শ্যামাবতী প্রেয়সী পর্ব-০৮

0
29

#শ্যামাবতী_প্রেয়সী
#পর্বঃ ৮
#জেসমিন_জেমি

গোধূলী বিকেল।
বিকেলের রক্তিম আঁকাশ, সূর্যের লালচে আভা ধরনীর বুকে ছড়িয়ে পড়েছে। নীল রঙা আঁকাশের বুকে সাদা মেঘে ঢাকা পড়া আঁকাশটার রঙ বদলে রক্তিম হয়ে উঠেছে। একটা সুন্দর ঝলমলে সুন্দর দিনের শেষ বেলা। গোলাকার থালার মতো রক্তিম সূর্য পশ্চিম আঁকাশে ঢলে পড়েছে। এইতো আর কিছু সময় পরেই ধরনীর বুকে অন্ধকার নেমে আসবে। পাখিদের কিচিরমিচির শব্দ ভেসে আসছে দূর থেকে। সন্ধ্যের এক ঝাক পাখিরা উড়ে যাচ্ছে তার গন্তব্যে। এই সময়টা ভীষণ শান্তির। প্রকৃতির এই ভীষন উপভোগ্য বৈচিত্র্যময় আয়োজন মানুষের মনে এক অদ্ভুত মানসিক শান্তি এনে দেয়।

পরী নিজের রুমের বেলকনিতে দাঁড়িয়ে হতবাক নজরে বাইরে তাকিয়ে আছে । কি হচ্ছে এসব? হঠাৎ করে কি হচ্ছে তার সাথে? এমন উদ্ভব কাহিনী গুলো তার সাথেই কেনো ঘটছে? তার সুন্দর দিনের সূচনার শেষে যে এমন অদ্ভুত ঘটনা ঘটবে কে জানে?
প্রায় পাঁচ মিনিট পরেই সেখানে হাজির হলো খাদিজা বেগম আর জুলেখা বেগম।
শিকদার মহল গমগম করছে। নিচ থেকে ভেসে আসছে শোরগোল। উহু কোনো ঝামেলার নয়। এই শোরগোল শিকদার মহলে মানুষের উপস্থিতি জানান দিচ্ছে। পরী নিজের রুমে কারো উপস্থিতি টের পেয়ে বেলকনিতে থেকে রুমে ফিরলো। খাদিজা বেগম , জুলেখা বেগম হেঁসে এগিয়ে এলো। তাদের দুজনের হাতে শাড়ী গহনা। পরী হিতাহিত জ্ঞান শূন্য হয়ে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে রইলো। নিচ থেকে জুলেখা বেগমের ডাক পড়তেই জুলেখা বেগম গহনার বক্স পরীর মামির হাতে দিয়ে ব্যস্তকন্ঠে বললো,

আপা মেয়েটাকে তৈরি করুন তারাতারি দেড়ি হয়ে যাচ্ছে।

বলেই নিচে ছুটলো তখনি দরজা ঠেলে তড়িঘড়ি করে রুমে ঢুকলো রিপ্তী, আমিরা পরীর (মামাতো বোন)। দুজনের পড়নে মেরুন রঙের জর্জেট থ্রী পিস। রিপ্তী এসেই জড়িয়ে নিলো পরীকে।

আচ্ছা পরী কী ব্লাঙ্ক হয়ে গেছে? সে কি কিছু বুঝতে পারছে না? পরীর মাথা কাজ করা কি বন্ধ করে দিয়েছে? না হলে সে কথা কেনো বলতে পারছে না।

পরী অবাককন্ঠে শুধালো,
মামি মা? এসব? এসব কি হচ্ছে?

খাদিজা বেগম এগিয়ে এসে বিছানায় শাড়ী গহনা রেখে মুচকি হাসলো। ছোট দেহের মেয়েটাকে টেনে বিছানায় বসিয়ে বিস্ময়ে ভরা মুখশ্রীর ফুলোফুলো গাল দুটো চেঁপে বললো,

আমাদের পরীর রাজপুত্রের সাথে বিয়ে হচ্ছে।

পরীর ঘন কালো পাপড়িযুক্ত চোখজোড়া গোলাকার রুপ নিলো। রাজপূত্র? হ্যাঁ এহতিশাম রাজপূত্রের থেকে কোনো অংশে কম নয় কিন্তু এই রাজপূত্রের পাঁশে এই শ্যামবর্ণের পরী যে বড় বেমানান।

রিপ্তী পরীর পাঁশে বসে উত্তেজিত কন্ঠে বললো,

পরী আপা এহতিশাম ভাইয়ার সাথে তুমিও কানাডা চলে যাবে? মেহতাব ভাইয়া বলেছে এহতিশাম ভাই বাংলাদেশে আর সপ্তাহখানেক আছে তারপর আবার কানাডা ব্যাক করবে। তুমিও কি চলে যাবে?

