শ্যামারণ্য পর্ব-১১

0
698

#শ্যামারণ্য
#পর্বঃ১১
লেখনীতেঃ #ফাহমিদা_মেহেজাবীন

ট্রেন থেকে নেমে স্টেশনে অপেক্ষারত সামশেরকে দেখে অবাক হয়ে যায় শ্যামা। ওই লোক তাহলে তার মেসেজ দেখেছে? তাহলে একবার ফোন করলোনা যে?

সামশের তাকে দেখে তার দিকে এগিয়ে এসে তার ব্যাগ হাতে তুলে নিলো,তাকে মানা করার পরও সে শুনলোনা। শ্যামা এই লোককে যত দেখে ততো অবাক হয়। এই বয়সেও কতটা শক্ত এই বুড়োটি।

শ্যামা গাড়ি চলা শুরু করলে সামশের কে প্রশ্ন করে,”আপনাকে কি আপনার মনিব পাঠিয়েছেন?”

“জ্বি মালকিন”

মালকিন সম্বোধন শুনে কাশি চলে আসে শ্যামার,কোনোমতে সে জিজ্ঞেস করে,
“মালকিন?আপনি হঠাৎ আমাকে মালকিন ডাকছেন কেনো?”

“মনিব বলেছে,আপনি ফিরে আসার পর থেকে আপনাকে যেনো মালকিন ডাকি”

মানুষটির আধিখ্যেতার কথা শুনে চোখ মুখ কুঁচকে বলে শ্যামা,” মালকিন ডাকটা শুনতে কেমন যেনো,আপনি আমাকে আগের মতো ম্যাডাম বলেই ডাকবেন”

“আমি তা করতে পারিনা মালকিন। মনিবের হুকুম পালন করা আমার কর্তব্য”

বিরক্তিতে চোখ বন্ধ হয়ে আসে শ্যামার,সে তো ভুলেই গিয়েছিলো,এই বুড়োর চরম মনিবভক্তি রয়েছে।
“আচ্ছা যাক সে কথা। আপনার মনিব আমার ফোন ধরেননি কেনো?আর আমার মেসেজ পড়ে কল বেক করেননি কেনো?”

কিছুক্ষণ নীরবতার পর সামশের জবাব দেয়,”মনিব প্রতিদিন দিনের বেলা ব্যস্ত থাকেন। তাই তিনি কারো সাথে কথা বলতে পারেন না।”

“ওহহহ আচ্ছা…” এই বলে শ্যামা গাড়ির জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকে। এই গ্রামটি প্রচুর সুন্দর।
নির্জনা কুঠি লোকালয় হতে অনেকটা দূরে হওয়ার এখনো ভালো করে ঘুরে দেখা হয়নি গ্রামটি। সে মনে মনে ঠিক করলো একদিন গ্রামটা ভালোভাবে ঘুরে দেখবে।

একসময় গাড়ি নির্জনা কুঠির গেইটে পৌছায়।
দূর থেকে সেই পুরোনো দোতলাবিশিষ্ট বিশাল বাড়িটির দিকে তাকিয়ে শ্যামার মনে পড়ে যায়,কেমন গা ছমছমে অনুভূতি হয়েছিলো তার এখানে যখন প্রথম এসেছিলো।
কিন্তু আজ তার একদম ভয় লাগছেনা। এমন অনুভূতি হচ্ছে যেনো সে তার আসল ঠিকানায় ফিরে এসেছে।
অবশ্য সেই ভাবনাটি অতটা ভুল ও নয়, কারণ আজ থেকে এই বাড়িই হতে চলেছে তার ঠিকানা।

বাড়ির সিড়ি মাড়িয়ে মূল দড়জার সামনে গিয়ে পৌছায় শ্যামা,সামশের গাড়ি থেকে ব্যাগ গুলো বের করছে তখন।
শ্যামা দড়জার সামনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিলো,তখনি হুট করে দড়জাটি খুলে যায়।
হঠাৎ দড়জাটি এভাবে আপনা আপনি খুলে যেতে দেখে আঁতকে উঠে শ্যামা।
এবার দরজার ফাঁক গলে উঁকি দেয় একটি বাচ্চা মেয়ে।
বয়স ১৪ কি ১৫ হবে,মেয়েটি তাকে দেখেই খিলখিল করে হেসে ফেলে।

“মালকিন ডরাইছে….মালকিন ডারাইছে!” এই বলে হাত তালি দিতে দিতে হাসতে থাকে মেয়েটি।
শ্যামা একটু ধাতস্থ হয়েছে মাত্র, ততক্ষণে সামশেরও ব্যাগ নিয়ে তার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে।

সে মেয়েটিকে উদ্দেশ্যে করে ধমকে উঠে,”ওই মাইয়া! মালকিনের সাথে মশকরা করস,তোর আক্কেল জ্ঞান আছে?”

