#শ্যামারণ্য
#পর্বঃ২৫
লেখনীতেঃ #ফাহমিদা_মেহেজাবীন
সকাল বেলা একটু দেরি করে ঘুম ভাঙ্গে শ্যামার। উঠে খাট থেকে নামতে গিয়ে পায়ে নূপুরের শব্দ পেয়ে চমকে উঠে সে। পায়ের দিকে তাকাতেই দেখে অরণ্যের দেওয়া সেই নূপুর জোড়া,যেগুলো সে রাগের মাথায় ছুড়ে ফেলে এসেছিলো। উনি তাহলে সে ঘুমানোর পর এগুলো পড়িয়ে দিয়েছেন?
ভাবতে ভাবতেই অরণ্য তাকে নূপুর পড়িয়ে দিচ্ছে এমন কল্পনা ভেসে উঠে তার চোখের সামনে,লজ্জায় রাঙা হয়ে উঠে গাল। সে মাথা ঝাঁকিয়ে নিজের মাথায় আলতো চাটি মে’রে নিজের হুশ ফেরায়। এই লোক তাকে এক রাতেই উনাকে বারবার দেখার লোভ লাগিয়ে দিয়েছেন। যখন তখন এখন উনার চেহারাটায় মনে ভাসবে সারাদিন।
অরণ্যের কথা ভাবতে ভাবতে বিছানা ছেড়ে উঠে গোসল সেরে নেয় শ্যামা। পরে নাস্তা খেতে খেতে মাকে যখন জানালো সে ফিরে যেতে চায় তখন মা আশ্চর্যজনকভাবে কোনো দ্বিমত করেন নি।
শ্যামার মা মেয়েকে নিয়ে খুবই চিন্তিত ছিলেন,এই কদিনেই মেয়েটা কেমন শুকিয়ে গেছে। না ঠিকমতো খায়,না কথা বলে।সবকিছু থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে ঘরবন্দী করে ফেলেছে নিজেকে। সাম্প্রতিক ঘটনাগুলো মেয়ের মনের উপর অনেক প্রভাব ফেলেছে হয়তো।
রওনক কে নিয়ে এতো ব্যস্ত সময় কাটে তার যে সে দুদন্ড বসে মেয়ের সাথে সুখ দুঃখের কথা বলতে পারেন নি। তারচেয়ে ভালো ফিরেই যাক। এখান থেকে দূরে গেলে,কাজকর্মে ব্যস্ত থাকলে এখানের যাবতীয় চিন্তাগুলো ভুলে থাকতে পারবে। তাই সে নিশ্চিত মনেই শ্যামার ফিরে যাওয়ার প্রতি সম্মতি প্রকাশ করে।
মাকে এতো সহজে ম্যানেজ করতে পেরে শ্যামা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। বাবা তার উঠার আগেই সৌরভের সাথে বেড়িয়ে গেছেন,আজ উকিলের সাথে সাক্ষাৎ আছে তাদের। বাবাকে নাহয় মা বলে দিবে পরে।
শ্যামা মনের সুখে নিজের রুমে ফিরে এসে গোছগাছ করতে থাকে। আসার সময় রাগের মাথায় এক কাপড়েই চলে এসেছিলো,তাই বেশি কিছু গুছানোর নেই তার। সে অরণ্যের মায়ের হাতের বালাগুলো যে বাক্সে তুলে রেখেছিলো,সেগুলো ব্যাগে রেখে দেয় মনে করে। ব্যস,সব গুছানো শেষ। এবার শুধু সন্ধ্যা হওয়ার অপেক্ষা। মাকে বলেছে সন্ধ্যায় বের হবে।
বিকেলের শুকনো কাপড়গুলো নামানোর পর কেউ সচরাচর ছাদে যায়না। সন্ধ্যার পর সবার থেকে লুকিয়ে সেখানে অপেক্ষা করতে কোনো অসুবিধা হবেনা শ্যামার।
সব এই পর্যন্ত ঠিক ছিলো। অরণ্যের সাবধানবাণী উপেক্ষা করে ঘরের বাইরে যাওয়ার কোনো প্রয়োজনবোধ হয়নি তার।
অন্তত সকাল পর্যন্ত হয়নি। কারণ দুপুর গড়াতে গড়াতে শান্তিপূর্ণ পরিবেশটা হঠাৎই এলোমেলো হতে লাগলো।
শ্যামা তার রুমে বসে আপন মনে অরণ্যের স্মৃতিচারণ করছিলো,তখন হঠাৎ তার মা হন্তদন্ত হয়ে রুমে এসে বলে,
“শ্যামা জলদি চল!”
শ্যামা চমকে উঠে তার মায়ের দিকে তাকালো,মাকে অনেক ভীত দেখাচ্ছে,চোখ থেকে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে,কয়েক মূহুর্তের ব্যবধানে যেনো তার বয়স কয়েক বছর বেড়ে গিয়েছে। মায়ের এমন অবস্থা দেখে বিচলিত হয়ে জিজ্ঞেস করে শ্যামা,
“কি হয়েছে মা?এমন দেখাচ্ছে কেনো তোমাকে?”
