শেহরোজ পর্ব-২১+২২

0
346

#শেহরোজ – ২১
#ইসরাত_জাহান_দ্যুতি
***

মেজাজটা শেহরোজের বিগড়ে গেল আবারও। কঠিন এক ধমকের সঙ্গে বলে উঠল খালিদ উসমানকে‚ “কীভাবে আপনি এমন একটা ইনফরমেশন দিতে ভুলে গেলেন আমাকে? আপনি জানেন কতখানি টাইম ওয়েস্ট করেছেন আমার?”

ফোনের ওপাশে অপরাধবোধে ন্যুব্জ হয়ে আছেন খালিদ৷ আসলেই সময়টা নষ্ট হয়েছে তারই জন্য। বারবার করে বলা হয়েছিল তাকে‚ শাজের ব্যাপারে খুটিনাটি সকল তথ্যই যেন ‘অপারেশন বাংলাদেশ’ ফাইলের অন্তর্ভুক্ত থাকে। তারপরও তিনি কী করে ভুলে গেলেন? অনুচ্চস্বরে জিজ্ঞেস করলেন শেহরোজকে‚ “প্ল্যান কি তবে পুরোপুরি চেইঞ্জ করতে হবে আপনাদের?”

“চেইঞ্জ করতে হবে না?” রাগে মাথা দপদপ করছে শেহরোজের‚ “আপনার এবং মেজর শেহনানের রেমার্ক কী ছিল? ব্রিগেডিয়ার ওমর ফারুক সরকার পক্ষের বিরুদ্ধে যে এভিডেন্স পেয়েছিলেন তা তিনি এমন কোনো জায়গাতে হাইড করেছেন যেটা কেবল শাজকেই জানিয়ে গেছেন তিনি। গুম হওয়ার আগ মুহূর্তে শেহনানকে এই ইঙ্গিতই তো দিয়েছিলেন‚ তাই না? আপনিও এমনটাই বলেছিলেন যে সিক্রেট কোথাও একটা আছে৷ আমিও এতদিন সেভাবেই এগিয়েছি। ভেবেছি‚ শাজের বিশ্বস্ত হওয়ার পর ওকে ম্যানিপুলেট করে সেই জায়গাটির কথা ওর থেকে জেনে নেব। যদি সেটা কোনো ব্যাঙ্ক লকার হয় অথবা এমন কোনো সিক্রেট প্লেস‚ যেটা অবধি পৌঁছনোর জন্য চাবি কিংবা শাজের ফিঙ্গারপ্রিন্ট‚ রেটিনা স্ক্যান ব্লা ব্লা লাগতে পারে। কত অলটারনেটিভ সিস্টেমকে মাথায় রেখে আমাকে এভরি ডে শাজকে ইমপ্রেস করার পেছনে সময় ঢালতে হলো। অথচ শাজ চাইল্ড প্রডিজি‚ এই মোস্ট ইম্পর্ট্যান্ট ইনফরমেশন আপনি যদি বলতে না ভুলে যেতেন তাহলে ওই এভিডেন্স ওর থেকে বের করার জন্য অলটারনেটিভ ওয়ে ছিল আমার।”

“বুঝতে পারছি। দোষটা আমারই। আমি আসলে নিজের সারাজীবনের সাধনাকে নিয়ে যা ভেবে রেখেছিলাম‚ তা হঠাৎ করেই ভিন্ন পরিকল্পনার অংশ হয়ে যাওয়াতে ব্যাপারটার সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারছিলাম না। আবার ওদিকে আমার একমাত্র ভাতিজির বিপদ। দুটো বিষয় মিলিয়েই আমার মানসিক অবস্থা ছিল বিশৃঙ্খল।”

একটু দমল শেহরোজ৷ উপলব্ধি করল খালিদ উসমানের মানসিক দূরাবস্থার কথা৷ ষাটোর্ধ লোকটা নিজের পুরো জীবনই কাটিয়ে দিয়েছেন অভিনব এক গ্যাজেট তৈরির পেছনে। সফলও হলেন তাতে৷ কিন্তু তা বিশ্বের দরবারে উপস্থাপনের সুযোগ পেলেন না৷ দেশের কল্যাণে আর ভাতিজির জীবন রক্ষার জন্য চুক্তিবদ্ধ হলেন তার গ্যাজেটের বিনিময়ে৷ ব্যাপারটা মেনে নেওয়া আসলেই কষ্টকর আর সময়সাপেক্ষেরও বিষয়।

“তাহলে আপনি বলছেন”‚ খালিদ সাহেব কিছুটা সন্দিহান‚ “ওই ডকুমেন্টস শাজ অন্য কোথাও না‚ নিজের ব্রেইনে সেইভ রেখেছে?”

“স্যার”‚ খালিদ উসামনের বোকামিতে না চাইতেও বিদ্রুপূর্ণ হাসল শেহরোজ। “পৃথিবীর বিরলতম মানুষের একজন চাইল্ড প্রডিজি। যারা অল্প বয়সেই অসাধারণ মেধার অধিকারী হয়। তো মেয়ের এমন একটা ব্রেইন থাকতে ওমর ফারুকের মতো একজন ফায়ারি সেনা অফিসার কি এদিক-ওদিক ছোটাছুটি করবে ডকুমেন্টস হাইড করার জন্য? আপনিই বলুন। আপনার ভাইকে আমার থেকে আপনার বেশি জানার কথা।”

