শ্যামাবতী প্রেয়সী পর্ব-১১

0
31

#শ্যামাবতী_প্রেয়সী
#পর্ব- ১১
#জেসমিন_জেমি

ধরনীর বুকে অপরাহ্ন নামল। তপ্ত দুপুরে সূর্যের ঝলমলে আলোয় উজ্জল ধরনী। পরী বাড়ীটি ঘুরে ফিরে দেখছে। বাড়ীটা ভীষণ সুন্দর। পরীর খুব ভালো লেগেছে কিছুটা গ্রাম গ্রাম ভাব। শহরের আভিজাত্য এখনো ছুয়ে দেয়নি জায়গাটাতে। বাড়ীটি দুটি তলাবিশিষ্ট। বাড়ির একটি কোণে একটি বড় ডাইনিং রুম। বাড়ির মূল প্রবেশ পথটিতে একটি বিশাল গেট। বাড়ীর পাঁশেই এক পুরানো গাছের নিচে ছোট একটি পুকুর। পুকুরটির পানি স্বচ্ছ,পুকুরের স্বচ্ছ পানিতে ভাসছে শাপলা । পরী বাঁধাই করা পুকুর ঘাটে বসে আছে তার ঠিক পাশেই এক মিষ্টিমুখ বকবক করে যাচ্ছে। মেয়েটা তাকে পুরো বাড়ী ঘুরিয়ে দেখিয়েছে। পরীর হাতে পাকা পাকা বরই আর অন্য হাতে লবন। আলিশা একটু আগে বরই গাছ থেকে বরই এনে পরীর হাতে ধরিয়ে দিয়েছে। আলিশা চঞ্চল কন্ঠে বললো,
ভাবি খাচ্ছো না কেনো? খাও দেখো ভীষন মজা।

পরী হাসলো শুধু পরপর বরই এ কামড় বসালো। আলিশাও বরই খেতে খেতে পানিতে পা দোলাতে দোলাতে বললো,
আমি কি বেশি বকবক করছি? তুমি কি বিরক্ত হচ্ছো ভাবি?

পরী – না না বিরক্ত কেনো হবো? আমার তো খুব ভালো লাগছে।

আলিশা হুট করে পরীকে দুহাতে জড়িয়ে নিলো। পরপর বললো,
ভাবিইইই তুমি খুব ভালোওওও।

পরী হতভম্বিত হয়ে গেলো আলিশা আবারও বললো,

জানো মা বলে আমি বেশি বকবক করি।

দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,
এরজন্য নাকি আমার বিয়ে হবে না। কেউ নাকি আমাকে বিয়ে করবে না।
আমার কি সত্যিই বিয়ে হবে না ভাবি?

পরী মেয়েটার মুখে চাইলো। মেয়েটা সুন্দর গায়ের রং ফর্সা। তবে তার থেকেও বেশি সুন্দর মেয়েটার চোখ দুটো। মেয়েটা যখন হাসে ওর চোখ দুটোও সাথে সাথে হাসে, আর মেয়েটার হাসি যেনো মুখ থেকে সরেই না কখনো। এই যে পরী সকাল থেকে দেখছে এই মেয়ে হেঁসেই চলেছে। আর সারাক্ষণ কথা বলেই যাচ্ছে। হ্যাঁ মেয়েটা কিঞ্চিৎ পরিমান বেশি কথা বলে তবে এটাও যেনো মেয়েটার একটা সৌন্দর্য। মেয়েটাকে চুপ থাকলে বোধহয় কম সুন্দর লাগবে বরং কথা বললেই তাকে বেশি ভালো লাগে। সকাল থেকে পরীর সঙ্গী হয়েছে আলিশা।

পরী আলিশার গাল টেনে দিয়ে বললো,
কেনো হবে না? আমাদের আলিশার জন্য রাজপূত্র আসবে।

আলিশা ফিক করে হাসলো, বললো,
এহতিশাম ভাইয়ার মতো??

পরী থতমত খেয়ে বসলো। আলিশা আবারও বললো,
বলো বলো এহতিশাম ভাইয়ার মতো রাজপূত্র?