“রওনক…রওনক কে হাসপাতালে নিতে হবে”, মা কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলে।
শ্যামা তড়িৎ গতিতে ছুটে যায় মায়ের রুমে,রওনক তার দাইমার কোলে রয়েছে।এক নাগাড়ে কেঁদে চলেছে বাচ্চাটা।
মা ও তার পিছু পিছু ফিরে এসে বলে,
” বাচ্চাটার রাত থেকে গা একটু গরম ছিলো। কিন্তু একটু আগে ঘুম থেকে উঠার পর থেকে কোনোমতে খাচ্ছেনা,গা জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে।বাচ্চাটা এক নাগাড়ে কেঁদে চলেছে,নিশ্চয়ই অনেক কষ্ট হচ্ছে তার। কিছু কর মা,জলদি হাসপাতালে যেতে হবে।”
শ্যামা বাচ্চাটার গায়ে হাত দিয়ে দেখলো,আসলেই জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে বাচ্চাটার। সে মাকে চিন্তিত গলায় বলে,
“ওর কিছু জামা কাপড় আর রিপোর্টগুলো গুছিয়ে নাও,আমি গাড়ি ডেকে আনছি।”
হঠাৎ সৃষ্ট প্রতিকূল পরিস্থিতিতে শ্যামা পুরোপুরি ভুলে যায় অরণ্যের দেওয়া সাবধানবাণী। অবশ্য মনে থাকলেও তার সামনে তার নিয়তি আর কোনো পথ খোলা রাখেনি।
বাবা ঘরে নেই,হেনা অনেকদিন বাদে আজই কলেজে গিয়েছে,মাকে সে একটা অসুস্থ বাচ্চা নিয়ে একা যেতে বলতে পারেনা,যেতে তো তাকে হতোই।
ঘরের চৌহদ্দি পেরিয়ে গাড়ি ডেকে আনে শ্যামা। তারপর মা, রওনক আর দাইমাকে নিয়ে বেড়িয়ে যায় হাসপাতালের উদ্দেশ্যে। তার এই ভুলটার দাম তাকে প্রাণ দিয়েও দিতে হতে পারে সেটা পুরোপুরি ভুলে গেলো সে।
রওনককে হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। ডাক্তার অনেকক্ষণ পর্যবেক্ষণ করে আস্বস্ত করে তাদের যে বেশি সিরিয়াস না। ঠিক সময়েই হাসপাতালে আনা হয়েছে। দুইদিন অবজারভেশনে রাখলে সুস্থ হয়ে যাবে।
মার জান আটকে ছিলো গলার কাছে,ডাক্তারের কথা শুনে যেনো ধরে প্রাণ ফিরে আসে তার। শ্যামাও স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে।
বিকেল গড়াতেই বাবাকে নিয়ে সৌরভ হাজির হয় হাসপাতালে। শ্যামা বাবাকে ফোনে আস্বস্ত করেছিলো যে অবস্থা সিরিয়াস না,শুধু দুইদিন হাসপাতালে রাখতে হবে।
তবু বাবাকে অনেক চিন্তিত দেখালো। অবশ্যই কারণ বাচ্চাটা বাবার চোখের মণি,মায়ের থেকেও বেশি বাবা ওকে ভালোবাসে।
তাই প্রিয় নাতির কোনো কষ্ট উনি সহ্য করতে পারছেন না।
শ্যামা তাকে আস্বস্ত করার ভঙ্গিতে বলে,
“বাবা চিন্তা করোনা তো। ছোট্ট বাবুদের জ্বর-ঠান্ডা প্রায়ই লেগে থাকে। পরের বার থেকে ঠান্ডা বাতাস লাগতে দিওনা।”
বাবা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,
“আজ তুই ছিলি বলে মা,নয়তো তোর মা একা একা কিভাবে বাচ্চাটাকে হাসপাতালে আনতো।”
মা ও বলে উঠে,”ঠিক বলেছো,আজ আরও ওর ফিরে যাওয়ার কথা। ও চলে যাওয়ার পর এমন কিছু ঘটলে আমি কি করতাম ভাবলেই গা শিউরে উঠে আমার। বিপদ আসলে আমি দিশেহারা হয়ে পড়ি,কি করা উচিত বুঝতে পারিনা।”
‘আজ আরও ওর ফিরে যাওয়ার কথা’, মায়ের বলা কথাটি কর্ণকুহরে যেতেই অবশেষে সম্বিৎ ফিরলো শ্যামার।
আজ অরণ্যের তাকে নিতে আসার কথা,আর সে বারবার সাবধান করে দিয়েছিলো যা কিছুই হয়ে যাক বাড়ির চৌহদ্দি পার না করতে। সাথে সাথে একটি অজানা আতঙ্কের সঞ্চার হয় তার মনে। তার মস্তিষ্কে তখন একটি কথা ই আসে,তার ফিরে যেতে হবে বাড়ি,যত দ্রুত সম্ভব।
তাই সে তৎক্ষণাৎ বলে উঠলো,
“মা এখানে যেহেতু সব ঠিক আছে,বাবা ও এসে গেছেন। তাহলে আমি ফিরে যাই,কেমন? আমার আজ সন্ধ্যায় বেরোতে হবে,তোমাকে তো বলেছিলাম। আমি হেনাকে মেসেজ করে বলেছি সব, একটুপর সেও চলে আসবে।”
বাবা ভ্রু কুঁচকে বললেন,”বেরোতে হবে মানে?তুই চলে যাচ্ছিস?”
মা ই বাবার জন্য জবাব দেয়,”হ্যাঁ আজ ওর ফিরে যাওয়ার কথা,সকালে বলেছিলো। তখন তুমি ছিলেনা তাই জানোনা।
যেতে দাও ওকে,কাজেকর্মে থাকলে মন-মেজাজ ব্যস্ত থাকবে। এদিকটা আমরা সামলে নিবো।”
বাবা আর কিছু বললেন না,মাথা নাড়িয়ে সায় দিলেন।
সৌরভ নীরবে একপাশে দাঁড়িয়ে তাদের কথা শুনছিলো এতোক্ষণ। শ্যামা চলে যাবে শুনে ভ্রু কুঁচকে উঠে তার। এই মেয়েটাকে গত পনেরোদিন যাবত বশ করার চেষ্টা করে চলেছে সে কিন্তু মেয়েটা একদমই ধরা দিচ্ছেনা তার কাছে। ভেবেছিলো আগের মতো তাদের কথাবার্তা শুরু হলে,তার প্রতি শ্যামার আগের অনুভূতিগুলো জেগে উঠবে। কিন্তু মেয়েটা তার সাথে সৌজন্যতার খাতিরে যতটুকু না বললেই নয় তার চেয়ে বেশি কথাও বলেনা।
ব্যাপারটা তার পুরুষত্বে দারুণভাবে আ’ঘা’ত করে। সৌরভ চৌধুরীকে কখনো কোনো মেয়ের পিছনে এতো কাঠখড় পো’ড়া’তে হয়নি। মেয়েরা তার সুদর্শন চেহারা আর ব্যাকগ্রাউন্ড দেখেই তার পিছনে ঘুরঘুর করে। সে মেয়েদের সাথে একটু হেসে কথা বললেই তাদের বিছানা অব্দি নিতে বেশি চেষ্টাও করতে হতোনা তাকে।
কিন্তু এই মেয়ের এতো কিসের দেমাগ? সে রীতিমতো তার পরিবারের জন্য খাটছে দিনরাত,তবুও মেয়েটা গায়ে পড়ে একবার কথা বলতে আসেনা,দূরত্ব বজায় রেখে চলে।সে নিজ থেকে ফোন করে কথা বলতে চাইলে দায়সারা জবাব দিয়ে ফোন রেখে দেয়। সবচেয়ে বেশি যে বিষয়টি তাকে প্রভাবিত করে তা হলো এই মেয়েটাই এক সময় তাকে পা’গ’লের মতো ভালোবাসতো,তার কারণে অপমানিত হওয়ার পর ভার্সিটি আসা পর্যন্ত বন্ধ করে দিয়েছিলো। এখন সেই মেয়েটাই তাকে পাত্তা দিচ্ছেনা,বিষয়টা রীতিমতো তাকে চ্যালেঞ্জ করার মতো মনে হয় তার। মেয়েটার চোখে মুখে ফুটে উঠা তার প্রতি অনীহা,তাকে এড়িয়ে যাওয়ার প্রচেষ্টা যেনো বারবার তাকে বিদ্রুপ করে বলে ‘আমাকে তুই কখনো পাবিনা’।