লজ্জায় লাগছে নিজের বোকামির কথা ভেবে খালিদ সাহেবের৷ ঠিকই তো! রাঙামাটি থেকে ফিরে যেদিন ওমর মাত্র আধা ঘণ্টার জন্য বাসাতে আসতে পেরেছিলেন‚ ওই আধা ঘণ্টার মাঝে মূল তথ্য-প্রমাণ এমন গুপ্ত কোথায়ই বা লুকিয়ে রাখা সম্ভব—একমাত্র শাজের অসাধারণ মস্তিষ্ক ছাড়া! শাজের এই অসাধারণ মেধার কথা ওমর কোথাও প্রকাশও করেননি। এমনকি তিনি নিজেও করেননি। কারণ‚ ওমর চাননি তার মেয়েকে নিয়ে তোলপাড় শুরু হোক‚ মেয়েটার আশেপাশে কৌতূহলী মানুষের ভিড় জমা হোক। আইরিনকে হারানোর পর শাজকে তিনি কখনো দূরে পাঠানোর কথা চিন্তাও করতে পারতেন না। তাই তো খালিদ সাহেবও কখনো শাজকে রাজি করাতে পারেননি—তার কাছে চলে আসার জন্য। বাবাকে ভালোবেসে বাবার বাড়িটাকে ছেড়ে কোথাও গিয়ে থাকতে চায় না মেয়েটাও।

“তাহলে এখন?” জিজ্ঞেস করলেন খালিদ।

“আগামীকাল জানতে পারবেন”‚ জবাব দিলো শেহরোজ বেশ কিছুক্ষণ পর।

দীর্ঘশ্বাস ফেললেন খালিদ। হতাশ সুরে বলে উঠলেন‚ “মেয়েটা যদি আমাকে একটাবার ভরসা করে ব্যাপারটা বলত! ও আসলে ভয় পেয়ে আছে খুব। আমাকে জানালে আমার ওপর আরও বিপদ নামবে‚ এই ভয়েই আমার থেকে লুকিয়ে নিজে জীবন ঝুঁকির মুখোমুখি হচ্ছে। আর ও যদি জানত ওমর ওর থেকে শেষ বিদায় নেওয়ার পর সুযোগ পেয়ে মেজর শেহনানকেও ক্লু দিয়ে গেছে‚ তাহলেই সব জানাত আমাকে।”

খুব জটিল এক পরিস্থিতির মাঝে পড়ে শাজ দুটো বছরে বহুবার ভেঙে পড়েছে আবার একা একাই নিজেকে সামলে নিয়েছে৷ কাউকে বিশ্বাস করতে না পারার মতো যন্ত্রণা আর অসহায়ত্ব তারাই উপলব্ধি করতে পারে—কেবল যারা এই সমস্যাতে ভোগে।

শেহরোজ ফোনটা কেটে দিয়ে শাজকে নিয়ে ভাবতে ভাবতে বসল এসে বিছানাতে৷ যখন সেনাবাহিনীর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারাই দেশদ্রোহী কিংবা বিশ্বাসঘাতক‚ দেশের নিরাপত্তা সংস্থার শীর্ষেও একই হাল৷ তখন মেয়েটা কোথায়ই বা সাহায্যের আশা করবে আর কাকেই বা বিশ্বাস করবে? উলটে শেহনান যদি হাজির হতও ওর সামনে প্রমাণগুলো চাইতে। তাকেও শাজ বিশ্বাস করতে পারত না। বরং করাটাই নির্বুদ্ধিতা দেখাত। সেক্ষেত্রে সহজভাবে ওর থেকে তথ্যগুলো আদায় করার সুযোগই নেই৷ আর ওর বিশ্বাস বা ভরসা অর্জনটা যতটা সহজ ভেবেছিল সে আসলে ততটাও সহজ নয়৷ ভেতরটা শাজের যতই আবেগী হোক‚ ততটাই আবার দৃঢ়ও। তবে তার প্রতি শাজ খুব দ্রুতই দুর্বল হয়ে পড়ছে‚ তাকে নিজেরই অজান্তে বিশ্বাসও করছে আর আস্থাও করছে৷ কিন্তু ওই তথ্যগুলো তাকে জানিয়ে দেওয়ার মতো তাকে ভরসাযোগ্য ভাবতে বহু দেরি। যেটা আজ ভালোভাবেই বুঝেছে শেহরোজ ওর সঙ্গে কথা বলে। আবেগের বশে তখন বাবা-মায়ের ব্যাপারে মনোবেদনা প্রকাশ করে দিয়েছে বটে। কিন্তু যখনই ওমরের নিখোঁজ আর চাচা এবং ভাইয়ের প্রসঙ্গে গিয়েছে সে‚ তখনই শাজ কৌশলে প্রসঙ্গ পালটে ফেলেছে। বেশ রাগই হয়েছিল সে সময়৷ কিন্তু আজ তার কী হচ্ছে কে জানে! শাজের মুখটাতে চোখদুটো আটকালেই কারণে‚ অকারণে আকৃষ্ট হচ্ছে সে। পেছনে মাতোয়ারা সুবাস ছড়িয়ে মেয়েটা যখন চলে গেল রাতের খাবারের বাহানায়‚ তখন অপ্রতিরোধ্য এক ঝোঁক তার চেপে বসেছিল ওকে কোনো এক উপায়ে নিজের কাছে ধরে রাখার৷

গাল ফুলিয়ে বাতাস বের করে শেহরোজ মাথাটা ঝাঁকাল আর নিজেকে বোঝাল‚ “দ্য সাইনস আর নট গুড‚ ম্যান। বি কেয়ারফুল‚ শেহরোজ শায়েগান। শেষমেশ বঙ্গললনার জালে জড়িয়ো না। নয়ত ইরাজ শায়েগানের মতোই দমবন্ধ হয়ে মরবে।”

