শ্যামাবতী প্রেয়সী পর্ব-১৯

0
26

#শ্যামাবতী_প্রেয়সী
#পর্বঃ ১৯
#জেসমিন_জেমি

নিস্তবতায় ঘেরা গভীর রাত। মাঝরাতে আনানের ঘুম ছুটে গেলো। চোখ মেলে তাকালো পুরো রুম অন্ধকার । আনান একহাতে বিছানা হাতড়ালো অন্য হাত নাড়াতে গিয়ে টের পেলো তার হাত কারো হাতের মুঠোয়। আনান আঁশপাঁশ হাতরে মোবাইলের ফ্লাশ অন করতেই চোখে পড়লো এক ঘুমন্ত মুখশ্রী। যে এই মুহুর্তে আনানের হাত ধরে ফ্লোরে বসে আছে তবে বিছানায় মাথা রাখা। আনান গভীর চোখে রিপ্তীর দিকে চেয়ে রইলো। ছোট গোলগোলা এক ফর্সা মুখশ্রী। আনান রিপ্তী এক বিছানায় থাকে না। রিপ্তী সোফায় ঘুমায়। যদিও আনান সেদিন বলেছিলো বিছানায় শুতে পারিস। রিপ্তী মুখ ঝামটে বলছিলো আপনার মতো মানুষের সাথে বেড শেয়ার ম/রে গেলেও করবো না। আনান সেদিন রিপ্তীকে ধাক্কা দিয়ে সড়িয়ে বলেছিলো,
সর তোর সাথে বেড শেয়ার করতে বসে আছি আমি? ফালতু বকবক করবি না।

রিপ্তী আনানকে বলেছিলো,
আপনি বসে থাকলেও, ম/রে গেলেও আমি বেড শেয়ার করবো না।

আনান ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লো। রিপ্তী কোমরে হাত গুজে তেড়ে এসে বললো,
কি করছেন? আমার বিছানায় কেনো যাচ্ছেন?

আনান ভ্রু কুঁচকে বললো,
তো কার বিছানায় যাবো? পরীর?

রিপ্তী আনানের কলার চেঁপে ধরলো,
ফালতু কথা বলবেন না বলে দিলাম।

আনান একঝটকায় সড়িয়ে নিলো রিপ্তীর হাত। থমথমে কন্ঠে বললো,
সর বকবক করলে রুম থেকে বের করে দিবো। পরে বাইরে বসে বসে বকবক করিস।

রিপ্তী বেশ অবাক হলো। এতো বড় সাহস? রিপ্তীকে রিপ্তীর রুম থেকে বের করে দিবে?

-আমার রুম,আমার বাড়ী আমাকে বের করে দিবেন? এতো অকৃতজ্ঞ মানুষ।

আনান রিপ্তীর দিকে চোখ পাকিয়ে তাকালো সাথে সাথে আবারো বিছানায় শুয়ে পড়লো। রিপ্তী সেভাবেই দাঁড়িয়ে রইলো। সে ম/রে গেলেও এই লোকের সাথে বেড শেয়ার করবে না। সে বালিশ টেনে সোফায় গিয়ে শুয়ে পড়লো। চিবিয়ে চিবিয়ে বললো,
খা/টা/শ লোক।

সেদিনের কথা মনে পড়লেই আনান মুচকি হাসলো। একহাতে রিপ্তীর মুখের উপর এলেমেলো চুলগুলো গুছিয়ে দিলো। মুখে আলো পড়তেই রিপ্তী চোখ মুখ কুঁচকালো। মুখ দিয়ে অস্পষ্ট শব্দ করলো। আনানের হাতে নাক মুছে আবারো ঘুমালো। আনান চোখ কুঁচকে ফেললো। সে আচমকা হাত টেনে নিলো রিপ্তীর থেকে রিপ্তী হকচকিয়ে উঠলো। ঘুম ছুটে গেলো ধরফর করে উঠে বসে রইলো। চোখের সামনে আনানকে দেখে ঘুমঘুমকন্ঠে বললো,
কি হয়েছে? কি হয়েছে?

আনানের কেনো যেনো হাসি পেলো। সে অন্ধকারে হাসলো পরপর থমথমেকন্ঠে বললো,
আমার হাত কি সরকারি মাল?

রিপ্তী অবাক হলো ভীষণ। বললো,
মানে?

আনান দাঁতে দাঁত চেঁপে বললো,
আমার হাত বুকে জড়িয়ে ঘুমাচ্ছিস কেনো? আমাকে নোংরা বলিস আবার আমারই ঘুমের সুযোগ নিচ্ছিস?

