#শ্যামাবতী_প্রেয়সী
অন্তিম পর্বের ১ম অংশ
#জেসমিন_জেমি
১বছর পর।
কানাডার বৃহতম শহরের মাঝে অন্যতম শহর হচ্ছে টরন্টো। কানাডার সবচেয়ে বড় শহর এবং অর্থনৈতিক,সাংস্কৃতিক ও বাণিজ্যিক কেন্দ্র বলা যায় টরন্টোকে। সবদিক থেকে উন্নত শহর টরন্টো। উন্নতমানের শিক্ষা,চিকিৎসা,শপিংমল, রেস্টুরেন্ট, আর্টগ্যালারি সহ অনান্য উন্নত প্রতিষ্ঠান মানুষের জীবনযাত্রার মান টরন্টোকে একটি শীর্ষস্থানীয় শহর হিসেবে তৈরি করেছে।
——–
এহতিশাম কিছুদিন থেকে ভীষণ ব্যস্ত। এতো বড় বাড়ীতে একা একা থাকতে কার ভালো লাগে? পরী নিজ বাড়ী রেখে বিকেলে গিয়ে উঠলো শশুর বাড়ীতে। আমাইশা আর নাথান এ বাড়ীতে এসেছে আজ। ওদের বিয়ে হয়েছে চারমাস আগে। এবাড়ীতে এসে আমাইশাকে পেয়ে পরী একটু সস্থি পেলো৷ এ্যালিসা ইননা কিচেনে সবার জন্য গরম গরম খিচুড়ি, গরুর গোস্ত রান্না করছে। ওরা তিনজন বেশ জমিয়ে গল্প করলো৷ আমাইশা এহতিশামের বোন। আয়মান চৌধুরী এহতিশামের মা মা/রা যাওয়ার পর বিদেশিনী এ্যালিসা ইননা কে বিয়ে করেন। ভদ্র মহিলা ভীষণ ভালো। পরীকে ভীষণ স্নেহ করে এহতিশামকেও বেশ ভালোবাসে। তবে এহতিশাম কোনো এক কারনে মহিলাকে ততটা আপন করতে পারে না৷ এইযে বাবার বাসা থেকে অনেকটা দূরে এহতিশামের বাড়ী । নিজের বিজনেস আয়মান চৌধুরীর কোনো কিছুতে এহতিশামের হাত নেই তবে এহতিশাম আমাইশাকে ভীষণ ভালোবাসে। দুজন এক মায়ের পেটের ভাই বোন না হলেও চেহারায় কত মিল। আমাইশা পরীকে যেদিন দেখলো সেদিন ভাঙা ভাঙা বাংলায় বললো,
তুমি পরি? আমার ভাবি? কত কিউট তুমি।
পরী আমাইশার ভাঙা ভাঙা বাংলা শুনে সেদিন হেসেছিলো খুব। মেয়েটা দেখতে ভীষণ সুন্দর। চুলগুলো কেমন বাদামি রঙের। দেখতে পুরো পুতুলের মতো। পরীর মেয়েটাকে বেশ ভালো লেগেছে। কেমন বাচ্চা বাচ্চা টাইপের।
এহতিশাম ও বাড়ীতে না এলেও পরীর এ বাড়ীতে চলাচল আছে। আয়মান চৌধুরী প্রথম প্রথম তেমন কথা না বললেও এখন পরীকে ভীষণ স্নেহ করেন। আর এহতিশাম? সে তো এক পা/গ/ল, উন্মাদ৷ পরী যখন ওই মানুষটাকে দেখে তখন শুধু একটা কথায় মাথায় আসে এই মানুষটাকে আল্লাহ তাকে কোনো ভালো কাজের উপহারস্বরুপ পাঠিয়েছে।