বিশাল এক হাই ছেড়ে সে বিছানায় গা এলিয়ে দিতেই সেন্টারটেবিলে রাখা ফাইটার ফিশের অ্যাকোয়ারিয়ামে চোখ পড়ল। শাজের ফেরত দেওয়ার কারণটা মাথায় খেলতেই হাসল ঠোঁটের কোন বাঁকিয়ে৷ কয়েক পল পরই হঠাৎ লাফিয়ে বিছানা থেকে নেমে অ্যাকোয়ারিয়ামটা হাতে নিলো। ঘড়িতে সময় দেখল রাত বারোটা বিশ। তোয়াক্কা করল না। একটা বাহানা মিলেছে শাজের ঘরে যাওয়ার। সুযোগটা হাতছাড়া করার প্রশ্নই আসে না৷

ঘর থেকে বেরিয়ে করডির ধরে এগোলো শেহরোজ৷ মাস্টার বেডরুম পার করে এসে থামল শাজের ঘরের দরজায়—দু বার ঠকঠক করল।

শাজ ঘুমায়নি তখনো ইনসমনিয়ার সমস্যা আছে বিধায়৷ আশ্চর্যভাবে শেহরোজের কথা ভাবতেই মগ্ন ছিল সে৷ এত রাতে দরজায় শব্দ পেয়ে চমকাল একটু। শুয়ে থেকেই জিজ্ঞেস করল‚ “কে? দাদী?”

“দাদীর ফিউচার গ্র্যান্ডসন-ইন-ল”‚ বলে মৃদু হাসল শেহরোজ।

তড়াক করে উঠে বসল শাজ। শেহরোজের উপস্থিতি আর কথাটা শুনে হৃৎস্পন্দনের গতি বেড়ে গেল আচমকাই। রাত-বিরেতেও এসে এভাবে জ্বালাবে না-কি এই ছেলে? চিন্তাতেই পড়ল যেন। শিথান থেকে ওড়নাটা নিয়ে গায়ে জড়াতে জড়াতে বিছানা থেকে নেমে এলো৷ দরজার কাছে এসে কপট ভারীস্বরে জিজ্ঞেস করল‚ “কী চাই?”

“তুমি কী দিতে চাও?” ওপাশ থেকে ভেসে এলো শেহরোজের দুষ্টুমি কণ্ঠ‚ “সেটাই নেবো।”

“ইয়া আল্লাহ!” বিড়বিড়িয়ে বলে উঠল শাজ‚ “তার ফ্লার্টিং মোড অন।” দরজাটা খুলতেই শেহরোজের হাতে অ্যাকোরিয়াম দেখে সে ভ্রু কুঁচকাল আর শেহরোজ মুচকি হাসল। ওকে বলল‚ “ইট’স নট গুড টু রিফিউজ সামওয়ান’স গিফট। সে তাতে দুঃখ পায়‚ শেহজাদি খানাম।”

“এখন আবার শেহজাদি হয়ে গেলাম?” কৃত্রিম বিস্মিতভাব দেখাল শাজ।

শেহরোজ মুচকি হাসি ঠোঁটে মেখেই বাড়িয়ে দিলো অ্যাকোয়ারিয়ামটা। শাজ না নিয়ে বলল‚ “ফেরত যেহেতু দিয়েছিই আপনার কাছেই রাখুন।”

“শাজ”‚ হাসিটা গায়েব হয়ে গেল শেহরোজের। শীতল গলায় জানাল‚ “আমি অপমানবোধ করছি।”

“তো এটা কাল সকালে দিলেও তো হত”‚ বলতে বলতে সে নিয়ে নিলো ওটা।

“কিন্তু এখন তো আসা হত না।”

ঝট করে চাইলো শাজ ফাইটার ফিশ থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে। নিশ্চুপ শেহরোজের চোখে চোখ রাখতেই মনে হলো ওর‚ কিছু বলছে ওকে চোখদুটো। জিজ্ঞেস করল তাকে‚ “এখন আসতে পেরে কী হলো?”

জবাবে আরও কিছুক্ষণ নীরবে নিষ্পলক চেয়ে রইল শেহরোজ। তারপর হঠাৎ শাজকে চমকে দিলো হাত বাড়িয়ে ওর মধু বাদামী রঙা চুলের মাঝে গুঁজে থাকা বুস্তানির পালক তুলে নিয়ে। ওকে আরও চমকে দিয়ে কাছে এসে দাঁড়াল সে। ওর মসৃণ গালের পাশ ছুঁয়িয়ে পালককে ধীরে ধীরে নামিয়ে আনল কামুকতাপূর্ণ পুরু অধরে… চিবুকে… চিবুক ছুঁয়িয়ে গলায়। গলা থেকে বুকের কাছে যাওয়ার পূর্বেই শ্বাসরুদ্ধ হয়ে আসা শাজ চকিতেই পালকটা ধরে ফেলল শক্তভাবে৷ তখনই শেহরোজ মুখটা নামিয়ে এনে কোমল গালের সঙ্গে তার গালটা মেশাল আর মৃদুস্বরে বলল‚ “আই বিলিভ‚ ইউ হ্যাভ নেভার সিন দ্য মোস্ট এক্সপেনসিভ রোজ ইন দ্য ওয়ার্ল্ড। বাট আই অ্যাম লসিং মাইসেল্ফ টু হার ফ্রেগ্রেন্স এভরি মোমেন্ট। শাজ‚ উইল ইউ অ্যাডমিট ইউ আর মাই জুলিয়েট রোজ?”

