শেহরোজ পর্ব-১৩

0
419

#শেহরোজ — ১৩
#ইসরাত_জাহান_দ্যুতি
***

রোদের তেজ খুব। গাড়ির জানালাটা তাই বন্ধ করে দিতে চেয়েছিল শেহরোজ। ওর পাশে বসা শাজ তখন “একদম না” বলে কড়া নির্দেশ দিয়ে বসে। অথচ তারই কোলের ওপরে আরামে রোদ চড়ে বসে আছে। তাপে তার গা পুড়ে যাওয়ার মতো অবস্থা খেয়াল করে শেহরোজ ড্রাইভের মাঝেই জিজ্ঞেস করল আবারও‚ “তোমার গরম লাগছে নিশ্চয়ই? বন্ধ করে দিই?”

সিটে গা এলিয়ে শাজ ঘনঘন শ্বাস টানছিল নিজেকে সহজ রাখার জন্য। প্রশ্নটা শুনে শেহরোজের মুখপানে তাকাল। একটু চিন্তা বোঝা যাচ্ছে ছেলেটার চোখের তারায়। আবার সে প্যানিকড হয়ে পড়ে কি-না‚ এই ভয়ই হয়তো পাচ্ছে। তা বুঝে মৃদু হাসল শাজ। সায় দিলো‚ “করুন।”

“খারাপ লাগলে অবশ্যই জানাবে‚ ও.কে?”

“লাগছেই তো।”

শুনেই শেহরোজ উদ্বিগ্ন হয়ে উঠল‚ “গাড়িটা কি স্টপ করব?”

“আরে না না”‚ হেসে ফেলল শাজ। “আপনি রিল্যাক্সে চালান তো। আমি ঠিক আছি।”

“তাহলে বললে কেন খারাপ লাগছে?” কপাল কুঁচকে বলল শেহরোজ।

“সেটা অন্য মিনিংয়ে বলেছি। আসলে এবার পহেলা বৈশাখে আমরা ফ্রেন্ডস সুনামগঞ্জ যেতে চেয়েছিলাম। মিতুদের বাড়িতে। মিতু কত এক্সাইটেড ছিল। আর এখন আমার সহজ সরল সেই বন্ধুর কী অবস্থা!” আহত শোনালো শাজের কণ্ঠটা।

“শোনো শাজ‚ এ ব্যাপারেই কথা বলতে যাচ্ছিলাম তোমার সাথে।”

একটু গম্ভীর হয়ে উঠল শাজ। ভাবল‚ সাক্ষীর ব্যাপারে বলবে শেহরোজ। তাই ভার কণ্ঠে জানাল ওকে‚ “আপনাদেরকে সাক্ষী এনে দিতে পারছি না আমি। কেউ সাক্ষী দিতে রাজি নয়।”

“আর তা নিয়ে তোমাকে ভাবতেও হবে না৷ শুধু আমি যেটা বোঝাবো সেটা ধৈর্যের সঙ্গে বুঝতে চেষ্টা করলেই হবে।”

ভ্রু’কুটি করে উৎসুক হয়ে তাকাল শাজ। শেহরোজ বলল তখন‚ “তুমি একটা ব্যাপারে কনফার্ম হতে পেরেছ যে‚ কোনো একটা শক্তিশালী শত্রুপক্ষ তোমাকে তুলে নিতে চাইছে বেশ অনেকদিন যাবৎ। কিন্তু আল্লাহর মেহেরবানিতে বেঁচে গেছ। এখন এই ব্যাপারটার একটা সুরাহা না হওয়া অবধি কিংবা তোমার এই বিপদ না দূর হওয়া অবধি খুবই খুবই কেয়ারফুল থাকতে হবে তোমাকে৷ আমার মতে‚ ভার্সিটি যাতায়াতটাও কিছুদিন বন্ধ রাখা উচিত ছিল তোমার৷ সেটা যেহেতু করতে রাজি না তুমি‚ সেহেতু তোমাকে চোখ-কান খোলা রাখতে হবে সর্বক্ষণ৷ এখন এর মাঝে ছাত্রশক্তির কারও সঙ্গেই কোনোরকম বিরোধ বা দ্বন্দে জড়ানোটা উচিত হবে না৷ মিতুর জন্য জাস্টিস আনতে গিয়ে নিজের ওপর বিপদ বাড়াতে চাও না নিশ্চয়ই? যারা দুবার ধাওয়া করেছে তোমাকে‚ তার মানে আরও বহুবার করবে তোমাকে বাগে না পাওয়া অবধি৷ এই বিপদের মাঝে ছাত্রশক্তির ঝামেলাকে ঘাড়ে টেনো না এখন। এটা কেবল আমার পরামর্শ বা উপদেশই নয়৷ অনুরোধও করছি।”

“অনুরোধ?” কথাগুলো শুনতে শুনতে শেষ কথাটা স্বগতোক্তি গলায় বলে উঠল শাজ। শেহরোজ তা শুনে সাবলীল সুরে বলল‚ “হ্যাঁ, অনুরোধই ধরো৷ সেদিন ছাদে আমাদের সেকেন্ড মুলাকাত থেকেই তোমাকে আমার ভীষণ স্পেশাল লেগেছে‚ ভালো লেগেছে৷ এখন আমরা দুজন দুজনের অজান্তেই ভালো বন্ধুও হয়ে গিয়েছি৷ সেই বন্ধু হয়েই অনুরোধটা করছি। মিতুর বিষয়টি অত্যস্ত পেইনফুল বটে৷ তুমি ওর কাছের বন্ধু হয়ে আজ হয়তো কিছু করতে পারছ না৷ কিন্তু মহান আল্লাহর ওপর ভরসা‚ বিশ্বাস রাখো৷ তিনি উপযুক্ত সময়ে ঠিক বিচারটা করে দেবেন ওর জন্য।”

“এর মানে আপনি বিশ্বাস করেছেন সাদিয়া, লাবণ্য, ওরা দোষী? আমাকে বিশ্বাস করেছেন?” বিস্ময় গলায় জিজ্ঞেস করল শাজ।

“কেন করব না?”

