#শ্যামাবতী_প্রেয়সী
#পর্ব-৫
#জেসমিন_জেমি
এক নতুন দিনের সূচনা। প্রতিদিনের ন্যায় সূর্যের ঝলমলে আলো ছড়িয়ে পড়েছে চারপাঁশে। অন্ধকার রাত পেরিয়ে আলোয় ঝলমলে সকাল নতুন জীবনের সম্ভাবনার হাতছানি । ভোরের ঝলমলে আলো, হিমশীতল ঠান্ডা হাওয়া – পাখিদের মিষ্টি স্বরে কিচিরমিচির শব্দ সব মিলিয়ে সকাল হয় শান্তিময় । প্রতিটি সকাল কারো জীবনে এনে দেয় আনন্দের জোয়ার আবার কারো কারো জীবনে নেমে আসে ঘোর অন্ধকার। কারো জীবনের হয় নবসূচনা আবার কারো জীবনের শে’ষ। কার সাথে কি হতে চলেছে সেটা কেউ জানে না। জীবন চলমান। মানুষ তার চলমান জীবনে ভবিষ্যৎ এ কি ঘটতে চলেছে তা জানতে অতি আগ্রহে অপেক্ষা করে।
ঘড়িতে ৭টা বেজে ২৫ মিনিট।
পরী এখনো ও ঘুমে। বাহির থেকে পাখিদের কিচিরমিচির শব্দ শোনা যাচ্ছে । জানালার পর্দা ভেদ করে মিষ্টি রোদ চোখে-মুখে পড়তেই পরী চোখ মুখ কুঁচকালো। হাত চোখের উপর রেখে রোদের ঝিলিক থেকে বাঁচতে চাইলো তবে কাজের কাজ হলো না। চোখ মুখ কুঁচকে অন্যপাঁশ ফিরলো।
রিপ্তী- পরী আপা। ও পরী আপা।
দরজার অপাঁশ থেকে রিপ্তীর গলা শুনে ঘুমটা পুরোপুরি ছুটে গেলো পরীর আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসলো। কোমর সমান চুলগুলো হাত খোঁপা করতে করতে দরজা খুলে ঘুমঘুমকন্ঠে বললো,
কি হয়েছে?
রিপ্তী পরীর দিকে তাকিয়ে রহস্যময় হাসলো। পরী ভ্রু কুঁচকে বললো,
এভাবে হ্যাংলার মতো হাসসিস কেনো? পাগল হলি রিপি?
রিপ্তী রুমে ঢুকে বিছানায় বসলো পরী মুখে হাত চেঁপে হামি দিতে দিতে ওয়াশরুমে ঢুকলো। কয়েকমিনিট পর ফ্রেশ হয়ে ফিরলো। রিপ্তী বললো,
আপা চলো বড় মা ডাকে।
পরী চুলে কাঠি লাগাতে লাগাতে বললো,
চল।
রিপ্তী পরীর পথ আটকে সামনে এসে দাঁড়ালো। পরী এবার বেশ বিরক্ত হলো। ভ্রু কুঁচকে বললো,
সমস্যা কি? মা’র খাবি? আজব বিহেভিয়ার কোনো করছিস?
রীপ্তি ধীরকন্ঠে বললো,
টিশার্ট আর প্লাজু চেন্জ করে নিচে যাও।
পরী – কেনো টিশার্ট, প্লাজুতে কি সমস্যা?
রিপ্তী হেঁসে বললো,
বাড়ীতে অনেক মানুষ তাই।
পরীও অনেকক্ষণ যাবৎ বাহির থেকে লোকসমাগমের আওয়াজ শুনতে পেয়েছে। বাড়ীতে এতো সকাল সকাল কে এলো?
পরী – কে এসেছে?
রিপ্তী – কে না বলো কারা এসেছে।
পরী – কারা মানে?
রিপ্তী – বড় ফুফা, বড় ফুফু, আনান ভাই এসেছে।
পরী অবাক হলো ভীষন। বড় ফুফা, আনান ভাই কম করে হলেও শিকদার বাড়ীতে ৩ বছর হলো আসেন না। শুধু বড় ফুফু আর তার ছোট ছেলে এমরান এসেছিলো মেহতাব যেদিন বাড়ীতে ফিরলো সেদিন তবে মেহতাবের সাথে দেখা করে চলে গিয়েছিলো। আজ হঠাৎ পুরো পরিবার শিকদার বাড়ীতে এলো কেনো?
পরী অবাকগলায় বললো,
হঠাৎ উনারা কেনো?