“জুলিয়েট রোজ?” সম্মোহিতার মতো আওড়াল শাজ।

“মাই জুলিয়েট রোজ”‚ কর্তৃত্বের সুরে শেহরোজ ফিসফিসিয়ে আকস্মিক আলতো চুমু খেল শাজের গালের মাঝে৷

সম্বিৎ পেলো যেন শাজ এই উষ্ণ স্পর্শেই। তবে ওর প্রতিক্রিয়ার পূর্বে শেহরোজই নিজ দায়িত্বে দূরত্বে চলে এলো। ওর বিস্ময়াবিষ্ট মুখপানে একটুক্ষণ দৃষ্টি বুলাল। তারপর প্রস্থান করল সে নীরবেই। আর তার যাত্রাপথে জড়ী-ভূত শাজ চেয়ে রইল বিস্ফারিত চোখে।

#শেহরোজ – ২২
#ইসরাত_জাহান_দ্যুতি
***

নক্ষত্রনিবাসে প্রথম সকাল।
স্লাইডিং ডোরের সামনে থেকে পর্দাটা হটাল শাজ। পুবের আকাশ রাঙা হচ্ছে—উঠি উঠি করছে প্রভাত সূর্য। পাখপাখালির কিচিরমিচির মৃদু ভেসে আসতেই দরজা খুলে বেরিয়ে এলো মিনি ছাদের মতো দেখতে ওর প্রিয় ব্যালকনিতে। নকশা কাটা লোহার রেলিং ধরে দাঁড়াতেই পরাণ শীতল করা ভোরের স্নিগ্ধকর বাতাস শরীরে মাখাল‚ বুক ভরে টেনে নিলো।

বাড়ির পেছনের ঘাসগুলো বেশ বড়ো হয়ে গেছে৷ গাছের শুকনো পাতাও নিচে জমতে শুরু করেছে অনেক। তা খেয়াল করতেই শাজ ভাবল‚ আজ বাবর লোকটাকে কাজে নামাতে হবে। কিন্তু তাকে দিয়ে একা একা কাজ করানোটা ঠিক হবে না৷ একেবারে ছোটোও তো না বাড়ির এরিয়া। সারা বাড়ির চারপাশ ঝেড়ে পাতা পরিষ্কার করতে কম খাটুনি হবে না৷ লোকটাকে সহযোগিতা করতে হবে৷ হঠাৎ করে মাথায় এলো এ বাড়ির নতুন সদস্যের কথা—যার জন্য গোটা রাতটাই নির্ঘুম কেটেছে ওর৷ শোধ হিসেবে তাকেই লাগিয়ে দেবে কাজে বাবরের সহকারী হিসেবে৷

কিন্তু আজ তার সামনে যেতেও কেমন কেমন যেন লাগছে শাজের৷ অথচ প্রথম চুমুর পর এই কেমন কেমন লজ্জা অনুভব হয়নি৷ কারণ কী? ভাবল শাজ কিছুক্ষণ। তারপরই বুঝতে পারল‚ শেহরোজের প্রণয় প্রস্তাব অন্যান্য দিনের চেয়ে গতকাল আলাদারকম ছিল আর ভীষণ আবেগীও ছিল সে ওই মুহূর্তে। যে আবেগে তখন আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিল ও-ও। সে বিদায় নেওয়ার পর কালই ও প্রথম ভেবেছে তার প্রস্তাবের ব্যাপারে। যেভাবে ও নিজেই একটু একটু করে ঝুঁকে পড়ছে শেহরোজের ওপর‚ তাতে প্রশ্রয় না দিয়ে পারছে না নিজের অনুভূতিকেও আর শেহরোজের কাছে আসাকেও৷ কিন্তু একই সাথে মনে বহাল থাকছে সেই পুরোনো দ্বিধা অনুভূতিও। বিশ্বাসের অভাবে আর মাত্রাতিরিক্ত সন্দেহের কারণে দু দুটো সম্পর্ক থেকে জোরপূর্বকই বেরিয়ে এসেছে ও৷ তৃতীয়বারের মতো শেহরোজের সঙ্গে জড়িয়ে যাওয়ার পর যদি আগের মতোই এই সমস্যা দেখা দেয় ওর মাঝে‚ তখন কি ও পারবে অতীতের মতো আবারও একতরফা সিদ্ধান্ত নিয়ে সম্পর্ক ছিন্ন করে দিতে? অথবা শেহরোজই কি মেনে নেবে তা? যেমনটা রনি আর অয়ন মেনে নিতে বাধ্য হয়েছিল ওর সেই সিদ্ধান্তকে? ওদের তো তবু কিছু দোষ ছিল। যেটাকে বাহানা বানাতে পেরেছিল। কিন্তু শেহরোজের বেলাতে…?

খুব সংশয়াপন্ন দেখাল শাজকে৷ আসলে নিজের প্রতি ওর নিজেরই আস্থা নেই৷ একটা সম্পর্কে আবদ্ধ হওয়া মানে সেই সম্পর্কের প্রতি নিবেদিত হওয়া‚ দায়িত্ববান হওয়া‚ আনুগত্য থাকা এবং সৎ থাকা। ও হয়তো প্রথম ধাপেই ব্যর্থ হয়ে পড়বে। তখন কি বিনা কারণে কষ্ট দিয়ে ফেলবে না সে শেহরোজকে? না‚ নিজের সমস্যাটা থেকে পরিত্রাণ না পাওয়া অবধি সায় জানানো যাবে না। তাকে কোনো কষ্ট দিতে চায় না ও‚ নিজেও হতে চায় না কোনো প্রকার ছলনাময়ী।