চটে গেল শাজ‚ “তাহলে গতকাল কেন ওদের কিছু বললেন না? উলটে আমাকে শাসালেন, সাক্ষী যোগাড় করে প্রমাণ করতে বললেন আমার অভিযোগকে।”

শেহরোজ হাসল‚ “আমি তখন গরম না হলে যে ইরা তোমাকে গেস্টরুমে নিয়ে যেত!”

“আপনি বলতে চাইছেন তখন আমাকে শাসানি, ধমকানি দিয়েছিলেন ওদের কাছ থেকে প্রোটেক্ট করার জন্য?” আবারও বিস্মিত হলো শাজ। উত্তরে শেহরোজের মুচকি হাসিটুকু ছাড়া আর কিছু পেলো না৷

এ ব্যাপারটার জন্য হঠাৎ ওকে ঘিরে শাজের মন প্রদেশে অর্থহীন, অবুঝ অনুভূতিগুলো অন্যমাত্রা লাভ করল যেন। বাকিটা পথ এ অনুভূতির উচ্ছ্বাসেই ডুবে রইল বলে ভুলে থাকল সে মায়ের করুণ স্মৃতিগুচ্ছকে।
***

দুপুর ১:৩০ ।

গতকালের ঝামেলার বিবরণ দিচ্ছিল অঙ্কন শাজদের কাছে৷ তানহা আর প্রিয়া আগ্রহের সঙ্গে শুনতে থাকলেও শাজের মনটা নেই এখানে৷ তার শুধু শেহরোজের কথায় খেয়ালে আসছে। তখন তার অনুষদের বাইরে নামিয়ে দিয়ে ছেলেটা চলে যায় নিজের কাজে। আর সে চলে আসে ক্লাসে। তারপর থেকে প্রায় দুটো ঘণ্টা পেরিয়ে গেছে৷ এই দুটো ঘণ্টাতেই মনে হচ্ছে কতক্ষণ দেখছে না ওকে। কী ভয়াবহ অবস্থা হচ্ছে তার! এভাবে ওকে মিস করতে থাকলে তো সে ঘরেও টিকতে পারবে না। কিন্তু অশান্ত‚ অবাধ্য মনকে বোঝায় কে? অঙ্কনের গল্পের মাঝেই হঠাৎ বসা থেকে উঠে পড়ল সে।

“কীরে‚ কী হলো?” গল্প থামিয়ে অঙ্কন অবাক স্বরে জিজ্ঞেস করল। তাকিয়ে আছে তানহা আর প্রিয়াও। ওদের চোখেও একই প্রশ্ন। কিন্তু তার কোনো জবাব না দিয়ে উলটে অঙ্কনকে জিজ্ঞেস করল শাজ‚ “তোদের রোজ ভাই এখন কোথায় থাকতে পারে?”

“খুব সম্ভব টিএসসিতে। কেন কী হইছে? তাকে আবার কী দরকার?”

ওদেরকে আরও অবাক বানিয়ে শাজ বিনা উত্তরে গ্রন্থাগার থেকে বেরিয়ে এলো। গন্তব্য টিএসসি। বন্ধুদের বেকুব চেহারাগুলো পেছন মুড়ে দেখারও প্রয়োজন বোধ করল না সে।

টিএসসি চত্বরে আসতে আসতে শাজ ভাবল নিজের বোকামির কথা। গত দুইদিনে কত কথা হয়েছে শেহরোজের সাথে! আজও এক সঙ্গেই আসলো তারা৷ অথচ ফোন নাম্বারটা বিনিময়ের কথা একবারও মাথায় আসেনি! এখন টিএসসিতে গিয়ে যদি দেখে শেহরোজ নেই — ব্যাপারটা কেমন বিরক্তিকর হবে? পিয়াল বা ঝুমা আন্টি‚ কারও কাছে কল করে নাম্বারটা যে চেয়ে নেবে সে উপায়ও নেই৷ ত্যাঁদড় পিয়াল তো দেবেই না বরঞ্চ বড়োভাইয়ের মতো ভাব দেখিয়ে ধমকানো আরম্ভ করবে। আর কার্টুন ঝুমা শেখের স্বভাব তো আরও সরেস। ভার্সিটিতে দুজন একসঙ্গে এসে নাম্বার চাওয়ার বেলায় কেন তাকে কল করা হয়েছে ‚ এ নিয়ে নিজের মতো কাল্পনিক ঘটনা বানিয়ে শোনাতে শোনাতে তার মেজাজই দেবে নষ্ট করে। অতএব ‚ ভাগ্যের ওপরই ভরসা করে শাজ পৌঁছল টিএসসি। এদিক-ওদিক চোখ বুলিয়ে খুঁজতে শুরু করল শেহরোজকে। আচমকা পেছন দিক থেকে সমস্বরে “হোওওওও” করে উঠল কারা যেন। ফিরে দাঁড়াল শাজ৷ হাত ছয়েক দূরে বসার জায়গাকে কেন্দ্র করে ছেলে-মেয়েদের জটলা পাকিয়ে আছে। ওরাই হাত তালি দিচ্ছে আর কী যেন বলছে। ফাঁকা থেকে সে দেখতে পেলো ইরা মির্জাকে — হাঁটু গেঁড়ে মেয়েটা বসে আছে হাতে গোলাপ নিয়ে। তুমুল কৌতূহল নিয়ে শাজ এগিয়ে এলো। এই নেত্রী মহাশয়া এভাবে কাকে ভালোবাসার আর্জি জানাচ্ছে? ভাবতে ভাবতে তখনই আবার সবার সমস্বর আর হাত তালিতে বেজে উঠল একটা বাক্য বারবার‚ “রোজ ভাই‚ হয়ে যান দুলাভাই।”