রিপ্তী হেঁসে উঠে বললো,
নিচে চলো তখনি জানতে পারবে।
পরী মাথা নেড়ে টিশার্ট-প্লাজু চেন্জ করে বাসায় পড়ার ছালওয়ার কামিজ পড়ে নিলো।
——★———
বাড়ীর বড়রা সবাই লিভিং রুমে বসে আছে। মাহদুল শিকদার, মাহমুদ শিকদার, মিরাজ শিকদার এক সোফায় বসেছে। মিরাজের কোলে ছোট্ট রিপ্ত গোলগোল চোখ ঘুরিয়ে একবার বাবা চাচাদের তো একবার সামনে বসা ফুফাদের দেখছে। সামনের সোফায় আয়নাল তালুকদার পাঁশে তার স্ত্রী সাদিয়া। পাঁশের সোফায় আনান বসেছে। জুলেখা বেগম চা এনে সামনের টি টেবিলে রাখলো। আয়রা বেগম, রুমি বেগম কিচেনের দরজায় দাঁড়িয়ে আছে। জুলেখা বেগম চা এগিয়ে দিলে আয়নাল তালুকদার নিতে নিতে বললো,
বলুন ভাইজান কি সিদ্ধান্ত নিলেন।
ওরা মূলত আনানের জন্য পরীকে চাইছে। পরীর সাথে আনানের বিয়ের কথা বলতেই সকাল সকাল শিকদার মহলে আসা৷ মাহদুল শিকদার চায়ে চুমুক বসালেন। কিছু একটা ভেবে সময় নিয়ে বললো,
-মাহমুদ কি বলিস?
মাহমুদ শিকদারকে চিন্তিত দেখালো ভীষণ। বললো,
ভাইজান আপনি যেটা ভালো মনে করেন।
মাহদুল শিকদার মাথা নাড়লো মুখে বললো হু।
লোকটাকেও ভীষণ চিন্তিত দেখাচ্ছে। লিভিংরুমের সবার মনে চলছে টানটান উত্তেজনা। সবাই উৎসুক দৃষ্টিতে আপাতত মাহদুল শিকদারের দিকে তাকিয়ে মাহদুল শিকদার ধীরে ধীরে চায়ে চুমুক বসালো সবটুকু চা শেষ করে বললো,
আজই আকদ সাড়তে চাই। রাজি আছেন?
সামনে বসা তিনজন মানুষ যেনো দম ছেড়ে বাঁচলো। দুজনের মুখে ফুটে উঠলো এক রহস্যময় হাসি। সাদিয়া বেগম জোড়ে জোড়ে বললো,
আলহামদুলিল্লাহ। রাজি কেনো থাকবে না ভাইজান? অবশ্যই অবশ্যই রাজি।
আয়নাল তালুকদার চোখ পাকিয়ে স্ত্রীর দিকে তাকালো। লিভিংরুমে পরী আর রিপ্তী এসে দাড়াতেই সাদিয়া বেগম বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো পরীকে জড়িয়ে নিজের গলায় থাকা স্বর্ণের চেইন পরীর গলায় পড়িয়ে দিয়ে কপালে চুমু খেলেন। এ বাড়ীর সব ছেলে মেয়ে সাদিয়া বেগমের আদরের। এ বাড়ীর বড় ছেলে মেহতাবের পর বড় মেয়ে পরীর আগমন হলো। নিজের দুটো ছেলের পর এ বাড়ীর একমাত্র মেয়েকে নিজের মেয়ের মতো ভালোবেসেছে সাদিয়া বেগম। সেই মেয়েকে ছেলের বউ করতে পারবে ভেবে খুশিতে আত্মহারা হয়ে উঠলো।
পৃথিবী বড়ই অদ্ভুত আর এই অদ্ভুত পৃথিবীতে বিভিন্ন চরিত্রের, বিভিন্ন মনমানসিকতার মানুষ বসবাস করে। এই যেমন কেউ কেউ পরীকে কালো বলে অবহেলা করে কেউ কেউ পরীকে আদরে ভরিয়ে রাখে। কেউ কেউ তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে দূরে সরিয়ে দেয় কেউ আবার অতি যত্নে কাছে টেনে নেয়। পরী বিস্ময়ভরা চোখে সবার দিকে চাইলো। হঠাৎ সোফায় বসা আনানের দিকে চোখ পড়তেই আনান কেমন করে হাসলো৷ পরী সাথে সাথে চোখ সরিয়ে নিলো। আনান ভাই, এই আনান ভাইকে সে কখনোই বিয়ে করতে পারবে না। হঠাৎ করে তিনবছর আগের কথা মনে পড়তেই সারা শরীর ঘৃণায় রি রি করে উঠলো পরীর ।
তিনবছর আগে,,
সেদিন অনুষ্ঠান ছিলো শিকদার মহলে। পুরো শিকদার মহলে ছিলো লোকসমাগম। পরী তখন কেবল নবম শ্রেনীতে পড়ে। আনান অনার্স থার্ড ইয়ার। সেদিন অনুষ্ঠানে লং গাউন পড়েছিলো। পিঠ সমান চুল গুলো ছিলো খোলা। অনুষ্ঠানের সব আয়োজন করা হয়েছিলো ছাদে। পরী আর রিপ্তী খাওয়া শেষ এ হাত ধুঁয়ে হাত মোছার কিছু খুঁজে পাচ্ছিলো না। রিপ্তি সেদিন চিলেকোঠার ঘরে কিছু পুরাতন জামা কাপড় রেখেছে বলতেই দুজন সেখানে যায়৷ ছাদ এখন পুরো ফাঁকা সবাই নিচে চলে গেছে। রিপ্তি হাত মুছে তারাহুরো করে দৌঁড়ে নেমে যায়। পরী দাঁড়াতে বললেও দাঁড়ায় না। পরী হাত মোছা শেষ করে পিছু ফিরতেই দেখলো দরজায় আনান দাড়িয়ে আছে। পরী আনানকে দেখে হেসে বলে,
আনান ভাই তুমি? কিছু লাগবে?