পরী মাথা ভনভন করছে। কিসের বিয়ে? কোথায় যাবে? রিপ্তী পরীকে জড়িয়ে ধরে ধীরকন্ঠে বললো,

– তুমি কোথাও যাবে না তুমি আমাদের সাথেই থাকবে।

আমিরা রিপ্তীর মাথায় গাট্টা মেরে ভ্রু কুঁচকে বললো,
এই বুদ্ধু ভাইয়া বিয়ে করবে বউ বাংলাদেশে ফালাই রাখার জন্য?

পরী বোকা বোকা চাহনীতে ওদের কথা শুনে যাচ্ছে। বিয়ে? সাদাবিলাই ? এই এক রাতের মাঝে এতো কিছু ? দুপুরে পরীকে জানানো হলো আজ তার বিয়ে তাও এহতিশামের সাথে। ঘরোয়া ভাবে তাদের বিয়ের আয়োজন হবে। পরী যেনো আঁকাশ থেকে পড়লো। ওই সাদা বিলাই? হঠাৎ করে এসব কি হচ্ছে? লোকটার মাথা কি ঠিক আছে? এভাবে পাগলামির মানে কি? আর ওই লোকটার সাথে সাথে কি বাড়ীর লোকদের ও মাথা খারাপ হয়েছে? পরী দুপুরের পর থেকে এহতিশাম আর মেহতাবের খোঁজ করলো কিন্তু দুজনের কাউকে পেলো না। তার যে এহতিশামকে খুব দরকার। এহতিশামের সাথে কথা বলার দরকার? কাল জ্বরের ঘোরে লোকটাকে ঠিক কি কি বলেছে তা পরীর সম্পূর্ণ মনে থাকলেও এটুকু মনে আছে সে লোকটাকে বলেছিলো,
আপনি আমায় বিয়ে করবেন?

আচ্ছা লোকটা কি পরীর এই একটা কথায় পরীকে বিয়ে করতে চাইছে? লজ্জায় পরীর ইচ্ছে করছে হাওয়ায় মিলিয়ে যেতে, নাহলে পরীদের মতো পরীর ও দুটো ডানা হোক সে উড়ে যাক এসব ছেড়ে। পরীর কথা বাড়ীর কেউ শুনলো না কেউ না। পরীর রুমে আয়রা বেগম আসলে পরী মায়ের কাছে গেলো অনেক কথা বললো তবে আয়রা বেগম আজ মেয়ের উপর রাগলেন না। শুধু মায়াভরা চোখে শ্যামবর্ণ গোলগাল গঠনের মুখশ্রীর দিকে চেয়ে রইলো। হুট করে মেয়েকে বুকে জড়িয়ে নিলেন। পরীর কি হলো কে জানে? কতদিন পর মাকে জড়িয়ে ধরলো৷ খুশীতে মন নেচে উঠলো। আপাতত সে সব ভূলে গেলো। বিয়ে, এহতিশাম সব সব সব। আয়রা বেগম মেয়ের মাথায় শব্দ করে চুমু আঁকলো পরী পরম আবেশে চোখ বুঝলো। চোখের কোনে অশ্রু কনারা ভীর জমালো। নিস্তেজ হয়ে মায়ের বুকে পরে রইলো। শান্তি মায়ের বুকে অদ্ভুত শান্তি! পরীর ইচ্ছে করছে এভাবেই মায়ের বুকে সারাজীবন কেটে যাক। সময় এখানে থমকে যাক। বেশ কিছুক্ষণ পর আয়রা বেগম মেয়েকে ছেড়ে কিছু না বলে রুম থেকে ব্যস্ত পায়ে চলে গেলো ৷ আয়রা বেগম সম্ভবত পালালো। নিজের চোখের জল মেয়ের আড়াল করার জন্য এভাবে ছুটে পালানো।

মাহদুল শিকদার পরীকে তৈরি করার জন্য তাগাদা করলো আমিরা, রিপ্তী ও খাদিজা বেগমের সাথে সাহায্য করলো।

