শেহরোজ পর্ব-১৫

0
376

#শেহরোজ – ১৫
#ইসরাত_জাহান_দ্যুতি
***

জুল-জুল চোখে তাকিয়েই শাজ দেখল নাকের পানিতে‚ চোখের পানিতে ঝুমা শেখের কাজল আর মেকআপ ঘেঁটে যাওয়া মুখটা ওর মুখের ওপর ঝুঁকে আছে। তার নাকের পানি গড়িয়ে এসে ওর গালের ওপর পড়বে পড়বে এমনই মুহূর্ত— অবিলম্বেই সে শোয়া থেকে উঠে বসল‚ “ছিঃ! তুমি একটা কী?” বলে উঠেই শাজ ধমকাল আন্টিকে‚ “যাও! নাকটা পরিষ্কার করে আসো আগে।”

তা বোধ হয় কানেই পৌঁছল না ঝুমার। ওকে বসতে দেখেই সে আহাজারি শুরু করে দিলো‚ “ওরে শাজু তুই তাজা হইছিস? আমার কইলজাডা আজরাইল খাবলা মাইরা নিয়াই যাচ্ছি়ল রে! আমি না হয় তরে ঘরেত্তুন বাইর অইতে কইছিলাম। তাই বইলা কি তুই এক্কেরে রাস্তায় বাইর হুই যাবি? নিচে ডাক্তোরের ঘরে যাইতি‚ উফ্রে পোফেসরের ঘরে যাইতি‚ তার উফ্রে না হয় ছাদেই যাইতি। কিন্তুক সব ছাড়ি রাস্তায় দৌড়ায় নাগা সন্ন্যাসী হবার কইছে কেডাই ! হেইদিন তর হইলদ্যা সেকার্ট পিন্দাম চাইছিলাম বইলা তুই আমার মুখর উপরদি দ্রিম করি দজ্জা আটকাইলি। আমি কি রাগ করি রাস্তার রাণী সুরাইয়া হইছি ? গেলি তো গেলি রাস্তা দেখলি না‚ ড্রেন দেখলি না চিত্তর হই অজ্ঞান হই গেলি। শেরুজ বাজান যদি ওডে না থাইকত‚ হডে হডে টুকাইতাম তরে?”

শেহরোজের নামটা শোনা মাত্রই শাজের মনে পড়ে গেল বাচ্চা ছেলেটার কথা। আতঙ্কিত দেখাল তখন। “ওই বাচ্চাটাও কি মরে গেল”‚ স্বগতোক্তি গলায় বলে উঠল। দাদী শিথানেই বসে ছিলেন। তিনি ওকে শান্ত করার আগেই ঝুমা শেখ এগিয়ে এসে ওর মাথা আর গায়ে হাত বুলাতে বুলাতে বললেন‚ “ওই বেত্তামিজ ঝিবুত সহিসালামত আছে লো। তুই দাপাদাপি করিসনে আর। ম্যালা ডর পাইছিস। খাঁড়া‚ এট্টু দুয়া পড়ি ফুঁ মারি দেই শইল্যের মইদ্দে।”

চোখে-মুখে বড়ো বড়ো ফুঁ পড়তেই শাজ বিরক্ত হয়ে আবার ধমক বসালো ঝুমাকে‚ “থামবে? তোমাকে নাক-মুখ পরিষ্কার করে আসতে বলেছি কিন্তু!”

“এই ঝুমা!” দাদীও বিরক্ত হয়ে বললেন‚ “থাম তো ছেড়ি! আর জ্বালাইসনে ওরে।”

কিন্তু ঝুমা শেখ কি কারও কথাকে তোয়াক্কা করা মানুষ? ঝাড়ফুঁকের কাজ শেষ করে সে বিছানা থেকে উঠে এলো আবার বুস্তানের কাছে। যে এ ঘরেই তার স্ট্যান্ডের ওপর চুপচাপ বসে এদের তামাশা দেখায় ব্যস্ত ছিল। মেকআপ ঘেঁটে যাওয়া মুখটা নিয়ে ঝুমা দাঁড়াল তার সামনে‚ তারপর হঠাৎ দোয়া কালাম পড়ে তাকেও ফুঁ দিতে আরম্ভ করলে তা দেখে বিরক্তের শেষ সীমায় পৌঁছল শাজ। দাদী বলে উঠলেন‚ “ওরে আবার ফুঁ ফা দিতাছিস ক্যা রে?”

