শ্যামাবতী প্রেয়সী পর্ব-০৯

0
32

#শ্যামাবতী_প্রেয়সী
#পর্বঃ ৯
#জেসমিন_জেমি

রাত তখন প্রায় ১০ টা। ব্যস্ত রাস্তায় শো শো শব্দ করে ল্যামপোস্টের আবছা আলোয় রাস্তার দুপাঁশে লম্বা লম্বা গাছ গুলোকে পেছনে ফেলে ছুটে চলেছে পরীদের গাড়ী। ল্যাম্পপোস্ট থেকে ফিকে আলো পড়ছে চারপাঁশে । গাড়ী পিনপিন নিরবতায় ঘেরা। পরী কাচুমাচু হয়ে এহতিশামের থেকে বেশ দূরত্ব রেখে বসে আছে। কান্না করায় চোখে মুখ ফুলে গেছে। জীবন বরই অদ্ভুত! কখন কার জন্য কি অপেক্ষা করছে কেউ জানে না,কেউ না। পরী কি জানতো কিছুদিনের পরিচিত মানুষটার সাথে তার জীবন জুড়ে যাবে? লোকটাকে কতটুকুই চিনে পরী? পাঁশে বসা অচেনা অজানা এক পুরুষ অথচ কিছু মুহুর্ত আগে লোকটার নামে নিজেকে দলিল করে দিয়েছে । মাত্র কদিনে কত কিছুই না সহ্য করতে হলো পরীকে রিজভীর থেকে প্রতারণা। প্রতারণা? এটাকে প্রতারণা বলে? হ্যাঁ এটা প্রতরণাই হবে বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়ে বিয়ে না করে অন্য একজনকে বিয়ে করা প্রতারণা না হলে কি হবে? আনানের মতো অসভ্য ইতর লোকের মুখে বিশ্রী ভাষায় গালিগালাজ সহ্য করা। এই সম্পূর্ণ অচেনা মানুষটাকে বিয়ে করা। পরীর মাথা ভার ভার লাগছে গাড়ী ছুটে চলেছে নিজ গন্তব্যে। কে জানে কোথায় যাচ্ছে এই গাড়ী। পরী কিছু জানে না কিছু না শুধু পাঁশে বসা লোকটার উপর ভরসা করে শিকদার মহল থেকে বের হয়ে আসা। পরী নিজ মনে আওড়ালো,
– ভরসা? লোকটাকে ভরসা করা যায়? ভরসা করার মতো কতটুকুই বা চিনিস লোকটাকে?

পরী সাথে সাথে ঠোট চেঁপে ধরলো ঘুম জড়ানো চোখ বুঁজে আওড়ালো,

লোকটা তাকে কেনো বিয়ে করলো? লোকটা তো পরীর মতো এমন কালো, আনস্মার্ট মেয়ে ডিজার্ব করে না। লোকটার পাঁশে পরী বেমানান।
পরীর যে লজ্জা করছে । কখনো যদি লোকটাও রিজভীর মতো বলে উঠে
– তোমার মতো মেয়ে আমার পাঁশে মানায় না পরী।

অথচ বোকা পরীর জানলই না পাঁশে বসা এই পুরুষটা তাকে কতটা ভালোবাসে।
পরীকে নিজের করে পাওয়ার জন্য এই কয়েকটা দিন কি কি না করেছে। হায় এই নির্বোধ বালিকা কিছুই জানে না, কিছু না।