পরনে জিন্স, সাদা শার্ট, শার্টের বুকে ঝুলিয়ে রাখা গুচির কালো সানগ্লাস। আর সব সময়ের মতো পেছনে বাঁধা ছোট্ট ঝুঁটিটা। কিছুটা মৃদু হাস্যযুক্ত মুখে পকেটে এক হাত পুরে দাঁড়িয়ে আছে শেহরোজ ইরার সামনে। অথচ চোখের দৃষ্টি বরাবরের মতোই পাথর‚ শান্ত। সবার আনন্দ, উত্তেজনার মাঝে আত্মবিশ্বাসপূর্ণ চঞ্চল হাসিতে মুখরিত ইরার দিকে তাকিয়ে থাকল সে কিছুক্ষণ৷ তারপর সবার উল্লাসকে বাড়িয়ে দিয়ে গ্রহণ করে নিলো ইরার লাল গোলাপটিকে। মুহূর্তেই আরও একবার সবাই “হোওওও” করে উঠে হাত তালি দিতে থাকল।

“ব্রাভো”‚ বিড়বিড়িয়ে উঠল শাজ। দূরে দাঁড়িয়ে অনিমেষ চোখে সম্পূর্ণ মুহূর্তটুকু দেখল সে। চোখের পলক ফেলে হঠাৎ মাথাটা ঝাড়া দিয়ে উঠল৷ যেন অলীক জগত থেকে এক ঝটকায় বাস্তবে ফিরিয়ে আনল নিজেকে। ফিরে এলো সে৷ টিএসসি থেকে বের হতে হতে ভাবল‚ “বড়ো বাঁচা বেঁচে গেছিস‚ শাজ। লাকিলি এখানে পৌঁছেছিলি৷ নয়ত কি মোহভঙ্গ হতো তোর? সাচ আ স্টুপিড ইউ আর! ওর ওই অভিনব ফ্লার্টিংয়েই তুই মজে গিয়েছিলি? ধিক তোকে ধিক!”

আর এ জন্যই তবে মিতুর ঘটনা নিয়ে তাকে বাড়াবাড়ি করতে বারণ করেছিল শেহরোজ! সেও কী গাধার মতো ভেবে নিয়েছিল যে‚ ছেলেটা আসলে তাকে নিয়ে কত চিন্তিত। এমন বোকামির জন্য নিজের প্রতি রাগ‚ ঘৃণার সঙ্গে জেদটাও বাড়ছে শাজের। কিন্তু এই জেদের কোনো মূল্যায়ন সে দিতে পারবে না। কোনো শিক্ষার্থীকেই পাবে না সে সাক্ষী দেওয়ানোর জন্য৷

গত দুদিনের প্রতিটি মুহূর্ত এসে মানসপটে ভিড়তে চাইছে। শাজ আর সেসব ভাবনাকে জায়গা দিলো না মন ‚ মস্তিষ্কে ‚ কোনোখানেই। ভাবতে শুরু করল ‚ মিতুর ব্যাপারটা নিয়ে ঠিক কী করা যায়? হল প্রভোস্ট শওকতের সঙ্গে একবার কথা বলবে? সে কী বলে তা জানা যেত তাহলে। ভাগ্য সহায় হলে কোনো পদক্ষেপ যদি নেয়!

এই ভেবে রিকশাতে উঠে চলে এলো শাজ প্রশাসনিক ভবনের সামনে। ঠিক সে সময়ই ফোনটা বেজে উঠল। ব্যাগ থেকে ফোনটা বের স্ক্রিনে রনি নামটা দেখেই ক্ষিপ্ত মেজাজ আরও বিচ্ছিরি হলো৷ কল ধরবে না সে৷ কিন্তু সম্পর্ক ভাঙার পর আজ পর্যন্ত রনি কখনো ফোন করে বিরক্ত করেনি তাকে৷ তবে কি কোনো দরকারে কল করছে? ভেবে কলটা তুলল৷ সোজাসুজি জিজ্ঞেস করল রনি‚ “কোথায় তুমি?”

“কেন?” রুক্ষ কণ্ঠ শাজের।

“ভার্সিটি আছ জানি। ভিসির অফিসে আসো এখনই। স্যার অপেক্ষা করতেছেন।” বলেই কলটা কেটে দিলো রনি৷ কারণ সে জানে, এরপর শাজকে কথা বলতে দিলে শাজ তাকে প্রশ্নের পর প্রশ্ন করে তর্ক আরম্ভ করবে।

ফোনের দিকে ভ্রু কুঁচকে চেয়ে শাজ ভাবনায় পড়ল— ভিসির মতো মানুষ কেন অপেক্ষা করছে তার জন্য? রনিকে দিয়েই বা কেন ডেকে পাঠাচ্ছে তাকে? রিকশা ঘুরিয়ে রওনা হলো আবার ভিসি চত্বরে। চিন্তাভাবনা করতে করতে এসে পৌঁছলো ভিসির বাসভবনে। অফিসরুমে ঢুকতেই দেখা পেলো রনির। বসে আছে ভিসির সামনের চেয়ারে। সাথে আছে তার তিন সঙ্গীসাথী। তারা রুমের এক পাশে দাঁড়িয়ে। সেও গিয়ে দাঁড়াল টেবিলের কাছাকাছি। ভিসি তখন জিজ্ঞেস করল তাকে‚ “রনি বলছে বীরশ্রেষ্ঠ রুহুল আমিন হলে মাস্টার্সের তিন ছাত্রী অনার্সের এক ছাত্রীকে টর্চার করেছে? আর এ ব্যাপারে তোমার নাকি অভিযোগ আছে?”

