শ্যামাবতী প্রেয়সী পর্ব-০৩

0
17

#শ্যামাবতী_প্রেয়সী
#পর্ব ৩
#জেসমিন_জেমি

শিকদার বাড়ীর দুই গিন্নী রান্নায় ব্যস্ত। পরী কেবলই ঘুম থেকে উঠেছে। ঘুম ঘুম চোখে লিভিং রুমে এসে দাঁড়ালো। শিকদার বাড়ীর তিনকর্তাকে দেখলো বাড়ীর সামনে বাগানে রাখা বেতের চেয়ারে বসে সকালের মিষ্টি রোদ পোহাচ্ছে। পরী লক্ষ করলো তার বাবা জেঠুদের সাথে মেহরাব আর এহতিশাম ও আছে । এহতিশামকে দেখেই পরী বিরবির করে বললো,
সাদা বিলাই।
বলেই শব্দ করে হাসলো। এই লোকটাকে সাদা বিলাই বললে পরীর কেমন যেনো শান্তি লাগে।হাহ এতো ফর্সা কে হতে বলেছিলো লোকটাকে?
পরী হাজারবার বলবে সাদা বিলাই। ছেলে মানুষদের এতো সুন্দর হওয়ার কি দরকার? তারা কেনো এতো সুন্দর হবে?
পরী বেশ অবাক হলো। পরী কি লোকটাকে হিংসা করছে?

পরী এলোমেলা উশখো খুশকো চুলে রান্নাঘরে উঁকি দিলো। আয়রা বেগম কপাল কুঁচকে বললো,
মহারানীর উঠার সময় হলো?

জুলেখা বেগম আয়রা বেগমকে থামিয়ে দিয়ে বললো,
আয়রা থামতো। পরী যা ফ্রেশ হয়ে জলদি নিচে আয়।

পরী মাথা নাড়লো পরপর রুমে চলে গেলো ফ্রেশ হতে।
——–

জুলেখা বেগমের স্বামী মাহদুল শিকদার সেই কখন চা চেয়েছে। জুলেখা বেগম তড়িঘড়ি করে চা করে পরীকে ডাকলো। পরী ফ্রেশ হয়ে ছুটে এসে বললো,
হ্যাঁ বড়মা বলো।

জুলেখা বেগম বললো,
ওদেরকে চা দিয়ে আয়।

পরী বাধ্য মেয়ের মতো মাথা নাড়লো ধীরকন্ঠে বললো,
আচ্ছা।

আয়রা বেগম সাবধান করে বললো,
সাবধানে গরম কিন্তু! দেখিস হাতে পায়ে ফেলিস না।

পরী হেঁসে উঠলো।বললো,
– আচ্ছা।

মা তাকে বকে, কথা শোনায় অথচ কখনো কখনো পরীর চিন্তায় মরিয়া হয়ে উঠে । মায়েরা বোধহয় এমনই হয় । পরী একবার গরম চা হাতে ফেলেছিলো সেদিনের পর থেকে গরম কিছু হাতে নিলেই আয়রা বেগম ধমকে বলবে,
দেখিস ফেলে টেলে দিস না।

পরীর হাসি দীর্ঘস্থায়ী হলো না। পরী ট্রে নিয়ে দুটো সিঁড়ি পার হতেই ট্রে হাত ফসকে পড়লো। পরী চিৎকার করে উঠলো। গরম চা ছিটকে পড়লো পরীর পায়ে সাথে সাথে জায়গাটা লাল হয়ে উঠলো। পরী পা চেপে লাস্ট সিঁড়িতে বসে পড়লো। পরীর চিৎকার এ সবাই আৎকে উঠলো। কিচেন থেকে আয়রা বেগম, জুলেখা বেগম ছুটে আসলো। বাগান থেকে সবাই ছুটে এসে দেখলো পরী পা চেঁপে ধরে দাঁতে দাঁত চেঁপে বসে আছে। চোখ দুটো ছলছল করছে। আয়রা বেগম ছুটে এসে তৎক্ষনাৎ মেয়ের গালে সপাটে চ’ড় বসালেন। আকস্মিক ঘটনায় সবাই হতভম্ব হয়ে গেলো৷ আয়রা বেগম রাগে ফুসে উঠে বললো,
একটা কাজ, একটা কাজ ঠিক ভাবে করতে পারিস না। কি পারিস? খেতে পারিস শুধু?

