশির খবর পাওয়ার অপেক্ষায় রয়েছে। এমির সে খুশি উপেক্ষা করতে পারল না। বলল,

-” রেজাল্ট দিয়েছে”।

শেহনাজ এগিয়ে এলো। চোখে মুখে তার আগ্রহের অভিব্যক্তি। এমিরের বাহু টেনে বলল,
-” আপনার সিজিপিএ কত এসেছে? বলুন না”।

-” থ্রি পয়েন্ট নাইন সিক্স”।

কথাটুকু বলতেই শেহনাজ লাফিয়ে উঠল। খুশিতে চোখ মুখ উজ্জ্বল হলো ওর। আনন্দের চোটে কথাই বের হলো না মুখ থেকে। কিছু সময় লাফিয়ে বলে উঠল,

-” এত্ত ভালো রেজাল্ট। আমার স্বামী এত্ত ভালো রেজাল্ট করেছে? উফফ কি যে আনন্দ হচ্ছে আমার”।

ভ্রূদ্বয় নাচাল এমির। চোখ ছোট ছোট করে ক্ষীণ স্বরে বলল,
-” এত স্বামী স্বামী করো, লজ্জা করে না? বয়স কত তোমার”?

ওড়না দিয়ে মুখ ঢাকল শেহনাজ। লজ্জা পাওয়ার ঢং করল। বলল,
-” আমার একটু লজ্জা শরম কম”।

মিছে রেগে উঠল এমির। ভারিক্কি কণ্ঠে বলে উঠল,
-” মাইর দিবো শেহনাজ। সবসময় উল্টাপাল্টা কথা। ভদ্রতা সভ্যতা কিচ্ছু নেই”।

শেহনাজ মিটিমিটি হাসল। এমিরকে আরেকটু রাগিয়ে দিতে ইচ্ছে হলো ওর। এমিরের গা ঘেঁসে দাঁড়াল সে। এমিরের উচ্চতা পাঁচ ফুট এগারো ইঞ্চি। সে তুলনায় শেহনাজের মাথা তার ঘাড়ের কাছে ঠেকে।

নাটকীয় ভঙ্গিতে ওড়না আঙ্গুলে পেচাতে পেচাতে শেহনাজ বলল,

-” ভাগ্যিস ভদ্রতা সভ্যতা নেই। আমার অতিরিক্ত লজ্জা শরম থাকলে এ জন্মে আপনার বাবা ডাক শোনা হবে না”।

এমির ভড়কায়। এতটুকু একটা মেয়ে তাকে নাস্তানাবুদ করছে? ভাবতেই খানিক বিব্রত হয় সে। শরীরের লোম গুলো কেঁপে উঠে। মেয়েটা এত নির্লজ্জ কেন?

এমির মানিব্যাগ পকেটে ঢুকাতে ঢুকাতে বলে,
-” ঠাডিয়ে চড় খেলেই তুমি ঠিক হবে। এসব কথা বলার লাইসেন্স তোমাকে কে দিয়েছে”?

-” বিয়ে করলে এসব লাইসেন্স আপনাআপনিই চলে আসে”।

______

হাসান দাঁড়িয়ে আছে একটি দোকানের ছাউনির নিচে। মৃদ্যু বাতাস বইছে। ধরণী নিজের রুপ পাল্টে মোলায়েম হয়ে গিয়েছে। গাছের পাতাগুলো হেলেদুলে নাচছে। পরিবেশটাকে ভিষণ সুন্দর মনে হচ্ছে।

হাসানের গায়ে ধূসর শার্ট। চোখে চিকন ফ্রেমের চশমা। হাতে বাদামি রঙের ঘড়ি। স্বচ্ছ চোখে আশপাশে চায় সে। তানিয়া এগিয়ে আসছে। পরণে হালকা গোলাপী রঙের সুতির থ্রিপিস। হাতে ব্যাগ। হাসানকে দেখেই সালাম দিল সে। বিনিময়ে হাসান হেসে সালামের উত্তর নিল। একত্রে সম্মুখে হেঁটে যেতে যেতে তানিয়া জিজ্ঞেস করল,

-” ঊর্মিকে আপনার কেন প্রয়োজন জানতে পারি”?