———-

ঘড়িতে রাত ৮ টা।
লিভিংরুমে সোফায় পরীকে ঘোমটা টেনে বসানো হয়েছে। চারপাঁশে ওদেরকে ঘিরে লোকজনের আনাগোনা। পরীর পড়নে খয়েরী রঙের শাড়ী। যার পাড়ে সোনালি রঙের রেশমী সুতার কারুকার্যময় কাজ। শাড়ীর আঁচল টেনেই মাথায় ঘোমটা টানা। সোজা কালো লম্বা চুলগুলো খোঁপা করা। গলায় সোনার সিম্পল হার। চোখে হালকা কাজল। এক স্নিগ্ধ মুখশ্রী, সব মিলিয়ে এক অপূর্ব সৌন্দর্য ফুটে উঠেছে।
যে সৌন্দর্য সবার চোখে না পড়লেও একজন প্রেমিক পুরুষের ঘুম কেড়ে নেওয়ার মতো।

ঘরোয়া অনুষ্ঠান হলেও বেশ লোকের আনাগোনা শিকদার মহলে। ঘরোয়া বললেই কি আর ঘরোয়া হয়? শিকদার বাড়ীর বড় মেয়ের বিয়ে বলে কথা। পরীর ফুফু সাইদা বেগমও বিয়েতে উপস্থিত শুধু তার বাড়ীর লোকজন আর সাদিয়া বেগম নেই আর বাকি সকল আত্মীয় শিকদার মহলে উপস্থিত। পরীর ঠিক পাঁশেই এক সুঠাম, লম্বা চওড়া মসৃণ দেহের পুরুষ বসা। পরী আড়চোখে দেখলো। এহতিশামের পড়নে সাদা পান্জাবি, মাথায় টুপি। হাতে ব্লাক অ্যান্ড্রয়েড ওয়াচ। লোকটা সোজা হয়ে বসে আছে। এহতিশামের পাঁশে ছোট দেহ গড়নের পরীকে বোধহয় পিঁপড়া লাগছে। শিকদার বাড়ীর তিন কর্তা আর মেহতাব সামনের সোফায় বসা। মেহতাব কাজি সাহেবকে তাগাদা দিয়ে বললো,
কাজি সাহেব শুরু করুন তাহলে।

কাজি সাহেব হাসলো পরপর বিয়ের কাজ শুরু করলো। পরীকে যখন কাজি সাহেব পরপর তিনবার বলল,
বলুন কবুল।

পরীর কানে যেনো কোনো কথা ঢুকলো না। এভাবেও বিয়ে হয়? কি জানি পরীর কি হলো হঠাৎ করে পরীর কান্না পাচ্ছে। পরীর চোখ দুটো ছলছল করে উঠলো৷ কান্নায় সারা শরীর হালকা ঝাঁকিয়ে উঠলো। ভয়ে কিছুটা কুঁকড়ে গেলো, নাভার্স হয়ে পড়লো । ছোট দেহখানা তিরতির করে কাঁপছে। লিভিংরুমে পিনপিন নিরবতা বিরাজ করছে। সবাই অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে। পরী নিজের হাত দুটো নিজে মোচরাচ্ছে। এমন সময় নিজের পাঁশে কারো উপস্থিতি টের পেলো। মেহতাব ঠিক পরীর পাঁশে এসে দাড়িয়েছে। মেহতাবের পড়নে অলিভ গ্রীন শার্ট, ব্লাক জিন্স। মেহতাব পরীর মাথায় হাত রাখলো। রিপ্ত, রিপ্তী, পরী ওরা সবাই মেহতাবের খুব আদরের। মেহতাবের ভরসার হাত মাথায় পেয়ে পরী ঠান্ডা হলো। হঠাৎ নিজ হাতে পুরুষালি হাতের স্পর্শ পেয়ে পাঁশে তাকাতেই দেখলো এহতিশাম পরীর হাত নিজ হাতের মুঠোয় পুড়ে নিয়েছে । পরী বিস্ময়ে হতবাক চোখে মুঠোবন্দি হাতের দিকে দেখলো। কাজি সাহেব আবারো বললো কবুল বলতে মেহতাব ধীরকন্ঠে বললো,

-পরী।

পরি বেশ সময় নিয়ে ধীরকন্ঠে কবুল বললো। সবাই উচ্চস্বরে বলে উঠলো,
আলহামদুলিল্লাহ।
এহতিশামকে কবুল বলার সাথে সাথে শোনা গেলো এক গরুগম্ভির কন্ঠস্বর যে কোনো রকম সময় নষ্ট না করেই কবুল বলে ফেললো। নিরবতায় ছেয়ে যাওয়া শিকদার মহলে নেমে আসলো খুশির আমেজ। মাহদুল শিকদার, মাহমুদ শিকদার মেহতাবকে নিয়ে উঠে চলে গেলেন দূরে। সবাই নববধূ আর বরকে রেখে সরে গেলো। পরী এখনো আগের অবস্থায় বসে আছে। শুধু মাথার ঘোমটাটা হালকা সরানো হয়েছে। পরীর হাত এখনো এহতিশামের হাতে বন্দি। পরী নড়েচড়ে হাত সরাতে চাইলেই এহতিশাম হালকা ঝুঁকে ফিসফিস করে বললো,
হুসস, ছাড়ার জন্য আপনার হাত ধরেনি মিসেস আয়াশ।