হাতের তালু ঘামতে শুরু করল শাজের। অভিযোগ থাকলেও সে তো কোনো সাক্ষ্য প্রমাণ দিতে পারবে না৷ কী বলবে এখন ভিসিকে? রনির দিকে একবার বাঁকা চোখে তাকাল। মুখ ভরে গালি এসে জমা হচ্ছে তার৷ পায়ের জুতা খুলে এখন রনির গালে চাপড়াতে পারলেও শান্তি হবে না বোধ হয়। কোন সাহসে শয়তানটা এই মাতব্বরি দেখাতে এলো?

পায়ের ওপর পা তুলে বসা রনি। এক পা নাচাতে নাচাতে শাজকে বলল‚ “আমি গতকালের ঘটনা সবটাই শুনছি, শাজ। ক্যান্টিনের সামনে রোজ আর ইরা ওদের দলবল নিয়ে তোমারে হুমকি ধমকি দিছিল মিতুর বিষয়ে নাক না গলানোর জন্য। সেই কথাগুলোই স্যারকে জানাইছি আমি। তুমি খুলে বলো সব কিছু।”

শাজ কিছু বলার আগেই ভিসি বললেন‚ “ওর অভিযোগ শোনার সাথে তো যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করছে তাদের কথাও শুনতে হবে আমাকে৷ ঘটনা সত্য নাকি মিথ্যা‚ সেটা যাচাই-বাছাই করার জন্য দু পক্ষেরই কথা শোনা জরুরি। যে ভিক্টিম তাকেও প্রয়োজন। আই উইটনেসও প্রয়োজন।”

“স্যার‚ ব্যাপারটা নিয়ে আমার কোনো অভিযোগ নেই।” শাজ অপ্রতিভ হয়ে বলল‚ “এটা আসলে মিসআন্ডারস্ট্যান্ডিং হয়েছে আমাদের মাঝে৷”

চমকিত হয়ে রনির পা নাচানো থেমে গেল। “কী বলতেছ‚ শাজ? তুমি কি ওদের ভয় পাইতেছ? আমি তো আছি। তুমি মিতুর সাথে স্যারের কথা বলায় দাও।”

“রনি ভাই‚ আপনাকে ধন্যবাদ”‚ শাজ দাঁতে দাঁত চেপে কৃত্রিম হাসি মুখে বলল। “কিন্তু এটা নিয়ে আমার সত্যিই কিছু বলার নেই স্যারকে৷ কাউকে ভয়ও পাচ্ছি না আমি। রোজ ভাইয়ার সঙ্গে আমার আজই কথা হয়েছে। যে মিসআন্ডারস্ট্যান্ডিংটা হয়েছিল আমাদের মধ্যে সেটা মিটিয়ে নিয়েছি আমরা।”

“কী রনি?” বিরক্তির সঙ্গে বলে উঠলেন ভিসি‚ “এসব সামান্য ব্যাপার স্যাপারে প্রভোস্টকে ছেড়ে সরাসরি কেন আমার রুম পর্যন্ত চলে আসো?”

যথেষ্ট অপমানবোধ করল রনি‚ “স্যরি‚ স্যার। আসছি আমরা।”

শাজই সবার আগে বেরিয়ে এলো। ভবন থেকে বের হতেই পেছন থেকে রনি চেঁচিয়ে ডেকে উঠল ‚ “শাজ‚ দাঁড়াও। কথা আছে তোমার সাথে।”

একদম গেটের বাইরে এসে দাঁড়াল শাজ। রনি কিছু বলার আগেই তাকে উত্তপ্ত মেজাজে বলল সে‚ “আপনার সাথে আমার কাগজে কলমে কোনো সম্পর্ক আছে? রক্তের সম্পর্ক আছে? কোন সূত্রে তাহলে আমার হয়ে আগ বাড়িয়ে ভিসি পর্যন্ত চলে গেলেন? কোন সাহসে আমার ব্যাপারে ঢুকলেন আপনি? আপনার থ্যাবড়া নাকটা গলানো কবে বন্ধ করবেন? আপনার সাহায্যের প্রয়োজন হলে তো আমি বলতাম। বলিনি যেহেতু তখন নির্লজ্জের মতো এক্স-এর আগেপিছে কেন চোখ রাখেন? না-কি এখনো আমাকে এক্স ভাবেন না? এটাই হবে হয়ত। অলরাইট‚ আজকে থেকে যেন ভাবেন সেটার ব্যবস্থাই করছি।” বলা শেষেই শাজ হিতাহিতজ্ঞানশূন্যের মতো চেঁচিয়ে উঠতে গেল — উদ্দেশ্য তার আর রনির বিচ্ছেদের কথা বলবে আশেপাশের সবাইকে। আর তা বোঝা মাত্রই রনি হাতজোড় করে “মাফ চাইছি” বলে চেঁচিয়ে উঠল। থামল শাজও। রক্তচক্ষু নিয়ে শাজকে শেষবারের মতো দেখে বিদায় নিলো সে৷