নিজের এই ছোট্ট জীবনে কয়েকদিনে ঘটে যাওয়া কাহিনীর হিসাব মেলাতে মেলাতে মাথা ভার হয়ে উঠেছে। পরীর চোখে মুখে ক্লান্তির ছাপ স্পষ্ট। ক্লান্তিতে চোখ বুঁজে আসছে। চোখ মেলে রাখা দায় হয়ে উঠেছে। সিট এ হেলান দিয়ে মুহুর্তেই ঘুমে তলিয়ে গেলো। পুরুষালী হাতের স্পর্শে পরী ঘুমঘুম চোখে আবছা আলোয় পাঁশের সিটে বসা এহতিশামের দিকে তাকালো লোকটার গায়ে এখনো সেই পান্জাবি জড়ানো, পরীর গায়েও তখনকার সেই শাড়ী। বাইরের ল্যামপোস্টের আলোয় ফর্সা মুখশ্রীর অবয়ব স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। এহতিশাম পরীর মাথা টেনে নিজের কাঁধে রাখলো। কাঁধ একটু নিঁচু করে পরীর জন্য আরামদায়ক করলো । পরী আরাম পেয়ে পাঁশে বসা সুঠামদেহি পুরুষের বাহু দু হাতে চেঁপে ধরলো।
এহতিশাম অন্ধকারে তার প্রাণকে দেখলো। ঠোটের কোনো মিষ্টি হাসি ফুটে উঠলো মুহুর্তেই । সিটের পাঁশে থাকা জ্যাকেট পরীর শরীরে জড়িয়ে দিলো। পরী চোখে মুখে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা অবাধ্য এলোমেলো চুল গুলো গুছিয়ে দিয়ে ফিসফিস করে বললো,

– প্রিয় প্রাণ,
অবশেষে তুমি আমার ।

এহতিশাম হালকা ঝুঁকলো পরীর কপালে ঠোঁট ছোঁয়ালো পূনরায় ফিসফিস করে বললো,

-শুনো শ্যামবতী প্রেয়সী,
তুমি শুধু আর শুধু এই এহতিশাম আঁয়াশের।

পরী নড়েচড়ে উঠলো এহতিশামের শরীর ঘেঁষতেই এহতিশাম বাঁকা হাসলো- বললো,

-মিসেস আয়াশ এহতিশাম ব্যতীত অন্য কাউকে কথা শেষ করলো না পূনরায় বললো,
হুসসসস মে*রে দিবো একদম।

পরী কি এসব শুনলো? সে তো ঘুমের রাজ্যে তলিয়েছে । অথচ একজোড়া প্রেমিক চোখ ল্যাম্পপোস্টের ঘোলাটে আলোয় তার ঘুমন্ত শ্যামাবতীকে দেখতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো।

————-★———–
শিকদার মহল এবার ফাঁকা বললেই চলে ।
বাড়ীর তিনকর্তা সোফায় বসা। জুলেখা বেগম আয়রা বেগম সাইদা বেগমকে ধরে দাঁড়িয়ে আছে। শিকদার বাড়ীর তিন কর্তা অবাক চোখে মেহতাবের দিকে তাকিয়ে আছে। সাইদা বেগম কাঁদছে। মেহতাব উঠে এসে ফুফুর চোখের পানি মুছে দিয়ে থমথমে কন্ঠে বললো,
শান্ত হও ফুফু।

সাইদা বেগম মেহতাবকে জড়িয়ে এবার শব্দ করে কেঁদে উঠলো। কান্না গলায় বললো,
আমি, আমি এসব কিছু জানি না মেহতাব।

মাহদুল শিকদার হুংকার দিয়ে উঠলো,
আমাদের মেয়ের দিকে হাত বাড়ালে হাত কে*টে ফেলবো।

মেহতাব থমথমে কন্ঠে বললো,
বাবা সবটা আমি সামলে নিবো।

মাহমুদ শিকদার কৃতজ্ঞতা স্বরে বললো,
তুই না থাকলে কি হতো বাবা?

মেহতাব – সব এহতিশামের সামলে নিয়েছে চাচা ।

মাহমুদ শিকদার বললো,
পরীর কোনো বিপদ হবে না তো ? এহতিশাম কি সবটা সামলাতে পারবে?

মেহতাব – এহতিশাম সবটা সামলে নিবে।
ধীরকন্ঠে বললো,
এহতিশাম থাকতে পরীকে কোনো বিপদ ছুঁতে পারবে না চাচা ।

———
মেহতাব রুমে ঢুকলো রাত ১২ টায়। ফ্রেশ হয়ে বেলকনিতে গিয়ে কেবলই অনলাইন হয়েছে। ফোনের স্ক্রিনে বড় বড় অক্ষরে ভেসে উঠলো আমাইশা নাম সাথে ২০ মিসড কল। স্ক্রিনে তাকিয়ে মেহতাব ভ্রু কুঁচকালো তখনি টুংটাং আওয়াজে ফোন বেঁজে উঠলো। মেহতাব কপাল কুঁচকে ফোন রিসিভ করলো। ফোন কানে চেঁপে ধরতেই অপাঁশ থেকে ভেসে আসলো মেয়েলী কন্ঠস্বর –
কোথায় ছিলেন? ভালো আছেন?

