#শেহরোজ – ২৫
#শেষাংশ_খ.
#ইসরাত_জাহান_দ্যুতি
***
“শাজ!” ফিসফিসানির মতো শোনাল শেহরোজের গলা। “আমি যা কনফেস করতে চাইছি৷ তুমি তা শোনার পর আমাকে বুঝবে। এই বিশ্বাস আমি করতে পারি তোমার প্রতি‚ রাইট?”
“আপনি… আপনি বলুন‚ শেহরোজ।” অপ্রতিভ ভাবটুকু কাটিয়ে আশ্বস্ত গলায় বলল শাজ‚ “আপনি নির্দ্বিধায় বলুন। আমি বুঝতে চেষ্টা করব নিশ্চয়ই।” শেহরোজকে এমন নিঃসহায়‚ নিরুপায় অভিব্যক্তিতে আগে কখনো দেখেনি সে৷ যদি এভাবে তার ভালোবাসার স্বীকারোক্তি দেয় ওকে‚ তবে এবার তো ফিরিয়ে দেওয়া মুশকিল হয়ে যাবে ওর জন্য!
লম্বা এক শ্বাস ফেলে শেহরোজ মেঝেতে জাপটে বসল। হাতদুটো ছাড়ল না শাজের। “আমি শেহরোজ শায়েগান। আমার এ দেশে কোনো রিলেটিভস নেই। কেবল এটা সত্য‚ এ দেশটা আমার মায়ের।”
“শায়েগান?” ভ্রু‚ কপাল কুঁচকে শাজ স্বগতোক্তির মতো আওড়াল পদবীটা।
“সন অফ শহীদ ইরাজ শায়েগান। আমার পাপা ছিলেন সেপাহ (সিপাহ-ই পাসদারান-ই এনকেলাব-ই ইসলামি)-এর ইনটেলিজেন্স অফিসার।”
“সেপাহ?” শাজ একইভাবেই জিজ্ঞেস করে উঠল৷ এখনো শেহরোজের কথাগুলো ওর মস্তিষ্ক ধরতে পারছে না।
“আইআরজিসি।”
বিস্মায়াবিষ্ট শাজ‚ “ইসলামিক রেভল্যুশনারি গার্ড কর্পস!”
“হুঁ। ষোলো বছর অবধি আমার জীবনটা কলোরাডোর এক পাহাড়ি অঞ্চলে কেটেছে সাধারণ বাচ্চাদের মতোই। তারপরই আমাকে চলে যেতে হয়েছে তেহরান। আমার পাপার ভূমিতে। আমার সাধারণ জীবন বদলে যেতে থাকে তখন থেকেই। তবে আমি সেপাহ-এর ইনটেলিজেন্স নই। আমি ইন্টারন্যাশনাল সিকিউরিটি ইনটেলিজেন্স-এর একজন স্পাই এজেন্ট। আমাকে অপারেশন বাংলাদেশ-এর মিশনে পাঠানো হয়েছে আর তোমাকে…”‚ বলে চলল শেহরোজ নিজের মতো।
শেহরোজের কথামতো চুপচাপ বিস্তারিত শুনতে শুনতে শাজ আদতেই কথা বলতে ভুলে গেল।
“তোমার বাবা গুম হওয়ার আগ মুহূর্তে কোনো একভাবে সুযোগ পেয়েছিলেন মেজর শেহনান শিফানকে একটা মেসেজ পাঠানোর। কিন্তু মেসেজটা এতটাই ক্রিটিক্যাল ছিল যে‚ শেহনান সেই মেসেজের মিনিং…”
“কী ছিল সেই মেসেজ?” অস্বাভাবিক ভারী কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল শাজ শেহরোজের কথার মাঝপথেই।
“স্ট্রমস আর ডেঞ্জার ফর ওয়েভার বার্ড।”
‘ওয়েভার বার্ড’ শব্দদুটো শুনতেই শাজের চোখ টলমল হয়ে উঠল। বিশ্বাস করল শেহরোজের কথা। একমাত্র আব্বুই যে ওকে ‘বাবুই’ বলে ডাকত৷ জীবনের শেষ অবধিও ওকে নিয়েই ভেবেছিল আব্বু! তাই তো এই সাঙ্কেতিক মেসেজের মাধ্যমে ওকে রক্ষা করার কথা বলেছিল। না-কি আরও কোনো কারণ ছিল? প্রশ্নটা মনে জাগতেই তাকাল শেহরোজের দিকে। শেহরোজ তা বুঝল কি-না