“তহন আমরা তিনজন কপালিনীর মতো তাণ্ডব শুরু করছিলাম না, চাচি?” যেন গুরুত্বপূর্ণ কথা জানাচ্ছে ঝুমা তেমন মুখভঙ্গিতে বলল‚ “এই বেডা তো ওই ঘরেই ছিল টিভির পাশে। খেয়াল করছিলাম ফালায় ফালায় উঠতেছিল আমাগো তিনজনের ক্যারক্যারানি শুইনা৷ নতুন মানুষ‚ নতুন জায়গায় আইছে। বুঝতাছোই তো।”

“ওটা পাখি”‚ দাঁতে দাঁত লাগিয়ে রাগান্বিত চেহারায় শাজ সংশোধন করে দিলো। আর দাদী জিজ্ঞেস করলেন‚ “ও যে বেডা তা তুই বুঝবার পারলি ক্যামনে?”

সেই জবাবটা আর দিলো না ঝুমা। চুপচাপ বুস্তানকে আবার ঝাড়ফুঁক শুরু করলে এবার সবাইকে চমকে দিয়ে বুস্তান কর্কশ গলায় চেঁচিয়ে উঠল‚ “গেট আউট‚ ডিমন! গেট আওয়ে ফ্রম মি।” বলতেই থাকল অনর্গল‚ সঙ্গে লাফঝাঁপও আরম্ভ করল৷

মেদবহুল ঝুমা শেখের অস্বাভাবিক সাজ বেচারাকে ভূতের ছবি স্মরণ করিয়ে দিয়েছে বলেই উত্তেজিত হয়ে ঝুমাকে তাড়াতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। তা বুঝতে ঘরের কারওই বাকি নেই। দাদী হেসে অস্থির। ঝুমা বেগম ক্ষিপ্ত হয়ে উঠল তখন৷ স্ট্যান্ডটা ধরে ব্যালকনিতে পাখিটিকে নিয়ে যেতে যেতে বকাঝকা করল‚ “পাছায় এক উষ্টা দিয়া তরে মালুশিয়া পাডাই দিমু‚ বজ্জাত ফাখি। আমারে ডিমন কস! তুই ডিমন‚ শতান বেডা!” ব্যালকনিতে স্ট্যান্ডটা ঠাস করে রেখে বলল‚ “থাক তুই এহানেই। ঘরে আর জায়গা হবে না তর।” ফিরে এলো সে এরপর। গুম হয়ে বসে থাকা শাজ তখন জিজ্ঞেস করল তাকে‚ “আমি ঘরে ফিরলাম কীভাবে?”

“রোজ থাকতে আবার কীভাবে? আমার বাজান হিম্যান তোর মতো হিপ্পোর বাচ্চারে কান্ধে উডাই আনছে। আমি এহানতে যায়ি হেতের লাই পুডিং বানামু। কত শক্তি খরচ হলো আমার ছাওডার!”

“ভালোভাবে কথা বলো তো”‚ ধমক মারল শাজ। চাপা রাগের সঙ্গে বলল‚ “আমার সেন্স না ফিরিয়ে তাকে কোলে তুলে কে আনতে বলেছে? রাস্তার মধ্যে মানুষজন এটা দেখে কী ভেবেছে আমাদের?”

“মনে অয় তর জ্ঞান ফিরতাছিল না কইয়াই অই কোলে কইরা আনছে”‚ বললেন আয়শা খাতুন।

“দেখেছ?” আয়শা খাতুনকে বিচার দেওয়ার মতো করে বলল ঝুমা‚ “এই সামান্য মামলা তুমি বুঝলে ঠিকই। কিন্তু তোমার নাতনি বুঝল না। ও খালি ছেলেটাকে অপমান করার ধান্দা খোঁজে। কী দোষ করেছে রোজ? দক্ষিণখানের বাড়িটার কথা তো ওকে আমিই বলেছি। এতিম ছেলেটা দাদা-দাদীরে ছেড়ে এই শহরে একার মতো এসে থাকছে বলে মায়া হয় আমার। আজকে ঝিলিকের বিয়েটা না হয়ে গেলে ওকে আমার জামাই বানাতাম। তাহলে একটা মাত্র মেয়েটাকে আমার ওই সুদূর ইতালি গিয়ে…”

“আরেকটা পয়দা করলেই হয়ে যাবে”‚ ঝুমার কথার মাঝে হঠাৎ বলে উঠল শাজ। “আজকে আঙ্কেল বাসায় ফিরলে তিন নাম্বারটার প্ল্যানিং শুরু কোরো। এখন আমার ঘর থেকে বিদায় হও। আমি একটু রেস্ট করব”‚ কাটকাট সুরে বলেই সে শুয়ে পড়ল আবার।

