শেহনাজ পর্ব -১৪

0
39

#শেহনাজ _____{১৪}
লেখনীতেঃ #বৃষ্টি_শেখ

যে বয়সে ছেলেমেয়েরা বাবা মায়ের স্নেহে, আদরে বড় হয়। সেসময়ে এমির বেড়েছে একা। একাকীত্ব সর্বদা পুড়িয়েছে তাকে। এমিরের আম্মার সাথে এমিরের বাবার অত ভালো সম্পর্ক ছিল না। একে এরশাদ ছিলেন ধনী জমিদার, তার উপর এলাকায় তার আলাদা একটা দাম ছিল। বলা চলে তিনি সম্মানীয় ব্যক্তি ছিলেন। তিনি স্ত্রীকে নিজের দাসী হিসেবেই প্রাধান্য দিতেন বেশি। সন্তানের জননী হিসেবেই শুধু মায়া-দয়া দেখাতেন। তখনকার সময়ের মানুষেরা স্ত্রী দের মূল্য বুঝতো না। নারীদের শক্তি, দক্ষতা, শ্রম সম্পর্কে বিন্দুমাত্র ধারণা ছিল না পুরুষদের। এমিরের আব্বা তাদের মধ্যেই একজন। স্ত্রীকে তিনি কেবল সন্তানদের মা এবং নিজের চাহিদা পূরণের সামগ্রী ভাবতেন। নারীর যে সাহস,আত্মত্যাগ বইয়ের পাতায় জ্বলজ্বল করে সেসব সম্পর্কে কোনো জ্ঞান ই ছিল না কারো।

এমিরের আম্মা মারা যাবার পর এমির নিজেকে গুটিয়ে ফেলেছিল। এমনটা তো সবার জীবনে ঘটে না। এমিরের বন্ধুরা তখন স্কুল থেকে মাস তিনেকের বন্ধ পেয়ে ঘুরছে, ফিরছে, পরিবারের সাথে সময় কাটাচ্ছে। অথচ সেসময় এমির দাবানলের মতো পুড়ছে। আম্মার মৃত্যুর শোক, বুবুর নিখোঁজ সংবাদ আর আব্বার এমন জানোয়ারের রূপ মেনে নিতে গিয়ে এমির হয়ে উঠেছিল উন্মাদ। পরিক্ষার এত ভালো ফলাফল তার উপর বিস্তর প্রভাব ফেলেনি। সৎ মা নিয়ে এক অজানা ভয় কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছিল এমিরকে। তার পর এমিরের সাথে যা হলো তা অকল্পনীয়। ছ মাসের জন্য কারাগারে আটকা পরল এমির। দুরন্ত, কৈশোর যখন প্রজাপতির মতো উড়ে বেড়াচ্ছে, এমির তখন দিন গুনছে মুক্ত হবার জন্য। এক রাশ যন্ত্রণা, উন্মাদনা এমিরকে করে তুলেছিল মানসিক রোগী।

সেই এমির আজ বদলেছে। এতটাই বদলেছে যে ঢাকা শহরের সব মানুষ তাকে চিনতে আরম্ভ করেছে। পত্রিকায় বিশাল আকারের ছবি বেরিয়েছে এমিরের। টেলিভিশনের শিরোনামের প্রথম ট্যাগ লাইনে রয়েছে এমির সাখাওয়াতের নাম।

শেহনাজ তার সবচেয়ে সুন্দর জামাটা আজ পরল। এমির তাকে এই নীল রঙের কারুকাজ করা ফোর পিস কিনে দিয়েছিল তাকে। শেহনাজ নিজেকে আজ বহুদিন বাদে গোছাল। নতুন রূপে সাজিয়ে তুলল। চুল গুলোকে আচড়ে স্টাইল করে চুল বাঁধল। চোখে গাড় করে কাজল নিল সে। হাতে দুটো চুরি। নাকে সিটিগোল্ডের নাকফুল। পায়ের জুতোটাও পরিষ্কার। আয়নায় নিজেকে দেখে চমকাল শেহনাজ। এতদিন পর সে সেজেছে। সেই আগের মতো লাগছে ওকে। সব সুখ যেন আছড়ে পরছে শেহনাজের মুখে।