রিপ্তী যেনো আঁকাশ থেকে পড়লো। মাঝরাতে এই মাতাল লোক বলছে কি? মুহুর্তেই রিপ্তীর রাগ লাগলো। কি সব উল্টাপাল্টা বলছে রিপ্তী কখন নোংরামো করলো? রিপ্তী কি এই নোংরা লোকের মতো নাকি? রিপ্তী তেজি গলায় বললো,
বাজে কথা বলবেন না বলে দিলাম।

আনান চোখ কুঁচকে বললো,
বাজে কথা? এই তুই আমার বিছানার পাঁশে কি করছিস? আমার হাত বুকে জড়িয়ে ছিলি কেনো?

রিপ্তীর মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো। সে চট করে উঠে গেলো। ফোনের ফ্লাশের আলোয় যেতে যেতে বললো,
অসভ্য লোক! মাতাল কোথাকার। অসভ্যতামো করার জন্য নিজেই হাত টেনে বসে ছিলেন। বলেছিলেন, কোথাও যাস না এখানেই থাক। যাস না প্লিজ।

তখন রিপ্তী চেয়েছিলো সরে আসতে আনান আসতে দেয় নি। যেহেতু ওরা এক বিছানায় থাকে না তাই রিপ্তী সারারাত ফ্লোরে বসে ছিলো।আর এই লোক কিনা বলছে রিপ্তী নোংরামো করছে?

আনান শুনলো সে বললো,
কি? কি? কি বললি আবার বল।

রিপ্তী অন্ধকারে মুখ ভেংচি কাটলো বললো,
পারবো না।

বলেই সোফায় উলটো পাঁশ ফিরে শুয়ে পড়ল।আনান মনে করার চেষ্টা করলো রাতে কি হয়েছিলো। কিন্তু দুর্ভাগ্য বশত আনানের কিছু মনো পড়লো না। আনান শুতে শুতে বললো,
নোংরামো করার ইচ্ছে থাকলে এমনিই করতে পারিস আমি মাইন্ড করবো না৷ আমি তোর বর হই অন্য কেউ না। তবে শুধু শুধু আমার নামে মিথ্যা অপবাদ দিবি না।

রিপ্তী চেঁচিয়ে উঠলো। আনান হাঁসতে হাঁসতে অন্য পাঁশ ফিরলো।

আনান তখন ড্রাংক ছিলো। রিপ্তী আনানকে শুইয়ে দিয়ে সরে আসতে নিলেই আনান রিপ্তীর হাত নিজের হাতের মুঠোয় পুড়ে বললো,
যেয়ো না প্লিজ।

রিপ্তী গোলগোল করে তাকালো। কি বললো? যেয়ো না? কাকে বললো? রিপ্তীকে? রিপ্তী অবাককন্ঠে বললো
– কি বললেন?

আনান রিপ্তীর হাত টেনে মাথায় গুজে মাতাল কন্ঠে বললো,
আমাকে ছেড়ে যেয়ো না প্লিজ।

রিপ্তী হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করলো। আনান ছাড়লো না সে রিপ্তীর হাতে শব্দ করে চুমু এঁকে বললো,
অশান্ত পাখি। দু মিনিট শান্তিতে থাকতে পারো না?

রিপ্তী কেঁপে উঠলো। ইদানীং আনানকে তার ভালো লাগছে। কি সাংঘাতিক ব্যাপার স্যাপার। দুদিন আগেও নাম শুনলেই রাগ হতো, ঘৃণা হতো। আর এখন? রিপ্তী নিজের উপর নিজেই বেশ বিরক্ত। রিপ্তী ঠোঁট কুঁচকে বললো,
শান্তিতে থাকতে দিচ্ছেন কোথায়?

এবার আর আনানের থেকে জবাব এলো না।
রিপ্তী আবারো ডাকলো কিন্তু আনান শুনলো না।রিপ্তীর হাত ও ছাড়লো না অগত্যা রিপ্তীকে ফ্লোরে বসে রাত্রি যাপন করতে হলো।

———–★———
এরপর কেটে গেছে দুদিন।
আজ থেকে রিপ্তীর এইচএসসি এক্সাম। পরিক্ষার প্রিপারেশন মোটামুটি। তবে ১ সপ্তাহ ধরে বেশ অনিয়ম হয়েছে। রিপ্তী সারারাত জেগে পড়েছে । আনান এ দুটো দিন শিকদার বাড়ীতে ছিলো না। এতে রিপ্তীর জন্য বেশ সুবিধাই হয়েছে। শুধু মিরাজ শিকদার ছাড়া এ বাড়ীর সবাই এখন রিপ্তীর সাথে কথা বলে। রুমি বেগম মেয়ের সাথে টুকটাক কথা বলে। এইতো কাল রাত জাগার কারনে মেয়েকে বকে গেছে। ভোর বেলায় উঠে রিপ্তী বেশ মনোযোগ দিয়ে রিভিশন দিচ্ছিলো। শিকদার বাড়ীর পরিবেশ দুদিন ধরে বেশ স্বাভাবিক। রিপ্তী বুঝে উঠতে পারলো না হুট করে এতোটা স্বাভাবিক হওয়ার কারন কি। আপাতত সেদিকে তার কোনো মাথা ব্যথা নেই পরিক্ষার প্রস্তুতি নিতে হবে তাকে।