হাসান চুপ রইল। খানিক ভেবে বলল,
-” সেদিন তো কারণ টা তোমায় বলেছিলাম”।

তানিয়া মুচকি হাসল। বলল,
-” বলেছিলেন। কিন্তু কারণ টা আমার ঠিকঠাক লাগেনি”।

হাসান কিছুই বলল না। তানিয়া পরবর্তীতে আর কোনো প্রশ্ন করার সাহস পেল না। ঊর্মির বাসার কাছে এসে হাসানকে বলল,
-” ঊর্মির শ্বশুরবাড়ি এটা। আপনাকে নিয়ে গেলে ও আবার রেগে যাবে না তো”?

ললাটে ভাঁজ পরল হাসানের। ভ্রু বাকিয়ে বলল,
-” রাগ করবে কেন”?

বোকা হাসল তানিয়া। দু ঘাড় উঁচু করে বলল,
-” জানি না। মনে হলো তাই বললাম”।

ওরা ঊর্মির ফ্ল্যাটে এসে পৌঁছাল। কলিং বেল চাপল ঊর্মি। মেয়েটা শেহনাজের মতোই চটপটে। কলিং বেল চেপেই পা নাচাতে শুরু করল তানিয়া। দরজা খোলার অপেক্ষা করতে লাগল। তানিয়ার অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে ঊর্মিই দরজা খুলল। তানিয়াকে দেখে গাড় হাসল ঊর্মি। বলল,
-” তুই? বলিসনি তো আসবি”?

তানিয়া জড়িয়ে ধরল বন্ধুকে। উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বলল,
-” তোকে সারপ্রাইজ দিবো বলেই আগে জানাইনি। নে আমাদের এবার ঢুকতে দে ঘরে”।

আমাদের শব্দটি শুনে ঊর্মি তানিয়ার পাশের ব্যক্তিটির উপর নজর রাখল। খানিক অবাক হলো ঊর্মি। হাসানের দিয়ে তাকিয়ে খুব স্বাভাবিক স্বরে বলে উঠল,
-” আপনি? কি মনে করে? আসুন ভিতরে”।

হাসান আর তানিয়া ঢুকল ঘরে। ফ্ল্যাটটা বেশ শৌখিন। দুটো ঘর রয়েছে। রান্নাঘর আর ওয়াশরুম ঘরের সাথেই। পরিপাটি এ ঘরটিতে পা রাখতেই হাসানের অস্বস্তি লাগতে শুরু করল। কেন এসেছে জিজ্ঞেস করলে কি উত্তর দিবে সে? বলবে যে তাকে কেন ঠকানো হয়েছে তা জানতে এসেছে? কিন্তু বলে কি কোনো লাভ হবে? ঊর্মি যদি বলে সে হাসানকে ওভাবে দেখেইনি। এছাড়া ঊর্মি তো এমন কোনো ইঙ্গিত ও দেয়নি। কিসের ভিত্তিতে এত বড় অভিযোগ তুলবে হাসান”?

তানিয়া আর হাসানকে খাটেই বসতে দিল ঊর্মি। শাড়ির আঁচল টেনে তানিয়ার উদ্দেশ্যে বলল,
-” উনাকে কোথায় পেলি”?

-” মেসেঞ্জারে। তোর আর আমার ছবি ছিল না প্রফাইলে? দেখে বলল আমি তোকে চিনি কিনা। আর তোর বাড়িতে নিয়ে আসতে বলল”।

হাসল ঊর্মি। মেয়েটা একটুও ঘাবড়ায় না; লজ্জা, সংকোচ কোনোকিছুই নেই মেয়েটার মাঝে। হাসান সে মুখ বারবার দেখে। তা দেখে ঊর্মী তানিয়াকে বলে,
-“রান্নাঘরে গরম পানি আছে, একটু চা বানিয়ে নিয়ে আয় তো”।

তানিয়া ঊর্মির খুব ভালো বন্ধু। তার এহেন আদেশে তানিয়া মোটেই বিরক্তিবোধ করল না।বরং হাসি মুখে রান্নাঘরের উদ্দেশে পা বাড়াল। ঊর্মি হাসানকে প্রশ্ন করল,
-” আমাকে দেখতে এসেছেন”?

কেশে উঠল হাসান। চোখ দুটো জ্বলে উঠল। বলল,
-” ওই আর কি। দেখতে এলাম বিবাহিত জীবন কেমন কাটছে”।

-” বিয়ের মাত্র সপ্তাহ খানেক হয়েছে। এখন তো জীবন সুন্দর কাটবেই। ভবিষ্যতে কি হবে বলতে পারছি না”।

-” লাভ ম্যারেজ “?
-” হ্যাঁ”।

হাসান চুপ করে রইল। বলার মতো কোনো কথাই খুঁজে পেল না। ঊর্মি নিজেই বলল,
-“আপনি কি আমাকে ভালোবেসে ফেলেছিলেন”?