আয়শা খাতুন নীরব দর্শকের মতো শুধু চুপচাপ হেসে গেলেন। আর ঝুমা শেখ বারো জেলার বারো মেশালি ভাষায় শাজকে বকাঝকা করতে করতে গেল বাসা থেকে বেরিয়ে।

তারপর দাদীও আর বসে থাকেননি। রাতের খাবারের এন্তেজাম করতে চলে গেলে শাজ সে সময় উঠে এসে ব্যালকনিতে বসল। বুস্তান ওকে দেখে খুশি হলো খুব। সে নানাভাবে অঙ্গভঙ্গি করে ওর মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টা চালাতে থাকল আর ডাকতে থাকল ‚“হ্যাল্লোওও… ডার্লিং?”

সাড়া দিতে ইচ্ছা করল না শাজের। ভাবশূন্য চোখে নক্ষত্রের আকাশ দেখতে দেখতে শেহরোজের কথাগুলোকে স্মরণ করল৷

আজ দুটো বছর হতে চলল সে রাতে ঘুমের সঙ্গ পায় না‚ সহজে কাউকে বিশ্বাস আর ভরসা করতে পারে না‚ মন খুলে কারও সঙ্গে কথা বলতে ভয় হয়— যদি মনের ভুলে সর্বনাশা সত্যটা বেরিয়ে আসে? অয়ন‚ রনি‚ এদের নানারকম দোষ থাকলেও ওরা দুজনেই নিজেদের বদলানোর কথা বলেছিল‚ অন্তত একবার সুযোগ চেয়েছিল। তখন একটা সুযোগ দেওয়ার কথা বন্ধুরাও বলেছিল৷ কিন্তু ওর যে সব থেকে বড়ো ভয়ই ছিল নিজের ভেতর লুকিয়ে রাখা ধ্বংসাত্মক সত্যকে ঘিরে। ওদের কারও প্রতি দুর্বলতা জন্মে গেলে সেই দুর্বলতা থেকে এই সত্য হয়তো প্রকাশ করে ফেলতে পারে সে। কিন্তু এই সত্যকে ধারণা করার ক্ষমতা যে ওদের ছিল না‚ যোগ্যতাও ছিল না।

অথচ এভাবেই বা আর কতদিন? এমন যোগ্য কারও সন্ধান তো ওর জানা নেই। তাহলে কতদিন নিজেকে প্রাণ খুলে বাঁচা থেকে বঞ্চিত করবে সে? জীবনসঙ্গী ছাড়া কি জীবনটা পরিপূর্ণ হয়? দিনে দিনে নিজের মানসিক ‚ শারীরিক অবস্থারও অবনতি ঘটছে। যে ভয়ঙ্কর সত্যের ভার ওকে বহন করতে হচ্ছে‚ তা থেকে নিস্তার না পেলে ও স্বাভাবিক একটা জীবনের কল্পনাও করতে পারবে না। আব্বু কি সেদিন একবারও ভাবেনি এই ভার সহ্য করার ক্ষমতা তার ছোট্ট নাজুক মেয়েটার জন্য কতটা কঠিন হতে পারে?

“উফ্! এটা কী ভাবছিস তুই?” হঠাৎ মাথা চেপে ধরে শাজ স্বগতোক্তি করল বিড়বিড়িয়ে‚ “আব্বু কি সেদিন একটা সেকেন্ড ভাবার মতো অবস্থাতে ছিল? সে কি জানত ওটাই হবে তার আর আমার শেষ সাক্ষাৎ?” টপটপ করে নোনাজল পড়তে থাকল ওর কোলের ওপর।
***

দক্ষিণখান‚ রাত ৯:৪০

“নক্ষত্রনিবাস” শাজের মা আইরিন খানের ছোটো স্বপ্নমহলের নাম। মূলত এটি ডুপ্লেক্স নয়‚ হাফ ট্রিপ্লেক্স বাড়ি৷ স্ত্রীর এই স্বপ্নমহলের কথা যেদিন প্রথম জানলেন শাজের বাবা ওমর সাহেব‚ তারপর থেকেই মানুষটি খোঁজ আরম্ভ করেন প্রকৃতির কাছাকাছি নিরালায় থাকার মতো একটি জায়গা। একদিন পেয়েও যান লোকচক্ষুর আড়ালে থাকা বারো কাঠার এই খালি জায়গাটি৷ পেশাতে আইরিন স্থাপত্যশিল্পী থাকায় তার স্থাপত্যবিদ্যা আর ইন্টেরিয়র কোর্সের সমস্ত মেধাকে কাজে লাগিয়ে দেন এই বাড়িটির পেছনে। তবে বাড়িটি তৈরির সময় খালিদ উসমান পাশে থেকেছিলেন ছোটো ভাইয়ের। তার বিশেষ অবদানেই এই বাড়িটির এক বিশেষত্বও রয়েছে — যে সম্পর্কে শাজেরও অজানা।