আমিরাও কিছুদিন ধরে পড়ালেখায় ব্যস্ত। বোর্ড এক্সাম, ভালো রেজাল্ট করতে হবে, তারপর ভালো কোনো ভার্সিটিতে চান্স। সবগুলো টিউশন বন্ধ রেখেছে আপাতত। টিউশনের টাকায় তার পড়ালেখার খরচ চলে তাছাড়া শিকদার বাড়ী থেকেও তাদের দেখাশোনা করা হয়। আমিরার বাবা মারা গেছে আমিরার যখন ১১ বছর। তখন সপ্তম শ্রেণীতে পড়ে। আমিরার বাবা শিকদার কম্পানিতেই চাকরী করতেন। তখন ওরা গ্রামে থাকতো হঠাৎ করে একদিন দুপুর বেলা আমিরার স্কুলে খবর গেলো তার আব্বা আর বেঁচে নেই। আমিরার মাথায় যেনো আঁকাশ ভেঙে পড়লো। স্কুল থেকে ছুটতে ছুটতে বাড়ীতে এসে দেখলো বাড়ী ভর্তি লোকজন। গ্রামের মানুষজনে বাড়ীতে পা ফেলা দায়। বাড়ীর বাহির থেকেই মায়ের কান্নার গলার স্বর শুনতে পেলো। আমিরা শান্ত হয়ে গেলো ধীর পায়ে এগিয়ে যেতেই উঠানে খাটিয়াতে সাদা কাপড়ে মুড়ানো বাবার লাঁ/শ দেখলো। আমিরা ঠাই দাঁড়িয়ে রইলো আমিরাকে দেখেই আয়রা বেগম আমিরাকে জড়িয়ে নিলো। মেয়েটা হু হু করে কেঁদে উঠলো। বাবা হারানোর কষ্টটা সেই বুঝবে যে হারিয়েছে। সেদিন থেকে আমিরার মাথার উপর থেকে ভরসার হাত সরে গেলো। কেউ রইলো না তাদের দেখার জন্য। মাহদুল শিকদার ওদের মা মেয়ে কেউ তাদের সাথে নিয়ে এলো। ওদেরকে বলা হলো শিকদার বাড়ীতে থাকতে তবে খাদিজা বেগম নাকচ করলো। একজনের বাড়ীতে সে এভাবে পড়ে থাকতে পারে না। তারপর তারা গিয়ে উঠলো ছোট্ট একটা বাসায়। আমিরাকে রিপ্তীর সাথে ভর্তি করানো হলো। আস্তে আস্তে আমিরা বড় হলো। এখন উপার্জন করছে যদিও তা সামান্য।
———–
দুদিন ধরে বাসার বাইরে যায়নি শিকদার বাড়ীতে সেদিন যাওয়ার কথা থাকলেও সে যায়নি । সারাক্ষন পড়ার উপরে। খাদিজা বেগম সকালের রান্না শেষ করে মেয়েকে খেতে ডাকলো আমিরা গেলো না। খাদিজা বেগম দীর্ঘশ্বাস ফেললো। মেয়ে তার পড়ালেখায় বড্ড সিরিয়াস । মেয়ের মুখে দু-লোকমা তুলে দিয়ে বললো,
এতো পড়তে হবে না৷

আমিরা বইয়ে চোখ বুলাতে বুলাতে বললো,
ফেইল করলে তখন?

খাদিজা বেগম বললো,
বিয়ে দিয়ে দিবো।

আমিরা কপাল কুঁচকালো, খাদিজা বেগম হেঁসে বললো,
তো বিয়ে দিবো না তোকে?

আমিরা থমথমেকন্ঠে বললো,
আমি বিয়ে করবো না মা। আমি বিয়ে করলো তোমার কি হবে?

খাদিজা বেগম দীর্ঘশ্বাস ফেললো৷ পরপর বললো,
তোকে বিয়ে দিয়ে মেয়ের শশুর বাড়ীতে গিয়ে উঠবো তখন কি থাকতে দিবি না?