হাসান চমকাল। ঊর্মি তবে সব জানে? সব বুঝে? তাহলে এমন করল কেন”?

-” আপনার কি মনে হয়”?

-” আমার যা মনে হয় আমি তা বলে দিয়েছি”।

দীর্ঘ শ্বাস ফেলল হাসান। আক্ষেপের সুরে বলল,
-” আমাকে বারণ করেননি কেন”?

-” কেউ আমাকে ভালোবাসলে আমার ভালোই লাগে। এতে নিষেধ করার কি আছে? এটা সম্পূর্ণ আপনার ব্যক্তিগত বিষয়”।

-” এক বারও ভাবেননি অপর ব্যক্তি ভেঙেচুরে যাবে কিনা”?

-” ভালোবাসলে ভাঙতেই হবে। এটা কি স্বাভাবিক নয়”?

-” ইচ্ছে করে এমনটা করলেন”?

হাসল ঊর্মি। বলল,
-” না ইচ্ছে করে নয়। আপনার সাথে যখন আমার দেখা হয়েছিল তখন আমার বয়ফ্রেন্ডের সাথে আমার সম্পর্ক ঠিক ছিল না। বিয়ের দু দিন আগে ও সবটা ঠিক করে দিল আর বাড়িতে বিয়ের প্রস্তাব পাঠাল। ব্যাস আমিও রাজি হয়ে গেলাম”।

হাসান চুপ করে রইল। উক্ত কথার বিপরীতে আর কোনো কথা বলাই সাজে না। নিজের অনুভূতি কে তাচ্ছিল্য করল হাসান। টলটলে চোখে কেবল বলল,
-” এত এত সুখ আপনার সহ্য হোক”।

ঊর্মি থমকাল। কেঁপে উঠল সর্বাঙ্গ। হাসান কি তাকে অভিশাপ দিচ্ছে? কিছু বলার আগেই তানিয়া এলো। হাতে তিন চাপ কড়া চা। প্রথমেই চায়ের কাপটি হাসানের হাতে তুলে দিল তানিয়া। এরপর টুকটাক গল্প করতে গিয়ে সন্ধ্যে হলো। তানিয়া ব্যাগ গোছাল। বলল,
-” থাক, আমি যাই। সন্ধ্যে হয়েছে”।

হাসান উঠে দাঁড়াল। বলল,
-” আমিও যাবো।

ঊর্মির উদ্দেশ্যে বলল,
আসছি”।

দুজনেই বেরিয়ে এলো। দরজা আটকে দিতে পিছু এলো ঊর্মি। সে কেবল চেয়ে রইল হাসানের দিকে। আশ্চর্য মানুষটার জন্য তার অন্তর পুড়ছে। দুদিনের কিছু ঠুনকো আলাপে এত দহন আসে কোথা থেকে বুঝতে পারে না ঊর্মি। তবে কি হাসান একটু বেশিই তার প্রেমে মজেছিল?

তানিয়া আর হাসান হাঁটছে পাশাপাশি। হাসান বলল,
-” অটোতে যাবে”?

-” হুহু, আপনি”?

-” একসাথে গেলে অসুবিধে হবে? নইলে দুটো অটো নিতে হবে”।

নাকচ করল তানিয়া। বলল,
-” সমস্যা নেই। একই তো পথ”।

অটো চলল দ্রুত গতিতে। মাঝ রাস্তায় এসে বাঁধল জ্যাম। তানিয়া সে সুযোগ নিল। বলল,
-” ঊর্মির সাথে কি আপনার অন্যরকম সম্পর্ক ছিল”?

হাসান তখনই উত্তর দিল না। ধীর কণ্ঠে বলল,
-” না। তেমন কোনো সম্পর্ক ছিল না। যা ছিল তা একপাক্ষিক আর অপ্রকাশিত”।