দীর্ঘশ্বাস ফেলে চোখ‚ কপাল চেপে ধরে শাজ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল ওখানেই৷ সব কিছু এখন এত অসহ্য লাগছে যে, তার আর ইচ্ছে করছে না ভার্সিটি থাকতে। হ্যাঁ‚ আজ আর কোনো ক্লাস করবে না সে। প্রিয়াকে কল করে জানিয়ে দিয়ে পায়ে হেঁটেই এগোতে থাকল সে। হঠাৎ এসে কেউ দাঁড়িয়ে পড়ল সামনে৷ দৃষ্টি ঝুঁকিয়ে হাঁটছিল শাজ। চোখ তুলে দেখল সামনে নিরুদ্বেগ চেহারার শেহরোজকে।

“ভিসির কাছে গিয়েছিলে কেন?” জিজ্ঞেস করল শেহরোজ।

সঙ্গে সঙ্গেই মেজাজের পারদ যেন একশো দশ ডিগ্রি অতিক্রম করল শাজের। “আরে…!” বিস্মিত হওয়ার ভান করে সে বক্রোক্তি করল‚ “আপনিও দেখি আমার আগেপিছে চোখ লাগিয়ে রাখেন! ভীষণ স্পেশাল লাগছে তো নিজেকে।”

সরু দৃষ্টি ছুঁড়ল শেহরোজ৷ শাজের কথার বাঁকা সুরটা বুঝতে অসুবিধা হয়নি ওর৷ কিন্তু কেন এই সুরে কথা বলছে ওর সঙ্গে? বুঝতে না পেরে জিজ্ঞেস করল‚ “কী হয়েছে তোমার?”

“আমার পিছু পিছু কেন এসেছেন আগে সেটা বলুন”‚ চেঁচিয়ে উঠল শাজ। “ভিসির সঙ্গে আমার অ্যাপোয়েনমেন্ট থাকলে সেটা জিজ্ঞেস করার আপনি কে?”

“আমি বলিনি তো কেউ হই” ‚ ধীরস্বরে বলল শেহরোজ।

“তাহলে কেন জিজ্ঞেস করছেন? ওহো… এটা জানার জন্যই তো আমার পিছু পিছু চলে এসেছেন! মানে আপনার, আপনার সিনিয়র গার্লফ্রেন্ড আর তার চ্যালাদের বিরুদ্ধে সাক্ষী হাজির করে ফেলেছি না-কি সেই টেনশনে ঠিকঠাক সেলেব্রেটও করতে পারেননি মনে হয়। প্লিজ আপনি ‚ আপনার প্রেমিকা নিশ্চিন্ত থাকুন। আমার মতো সাধারণ এক শাজের এত হেডম নেই যে মহান ছাত্রশক্তির নেতা নেত্রীদের মুখে ঝাঁটা মারতে পারব।” রাগের সঙ্গে গলা চড়িয়ে অনর্গল কথাগুলো বলা শেষে ফোঁসফোঁস করে শ্বাস ফেলতে থাকল সে। গরমে আর রাগে মুখটাও লাল হয়ে উঠেছে তার।

আশেপাশের মানুষগুলোকে ওদের দিকে উৎসুক হয়ে চাইতে দেখে শেহরোজ মৃদুস্বরে বলল‚ “চলো ফুডকোর্টে গিয়ে বসি৷ লাঞ্চ করতে করতে কথা শুনব তোমার।”

“কী পরিমাণ হিপোক্রেট, চিটার আপনি!” চোখ-মুখ বিকৃতি করে শাজ ভর্ৎসনা করল‚ “একদিকে ইরা মির্জাকে সামাল দিয়ে অন্যদিকে আমাকে এসেও লাইন মারতে চাইছেন? মানে বাসা‚ ভার্সিটি, কোনোখানেই ছাড় দেওয়া চলবে না৷ ওয়েল‚ দোষটা আমারই৷ আপনি যে একজন উইমেনাইজার সেটা বুঝতেই পারিনি। গতকালও আমার অসহায়তার সুযোগ নিয়েছিলেন‚ তখনো বুঝলাম না। আরও কিনা আমি ঢলে পড়ছিলাম? শেইম অন মি!” ধিক্কার শেষে শেহরোজকে হুমকি দিলো সে‚ “ফারদার আমার ত্রিসীমানাতেও আপনি ঢুকবেন না।” তারপর আর দাঁড়াল না। ওকে পাশ কেটে হনহনিয়ে এগিয়ে গেল সামনে।

যেমনভাবে দাঁড়িয়ে ছিল শেহরোজ, তেমনভাবে দাঁড়িয়েই কেবল ঘাড় বাঁকিয়ে চেয়ে রইল শাজের গমন পথে। হাতের শক্ত মুঠোয় ইরার দেওয়া লাল গোলাপটা তখন পিষ্ট৷ আশেপাশের মানুষগুলোর কৌতুকপূর্ণ চাউনিগুলো দেখে ধারাল চোয়ালদ্বয় কঠিন হয়ে উঠল ওর৷ ওখান থেকে সামনে এগোলো সেও৷ শাজ চলে গেছে ততক্ষণে দৃষ্টিসীমার বাইরে।

ফোন লাগাল শেহরোজ সাব্বিরকে। দু সেকেন্ডেরও কম সময়ের মাঝে কানে গোঁজা ওয়্যারলেস ইয়ারবাডে শুনতে পেলো সাব্বিরের “ভাই” ডাক। জলদগম্ভীর কণ্ঠে আদেশ করল তাকে‚ “ও বেরিয়েছে। ভিসি চত্বরের এরিয়াতে চলে আসো ফাস্ট।”

“রজার দ্যাট৷” কলটা কাটতে গিয়েও সাব্বির সাহস নিয়ে জিজ্ঞেস করল শেহরোজকে‚ “কিছু হয়েছে‚ ভাই? মানে আপনাদের গাড়িটা ঠিক নেই?”