শেহরোজ আছে এ মুহূর্তে নক্ষত্রনিবাসেরই টেরাজো ছাদটিতে। রেলিংয়ে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে নিচে ঝুঁকে পর্যবেক্ষণ করছে আকাশ আর ইব্রাহীম খলিলের কাজগুলো। এর মাঝে চিলেকোঠা থেকে বেরিয়ে এলো সাব্বির। চুপচাপ শেহরোজের পিছু এসে দাঁড়ালে তাকে ঘাড় ফিরিয়ে না দেখেই জিজ্ঞেস করল শেহরোজ‚ “অল ও.কে?”

“হ্যাঁ‚ কানেকশনের তো প্রবলেম নেই। সবগুলো ক্যামেরার পজিশন একদম ঠিকঠাক আছে। কিন্তু…” দ্বিধান্বিত মনে সাব্বির থেমে গেল৷ শেহরোজ ফিরে দাঁড়াল তখন। ভ্রু নাচিয়ে তাকে ইশারায় জিজ্ঞেস করল‚ “কিন্তু কী?”

“ওর বেডরুমে স্প্যাই ক্যামেরা আমার পছন্দ হচ্ছে না”‚ অকপটে জানিয়ে দিলো সাব্বির।

“আমার কাজের সময় অন্য কারও পছন্দ‚ অপছন্দকে কেয়ার করি না আমি”‚ চাঁছাছোলা সুরে জবাবটা দিয়ে শেহরোজ নিচে চলে গেল। আর এই জবাবটা সাব্বিরের একদমই ভালো লাগল না৷ শাজের প্রাইভেসির সঙ্গে আপোষ করার কথা ভাবলেই নিজেকে কেমন আরও বেশি অপদার্থ‚ অযোগ্য মানুষ লাগছে তার।

কাজ শেষ করেই লিভিংরুমে এসে কাউচের ওপর গড়িয়ে পড়ল ইব্রাহীম খলিল। আকাশও বসে পড়ল সোফায়। শেহরোজ বাসার ভেতরের চারদিকটা ঘুরে দেখছিল তখন। ওদের দুজনকে দেখে কিছু একটা বলার জন্য মুখ খুলতে গেলেই ইব্রাহীম তড়িঘড়ি করে বলে উঠল‚ “সন্ধ্যা থেকে একটানা কাজ করেছি‚ বস। সব কাজ শেষ করেই এসে বসেছি। আধা ঘণ্টার মধ্যে আর কোনো কাজ দিয়ো না এই বুড়া মানুষকে।”

“কে বুড়ো মানুষ?” কৌতুক করে বলল আকাশ‚ “আমি তো এই টিমে কর্নেল ছাড়া আর কাউকেই বুড়ো দেখি না৷ কর্নেলকেও তো বুড়ো বলতে অসু্বিধা লাগে।”

“ব্যাটা‚ আমার দিকে তাকা।” ইব্রাহীম আকাশের ঘাড়টা ধরে নিজের দিকে ফিরিয়ে বলল‚ “তুই আমার ছেলের নামের একটা কলঙ্ক।”

