শ্যামাবতী প্রেয়সী পর্ব-০৭

0
28

#শ্যামাবতী_প্রেয়সী
#পর্ব ৭
#জেসমিন_জেমি

রাত তখন ১১টা।
পরী ছাদের ঠিক যে পাঁশে নিরিবিলি সেদিকটায় রেলিঙ ঘেষে দাঁড়িয়ে আছে। খোলা অবাধ্য চুল বাতাসে উড়ে এসে চোখে মুখে উপচে পড়ছে। গায়ের উড়নার এক কোনা ছাদের ফ্লোর ছুঁইছুই।এ যেনো বড্ড অগোছালো এক পরী। পরীর যখন মন খারাপ থাকে তখন রাতের এই অন্ধকার ছাদ, খোলা আঁকাশ, আকাশের সেই গোলাকার চাঁদ হয় পরীর মন খারাপে সঙ্গী। পরী খোলা আঁকাশের পানে তাকিয়ে জড়ানো কন্ঠে বললো,
আমিও মানুষ আমার ও যে কষ্ট হয়,,,

পরীর সারা শরীর জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে। হাতের ব্যাথায় চোখ দুটো জলে ভরে উঠেছে। হাতটা ফুলে টনটন করছে। নিজ পায়ে তেমন একটা শক্তি পাচ্ছে না। নিজের শরীরের ভর ছেড়ে দিচ্ছে তো রেলিঙ ধরে সোজা হয়ে দাড়াচ্ছে। জ্বরের ঘোরে নিজে নিজেই বিরবির করছে। লিভিংরুমে হইচই বেঁধেছে। আয়নাল তালুকদারের সাথে মাহদুল শিকদারের তুমুল কথা কাটাকাটি হচ্ছে। সন্ধ্যায় যখন খবর এলো আনানকে কিছু লোক মেরে হসপিটালে পাঠিয়েছে। ঠিক তখন সব দোষ ওর ঘাড়ে এসে পড়লো। নিশ্চয় পরী অলক্ষুনে, অভিশাপ ওর জন্যই এতো কিছু হচ্ছে। না হলে আজই ছেলেটাকে লোকগুলো মারলো কেনো? পরী যদি অলক্ষুনে না হয় রিজভী কেনো ওকে বিয়ে করতে না করলো? আয়রা বেগম এক অভিশাপ জন্ম দিয়েছে। এক অভিশাপের মা সে। এই ভেবে রাগে দুঃখে মেয়ের হাতে মুচড়ে দিয়েছে। এ বাড়ীর কেউ অবশ্য তা জানলো না। নিচ থেকে সরগোল শোনা যাচ্ছে। আয়নাল তালুকদার একজন বিকৃত মস্তিষ্কের মানুষ মুখে যা আসছে তাই বলে যাচ্ছে। সাদিয়া বেগম স্বামীকে দমাতে পারছেন না। আয়নাল তালুকদার যেনো তিনবছরের রাগ, ক্রোধ সব কথায় মিটাচ্ছে। নিচ থেকে মেহতাবের গলাও শোনা যাচ্ছে। পরী চোখ বুজে নিলো তার জন্য এতো সব কিছু হচ্ছে। শুধু তার জন্য হচ্ছে সে অপয়া, অলক্ষি, সে একটা অভিশাপ । সে এই পৃথিবীতে থাকলে সবার শুধু খারাপই হবে। আনানের হাতে পায়ে ব্যান্ডেজ বাঁধা, আনান যখন সবার সামনে বিশ্রী ভাষায় বললো,
দেখুন গিয়ে বাইরে কোনো নাগর আছে যে আমাকে এভাবে মা*রতে পাঠিয়েছে।

এ কথা বলতে দেড়ি মেহতাব আনানের নাক বরাবর ঘুষি মা*রতে দেড়ি করেনি। শিকদার মহলে এক অশান্তি শুরু হয়েছে।

এসবের কেন্দ্রমূল পরী। পরীর লজ্জায় ঘৃনায় ম*রে যেতে ইচ্ছে করছে। আচ্ছা সে ম*রে গেলেই শিকদার মহলে শান্তি আসবে? আচ্ছা সে ম*রে গেলেই কি আয়রা বেগম হাফ ছেঁড়ে বাঁচবেন? সে ম*রে গেলে কি পৃথিবী পরী নামক অভিশাপ থেকে মুক্তি পাবে?
হয়তো পাবে। আচ্ছা সে ম*রে যাওয়ার পর কি আয়রা বেগম তাকে ভালোবাসবে? আফসোস করবো বুকে জড়ানোর? রিজভী ভাইয়া কি একটু হলেও আফসোস করবে পরীর জন্য?