পরী ঘোমটার আড়ালে ফটিক চাইলো। এই কন্ঠস্বর কেমন যেনো চেনা লাগলো। কোথায় শুনেছে? ছাঁদে? হ্যাঁ ছাদে শুনেছিলো। তাহলে সেদিন কি এহতিশামই ছাঁদে ছিলো? শাড়ীগুলো কি উনিই পাঠিয়েছিলো? কিন্তু উনি কিভাবে পাঠাবে? কেনো পাঠাবে? নাহ পরী আর ভাবতে পারলো না। মেহতাব এসে এহতিশামকে ডাকলো এহতিশাম পরীর দিকে তাকিয়ে বাঁকা হেঁসে ধীরকন্ঠে বললো,
মিসেস আঁয়াশ বিদায়ের জন্য তৈরি হোন।

পরী এহতিশামের কথার আগা মাথা বুঝলো না। ড্যাবড্যাব করে সেদিকে তাকিয়ে রইলো। এহতিশাম পান্জাবি ঠিক করতে করতে বললো,
অ্যাই আপনি কান্না করতে পারবেন তো? চোখে জল আছে তো? নাকি এতো গুলো দিন কেঁদে শেষ করে ফেলেছেন? বিদায় বেলায় কান্না না করলে বিয়ে করে নতুন বউ নিয়ে যাচ্ছি ফিল পাবো না।

পরী কাজল লেপ্টানো চোখে হা করে তাকিয়ে রইলো। এটা কে এহতিশাম? ওই সাদা বিলাইটা? এ লোকটা এমন ব্যবহার করছে কেনো? লোকটা কি পা*গল হয়ে গেছে? নাকি পরী এসব স্বপ্ন দেখছে। সবটা স্বপ্ন! হ্যাঁ স্বপ্নই হবে হয়তো। না হলে এভাবে বিয়ে হয় কখনো? পরীর ভাবনার মাঝে রিপ্তী আর আমিরা এসে পরীর দুপাঁশে বসে পরলো। আমিরা বলে উঠলো,
পরি আপা দুলাভাই কত সুন্দর!
আমিরা ফট করে বললো,
জানো আমার এক বান্ধবি বলেছে কালো মেয়েরা সুন্দর জামাই পায়।
তাই তুমিও সুন্দর জামাই পেলে রিপ্তী আমিরার গালে থাপ্পড় বসিয়ে বলে উঠলো,
এই আমার পরী আপা কি কম সুন্দর?

আমিরা থতমত খেয়ে বললো,
সুন্দর তবে এহছান ভাই বেশি সুন্দর।

রিপ্তীর কপালে ভাজ পড়লো। রিপ্তীর মন চাচ্ছে আমিরার গালে ঠাস করে চড় বসাতে তবে সে সেটা করবে না বাড়ীতে অনেক মানুষ। রিপ্তী আমিরার মাথায় মৃদু থাপ্পর মেরে বললো,
অমুর্খ এহছান না এহতিশাম। নামটাও বলতে পারিস না।

আমিরা চটে উঠলো,
কি বললি অমুর্খ? আমি অমূর্খ?

রিপ্তী ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে বললো,
হ।

আমিরা কপাল কুঁচকে বললো,
আমি অমুর্খ? কদিন বাদে অনার্স এডমিশন নেবো আমি অমূর্খ?

রিপ্তী থমথমে কন্ঠে বললো,
এরজন্যই তো বলি তুই একটা গাধা। তুই আসলেই গাধা। অমুর্খ বলেছি মুর্খ বলনি।

দুজনের মাঝে লেগে গেলো তর্কাতর্কি। এই দুজন এমনই। খুব ভালো বান্ধবী অথচ দেখো কথায় কথায় এরা ঝগড়ায় চলে যায়। খাদিজা বেগম এখানে এসে দুজনকে ঝগড়া করতে দেখে মেয়ের কান চেপে ধরলো,
তোদেরকে কি বললাম? আর তোরা কি করছিস?

আমিরা, রিপ্তী দুজনই ফটিক জিব কাটলো। তড়িঘড়ি করে পরীকে রুমে নিয়ে গেলো ।

চলবে??

( ভুলক্রুটি মার্জনীয়। আজকের পর্বটা ভীষণ অগোছালো হয়েছে )