আজকের তারিখটা মনে করল শাজ৷ ডক্টর রেবেকার
সঙ্গে আরও তিনদিন পর ওর অ্যাপয়েন্টমেন্ট। কিন্তু আজ তিনি বাসায় আছেন—ছুটি কাটাচ্ছেন৷ তাই আজই যাবে ও।

গত তিন মাস হলো শাজ পিটিএসডি (পোস্ট-ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিজঅর্ডার) আর অ্যাংজাইটির কবল থেকে মুক্তি লাভের জন্য সাইকোথেরাপি আর নানারকম ওষুধের ওপর আছে। এর মাঝে পা ভেঙে পড়ে থাকায় এক মাস সাইকোথেরাপি নেওয়া হয়নি। পিটিএসডি কাটিয়ে ওঠা ভীষণ জটিল আর চ্যালেঞ্জিংও। গত দেড়-দুই বছর এই সমস্যাটির কারণেই শুধু মানুষের প্রতি নয়‚ সমগ্র বিশ্বের প্রতিই অবিশ্বাস অনুভব করে ও৷ পরিচিত মানুষগুলোর প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলেছে‚ কাউকে বিশ্বাস করতেই ও ভয় পায়। যার কিছুটা প্রভাব ওর কাছের সম্পর্কগুলোতেও পড়ছে মাঝেমাঝে। তাই শেহরোজের সঙ্গে যাত্রাটা শুরু করবে ও পুরোপুরি সুস্থ হওয়ার পরই।
***

বেশ শান্তির ঘুমই শেহরোজ ঘুমিয়েছে গতরাতে৷ শাজের কাছ থেকে ফেরার পর কেমন প্রফুল্ল লাগছিল মনটা। এই যে ঘুম থেকে জাগার পরই যখন মনে পড়ল তার‚ ঘরের বাইরে পা দিলেই মেয়েটাকে দেখতে পাবে‚ দুষ্টুমিষ্টি কথা বলতে পারবে। তা ভাবার পরই চেহারায় খুব উচ্ছ্বাস প্রকাশ পাচ্ছে তার।

ফোনটা হাতে নিয়ে শেহরোজ সিসিক্যামেরার ফুটেজ চেক করতে করতে দাঁত ব্রাশ আরম্ভ করল। বাড়ির সামনের দিকটা দেখা শেষে ভেতরের ফুটেজ দেখতেই থেমে গেল ব্রাশটা মুখের মধ্যে। এত সকালে শাজ ঘুম থেকে জেগেছে আজ! অবাক হলো সে। মেয়েটা রাতে ঘুমাতে পারে না জানা আছে তার৷ সেজন্যই বেলা করে ঘুমানোর অভ্যাস৷ আজ কী হলো? না-কি রাতে ঘুমায়ইনি ও? সেটা হলেও অবিশ্বাস্য হবে না। গতরাতে যে দুঃসাহসিক কাণ্ড ঘটিয়ে এসেছে এই বঙ্গললনার সাথে! ভাবতেই একটু হেসে ফেলল। কিন্তু আফসোস হচ্ছে বেশ। রাতে নিশ্চয়ই শাজ ছটফট করেছে আর তাকে নিয়েই ভেবেছে? ওই মুহূর্তটুকু যদি দেখতে পারত সে! মেজাজ খারাপই হলো তাতে৷ আর বিড়বিড়িয়ে গালি দিয়ে বসল আইয়াজকে‚ “শালা অ্যাসহোল! বোনের প্রোটেকটিভ ব্রাদার হয়েছ‚ না?”

শাজের ঘরের সিসিক্যামেরার ফুটেজ চেক করার দায়িত্বটা আইয়াজ এক প্রকার কঠিনভাবেই শেহরোজের থেকে নিয়ে নিয়েছে। যেটা নিয়ে শেহরোজ তখন বিরক্ত বা না রাগলেও এখন ভালোই বিরক্ত হচ্ছে। গতরাতে পুলে যা ঘটেছে শাজ আর তার মাঝে‚ নিশ্চয়ই সেটা দেখেও বুলডগের চেহারা বানিয়ে বসে আছে আইয়াজ আর অপেক্ষায় আছে তার বেসমেন্টে যাওয়ার! তারপরই বড়ো ভাইয়ের অবতার হয়ে শুরু করবে তার সঙ্গে বাক যুদ্ধ। ভেবেই বিড়বিড়িয়ে আবার গালি দিলো শেহরোজ‚ “শালা‚ তুই ভাই না হলে তোর খাঁড়া নাককে বাঁকা বানিয়ে দিতাম!”

ফ্রেশ হতে হতেই আজকের দিনটার পুরো পরিকল্পনা গুছিয়ে নিলো সে৷ ফাঁকে ফাঁকে কথাও বলল ফোনে দলের সকলের সাথে। কর্নেল রাশিদের দায়িত্ব ছিল এলাকায় সন্দেহজনক কাউকে চোখে পড়ে কি-না তা লক্ষ রাখা। এখন অবধি এমন কেউ তার নজরে আসেনি। খবরটা ভালো।

ফুরফুরে মেজাজে শেহরোজ নিচে এলো৷ লিভিংরুমে পৌঁছতেই উচ্চ ভলিউমে টিভি চলতে দেখে নজর বুলাল ঘরের চারদিকে৷ টিভিটা দেখছে কে? সোফায় তো কেউ নেই। খুঁজতে খুঁজতে পেয়ে গেল ব্যক্তিকে৷ রান্নাঘরে শাজ নাশতার আয়জন করছে। কিন্তু কানটা তার খাঁড়া হয়ে আছে টিভির শব্দে। মনোযোগ দিয়ে শুনছে সকাল সাতটার সংবাদ।