এতো এতো ভাবনার মাঝে বোকা পরী জানলো না তাকে কেউ ভালোবাসে। কেউ তাকে নিজের সব, সব, সবটা দিয়ে ভালোবাসে। তাকে পাওয়ার জন্য পৃথিবী উলটপালট করে দিতেও পারে। পরীর জন্য নিজের জীবন বাজি রাখতেও রাজি।

——-
মাথা ভনভন করছে। পরীর আর শক্তিতে কুলালো না পা দুটে বসে পরলো। চোখের সামনে সব ঝাপসা দেখতে লাগলো। শরীরের টাল সামলাতে না পেরে যখন ফ্লোরে পড়তে নিলো তখনি একজোড়া পুরুষালি হাত খুব যত্নে সুঠামদেহি পুরুষের বিশাল বুকের মধ্যিখানে ছোটখাটো গড়নের পরী কে আগলে নিলো। পরী এহতিশামের বুকে মুখ গুঁজে পরে রইলো। পরীর শরীরের তাপমাত্রায় এহতিশামের শরীর গরম হয়ে উঠলো। এহতিশাম চিন্তিত, ধীরকন্ঠে শুধালো,

প্রান ঠিক আছো?

পরী পিটপিট করে চোখ মেললো, মাথা উঁচু করে দেখলো চোখের সামনে ভেসে উঠা এক চিন্তিত ফর্সা মুখশ্রী। লোকটা ভীষণ লম্বা। এ বাড়ীতে মেহতাবের সাথে এমন লম্বা চওড়া লোক আরো একজন লোক আছে যে পরী কি বেমালুম ভুলে বসেছিলো? পরী নিজেকে ছাড়ানোর জন্য নড়াচড়া করলো এহতিশাম ছাড়লো না নিজের সাথে শক্ত করে জড়িয়ে নিলো। পরীর জ্বরে উত্তপ্ত কপালে ঠোঁট ছোয়ালো । পরী ছটফট করে জড়ানো কন্ঠে বললো,
ছাড়ুন আমায়, আমি অভিশাপ।

এহতিশাম পরীকে জড়িয়ে পূনরায় কপালে ঠোঁট ছোয়ালো। বললো,

তুমি অভিশাপ নয় ,
তুমি সদ্য ফোঁটা পবিত্র এক গোলাপ।

পরী চোখ খুললো। এহতিশাম আবারো বললো,

যদি পুরো পৃথিবী বলে তুমি অভিশাপ,
আমি বলবো এই অভিশাপই আমার প্রান।
এহতিশাম আয়াশের প্রান।

পরী মাথা তুলে অকস্মাৎ বিরবির করে বললো,
অ্যাই সাদা বিলাই?

এহতিশাম পরীকে জড়িয়েই ধীরকন্ঠে বললো,
-হু।

পরী এহতিশামের ফর্সা গালে হাত রেখে বললো,
আপনি এতো সুন্দর কেনো?

এহতিশাম বললো,
তোমার দেখার চোখ সুন্দর তাই!

পরী – উহু আপনি এমনিতেই সুন্দর। অনেক সুন্দর।

পরী এহতিশামের বুকে কিছুক্ষন মুখ গুঁজে পরে রইলো। এক মিষ্টি সুগন্ধ ভেসে আসছে লোকটার শরীর থেকে পরী নাক টেনে লম্বা শ্বাস নিলো। দু হাতে শক্ত করে এহতিশামকে জড়িয়ে নিলো। হুট করে বলে উঠলো,

আমায় বিয়ে করবেন সাদা বিলাই ?

এহতিশাম বেশ বুঝলো মেয়েটা জ্বরের ঘোরে আবল তাবল বকছে। মেয়েটা নিজের মাঝে নেই। এহতিশাম কিছু বললো না। এহতিশামকে চুপ থাকতে দেখে পরী কপাল কুঁচকে এহতিশামের বুকে মৃদু থাপ্পড় মেরে বললো,

ছাড়ুন, ছাড়ুন আমায়। আপনিও আমায় ভালোবাসেন না। আপনিও সবার মতো। আপনিও সবার মতো।

বলেই ঠোঁট উলটে বাচ্চাদের মতো শব্দ করে কেঁদে উঠলো। এহতিশামের থেকে সরতে নিলেই এহতিশাম আবল তাবল বকা মেয়েটাকে কোলে তুলে নিলো। পরী চোখ বুঁজেই এহতিশামের শার্টের কলার চেপে ধরলো। বিরবির করে কি বলতে বলতে যেনো মেয়েটা জ্ঞান হারালো। শরীরের সব শক্তি ছেড়ে দিলো এহতিশামের উপর। এহতিশামের শার্টের কলার চেপে রাখা হাতের মুঠো নরম হয়ে গেলো। এহতিশাম পরিকে নিয়ে দ্রুত ছাদ থেকে নামলো।