এমির কালো রঙের শার্ট পরল। ডেনিমের প্যান্ট পরল। কম দামী পারফিউম নিল। শেহনাজকে দ্রুত বের হতে বলে বাইরে এসে অটো যোগাড় করল এমির। শেহনাজকে এভাবে নামতে দেখে এমিরের বুকটায় হরতাল শুরু হলো। প্রেমে পড়ার এক আলাদা অনুভূতি জাগ্রত হলো। বিমোহিত হয়ে তাকাল এমির। প্রেমিকের ন্যায় অবিশ্রান্ত চোখ দুটি শেহনাজের শরীরের ভাঁজে ভাঁজে ছড়িয়ে গেল।

______

প্যান্ডেল সাজানো হয়েছে। ফুল দিয়ে গেট সাজানো হয়েছে। মাঠে সারি সারি চেয়ার বসানো হয়েছে। ক্যামেরা ম্যান গুলো ঘুরছে আশেপাশে। শেহনাজ এমিরের পাশে পাশে রইল। স্টেজের একদম সামনের সিটে বসল সে। অনুষ্ঠান শুরু হলো। বিভিন্ন লেকচারার লেকচার দিল। কলেজের বিভিন্ন আয়োজন, কার্যক্রম নিয়ে বক্তব্য দেওয়া হলো। এমির আশপাশে তাকাল। নয়ন, সাদাত, হাসান ওরা কোথায়? এমিরের এমন একটা সুন্দর দিনে কি ওরা থাকবে না? সাদাতকে কল করলে পায় না এমির। সবসময় ব্যস্ত দেখায়। এমিরের ধারণা সাদাত তাকে ব্লক করেছে। কিন্তু কেন? প্রশ্ন করার সময় নেই এমিরের।

হাসান, সাদাত, নয়ন এলো কিছু ক্ষণ বাদেঈ। এমিরকে দেখে সাথে সাথে এমিরের পাশের চেয়ার গুলোতে বসল ওরা। শেহনাজ প্রথমেই ওদের জিজ্ঞেস করল,

-” আপনাদের আসতে এত দেরি হলো কেন”?

নয়ন কিছু বলতে উদ্যত হতেই ওকে থামাল হাসান। বলল,
-” তা বলছি, কিন্তু একটা কথা বলো তো,- তোমাকে নাম ধরে ডাকবো নাকি ভাবি বলে ডাকবো”।

লজ্জা পায় শেহনাজ। বলে,

-” নাম ধরেই ডাকবেন ভাইয়া। আমার কোনো সমস্যা নেই”।

নয়ন বলল,
-” সামনে নির্বাচন না? রাস্তা ব্লক। আমরা তো এত পথ হাইটাই আইলাম”।

সাদাত চুপচাপ। এমির তা দেখে দুঃখ পেল মনে। বলল,
-” সাদাত, তোর খবর বল? সোহার সাথে সবকিছু ঠিকঠাক আছে”।

গুরুগম্ভীর হয়ে রয়েছে সাদাত। এমিরের প্রশ্নে সে কেবল মাথা দুলাল। বলল,
-” আছে”।

এমির সন্দেহ চোখে তাকাল। সাদাতের পাশের চেয়ারে এসে ওর কাঁধে হাত রাখল। বলল,
-“তুই কি আমার উপর কোনো কারণে রেগে? এভাবে কথা বলছিস কেন”?

-” রাগ করার মতো কি কিছু করেছিস? তাহলে রেগে থাকবো কেন”?

-” কি করেছি জানি না। কিন্তু আমি মাফ চেয়ে নিচ্ছি। বল না কি হয়েছে”?

সাদাত ফোস করে শ্বাস ছাড়ল। বলল,
-” তোকে সবসময় আমি একজন ম্যাচিওর মানুষ হিসেবেই জানতাম। কিন্তু তুই আমার ধারণাকে ভুল প্রমাণ করে দিয়েছিস এমির। শেহনাজের মতো একটা বাচ্চা, নিষ্পাপ মেয়ের জীবন নিয়ে রীতিমতো খেলেছিস তুই। বিয়ের পরদিন কে বাড়ি ছেড়ে চলে যায় বলবি আমায়”?