তানিয়া একটু থেমে বলে,
-” আমরা আমাদের জীবনে অধিক প্রত্যাশা রাখি। সেই প্রত্যাশা যখন পূরণ না হয় তখন ভেঙে পড়ি। এজন্য জীবনে প্রত্যাশা রাখতে নেই। আমরা যাকে ভালোবাসি সেও যে আমাদের ভালোবাসবে এমন কোনো প্রত্যাশা রাখতে নেই। আপনি যাকে ভালোবাসেন সে অন্য কাউকে আপনার মতো করেই ভালোবাসবে এটা স্বাভাবিক। আপনার যেমন তাকে পছন্দ তেমনই তার অন্য কাউকে পছন্দ। আপনি যাকে গুরুত্ব দিবেন সেও যে আপনাকে একই সমপরিমাণ গুরুত্ব দিবে এটা ভাবা ভুল। প্রত্যেকের নিজ নিজ পছন্দ থাকতে পারে, রুচি থাকতে পারে। এটাকে যত সহজ ভাবে নিবেন তত জীবন সুন্দর”।

হাসান তাকিয়ে রয় তানিয়ার দিকে। তানিয়া পুনরায় বলে ওঠে,
-” পৃথিবীতে এত এত মানুষ থাকতে আপনি ঊর্মিকেই ভালোবেসেছেন। তেমনি ঊর্মিও এত এত মানুষের মাঝে অন্য কাউকে ভালোবেসেছে। এতে আপনাদের কারোরই দোষ নেই”।

তানিয়ার বাড়ির সামনে এসে অটো থামল। নামল তানিয়া। পার্স থেকে টাকা বের করে দিল। যাওয়ার সময় হাসানের উদ্দেশ্যে বলল,
-” দুর্ভাগ্যবশত আপনার আর ঊর্মির কথোপকথন আমি শুনে ফেলেছি। কিছু মনে করবেন না প্লিজ”।

_______

চুলোয় ভাত বসিয়েছে শেহনাজ। ঘুমে ঢুলছে সে। এমির এতক্ষণ বাইরে ছিল বন্ধুদের সাথে। ফিরেছে ন টার দিক। শেহনাজের জন্য বাইরে থেকে মোরগ পোলাও এনেছে এমির। হাফ প্লেট খেয়ে পেট কিংবা মন কোনোটাই ভরেনি শেহনাজের। রাত দুটো বাজতেই পেট গুড়গুড় করছে ওর। এমিরকে বলে লাভ হয়নি। এমির ওঠেইনি। পাত্তা দেয়নি শেহনাজের কথাকে। তাই শেহনাজ নিজেই উঠে রান্না করতে এসেছে।

চাল ফুটেছে। এমির ঘুমে। শেহনাজ ভাতের মার গালতে পারে না। কিভাবে কি করবে বুঝে উঠতেও পারছে না। মাথাটা ভনভন করছে। নিশ্চিন্তে ঘুমোনোর বদলে কিনা রাত বিরেতে রান্না করতে উঠেছে? এ দিন ও দেখতে হবে শেহনাজকে? ভাবেনি কস্মিনকালেও। কাপড় দিয়ে পাতিলের দু প্রান্ত ধরে মার গালতে লাগল শেহনাজ। হঠাৎ কাপড়ের নিচের উত্তপ্ত অংশ লাগল শেহনাজের হাতে। উত্তপ্ততায় পাতিলের এক প্রান্ত ছেড়ে দিতেই গরম মার পরল শেহনাজের হাতে। অনিচ্ছাকৃত অস্ফুটে শব্দ বের করল শেহনাজ। চামড়া জ্বলে উঠল ওর। ব্যথায় গুঙিয়ে উঠল সাথে সাথে। লাল লাল ফোসকা পরতে দেরি হলো না। নিশ্চল শরীরটা কেঁপে উঠল ব্যথায়। শিরা উপশিরা সেই অসহ্যকর ব্যথার জানান দিল।

শব্দের দাপটে ধরফর করে উঠৈ বসল এমির। ছুটে এলো শেহনাজের নিকট। শেহনাজ মুখে হাত চেপে কাঁদছে। জ্বলনে কাঁপছে ওর গা। চোখ গুলো লাল হয়ে গেছে। এমির দ্রুত নিজের ব্যাগ চেক করল। সেখান থেকে এক প্রকার মলম আনল। শেহনাজের হাতটা প্রথমেই ধরল ঠান্ডা পানির নিচে। অতঃপর ধীরে সুস্থে মলম লাগিয়ে দিল। শেহনাজ তখনও কাঁদছে। এত জ্বলছে যে হাত বুঝি অবশ হতে চলেছে। এমির সেথায় ফু দিতে দিতে বলল,

-” এত রাতে কে তোমাকে রান্না করতে বলেছে? আমাকে ডাকলে না কেন”?

ফুপিয়ে উঠল শেহনাজ। চোখ মুছে বলল,
-” খিদে পেয়েছে আমার। কি করবো”?