ঘড়ীতে ১০ টা বেজে ৪৫ মিনিট। পরীর মোবাইল বেজে উঠলো। পরী ধরলো না সে গাল ফুলিয়ে ফোন সুইচ অফ করে রাখলো৷ পরীকে ঝাড়ি দেওয়া? বলবো না কথা। সঙ্গে সঙ্গে নাথানের ফোনে কল এলো৷ নাথান রিসিভ করলো অপাঁশ থেকে কে, কি বললো শোনা গেলো না তবে নাথান ছোট করে বললো,
হ্যাঁ ব্রো৷
কল কেটে গেলো তার আধঘন্টা পর কলিংবেল বাজলো৷ এ্যালিসা বেগম গিয়ে খুলে দিলো৷ এহতিশামকে দেখে ভদ্রমহিলার মুখ জ্বলজ্বল করে উঠলো খুঁশিতে ৷ সে বললো,
হানি তুমি? ভিতরে আসো৷
এহতিশাম মাথা নাড়ালো। ভদ্রমহিলা ফর্সা মুখে এক তৃপ্তির হাসি। ভদ্রমহিলা পরীকে ডেকে বললো,
মাম্মা কাম কাম হানি এসেছে।
পরীর হাত ফসকে খিচুড়ির লোকমা পরে গেলো৷ সেদিকে তাকাতেই দেখলো চোয়াল শক্ত করে এহতিশাম আসছে। চোখে মুখে গাম্ভীর্যতা। পড়নে লাইট গ্রে শার্ট, হোয়াইট জিন্সের সাথে ইন করা। তার উপরে ওভারকোট,হাতে অ্যান্ড্রয়েডের ওয়াচ। দেখেই বুঝা যাচ্ছে অফিস থেকে ফিরেছে মাত্র। আমাইশা ভাইকে দেখে হেসে উঠলো। এ্যালিসা ইননা ব্যস্ত হয়ে পড়লেন।এহতিশামের জন্য চটপট খিচুড়ি প্লেটে বেরে বললো,
হানি যাও ফ্রেশ হয়ে আসো।
পরী উঠে গেলো দৌড়ে আয়মান চৌধুরীকে নিচে নামালো। ডাইনিং এ অনেকদিন পর বাপ ছেলে একসাথে বসে ডিনার করছে৷ এ্যালিসা হাসলো সে ব্যস্তহাতে সবাইকে বেড়ে দিতে লাগলো। সে যেনো এক বাঙালি বধূ। শুধু দেখতে এমন বিদেশী না হলে উনাকে পাক্কা বাঙালি লাগতো।
——–
রিপ্তী তিনদিন হলো শিকদার বাড়ীতে এসেছে। এরমাঝে আনানের কোনো খোঁজ ছিলো না।আজ সন্ধ্যায় হুট করে এসে বলছে তাকে চলে যেতে হবে সে যাবে না। লোকটা যা বলবে তাই শুনতে হবে রিপ্তীকে? শুনবে না সে কিছুতেই শুনবে না। সে ফোন করে সাদিয়া বেগমের কাছে হাজার খানেক অভিযোগ করলো। সাদিয়া বেগমেরই বা কি করার আছে? ছেলে যে তার ঘাড়ত্যাড়া। সে চুপচাপ মেয়েটার অভিযোগ শুনলো৷ রুমি বেগম মেয়ের জামাইকে খেতে দিয়েছে। সবার সাথে মোটামুটি সম্পর্ক ভালো হয়ে উঠেছে আনানের। আনান নিজের মায়ের কাছে শুনেছে তার বাবার ব্যবসা সে নিজের ভুলে হারিয়েছে। এমনকি তার বাবার ভূলের কারনে আমিরার বাবা মৃ/ত্যু হয়েছে। এসব কিছু জানার পর বাবার সাথে তার সম্পর্ক খারাপ হয়েছে। রিপ্তী গাল ফুলিয়ে পাঁশে বসে আছে। আয়রা বেগম রিপ্তীর মাথায় হাত রেখে বললো,।খাচ্ছিস না কেনো?