আমিরা কপাল কুঁচকে রইলো৷

—–
আমিরা তৈরি হয়ে বাসা থেকে বের হয়েছে। আঁশে পাঁশে পরিক্ষার্থী চারজন। দুজন মেয়ে দুজন ছেলে তবে ওদের কেন্দ্র এক কলেজে আর আমিরার অন্যটা। আমিরা ঠিক করেছে ওদের সাথেই যাবে। কিছুদিন আগে প্লান ছিলো রিপ্তীর সাথে যাবে তবে এখন যেহেতু ওর সাথে কথা হয় না রিপ্তীর সাথে যাওয়াও হবে না। আমিরা রাস্তায় বের হয়ে ওদের জন্য ওয়েট করছে। খাদিজা বেগম মেয়ের পাঁশে দাঁড়িয়ে আছে। খাদিজা বেগম বললো,
ওদের সাথে কথা বললে ভালো হতো না?

আমিরা ঘড়ীতে সময় দেখতে দেখতে বললো,
কাদের সাথে?

খাদিজা বেগম – তোর ফুপা। রিপ্তীও তো পরিক্ষা দিচ্ছে একসাথে গেলে নিশ্চিন্ত থাকতাম।

আমিরা চোখ মুখ কুঁচকে ফেললো৷ বললো,
মা সব সময় অন্যের উপর ভরসা করে কেনো থাকো? কে ওরা? আমরা ওদের কি হই?

খাদিজা বেগম চুপটি করে রইলো৷ সেদিনের পর ও বাড়ীতে পা রাখেনি আমিরা। পরী অবশ্য কয়েকবার কল করেছে কতবার যেতে বলেছে। তবুও যায়নি। কেনো যাবো? যার সাথে রেগে আছে সে তো একবারের জন্যও কল করেনি। স্যরি বলেনি। বলেনি আমু আম স্যরি। আয় লাবু আমু। আমিরার ভাবনা মাঝেই গাড়ী এসে থামলো তাদের সামনে। আমিরা নিচু হয়ে কিছু বলবে তার আগে মেহতাব গ্লাস নামিয়ে ধীরকন্ঠে বললো,
উঠো।

আমিরা ওপর সীটে তাকাতেই দেখলো রিপ্তী বসা মুখ থমথমে। একবারও আমিরার দিকে তাকালো না সে৷ আমিরা ধীরকন্ঠে বললো,
ভাইয়া আমি আসলে, আমার ফ্রেন্ডসদের সাথে যাচ্ছি আপনারা যান।

মেহতাব কপাল কুঁচকে বললো,
ঘুরতে যাচ্ছো?

আমিরা থতমত খেয়ে বললো,
হুওও? না তো।

মেহতাব থমথমে কন্ঠে বললো,
তাহলে?

আমিরা মুখ কাচুমাচু করে দাড়িয়ে রইলো। খাদিজা বেগমও মেয়েকে জোর করলো৷ মেহতাব নেমে একপ্রকার টেনে গাড়ীতে তুললো৷ আমিরা অবাক চোখে তাকিয়ে রইলো৷ এই মুহুর্তে তার মস্তিষ্ক ফাঁকা এই যে এতো এতো পড়াশোনা সে রাত জেগে করলো তা এখন মষ্তিষ্কে অ আ ক খ ছাড়া কিছুই না৷ গাড়ীতে উঠেই সে রিপ্তীর দিকে চাইলো। রিপ্তী সামনে তাকিয়ে নিজের পাঁশে থাকা শপিং ব্যাগ আমিরার দিকে এগিয়ে দিলো৷ আমিরা দেখলো তবে ধরলো না রিপ্তী জোড় করে হাতে ধরিয়ে দিলো৷ আমিরা হাতে নিতেই রিপ্তী ধীরকন্ঠে বললো,
খোল।

আমিরা খুলতেই দেখলো একটা ভীষণ সুন্দর ঘড়ি। এটা সে কিছুদিন আগে রিপ্তীর সাথে দাম করেছিলো তবে দাম বেশি থাকায় সেদিন নিতে পারেনি সাথে আরো দুটো দামি কলম, একটা ডায়েরী, একটা ছোট্ট শোপিস আর কিছু চকোলেট। আমিরা বললো,
এগুলো কার?

রিপ্তী বললো,
জরিনার মার।

আমিরা বললো,
আমাকে দিচ্ছিস কেনো তাহলে?

রিপ্তী বললো,
তুই জরিনার মা।

ওদের কথার মাঝে মেহতাব ড্রাইভ করতে করতে ধমকে বললো,
তোকে কে বললো আমার মেয়ের নাম জরিনা রাখবো? স্টুপিড

আমিরা, রিপ্তী থতমত খেয়ে বললো,
এ্যাঁ? কি বললে?