এহতিশাম রাজপূত্র? হ্যাঁ সে রাজপূত্রই বটে, রুপকথার রাজপূত্র নয় পরীর জীবনের বাস্তব রাজপুত্র । পরী যখন ছোট ছিলো তখন মাহমুদ শিকদার বলতো,
আমার আম্মার জন্য সাত সমুদ্র তেরো নদী পার হয়ে রাজপূত্র আসবে।

পরী কী তখন অতো কিছু বুঝতো? তবুও খিলখিল করে হাসতো আয়রা বেগম বাবা মেয়ের হাসি শুনে ছুটে ঘরে এসে বলতো,
কি নিয়ে গল্প হচ্ছে মা-ছেলের?

পরী আধো আধো গলায় বলতো,
রাজপূত্র।

আয়রা বেগম মেয়েকে কোলে তুলে কপালে চুমু একে বলতো,
রাজপূত্র তো আসতেই হবে আমার মেয়ে তো রাজকন্যা।

হঠাৎ করে পুরনো কথা মনে পড়ে গেলো। দুচোখ ভারি হয়ে উঠলো মুহুর্তেই। শৈশবের স্মৃতি ভীষন মধুর। বয়স বাড়ার সাথে সাথে সব কিছু পরীর জন্য বি*ষাক্ত হয়ে উঠেছে। আয়রা বেগম পরীর থেকে দূরে সরে গেছে।
আলিশা পরীকে মৃদু ধাক্কা দিয়ে বললো,
ভাবিই!

পরী দু দিকে মাথা নাড়লো। মুখে বললো,
হুম।

আলিশা ধীরকন্ঠে বললো,
তুমি কি বিরক্ত হচ্ছো?

পরী এবার নিজেকে স্বাভাবিক করলো। ঠোঁট প্রসারিত করে হেঁসে বললো,
বোকা মেয়ে বিরক্ত কেনো হবো?

আলিশা আবারও চটপটে হয়ে উঠলো।বললো,,

তাহলে বলো এহতিশাম ভাইয়ার মতো রাজপুত্র আসবে?

পরী এবার ফিক করে হাসলো, বললো,
হুম হুম ।

আলিশা হেঁসে উঠলো। বাচ্চা একটা মেয়ে আলিশা। এবার ক্লাস নাইনে উঠেছে। বাচ্চামো স্বভাব এখনো কা/টে নি মেয়েটার।

পরী- তোমাদের বাড়ীটা সুন্দর।

আলিশা ঠোঁট উল্টালো, বললো,
এটা আমাদের বাড়ী নাহ।

পরী বেশ অবাক হলো, বললো,
তোমাদের বাড়ী না?

হুট করে আলিশার মুখের হাসি মিউয়ে গেলো। ধীরকন্ঠে বললো,
নাহ এটা এহতিশাম ভাইয়াদের বাড়ী। আমাদের বাড়ী নেই। আমরা এখানে শুধু থাকছি এটুকুই।

পরী বেশ অবাক হলো। বাড়ী নেই? বাড়ী থাকবে না কেনো? লক্ষ্য করলো যে মেয়েটার মুখ থেকে হাসি সরে না হুট করে মেয়েটা চুপসে গেলো। মেয়েটার মুখে এখন আর হাসি নেই। বাচ্চামোটাও মনে হলো হাওয়া হয়ে গেলো। মেয়েটা উঠে দাঁড়ালো। পরী পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার জন্য বললো,
তোমরা থাকছো মানেই তোমাদের বাড়ী বুঝেছো?

আলিশা মৃদু হাসলো। পরী আবারও অবাক হলো। মুহুর্তেই বাচ্চা মেয়েটা কেমন যেনো বড় বড় হয়ে গেলো। আলিশা বললো,

– থাকলেই নিজের হয় না ভাবি। কিছু জিনিস নিজের হয়েও নিজর হয় না। মানুষ থেকে শুরু করে বাড়ী বলো নিজের বলতে কিছু হয় না।

পরী উঠে এসে আলিশার কাঁধে হাত রাখলো। মেয়েটা অন্যপাঁশ ফিরলো এক হাতে চোখ মুছলো। পরী ধীরকন্ঠে বললো,,,

কাঁদছো কেনো? কি হয়েছে বলো। আমি কি তোমায় কষ্ট দিয়ে ফেললাম?
আম স্যরি আলিশা। আমি আসলে,,,