রিপ্তী টলমলে চোখে আনানের দিকে তাকিয়ে বললো,
খাবো না, যাবো না আমি।
সে উঠে চলে গেলো৷ কি পেয়েছে লোকটা রিপ্তীকে৷ জোড় করে বিয়ে করলো। এখন সব কিছুতেই জোরজবরদস্তি করবে? আনান শেষ লোকমা মুখে দিতেই রুমি বেগম বললো,
মেয়েটা তো ছোট ওকে একটু বুঝিয়ে শুনিয়ে নিয়ো। বাচ্চা একটা মেয়ে।
আনান মাথা নাড়ালো৷ মনে মনে বললো,
বাচ্চা মেয়ে? ওই মেয়ে বাচ্চা? বাচ্চা হলে চুরি করতে পারতো? আনানের মতো দামড়া একটা ছেলের মন ওইটুকু একটা বাচ্চা মেয়ে কিভাবে চুরি করতে পারে? শাস্তি দিতে বিয়ে করে যে আনান নিজে শাস্তি ভুগছে। এই যে তিনদিনের জন্য মেয়েটা এ বাড়ীতে এসেছে আনানের মনে হচ্ছিলো তার প্রাণ পাখিটা তার কাছ থেকে কেউ ছিনিয়ে নিয়েছে। রুমে গেলে শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিলো। না পেরে আজই চলে এসেছে নিতে।
আর এই মেয়ে কিনা বলছে যাবে না? ফাজলামো পেয়েছে?
আনান রুমে যেতেই রিপ্তী বালিশ ছুড়ে মারলো৷ আনান বালিশটা ধরে এগিয়ে গিয়ে চোয়াল শক্ত করে বললো,
সমস্যা কি?
রিপ্তী বললো, যাবো না আপনার সাথে।
আনান বালিশ বিছানায় ছুড়ে আয়েশ করে বিছানায় বসে রিপ্তীর হাত টেনে কোলে বসালো।রিপ্তী হকচকিয়ে উঠলো। আনান কোমর চেপে বললো, কারন?
রিপ্তী গাল ফুলিয়ে বললো,
কেনো যাবো?
আনান- যাবি না কেনো?
রিপ্তী – আপনি তো বললেন আমায় মুক্তি দিবেন। তাহলে আপনার সাথে গিয়ে কি করবো? এমনিতেই চলে আসতে হবে এখন গিয়ে করবো?
আনানের মনে পড়লো তিনদিন আগের কথা।রিপ্তী সেদিন বলেছিলো – আপনার সাথে আমি থাকবো না।
সে বলেছিলো – আমার দিক থেকে কোনো বাঁধা নেই। আমি তোকে মুক্ত করে দিবো৷
আনান ভেবেছিলো রিপ্তী যদি মুক্তি চায় তাহলে অবশ্যই আনান মুক্তি দিবে ৷ একবছরে তাদের সম্পর্ক বেশিদূর আগায়নি। বাচ্চা একটা মেয়ে আনান জেদের বশে মেয়েটাকে তার সাথে জড়িয়েছিলো ঠিকই কিন্তু এখন সে নিজের ভুল বুঝতে পেরেছে। সে ঠিক করেছিলো রিপ্তী চাইলে সে রিপ্তীকে মুক্তি দিবে। তবে আনান এ তিনদিন রিপ্তীর থেকে দূরে থেকে বুঝেছে সম্ভব না। রিপ্তী মুক্তি চাইলেও আনানের পক্ষে আনানের চঞ্চল পাখিকে মুক্তি দেওয়া সম্ভব না। আনান দরকার পড়লে এই পাখিটাকে নিজের বুকের খাচায় বন্ধি করে রাখবে। ভালোবাসায় খাঁচায় পুষবে তবুও মুক্তি দিবে না। এবার যখন সে আনানের হয়েছে হোক ভূল করে তবুও সে আনানের। আনান কপাল কুঁচকে বললো,
তুই মুক্তি চাস?
রিপ্তী উঠার জন্য ছটফট করতে লাগলো। আনান শক্ত করে কোমর চেপে বললো,
দু মিনিট শান্ত থাকতে পারিস না?
রিপ্তী তেজিকন্ঠে বললো,
না পারি না। আপনার সমস্যা? সমস্যা হলে ছেড়ে দিন।
আনান চোখ কুঁচকে তাকিয়ে রইলো। বেশ সময় পর বললো,
তৈরি হ।
রিপ্তী গাল ফুলিয়ে বললো, যাবো বললাম তো।
আনান বললো,
যেতে হবে।
রিপ্তী চট করে ঘুরে বসলো। আনানের গলা জড়িয়ে ধরলো। আনান ভ্যাবাচেকা খেয়ে বসলো৷ রিপ্তী দাঁত চেঁপে হাসলো। বললো,
যেতে পারি এক শর্তে।
আনান কপাল কুচকে বললো,
আমি কোনে শর্ত শুনতে রাজি না।
রিপ্তী বাচ্চাদের মতো ঠোট ফুলালো। আনান ভ্রু কুচকে দেখলো৷ এই যে এই বাচ্চা বাচ্চা মেয়েটাকে আনানের লাগবে। আনানের পক্ষে এই বিচ্ছুটাকে ছাড়া মানে তার প্রাণটাকে দেহ থেকে বিদায় করা৷ কেউ কি জেনে শুনে তা করতে রাজি? আনান রিপ্তীর কোমর দুহাতে আঁকড়ে বললো,
কি শর্তে?