কে জানে! তখনই সে জানাতে শুরু করল আবার‚ “শেহনান ইউএন মিশন চলে যাওয়ার ফলে তোমার বাবার গুম হওয়ার কারণটা আনলক করতে পারেনি। মিশন শেষে ফিরে এই মেসেজের মিনিং খুঁজতে তোমার সঙ্গেও দেখা করার সিদ্ধান্তও নিয়েছিল। কিন্তু তুমি তখন পুলিশ, আর্মি‚ ডিটেকটিভ‚ কারও সঙ্গেই দেখা করতে না৷ কারণ‚ বেশ হয়রানি করা হচ্ছিল সে সময়ও তোমাকে‚ তোমার চাচাকে। এরপর শেহনান প্যারা কমান্ডো ট্রেনিংয়ে সিলেকটেড হওয়ায় এই মেসেজটা ওর কাছে রহস্যই থেকে যায়। তবে বলা উচিত এই ট্রেনিংই ওর জীবনও বাঁচায়। এই মেসেজটা তোমার বাবার ঘাতকদের কাছেও খুব ইম্পর্ট্যান্ট ছিল৷ তিনি এই মেসেজে কীসের ইঙ্গিত দিয়ে গেছেন তা জানার জন্য মরিয়া ছিল বলে শেহনান ওদের টার্গেট হয়ে পড়ে। কিন্তু তারপর হঠাৎ করেই ডিসিশন নেয় শেহনানকে মেরে ফেলবে। তোমার বাবার নিখোঁজের পর শেহনানকে একই কৌশলে সরালে তা সকলের কাছে রহস্যময় লাগবে বিধায় পরিকল্পনা করে ভিন্নভাবে। টার্গেট করা হয় শেহনানের ভাই ইরফানকেও। পিএম-এর ভাইঝি ঝোঁকের বশে কিছু সিক্রেট ইনফরমেশন জানিয়ে ফেলেছিল তাকে৷ এই ভুলকে শুধরানোর জন্য তোমার ভার্সিটির ভিসি রূপে র-এর ইনটেলিজেন্স অফিসার রমেশচন্দ্র প্ল্যান করে দুয়েকটা ফেইক ইনফরমেশন জানায় ইরফানকে পিএম-এর ভাইঝির মাধ্যমেই। যাতে ইরফান এ তথ্যগুলো জানানোর চেষ্টা করে শেহনানকে। আর ইরফান করেও তাই৷ যেদিন ইরফানের ডাকে শেহনান তার কাছে যায়‚ সেদিনই স্যাবোটাজ করে ওদের মারার চেষ্টা করা হয়। গত বছর নভেম্বরের ঘটনা এটা৷ কিন্তু আল্লাহ সহায় ছিলেন তাই বেঁচে যায় শেহনান আর মারা যায় ইরফান। ওর হাতে যেসব ইনফরমেশন আসে তা তোমার বাবার গুম হওয়ার সঙ্গে কোথাও একটা কানেকশন আছে বুঝতে পেরে সে লুকিয়ে থেকে খুব সাবধানে যোগাযোগ করে তোমার চাচার সাথে। ওই মুহূর্তে তোমার চাচা ছাড়া আর কারও কথায় ও ভাবতে পারেনি। বলা ভালো বিশ্বাস করতে পারেনি। তাকে ওই মেসেজের কথাও জানায় আর ইনফরমেশনগুলোও।”
“আমার চাচার তবে আপনার মতো স্পাই এজেন্টদের সঙ্গেও ওঠা-বসা আছে!” মুগ্ধতা নয়‚ শাজের কণ্ঠে মুগ্ধতার আড়ালে শেহরোজ অনুভব করল অন্যকিছু। হতে পারে তা তিরস্কার। অথবা গভীর মনঃকষ্ট‚ অভিমান।
“ছিল না। তিনি জানতেনও না আমাদের অরগানাইজেশানের ব্যাপারে৷ তিনি এই বিপদের কথা শেয়ার করেছিলেন একজন ফিলিস্তিনির সঙ্গে৷ যিনি এমআইটির একজন প্রফেসর আর তোমার চাচার খুব ভালো ওয়েলউইশার। এবং তিনি আমাদের অরগানাইজেশানেরই একজন ইনফরমার।”