গত পরশু রবীন্দ্র সরোবরে ছোটো লাইব্রেরিটার পেছনে থাকা বাড়িতে গ্রেনেড বিস্ফোরণ ঘটেছে গভীর রাতে। তা নিয়ে তদন্তে নেমেছে ডিবি পুলিশ। সে রাতে যারা ওই সময়ে আশেপাশেই ছিল তাদের কারও কারও সঙ্গে সাংবাদিক কথা বলে যে তথ্যটুকু পেয়েছে‚ তাতে উঠে এসেছে চার-পাঁচজন কালো পোশাক আর কালো মুখোশ পরিহিত দুর্বৃত্তকে ধাওয়া করতে দেখেছে পিস্তল হাতে কয়েকজন লোককে৷ এছাড়াও বাড়িটির ভেতর থেকে কয়েকটি লাশও বের করতে দেখা গেছে তাদের। এবং তারা ছিল গোয়েন্দা বিভাগের অফিসার‚ সে ব্যাপারেও জেনেছে সাংবাদিক। কিন্তু কেন ওই লন্ডন প্রবাসীর বাড়িটাতে রাতে বিস্ফোরণ ঘটাল দুর্বৃত্তরা? এবং এরা কারা ছিল? কোনো জঙ্গি সংগঠন কি-না? এ ব্যাপারে এখনো কোনো তথ্য মেলেনি। পুলিশ বাড়ির ভেতরে কোনো সাধারণ মানুষ‚ সাংবাদিক‚ কাউকেই প্রবেশের অনুমতি দিচ্ছে না।

খবরটা শুনতে শুনতে শাজের ভ্রুজোড়ার মাঝে ভাঁজ পড়তে শুরু করেছে৷ সেটা খেয়াল করতে করতেই শেহরোজ বসল সোফাতে৷ কী ভাবছে মেয়েটা? ওর মাঝে খেয়াল করল শেহরোজ আরও নতুন কিছু। চুলগুলো এখন বেনি করে সামনে এনে রাখা‚ ওড়না আঁটসাঁট করে পরিপাটিভাবে পরা—যেন বাড়ির গৃহিণী। এক হাতে রুটি সেঁকেই আবার রুটি বেলার কাজও করছে একই সাথে। সামান্য এই দৃশ্য সহসা শেহরোজের মাঝে কিছু একটা চমক ঘটিয়ে দিলো। গভীর মনোযোগে শাজকে দেখতে দেখতে মৃত বাবার উদ্দেশ্যে জানাল বিড়বিড়িয়ে‚ “আমিও বোধ হয় তোমার পথেই হাঁটতে যাচ্ছি‚ পাপা। তোমার মতোই হয়তো বাঁধতে যাচ্ছি বাংলার রূপসীকে।”

নস্টালজিক শেহরোজ শাজের পানে চেয়ে এক যুগের বেশি সময় পেছনে চলে গেল। বাসার ভেতর মাকে দেখত সে ঠিক এই রূপেই—সেলোয়ার কামিজ আর চুলে বিনুনি গেঁথে ছোটাছুটি করে এ-কাজ ও-কাজ করে বেড়াতে। বাবা ছুটিতে বাড়ি ফিরলেই এক উৎসব আমেজ অনুভব করত সে। মায়ের চেহারাতেও আলাদা জৌলুশ টের টেত তখন। ঘুম থেকে জেগেই দেখত‚ তার বাঙালি রূপসী মা এমনইভাবে নাশতা বানাচ্ছে আর বাবা তার কাছে দাঁড়িয়ে গল্প করছে‚ গল্পের মাঝে মাঝে মা লাজুক হাসছে‚ সে হাসি দেখে বাবা তার চেহারায় আরও লাজুকতা এনে দিতেন গালে ছোটো-ছোটো ঠোঁটের আদরে। মা এমনি সময়ে হিজাব‚ ঢিলেঢালা পোশাক ছাড়া কখনো শাড়ি পরত না। কিন্তু বাবা ফিরলে সে দেখতে পেত‚ অত লম্বা এক কাপড় মা কী চমৎকারভাবে গায়ে জড়াত! দেখতে ভারি সুন্দরও লাগত৷ মাকে সে জিজ্ঞেস করেছিল একবার‚ “এই লেবাসের নাম কী‚ নানে?”

মা মুচকি হাসত‚ “এটাকে শাড়ি বলে‚ আব্বাজান। আমার দেশের ঐতিহ্য এই লেবাস।”

শেহরোজ খুশি হত ভীষণ‚ মা যখন তাকে আব্বাজান বলে ডাকত। মায়ের দেখাদেখি বাবাও ডাকত অনেক সময় এভাবেই। বাবার থেকে মাকেই কাছে পেত সে সব সময়। তাই মায়ের দেশ‚ মায়ের ভাষা‚ মায়ের ঐতিহ্যবাহী পোশাক‚ খাবার‚ মায়ের দেশের সবেতেই তার আগ্রহ আর ভালো লাগা ছিল প্রগাঢ়৷ কিন্তু বাবা-মায়ের মৃত্যুর পর ধীরে ধীরে এ দেশের প্রতি কৌতূহল‚ আগ্রহ‚ সবই উবে যায় মন থেকে৷ ভুলেই যায় সে এ দেশটাকেও৷ কিন্তু কে জানত জীবনের এই পর্যায়ে এসে এখানে তাকে পা দিতে হবে? আর আশ্চর্যভাবে মায়ের পর দ্বিতীয় কোনো বঙ্গললনাকে আপন করতে ইচ্ছা করবে?