“কিন্তু আমার বাপের জানাজা হয়ে গেছে আরও চার বছর আগে”‚ হাসতে হাসতে বলল আকাশ।

দুজনের মশকরার মাঝে সাব্বিরকে দেখা গেল দোতলা থেকে নামতে। চোখে‚ মুখে আঁধার তার। সেটা দেখে ওরা দুজন দুজনের মুখ চাওয়াচাওয়ি করে তাকাল শেহরোজের দিকেও৷ শেহরোজ অবশ্য নির্বিকার দাঁড়িয়ে ক্যাবিনেটের ওপর রাখা কাচের জারটা দেখছে মনোযোগের সঙ্গে৷ গোল একটি কাচের জারে ছোটো এক টুকরো অরণ্য যেন। এটা আজ সন্ধ্যাতেই সাব্বির এনেছে। আইরিন আর শাজ দুজনেরই নাকি ভারি পছন্দের জিনিস এটা। কিন্তু সাব্বির জানে না‚ এটা শেহরোজেরও বেশ পছন্দের৷ আর সে মানুষটা পৃথিবীতে মায়ের পর কেবল পাহাড়‚ অরণ্যের প্রতিই দুর্বল। এমনিতে বাড়িটাও খুব ভালো লেগেছে ওর। আইরিন খান যে আভিজাতিকভাবেই শৌখিন আর রুচিশীল মানুষ ছিলেন— তার পরিচয় এই বাড়িটির প্রতিটি অংশই জানিয়ে দিচ্ছে।

সাব্বির এসে আকাশের পাশে বসলে ইব্রাহীম ডেকে উঠল তাকে‚ “কী ব্যাপার‚ কুখ্যাত হ্যাকার মশাই?” কাউচে চিত হয়ে শুয়ে পা নাচাতে নাচাতে সাব্বিরকে জিজ্ঞেস করল‚ “মেজাজ টেজাজ ভালো তো?”

সাব্বির কোনো জবাব দিলো না। আকাশের ফোনটা নিয়ে বাড়ির এক অংশের স্পাই ক্যামেরার সঙ্গে সেটাকে যুক্ত করতে থাকল চুপচাপ।

আজ বাড়ির প্রতিটি কোনাতে শেহরোজ স্পাই ক্যামেরা বসিয়েছে আকাশ আর ইব্রাহীমকে দিয়ে। আগামীকাল থেকে প্রত্যেকে বাড়ির একেকটি দিকের ওপর নজরদারি চালাবে‚ পালাক্রমে রাতেও জাগবে সকলে। শাজের ওপর খুব শীঘ্রই যে আক্রমণটা আসতে চলেছে— এটা তারই পূর্ব সতর্কতা। সাব্বির একজন উচ্চ পর্যায়ের ‘হোয়াইট হ্যাকার।’ পরিষ্কার করে বললে যে কোনো কল্যাণকর কাজের ক্ষেত্রে সে হ্যাকিং করে থাকে৷ শেহরোজের এই দলে একমাত্র সেই অসামরিক ব্যক্তি। তবে চার মাস হতে চলল প্রায় প্রতিদিনই তাকে শেহরোজসহ দলের বাকি সদস্যরা নানানরকম প্রশিক্ষণ দিয়ে যাচ্ছে৷ যার নমুনা দেখিয়েছে সে গতকাল শাজকে রক্ষার সময়। যেটা খুবই প্রশংসনীয় ছিল বলে শেহরোজ তাকে নিয়ে আশাবাদী।

সাব্বিরের মুখোমুখি এসে বসল শেহরোজ। ঠিক তখনই ওর ফোন বাজল। স্ক্রিনে ‘মেজর শেহনান’ নামটা দেখে শেহরোজ মজা করে বলে উঠল‚ “ব্যাটেলিয়ন‚ আমার না হওয়া ব্রাদারের কল।” কথাটা শুনেই সকলে উৎসুকভাবে তাকাল ওর দিকে।

“আরতে আজ বড়ো বড়ো টাটকা ইলিশ ঢুকতে দেখলাম‚ ভাই। ভাবির জন্য এসে নিয়ে যেতেন”‚ মেজর জানাল ফোনের ওপাশ থেকে।

মুচকি হাসল শেহরোজ‚ “তাই না-কি‚ ভাই? আপনার ভাবির টাটকা ইলিশ খুবই পছন্দ। তাহলে তো আসতেই হচ্ছে। আপনি আরত থেকে বের হয়ে আসছেন‚ তাই না?”

“জি ভাই। বাসার পথ ধরেছি। আমি তো গরিব মানুষ৷ অত দামের ইলিশ খাওয়ার তাওফিক নাই। ইলিশ তো আপনাদের ধনী মানুষজনের জন্য।”

“সেইফলি চলে আসুন‚ মেজর”‚ বলে কলটা কেটে দিলো শেহরোজ। গুরুগম্ভীর মুখটা ফোন থেকে তুলে জানালো ওদেরকে‚ “টার্গেট ধানমন্ডিতে একা যায়নি। সঙ্গে আরও অফিসার ঢুকেছে ওই বাড়িতে।”