শাজকে দেখাল স্তব্ধীভূত। শেহরোজের কোনো কথাকেই সে কোনোভাবেই পারছে না অবিশ্বাস করতে। মাত্র একদিনের ব্যবধানে এই ব্যক্তির চোখদুটি হলো ওর কাছে অপরিচিত। আর এই মুহূর্তে আশ্চর্যভাবে সেই অপরিচিত চোখের ভাষায় বলছে‚ ছেলেটা মিথ্যা বলছে না! কিন্তু ও যে খুব করে চাইছে সবটা মিথ্যা হোক। একমাত্র আপন যে দুটো মানুষ আছে ওর এই দুনিয়াতে‚ ওকে ঘিরে তাদের এসব কিছু মিথ্যা হোক‚ শেহরোজের এই স্বীকারোক্তিগুলো মিথ্যা হোক৷ মাথাটা দু’হাতে চেপে ধরল হঠাৎ‚ বিড়বিড়াল‚ “আমার অনুভূতিগুলোও মিথ্যা হয়ে যাক।”
“শাজ”‚ ললিত কণ্ঠে ডাকল শেহরোজ।
কিন্তু কোনো সাড়া দিলো না শাজ৷ একজন স্পাই এজেন্টকে কী অবলীলায় ওর জীবনে প্রবেশের অনুমতি দিয়ে দিলো ওর আপন চাচা‚ ওর একমাত্র ভাই! সেই লোকটিও সুযোগে ওর সান্নিধ্যে আসার জন্য প্রত্যেকটা মুহূর্ত অভিনয় করে গেল ওকে ভালোবাসার। সবটাই জানছে ওর আপন মানুষদুটি। কিন্তু তারা নির্বিকার। আর ও-ই বা কী করে এই কপট প্রণয়ে ফেঁসে গেল? তাও কি-না মাত্র চার-পাঁচ দিনে! বুঝতেই পারল না কখনো শেহরোজের কপটতা—এতটাই নির্বোধ সে! না-কি শেহরোজই দারুণ দক্ষ ছিল অভিনয়ে?
“তুমি কিছু বলো‚ শাজ”‚ ওর হাতটাকে বুকের সঙ্গে চেপে ধরল শেহরোজ।
নোনাজলে ঝাপসা চোখদুটো তুলে শেহরোজের আকুতি ভরা চোখে চাইলো। হাতটাকে টেনে নিলো তার বুক থেকে। “ঠিক কী বলা যায় বলুন তো?” জবাবের বদলে পালটা প্রশ্ন রাখল শাজ।
“আমরা অপরাধী তোমার কাছে। তা অস্বীকার করার সুযোগ নেই৷ কিন্তু আমাদের সিচুয়েশনটাই এমন ছিল যে‚ চাইলেও তোমাকে শুরু থেকে সবটা অবগত করতে পারিনি৷”
“সিচুয়েশন”‚ অনুচ্চস্বরে উচ্চারল করল শাজ। “আমার মানসিক পরিস্থিতি কি এতটাই হতাশজনক ছিল? একটাবার এ ব্যাপারে কথা বলতে পারল না কাকু? এমনকি ঝুমা আন্টি? আর আমার ভাই…”‚ আইয়াজের কথা ভেবেই হেসে ফেলল৷ সেই হাসি ক্লেশিত।
দীর্ঘশ্বাস ফেলল শেহরোজ৷ এই আবেগী‚ অভিমানী শাজকে বোঝানো‚ সামলানো কঠিন কি খুব? কিন্তু কঠিন হলেও ওকে পরিস্থিতিটা বোঝাতে হবেই৷
নিজের মানসিক অবস্থাটা সত্যিই ওর কতখানি নাজুক ছিল তা এই মুহূর্তে অভিমানে আর কষ্টে ভুলে গেছে শাজ৷ যদি এমন পরিস্থিতিই থাকত যে‚ ওকে সব কিছু শুরু থেকে জানালে ও সহজেই ওমর ফারুকের দেওয়া চিপটা তাদের হাতে তুলে দিতো! তবে কি খালিদ উসমান বাধ্য হতেন একজন বিদেশী স্পাই এজেন্টকে ওর জীবনে পাঠাতে? তিনি তো সন্তানই মানেন শাজকে৷ মানুষটা কতখানি অসহায় আর নিরুপায় হলে নিজের সারা জীবনের সাধনার বিনিময়ে ভাতিজির জীবনের নিরাপত্তা কামনা করেছেন! অথচ তা এই মুহূর্তে শাজ বিচার করতে পারছে না।
“শাজ‚ আমার অপরাধকে কি ক্ষমা করা যায়?”