আজ মেয়েটা একেবারেই তার নাগালের বাইরে চলে যাবে শুনে মাথায় র’ক্ত উঠে যায় তার। আজ সে এর শেষ দেখে ছাড়বে।
শ্যামা তার ব্যাগ নিয়ে যেতে উদ্ধত হলে সে সবাই শুনতে পায় মতো ঘোষণা করে,
“আমিই তাহলে শ্যামাকে পৌছে দিয়ে আসি। আমিতো এমনিতেই ওদিক দিয়ে যাবো।”
শ্যামা থমকে গিয়ে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকায় সৌরভের দিকে।লোকটি তার দিকেই তাকিয়ে আছে একদৃষ্টিতে,মুখে লেগে আছে তার সেই অমায়িক হাসি যা দেখে এক সময় তাকে ভালোবেসে ফেলেছিলো শ্যামা। কিন্তু এখন লোকটাকে এভাবে দেখলে কেমন জানি লাগে তার,গা শিরশির করে উঠে লোকটি তার দিকে তাকালে।লোকটির গায়ে পড়ে সখ্যতা করার চেষ্টা তার মোটেও পছন্দ নয়।আবার কিছু বলতেও পারেনা কারণ লোকটা দুঃসময়ে তাদের পরিবারকে সাহায্য করছেন,বাবাও লোকটিকে অনেক স্নেহ করতে শুরু করেছেন।
সে ইতস্ততভাবে মানা করতেই যাচ্ছিলো তখন বাবার গলা ভেসে আসে কানে,
“হ্যাঁ বাবা তুমি ওকে সাথে করে নিয়ে যাও। তোমার সাথে গেলে আমিও নিশ্চিত থাকবো।”
সৌরভ মুচকি হেসে শ্যামার উপর থেকে দৃষ্টি না সরিয়েই জবাব দেয়,
“চিন্তা করবেন না আঙ্কেল,আমি শ্যামার অনেক ভালো করে খেয়াল রাখবো। আপনি নিশ্চিন্ত থাকেন।”
ব্যস,তার আর কিছু বলার সুযোগই থাকেনা এরপর। মুখের উপর মানা করলে খারাপ দেখাবে,কোনো প্রত্যক্ষ কারণও নেই মানা করার। সৌরভ তার সাথে কখনো খারাপ কিছু করেনি বা এমন ইঙ্গিত দিয়ে কথা বলেনি। শুধু মনের খচখচানির জন্য তো একজন মানুষ যে তাদের পরিবারের শুভাকাঙ্ক্ষী তাকে অপমান করা যায়না। শ্যামা স্মিত হাসার চেষ্টা করে সায় দেয় সৌরভের প্রতি।
মাথায় তখনও বারি খাচ্ছে একটা কথা ‘কাউকে বিশ্বাস করোনা’। সে একবার চোখ বন্ধ করে অরণ্যের চেহারাটা ভাবার চেষ্টা করে নিজেকে ধাতস্থ করার প্রয়াস করলো,মন টা অজানা ভয়ে কুঁকড়ে আছে। সে যত দ্রুত সম্ভব বাড়ি পৌছাতে চায়। মাঝে আর কয়েকটা ঘন্টা মাত্র। বারোটা বাজলেই সে তার প্রিয় মানুষটির বুকে থাকবে,তার সবচেয়ে শান্তির স্থান,যেখানে কোনো বিপদ তাকে ছুঁতেও পারবেনা। এসব ভাবতে ভাবতেই শ্যামা দ্রুতকদমে বেড়িয়ে পড়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে।
সৌরভ তার পিছু পিছু আস্তে ধীরে আসছে। শ্যামার গমনরত পিঠের দিকে তাকাতে তাকাতে তার মুখ থেকে সেই অমায়িক মেকি হাসি পুরোপুরি মুছে যায়। সে তার ফোন বের করে কাউকে একটা মেসেজ পাঠিয়ে ফোনটা রেখে দিয়ে হাঁটতে থাকে শ্যামার পিছুপিছু।
ঠোঁটে কুঠিল হাসি ফুটে উঠে তার,মনে মনেই বলে উঠে সে,
“শ্যামা পাখি আজ হয় তুমি নিজ থেকে ধরা দিবে নয় তো শিকারীর হাতে শিকার হবে। দুই ক্ষেত্রেই তোমাকে আজ আমার হতেই হবে।”
(চলবে)
#শ্যামারণ্য
#পর্বঃ২৬
লেখনীতেঃ #ফাহমিদা_মেহেজাবীন
সৌরভের বাইক হঠাৎ পথ পরিবর্তন করায় শ্যামা বিচলিত কন্ঠে বলে,
“আপনি ওদিকে কেনো যাচ্ছেন?আমাদের গলির পথ তো অন্যদিকে?”
সৌরভ বাইকের গতি আগের থেকে বাড়িয়ে দিতে দিতে বলে,
“পাঁচ মিনিট লাগবে শ্যামা। আমার ফ্রেন্ড এর বাড়িতে কিছু জরুরি কাগজপত্র ফেলে এসেছি,এগুলো আমার একটু পর দরকার পড়বে। বেশি সময় নিবোনা।এই যাবো,কাগজ নিবো তারপর তোমাকে বাসায় পৌছে দিয়ে আসবো।”
“তার দরকার নেই,আপনি আমাকে এখানেই নামিয়ে দিন। এখান থেকে বেশি দূর না। আমি হেটে অথবা রিকশা নিয়ে চলে যাবো।”
“শ্যামা তোমাকে মাঝ রাস্তায় নামিয়ে দিলে আঙ্কেলকে আমি মুখ দেখাতে পারবোনা। ব্যস চলে এসেছি,আরেকটু।”
শ্যামা ত্রস্ত কন্ঠে বলে উঠে,”প্লিজ বাইক থামান,বাবা কিছু বলবেনা। আমার দ্রুত বাড়ি পৌছানো লাগবে। আপনি এখন না থামালে আমি লাফ দিবো কিন্তু।”
সৌরভ তার বাইকের স্পিড আরও বাড়িয়ে দিয়ে বলে,
“আরে করছো কি?পা’গ’ল হলে নাকি?দেখো আমরা চলে এসেছি,এই বাঁকটা ঘুরলেই পৌছে যাবো।”
হঠাৎ বাইকের স্পিড বেড়ে যাওয়ায় শ্যামা চোখমুখ খিচে সিট আঁকড়ে ধরলো,কোনো জবাব দেওয়ার জন্য ধাতস্থ হওয়ার আগেই বাইক কষে ব্রেক করে থেমে যায়।
চোখ পিটপিট করে দৃষ্টি সয়ে আসতেই সে তার আশেপাশের পরিবেশ লক্ষ্য করে। দোতলা একটি বাড়ির সামনে এসে দাঁড়িয়েছে তারা,গলির এই বাঁকে কোনো দোকানপাঠ নেই,শুধু এই দোতলা বাড়িটা রয়েছে। এমন জনমানবহীন গলি দেখে শ্যামা তড়িঘড়ি করে বাইক থেকে নেমে যায়। সৌরভ নামার আগেই সে বলে উঠে,
“ধন্যবাদ ভাইয়া,এখান থেকে আমি একা ই চলে যাবো।”
বলেই সে চলে যেতে ধরে তখনই একটা মেয়েলি কন্ঠ তাকে ডাক দেয়,
“আরে শ্যামা না?কতোদিন পর দেখলাম”
হঠাৎ কারো কন্ঠে তার নাম শুনে ফিরে তাকায় শ্যামা। মেয়েটা বাড়ির ভেতর থেকে বেড়িয়ে এসেছে হয়তো বাইকের আওয়াজ শুনে, রিপ্তি আপুকে চিনতে বেশি কষ্ট হয়নি তার। তিনিও সৌরভ ভাইয়ার ব্যাচমেট ছিলেন,সুপ্তি আপুর বেস্ট ফ্রেন্ড। সুপ্তি আপু তাকে অপমান করার দিন তিনিও তার সাথেই এসেছিলেন।
শ্যামা জোরপূর্বক মুখে হাসি ফুটিয়ে বলে,
“কেমন আছো আপু?”