মেয়েটা সামশের এর ধমক খেয়ে চুপসে যায়,তা দেখে শ্যামা বলে উঠে,
“আহ চাচা,বাচ্চা মানুষ একটু দুষ্টুমি তো করবেই। এখন ওর দুরন্তপনার বয়স। ওকে বকবেন না প্লিজ।”

শ্যামার কথা শুনে মেয়েটির চোখ মুখ খুশিতে চকচক করে উঠে।
সামশের নত স্বরে বলে উঠে,”ভুল মাফ করবেন মালকিন। তবে ওকে বেশি লাই দিতে যাবেন না কিন্তু,দেখবেন তখন আপনাকে মানবেনা।”

“আচ্ছা আচ্ছা তা নাহয় পরের কথা। কিন্তু কে ও? আগেরবার তো দেখলাম না।”

সামশের কিছু বলার আগে মেয়েটিই আগে গদগদ হয়ে বলে,
“আমার নাম রিমঝিম মালকিন,তই সবাই আমারে রিমু বইলা ডাকে। আপনি আমারে কি কইয়া ডাকবেন?”

শ্যামা হেসে ফেলে মেয়েটির পাকা পাকা কথা শুনে। কিন্তু সামশের এদিকে চরম বিরক্তিতে মুখ আধার করে ফেলেছে,
“মালকিন, রিমু এই গ্রামেরই মেয়ে। ওকে কাল থেকেই কাজে রেখেছি। আপনি বাড়িতে একা মেয়ে থাকবেন,আপনি যাতে একাকিত্ব বোধ না করেন তাই মনিব আমাকে কাউকে কাজে রাখতে বলেছেন।
এই রিমু একটু বাচাল হলেও কাজে অনেক পটু,সে আপনাকে কাজে সাহায্য করবে,আপনাকে সঙ্গ দিবে। এজন্যই একে রাখা হয়েছে।”

‘বাহ লোকটি সে আসবে বলে এতো ব্যবস্থা নিয়ে ফেলেছে?তাও সে হ্যাঁ বলার আগেই?’ মনে মনে ভাবে শ্যামা।

সে হেসে রিমুর দিকে তাকিয়ে বললো,”তাহলে আমি তোমাকে রিমঝিম বলেই ডাকবো কেমন? চাচা আপনার মনিবকে বলে দিবেন, আমার এই নতুন সঙ্গীটি অনেক পছন্দ হয়েছে।”
রিমু শ্যামার কথা শুনে লজ্জায় মুখ ঢেকে হেসে ফেলে।

“মালকিন আপনি আপনার ঘরে গিয়ে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিন। আমরা নাহয় এর পরের বিষয়গুলো পরে আলোচনা করবো।
এই রিমু যা,মালকিন কে তার ঘরে নিয়া যা।”

রিমু আদেশ অনুযায়ী শ্যামার ব্যাগ নিয়ে হাঁটা ধরে,শ্যামাও সম্মতিতে মাথা দুলিয়ে তার পিছু নেয়। যেতে যেতে রিমুকে প্রশ্ন করে শ্যামা,
“তা তুমি কি এখন এই বাড়িতেই থাকো?”

“না গো মালকিন,আমি সকাল বেলা আসি,সন্ধ্যার আগে আগে চইলা যাই। আমার মা একা থাহে তো ঘরে।”

“তোমার মা একা থাকে মানে?বাবা নেই তোমার?”