“আপনি…”‚ কান্নাকে বাধা দেওয়ার জোরালো চেষ্টা চালাতে গিয়ে ঠোঁটদুটি ভীষণ কাঁপছে শাজের। কথাও জড়িয়ে আসতে চাইছে অশ্রুরুদ্ধ কম্পমান কণ্ঠের কারণে৷ সেভাবেই বলল সে‚ “আপনি কে‚ শেহরোজ? আপনি আমার পর। আপনার কাছে আমার কোনো এক্সপেকটেশন থাকার কথা না‚ রাইট? যেখানে আপন ভাইয়ের কাছেই কখনো কিছু আশা করতাম না।”
খুব সত্য। সত্যিই শেহরোজ কে শাজের? এই বাস্তব সত্যটা শুনতেই বুকের ভেতরটাই কেমন যেন লাগল তার। সেটা কি কষ্ট? কিন্তু কষ্ট পেলে তো সে বোকা। সেও নিশ্চয়ই কখনো আশা করেনি শাজ তাকে প্রচণ্ড আপন ভাববে? তাছাড়া কদিনই বা তাকে চেনে শাজ? ওকে নিয়ে তার ভাবনা‚ তার পরিকল্পনা‚ তার ভালো লাগা বা অনুভূতির যাত্রা চারটা মাস। সেখানে তাকে ঘিরে শাজের অনুভূতি মাত্র চারদিনের। চারদিনে কি কারও আপন হওয়া যায়? না কাউকে ভালোবাসা সম্ভব হয়? যা হয় তা কেবল আকর্ষণ আর মোহাচ্ছন্নতা। শাজও এসবের মাঝেই অবস্থান করছে এখন। তাকে শাজ ভালোবাসার আগেই আজ এই সবকিছুও নিঃশেষ হয়ে যাবে।
“আমি জানি আমি তোমার কেউ নই”‚ মুখটা অবনত করে বলল শেহরোজ। “কিন্তু তোমার চাচা‚ তোমার ভাই‚ ঝুমা আন্টি‚ তারা বাধ্য না হলে তোমার থেকে সবটা আড়াল করত না‚ তাই না? আর বাধ্য না হলে কাল রেবেকা গোমেজের হেল্পও নিতে হত না আমাকে। একটু ভেবে দেখো‚ শাজ।”
সম্মতি প্রকাশ করল শাজ মাথা ঝাঁকিয়ে। “বোধ হয় আপনারাই সঠিক৷ আমার আর ভাবার প্রয়োজন কী?”
“শাজ!” আকুল স্বরে অনুরোধ করল শেহরোজ‚ “ডিয়ার মি‚ প্লিজ মাথাটা একটু ঠান্ডা করে ভাববে? আর আমাকে একটুখানি বিশ্বাস করবে?”
চেয়ারটা ছেড়ে নীরবে উঠে পড়ল শাজ। ভেজা চোখ আর গাল মুছতে মুছতে মন্থর পায়েই হাঁটতে শুরু করল ঘরে ফেরার লক্ষ্যে৷ বিমর্ষ শেহরোজ হতাশ চোখে অনিমেষ চেয়ে রইল ওর যাওয়ার পানে৷ অকস্মাৎ উপলব্ধি করল‚ যদি বেঁচে থাকে তবে যে এবার তাকে শূন্য হয়ে ফিরতে হবে তেহরান। মাথাটা নুইয়ে চোখদুটো বুজে ফেলল—কল্পনা করল শাজের শেষ হাসিমুখর মুহূর্তটুকু৷
“শেহরোজ?”