রিপ্তী – আই লাভ ইউ বলেন।
আনান – কি?
রিপ্তী চোখ পাকিয়ে বললো -বলুন
আনান ভ্রু কুঁচকালো বললো,
বলবো না।
রিপ্তী উঠে গেলো, বললো,
যাবো না।
আনান দাঁত চেঁপে হেঁসে উঠলো। বিছানায় গা এলিয়ে বললো,
আই লাভ ইউ মোর দ্যান অশান্ত পাখি ।
রিপ্তী তড়িৎ গতিতে পিছু ফিরলো। ছুটে এসে বিছানায় বসলো, বললো,
কি বললেন আবার বলুন।
আনান – আনান এক কথা বার বার বলে না।
রিপ্তী আনানের কলার ঝাঁকিয়ে বললো,
বলুন, বলুন বলুন বলছি।
আনান রিপ্তীর হাত ছাড়িয়ে ধমকে বললো,
তুই কি যাবি? নাকি আমি চলে যাবো?
রিপ্তী গাল ফুলিয়ে উঠে বসলো। যাবে না সে।সব সময় এমন করে। এই লোক কি বুঝে না রিপ্তী এই লম্পট লোকটাকে ভালোবাসে? রিপ্তী অভিমানে চোখ দুটো টলমল করে উঠলো৷ উঠে যেতে যেতে অভিমানী গলায় বললো,
যাবো না চলে যান। সারাজীবনের জন্য চলে যান।
আনান দেখলো তার প্রেয়সীর অভিমানে টইটম্বুর শীতল চোখজোড়া। বুকের ভিতর কেমন ধক করে উঠলো। কি জ্বালা এই বাচ্চা মেয়ের চোখে পানি দেখলে আনানের অন্তর কেঁপে উঠে। বুকের ভিতর কেমন চিনচিন ব্যথা অনুভব হয় যে কেউ হাতুড়ি দিয়ে লোহা ফুটাচ্ছে৷ আনান রিপ্তীকে হেঁচকা টানে বুকের মাঝে এনে ফেললো। শীতলকন্ঠে বললো,
এতো অভিমানি কেনে তুই? এতো জ্বালাস কেনো তুই?
রিপ্তী অশ্রুশিক্ত নয়নে আনানের দিকে চাইলো। আনান রিপ্তীর চোখে চুমু এঁকে দিলো৷ রিপ্তী কেঁপে উঠলো। আনান টের পেলো ছোট দেহের কম্পন। আনান ঝুঁকে রিপ্তীর কানে ফিসফিসিয়ে বললো,
ভালোবাসি, ভালোবাসি, ভাললবাসি ঝগড়ুটে রিপ্তী৷
রিপ্তী এটাই শুনতে চেয়েছিলো৷ লোকটা মুখে বলুক সে রিপ্তীকে ভালোবাসে কিন্তু লোকটা কি বললো? রিপ্তী ঝগড়ুটে? রিপ্তী আনানের বুকে কিল মেরে তেজি গলায় বললো,
কি বললেন?
আনান হকচকিয়ে উঠলো, বললো,
কি বললাম?
রিপ্তী- আমি ঝগড়ুটে?
আনান – না আমার বউ ঝগড়ুটে।
রিপ্তী তেজি স্বরে ফট করে বললো,
তো আপনার বউকে বলুন আমাকে কেনো বলছেন?
