#শ্যামাবতী_প্রেয়সী
#পর্বঃ ৬
#জেসমিন_জেমি
সন্ধ্যা নেমে এসেছে। ধরনীর বুকে এখন আর সেই ঝলমলে সূর্যের আলো নেই। চারপাঁশে আবছা অন্ধকার । পরী জানালার পাশে দাঁড়িয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে। পরীর গালে এখনো পাঁচ আঙুলের ছাপ বসে আছে। এইতো দুপুরে যখন মায়ের কাছে বললো সে আনানকে বিয়ে করতে চায় না সাথে সাথে সপাটে থাপ্পড় পড়েছিলো তার গালে। পরীর চোখ দুটো চিকচিক করে উঠলো। তার মা কেনো তাকে বুঝে না? তার মা তাকে কেনো ভালোবাসে না? কেনো বুকে জড়িয়ে কপালে চুমু এঁকে দেয় না। ছোট কাকি যেমন রিপ্তীর মাথায় হাত রাখে, আদর করে, চুমু খায় তাকে কেনো তার মা ভালোবাসে না?
– আপা তোমার গালে কি হয়েছে?
পরীর ভাবনায় ছেদ পড়লো পরী ঘাড় ফিরিয়ে সেদিকে তাকাতেই দেখলো রিপ্তী দাঁড়ানো। পরী পূনরায় জানালায় চোখ রাখলো অন্ধকার হাতরে দৃষ্টি সেই অদূরে। রিপ্তী তড়িঘড়ি করে এগিয়ে এসে পরীর গালে হাত রাখলো,
বলো আপা। তোমার গালে কি হয়েছে?
গভীর দৃষ্টি নিক্ষেপ করতেই রিপ্তী বুঝলো,
এগুলো কারো হাতের ছাপ। রিপ্তী লাফিয়ে উঠে বললো,
ওমা কে মে’রে’ছে তোমায়? হাতের ছাপ বসে গেছ একদম।
পরী মেঁকি হাসলো। এমন সময় লিভিং রুম থেকে সোরগোলের শব্দ ভেসে আসলো । রিপ্তী হকচকিয়ে উঠলো,বললো,
কি হয়েছে?
পরী মাথা নাড়লো যার মানে সেও জানে না।
পরী রিপ্তী তড়িঘড়ি করে রুম থেকে ছুটলো। নিচে আসতেই দেখলো। এহতিশামের পায়ে সফেদ রঙের ব্যান্ডেজ পেঁচানো। ফর্সা কপালের একপাঁশে ও ব্যান্ডজ চাপানো। ব্যান্ডজের উপর ভেসে উঠেছে লাল র’ক্ত কণা। ধবধবে ফর্সা মুখশ্রী, লম্বা নাকটা কেমন যেনো লাল রঙ ধারন করেছে। চোখ দুটো ও রক্ত লাল হয়ে উঠেছে। জুলেখা বেগম হা হুতাশ করছেন। আয়রা বেগম ছুটে গেলেন এহতিশামের কাছে।
আয়রা বেগম চিন্তিত গলায় বললেন
– কি হয়েছে বাবা ? কিভাবে হলো এসব?
এহতিশাম হাসার চেষ্টা করে বললো,
ছোট এক্সিডেন্ট।
জুলেখা বেগম – কি? কিভাবে?
ঠিক আছো? বেশি লাগে নি তো?
মেহতাব মা চাঁচিকে আশস্ত করে চোখ নাড়লো। পরপর রুমের এহতিশাম মেহতাব রুমের দিকে গেলো। এহতিশাম বেডে বসতেই মেহতাব থমথমে কন্ঠে বলে উঠে,
কি চাইসিস তুই?
এহতিশাম সাথে সাথে জবাব দিলো,
আমার প্রাণ।
মেহতাব -কেনো এমন পাগলামি করছিস?
কানাডা কবে ফিরছিস তুই? এমন পাগলামির মানে কি? তুই তো জানিস তোকে এখন কত প্রয়োজন ওখানে?