ঝট করে চাইলো শেহরোজ শাজের কান্না জড়ানো কণ্ঠকে অনুসরণ করে।
সিঁড়ির মুখে দাঁড়িয়ে শাজ। সজল চোখে বলল‚ “আব্বুর পর আপনিই সেই মানুষ ছিলেন৷ যার ছায়ায় কেন যেন সব থেকে নিরাপদ অনুভব করতাম। শান্তিও। আর…” কণ্ঠস্বর ক্ষীণ হয়ে এলো এ পর্যায়ে‚ “হয়তো ভালোও বেসে ফেলতাম।”
“শাজ”‚ উঠে দাঁড়াল শেহরোজ। “উইল ইউ গিভ মি আ চান্স টু এক্সপ্লেইন মাই ফিলিংস?” বলতে বলতে শাজের দিকে এগোতে শুরু করল শেহরোজ শম্বুকগতিতে। তখনই শাজ থামতে বলল তাকে হাতের ইশারায়। অবিলম্বেই পা জোড়া থেমেও গেল তার।
“আমাদের এই গল্পের ভূমিকাতেই মিথ্যা আর ছলনা”‚ শুষ্ক স্বরে বলল শাজ। “সেখানে কোনো ফিলিংস থাকতে পারে না৷ আছে শুধু অভিসন্ধি। আপনাকে আর কোনো অভিনয় করতে হবে না‚ শেহরোজ৷” একটু থেমে কান্নাটুকু গিলে নিলো। হিম সুরে জানাল তারপর‚ “আপনাকে আপনার লক্ষ্যে পৌঁছে দেবো। কথা দিলাম। কেবল আপনার অ্যাসাইনমেন্ট শেষে আমার জীবন থেকে বিদায় গ্রহণের অনুরোধ রইল। রাখবেন নিশ্চয়ই অনুরোধটুকু?”
বিমূর্তের মতো চেয়ে রইল শেহরোজ। কিন্ত বুকের গহিনে ভাংচুরের যন্ত্রণা। ভুল করেও সেই যন্ত্রণার ছাপ পড়তে দিলো না চেহারায়। আর চেষ্টাও করল না অনুভূতিগুলোকে ব্যাখ্যা করার। উপরন্তু হাসল স্মিত‚ “তুমি চাইছ। আমি রাখব না তা কী করে হয়?”
“থ্যাঙ্কস।” বলে আর দাঁড়াল না শাজ। হনহনিয়ে ছাদ থেকে নেমে এসেই ঘরে ঢুকে দরজাটা বন্ধ করে দিলো। ক্যাবিনেটের সর্বশেষ ড্রয়ারটা খুলে বের করল ওমর ফারুকের ইউনিফর্ম। রাঙামাটিতে তার কোয়ার্টারে থাকা তার সকল কিছু যেদিন ওর হাতে তুলে দেওয়া হলো‚ তারপর থেকে এই ইউনিফর্ম শাজ কখনো নিজের কাছ ছাড়া করে না৷ বাবার পোশাকটা বুকে জড়িয়ে ধরে ডুকরে কেঁদে উঠল শাজ। সেই কান্না আহাজারিতে পরিণত হলো৷ ক্যাবিনেটের গায়ে হেলান দিয়ে মেঝেতে পা ছড়িয়ে বসে চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে প্রলাপের মতো বকতে থাকল সে। “আব্বু‚ তুমি সেদিন বলেছিলে কাউকেই যেন বিশ্বাস না করি৷ সত্যিই করিনি… করতে পারিনি৷ তুমি বিদায়ের আগে আমাকে শেষবারের মতো জড়িয়ে ধরে আদর করে বলেছিলে‚ সঠিক কেউ এলে আমি নাকি ঠিক চিনে নিতে পারব। কারণ‚ তুমি বিশ্বাস করতে আমার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ের ক্ষমতা নাকি প্রখর। কিন্তু দেখো ওর উদ্দেশ্য‚ ওর ছলনা আমার মন টের পায়নি৷ অথচ তবুও আমার সেই মন আর মস্তিষ্কও জানান দিচ্ছে‚ তোমার অসম্পন্ন মিশন সম্পন্ন করার যোগ্যতা আর ক্ষমতা আছে একমাত্রই ওরই। আমি ধোঁকার কষ্টকে ভুলে ওকে কি বিশ্বাস করব তবে? বলো‚ আব্বু? আমার এই মনটা দ্বিধাজড়িতও।”