মিনিটখানিকের মতো চুপ থাকল শেহরোজ। তারপর থমথমে সুরে “শি ইনসালটেড মি ইন পাবলিক। মেজাজ ঠিক নেই” বলে লাইন কেটে দিলো।

কথাটা কানে বাড়ি খেতে থাকল সাব্বিরের। ভাবতে থাকল‚ শাজ হঠাৎ লোক সম্মুখে অপমান করেছে কেন শেহরোজকে? কী হয়েছে? আর অপমানটা নিশ্চয়ই খুব বাজেভাবে করেছে। নয়ত এমন ক্ষুব্ধ মেজাজ তো হওয়ার কথা নয় কমান্ডারের! শেষ এরকম মেজাজের মুখোমুখি হয়েছে সে মাস তিন আগের ছোট্ট একটি প্রশিক্ষণে। এমনকি সেই একই মেজাজ থেকে ইব্রাহীম খলিল‚ রাশিদ খানের মতো এক কালের ঊধ্বর্তন কর্মকর্তা হয়েও ছাড় পায়নি! এবং এই মাস চারেকেই ওরা বুঝে গেছে — ওদের দলপতি দেখতেও যেমন গম্ভীর‚ নির্দয়। মেজাজ আর স্বভাবেও ঠিক তাই।
***

“আমার বাপের জেনারেশনের পর আসা শালা সব পুরুষই খচ্চর শ্রেণীর! কাকে বিশ্বাস করব আর কাকে ভরসা করব? সবগুলোরই আগা টু গোড়া পর্যন্ত ভেজাল।” আপনমনেই বকে যাচ্ছে শাজ রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে। রাগে তার মাথা ফেটে যেতে চাইছে যেন৷ তাই তো নিজের গাড়িটার কথাও বেমালুম ভুলে গিয়ে এখন ট্যাক্সি ‚সিএনজির জন্য অপেক্ষা করছে সে।

একই সাথে বেখেয়াল হয়ে তার চোখ এড়িয়ে গেল‚ রাস্তার অপরপাশ থেকে একটা গাড়ি ঘুরে আসছে তারই জন্য। সেই গাড়ি চালকের উদ্দেশ্য ট্যাক্সি ড্রাইভার হয়ে আজ তাকে শিকার করে নেবেই। এবং ডানদিক থেকে আসছে সাব্বিরও ট্যাক্সি ড্রাইভারের ভূমিকা পালনের উদ্দেশ্যেই৷ শাজ যদি একবারও বুঝতে পারত কী দমবন্ধ পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে যাচ্ছে সে এই মুহূর্তে!

একই গতিতে দুটো গাড়ি ছুটে আসল দুদিক থেকে। মাত্র দশ সেকেন্ডের ব্যবধানে সাব্বিরের গাড়িটা এসে আগে পৌঁছল শাজের একদম সামনে৷ অপর গাড়িটাকে যেজন্য বাধ্য হয়ে একটু দূরত্বে ব্রেক কষতে হলো৷ তবে দৃশ্যটা দেখালো সিনেমার দুই নায়ক অথবা দুই খলনায়ক শাজকে কেন্দ্র করে গাড়ির প্রবেশ ঘটালো যেন অ্যাকশনের সঙ্গে। যাদের নজরে পড়ল দৃশ্যটা‚ তারা দারুণ উপভোগের সঙ্গে ঘটনাটার সাক্ষী করতে চাইলো পাশের না দেখা সঙ্গীকে৷

এদিকে‚ হতবুদ্ধি অবস্থা শাজের৷ এতক্ষণ কোনো গাড়িঘোড়ার দেখায় পাচ্ছিল না সে৷ আর যখন পেলো তখন কিনা দু দুটো একসঙ্গে পেলো! একটু আগে শেহরোজকে কটাক্ষ করতে নিজেকে ‘স্পেশাল’ দাবি করে এলেও এখন তার সত্যিই নিজেকে কেমন বিশেষ বিশেষ অনুভব হচ্ছে৷ এই ভাবনায় হাসি পাওয়ার কথা থাকলেও পরিস্থিতির কারণে হাসিটা এলো না৷

“যাবেন নাকি আপু?” সাব্বির জিজ্ঞেস করল।

“যাব তো গুলিস্তান। নেবেন কত?”

“যেইটা দিয়া থাকেন প্রতিদিন সেইটাই দিয়েন।”

“ম্যাডাম?” ডেকে উঠল দ্বিতীয় ট্যাক্সি ড্রাইভার। বলল শাজকে‚ “আমারে অর্ধেক দিয়েন।”

“অর্ধেক!” তাজ্জব হয়ে তাকাল শাজ।

“ব্যাটা তোর কথা শুনে মনে হচ্ছে তুই আজই নতুন নামছিস”‚ সাব্বির চেঁচিয়ে উঠল চকিতেই৷ “নইলে কোন চু*দি*রভাই এই ভরদুপুরে গুলিস্তান যাইতে চায় অর্ধেক ভাড়ায়?” বলেই শাজকে বোঝানো শুরু করল‚ “আপু‚ ভাড়া অর্ধেকের কথা বলে উঠানোর পর দেখবেন রাস্তায় চিনতেছে না ব্যাটা। ঘুড়ায়ে ফিরায়ে নিয়ে যাইতে যাইতে পাছে মিটার দেখায়ে বলবে ভাড়া তিনশো দ্যান।”

অজ্ঞাত ড্রাইভার রেগে উঠল‚ “এইশ্শ্যালা! তুই জানোস আমি নতুন নামছি? আমার নিজের গাড়ি আমি নিজেই চালাই আইজ চার বছর। শালা আমি গুলিস্তান চিনুম না আর তুই চিনে উলটাই ফেলবি?”