আনান মিটিমিটি হাসছে, রিপ্তী রাগে ফুসছে। আনানকে হাসতে দেখে ওর সারা শরীর জ্বলে উঠলো। আনান রুম থেকে বেরিয়ে যেতে যেতে বললো,
তাকেই তো বললাম৷
রিপ্তী এবার ফটিক জিব কাটলো। বউ তো সে। রিপ্তী তেড়ে গিয়ে মুখ খুলবে তার আগে আনান রিপ্তীর ঠোঁট আঙুল চেপে বললো,
আর একটা কথা বলবি এক থাপ্পড়ে দুধ দাঁত সবগুলো ফেলে দিবো। তারাতাড়ি তৈরি হ না হলে ফেলে রেখে চলে যাবো।
রিপ্তী মুখ ভেংচি কাটলো। আনানকে নকল করে বললো,
নাহলে ফেলে রেখে চলে যাবো হুহ।
চলমান,,,
#শ্যামাবতী_প্রেয়সী
অন্তিম পর্বের দ্বিতীয় অংশ
#জেসমিন_জেমি
দিনশেষে ধরনীতে নামলো রাত। চারপাঁশে অন্ধকার নামছে। মেহতাব আমিরাদের বাড়ীতে এসেছে। সারাদিনের ক্লান্তি নিয়ে একপলক তার বউপাখিকে দেখতে এসেছে। বড়দের সবার মতামতে হুট করেই আকদ করে রাখা হয়েছে ওদের। সেদিন মাহদুল শিকদার হুট করে বিয়ের কথা বললো। খাদিজা বেগম বেশ অবাক হয়েছিলো। ছেলে হিসেবে মেহতাব ভালো আর যদি বলা হয় শিকদার বাড়ীর লোকজন তারাও ভীষন ভালো। যদিও আমিরার মত ছিলো না সে পড়লেখা শেষ করবে তবে খাদিজা বেগমের জন্য শেষমেষ তাকে রাজি হতে হয় ৷ আমিরা বুঝে উঠতে পারলো না হুট করে সবার কি হলো? এতো তারাতারি করে আকদই বা করার কি প্রয়োজন ?
খাদিজা বেগম এক গ্লাস ঠান্ডা পানি এগিয়ে দিলো। গলা ছেড়ে মেয়েকে ডাকলো,
-আমিরা মেহতাব এসেছে৷
আমিরার কোনো সারা শব্দ না পেয়ে খাদিজা বেগম হেসে বললো,
ও রুমেই আছে তুমি যাও।
মেহতাব বললো,
না থাক আমি কাল আসবো এখন যাই।
খাদিজা বেগম বললো,
না না সে কি কথা রাতে খেয়ে তারপর যাবে। তুমি বরং রুমে যাও৷
মেহতাব মাথা চুলকে রুমের দিকে গেলো৷ খাদিজা বেগম রান্না করতে গেলো।
মেহতাব রুমে যেতেই দেখলো বিছানায় গুটিশুটি হয়ে শুয়ে আছে আমিরা৷ ঘুমন্ত মুখশ্রী, নাকে জ্বলজ্বল করছে তার নামের নাকফুল। একদম নতুন বউ বউ লাগছে। মেহতাব এগিয়ে গেলো পরপর ভ্রু কুঁচকালো এমন অসময়ে কে ঘুমায়?
মেহতাব আমিরার নাকে আঙুল ছোঁয়ালো। কপালে হালকা করে টোকা দিয়ে বললো,
-মেহতাবের ঘুমপাখি।
আমিরা উলটোপাঁশ ফিরলো। মেহতাব ঠোট চেঁপে হাসলো। পরপর ওয়াশরুমে গেলো৷
———–
টরেন্টোতে এখন শীতকাল। ডিসেম্বরের প্রথম দিকে আঁকাশ ধীরে ধীরে ধূসর হতে থাকে। জানালার বাইরে তাকালেই দেখা যায় নরম তুলার মতো সাদা ফোঁটা বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে। তুষারপাতের দৃশ্য যেন প্রকৃতির এক শান্ত সঙ্গীত। পুরো শহর ঢেকে যায় এক সাদা চাদরে। আজ প্রথম তুষারপাত হচ্ছে। পরী জানালা খুলতেই চেঁচিয়ে উঠলো। জীবনে প্রথমবার বরফ বৃষ্টি দেখছে। হ্যা পরী টিভিতে অনেক দেখেছে পরী নাম দিয়েছে বরফ বৃষ্টি। এহতিশাম পরীর কন্ঠস্বর শোনে দৌড়ে এলো৷ পরী খুশিতে এহতিশামকে জড়িয়ে বললো,
দেখুন দেখুন বরফবৃষ্টি।
জানালার বাহিরে হাত বাড়িয়ে বললো,
ইয়া আল্লাহ আমি, আমি আজ প্রথম দেখলাম।
পরীর চোখে মুখে উপচে পড়ছে নজরকাড়া হাসি৷ এহতিশাম গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। আদরে গাল দুটো ছুঁয়ে দিলো। পরী এহতিশামের হাত টেনে বললো,