“আমি ভালো আছি,কিন্তু তোমাকে তো চেনায় যাচ্ছেনা দেখি। তুমিও সৌরভের সাথে আসবে জানতাম না আমি।”
শ্যামা তার থেকে দু কদম দূরে দাঁড়ানো সৌরভের দিকে তাকালো,যে চোখ মুখ গম্ভীর করে এক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে।
“না,উনি শুধু আমাকে লিফট দিচ্ছিলেন। আপনারা আপনাদের কাজ করুন। আমি চলে যাচ্ছি।”
কিন্তু চলে যেতে নিলেই রিপ্তি তার হাতটা খপ করে ধরে ফেলে,
“তা কি করে হয়?এতোদিন পর দেখা হলো,বাসায় এসো। চা খেতে খেতে গল্প করা যাবে।”
শ্যামা হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করতে করতে বলে উঠে,
“না আমার তাড়া আছে,আমাকে যেতে দিন।”
শ্যামা হাত ছাড়ানোর জন্য মোচড়ামুচড়ি করতে থাকে কিন্তু রিপ্তি মেয়েটা তখনও তাকে শক্ত করে ধরে রেখে কথা বলছে।
সৌরভ সবটা পাশ থেকে দেখে যাচ্ছিলো। রাগে গা জ্ব’লে যাচ্ছে তার। সারা রাস্তা জুড়ে মেয়েটা চলে যাবে চলে যাবে করছে,ওকে কি চলে যাওয়ার জন্য এনেছে নাকি।
সে এবার কোনো ভনিতা না করেই তার পুরুষালী হাত দিয়ে শ্যামার চুলের মুঠি চেপে ধরে গেইটের ভেতর ঢুকিয়ে হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে যায় ঘরের ভেতরে।
ঘটনাটি আকস্মিক ঘটে যাওয়ায় টাল সামলাতে পারলোনা শ্যামা,কিছু বুঝে উঠার আগেই সৌরভ তাকে ঘরের ভেতর টেনে নিয়ে গিয়ে মেঝেতে ছুড়ে ফেলে। হাটুতে আর হাতের কনুইয়ে বেশ চোট পায় শ্যামা,ব্যাথায় কুঁকিয়ে উঠে সে। কিন্তু শরীরের ব্যথা ফিকে হয়ে যায় মনের আতঙ্কের কাছে। শ্যামা বুঝতে পারে এবার,অরণ্য ঠিকই বলেছিলো,বিপদ হবে বাইরে। আর সে নিজে এসে ধরা দিয়েছে সেই বিপদের কাছে। বাইরে এখনো দিনের আলো। সূর্যটাও ডুবেনি। অরণ্য তাকে বাঁচাতে আসবেনা এই মুহুর্তে। শ্যামা চিৎকার করে সাহায্য চাইতে নিলে সৌরভ তার চুল টেনে ধরে ঠাস করে গালে একটা থা’প্প’ড় লাগিয়ে দিয়ে বলে,
“চুপ! একদম চুপ! অনেক শুনেছি তোর প্যানপ্যান। আরেকটা শব্দ করলে তোর সাথে তোর পরিবারকে সহ কে’টে ফেলে দিবো,ন্যাকার গুষ্টি সবগুলো!”
শ্যামা শরীরের ব্যথায় আর চাঁপা আতঙ্কে স্তব্দ হয়ে যায়,ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে সে এটা ভেবে যে আজ তার সাথে কি কি হতে চলেছে।
রিপ্তিও তাদের পিছুপিছু এসে দাঁড়িয়েছে,সে বিরক্তিমাখা কন্ঠে বলে,
“আহ সৌরভ! তোর ধৈর্য এতো কম কেনো?আমি কথা বলছিলাম তো নাকি?শুধু শুধু মেয়েটাকে ভয় পাইয়ে দিলি।”
সৌরভ রাগী কন্ঠে জবাব দেয়,”আরে দেখছিলি তো কেমন যাওয়ার গোঁ ধরেছিলো। এসব মেয়েদের এই ভাষাতেই বশ করতে হয়।”
“আরে থাম তো,তোর মাথা আগে ঠান্ডা কর,আমি বোঝাচ্ছি ওকে”
সৌরভ ফোঁস করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,
“ওকে ভালো করে বুঝিয়ে দিস তাহলে আমি কে,আর কি কি করতে পারি। যা রুমে নিয়ে যা ওকে।”
রিপ্তি মেয়েটা এসে শ্যামাকে ফ্লোর থেকে টেনে তুলে,ভয়ে থরথর করে কাঁপছে সে,ভালো করে হাঁটতেও পারছেনা হাঁটুতে চোট পাওয়ার কারণে। শ্যামা চোখের কোণা দিয়ে একবার সৌরভের দিকে তাকায়,লোকটা এখনো তার দিকেই তাকিয়ে আছে। তাকে মোটেও এই মূহুর্তে সেই সৌরভের মতো দেখাচ্ছেনা যাকে সে চিনতো। এই লোকটা কি সবসময়ই এতো ভয়ংকর ছিলো?