এহতিশাম স্বাভাবিক কন্ঠে বললো
– শাট আপ! বকবক বন্ধ কর।
মেহতাব দীর্ঘশ্বাস ফেললো। ৫ মিনিট পর পরীকে ডাকলো । পরী তখন রুমের বাইরেই ছিলো৷ ধীরকন্ঠে বললো,
হ্যাঁ ভাইয়া।
মেহতাব দরজায় এসে পরীকে দেখে কপাল কুঁচকে বললো,
– এক গ্লাস গরম দুধ দিতে বল ।
পরী মেহতাবের কথা শুনে দ্রুত রান্না ঘরে ছুটলো। মেহতাব রুমে ঢুকে এহতিশামের দিকে তাকাতেই দেখলো এহতিশাম অগ্নি চোখে ওর দিকেই তাকিয়ে আছে। যেনো দৃষ্টি দিয়েই মেহতাবকে গিলে খাচ্ছে। মেহতাব সাথে সাথে ভড়কে গেলো, চিবুক গিলে বললো,
কি সমস্যা? কি করেছি আমি? এভাবে তাকিয়ে আছিস কেনো শালা? ওর মতো আমাকেও মারবি?
এহতিশাম চোয়াল শক্ত করে থমথমে কন্ঠে বললো,
ওকে পাঠালি কেনো?
মেহতাব ভ্রু কুঁচকে বললো,
পাঠিয়েছি তাতে কি হয়েছে?
এহতিশাম চোয়ালদ্বয় শক্ত করে বললো,
যদি কোনে দূর্ঘটনা ঘটে আই উইল কি’ল ইউ।
মেহতাব এবার ভয় পেলো না। সেদিনের কথা মনে পড়তেই হেসে উঠলো৷ একটা ছেলে একটা মেয়েকে কতটা ভালেবাসতে পারে? কতটা? সেদিন পরীর পায়ে গরম চা পড়তেই এহতিশাম মেহতাবকে বরফ লাগিয়ে দিতে বলে এমনকি কোলে করে রুমে পর্যন্ত নিয়ে যেতে বলে। ছেলেটা কতটা পরিমানে ছটফট করছিলো তা শুধু মাত্র মেহতাবই জানে। তবে বাহির থেকে দেখা গেলো এক কংক্রিট যে শুধু দাঁড়িয়ে সবটা দেখলো।
মেহতাব হা হা করে হেঁসে উঠলো। দাঁত কেলিয়ে বললো,
আনান আর রিজভীর মতো?
এহতিশাম পুনরায় একি স্বরে বললো,
ওদের থেকে মারাত্মক ভাবে।
মেহতাব বেডে না বসে গিয়ে সোফায় বসলো৷ এ ছেলেকে ভরসা নেই মেহতাবের সোফায় বসে দাঁত কেলিয়ে বললো,
আমি, এই মেহতাব! তোকে সাহায্য করছি। একটু তো দয়া মায়া কর ভাই।
এহতিশাম বাঁকা হেঁসে বললো,
আমার প্রাণে হাত বাড়ালে তোর কাজিন কেনো তোর ওই হাত দুটো ও থাকবে না৷
মেহতাব ভ্রু কুঁচকে বললো,
শা’লা। আমার কাজিনের দিকে নজর দিছস তোরে তো হাত পা ভাইঙ্গা বক্স কইরা কানাডা পাঠানো দরকার।
এহতিশাম কপাল কুঁচকে চাইতেই মেহতাব বললো,
তবে আমাকে দেখ আমি কত ভালো বন্ধু। তোকে আমার বাসায় থাকতে দিচ্ছি, খাওয়াচ্ছি।
এহতিশাম বেডে শরীরের ভর ছেড়ে দিয়ে বললো,
তোর বাড়ী না আমার শশুর বাড়ী।
মেহতাব তেড়ে আসলো।
– শা*লা আমার বাড়ী না মানে? এক্ষুনি বের করে দিবো।
এহতিশাম চোখের উপর হাত রেখে বললো,
রুম থেকে যা মেহতাব।
মেহতাব ভ্রু কুঁচকে বললো,
তুই বললেই যাবো কেনো?