এমির এবার বুঝতে পারল বিষয়টা। শুধাল,
-” এজন্য রেগে আছিস”?

-” কেউ দেখেনি, আমি দেখেছি শেহনাজ কতটা যন্ত্রণা সহ্য করে থেকেছে তোর রেখে যাওয়া বাড়িটায়”।

সাদাত যদিও নিচু স্বরে বলল কথাগুলো। কিন্তু সব কথাই শেহনাজের কানে পৌঁছাল। সে দ্রুত সেখান থেকে চলে গেল। বন্ধুদের মাঝখানে তার থাকা ঠিক নয়। তার উপর তার বিষয়েই কথা হচ্ছে।

সাদাত বলল,
-” মেয়েটা তোকে ঠিক কতটা ভালোবাসে আমি বলে বোঝাতে পারবো না। এমন মেয়ে কোটিতে একটি পাওয়াও কষ্টকর। আর তুই ওকে ফেলে রেখে চলে গেলি। অথচ দ্যাখ এতকিছুর পর ও শেহনাজ তোর কাছেই। একটুও অবহেলা করেনি তোকে, অভিযোগ ও করেনি”।

এমির দমল। সে অনুভব করতে পারে শেহনাজের ভালোবাসা। কিন্তু এ সম্পর্কটাকে স্বাভাবিক গড়ে তুলতে যে ওর ও বেগ পোহাতে হয়েছে। অনেক ভেবেচিন্তে এমির সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে শেহনাজকে সে কখনোই ছাড়বে না। এতকিছু জানার পর ও যেহেতু শেহনাজ তার কাছেই রয়েছে, সেহেতু তাদের সম্পর্কে আর কোনো বাঁধা থাকা উচিত নয়”।

এমির সাদাতের হাত ছুঁয়ে বলল,
-“শেহনাজকে রেখে আর কোথাও কোনোদিন যাবো না। আমি ভেবেছিলাম শেহনাজের এসব প্রেমালাপ উঠতি বয়সের আবেগ, মোহ। সব সময় ওকে এ ব্যাপারে আমি বুঝিয়েছি। যখন নিজে বুঝেছি ওর এই প্রেমালাপ আবেগের বশবর্তী হয়ে বলা নয়, তখনই ঠিক করেছি ওকে ছাড়বো না। আগলে রাখবো সবসময়”।

সাদাত, হাসান আর নয়নের চোখ চকচক করে উঠল। নয়ন বলল,
-” সত্যিই ওকে মেনে নিয়েছিস তুই”।

এমির ঘাড় নাড়ল। সবাই খুব খুশি হলো। এরপর ভিড় বাড়ল। একে একে কলেজ এবং ভার্সিটির মানুষজনে ভরে গেল মাঠ। সকলেই শুভেচ্ছা জানাল এমিরকে। স্টেজে ডাকল বিনয়ী স্বরে। এমির উঠে দাঁড়াল। পাশ থেকে হাত তালি দিল শেহনাজ। খুশিতে নেচে উঠল ওর মন। এমিরকে ফুলের তোড়া দেওয়া হলো, সার্কিফিকেট আর মেডেল দেওয়া হলো। সাথে বিশেষ সম্মাননা হিসেবে অ্যাওয়ার্ড ও দিল। এমিরকে মাইক দেওয়া হলো। বলা হলো শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে কিছু বলতে। এমির দম নিল। কথাগুলো সাজাল গোপনে। অতঃপর বলল,

-” প্রথমে যদি আমার এ ফলাফলের কথা বলি, তাহলে বলবো এ ফলাফল আমি ডিজার্ভ করি। মাসের পর মাস বছরের পর বছর রাত জেগে কিংবা ভোরে, নিঃশব্দে, কোলাহলে রোবটের মতো বই নিয়ে পরে থেকে তবেই এ ফলাফল আমি অর্জন করেছি। পরিশ্রম করেছি, লক্ষ্যকে স্থির রেখেছি। উদ্দেশ্য গুলোকে প্রতি ধাপে ধাপে সাজিয়ে তবেই এতদূর আসতে পেরেছি। আমি ক্ষুধার জ্বালা সহ্য করেছি, কিন্তু বই নেই এ কথা সহ্য করতে পারিনি। তোমার যারা ইউটিউবে ট্রেন্ডিং রিলস খোঁজো, তারা আমার ইউটিউব, যোগাযোগ মাধ্যম ঘাটলেই বুঝতে পারবে কতটা রিসার্চ করেছি আমি। সবশেষে বলবো নিজের সাথে নিজেকে লড়তে হবে। মাথায় এটা সেট করে রাখতে হবে যে আমাকে পড়তেই হবে, পারতেই হবে। মনে রাখবে তোমার ফলাফল তোমাকে উচ্চ পর্যায় নিয়ে যেতে সক্ষম”।