মেহতাব আয়নায় একবার হা হয়ে যাওয়া মুখটা দেখলো। দাঁতে দাঁত চেঁপে হেসে উঠলো। ধীরকন্ঠে বললে,
কিছু না।

রিপ্তী বললো, ওও।

আমিরা এখনো হা করে তাকিয়ে আছে। রিপ্তী আমিরাকে ধাক্কা মে/রে বললো,
ডায়েরী খোল।

আমিরা হকচকিয়ে উঠলো, সাথে সাথে ডায়েরী খুলতেই গোটা গোটা অক্ষরে লেখা
i’m sorry amu. I love you amu.
Sorry sorry sorry

আমিরার ঠোট প্রসারিত হলো। রিপ্তী আড়চোখে আমিরাকে দেখছে। আসলে সেদিন আনানের উপর রিপ্তী প্রচন্ড রেগে ছিলো ৷ রাগের মাথায় সেদিন আমিরার সাথে খারাপ ব্যবহার করে ফেলেছিলো। আমিরা ডায়েরী বন্ধ করে বাইরে চোখ রাখলো গাড়ী চলছে। রিপ্তী কোমরে হাতগুজে বললো,
সমস্যা কি?

আমিরা বাহিরে তাকিয়েই বললো,
not accepted.

রিপ্তী- মানে?

আমিরা – sorry not accepted.

রিপ্তী আমিরার হাত টেনে ধরলো। আমিরা তাকাতেই রিপ্তী বাচ্চাদের মতো ঠোঁট ফুলানো মুখ ভেসে উঠলো। রিপ্তী ধীরকন্ঠে বললো,
sorry amu suna.

আমিরা অন্যপাঁশ ফিরে হাসলো। রিপ্তী এবার তেজিকন্ঠে বললো,
থাপ্পড় চিনস? স্যরি একসেপ্ট কর কইলাম। নইলে গাল লাল হইতে বেশি সময় লাগবো না।

আমিরা তাকাতেই রিপ্তী আবারো ঠোট ফুলালো, ঠোট নাড়িয়ে বললো,
প্লিইইইইইজজজ

আমিরা এবার চট করে হেসে উঠলো। দুজন অতি প্রিয় বান্ধবীর মাঝে মান অভিমানের পালা শেষ হলো৷ আর মেহতাব তা বেশ সময় নিয়ে দেখলো। রিপ্তী খুশিতে আমিরাকে চেঁপে ধরলো আমিরাও ধরলো। হুট করে আমিরার চোখ আটকে গেলো একজোড়া চোখে। যে চোখজোড়া ভীষন আগ্রহ নিয়ে আমিরাকেই দেখছে। চোখ যেনো কিছু বলছে আমিরা কি আর চোখের ভাষা বুঝে? সে বুঝলো না তবে বেশিক্ষণ সে চোখে চোখ রাখতে পারলো না সে দ্রুত চোখ নামিয়ে নিলো।

——–

পরীর বেশ কিছু কেনাকাটা করা প্রয়োজন। সে জন্য মার্কেটে এসেছে সাথে এহতিশামও এসেছে। পা/গ/ল লোকটা পরীর বারণ সত্ত্বেও পরীর এখন প্রয়োজন নেই এমন অনেক জিনিস কিনেছে। পরী শুধু চোখ মুখ কুচঁকে দেখছে। পরী এই মুহুর্তে এক শাড়ীর দোকানে বসে আছে। এহতিশাম এক একে ৭ টা শাড়ী সাইটে রেখেছে। সে আরো দেখছে পরীর বারণ সত্বেও শুনছে না। পরীর কাছে এখনো ২০ টার মতো শাড়ী আছে যেগুলো সে ছুয়েই দেখে নি। এহতিশাম পরীর সাথে সাথে বাসার সবার জন্যই কিনেছে। দোকানদার বেশ আগ্রহ নিয়ে শাড়ী দেখাচ্ছে ।পরী গালে হাত গুজে দেখছে। এহতিশাম বললো,
কি হয়েছে?

পরী ধীরকন্ঠে বললো,
এতো শাড়ী কিনে কি করবো?

এহতিশাম ধীরকন্ঠে বললো,
শাড়ী মানুষ কি করতে কিনে?

পরী হাম তুলে বললো,
অবশ্যই পড়তে।

এহতিশাম বললো,
তো? তুমিও পড়বে।

পরী বললো,
ধ্যাত।

দোকানদার টা আরো কিছু নতুন কালেকশন এনে পরীকে দেখাতে লাগলো। এমন সময় এহতিশামের ফোন বাজল সে পরীকে শাড়ী দেখতে বলে একটহ দূরে গেলো। পরী অনেক ভেবে চিন্তে সব গুলো শাড়ী রেখে দুটো শাড়ী নিলো। বললো,
এই দুটো প্যাকেট করুন।

দোকানদার বললো,
আপা বাকি গুলো? বাকি গুলো নিবেন না?

পরী বললো,
না।

দোকানদার বললো,
কিন্তু ভাইজান তো সব গুলা প্যাকেট করতে বললো?