_________

ভোরবেলায় চোখে মুখে সূর্যের ঝলমলে আলো পড়তেই পরী পিটপিট করে চোখ মেললো। আজ সকালটা ভীষন সুন্দর। রাতে বোধহয় বৃষ্টি হয়েছে। পৃথিবীর বুকে জমাট বাঁধা সকল ঝঞ্ঝাট যেনো বৃষ্টির ফোঁটায় ফোঁটায় ধুয়ে মুছে গেছে। পরী উঠে বসলো মাথাটা ভার ভার লাগছে। শরীরে জ্বরটা নেই। তবে মাথাটা কেমন যেনো করছে। হাতের দিকে তাকাতেই দেখলো হাতের কাটা জায়গায় সাদা ব্যান্ডেজ বাঁধা। পরী ধীরে ধীরে উঠে বেলকনিতে গিয়ে দাঁড়ালো। পরীর বেলকনি থেকে নিচের বাগান দেখা যায়। যেখানে বৃষ্টির ছোঁয়ায় ফুটে উঠেছে রঙ বেরঙের ফুলের সমাহার। বৃষ্টির ছোয়ায় গাছ গুলো সতেজ হয়ে উঠেছে। এক সুন্দর নতুন সকাল। শীতল নির্মল হাওয়া বইছে চারপাঁশে পরীর দীর্ঘ শ্বাস টানলো । হঠাৎ পরীর রাতের কথা মনে পড়তেই ঠোঁট কামড়ে ধরলো। এহতিশামকে বলা কথাগুলো মনে পড়তেই লজ্জায় গাল দুটো লাল হয়ে উঠলো। লোকটাকে সে কিভাবে বলতে পারলো অসব কথা?
পরী এখন কিভাবে মুখ দেখাবে? লোকটার সামনে? ছিহ লোকটা কি ভাবলো পরীর সম্পর্কে? আজ আর সাদা বিলাইয়ের সামনে পড়বে না পরী। কখনোই না, মরে গেলেও না।

পরী ফ্রেশ হয়ে নিচে নামলো। সকাল সকাল শিকদার মহলের তিন গিন্নী রান্নাঘরে ব্যস্ত। এটা নিত্যদিনের রুটিন। পরী কিচেনে উঁকি দিতেই দেখলো শিকদার বাড়ীর তিন গিন্নির সাথে পরীর মামি খাদিজা বেগম ও আছে। শিকদার বাড়ীর তিন কর্তাদের ও দেখা নেই। রিপ্তীকেও কোথাও খুঁজে পেলো না। রিপ্ত কান্না করছে ছোট কাকির কোলে। পরীর ভীষন আদরের রীপ্ত। ছেলেটার ফুলোফুলো গাল দুটো পরীর বেশি পছন্দ। আধো আধো গলায় যখন ডাকে পলীপা। পরীর তখন খুব ভালো লাগে। পরী রিপ্তকে যখন তখন টুকুস করে চুমু বসিয়ে দেয়। হঠাৎ মনে পড়লো সেদিন এহতিশাম রীপ্তর সাথে হাত নাড়িয়ে নাড়িয়ে কি যেনো বলছিলো। রীপ্ত তার ফোকলা দাঁতগুলো বের করে খিলখিলিয়ে হেঁসে উঠলো। রীপ্ত এহতিশামের গাল টেনে চুমু বসিয়ে দিতেই পরীর রাগ হলো। রীপ্ত ওই সাদা বিলাইকে কেনো চুমু খাবে? পরীর ভাবনায় ছেদ পড়লো যখন পরীকে দেখে রিপ্ত আধো আধো গলায় ডাকলো,
পলীপা।

সবাই ভূত দেখার মতো পরীর দিকে তাকালো। পরীর মামি খাদিজা বেগম এগিয়ে এসে বললো,
কেমন আছিস পরী।

পরী মাথা নেড়ে বললো,
ভালো আছি মামি। তুমি?

খাদিজা বেগম হেঁসে বললো,
ভালো আছি।

রিপ্ত একপ্রকার ছটফট করতে লাগলো পরীর কোলে আসার জন্য। রুমি বেগম এগিয়ে এসে পরীর কোলে রিপ্তকে চাপিয়ে দিয়ে বললো,,

-কদিন আর? তারপর পরী আপাকে কোথায় পাবি ? আহ্লাদে বাঁচি না।

পরী রুমির কথা আমলে নিলো মা তেমন রিপ্তকে কোলে চেপে ধরে রিপ্তর ফুলোফুলো ফর্সা গালে টুকুস করে চুমু একে দিয়ে বললো,
পরী আপা সারাজীবন থাকবে তাই না রিপ্ত?

রিপ্ত কি বুঝলো কে জানে খিলখিলিয়ে হেসে উঠলো। আয়রা বেগম রান্নার ফাঁকে ফাঁকে মেয়ের দিকে তাকালো। পরপর থমথমে কন্ঠে শুধালো,
জ্বর আছে এখনো?

পরী মাথা নেড়ে ‘না’ বুঝালো।
জুলেখা বেগম এগিয়ে এসে পরীর কপালে হাত রাখলো। না এখন জ্বর নেই। জুলেখা বেগম পরীর হাতে দুটো পরোটা আর ডিম পোজ দিয়ে লিভিংরুমে পাঠিয়ে দিলো নিজে আর রিপ্তকে খাওয়ানোর জন্য। পরী ঠিকই ভেবেছিলো আজকের সকালটা অন্যরকম। অন্যরকম সুন্দর ফুরফুরে মেজাজ। হঠাৎ সব কিছু সুন্দর লাগছে। পরীর জীবনটা এমন সুন্দর হলেও তো পারতো। এমন সুন্দর সকাল পরীর জীবনে প্রতিদিন আসুক।

চলবে,,,,,

(ভুলক্রুটি মার্জনীয়)