রিমু একটু মন খারাপ করে উত্তর দেয়,”বাজান নতুন বিয়া করার পর বাড়ির থেইকা বাহির কইরা দিছে আমাদের,আমার মা নাকি পোলা দিতে পারেনাই উনারে। তারপর থেইকা মামিগো লা’থি উ’ষ্ঠা খাইয়া নানার বাড়িত পইড়া আছি আমি আর মা। তবে হেরা আমাগো খাইতে পড়তে দিবার চায়না। এই জন্যিই তো যহন সামশের চাচা আমারে এই কাম এর কথা কইছে আমি রাজি হই গেছি। উনি আমারে অনেকগুলান টেহা দিছে। আমার আর মায়ের আর কারো কাছে চাইয়া খাওন লাগবোনা”

এইটুকু বাচ্চা মেয়ের এতো করুণ দশা শুনে শ্যামার অনেক খারাপ লাগে,সে আবার জিজ্ঞেস করে,
“তুমি লেখাপড়া করোনা?স্কুলে যাওনা?”

রিমু হেসে উত্তর দেয়,”আগে যাইতাম, এসব হওনের পর থেইকা আর যাওন হয়নাই। আমি ঠিক করছি পরের বছর আবার ভর্তি হমু ইশকুলে।”

শ্যামা রিমুর মাথায় হাত বুলিয়ে তাকে আশ্বাস দেয়,”তোমার যদি কখনো কোনো কিছু লাগে,নির্দ্বিধায় আমাকে জানাবে,ঠিক আছে?”

রিমু হাসিমুখে মাথা দুলিয়ে সায় দেয়। কথা বলতে বলতে তারা পৌছে যায় তাদের গন্তব্যে।
রিমু তাকে পথ দেখিয়ে দোতলার সেই আগের ঘরেই নিয়ে গেলো যেটাতে সে আগেরবার থেকেছিলো। রুমের ভেতর বিশেষ কোনোকিছু পরিবর্তন হয়নি। শুধু সব তোশক,পর্দা পুরোনো গুলো খুলে নতুন লাগানো হয়েছে।
রিমু তার ব্যাগ গুলো একপাশে রেখে জিজ্ঞেস করে,
“আপনার আর আর কিছু লাগবো মালকিন?”

শ্যামা স্মিত হেসে মাথা দুলিয়ে জানালো তার কিছুই লাগবেনা। রিমু তারপর তাকে রেখে তার কাজে চলে যায়।
শ্যামা হেটে গিয়ে বন্ধ জানালাটি খুলে দাঁড়ায়,একরাশ শীতল হাওয়া তার প্রাণ জুড়িয়ে দেয় মুহুর্তেই,গ্রামের স্নিগ্ধ বাতাসে প্রাণভরে নিঃশ্বাস নেয় সে।
———————-

সামশের তার কক্ষে তার সাথে দেখা করতে আসে সন্ধ্যায়। হাতে তার লাল রঙের একটি বেনারসি,আর একটি গয়নার বাক্স। এগুলো যে তার জন্যই আনা হয়েছে তা দেখেই বোঝা যাচ্ছে। সামশের এর কথা শুনে সে ধারণা আরো স্পষ্ট হলো।

“মনিব বলেছেন আপনাকে এই শাড়ি পড়তে আজকে।”

“শাড়ি চুরি এসব পরে আসবে। আগে আমাকে বলুনতো যে এই বিয়েটা হবে কিভাবে?”

সামশের তার কথার জবাবে একটি কাগজ তার দিকে বাড়িয়ে দেয়। শ্যামা তা হাতে নিয়ে পড়ে পর্যবেক্ষণ করতে থাকে।

মূলত বিয়ের চুক্তি এটি,সেখানে সেই প্রথম দিনের শর্তগুলো কাগজে কলমে উল্লেখ আছে।

শ্যামা একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, “তারমানে পুরোপুরি কাগজি বিয়ে হবে বলছেন?”

সামশের মাথা দুলিয়ে সম্মতি জানিয়ে বলে,”জ্বি মালকিন,মনিব স্বাক্ষর করে দিয়েছেন আগেই,এবার আপনি স্বাক্ষর করলেই এই চুক্তি সম্পন্ন হবে।”

শ্যামা কাগজের নীচের অংশে খেয়াল করলো। সেখানে পাত্রীর স্বাক্ষরের অংশটা খালি, আর পাত্রের অংশে গোটা গোটা অক্ষরে লেখা তার সেই স্বামী নামের মানুষটির নাম,
“অরণ্য তালুকদার”

শ্যামা আনমনেই কয়েকবার উচ্চারণ করে মানুষটির নাম ‘অরণ্য’

অবশেষে সে জানতে পারলো তার সেই অজ্ঞাত ব্যক্তিটির নাম। কিন্তু স্বাক্ষর করার পূর্বেও তার মনে এক অদৃশ্য সংশয় দানা বাধে।
‘তালুকদার? অরণ্য কি তাহলে এই জমিদার বংশের উত্তরসুরী?’