মেহতাব ছোট করে বললো,
হুম।

আমাইশা দীর্ঘশ্বাস ফেললো পূনরায় বলল,
আঁয়াশ ভাইয়া কোথায়?

মেহতাব থমথমে কন্ঠে বললো,
যেখানে থাকার কথা।

আমাইশা বললো,
ভাইয়া পা*গ*ল হয়েছে? এসব কি রকম পা*গ*লামি? এখানে কি হচ্ছে সেটা কি একবারও ভেবেছে? এমন পা*গ*লামির মানে কি?
আমার, বাবার কারো ফোন তুলছে না। কবে ফিরবে ভাইয়া? যত দ্রুত সম্ভব ফিরতে বলুন প্লিজ।

মেহতাব চুপ রইলো আমাইশা আবারো বললো,
মেহতাব কাইন্ডলি অফিসের মেইলটা চেক করতে বলুন ভাইয়াকে।

মেহতাব থমথমে কন্ঠে বললো,
ওকে আমি দেখছি।

আমাইশা ধীরকন্ঠে ডাকলো,
মেহতাব।

মেহতাব ধীরকন্ঠে বললো,
হু।

আমাইশা বললো,
যতদ্রুত সম্ভব কানাডা ব্যাক করুন প্লিজ।

মেহতাব বললো,
হুম।

মেহতাবের রুম বাড়ীর সামনের দিকটায় হওয়ায় বেলকনিতে দাঁড়ালেই বাড়ীর গেট পর্যন্ত দেখা যায়। মেহতাব কথা বলতে বলতে নিচে তাকাতেই দেখলো কেউ একজন দৌড়ে বাড়ীতে ঢুকছে। মেহতাব ভ্রু কুঁচকে সেদিকে তাকিয়ে রইলো। অপাঁশ থেকে আমাইশা হ্যালো হ্যালো বলে যাচ্ছে মেহতাব ফোন সড়িয়ে বললো,
পরে কথা বলছি।

আমাইশা বোধহয় ডাকলো মেহতাব শুনলো না ফোন পকেটে পুড়ে আবারে নিচে তাকালো পরপর আবারও কেউ বাগানের দিকে গেলো। বাড়ীর সবাই এখন যার যার রুমে মেইনগেট বন্ধ হয়েছে অনেক আগেই। কে এভাবে দৌড়াদৌড়ি করছে? তখনকার সেই লোকগুলো না তো? মেহতাব গায়ে শার্ট জড়িয়ে দ্রুত রুম থেকে বের হলো।

——-
আমিরা রিপ্তী এই রাত দুপুরে ট্রুথ ডেয়ার খেলছিলো । এই রাতে আমিরার ডেয়ার হচ্ছে বাগান থেকে গোলাপ ছিঁড়ে রিপ্তীর চুলে গুঁজে দিতে হবে। আমিরা নাক-মুখ কুঁচকে বলেছিলো,
কি রে ভাই আমি কি তোর বিয়ে করা জামাই? এমন রোমান্টিক ডেয়ার দিচ্ছিস কেনো? এসব তো জামাইদের কাজ।

রিপ্তী মানতে নারাজ অগত্যা আমিরাকে ছুটতে হলো বাগানে। একবার গোলাপ নিয়ে ছুটতে গিয়ে সবগুলো পাপড়ি ঝরে পড়লো আমিরা মুখভার করে আবারও বাগানে গিয়ে গোলাপ চারার সামনে এসে দাঁড়ালো মুখভার করে ধীরকন্ঠে বললো,
মাফ করে দাও গাছ ভাই রাতের বেলা ফুল ছিড়তে হয় না কিন্তু কি করবো বলো? এক পেত্নী আমাকে জোড় করে পাঠিয়েছে।