রিপ্তি মেয়েটা একপ্রকার টেনে হিছড়ে শ্যামাকে পাশের একটি রুমে নিয়ে গিয়ে খাটে বসিয়ে দেয়। তারপর শ্যামার গালে হাত দিয়ে মুখ দিয়ে এক প্রকার চুকচুক শব্দ করে বলে উঠে,
“আহারে চেহারাটাই নষ্ট করে দিলো,পুরো পাঁচ আঙ্গুলের ছাপ ভেসে উঠেছে। এই ছেলের রাগ উঠলে মাথা ঠিক থাকেনা। শুধু শুধু কেনো রাগিয়ে দিলে ওকে?”
শ্যামার রিপ্তির কোনো কথা ই কানে ঢুকলোনা,সে তার হাত ধরে মিনতি করে বলে,
“প্লিজ আপু,আমাকে দয়া করে যেতে দিন। আমার কোনো ক্ষতি করবেন না। আমি তো আপনাদের কোনো ক্ষতি করিনি।”
রিপ্তির শ্যামার আঁকুতি শুনে একটুও গললো না,সে ভাবলেশহীন গলায় বলে উঠে,
“দেখো শ্যামা, সৌরভের তোমাকে পছন্দ হয়েছে।ও তোমার কাছে যা চাইছে তা ভালোয় ভালোয় দিয়ে দিলে তোমারি লাভ। এই আমাকেই দেখো,ভার্সিটি উঠার পর মাস চলার টাকা থাকতোনা আগে,আর এখন এতো বড়ো একটা বাড়িতে ফ্রীতে থাকছি। শুধু মাঝে মাঝে বড়ো মাপের কোনো মানুষ আনলে তাকে খুশি করে দিতে হয়। ওরা কোনো মেয়ে তুলে আনলে জায়গা দিতে হয়। তার বদলে তারা আমাকে অনেক অনেক টাকা পুরস্কার দেয়,আমার আর কোনো কাজ করা লাগেনা। আমাদের মেয়েদের বিধাতা এতো সৌন্দর্য দিয়েছেন এমনি এমনি নাকি। এটাকে সঠিক দিকে ব্যবহার করতে জানলে লাইফটাই সেট হয়ে যাবে। আর এর মধ্যে মোটেও খারাপ কিছু নেই। শুধু আমি না,তোমার আমার চেনাপরিচিত অনেক মেয়েরাই আসে এখানে নিজ থেকে সেচ্ছায় বিলিয়ে দিতে। তারাও নিজের ভালো বুঝেছে তাই আসে। তুমিও বুঝে নাও এবার তোমার ভালো কিসে।
সৌরভকে খুশি করতে পারলে তোমার লাইফটাও সেট করে দিবে ও, কিন্তু ওর কথার অমান্য করলে কিন্তু কষ্ট পেতে হবে।”
শ্যামা যেনো আকাশ থেকে পড়লো মেয়েটার এসব কথা শুনে,একে দেখে তো কখনো মনে হয়নি সে এই ধাচের মেয়ে। ঘৃণায় চোখমুখ কুঁচকে যায় শ্যামার,
“আপনি না সুপ্তি আপুর বেস্টফ্রেন্ড ছিলেন। আপনি তার ই বয়ফ্রেন্ড এর সাথে এসব…..” কথাটা আর সম্পূর্ণ করলো না সে।
রিপ্তি যেনো কিছু মনে পড়ার ভঙ্গিতে বলে উঠে,
“আহহ সুপ্তি, ভালো উদাহরণ মনে করিয়েছিস তোকে বোঝানোর জন্য। দেখ একবার আমাকে দেখবি,আরেকবার সুপ্তির পরিণতির কথা ভাববি। আমি সৌরভের কথামতো চলেছিলাম তাই এখন আমি ইচ্ছে মতো আরামের জীবন কাটাচ্ছি,
আর সুপ্তি অবাধ্য হয়েছিলো তাই তার লা’শ রাস্তার পাশে পাওয়া গিয়েছিলো। কেউ কিচ্ছু করতে পারেনি সৌরভের,ওর অনেক বড়ো বড়ো মানুষের সাথে পরিচিতি আছে। এখন বাকিটা তোর উপর তুই কি চাস।”
বলেই রিপ্তি উঠে যায় সেখান থেকে,শ্যামা তার হাত ধরে আবার মিনতি করে তাকে ছেড়ে দেওয়ার জন্য,কিন্তু মেয়েটা তার কথা একবারও কর্ণপাত না করে দড়জা বাইরে থেকে বন্ধ করে চলে যায়। শ্যামা পেছন থেক দড়জা ধাক্কাতে ধাক্কাতে এক সময় ক্লান্ত হয়ে যায়,কিন্তু কেউ ফিরে আসেনা দড়জা খুলতে।
শ্যামা সুপ্তি আপুর পরিণতির কথা চিন্তা করে ভয়ে সিটিয়ে যায়। তাহলে সুপ্তি আপুর মৃ’ত্যু’র জন্য আসলেই তার কাছের মানুষগুলো দায়ী?এরা নিজের কাছের মানুষের ওই অবস্থা করেছিলো,তাকে কি অবস্থা করবে তাহলে?