আয়রা বেগম আবার চ’ড় বসাতে যাবে জুলেখা বেগম হাত ধরে নিলো৷ মাহদুল শিকদার ধমকে উঠে বললো,
মেঝো বউ। মেয়ের গায়ে হাত তোলার সাহস কোথায় পাও তুমি?

আয়রা বেগম রাগে ফুঁসতে লাগলো। তবে বড় ভাইজানের সামনে কিছু বললো না। মাহমুদ শিকদার ব্যস্ত হয়ে মেয়ের পায়ে ফুঁ দিতে দিতে রক্ত চোখে স্ত্রীর দিকে তাকালো। শক্তকন্ঠ বললো,
আমার মেয়ের গায়ে হাত তোলার সাহস কোথা থেকে পেলি তুই?

আয়রা বেগম ফুঁসে উঠে কিছু বলতে যাবে রুমি বেগম (শিকদার বাড়ীর ছোট বউ ) এসে আয়রা বেগমকে টেনে নিয়ে গেলো। পরী হু হু করে কেঁদে উঠলো। অসহ্য যন্ত্রনায় পরী দাঁত দাঁত চেঁপে ধরলো। মাহমুদ শিকদার অস্থিরকন্ঠে বললো,
আম্মা বেশি কষ্ট হচ্ছে? সাবধানে কাজ করবেন তো।

পরী ভেজা চোখে বাবার দিকে চাইলো। নিজের মায়ের কাছে যখন মেয়ের থেকে তার গায়ের রঙটা বেশি ম্যাটার করে সেখানে তার বাবা একজন মানুষ যার কাছে গায়ের রঙ নয় পুরো এই পরীটাই ম্যাটার করে। পরী তার ভীষণ আদরের,ভীষন স্নেহের।
মেয়েকে ভীষণ ভালোবাসে মাহমুদ শিকদার। ছোট বেলায় কেউ যখন মেয়েকে কালো কালো বলতো। কালো হয়ে পরী নাম রাখার কারনে ব্যঙ্গ করে বলতো নকল পরী। পরী তখন বাসায় ফিরে বাবার গলা জড়িয়ে কান্না করতো। মাহমুদ তখন মেয়েকে কোলে চেপে বলতো,

আম্মা আপনার নাম কি?

পরী হেচকি তুলে কাঁদতে কাঁদতে বলতো,
পরী।

মাহমুদ হেসে বলতো,
পরী কারা জানেন?

পরী তখন অবুঝের মতো মাথা নেড়ে না বুঝাতো। মাহমুদ মেয়ের কপালে চুমু একে দিয়ে বলতো,

পরী তারাই যাদের একটা সুন্দর মন আছে। যারা কখনো কাউকে কষ্ট দেয় না। কখনো কাউকে আঘাত করে না। কাউকে কাঁদায় না। আপনি কি কাউকে কষ্ট দিয়েছেন?

পরী – উহু।

মাহমুদ- কাউকে বকেছেন? কাঁদিয়েছেন?

পরী কান্না থামিয়ে বলতো উহু। মাহমুদ মেয়ের গাল টেনে বলতো,
তাহলে বলুন আপনি কি নকল পরী?

পরী বাবাকে জড়িয়ে বলতো,
উহু।

পরী তখন খিলখিল করে হেসে উঠতো মাহমুদ ও মেয়ের সাথে সাথে হাসতেন।
বাবা মেয়ের হাসিতে শিকদার মহল ও হেঁসে উঠতো।

——-★——-

পরী হঠাৎ পায়ে ঠান্ডা কিছুর টের পেতেই দেখলো মেহতাব পরীর পায়ে বরফ ধরে আছে। মেহতাব পরীর পায়ে বরফ ঘষে দিলো বেশ সময় নিয়ে পরীর যন্ত্রনা কিছুটা কমলো। মেহতাব থমথমে কন্ঠে বললো,
আরাম পাচ্ছিস? জ্বলছে এখনো?