চলুন না বাহিরে যাই।
এহতিশাম কঁপাল কুঁচকে ফেললো। থমথমে কন্ঠে বললো,
ইম্পসিবল।
পরী ঠোঁট উল্টিয়ে এহতিশামের ফর্সা গালে হাত রাখলো। এহতিশাম মুখ ফিরিয়ে নিলো। বললো,
ছেলে মানুষী বাদ দাও প্রাণ।
সে চলে যেতে নিলো বাঁধ সাধলো পরী। এহতিশামের পায়ে ভর করে ফর্সা গালে চুঁমু এঁকে আবদারের স্বরে বললে,
প্লিজ! প্লিজ! প্লিজ।
এহতিশাম কিছু না বলে চলে গেলো। পরী কাঁদো কাঁদো চোখে তাকিয়ে রইলো। পরীর প্রেগন্যান্সির ৫ মাস চলছে৷ মেয়েটা কেমন হুটহাট আবদার করে বসে। এই বলছে চকলেট খাবো, এই বলছে এটা খাবো-ওটা খাবো, এরা করবো-সেটা করবো ৷ রাত এখন ১টা বেজে ১০ মিনিট। পরী ঘুমন্ত এহতিশামকে ডেকে বলছে তার বিরিয়ানি খেতে ইচ্ছে করছে তবে বাহিরের নয় আপনার হাতের বিরিয়ানি। এহতিশাম ফুশ করে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। অগত্যা এহতিশামকে গভীর রাতে বউয়ের জন্য বিরিয়ানি রান্না করতে হচ্ছে। আর এখন কিনা বলছে এই রাতের বেলা বাহিরে যাবে তাও কিনা এই তুষারপাতের সময়। এহতিশাম রাজি হবে না কিছুতেই। দিনদিন মেয়েটার বাচ্চামো বাড়ছে। রাগ বাড়ছে, হুটহাট অভিমান করে বসছে৷ হুটহাট এহতিশামকে জড়িয়ে কেঁদে কেঁদে বলছে,
আমি যদি মা/রা যাই আপনি কি আবার বিয়ে করবেন?
এহতিশাম সেবার দুষ্টুমি করে বলেছিলো,
হ্যাঁ করবো।
মেয়েটা সেকি কান্না। আবার সেদিন যখন বললো,
না করবো না।
মেয়েটা বললো,
কেনো করবেন না? আপনাকে বিয়ে করতে হবে৷ একটা খুব খুব খুব সুন্দরী মেয়েকে বিয়ে করবেন।
———–
পরী বিছানায় উলটোপাঁশ ফিরে শুয়ে আছে। দীর্ঘ একঘন্টা পর একবাটি বিরিয়ানি নিয়ে ফিরলো এহতিশাম। কিন্তু পরী বিরিয়ানি খাবে না সে বাহিরে যাবে। পরীর জেদের সাথে এহতিশাম পারলো না। শেষমেষ তাকে পরীকে নিয়ে বের হতে হলো তবে এহতিশাম পরীকে উলের সোয়েটার, উলের গ্লাভস, স্নো বুটস, স্কার্ফ পড়িয়ে দিলো। পরী ফ্যালফ্যাল চোখে তাকিয়ে রইলো।
শুনশান নিরবতায় ঘেরা রাস্তা। বাতাসে উড়ে বেড়াচ্ছে নরম তুলোর মতো বরফ। গাছপালা, রাস্তায় যেনো সাদা জাদুকরী চাদর বিছিয়ে দিয়েছে কেউ। এই নিস্তব্ধ রাতের মাঝে বাড়ীর পাঁশের ফাঁকা রাস্তায় হাঁটছে দুজন কপত কপতী। হাতে হাত রেখে বরফে ঢাকা রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছে। রাস্তার দুই পাশে ঝলমলে ল্যাম্পপোস্টের ফিকে আলোতে দুজনের ছায়া ফুটে উঠেছে। পরী একবার নিজের পাশে সুঠাম দেহি মানুষটার ছায়া আরেকবার নিজের ছোট্ট ছায়াকে দেখলো পরপর শব্দ করে হাসলো৷ এহতিশাম ল্যাম্পপোস্টের আলোয় শ্যামবর্ণের মেয়েটাকে দেখলো৷ ওই চোখ, ওই ঠোঁট, ওই হাসি। ফুলোফুলো নরম গাল। ঘোর লাগানো দৃষ্টিতে দেখলো৷ পরী হাত বাড়িয়ে বরফ ছুয়ে দিচ্ছে। হাতে বরফ জমিয়ে হুট করে এহতিশামের দিকে ছুঁড়ে মারলো। এহতিশাম হকচকিয়ে উঠলো পরী ভেংচি কেটে দূরে গিয়ে বললো,
ভালোবাসি সাদাবিলাই।
এহতিশাম কপাল কুঁচকে দু পা এগিয়ে গিয়ে পরীর হাত চেপে গম্ভীর স্বরে বললো,
হু ইজ সাদা বিলাই?