শ্যামা রুমটিকে ভালো করে লক্ষ্য করলো এই রুমের সাথে লাগানো কোনো জানালা নেই।শুধু একটা খাট একটা সোফা,আরেকটা টি-টেবিল রয়েছে। যেনো বিশেষভাবে এসব কাজের জন্যই রুমটি তৈরি করা হয়েছে।
তার ব্যাগটা হাতাহাতির মাঝে বাইরে পড়ে গেছে,কাউকে ফোন করে বলারও সুযোগ নেই। বেরোবার কোনো পথ খুঁজে না পেয়ে হতাশ হয়ে বসে পড়ে শ্যামা। হতাশা তাকে আষ্টেপৃষ্টে ঝেঁকে ধরে যেনো।
সে ভয় কমাতে চোখ বন্ধ করে অরণ্যের চেহারাটা একবার মনে করতে চাইলো,তখন অরণ্যের বলা কথাগুলো মনে পড়ে যায় তার, ‘আমি আসার আগ পর্যন্ত নিজেকে রক্ষা করবে’।
অশান্ত মন অনেকটা শান্ত হয়ে যায়,হ্যাঁ অরণ্য তাকে নিতে আসবে। তাকে ততোক্ষণ নিজেকে রক্ষা করতে হবে শুধু।
শ্যামা ভয়ার্ত চোখে রুমে আবার চোখ বুলালো,আত্মরক্ষার জন্য কিছু দরকার তার। এই রুমটাতে খাট,সোফা আর টেবিলটা ছাড়া আর কিছুই নেই। টেবিলের উপর একটা প্লাস্টিকের জগ আর কাঁচের গ্লাস। শ্যামা গ্লাসটা তুলে নেয়,একমাত্র এটাই সে আত্মরক্ষার জন্য ব্যবহার করতে পারবে। শ্যামা গ্লাসটা যতটা কম শব্দ করে পারা যায় ভেঙ্গে একটা বড়সড় কাঁচের টুকরো নিয়ে বালিশের নীচে রেখে দেয়,বাকি টুকরোগুলো লুকিয়ে ফেলে। তারপর খাটের উপর বসে অপেক্ষা করতে থাকে। শ্যামা এখন আগের থেকে অনেকটা শান্ত হয়েছে। একটা সুযোগের অপেক্ষা শুধু।
এরপর কতটা সময় কেটে গিয়েছে জানেনা শ্যামা। আনুমানিক এক ঘণ্টা পর দড়জাটা খুলে যায় আর সৌরভ ঘরে প্রবেশ করে।নাকে ভেসে আসে মদের গন্ধ,গা গুলিয়ে উঠে শ্যামার সেই গন্ধে। এদিকে সৌরভ শ্যামাকে শান্তশিষ্ট ভাবে অপেক্ষা করতে দেখে বেশ খুশি হয়ে যায়,সে হেসে দড়জা বন্ধ করতে করতে বলে,
“বাহ রিপ্তির বোঝানোতে তাহলে কাজ হয়েছে। খুব ভালো,আমার আবার জোর জবরদস্তি করতে ভালো লাগেনা।”
সৌরভ তার গায়ের পাঞ্জাবি খুলতে খুলতে শ্যামার পাশে এসে বসে পড়ে,মদের গন্ধে চোখমুখ কুঁচকে ফেলে শ্যামা। সৌরভ তা বুঝতে পেরে বাঁকা হেসে বলে,
“মাত্র এক গ্লাস ড্রিংক করেছি নিজের রাগ শান্ত করতে,এইটুকু সহ্য করতে না পারলে হবে নাকি?জলদি এসবের অভ্যাস করতে হবে।”
শ্যামা কোনো জবাব দেয়না,সে শুধু সুযোগের অপেক্ষায় আছে কখন সৌরভ অন্যমনস্ক হবে একটু।
সৌরভ শ্যামার কোমড় জড়িয়ে ধরে তাকে কাছে টেনে নেয়।
পরপুরুষের স্পর্শে ঘ’ৃণায় সারা শরীর জ্ব’লে যাচ্ছে মনে হলো শ্যামার,মদের গন্ধে মনে হচ্ছে সব উগড়ে দিবে এখন। সে বালিশের নীচের কাঁচের টুকরোটিকে আঁকড়ে ধরলো,তার উদ্দেশ্য সৌরভের চোখে আঘাত করা,তার হাতিয়ার ছোট,মিস করলে দ্বিতীয় সুযোগ পাবেনা সে।
সৌরভ শ্যামার গালে হাত দিয়ে স্লাইড করতে করতে ঠোঁটের কাছে মুখ নামিয়ে আনে কিস করার জন্য। এই সুযোগেরই অপেক্ষায় ছিলো শ্যামা,সে কাঁচের টুকরোটি নিয়ে সরাসরি বসিয়ে দেয় সৌরভের চোখের উদ্দেশ্যে।
সৌরভ শেষ মুহুর্তে টের পেয়ে সরে যায়,কাঁচের টুকরোটি তার চোখে না লাগলেও কপালের একপাশে গভীরভাবে কেটে বসে,যন্ত্রণায় শ্যামাকে ধা’ক্কা দিয়ে ফেলে সে।
শ্যামার তখন কিছু ভাবার সময় নেই।সে দ্রুত উঠে দড়জা খুলে বেড়িয়ে যেতে নিলে রিপ্তির মুখোমুখি পড়ে যায়,সে সৌরভের চিৎকার শুনে ছুটে এসেছিলো।
শ্যামা তাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে পালিয়ে যেতে নিলে রিপ্তি পিছন থেকে তাকে জড়িয়ে ধরে ফেলে দেয়। শুরু হয়ে যায় ধস্তাধস্তি,শ্যামা অনেক চেষ্টা করে ছাড়া পাওয়ার। কিন্তু ছাড়ানোর আগেই সৌরভ বেরিয়ে আসে রুম থেকে।
কপালের একপাশে কে’টে গিয়ে দরদর করে র’ক্ত পড়ছে তার ক্ষত থেকে। প্রচন্ড রেগে আছে সে,অনেক হিংস্র দেখাচ্ছে তাকে। সে নীচু হয়ে বসে শ্যামার চুল ধরে টেনে তুলে,
“তোকে বেশি কষ্ট দিতে চাইনি আমি কারণ তুই মেয়েটা খারাপ না। কিন্তু তুই আমাকে ভালো থাকতে দিলিনা। আমার শরীর থেকে র’ক্ত ঝরিয়েছিস তুই। আমি তোর এমন অবস্থা করবো যে মৃ’ত্যুর ভিক্ষা চাইবি তুই।
এই রিপ্তি,সবাইকে খবর দে। এর অনেক তেজ,আমি একা একজন ওর তেজ কমাতে পারবোনা।”
বলতে বলতেই শ্যামাকে রুমে ছুড়ে ফেলে দিয়ে দড়জা লাগিয়ে দেয়।
শরীরের বিভিন্ন জায়গায় চোট লাগে তার,কিন্তু শরীরে ব্যথাগুলো অনুভূত হওয়া যেনো বন্ধ হয়ে গেছে তার।
সে সেখানেই সেই অবস্থায় পড়ে কাঁদতে থাকে। সব শেষ,সব রাস্তা বন্ধ,সে হয়তো অরণ্যকে আর কখনো দেখতে পাবেনা।
ভাবতেই নিজের মৃ’ত্যুকামনা করতে থাকে সে। সে নিজে নিজে বলতে থাকে,