“খাটুনি তো বেড়ে গেল।” পেটে হাত ডলতে ডলতে বলল ভোজনপটু ইব্রাহীম‚ “খাওয়া-দাওয়াটা এখনই সেড়ে নিই তাহলে৷ যাতে জলদি হজম হয়ে পেট ক্লিয়ার করে বের হওয়ার সুযোগ পাই।”

তার কথা শুনে গা দুলিয়ে হাসতে থাকল আকাশ৷ বলল‚ “আপনার মতো যদি হতে পারতাম! অপারেশন শেষ না করা পর্যন্ত আমার আর খাওয়া হবে না। তার চেয়ে বরং টার্গেট প্র্যাক্টিস করি গিয়ে।”

“সারাদিনে যথেষ্ট করেছ। আর নয়। ব্রেইনকে রিল্যাক্স করাও আর মাইন্ডকে স্ট্যাবল”‚ নির্দেশ গলায় শেহরোজ বলল৷ “আজকের অপারেশনের ওপর আমাদের সামনের প্ল্যান ডিপেন্ড করছে। এমনকি তোমাদের বাঁচা-মরাও।”

“ও.কে”‚ কাঁধ ঝাঁকাল আকাশ। “তাহলে আমিও যাই‚ দেখি খাদ্রমন্ত্রী ইব্রাহীম খলিলকে দেখে কটা গলাধঃকরণ করা যায় কিনা।”

“এই না হলে বাপকা বেটা!” বলেই দড়াম করে আকাশের পিঠে চাপড় মেরে বসল ইব্রাহীম।

শক্তপোক্ত শরীরটা না হলে আকাশের দম বেরিয়ে যাওয়ার উপক্রম হত এই চাপড়টাতে। ইব্রাহীম খলিলের ষণ্ডা মতোন দেহের ওজন যেমন ভারী। তেমন তার কিল‚ থাপ্পড়ের ওজনও। চোখ-মুখ কুঁচকে জ্বলতে থাকা মাঝ পিঠে হাতটা পৌঁছনোর চেষ্টা করল আকাশ— পারল না। তা দেখে ইব্রাহীম তার ছোটোখাটো ভুঁড়িটা কাঁপিয়ে হাসল একটু সময়। তারপর চলে গেল আকাশকে তুলে নিয়ে রান্নাঘরে৷

“আপনার ফোনটা চেক করুন‚ ভাই৷ সব ঠিকঠাক আছে কিনা”‚ শেহরোজকে বলল সাব্বির।

প্রলম্বিত শ্বাস ফেলে শেহরোজ সাব্বিরের পাশে এসে বসল। ফোনটা তার হাতে দিয়ে জিজ্ঞেস করে বসল হঠাৎ‚ “তুমি কি শাজের সঙ্গে মিট করার চিন্তাভাবনা করছ‚ আইয়াজ?”

চমকালো সাব্বির। মূলত বিস্ময়ে চমকালো সে৷ আজ দুপুরের পর থেকেই তার মনটা বিষণ্ন হয়ে আছে খুব। বোনটাকে কতগুলো বছর পর এত কাছ থেকে দেখল সে! অথচ নিজের পরিচয়ে এসে কথা বলার একটুখানি সুযোগও পেলো না। তাই সত্যিই ভাবছিল শাজের সামনে গিয়ে একবার দাঁড়াবে কি-না! কিন্তু শেহরোজের চোখে ধরা খেয়ে গেল সে? কী করে বুঝে ফেলল এই লোক? এখন আবার এ নিয়ে কী পরিমাণ বকাঝকা খেতে হবে কে জানে! অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে প্রসঙ্গ বদলানোর চেষ্টা করল তাই৷ বলল‚ “সাব্বির বলেই ডাকুন‚ ভাই৷ নয়তো কখনো ভুলচুক হয়ে যেতে পারে।”

“আমি শাজের বড়ো ভাই আইয়াজকেই দেখছি এখন।” কর্কশভাবে বলল শেহরোজ‚ “আমার ব্যাটেলিয়নের কোনো ব্যাটেলার নও তুমি এই মুহূর্তে।”

#নোট__ আপনাদের মন্তব্য খুবই প্রয়োজন। কিন্তু পড়া শেষে মন্তব্য জানাতে খুবই কৃপণতা করেন আপনারা। কেবল নিজের অনুপ্রেরণার জন্যই প্রয়োজন না মন্তব্য৷ আমার পেইজের রিচ আর এঙ্গেজমেন্ট বাড়ানোর জন্যও প্রয়োজন। গল্পে রিচ না থাকলে মনটা খারাপ হয়ে যায় ভীষণ।