পরী একটু দূরে দাঁড়ানো এহতিশামের দিকে তাকিয়ে বললো,

করুক।

দোকানদার মুখভার করে ফেললো। তার দোকানে থাকা মেয়েটাকে বললো,
নিশা শাড়ী দুটো প্যাকেট করো।

নিশা শুনলো সে গ্লাস ভেদ করে দূরে দাঁড়ানো এহতিশামে দিকে তাকানো। রাগে পরীর মাথা ফেটে যাচ্ছে ৷ দোকানে এসেছে থেকে মেয়েটা এমন ভাবে এহতিশামের দিকে তাকিয়ে আছে যেনো চোখ দিয়ে গিলে খাবে। পরীর ইচ্ছে করছে ঠাটিয়ে এক মা/রতে অন্যের জামাই এর দিকে এমনে তাকাবি কেনো পাজি মেয়ে? পরী চিবিয়ে চিবিয়ে বললো,
আমার জামাই এর দিকে নজর দিস। তোর চোখে তেলাপোকা সংসার বাধুক বজ্জাত মেয়ে।

দোকানদার নিশার দৃষ্টি লক্ষ করে এবার চেঁচিয়ে বললো,
নিশা শাড়ী দুটো প্যাকেট করো।

নিশা হকচকিয়ে উঠলো, বললো,
হ্যাঁ হ্যাঁ?

দেকানদার বললো,
প্যাকেট করো৷

নিশা শাড়ী দুটো প্যাকেট করে দিলো। কিছু মুহুর্ত পরে এহতিশাম আসলো। মেয়েটা হাসি মুখে এসে সামনে দাঁড়ালো। পরী চোখ মুখ কুঁচকে এহতিশামের বাহু চেপে ধরলো। বললো,
শাড়ী লাগবে না আমার চলুন বাসায় যাবো

এহতিশাম বেশ অবাক হলো। সে বললো,
কেনো লাগবে না?

পরী বললো,
লাগবে না মানে লাগবে না চলুন।

এহতিশাম পরীর দৃষ্টি লক্ষ করে তাকাতেই দেখলো সে সামনে দাড়ানো মেয়েটার দিকে তাকিয়ে আছে। মেয়েটা কেমন বেহায়া চোখে এহতিশামের দিকে তাকিয়ে আছে। এহতিশাম ভ্রু কুঁচকে একবার মেয়টার দিকে তাকালো পরপর পরীর দিকে তাকাতেই এহতিশামের হাসি পেলো। কি সাংঘাতিক ব্যাপার। এহতিশাম পরীকে রেখে দোকানদারকে কিছু বলে পরীকে নিয়ে বের হয় গেলো। বাহিরে বের হতেই প্রচন্ড গরমে অতিষ্ঠ হয়ে গেলো ওরা৷ গরমে ফর্সা মুখ লাল হয়ে গেছে এহতিশামের। পরী চোখ উঁচু করে এহতিশামকে দেখলো। এই যে নাক মুখ লাল হয়ে গেছে। পরীর হাত চেপে রাখা হাতের দিকে তাকিয়ে নিজের হাত লক্ষ করলো লোকটা পরীর থেকে পাঁচ গুন ফর্সা বরং আরো বেশি। পরী তো কালো আর এই লোকটা ধবধবে ফর্সা। বিশাল লম্বা ও এই যে পরী হিল পরেও লোকটার সাথে কাঁধ মেলাতে পারছে না। লোকটার পাঁশে নিশ্চিত পরীকে পিঁপড়ে লাগছে৷ এহতিশাম পরীর দিকে তাকাতেই পরী এদিক ওদিকে তাকালো। সামনে আইসক্রিমওয়ালা দেখতেই চেঁচিয়ে উঠলো,
আইসক্রিন খাবো।

এহতিশাম ভ্রু কুচকালো বললো,
উহু।

পরী নাছরবান্দা সে খাবেই অগত্যা পরীকে গাড়ীর পাঁশে দাঁড় করিয়ে এহতিশাম রাস্তা পার হয়ে আইসক্রীম নিতে গেলো৷ পরী দূর থেকে এহতিশামকে দেখলো। পড়নে ব্লাক শার্ট যার স্লিপ কনুই পর্যন্ত ভাঁজ করা, ব্লাক জিন্স, সিল্কি চুলগুলো সবসময়ের মতো এলেমেলো, হাতে ব্লাক ওয়াচ। পরী বিরবির করে আওড়ালো,
অতি সুদর্শন এক সাদা বিলাই হা হা।

পরী তুমি?
পরিচিত কন্ঠস্বর শুনে পরী পিলে চমকে পাঁশে তাকালো। পাঁশে তাকাতেই দেখলো রিজভী দাঁড়ানো। পরী একপলক রিজভীকে দেখলো৷ এলেমেলো উশখো খুশখো চুল, মলিন মুখ, গায়ে কেমন যেনে কুচকানো শার্ট। পরী অবাক হলো এ কোন রিজভী? রিজভী ছিলো ভীষণ স্মার্ট। এমন তো ছিলো না।

পরী বিস্মিত গলায় বললো,
আপনি? এখানে?