“অরণ্য…আপনি কি সব দেখছেন এখন?আমার উপর রেগে আছেন তাইনা?আমাকে ক্ষমা করে দিন প্লিজ,আপনি আমাকে এতো করে মানা করলেন তবু আমি নিজের বিপদ নিজে ডেকে এনেছি,নিজেকে রক্ষা করতে বলেছেন তাতেও ব্যর্থ আমি। আমাকে প্লিজ শেষবারের মতো ক্ষমা করে দিন,জলদি এসে নিয়ে যান আমাকে। আমি আর কক্ষনো আপনার অবাধ্য হবোনা…কক্ষনো না।”
(চলবে)
#শ্যামারণ্য
#পর্বঃ২৭ (বোনাস পর্ব)
লেখনীতেঃ #ফাহমিদা_মেহেজাবীন
শ্যামা যেই রুমটিতে বন্দী আছে এই মুহুর্তে সেটা নব লক দড়জা,বাইরে ছিটকিনি আছে শুধু,ভেতর থেকে ছিটকিনি দেওয়ার উপায় নেই। সৌরভ বাইরে থেকে দড়জা পুরোপুরি লক করে কোথায় যেনো যায় একটু পর,সেটা শ্যামা মেইন ডোর বন্ধ হওয়ার আওয়াজ শুনে বুঝেছিলো। বুঝতে পারলো চোটটা বেশ ভালোই লেগেছে তার,অন্তত ডাক্তারের সেলাই তো লাগবেই।
কিন্তু দড়জায় আড়ি পেতে থেকে শ্যামা রিপ্তির গলার আওয়াজ শুনতে পায়,বুঝতে পারে সে পুরোপুরি একা নয়। দড়জা ভাঙ্গার চেষ্টা করা যাবেনা।
রাত নয়টা থেকে বাড়ির ভেতরে মানুষজনের আওয়াজ বাড়তে থাকে,সেই সাথে পাল্লা দিয়ে জোরে মিউজিক চলতে শুরু করে। শ্যামার বুঝতে বাকি থাকেনা তার ভাগ্যে কি ঘটতে চলেছে। ভয়ে শিউরে উঠে সে সুপ্তি আপুর পরিণতির কথা ভেবে। পুলিশের রিপোর্টে এসেছিলো একাধিক পুরুষ শারীরিক নি’র্যা’তন করা হয়েছিলো তাকে,তার সাথেও নিশ্চয়ই সেটা ঘটতে চলেছে।
এই মানুষরূপী জানো’য়ার গুলো মেয়েদের শুধু ভোগের পণ্য মনে করে। এর আগেও সে এই আতঙ্কের স্বীকার হয়েছে।
অরণ্য আর তার বাবার মতো মানুষ তার জীবনে না থাকলে হয়তো গোটা পুরুষ জাতির উপর ঘেন্না চলে আসতো তার। অর্থলোভী,ক্ষমতালোভী,নারীলোভী,চরিত্রহীন এই পুরুষগুলো শুধু ক্ষণিকের মোহ মায়ার জন্য কারও জীবন কেঁড়ে নিতেও পিছপা হয়না। চরম ঘেন্নায় মন বিষিয়ে উঠে শ্যামার।
শ্যামা তীব্র মিউজিক এর সুযোগ নিয়ে রুমের সোফাটা আর টেবিলটা টেনে এনে লাগিয়ে দেয় দড়জার কাছে। পা আর হাতে চোট পাওয়ায় বেশ বেগ পেতে হয় এটুকু করতে,সে জানে এটুকু যথেষ্ট হবেনা ওদের থামাতে।তবু বুকে ক্ষীণ আশা তার, শুধুমাত্র ক্ষণিকের বিলম্ব অরণ্যকে সঠিক সময়ে পৌছে দিবে তাকে বাঁচাতে।
বাইরের অমানুষগুলো তখন মদ জুয়ার আসর নিয়ে বসেছে,পার্টির ক্লাইম্যাক্স শুরু হবে সৌরভ ফেরার পর। সে এখনো ফিরেনি। ডাক্তার তার মাথার এক্স-রে করতে বলেছে,কাঁচের অংশ ভেতরে থেকে গিয়েছে কিনা জানার জন্য। জলদিই চলে আসবে রিপ্তি জানায়।
রিপ্তি আজকের পার্টির জন্য শুধু অন্তর্বাস ছাড়া কিছুই পড়েনি,সৌরভ না আসা পর্যন্ত অতিথিদের আপ্যায়নের দায়িত্ব তার। এখানে রয়েছে বড়ো বড়ো নেতাদের ছেলে,বিভিন্ন রাজনৈতিক ছাত্রনেতাসহ অনেক গণ্যমান্য নাম।
রাত নামলেই এসব পার্টির জন্য মুখিয়ে থাকে তারা। বিশেষ করে পার্টির মূখ্য মনোরঞ্জন যদি একজন নারীর ইচ্ছের বিরুদ্ধে তার সর্বস্ব হরণ হয়,তাকে তিলে তিলে একটু একটু করে হ’ত্যা করা হয়ে থাকে,তাহলে তার চেয়ে মনোরঞ্জক কিছু তাদের পৈশা’চিক মনের জন্য হতেই পারেনা।
রাত এগারোটায় যখন ফিরে সৌরভ তখন মদের নেশায় বুদ হয়ে সবাই তার কপালের ব্যান্ডেজ নিয়ে একচোট হাসাহাসি করে ফেলে। মেয়ে মানুষের হাতে মা’র খেয়ে কপালে সেলাইয়ের দাগ লাগিয়েছে সেটা তাদের পুরুষ সমাজের কাছে বেশ লজ্জার এবং হাসির ব্যাপার বটে।
সৌরভও মুখে মেকি হাসি বজায় রাখলেও মনে মনে বেশ অপমানবোধ করে,আর শ্যামার প্রতি রাগটাও তার তরতর করে বাড়তে থাকে যা দমিয়ে রাখার কোনো প্রচেষ্টা সে করলোনা।
সাথীদের সাথে দুই পেগ গেলার পর মাইন্ডটা অনেক ফ্রেশ হয় তার,এবার পালা পার্টির মধ্যমণিকে হাজির করার। সকলে মদ আর গাঁজার নেশায় বেশ এক্সাইটেড। রাত সাড়ে এগারোটা পার হয়েছে তখন। সৌরভ সবাইকে অশ্লী’ল ভঙ্গিতে ইশারা করে বুঝিয়ে দেয় সে তাকে আনতে যাচ্ছে।
শ্যামা তার ঘরে ভয়ে সিটিয়ে আছে তখন। বাইরে মিউজিক এর আওয়াজ থেমে গেছে সেই আধাঘন্টা আগে। সৌরভ সহ আরও একাধিক পুরুষের মদ্যপ কন্ঠ স্পষ্ট শুনেছে সে। তাঁদের নিজেদের মধ্যে বলা অশ্লী’ল কথাবার্তাগুলো কানে বিষ ঢেলে দেওয়ার মতো লাগলো তার। ঘৃ’ণা এবং রাগের পাল্লাটা আতঙ্কের চেয়ে বেশি হলো।
সৌরভ যখন দড়জা খুলতে গিয়ে সামনে সোফা আর টেবিলের আটক দেখে তখন সে উচ্চস্বরে হেসে সবাইকে জানায়,বাকিরাও তার ব্যর্থ প্রচেষ্টার কথা শুনে অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে।সে হাসি শ্যামার পুরো শরীরে আগুন ধরিয়ে দিলো যেনো। তারা হাসছে তার অসহায়ত্বের উপর।