পরী মাথা নেড়ে না বুঝালো যার মানে জ্বলছে না। মেহতাব ফুস করে দীর্ঘশ্বাস ফেললো। এহতিশামের কোলে রীপ্ত। মাহদুল বললো,
মেয়েটাকে রুমে নিয়ে যাও।
আমি ওষুধ আনছি।

মাহমুদ বললো,
ভাইজান আমি যাচ্ছি।

মিরাজ বললো,
আমি যাচ্ছি ভাইজান ।

মাহদুল বললো,
আচ্ছা মিরাজ বরং যাক।
আমাকে বাইরে যেতে হবে।

মিরাজ মাথা নাড়লো। মাহদুল মিরাজ বাসা থেকে বের হলো।

জুলেখা বেগম পরীর হাত টেনে দাঁড় করিয়ে চিন্তিতকন্ঠে বললো,
হাঁটতে পারবি মা?

পরী মাথা নেড়ে বললো,

হুম।

পরী এক পা খুব কষ্ট করে হাঁটলো। পায়ের তিনটে আঙ্গুল এ বেশ ভালো ভাবেই ফোসকা উঠে গেছে। পরী কষ্ট করে হেটে দরজা পর্যন্ত যেতেই মেহতাব পরীকে কোলে তুলে নিলো । পরপর পরীর রুমের দিকে হাটলো জুলেখা বেগম ছেলের পিছু পিছু ছুটলো। পরী অবাক চোখে মেহতাবের দিকে তাকিয়ে রইলো।

———-
কেটে গেছে একদিন।
পরী পায়ের ফোস্কার জন্য তেমন একটা হাঁটাচলা করে না। পুরো একটা দিন রুমে বসেই কাটিয়েছে। এ একদিনে আয়রা বেগম মেয়ের রুমে শুধু একবার এসেছিলো। মেহতাব,জুলেখা বেগম পরীকে নিয়ম করে খাইয়ে দিয়েছে। মাহমুদ শিকদার মেয়ের সাথে বেশ সময় নিয়ে গল্প করেছে। পরেরদিন সকালে পরী বিছানায় বসে ফেসবুক স্ক্রল করছিলো এমন সময় হন্তদন্ত হয়ে রুমে ঢুকলো রিপ্তী শিকদার।
( মিরাজ শিকদারের বড় মেয়ে। এবার ইন্টারমিডিয়েটে পড়ছে। কাল বিকেলেই নানু বাড়ী থেকে শিকদার বাড়ীতে ফিরেছে। )

পরী মোবাইল সাইটে রেখে কপাল কুঁচকে তাকালো। থমথমে কন্ঠে বললো,
কি সমস্যা রিপি সরকার?

রিপ্তী জোড়ে জোড়ে শ্বাস নিয়ে ডাকলো,
পরী আপা ।

পরী কপাল কুঁচকে বললো,
আর কি হয়েছে? এমন হাঁপাচ্ছিস কেনো?

রিপ্তী একচোটে বললো,
পরী আপা রিজভী ভাইয়া কাল বিয়ে করেছে শুনেছো? বড় বাবাকে ফোন করে ফুফু কেঁদে কেঁদে বলছে।

পরীর হাত থেকে মোবাইলটা বিছানায় পড়ে গেলো । পরীর হাত পা কেঁপে উঠলো। কি এক অদ্ভুত কষ্ট পরীকেআষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরলো। পরীর চোখের কোনে অশ্রুকণারা ভীড় জমালো। টুপ করে এক ফোঁটা জলকণা গাল গড়িয়ে পড়লো। পরী কি কাঁদছে? পরী কেনো কাঁদছে?
পরী তো জানতো তার আর রিজভীর বিয়েটা হচ্ছে না। সে তো সবটা,সবটা,সবটা জানতো তাহলে পরী কাঁদছে কেনো? আচ্ছা পরী কি আশা করেছিলো রিজভী ফিরবে? ফিরে এসে বলবে পরী আমি তোমায় ভালোবাসি? আমি তোমাকেই বিয়ে করবো?

চলবে,,,,,,

(ভুলক্রুটি মার্জনীয়)