বন্ধ দরজার এপাশটাই শেহরোজ দাঁড়িয়ে। শাজের প্যানিক অ্যাটাক নিয়ে চিন্তা আর ভয় কাজ করছিল তার মাঝে৷ তাই এক মুহূর্ত দেরি না করেও সে ছুটে আসে শাজ ঘরে প্রবেশের পরই৷ কিন্তু ভাবেনি‚ বুকে মোচড় দেওয়া এই আর্তনাদ শুনতে হবে আর তা শুনতে শুনতে তাকে স্মৃতিবেদনাতুর করে তুলবে। বাবার মৃত্যুর পর দুদিন অবধি মাকে সে কাঁদতে দেখেনি। তৃতীয় দিনের রাতে বন্ধ দরজার ওপাশে মাকে এমন চিৎকার সুরেই কাঁদতে শুনেছিল। আর সে বসে ছিল গোটা রাত দরজার এপাশে। মায়ের সেই আহাজারিতে সকলের কান ভারী হয়ে এলেও তার হয়ে ছিল বুক ভার। নিভৃতে বসে সেও কেঁদেছিল সেদিন—কেবল নীরবে।
সেদিনটার মতো আজও শেহরোজ বসে পড়ল দরজার সামনে। চুপচাপ শুনতে থাকল শাজের কান্না। অবিরত একটা ঘণ্টা শুনতে শুনতে হঠাৎ শাজ নিশ্চুপ হয়ে গেল। কোনো আওয়াজ এলো না পাঁচটা মিনিট। তখনই আঁতকে উঠল সে৷ উঠে দাঁড়িয়ে কয়েক সেকেন্ড দ্বিধায় ভুগল ওকে ডাকবে কি-না! শেষমেশ দ্বিধা ঝেড়ে ফেলে দরজায় ঠকঠক করে ডাকল‚ “শাজ? ডিয়ার‚ প্লিজ ওপেন দ্য ডোর!”
চমকিত করে দরজাটা খুলে দিলো শাজ মুহূর্তেই। থমথমে মুখ‚ রক্তিম চোখ‚ গালে কান্নার দাগ আর ওর বুকে জড়িয়ে ধরা ওমর ফারুকের রেজিমেন্ট ক্যাপটা। প্রশান্তির শ্বাস ফেলল শেহরোজ ওকে দেখতে পেয়ে। কিন্তু তাকে আরও বেশি চমকে দিয়ে শাজ তার হাতটা ধরে ঘরে নিয়ে এলো। দরজাটাও বন্ধ করে দিলো। শেহরোজ মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে দেখতে থাকল শাজের গতিবিধি।
বিছানাতে এসে বসল শাজ। শেহরোজের দিকে এক পলক তাকাল নীরবে। তারপর শেষবারের মতো শেহরোজকে চমকে দিয়ে ক্যাপের সিম্বল অংশটুকু সেলাই করে খুলে তার নিচ থেকে বের করে আনল কাঙ্ক্ষিত সেই চিপটা। শত্রুপক্ষ ওমর ফারুকের ইউনিফর্মের সমস্ত জায়গা সন্ধান করলেও ক্যাপের এই সিম্বল ছিল তাদের সন্দেহের বাইরে। মুখ খুলল শাজ‚ “আমার ভাই তার ইউনিকোড দ্বারা হয়ত সমস্ত ডেটা হ্যাক করে নিতে পারবে। কিন্তু ওই ফাইলটা ওপেন করতে পারবে না। তার জন্য প্রয়োজন আমার…”
“তোমার পাসওয়ার্ড প্রোগ্রাম কোড ইন C++ ”‚ শাজের মুখের কথা কেঁড়ে নিলো শেহরোজ।”
“হুঁ”‚ এক মুহূর্ত চুপ থেকে সায় দিলো শাজ। “সে হোয়াইট হ্যাট হ্যাকার হলে আমি তো তারই বোন।”
***
চলবে।