______

শেহনাজ আর এমির যেন প্রেমিক-প্রেমিকার মতো। তারা একত্রে থাকে ঠিকই, কিন্তু একে অপরকে সেভাবে ছুঁতে পারে না। কেউ যেন বারবার বাঁধা দেয়। ওরা একসাথে ঘুরে,একসাথে খাওয়াদাওয়া করে বালিশে মাথা রেখে দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে থাকে অপলক। এমির রোজ সকালে উঠে রান্না বান্না করে অফিসে যায়। যাবার আগে শেহনাজকে অনেক আদেশ- নিষেধ জারি করে যায়। ফেরে রাত বারোটায়। ব্যাংক বন্ধ হলেই চলে আসে বাড়িতে।

এমিরের হাতে টাকা পয়সা নেই। মাস গেলে তবেই হাতে টাকা আসবে। এ মুহুর্তে সব কিছু সামলানো তার জন্য কষ্টকর হয়ে উঠেছে। এক বেলা ভাতের সাথে তরকারি জুটলেও পরের বেলায় কেবল নুন ভাত। যদিও শেহনাজ কোনো অভিযোগ করছে না, তবুও এমিরের হৃদয় ঝলসে যাচ্ছে। শেহনাজের এত এত আত্মত্যাগ তাকে বারবার অনুতপ্তে দ্বগ্ধ করছে। মেয়েটার কি এসব খাওয়ার অভ্যেস আছে?

সকালে এমির বেরিয়ে যেতেই শেহনাজ নিজেও বের হলো। এলাকা ছেড়ে অন্য এলাকায় গিয়ে একটা বিশ্বস্ত স্বর্ণকারের দোকানে এলো। শেহনাজের হাতে সোনার ব্রেসলেট। সাইফুল আলম শেহনাজের প্রত্যেকটা জন্মদিনে দামী দামী উপহার দিতেন। কখনো সোনার নুপুর, কখনো ব্রেসলেট আবার কখনো হীরের ইয়ারিং। শেহনাজের কাছে এখন এসব কিছুই নেই। এত কিছু পড়তে ওর ভালো লাগতো না। হাতে কেবল ব্রেসলেট আর হীরের আংটি টা সবসময় পড়ে থাকতো সে। এখনো সেটি হাতেই আছে। শেহনাজ এসব বিক্রি করতেই এসেছে। গায়ে জড়িয়েছে কালো ফ্র্ক। ওড়না টা জড়িয়েছে মাথায়। মুখের অর্ধেক অংশ ঢাকা। দোকানে গিয়ে সে মুখ খুলল। হাতের ব্রেসলেট আর আংটি টা বিক্রি করে দিল। অনেকগুলো টাকা হাতে এলো ওর। খুশিতে নেচে উঠল শেহনাজের মন। ততক্ষণাৎ পাশের বাজারে গিয়ে গরুর মাংস কিনল, ডিম কিনল, ব্রয়লার কিনল। টুকটাক মসলাপাতি আর বাসমতী চাল কিনে ফিরল ঘরে।

শেহনাজ রান্না করতে পারে না। তবে চেষ্টা করল সব কেটেকুটে, ধুয়ে রাখার। এমির ফিরল রাতে। ক্লান্ত ছেলেটা। খিদে চেপে রেখেছে পেটে। ফিরেই এমির ব্যাগ টা রাখল চৌকিতে। শেহনাজ এমিরকে পেয়েই জড়িয়ে ধরল। নাক ফুলাল এমির। শেহনাজকে সরাতে সরাতে বলল,