মনের সংশয় মনে রেখে সে একটি স্বাক্ষরের মাধ্যমে অরণ্যের সাথে তার নাম জুড়ে দেয়।
একইসাথে বন্ধ করে দেয় তার অনিশ্চিত ভবিষ্যত থেকে পালিয়ে যাওয়ার সমস্ত পথ।
————————–

সামশের চলে গেছে অনেকক্ষণ হয়ে গেছে,সে জানালার ধারে বসে এক দৃষ্টিতে পুকুরের শান্ত জলের দিকে তাকিয়ে আছে।
ওইদিকের শেষপ্রান্তের ঘরটা থেকে পুকুরটি আরও ভালোভাবে দেখা যায়। অরণ্য কি সেখানে আছে?সেও কি তার মতোই বিচলিত এই মুহুর্তে?

সামশের এর রেখে যাওয়া শাড়ি গয়না এখনো ছুয়েও দেখেনি শ্যামা। অনেক নার্ভাস লাগছে তার।
আজ বিয়ের পর তার আর অরণ্যের প্রথম রাত। কিন্তু ধরতে গেলে পুরোপুরি অজানা একজন তিনি তার কাছে। তার নামটি পর্যন্ত আজকে জানা হয়েছে তার।
তার সান্নিধ্যে আসার সুযোগ একবার হয়েছিলো তার। কিন্তু সেসময় সে নিজেকে নিয়ে এতোটাই মগ্ন ছিলো যে সে কোনো অনুভূতিই টের পায়নি।
তবে পরে যতবার সে ভেবেছে সে অরণ্যের কতটা কাছাকাছি ছিলো,ততোবার লজ্জায় তার মাটির সাথে মিশে যেতে ইচ্ছে করেছে।

আজকে কি অরণ্য অন্য সকল বিবাহিত পুরুষদের মতো স্বামীর অধিকার আদায় করতে চাইবে তার কাছে?
এটা ভাবতে ভাবতে সে এতোটাই নার্ভাস হয়ে আছে যে সে আর কোনোকিছুই ভাবতে পারছেনা।

সামশের রাতের খাবারের জন্য ডাকতে আসলে তাকেও মানা করে দেয়। সামশের শত চেষ্টা করেও তাকে মানাতে না পেরে ব্যথিত মনে চলে যায় সেখান থেকে। আজ এর জন্য মনিব তাকে নিশ্চয়ই শাস্তি দিবেন,বেচারা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভাবতে থাকে।

সামশের যাওয়ার পর সে আলতো হাতে বেনারসি শাড়িটি তুলে দেয়। শাড়িটিতে ভারী সোনালী সুতোর কাজ করা,অত্যন্ত ভালো মানের কাপড় দিয়ে তৈরি করা। তার আগের চাকরির সুবাধে কাপড় সম্মন্ধে ভালো জ্ঞান রয়েছে তার। তাই সে বুঝতে পারে এই শাড়ী অত্যন্ত দক্ষ কোনো কারিগর দ্বারা বানানো হয়েছে।
এবার গয়নার বাক্সটা খুলে শ্যামা। সেখানে রয়েছে এক জোড়া মোটা সোনার বালা এবং এক জোড়া রূপোর নূপুর।
সাথে একটি ছোট্ট চিরকুট,যেখানে লেখা আছে,

‘এই শাড়ী আর বালা জোড়া আমার মায়ের শ্যামা।
অনেক পুরোনো,তোমার হয়তো পছন্দ নাও হতে পারে।
তবে আমার মনে হয়েছে তোমাকে খুব মানাবে এগুলো।
তোমার যদি এগুলো পছন্দ না হয় পড়ার দরকার নেই শ্যামা,আমি কিছু মনে করবোনা।
হ্যাঁ তবে রূপোর নূপুর গুলো আমি নিজে তোমার জন্য পছন্দ করেছি,এগুলো সবসময় পড়ে না থাকলে আমি রাগ করবো।’

(চলবে)