পরী – আপনি।
এহতিশাম – তুমি কি?
পরী – সাদা বিলাই এর বউ।
বলেই খিলখিল করে হাসলো৷ এহতিশাম থমথমে মুখ করে তাকালো। পরী হাত ইশারায় এহতিশামকে নিচু হতে বললো। এহতিশামের ফর্সা কঁপালে ভাজ পড়লো। কপাল কুঁচকে নিচু হতেই পরী এহতিশামের ঠোঁটে ঠোঁট ছোয়ালো।
এহতিশামের ঠোট প্রসারিত হলো। দুজন আরো কিছুক্ষণ হাঁটলো। নিজের ওভারকোটটা পরীর গায়ে জড়িয়ে দিলো। বেশি দূরে গেলো না বাড়ীর সামনে রাস্তায় একটু হাটাহাটি করে দুজন এবার বাড়ীতে ফিরবে। পরী এহতিশামের বাহু চেঁপে হাঁটছে মাঝে মাঝে হাত উচিয়ে বরফ ছুয়ে দিচ্ছে। এহতিশাম ঘাড় বাকিয়ে পাঁশে তাকালো। চোখের সামনে ভাসলো এক প্রানবন্ত চমৎকার হাসি মাখা মুখশ্রী। পরী হাঁটতে হাঁটতে হুট করে দাঁড়িয়ে গেলো এহতিশাম বললো,
কি হয়েছে?
পরী হাত বাড়িয়ে বাচ্চাদের মতো বললো,
কোলে তুলুন।
এহতিশামের ইচ্ছে করলো নিজের কপাল নিজে চাপড়াতে এই মেয়ে কিছুদিন পর নাকি বাচ্চার মা হবে। এ মেয়ে তো নিজেই এক বাচ্চা৷ বাচ্চানো স্বভাবটা দুদিন ধরো বেড়েছে। এহতিশাম বিনাবাক্যে পরীকে কোলে তোলে হাঁটা ধরলো। পরী এহতিশামের গলা জড়িয়ে মিটি মিটি হাসছে। বেশ জ্বালাচ্ছে এই সাদা বিলাইকে। পরীর কেনো যেনো লোকটাকে জ্বালিয়ে মজা লাগে, শান্তি লাগে তবে আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে এ লোকটার হাবভাব দেখে মনে হয় লোকটা বিরক্ত হয় না একটুও । এহতিশাম কপাল কুঁচকে দেখলো দুষ্ট পরী এখন শান্ত হয়ে কিছু একটা ভাবছে। এহতিশাম বাড়ীর গেটের সামনে এসে বললো,
মিসেস আঁয়াশ দিন দিন ভীষণ পাজি হয়ে যাচ্ছেন।
পরী মুখ ভেংচি কাটলো। বললো,
তাতে আপনার কি? বিরক্ত হচ্ছেন? রাগ হচ্ছে?