পরপর কানে ধরে দুবার উঠবস করে বললো,
দেখো দেখো কানে ধরেছি ভূল করছি মাফ করে দিয়ো বুঝছো? অভিশাপ দিয়ো না যেনো নাহলে আবার আমার বিয়ে হবে না।

গোলাপ ছিঁড়ে বাগান থেকে বের হবে তখনই কেউ ওর মুখ চেঁপে ধরলো, হাত দুটোও কেউ নিজের হাতে বন্দি করলো। ভয়ে গলা শুঁকিয়ে উঠলো। চোখ দুটো বড় বড় করে উম উম শব্দ করে উঠলো। মেহতাব শক্তকন্ঠে বললো,
কে তুমি?

আমিরা মেহরাবের কন্ঠস্বরে আবারও উম উম শব্দ করলো। মেহতাব মুখ থেকে হাত সরাতেই আমিরা কাঁপাকাঁপা গলায় বললো,
আমি, আমি আমিরা।
মেহতাব সাথে সাথে মেয়েটাকে ছেড়ে দিলো। আমির ধপ করে মাটিতে গিয়ে পড়লো। অস্ফুটস্বরে বললো,
আল্লাহ গো কোমড়টা গেলো।

মেহতাব রাগীস্বরে বললো,
এতো রাতে বাগানে কি করছো?

আমিরা কোমড়ে হাতে চেঁপে কোনো রকম দাঁড়িয়ে বললো,
ফু,ফুল নিতে এসেছিলাম ।

মেহতাব রেগে মেয়েটার হাত শক্ত করে চেঁপে ধরে সন্দেহের স্বরে বললো
– মিথ্যে বলার জায়গা পাওনা?
কি করতে এসেছিলে? কি করতে চাইছো?

আমিরা পারে না তো এবার কেঁদেই দেয়। হাতের ব্যথায় কুকড়ে উঠে বললো,
ছাড়ুন ব্যথা পাচ্ছি।

মেহতাব ছাড়লো না আরো শক্ত করে চেপে ধরলো। বললো,
বলো। বলো বলছি মেয়ে।

আমিরা – সত্যি বলছি ফুল নিতে এসেছিলাম। হাত ছাড়ুন প্লিজ ব্যাথা পাচ্ছি।

চোখে মুখে লাইটের আলো পড়তেই ছিটকে সরে গেলো মেহতাব। রিপ্তী দ্রুত এগিয়ে এসে তুতলানো কন্ঠে বললো,
ভাইয়া তুমি?

মেহতাব এখনো তীক্ষ্ণ চোখে আমিরার দিকে তাকিয়ে আছে। রিপ্তী আমিরাকে বললো,
কিরে একটা ফুল নিতে এতোক্ষন লাগে?

মেহতাব ভ্রু কুঁচকালো । মেয়েটা তাহলে সত্যি বলছিলো এতোক্ষন? মেহতাব তো মেয়েটাকে ভুল বুঝলো। মেহতাব ধমকে উঠে বললো,
এতো রাতে ফুল দিয়ে কি হয়?

রিপ্তী চিবুক গিলে বলল,
দরকার ছিল ভাইয়া।

মেহতাব থমথমে কন্ঠে বললো,
রুমে যা। এতো রাতে আবার বাগানে দেখলে,,

রিপ্তী আমিরাকে টেনে দ্রুত পায়ে বাড়ীর দিকে গেলো। মেহতাব লাইটের আলোয় দেখলো এক ফর্সা মুখশ্রী যার নাক মুখ লাল বর্ণ ধারণ করেছে ইতিমধ্যে। মেয়েটা কেঁদে দিবে দিবে ভাব। মেহতাব ওই লাল হয়ে যাওয়া মুখের দিকে তাকিয়ে দ্রুত গতিতে চোখ ফিরালো। নিজে নিজেই বলে উঠলো,
ড্যাম ইট।

চলবে,,,,,,,,

ভুলক্রুটি মার্জনীয়