বসে বসে শাজকে দূর থেকে দেখে শান্তি মিলল না শেহরোজের৷ টিভির শব্দ কমিয়ে দিলো আগে। তখনই শাজ মুখ তুলে সামনে তাকাল। তাকে দেখামাত্রই দৃষ্টি ঝুঁকিয়ে নিলো দ্রুত—ভাবটা ধরল ও দেখেইনি শেহরোজকে! এই অভিব্যক্তিকে আরও বেশি বিশ্বাসযোগ্য করে তোলার জন্য জোরপূর্বক গলায় এক গানের সুর তুলল। যেন মনে হয় সে চারপাশে কাউকে লক্ষ না করে কাজের মাঝে ডু্বে আছে আর আনমনে গান গাইছে৷ গতরাতে তো প্রেমের আবেদন জানিয়েই বিদায় নিয়েছিল শেহরোজ। এখন এসে যদি তার জবাব চায়? এজন্যই তাকে এই মুহূর্তে কথা বলার কোনো সুযোগই দেবে না ও।

“নাশতাতে আজ কী হচ্ছে?” এসে দাঁড়িয়েছে শেহরোজ রান্নাঘরে। শাজ আগেই ভেবে রেখেছিল কোনো কথা বলবে না৷ কিন্তু মুখ ফসকে পালটা জিজ্ঞেস করে বসল‚ “কী খেতে চান নাশতায়?” বলার এক মুহূর্ত পরই নিজের বোকামিতে চোখ-মুখ খিঁচে ফেলল‚ মনে মনে একচোট বকলও নিজেকে।

প্রশ্নটাই কিছু একটা ভেবে শেহরোজ তেরছা ঠোঁটে হেসে শাজের পাশে এসে দাঁড়াল। তা দেখে শাজ বিচলিত হলো একটু। আন্দাজ করল উত্তরটা আসবে এমন কিছু‚ যেটা শোনার পর ওর চুপ থাকা ছাড়া কোনো গতিই থাকবে না। ওর ঠিক এ ভাবনার পরই বলে উঠল শেহরোজ‚ “শুনতে দারুণ লাগল। মনে হলো ঘরের কর্তাকে তার ঘরওয়ালি জিজ্ঞেস করছে‚ নাশতাতে কী খাবে?”

আরক্তিম হলো শাজ ভেতরে ভেতরে৷ মুখে কিচ্ছুটি বলল না। নির্বিকার ভঙ্গিতে কাজ করতে থাকলে শেহরোজ এবার বলল‚ “ঝুমা আন্টির কাছে শুনেছিলাম তুমি আর্লি বার্ড নও৷ আজ মনে হচ্ছে কথাটা মিথ্যা ছিল আন্টির। রান্নাতেও নাকি তোমার ভারি অলসতা আছে৷ এটাও বলেছিল আন্টি৷ এখন দেখছি তাও মিথ্যা।”

জবাব ঠোঁটের ডগায় এসেও শাজ গম্ভীরতা ধরে রইল৷ এর মাঝে শেহরোজ আবার প্রশ্ন করল‚ “তোমার দাদী কি অসুস্থ? নাশতা যে তুমি বানাচ্ছ?”

কথা বলল না শাজ এবারও। এদিকে নিজের মতোই শেহরোজ বলতে থাকল‚ “আমার নাশতাতে অনেক কিছুই হলে ভালো হয়। বারবারি অর সাঙ্গাক‚ মধু‚ লিঘভান‚ বালাং জ্যাম‚ চা‚ ওয়ালনাট‚ অমলেট‚ কাশক‚ শিরাজ‚ সবজি খোরদান‚ ফ্রুটস…” আরও বলে চলল সে দুপুর আর রাতের খাবারের বহু পদ। যার অধিকাংশই শাজ নাম শুনছে প্রথমবার৷ শুনতে শুনতে ও ভ্রু কুঁচকাচ্ছে‚ বুঝতে না পেরে বিরক্ত হচ্ছে৷ তবু কোনো কথা বলছে না।

সেটা দেখে শেহরোজের কপালে সূক্ষ্ম ভাঁজ পড়ল—তাকে কি উপেক্ষা করতে চাইছে মেয়েটা? কোনো কথাবার্তা বলছে না কেন? তার খাদ্যাভ্যাস শুনে তো এতক্ষণে প্রশ্নের পর প্রশ্ন করেই পাগল হওয়ার কথা! “রাতে ঘুম ভালো হয়েছে‚ শাজ?” মৃদুস্বরে জিজ্ঞেস করে উৎসুক দৃষ্টিতে দেখতে থাকল শাজকে। তৎক্ষণাৎ তার দিকে ফিরে চাইলো শাজ‚ “নিশ্চয়ই। হবে না কেন?”

“তাই তো৷ হবে না কেন?” মুচকি হাসতে থাকল শেহরোজ। শাজের প্রতিক্রিয়ার ধরনে সে নিশ্চিত হলো‚ রাতে বেচারির সত্যিই ঘুম হয়নি একদম।

এদিকে মনে মনে বকাবকি করছে শাজ শেহরোজকে৷ বুঝতে পারছে‚ ও কথা না বললে ছেলেটা জেদ ধরে দাঁড়িয়েই থাকবে৷ তাই গুমট না থেকে সংক্ষিপ্তে দায়সারা জবাব দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলো আর প্রার্থনা করল‚ যেন গতরাতের প্রশ্নের কোনো জবাব না চায় সে।

“তো বললে না তো কী নাশতা রেডি করছ এখন?”