-” আমি ঘেমে আছি শেহনাজ। সরো সরো। বাইরের ধুলাবালি লেগে যাবে”।

ঠোঁট বাকাল শেহনাজ। ছাড়ল না এক চুল। বলল,
-” আমার কোনো সমস্যা নেই। শুধু আপনি হলেই হয়”।

শেহনাজ বেশ খানিকক্ষণ এমিরকে জড়িয়ে রাখল। এমির কিছুই বলল না। শেহনাজ প্রশ্রয় পেল যেন। এমিরকে বুকে গেঁথে রাখার প্রয়াস চালাল। বেশ কিছুক্ষণ পর এমিরকে ছেড়ে দিয়ে খুশি মনে বলল,

-” আজকে একটু বিরিয়ানি রান্না করুন না। খেতে ইচ্ছে করছে”।

এমিরের মুখ খানা ছোট হয়ে গেল। বিবর্ণ, ফ্যাকাশে দেখাল। তবুও তা চেপে বলল,
-” আগে বলতে বাইরে থেকে আসার পথে নিয়ে আসতাম”।

-” উঁহু আপনার হাতের রান্না খাবো। সব কিছু আমি ধুয়ে, কেটে রেখেছি। আপনি শুধু রান্না বসাবেন”।

চমকাল এমির। বলল, ” সব আছে মানে”?

-” আজ বাজারে গিয়ে সমস্ত উপকরণ কিনে এনেছি”।

-” টাকা পেলে কোথায়”?

শেহনাজ আগে থেকেই ভেবে রেখেছিল কি বলবে। এর মধ্যে অনেকবার একা একা অনুশীলন ও করে ফেলেছে। তাই এমিরের এহেন প্রশ্নে সে থতমত খেল না। দৃঢ় আর আত্মবিশ্বাসের সাথে মিথ্যে বলল,

-” তানিয়ার কাছে অনেক গুলো টাকা পেতাম। আজ দিল। তাই সব কিনে আনলাম”।

এমির বিশ্বাস করতে চাইল না। শেহনাজ বলে উঠল,
-” বিশ্বাস হচ্ছে না? আচ্ছা আমি তানুকে কল করছি। ওকেই জিজ্ঞেস করুন”।

শেহনাজ ফোন উঠাল। তানিয়ার নম্বরে ডায়াল করার পূর্বেই থামাল এমির। বলল,

-” বিশ্বাস করেছি”।
শেহনাজ হাসল। দেখে মনে হচ্ছে খুব গর্বের একটা কাজ করে ফেলেছে সে। তানিয়াকে কল করা তার কেবল একটা কৌশল ছিল। সে জানতো এমির কল করতে না বলবে। এতটুকুতেই বিশ্বাস করবে ওকে”।

ওরা দুজন মিলে বিরিয়ানি রান্না করল। শেহনাজ সব কিছু এগিয়ে দিল এমিরের নিকট। শেহনাজ দুষ্টুমি করল ভিষণ। এক সাথে বসে খাওয়া দাওয়া করল। শেহনাজের পছন্দের একটা মুভি দেখে বেশ রাত করে ঘুমাতে গেল দুজন। শেহনাজ তৃপ্তি আর শান্তি নিয়ে ঘুমে তলিয়ে গেল।

____
মাঝরাতে শেহনাজের ঘুম ভেঙে গেল। বেলকনির দরজা অভ্যেসবশত খুলে রেখে ঘুমিয়েছিল শেহনাজ। সেখান থেকে কেমন ধুপধাপ আওয়াজ হচ্ছে। কে যেন কাঁদছে অসহায় ভাবে। শব্দটা কখনো গাড় হচ্ছে কখনো বা হালকা। পুরুষের আত্ম চিৎকার।