আলিশা হেঁসে উঠলো। বাচ্চা মেয়েটার মুখে আবার বাচ্চামো স্বভাব ভেসে উঠলো। হো হো করো হেঁসে উঠে বললো,
প্রাংক! ভয় পেয়েছো? ভেবেছো তোমার কথায় আমি কষ্ট পেয়েছি? হা হা।

পরী হতভম্ব হয়ে চেয়ে রইলো। মেয়েটা ভীষন দুষ্টু যদিও পরীও ভীষন দুষ্টু ছিলো। পরী ও এমন উড়নচণ্ডী স্বভাবের ছিলো। তবে সময়ের সাথে সাথে পরী হয়ে উঠেছে শান্তস্বভাবের।
আলিশা পেট চেপে হেসেই চলেছে তখনই বাড়ী থেকে আলিশার মা আছিয়া বেগমের ডাক পড়লো। আলিশা, পরী ব্যস্ত পায়ে সেদিকে গেলো। আলিশা পরীর হাত হাতে রেখে দুলতে দুলতে যাচ্ছে। পরী মেয়েটার দিকে চেয়ে রইলো।মেয়েটা হুট করে পরীর সাথে ভীষন মিশে গেছে।
আজ সারাদিনের সঙ্গীও এই বাচ্চা মেয়েটা।
সকালের নাস্তা শেষে এহতিশাম বের হয়েছে। লোকটাকে পরী যতটুকু বুঝলো,যতটুকু জানলো লোকটা ভালো, ভীষণ ভালো। এই তো সকালে যখন লোকটা বের হলো পরীর দু গালে হাত রেখে বললো,

দ্রুত ফিরবো।
খারাপ লাগলে আলিশার সাথে গল্প করতে পারো।

পরী শুধু মাথা নেড়েছিলো। এহতিশাম পরীকে অবাক করে দিয়ে পরীর কপালে শব্দ করে ঠোঁট ছোঁয়ালো। পরী শুধু ফ্যালফ্যাল নয়নে দেখলো। এহতিশাম আর পরীর সম্পর্ক কি এতো দূর এগিয়েছে? কই পরী তো এখনো এহতিশামকে কাছের মনে করছে না। এহতিশাম কেনো পরীকে তার এতো কাছের, এতো আপন ফিল করাচ্ছে। মনে হচ্ছে পরী এহতিশামের যুগ যুগ ধরে চেনা। তাদের মাঝে এক মধুময় প্রেমের সম্পর্ক আর এহতিশাম হচ্ছে পরীর পা*গল প্রেমিক। অথচ তাদের মাঝে এমন কোনো সম্পর্ক নেই। পরীও এহতিশামের প্রেমিকা না, এহতিশামও পরীর পা*গল প্রেমিক না। পরীর যেনো কি হয় এই লোকটার সামনে পরী কথা বলতে পারে না, কিছু জিজ্ঞেস করতে পারে না। অথচ পরীর কতশত কথা জমা, কতশত প্রশ্ন, কত কথা জানার আছে এহতিশামের থেকে। কই পরী তো এমন ছিলো না তবে কি পরী বাকপ্রতিবন্ধী? কই না তো! সে তো কথা বলতে পারে কদিন আগেও এহতিশামের সাথে ঝগড়া করেছে পরী তখন তো ঠিকই কথা বলতে পেরেছে তাহলে এখন? লোকটা কি জাদু মন্তর করে পরীকে বোবা করে রাখছে? রাখতেও পারে । এতো এতো ভাবনার মাঝে পরীর চোখ গেলো পাঁশে থাকা চঞ্চল মেয়েটার দিকে মেয়েটা হুট করে মনে পড়লো মেয়েটা তখন কাঁদছিলো। পরী নিজের চোখে দেখেছে। চোখের জল কখনো মিথ্যা বলে না। অথচ মেয়েটা কি সুক্ষ ভাবে এড়িয়ে গেলো। বোকা বানালো পরীকে।