এহতিশাম মৃদু হাসলো, নিচু হয়ে পরীর কপালে চুমু দিয়ে ধীরকন্ঠে বললো,
আমি বেশ ইন্জয় করছি।
পরী গোলগোল চোখ করে তাকালো। ইন্জয় করছে? এগুলো ইন্জয় করার মতো কিছু নাকি? এগুলো কে এক প্রকার টর্চার বলা যায়। এই পা/গ/ল লোক কিনা বলছে সেগুলো ইন্জয় করছে। এহতিশাম চোখ নাড়িয়ে বললো,
কিভাবে বাচ্চাদের সামলাতে হয় শিখে নিচ্ছি। কিছুদিন পর দুটো বাচ্চাকে একসাথে সামলাতে হবে তো ।
বলেই সামনে তাকিয়ে হাসলো। পরী বললো,
আপনি আমাকে ভালোবাসেন?
পরী এ কথা অসংখ্য বার জিজ্ঞেস করেছে। আজ আবারও এহতিশাম সরু চোখে পরীর দিকে চাইলো। পরী আবারো চোখ নাঁচিয়ে জিজ্ঞেস করলো এহতিশাম হেঁসে উঠলো। মেয়েটা এখনো জিজ্ঞাসা দৃষ্টিতে তাকানো। এহতিশাম প্রতিবারের মতো শান্তস্বরে বললো,
ভালোবাসি।
পরী খিলখিল করে হাসলো। বললো একটা গান শুনাবেন? ততক্ষণে ওরা রুমে ঢুকলো। এহতিশাম বললো,
-পারি না।
পরী এহতিশামের গলা শক্ত করে জড়িয়ে বলল প্লিজ!
নাহলে আমি আজ নামবো না হুহ।
এহতিশাম পরীকে জোড় করে বিছনায় বসিয়ে দিলো। পরীর পায়ের জুতো খোলে দিলো। পরী গাল ফুলালো। এহতিশাম সেদিকে তাকিয়ে রুম থেকে বের হলো। মিনিট কয়েক পর পাঁশের রুম থেকে গিটার এনে চেয়ার টেনে ঠিক পরীর সামনে বসলো। গিটার হাত রেখে পরীর চোখে চোখ রেখে গাইতে শুরু করলো,
ummmm,… ummmm… ummmm…
Pal ek pal main hi tham sa gaya.
Tu hath main hath jo de gaya..
Chalo main jahan jaaye tu.
Dayein main, teere bayein tu.
Hoon puth main hawayein tu,,,,
Sathiyaaaa…..
Hassun main jab chayee tu,
Roun main murjaye tu,
Bheegun main barsaye tu,,,,
Sathiyaaaaaa…
পরী দুহাতে গাল চেঁপে গান শুনছে। মানুষটার মতোই তার গানের গলাও সুন্দর। একটা মানুষ সব দিক থেকে এতো পার্ফেক্ট কিভাবে হয়? পরীর জীবনের সমস্ত প্রাপ্তি এই মানুষটা। এহতিশাম গান শেষে করে তার শ্যামাবতী প্রেয়সীর হাত মুঠোয় পুড়ে নিলো। পরী গান শুনে বিস্ময়ে হা হয়ে তাকিয়ে আছে। সে বললো,
আপনি এতো সুন্দর করে গান গাইতে পারেন?
এহতিশাম হাসলো ভীষণ সুন্দর সেই হাসি পরী মুগ্ধ চোখে দেখলো। এহতিশাম পরীর হাতে চুমু এঁকে দিলো। পরীকে বুকে টেনে নিলো পরী গুটিয়ে গেলো এহতিশামের প্রশস্ত বুকের মাঝখানে নাক টেনে এহতিশামের গায়ের ঘ্রাণ নিলো। এহতিশাম পরীর মাথায় হাত রেখে বললো,
এহতিশাম আঁয়াশ তার প্রানের জন্য সব করতে রাজি গান আর তেমন কি?
পরী এহতিশামের বুকে নাক ঘষে হেসে উঠলো। এই গভীর রাতে কেটে গেলো এক সুন্দর মুহুর্ত। এভাবেই এহতিশামের জীবন তার শ্যামাবতী প্রেয়সীর সাথে কেঁটে যাক । তাদের প্রতিটা মুহুর্ত এমন অসম্ভব সুন্দর মুহুর্তে পরিনত হোক।
-সমাপ্ত –