সাব্বির পাত্তা দিলো না তাকে। শাজকে বলল‚ “আপু‚ ওর কথা শুইনেন না। বেশি লাভ করতে গেলে অনেক সময় বিরাট লস হয়ে যায়। আপনি না হয় আমারে আরেকটু কম দিয়েন৷ কসম খোদা‚ একটানে আপনারে আপনার গন্তব্যে নামাই দেবো।”

সাধারণত এমন ফ্যাঁসাদে পড়েছে শাজ রিকশাওয়ালা, সিএনজিওয়ালাদের কাছে। আজ প্রথম ট্যাক্সিচালকদের দেখল একই কোন্দল করতে৷ কিন্তু একটা কথা মনে হচ্ছে শাজের। সাব্বিরের কণ্ঠ একটু চেনা চেনা লাগছে তার। যেন আজ-কালের মাঝেই এই কণ্ঠস্বর সে শুনেছে। কিন্তু পুরোপুরি মনে করতে পারল না মাথার মধ্যে শেহরোজ ঘুরঘুর করায়। তবে সাব্বিরকে সেই হামলাকারীদের কেউ মনে হচ্ছে না। উপরন্তু সাব্বিরের কালো বর্ণের মুখটার কাঠামোটা তার খুব কাছের এক পুরুষের সঙ্গে একটু আধটু মিল পেলো সে৷ যাকে বহু বছর চোখের দেখাটুকুও দেখতে পায় না। এই অনুভব থেকেই শাজ সিদ্ধান্ত নিলো সাব্বিরের গাড়িতে উঠবে।

“এই হালারপুত!” অজ্ঞাত ড্রাইভার গালিগালাজ করে সাব্বিরকে বলল‚ “লস তো তুই করাচ্ছোস ম্যাডামরে। মিটার প্রতি ভাড়া বাড়াচ্ছোস তোর মতো চু*দ*নারা। আমি ইমানদার মানুষ তাই…”

“এই ব্যাটা ইমানদার থামেন তো”‚ ধমকে উঠল শাজ লোকটির কথার মধ্যেই। “একেবারে অর্ধেক ভাড়ার কথা বলেই তো আমাকে টেনশনে ফেলে দিয়েছেন। কম ভাড়ার লোভ দেখিয়ে যদি সত্যিই রাস্তাঘাট না চিনেন? আপনি চলে যান।” বলে সে সাব্বিরের গাড়িতে উঠে পড়ল। দাড়ি গোঁফের ফাঁকে তখন সাব্বিরের ঠোঁটের কোনায় বিজয়ের হাসি একটুখানি ঝিলিক দিয়েই আবার মুছে গেল। গাড়ি টান দেওয়ার পূর্বে দেখে নিলো সামনের শত্রুটিকে ভালোমতো।

“শান্তির মায়রে বাপ!” অসহ্য বিরক্তি নিয়ে আচমকা মুখের লাগাম ছুটিয়ে দিলো শাজ , “কোথাও একরত্তি শান্তি নেই। যেখানেই যাই সেখানেই বিপত্তি৷ ওই শালা ঝুঁটিয়াল বালটাই কুফা। না , আমার লাইফে যেই চুতিয়াই আসে সেই চুতিয়াই হলো কুফা৷ নাকি আমাকেই আল্লাহ কুফা করেছে আল্লাহই জানে! মাদারবোর্ড জঙ্গলের বাচ্চা অয়ন খাইশ্টার মতো ডাবলিং করতে চেয়েছিল? শালা বাইনপো , বোকাটোস্ট! তুই খালি বাসায় ফের। তুই ঘুমালে তোর চ্যাটমার্কা চুল দাড়ির খতনা করে আসব আমি!”

বিশাল কষ্টেই সাব্বির পেট ফাটা হাসিটা চেপে রেখেছে। কথাগুলো যে শেহরোজকে উদ্দেশ্য করে বলছে শাজ , তা আর বুঝতে বাকি নেই৷ কিন্তু সে ভাবছে — লাইনে থাকা তার রুক্ষ মেজাজি কমান্ডার নিজের জন্য এই অসাধারণ সম্বোধনগুলো শুনে ঠিক কেমন মুখভঙ্গিতে আছে?

শাজের কাছে দ্বিতীয় গাড়িটা এসে থামতে দেখেই সে দ্রুত কল লাগিয়েছিল শেহরোজকে৷ তখন থেকেই শেহরোজ লাইনে আছে। সত্যিই সে ফোনের ওপাশে বসে শাজের বলা সমস্ত কথায় শুনছে৷ কিন্তু বারবার কপাল কুঁচকাচ্ছে কিছু শব্দের অর্থ না বুঝতে পেরে৷ তাই শাজ একটু চুপ হতেই ও জিজ্ঞেস করল সাব্বিরকে , “কী বলছে ও এসব? মাদারবোর্ড জঙ্গলটা কী? বোকাটোস্ট , বাইনপো! হোয়াট ডাজ দিজ মিন , সাব্বির?”