———-
এহতিশাম বাসায় ফিরলো রাতে। পরী আছিয়া বেগমের সাথে টুকটাক গল্প করছে। আছিয়া বেগম সম্পর্কে পরীর খালা শাশুড়ি। ভদ্র মহিলা ভীষন ভদ্র সভ্য। কথা বলে ছোট ছোট করে। একদম সহজ সরল নরম স্বভাবের মানুষ। মা মেয়ের ভীষন পার্থক্য। মা চুপচাপ শান্তস্বভাবের আর মেয়ে উড়ুনচন্ডী স্বভাবের। ড্রয়িং রুমে তিনজন মিলে গল্প করছিলো। আছিয়া বেগমের সাথে গল্প করে পরীর খুব ভালো লাগছে। ভদ্র মহিলা একদিনে পরীকে আপন করে ফেলেছে। মা মেয়ের এতো এতো অমিলের মাঝে এক মাত্র মিল হচ্ছে খুব সহজে মানুষকে আপন করে নেওয়া। আছিয়া বেগম মধ্যবয়সের, বেশ মোটা সোটা না হলেও উনাকে চিকন স্বাস্থ্যের ও বলা যায় না । পড়নে সূতির শাড়ী যার আঁচল মাথায় রাখা। মহিলা গল্প করতে করতে জানালো,
এহতিশামের মা আর তিনি খুব ভালো বান্ধবী।
এহতিশামদের সাথে ওদের রক্তের কোনো সম্পর্ক নেই।

তিনজনের গল্পের মাঝেই বাসায় ঢুকলো এহতিশাম। পড়নে বেবি ব্লু রঙের শার্ট, ব্লাক জিন্স, ব্লাক শূ, হাতে সিলভার ওয়াচ। কালো সানগ্লাস গলায় ঝুলানো। এলেমেলো চুল, ফর্সা মুখশ্রী লাল হয়ে উঠেছে। পরী বিরবির করে বললো,
লোকটা কি ক্লান্ত?
ক্লান্ত মানুষকেও এতো সুদর্শন লাগে?

পরী ফ্যালফ্যাল চোখে তাকিয়ে রইলো দরজায়।
এহতিশামকে দেখে আছিয়া বেগম উঠে এলো। এহতিশামের মুখে হাত বুলিয়ে বললো,
ক্লান্ত দেখাচ্ছে তোমাকে,
আলিশা রান্নাঘর থেকে ঠান্ডা পানি নিয়ে আয় তো।

এহতিশাম মৃদু হাসলো, বললো,
ঠিক আছি। ব্যস্ত হবেন না।

আছিয়া বেগম ধীরকন্ঠে বললো,
রুমে যাও। ফ্রেশ হও।

এহতিশাম বাধ্য ছেলের মতো মাথা নাড়লো। পরী হা করে তাকিয়ে রইলো। পরীর জানা মতে আছিয়া বেগম আর আলিশাকে এই প্রথম দেখছে এহতিশাম। বাংলাদেশে শেষ এসেছিলো যখন এহতিশামের বয়স ৮ বছর। আছিয়া বেগমের থেকে শোনা তারপর আর বাংলাদেশে আসেনি এহতিশাম। এখন পরী অনুমান করছে এহতিশামের বয়স ২৮ হবে হয়তো। তার বেশি হলেও হতে পারে। এহতিশাম পরীকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে ভ্রু কুঁচকালো। আছিয়া বেগম সেটা দেখলো পরীকে ডেকে বললো,

-দেখো দেখি পা/গলী বউ। এভাবে বসে আছো কেনো? যাও যাও রুমে যাও।

পরী থতমত খেলো পরপর কেঁশে উঠলো। এহতিশাম যেতে যেতে বাঁকা হাসলো। পরী চোখ মুখ কুঁচকালো, যার মানে এই বজ্জাত মার্কা হাসির মানে কি সাদা বিলাই সাহেব??
পরপর নিজেও রুমের দিকে গেলো।
কি এক অদ্ভুদ সম্পর্কে জড়িয়েছে পরী। এই সম্পর্কের আগা মাথা কিছুই খুঁজে পাচ্ছে না। শুধু এটুকুই জানা আছে সাদা বিলাই, এই বিদেশী বিলাই এখন তার স্বামী। ব্যাস শুধু এটুকুই। পরীর জীবন এখন এহতিশাম নামক কেন্দ্রবিন্দুতে এসে থেমেছে। আগে পরের সব কিছু কি পরী ভূলে বসেছে?

চলবে,,,,,,,

(ভুলক্রুটি মার্জনীয়)