রিজভী পুনরায় বললো,
কেমন আছো তুমি?

পরী ধীরকন্ঠে বললো,
আলহামদুলিল্লাহ ভালো। আপনার এ অবস্থা কেনো? কেমন আছেন আপনি?

রিজভী মেঁকি হাসলো, বললে,
আল্লাহ যেমন রেখেছে। আমি এই শপিংমলে জব করছি দুমাস যাবৎ।

পরী – মানে?

রিজভী – বাদ দাও, মায়ের সাথে কথা হয় তোমার?

পরী মাথা নাড়লো যার মানে না। রিজভী ধীরকন্ঠে বললো, ওও

পরী – কেনো আপনার সাথে হয় না?

রিজভী মাথা নেড়ে বললো,
না গত তিনমাস ধরে কথা হয় না দেখাও হয় না। রিয়াশা আর আমি বিয়ে করে বাড়ীতে যাওয়ার পর বাবা আমাদের মেনে নেন নি। বাসা আর ব্যবসা থেকে আমাকে সরিয়ে দিয়েছে।

পরী অবাকের উপর অবাক হচ্ছে সে বিস্মিত গলায় বললো,
সেকি কেনো?

রিজভী – কারন আমি তোমাকে বিয়ে না করে রিয়াশাকে বিয়ে করেছি৷

পরী সহসাই কথা বলতে পারলো না। রিজভী এদিক ওদিকে তাকিয়ে ধীরকন্ঠে বললো,
স্যরি পরী।

পরী গোলগোল চোখ করে বললো,
স্যরি? স্যরি কেনো বলেছেন?

রিজভী – তোমার সাথে অন্যায় করেছি আমি ক্ষমা তো চাইতেই হতো। আমায় ক্ষমা করে দিয়ো ৷ আমি আসলে ভূল ছিলাম।

পরীর চোখ পড়লো দূরে এহতিশামের দিকে। সে ধীরকন্ঠে বললো,
আল্লাহ আসলে ভুল মানুষগুলোকে সরিয়ে দেয় সঠিক মানুষগুলোকে উপহারসরূপ পাঠানোর জন্য।

রিজভী পরীর দিকে তাকিয়ে বললো,
কিন্তু আল্লাহ আমার থেকে সঠিক মানুষ কেড়ে নিয়ে অভিশাপসরূপ ভুল মানুষকে পাঠিয়েছিলো।

পরী শুনলো কথাটা। কিন্তু কি বলবে সে? কথা ঘুরানোর জন্য বললো,
রিয়াশা আপু কেমন আছে? কি করছে এখন?

রিজভী – জানি না। আমি আর সে একসাথে থাকছি না দেড়মাস যাবৎ৷ সম্ভবত আমাদের ডিবোর্সটা হয়ে যাবে।

পরী আর কথা খুঁজে পেলো না। তখনিই দুটো আইসক্রিম হাতে ফিরলো এহতিশাম। পরী সেদিকে তাকিয়ে হাসলো। রিজভী এহতিশামকে দেখে বললো,
ভাইয়া ভালো আছেন?

এহতিশাম ‘হু’ বললো। রিজভী হাতের শপিং ব্যাগ গুলো এগিয়ে দিলো। এহতিশাম ব্যাগগুলো গাড়ীতে রেখে উঠে বসলো৷ পরী রিজভীর থেকে বিদায় নিয়ে ততক্ষণাৎ গাড়ীতে উঠে বসলো৷ পরী উঠে বসতেই এহতিশাম গাড়ী ছাড়লো। পুরো রাস্তা এহতিশাম কোনো কথা বললো না। পরী এটা সেটা একা একা বকবক করেছে।

———-
পরিক্ষা শেষ করে বের হয়েছে রিপ্তী আর আমিরা। পরিক্ষা মোটামুটি ভালো হয়েছে। দুজন কেন্দ্র থেকে বের হয়ে রাস্তা ধরে হাঁটছে। প্রচুর ভীড়, গরমে নাজেহাল অবস্থা দুজনের। রাস্তার ওই পারে মেহতাবের গাড়ী দাঁড়ানো। রিপ্তী,আমিরা ক্লান্ত ভঙ্গিতে রাস্তা পার হয়ে হাঁটতে লাগলো। হুট করে কোথা থেকে ওদের সামনে আনান এসে দাঁড়ালো। রিপ্তী এমন সময় আনানকে দেখে চমকালো ভড়কালো। সে হতভম্বিত গলায় বললো,
আপনি?