এহতিশামের ইচ্ছা করছে নিজের কপাল নিজে চাপড়াতে। এরা ভাই বোন সবাই এমন ঝগড়ুটে কেনো ? এহতিশাম মেহতাবের দিকে তাকিয়ে থমথমে কন্ঠে বললো,
নাও গেট লস্ট মিস্টার মেহতাব শিকদার।
মেহতাব থমথমেকন্ঠে বললো,
শা*লা, ব,,,,
মেহতাব কথা শেষ করতে পারলো না এহতিশাম বললো,
গেট লস্ট। মিস্টার মেহতাব শিকদার আগামী দুঘন্টা আপনাকে আমার আঁশেপাঁশে দেখতে চাই না।
মেহতাব আর কথা বাড়ালো না। রুম থেকে বের হতে হতে বিরবির করে বললো,
তোর কাছে বোন কখনোই দিবো না শা*লা
এহতিশাম পিছন থেকে বললো,
শা*লা না দুলাভাই ডাক।
মেহতাব চোখ পাকিয়ে রুম থেকে বের হয় শব্দ করে দরজা আটকে দিলো।
সুদূর কানাডা থেকে এক শ্যামবতীর প্রেমে বাংলাদেশে ছুটে এসেছে সুদর্শন যুবক এহতিশাম আয়াশ। আচ্ছা সেই শ্যামাবতী কী জানে তাকে কেউ পাগলের মতো ভালোবাসে? সে কী জানে তাকে দেখার জন্য কেউ পাগল হয়ে উঠে? সে কী জানে তাকে কাছে পাওয়ার এক বুক তৃষ্ণা নিয়ে কেউ অপেক্ষায় আছে। উহু সে জানে না। তার জানার কথাও না।
—–*——-
পরী গ্লাস ভর্তি গরম দুধ নিয়ে আসতে নিলেই মেহতাবের সামনে পড়লো। মেহতাব সেদিকে তাকিয়ে কিছু না বলে চলে যেতে নিলেই পরী ধীরকন্ঠে ডাকলো,
মেহতাব ভাই।
মেহতাব ব্যস্ত কন্ঠে বললো,
ও হ্যাঁ রুমে নিয়ে যা। টি-টেবিলে তিনটে ট্যাবলেট আছে এহতিশামকে একটু দিয়ে দিস।
বলেই তড়িঘড়ি করে নিচে নামলো যেনো কোনো জরুরি কাজ পরেছে। এখনি যেতে হবে না হলে সর্বনাশ হয়ে যাবে৷ পরী সেদিকে তাকিয়ে ফুস করে দীর্ঘশ্বাস ফেললো। ধীরপায়ে রুমের সামনে গিয়ে দু আঙুলে টোকা দিতেই অপাঁশ থেকে থমথমে পুরুষালী কন্ঠস্বর ভেসে আসলো,
খোলা আছে৷
পরী রুমে ঢুকেই দেখলো এহতিশাম কপালে হাত চেঁপে শুয়ে আছে। পরী রুমে যেতেই এহতিশাম উঠে বসলো। এহতিশামের পড়নে সাদা শার্ট, ব্লাক জিন্স। ফর্সা ধবধবে মুখ এখনো লাল হয়ে আছে। যেনো কেউ মুখে লাল রঙ মাখিয়েছে। পরী বিরবির করে বললো,
এতো সুন্দর কেনো?
এহতিশাম শুনলো বোধহয় তবুও না শোনার ভান করে বললো,
কি চাই?
পরী – কি চাই মানে,? কি চাইবো?