এমির শেহনাজের করুণ চোখের পানে তাকাল। বক্ষস্থল কেঁপে উঠল এমিরের। নিজেকে খুব ঘৃণ্য বলে মনে হলো। মেয়েটার খিদে পেয়েছে আর সে কিনা পরে পরে ঘুমোচ্ছে? স্বামী হিসেবে তার কি কোনো দায় নেই?

উঠে দাঁড়াল এমির। বলল,

-” আমি রান্না করছি। তুমি বসো। উঠবে না”।

এমির মেঝেতে পরা সবগুলো ভাত তুলল। বাকি ভাত টুকু সযত্নে মার গালল। ফারজানা ব্যাগে করে গাছের কুমড়ো আর কিছু সবজি দিয়ে দিয়েছিল। এমির সে সবজি গুলো দিয়ে খিচুড়ি রান্না করল। সবকিছু কেটেকুটে বসিয়ে দিল চুলায়। শেহনাজকে ধারে কাছেও ঘেঁষতে দিল না। রান্না শেষে গরম গরম খিচুড়ি শেহনাজের প্লেটে বেরে দিল। শেহনাজের হাতের অবস্থা শোচনীয়। এ হাত দিয়ে আর খাবার খাওয়ার উপায় নেই। এমির বুঝল। হাত ধুয়ে এসে হাতের আঙ্গুলে লোকমা তুলে খাইয়ে দিল শেহনাজকে। শেহনাজ হতভম্ব চোখে চেয়ে রইল শুধু। তা দেখে হাসল এমির। বলল,

-” তোমাকে আর রান্না ঘরে যেতে হবে না। টিউশন করে এসে আমিই রান্না করবো”।

শেহনাজ মুখের খাবার টুকু গিলে বলল,
-” আপনার কষ্ট হবে না”?

পুনরায় হাসল এমির। খিচুড়ি মাখাতে মাখাতে বলল,
-” পুরুষ মানুষের আবার কিসের কষ্ট? শখের নারীর জন্য তারা সব কিছু করতে পারে”।

কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে তাকাল শেহনাজ। সে কি ভুল শুনল? এমির তাকে শখের নারী বলল? নিজের দ্বিধা দূর করতে শেহনাজ বলল,

-” আমি আপনার শখের নারী”?

এমির শেহনাজের কথাকে উপেক্ষা করল। গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
-” কানে কম শোনো? আমি বলেছি শোকের নারী। তুমি আমার জীবনের তিনমাত্র শোক শেহনাজ। তাই শোকের নারী বলেছি”।

________

ঘরে ভালো বালিশ নেই, তোষক নেই। জামাকাপড় রাখার মতো আলমিরা নেই। দু তিনটে প্লেট আর দুয়েক হাড়ি পাতিল ব্যতিত আর কিছুই নেই ঘরে। নতুন বলতে এমিরের চেয়ার টেবিল পাতা হয়েছে শুধু।

এমির গিয়েছে চাকরির ইন্টারভিউ দিতে। আজ পরিপাটি হয়ে ফর্মাল ড্রেস আপে এমির নিজেকে গুছিয়েছে। হাতে ফাইল পত্র নিয়ে স্বপ্নের দিকে ছুটেছে। শেহনাজ চিন্তিত। খুব করে চাইছে ইন্টারভিউ গুলো ভালো হোক। এমিরের একটা ভালো চাকরি জুটে যাক। শেহনাজ এ বিষয়ে মানত ও করে ফেলেছে। এমিরের চাকরি হলে তাদের সংসারে আর কোনো অভাব থাকবে না। তিন বেলা পেট পুড়ে খেয়ে, সুন্দর ভাবে জীবনযাপন করতে পারবে তারা।

দুপুরের দিকে ফিরল এমির। ঘর্মাক্ত শরীরে প্রবেশ করল ঘরে। শেহনাজ এগিয়ে এলো সাথে সাথেই। জিজ্ঞেস করল,

-” ইন্টারভিউ কেমন হয়েছে”?

এমিরের চাহনি মলিন। বোঝাই যাচ্ছে চাকরি হয়নি। শেহনাজ এ বিষয়ে আর প্রশ্ন করল না। আদর্শ গৃহিনীর মতো লেবুর শরবত বানিয়ে এমিরের মুখের সামনে ধরল। এমির শরবত টুকু এক দমে খেয়ে ফেলল। কিছুটা তৃপ্তি বোধ করল। ত্যক্ত কণ্ঠে বলল,

-“শুধু শুধু এতদিন এত কষ্ট করে পড়াশোনা করেছি। কোনো সার্কিফিকেট-ই কাজে লাগল না। ইন্টারভিউ ভালো হলে বলে দু-চার লাখ টাকা দিতে। এরকম চাকরি নাকি ফ্রিতে পাওয়া যায় না। আরেহ্ ভাই আমার যোগ্যতা থাকলে তুই কেন আমাকে চাকরি দিবি না”?