সৌরভ অল্প কিছু প্রচেষ্টার পর সরিয়ে ফেলতে সক্ষম হয় দড়জার সামনের আটক। এতো আহামরি ভারী কোনো জিনিস ছিলোনা তা কিন্তু সে যখন এক কোণায় সিটিয়ে থাকা শ্যামার দিকে এগুতে থাকে তখন তার চোখেমুখে খেলা করছে বিশ্বজয়ের হাসি।
তীব্র ব্যঙ্গ,চরম বিদ্রুপ ঝড়ে পড়ছে সেই হাসিতে। সে যেনো শ্যামার দিকে এগিয়ে যাওয়ার কদমগুলো ইচ্ছে করেই ধীরে ধীরে নিচ্ছে। প্রত্যেক কদমে শ্যামার চোখেমুখে বাড়তে থাকা আতঙ্কের ছাপ তার ভেতরের কাপুরুষ স্বত্ত্বাকে পৈশা’চিক অনন্দ দিচ্ছে যেনো।
এক সময় সেই কাপুরুষের পুরুষত্ব প্রমাণ করার ইচ্ছে ব্যকুল হলো যেনো,সে শেষ কয়েক কদম দ্রুত পার করে শ্যামার চুলের মুঠি চেপে ধরে টেনে হিছড়ে নিয়ে এসে ছুড়ে ফেলে বসার ঘরের টেবিলের কাছে।
সাথে সাথে কয়েকজন করতালি দিয়ে উঠে বাহবা দেওয়ার জন্য,তথাকথিত পুরুষের মতো কাজ হয়েছে কিনা।
ভেসে আসে কানে ‘মা’লটা জোস’ ‘ফিগার কিন্তু সেই’ ‘এক্ষুণি করে ফেলতে ইচ্ছে করছে’ ‘আমি কিন্তু তোর আগে’ এর মতো অশ্লীল ইঙ্গিতপূর্ণ কথা,যা তার ভেতরের নারীস্বত্তাকে ধ’র্ষি’তা তকমা পাওয়ার আগেই হাজারবার ধ’র্ষ’ন করে।
শ্যামা একবার চোখ বুলোয় ঘরটাতে,গোল করে বসা প্রত্যেকটা মুখোশধারী মানুষকে। তার মতোই র’ক্ত মাংসে গড়া মানুষ অথচ মনুষ্যত্বের ছিটেফোঁটা নেই তাদের মাঝে।
সবচেয়ে বেশি পীড়া দেয় পুরোপুরি উলঙ্গ অবস্থায় একজন পুরুষের সাথে লেপ্টে থাকা রিপ্তির দিকে।
পুরুষ তো পুরুষ,নারী হয়েও নারীর সম্ভ্রম হারানোর কষ্টটা বুঝলোনা। তার ধ্যান ভাঙ্গে সৌরভের কথায়।
সব হৈ-হুল্লোড় শান্ত করে,সবার অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে সৌরভ ঘোষণা করে,
“আমার মা’ল,সবার আগে আমি ভোগ করবো। তারপর তোরা পাবি।”
সবাই বেশ অশ্লী’ল ভাষাতে সায় দেয় তার প্রতি। সৌরভ ফ্লোরে পড়ে থাকা শ্যামার দিকে বাঁকা হেসে এক পা এক পা আগাতে থাকে,শ্যামা সেই তালে পিছাতে থাকে। এক সময় পিঠ গিয়ে টেবিলের সাথে ঠেকে যায়,তার হাতের সাথে বাড়ি খেয়ে মদের বোতল ফ্লোরে পড়ে ভেঙ্গে যায়।
কেউ তা আমলে নেয়নি,কেনো নিবে? একজন দুর্বল নারী তাদের এক পাল পুরুষের মধ্যে কি ই বা করবে?সে কিছু করতে পারবে এমন ভাবনা রাখাটাও লজ্জাজনক তাদের কাছে।
কিন্তু বিপদগ্রস্ত সেই নারী যেনো সেই কাঁচের টুকরো গুলোর মাঝেই বাঁচার ক্ষীণ আশার আলো দেখতে পায়। সৌরভ তার কাছে ঝুঁকে আসতেই যেই কাজটি তখন করতে পারেনি,এখন করলো সে। বোতলের সেই টুকরোটি তুলে ঢুকিয়ে দেয় সৌরভের এক চোখ বরাবর।
এতো দুঃসাহস এতো শক্তি কিভাবে এলো তার মধ্যে সে জানেনা। এখন সময় কতো, অরণ্য কখন আসবে সে জানেনা,একটু পর এক দল শকুন তার দিকে তেড়ে আসবে,এই দুঃসাহসের চরম মূল্য আদায় করবে সেসবও ভুলে গেলো।
তার মাথায় শুধু একটা কথা ই ঘুরপাক খাচ্ছে,
‘এতো সহজে জিতে যাবিনা তোরা,আমি লড়বো,জিতবো,আমার প্রিয় মানুষটার কাছেও ফিরে যাবো’
সৌরভ যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে তখন,কয়েকজন তার দিকে এগিয়ে গেলেও। বাকিরা তার দিকেই তেড়ে আসে। শ্যামা আরেকটা বোতল ভেঙ্গে আরও একবার লড়াই করার জন্য প্রস্তুত হয়।
অনেকেই এগিয়ে আসতে গিয়ে মাঝপথে ভয়ে থেমে যায়। কিন্তু তার মধ্যে একজন পিস্তল বের করে তাক করে শ্যামার দিকে।
শ্যামা ভেবে নিয়েছিলো এইখানেই শেষ তবে।
কিন্তু পিস্তলের ট্রিগারে চাপ দেওয়ার আগে অরণ্য সেখানে প্রকট হয়,পিস্তলসহ হাতটাই উপড়ে ফেলে জানোয়ারটার।
শ্যামার যেনো ধ্যান ভাঙ্গে অবশেষে হঠাৎ তার প্রিয় মানুষটিকে তার সামনে দেখে,অঝোর স্রোতে গড়াতে থাকে অশ্রু। অরণ্যও তাকায় তার দিকে,তার ঠোঁটে মুচকি হাসি ফুটে উঠে তার দিকে তাকিয়ে। এদিকে বাতাস ফুঁড়ে একজন মানুষের উদ্ভব হওয়ায় সকলে বিস্ফোরিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে,হাত হারানো যুবকটি তার স্বরে আর্তনাদ করছে তখনও।
কিন্তু সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না শ্যামা করলো না অরণ্য। শ্যামা অশ্রুসিক্ত নয়নে তাকিয়ে আছে অরণ্যের দিকে।
অরণ্য এক পা দুই পা করে তার সামনে এসে দাঁড়িয়ে হাতের তালু দিয়ে চোখগুলো বন্ধ করে দেয়,তারপর বলে উঠে,
“আমি না বলা পর্যন্ত চোখ খুলবেনা শ্যামা।”
(চলবে)