এহতিশাম কথা বাড়াতে চাইলো না
– ডোন্ট ডিস্টার্ব মি।
পরী ফুস করে জ্বলে উঠলো। রুম থেকে ফিরে যেতে নিয়েও আবার এলো নেহাৎই মেহতাব ভাই বলেছে নাহলে পরীর ঠেক লাগে নাই এই রুমে আসার। পরী রাগে ফুসফুস করতে করতে দুধের গ্লাস টি টেবিলে রেখে ট্যাবলেট গুলো এড়াতে এড়াতে বললো,
এহ আসছে আমার লাট সাহেব। আপনাকে ডিস্টার্ব করতে আমার বয়েই গেছে। হুহ
এহতিশাম কপাল কুঁচকে বকবক করতে থাকা শ্যামবর্ণের মেয়েটার দিকে তাকিয়ে রইলো। যারা পড়নে মেরুন রঙের ছালওয়ার কামিজ। কোমর সমান চুলগুলে বেনুনি করা। মেয়েটার ফুলো ফুলো গাল দুটো পরপর কথা বলার জন্য নড়ে চড়ে উঠছে। ঘন কালো পাপড়ি বিশিষ্ট চোখ জোড়া কথার ফাঁকে ফাঁকে উপর নিচ হচ্ছে। এহতিশাম যতোটুকু শুনেছে, যতটুকু জানে পরী ভীষণ শান্তশিষ্ট মেয়ে তবে এহতিশামের সাথে এ দুদিনে কয়েকবার ঝগড়া হয়েছে। পরী শুধু তার সাথেই এমন ঝগড়া করে? স্ট্রেন্জ! এভাবে ঝগড়া চললে সংসার কবে হবে? এহতিশাম বাচ্চার বাবা কবে হবে?
এহতিশামের ভাবনার মাঝেই পরী ট্যাবলেট গুলো এগিয়ে দিয়ে গমগমেকন্ঠে বললো,
– নিন খেয়ে নিন।
এহতিশাম ভ্রু কুঁচকে ট্যাবলেট গুলো হাতে নিলো। রাগে ফুসফুস করতে করতে দুধের গ্লাস এগিয়ে দিতে গিয়ে কয়েক ফোঁটা দুধ পরীর হাতের পাঁশে পড়লো। কি অদ্ভুত সব সময় গরম কিছু হাতে পায়ে ফেলার রোগ আছে নাকি মেয়েটার। এহতিশাম দাঁতে দাঁত চেঁপে ব্যস্ত হয়ে পরীর হাত থেকে গ্লাস টেনে নিলো। বেডের এক পাশে গ্লাস রেখে পরীর হাত নিজের হাতের আয়ত্বে নিয়ে হাত উল্টে পাল্টে দেখে ব্যস্ত কন্ঠে বললো,
ড্যাম্ ইট! হাতে পড়েছে ? জ্বলছে?
পরী অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো। কি করছে লোকটা? এতে ব্যস্ত হওয়ার কি আছে পরীর হাতে তো পড়েনি। কিন্তু পরীর জন্য লোকটা এতো ব্যস্তই বা হচ্ছে কেনো? আজব তো! পরী একপ্রকার টেনে হাত সরিয়ে নিয়ে কাঁপা কাঁপা গলায় বললো,
হা, হাতে পড়েনি।
এহতিশাম এবার পরীর হাত শক্ত করে চেঁপে হুমকিস্বরে বললো,
নেক্সট টাইম এসব হাতে দেখলে মে*রে দিবো একদম জানে মে*রে দিবো । আই উইল কি’ল ইউ ।
পরীর হাতে এক অসহ্যকর ব্যথা অনুভব হচ্ছে। উহু ব্যথাটা হাত চেপে ধরার জন্য না। হাতের কাটা জায়গায় কেউ চেঁপে ধরার জন্য। অসহ্য যন্ত্রনায় মুখ নীল হয়ে উঠলো পরীর। না চাইতেও চোখ দুটো জলে ভেসে উঠলো৷ ঠোট উল্টে আর্তনাত করে বললো,
ও মা গো হাতে লাগছে। ছাড়ুন।
এহতিশাম সাথে সাথে ছেড়ে দিলো। এহতিশাম কিছু বুঝে উঠার আগেই পরী দৌঁড়ে রুম থেকে বের হয়ে গেলো৷
চলবে,,,,,,,,