শেহনাজের ভারী মন খারাপ হলো। তা সে বুঝতে দিল না। হাসি হাসি মুখে বলল,

-” আজ হয়নি কাল ঠিকই হবে। আপনার তো টিউশনি গুলো আছেই”।

হতাশ চোখে তাকাল এমির। শেহনাজকে পাশে বসতে ইশারা করল। শেহনাজ বসে পরল এমিরের পাশে। ক্লান্ত কণ্ঠে এমির বলল,

-” তোমার পড়াশোনার কি হবে? কতদিন মিস গেল ভেবে দেখেছো”?

শেহনাজের মন কিছুটা খারাপ হলো। বলল,

-” আব্বু তো পড়াশোনার খরচ দিবে না। আপনার উপর খুব চাপ পড়বে”।

এমির বাঁধ সাধল। বলল,
– কাল থেকে কলেজে যাবে বাকিটা আমি দেখে নিবো”।

শেহনাজ খুশি হলো। বলল,
-” সত্যিই যাবো”?

হাসল এমির। বলল,
-” হ্যাঁ যাবে। ঠিকমতো পড়াশোনা করবে। একটা না একটা ব্যবস্থা ঠিক হবে”।

মাঝ রাতে হুট করে কারেন্ট চলে গেল। ঘুমন্ত শেহনাজ জেগে উঠল তখনই। গরমে ঘুমোতে পারছে না বেচারি। মশা গুলোও জ্বালাচ্ছে ব্যাপক। কয়েলে কাজ হচ্ছে না। শেহনাজ ভারী বিরক্ত। ঘুমু ঘুমু কণ্ঠে সে বলে ওঠে,

-” মশাগুলোর সমস্যা কি? এত কামড়াচ্ছে কেন? ওদের মনে কি একটুও দয়ামায়া নেই? এভাবে একটা সহজসরল মেয়ের রক্ত গিলে খাচ্ছে”?

এমির নিজেও ঘুম থেকে উঠছে। গরমটা বেশ জাঁকিয়ে বসেছে। ফোনের ফ্ল্যাশ অন করল সে। শেহনাজের বুকে ওড়না নেই। ওড়না লুটিয়ে আছে মেঝেতে। প্লাজু হাঁটুর কাছাকাছি উঠে গেছে। গরমে মেয়েটা সব কিছু ভুলে বসেছে। এত যন্ত্রণা সহ্য করার ক্ষমতা যে শেহনাজের নেই তা এমির বোঝে। কিন্তু এই মুহুর্তে চার্জার ফ্যান কেনার সামর্থ্য এমিরের নেই। শেহনাজ যেসবে অভ্যস্ত তার কোনোকিছুই এমির দিতে পারবে না।

এমির ঘর হাতড়ে একটি হাত পাখা বের করল। শেহনাজের ওড়না টা উঠিয়ে ওর বুকে দিয়ে দিল। প্লাজু গোরালির কাছে নামিয়ে রাখল। শেহনাজের পাশে শুয়ে বাতাস দিতে লাগল। হাত পাখার শীতল বাতাস পেতেই শেহনাজ শান্তি অনুভব করল। তন্দ্রা লেগে গেল। এমির ঘুমাল না। যতক্ষণ না কারেন্ট আসে ততক্ষণই হাওয়া দিতে লাগল। শেহনাজ দেখল না এমিরের এই যত্ন। এমির বুঝতেও দিল না। কেবল চেয়ে রইল শেহনাজের পানে। বিড়বিড় করে বলল,

-” এ পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর স্ত্রী শেহনাজ। শেহনাজ, আলোকিত চন্দ্র। যে হৃদয়, মন এবং অঙ্গপ্রত্যঙ্গে জায়গা দখল করতে সক্ষম”।

পুনরায় বলল,
-” এ পৃথিবীর প্রত্যেকে জানুক, শেহনাজ নামে একটি মেয়ে আছে। যার ভালোবাসায় আমার শক্ত, পাথরের মতো অনুভূতিহীন হৃদয় গলেছে”।

চলবে?