আনানের ঠোঁটে তখন বিশ্রি হাসি ঝুলছে। বিশ্রী নজরে পরীর পা থেকে মাথা পর্যন্ত অবলোকন করলো। পরী তখন নবম শ্রেনীতে পড়ে অতোটা ছোট নয় যে কে কেমন নজরে তার দিকে তাকিয়েছে সেটা বুঝবে না। পরী দূর থেকে দরজায় উঁকি দিয়ে দেখলো ছাদে কেউ নেই ভয়ে গলা শুকিয়ে উঠলো মেয়েটার। আনান বিশ্রী হাসি মুখে চেপে দু পা এগিয়ে এসে পরীর গালে হাত রাখতে যাবে তখনি পরী তুতলানো কন্ঠে ডাকলো ,
-মেহতাব ভাই ।
আনান পিছন ফিরতেই চিকন চাকন স্বাস্থের পরী দৌড় দিলো। আনান ও পিছু ছুটলো। পরী রুম থেকে বের হতেই ধাক্কা খেলো মেহতাবের সাথে। মেহতাব ঘাবড়ানো পরীকে দেখে কপাল কুঁচকে বললো,
কি হয়েছে এভাবে দৌড়াচ্ছিস কেনো?
কথা শেষ করতে পারলো না মেহতাব সাথে সাথে রুম থেকে দৌড়ে বের হলো আনান । পরী ভয়ে গুটিয়ে গেলো। মেহতাব পরীকে টেনে নিজের পাঁশে দাঁড় করিয়ে গম্ভিরকন্ঠে আনানকে বললো,
-কি হয়েছে?
আনান পরীর দিকে তাকিয়ে চোখ পাকিয়ে বললো,
-কিছু না মেহতাব।
পরপর পরীকে পাঁশ কাটিয়ে ছাদ থেকে নামলো।
পরী ভয়ে গুটিয়ে মেহতাবের ঘা ঘেষলো। মেহতাব পরে পরীকে জিজ্ঞেস করতেই পরী হুরহুর করে সব বলে দিলো। মেহতাবের সারা শরীর রাগে কেঁপে উঠলো। শিকদার বাড়ীর মেয়েদের দিকে যে কুনজরে তাকাবে তার চোখ উপড়ে শুকুনকে খাওয়াবে মেহতাব। সেদিন মেহতাব আনানকে মে’রে নাক মুখ ফা’টিয়ে দিয়েছিলো। সে সময়ই বাড়ীর বড়দের সাথে আয়নাল তালুকদারের ঝামেলা হয়। বাড়ীর সবাই অনেক করে জিজ্ঞেস করেছিলো কি হয়েছে? কেনো মে’রেছে আনানকে? সেদিন মেহতাব একটা কথাও বলে নি। পরীও কাউকে কিছু বলেনি। মেহতাব কেনো আনানকে সেদিন মে’রেছিলো এ বাড়ীর কেউ আজও জানে না। সেদিনের পর আয়নাল তালুকদার আর আনান শিকদার মহলে পা রাখেনি। হঠাৎ করে আজ!তাও আনানের সাথে বিয়ে? পরী কান্না পাচ্ছে সে এমন নিচ মনের মানুষকে কখনোই বিয়ে করবে না, কখনোই না। পরী দৌড়ে রুমে চলে গেলো৷ মেহতাব ও এতোক্ষণ যাবৎ এখানেই ছিলো। বেশ গভীর মনোযোগ দিয়ে সবটা শুনেছে৷ এই মুহুর্তে আনান বাকা হেঁসে তার দিকেই তাকিয়ে আছে। মেহতাবও ওর দিকে তাকিয়ে রহস্যময় হাঁসলো পরপর উঠে দাঁড়ালো পড়নের গ্রীন টিশার্টের কলার টেনে গটাগট পা ফেলে রুমের দিকে গেলো।
চলবে,,,,,,,,
(ভুলক্রুটি মার্জনীয়)