আনান ঠান্ডা পানির বোতল এগিয়ে দিয়ে বললো,
কাজে এসেছিলাম এদিকে। তোর সাথে দেখা হয়ে গেলো। পিছু ছাড়ছিস না দেখছি।

রিপ্তী রাগলো ভীষণ। পরিক্ষা শেষ করে এমনিতেই ক্লান্ত সে। কিছুতেই এই বদলোকের সাথে ঝগড়া লাগবে না সে। বোতলটা একপ্রকার ছুঁড়ে মারলো। আনান বোতল ধরে নিলো।
আমিরা আর আনানকে ফেলে সে গটাগট পায়ে গাড়ীর দিকে গেলো৷ আমিরা ও জোড়ে হাঁটলো। আনান বাকা হেঁসে ওদের সাথে গেলো। গাড়ীর কাছে যেতেই দেখলো মেহতাব দোকানের সামনে দাঁড়ানো। মেহতাব হাত ইশারা করতেই রিপ্তী গাড়ীতে উঠে বসলো। মেহতাব মাথা ঘুরিয়ে কাউকে খুজলো। কাঙ্ক্ষিত মানুষটাকে দেখে দুটো পানির বোতল, আর কিছু চিপস নিয়ে এগিয়ে এলো সাথে সাথে দেখলো আনানকে। চোয়াল শক্ত হলো মেহতাবের। দ্রুত হেটে ওদের সামনে দাঁড়ালো। আমিরার হাতে বোতল আর চিপস দিয়ে বললো,
গাড়ীতে বসো।

আমিরা দ্রুত গাড়ীতে উঠে বসলো।
গাড়ী থেকে একটু দূরে মেহতাব আর আনান দাঁড়ানো।

মেহতাব -তুই এখানে?

আনান ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে বললো,
বউ পরিক্ষা দিচ্ছে আসতেই হতো।

মেহতাব কপাল কুঁচকে থমথমে কন্ঠে বললো,
সিনক্রিয়েট করবি না একদম।

আনান মেহতাবের কাঁধে হাত রেখে বললো,
আরে ভাইজান চলুন তো বাসায় যাবো ক্লান্ত লাগছে।

মেহতাব কাঁধের দিকে চাইলো৷ আনান চোখ ইশারায় বললো ‘চল। রিপ্তী উঁকি দিলো। দুজনের কি কথা হচ্ছে কে জানে। যদি এখানে ঝগড়া হয়? রিপ্তী চটপট গাড়ী থেকে নামতে যাবে তার আগেই মেহতাব গাড়ীর দিকে চলে এলো পিছনে পিছনে আনান ও হাঁটলো। আনান এসেই বললো ,
শালিকা সামনে আসুন।

আমিরা বললো,
হু?

আনান বাঁকা হেসে বললো,
একটু স্পেস দিবেন না?

রিপ্তী চোখ পাকিয়ে তাকালো সে আমিরার হাত চেপে ধরলো। বললো,
আপনি সামনে বসুন।

আনান বাঁকা হাসলো। আমিরাকে ইশারা করতেই আমিরা চট করে নেমে দাঁড়ালো। কিন্তু সামনের সীটে বসলো না। সামনে যে স্বয়ং রাক্ষস আমিরা কিভাবে বসবে? আমিরাকে ঠাঁই দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মেহতাব চোয়ালশক্ত করে ধমকে বললো,
অ্যাই মেয়ে তুমি কি এখানে থেকে যেতে চাইছো,?

আমিরা চমকে উঠলো পরপর দুদিকে মাথা নাড়লো। যার মানে না। আনান হাসতে হাসতে বললো,
উঠে পড়ুন শালিকা৷ আমি আছি বাঁচিয়ে নিবো।

মেহতাব ধমকে বললো,
কেউ থাকতে চাইলে ত্থাকুক।

বলেই সে গাড়ী স্টার্ট দেওয়ার জন্য প্রস্তুত হলো। আমিরা তড়িঘড়ি করে উঠে বসলো। মেহতাব মৃদু হাসলো। আমিরা একদম কাচমাচু হয়ে মেহতাবের থেকে ভীষণ দূরত্ব নিয়ে বসলো।

আনান রিপ্তীর হাত টেনে বললো,
পরিক্ষা কেমন দিলি?

রিপ্তী চোয়াল শক্ত করে বললো,
শুনে আপনার লাভ কি?

আনান সীটে হেলান দিয়ে বললো,
ওহ তাইতো।

রিপ্তী মুখ ভেংচি কাটলো, বিরক্তিতে চোখ কুঁচকালো। বললো,
অসহ্যকর।

আনান চোখ বুজে রিপ্তীর হাত নিজের হাতের মুঠোয় পুরে বললো,
হুম ভীষণ।

চলবে????????

(ভুলক্রুটি মার্জনীয়)