“ফ্রিজে যা পেয়েছি তাই খেতে হবে আপাতত”‚ নীরস কণ্ঠে বলল শাজ। “রুটি‚ সবজি আর অমলেট।”

“বাবর চাচাকে তবে বাজারে পাঠিয়ো৷ মনে করে আমার খাবারের লিস্টটা তাকে লিখে দিয়ো প্লিজ!”

কৌতুক সুরে জবাব দিলো শাজ‚ “আমার মাথা নয়‚ বাড়ির ছাদের ওপর দিয়ে গেছে আপনার মেনু। কাইন্ডলি ওটা আপনিই বুঝিয়ে লিখে দিয়েন চাচাকে।”

“তুমি থাকতে বাবর চাচাকে কেন বোঝাতে যাব?” বলতে বলতে এসে দাঁড়াল শেহরোজ শাজের আরেকটু কাছে৷ তাতে শাজ বিরক্তি প্রকাশের আগেই ওকে ডিঙিয়ে সে রুটির পাত্র থেকে একটা রুটি হাতের তালুতে নিলো৷ “আরে গরম তো খুব”‚ দ্রুত সাবধান করল শাজ তখনই। তা তোয়াক্কাই করল না শেহরোজ। শুধু রুটিই মুখে পুরে চিবুতে চিবুতে জানাল ওকে‚ “বারবারি আর সাঙ্গাক হলো আ টাইপ অফ নান ব্রেড।” মুখে খাবার থাকায় শুনতে লাগছে কথাগুলো কেমন অদ্ভুত আর কিছুটা অস্পষ্ট। “লিঘভানটা হচ্ছে তাবরিজি পনির৷ ক্রিম পনির আরকি। এটার সঙ্গে তাজা মিন্ট আর পার্সলের মতো হার্বস হলো সবজি খোরদান। কাল্লে পাচে কুক করতে পারো চাইলে গোরু অথবা ভেড়ার অংশ দিয়ে আর আদাসি হচ্ছে রেড গ্রাম-এর তৈরি স্টু। তুমি চাইলে আমি তোমাকে শেখাব‚ শাজ।”

লম্বা এক শ্বাস ছেড়ে শাজ রুটি বেলা থামাল৷ কটাক্ষের সঙ্গে বলল‚ “আপনার সকালের নাশতার যে আইটেমের বাহার আর যে খাওয়া দেখলাম সেদিন আপনার! আপনার নাশতা বানানোর ধৈর্য আর ক্ষমতা আমার হবে না‚ স্যার৷” হাতজোর করে অপারগতা জানাল‚ “তাই আমি শিখতেও চাই না।”

শেহরোজ সহসা বলে বসল‚ “তো আমার মতো বরের ঘরে যদি যেতে হয় তোমায়?”

কথাটা শুনতেই শাজের চেহারায় রক্তিমাভাব দেখা দিলো৷ বিব্রত হয়ে শেহরোজের চোখ দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়ে বলল‚ “আপনার মতো দৈত্য দানব ছেলে হলে বিয়েই করব না।”

“কেন? একটু বেশি খাই এজন্য?” বলেই আবারও ওকে ডিঙিয়ে আরেকটি রুটি তুলে নিলো শেহরোজ। এবার শাজ রাগের সঙ্গে বলল‚ “এভাবে শুধু রুটি খাওয়ার কোনো মানে হয়? পাঁচটা মিনিট পরই সবজি হয়ে যাবে তো! আর বারবার আমাকে পার করে নিচ্ছেন কেন? এপাশে এসে নিলেই তো হয়।”

যেন শুনতেই পায়নি কথাগুলো—ঔদাস্য ভাব দেখিয়ে শেহরোজ চুপচাপ রুটি খেতে থাকল। শাজও আর কথা বাড়াল না৷ মন দিলো কাজে। খাওয়া শেষে ওর পাশ কাটিয়ে শেহরোজ ফ্রিজ খুলে পানির বোতলটা নিয়ে ফেরার সময় হঠাৎ নাকে এলো গোলাপের প্রলুব্ধকর সুবাসটা। নীরবে আর বেরিয়ে যাওয়া হলো না তার৷ শাজের সুগন্ধিটুকু গ্রহণ করতে দাঁড়িয়ে পড়ল ওর পেছনে৷ এখনো সে বিশ্বাসই করতে পারছে না এই সুবাস ওর শরীরের নিজস্ব সুবাস। অথচ সুগন্ধিটা এত কাবু করে ফেলছে তাকে! খুব সাবধানে মাথাটা নুইয়ে আনল শাজের কন্ধে। প্রাণভরে সুবাসটুকু টেনে নিতেই শাজ কাঁধের মাঝে নিঃশ্বাসের উষ্ণতা হঠাৎ অনুভব করলে ঝট করে ঘাড় ফেরাল আর শেহরোজও তক্ষুনি সোজা হয়ে দাঁড়াল। কিন্তু শাজ টের পেয়েছে ওর বেশ কাছেই ছিল শেহরোজ। “কী করছিলেন?” থমথমে গলায় জিজ্ঞেস করল তাই।

“ট্রায়িং টু কিস ইয়োর নেইপ”‚ সাবলীলভাবে জানাল শেহরোজ।

তা শুনে শাজের মুখটা তখন কঠিন হয়ে উঠতেই মুচকি হাসল শেহরোজ। “মাই অ্যাংরি সোয়ান”‚ ওর নাকের ডগা মৃদুভাবে টানল একবার‚ “ডোন্ট গেট ইট রং বাই থিংকিং দ্যাট।” স্বীকারোক্তি দিলো কোমল স্বরে‚ “তোমার স্মেইল আমাকে থামিয়ে দিয়েছিল আবারও।”

চলবে।