শেহনাজ অতি আবেগী, ভিতু, নরম মনের মানুষ। মাঝ রাতে এমন কান্নার শব্দ তাকে ভীত করে তুলল। এমিরকে ডাকল সে। দু ডাকেও এমির উঠল না। বেজায় ক্লান্ত কি না। শেহনাজ আর ডাকল না এমিরকে। মায়া হলো মানুষটার প্রতি। সন্দেহ, কৌতুহল তাকে এগিয়ে যেতে বাধ্য করল বেলকনিতে। ফোনের ফ্ল্যাশ অন করে শেহনাজ ধীর পায়ে এগিয়ে গেল বেলকনিতে। রাস্তা হলদেটে ল্যাম্পপোস্টের আলোতে আলোকিত। পিচ ঢালা রাস্তাটা পরিষ্কার। যানবাহন নেই কোনো। সেই হলদেটে আলোতে শেহনাজ এক অপ্রত্যাশিত ঘটনা ঘটতে দেখে চমকে উঠল। একজন পুরুষ দাঁড়িয়ে। বয়স ত্রিশের কম। পরণে সাদা পাঞ্জাবী আর সাদা ধুতি। তার সম্মুখেই হাঁটু গেড়ে বসে আছে বয়স্ক একজন লোক। অনুনয় করছ। দু হাত জড়ো করে ক্ষমা চাইছে। দাঁড়িয়ে থাকা পুরুষটি লোকটাকে ক্ষমা করছে না। একের পর এক চড় মেরে যাচ্ছে। বয়স্ক লোকটি কাঁদছে, চিৎকার করে কাঁদছে। তবুও পাষাণ ব্যক্তির মন গলছে না। সে বয়স্ক লোকটিকে সজোরে লাথি মারল। বয়স্ক লোকটি ছিটকে পরল রাস্তায়। ব্যথায় গুঙিয়ে উঠল। সাথে সাথে কয়েকটা লোক এসে বয়স্ক লোকটিকে মারতে আরম্ভ করল। পাঞ্জাবী পড়া লোকটি যেন এতে সুখ পেল। আরো ভয়ানক ভাবে মারতে নির্দেশ দিল বোধহয়।

শেহনাজ নির্বাক। থর থর করে কাঁপছে ওর শরীর। হাত পা অসাড় হয়ে আসছে। বয়স্ক লোকটি কাঁদছে। পুরো শরীর জুড়ে কাঁটাকাটি আর রক্তের প্রবাহ বইছে। শেহনাজ কি করবে ভেবে পায় না। এতগুলো লোক ওরা। কিভাবে বয়স্ক লোকটিকে সে বাঁচাবে? বাঁচাতে গিয়ে নিজেদের মরতে হবে।

শেহনাজ ফোনের ক্যামেরা অপশনে ঢুকল। কোথ্থেকে তার এই সাহস এলো জানা নেই ওর। ভিডিও করা শুরু করল শেহনাজ। বয়স্ক লোকটিকে কুড়াল দিয়ে কোপানো হলো রীতিমত। পায়ে পিষে দিল। হাতের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ আলাদা করতে লাগল। রক্তে মাখামাখি হয়ে উঠল রাস্তা। উত্তপ্ত, লাল রক্তে রাঙা হলো সেই লোকটির পাঞ্জাবী। চোখে মুখে লোকটির অবাধ আনন্দ। উচ্চস্বরে হাসে সে। পশুদের মতো ভয়ঙ্কর দেখায় লোকটাকে। বয়স্ক লোকটি ত্রিশ সেকেন্ড ছটফট করতে করতে মারা গেল রাস্তাথ মাঝেই। দেহখানা শান্ত হয়ে গেল। নড়চড় নেই কোনো। পরিবেশ টাও একদম শীতল হয়ে উঠল।

শেহনাজের চোখ বেয়ে গড়িয়ে পরল অশ্রু। হাত পা কাঁপছে ওর। হৃদপিণ্ড কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে। ঘেমেনেয়ে অস্থির শেহনাজ। ধরফর করছে বুকের উচাটন। চোখের সামনে ভেসে উঠছে বয়স্ক লোকটির অনুনয়, হাহাকার, ক্ষমা চাওয়ার ভঙ্গি। শেহনাজ ধীর পায়ে ঘরে ফিরল। চুপচাপ চৌকিতে উঠে শুয়ে পরল আগের মতো। সে রাতে ঘুম হলো না ওর। সারা রাত এক অস্বস্তি বিচরণ করল। ভয়াবহ তিক্ততায় পুড়ে উঠল ওর বুক। ফোনের স্ক্রিণে এখনো ভিডিও চলছেই। শেহনাজ ভিডিও টা অফ করে সেভাবেই শুয়ে রইল।

চলবে?