বিভ্রান্তে ভোগা শেহরোজের কথাগুলো শুনে সাব্বিরের হাসি পাচ্ছে বেকায়দারকম৷ শেহরোজ জানে যে , এই মুহূর্তে সে কোনো জবাবই দিতে পারবে না। ওরই নিষেধ আছে কথা বলা। তবুও বেচারা কৌতূহল আর উত্তেজনায় জিজ্ঞেস করে বসেছে তাকে। তা দেখেই মাথায় দুষ্টুমি চাপল সাব্বিরের। রেয়ার ভিউ মিররে শাজের রাগান্বিত মুখটা দেখে সে সরল গলায় জিজ্ঞেস করল , “আপু কি ওই ড্রাইভারকে গালাগাল করতেছেন?”

“না” , কাঠখোট্টা জবাব শাজের। সাব্বিরের প্রশ্নে সে আবারও খেঁকিয়ে উঠল শেহরোজের ওপর , “যাকে অমৃত বাণী দিচ্ছি ওই সুধীর ভাইকে বেলন আর ঝাঁটা দিয়ে সোদন দিতে পারলে মন ভরতো। ঝুটকোলি শালা যেখানে রস সেখানেই হাজির। ইচ্ছে হচ্ছে বোম্বাইয়ে ঝাঁঝ তার সিডবক্সে গুঁজে দিই।”

ঠোঁট চেপে হাসতে গিয়ে সাব্বিরের চোয়াল ব্যথা করতে লাগল। বাকিটা পথ গাড়ির ভেতরটাই নীরব হয়ে থাকল। কারণ , মনমরা হয়ে শাজ জানালার বাইরে চেয়ে বসে থেকেছে চুপচাপ । যার জন্য টেরও পায়নি সাব্বির কত দ্রুত গাড়ি টেনেছে আর পেছনে আজও ফেউ লেগেছে।

বাসার গলিতে ঢোকার পূর্বে একটা ঘটনা ঘটে গেল। সাব্বির দেখেও চুপ থাকল। শাজকে বাসার সামনে নামিয়ে দিয়ে সে অপেক্ষা করল শাজ ভেতরে না ঢোকা পর্যন্ত। নিশ্চিন্ত হয়ে তারপর ডাকল শেহরোজকে , “আছেন ভাই?”

“অত্যন্ত জঘন্য ট্রেইনার তোমরা” , জবাবে ফোনের ওপাশ থেকে ধমক গলায় বলে উঠল শেহরোজ৷ “বাংলা ভাষার ওপর আগে থাকেই যার দখল তাকে তোমরা ফার্স্ট ক্লাস ট্রেনিংটা দিতে পারলে না? ঝুমা শেখের কিছু কিছু কথাও আমার ব্রেইন ট্রান্সলেট করতে পারে না৷ আর এখন ও কী বলে আমাকে গালাগাল করল সেটাও বুঝতে পারলাম না। নিজেকে তোমাদের ভাষায় ‘ভো*দা*ই’ লাগছে আমার।”

কষ্টেসৃষ্টে হাসিটা সামলালো সাব্বির। “স্যরি , ভাই।” অপরাধী গলায় বলল , “আসলে বাংলার প্রমিত ভাষার সবটাই আপনাকে শেখানো হয়েছে৷ কিন্তু শাজের নিজের আবিষ্কৃত এসব ভাষার ব্যাপারে তো আমরা আগে থেকে অবগত ছিলাম না৷ আর ঝুমা শেখের ভাষার ব্যাপারটা কী , ভাই?”

“কিছু না”, ধমক লাগাল শেহরোজ আবারও। তারপর জানাল , “ফেউটার পিছু নিয়েছে কর্নেল। তুমি ফিরে যাও এখন।”

“গলিতে ঢোকার আগে খুব কাছ থেকে সাইলেন্সার যুক্ত গানে আমার জানালায় ফুল এঁকে দিয়ে গেছে , ভাই। বুলেটপ্রুফ কার , তাও দেখে গেছে।”

“তাই না-কি?” ফোনের ওপাশ থেকে শেহরোজের হাসির আভাস পাওয়া গেল। বলল , “তোমাদের শত্রু যে ওপেন চ্যালেঞ্জ দিয়ে গেল , সাব্বির। এবার দু পক্ষের লুকোচুরিই শেষ হতে চলেছে।”

“লুকোনো শত্রু থেকে মুখোমুখি দাঁড়ানো শত্রুদের সাথে লড়তে বেশি সুবিধা , ভাই। আমরা তো সেটাই চাইছিলাম।”

“ইয়াহ।” বলে কলটা রাখল শেহরোজ৷ ঠোঁটে চোরা এক বুদ্ধিদীপ্ত হাসি ফুটিয়ে আওড়াল ‚ “ব্রিং ইট অন !”

#বিশেষবার্তা__ এ পর্যন্ত সব থেকে বড়ো পর্ব এটা। সবার রিয়্যাক্ট, কমেন্ট চাই কিন্তু আজ৷ আর গুরুত্বপূর্ণ কথা হলো, ভার্সিটি টপিকে কাহিনি এখানেই শেষ। অর্থাৎ যারা জুলাই আন্দোলনের প্লট ভাবছিলেন তাদের জানাই, শেহরোজ এই প্লটে একদমই এগোচ্ছে না। সম্পূর্ণ ভিন্ন এক প্লট নিয়ে সামনে এগোবে ইনশা আল্লাহ।