শ্যামারণ্য পর্ব-৩৮+৩৯

0
713

#শ্যামারণ্য
#পর্বঃ৩৮
লেখনীতেঃ #ফাহমিদা_মেহেজাবীন

শ্যামা অরণ্যের মাথা বুকে নিয়ে হাউমাউ করে কাঁদতে থাকে। ভেতরটা জ্ব’লে পু’ড়ে শেষ হয়ে যাচ্ছে তার,আজ সে পুরোপুরি নিঃশেষ হয়ে গিয়েছে।

বৃদ্ধ ফকির মুখে চুকচুক শব্দ করে আফসোসের সুরে বলে উঠে,
“এই জন্যই বলেছিলাম সেদিন,এই পথে তুই যেতে চাস কিনা ভালো করে ভেবে নে। এটা তো হওয়ারই ছিলো।”

হঠাৎ ঘরের ভেতর কারো কন্ঠ শুনে চকিতে ফিরে তাকায় শ্যামা। ঘরের জানালার সামনে বৃদ্ধ ফকিরকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে রাগে ফেটে পড়ে সে, রাগমিশ্রিত সুরে কাঁদতে কাঁদতে বলে শ্যামা,
“কেনো এসেছেন আপনি এখানে?আমার দুঃখের তামাশা দেখতে এসেছেন?আমার অরণ্যকে আমার থেকে কেড়ে নিয়ে মন ভরেনি?আমার কান্না দেখে মজা নিতে এসেছেন?আপনি অনেক খুশি আজকে তাইনা?আমার অরণ্যকে তিলে তিলে মে’রেছেন আপনি। আজ একেবারেই শেষ সে…”

“মূর্খ মেয়ে! মাথা ঠান্ডা কর! তোর স্বামী তোকে কি বলেছে ভুলে গেছিস?শেকল ভঙ্গ হওয়ার সাথে সাথে সেই শেকলের সাথে সেও ভস্ম হয়ে যাবে,সাথে মুছে যাবে তার সকল পার্থিব স্মৃতি। কিন্তু না সেই শেকল ভস্ম হয়েছে না তোর স্বামী,না মুছে গিয়েছে তোর স্মৃতি। খেয়াল আছে সেটা?”

চমকে উঠে শ্যামা। এবার হুঁশ ফিরে তার,খেয়াল করে পর্যবেক্ষণ করে দেখে সে আসলেই সেই শেকল এখনো একপাশে নেতিয়ে পড়ে আছে,অরণ্যও ভস্ম হয়ে মিলিয়ে যায়নি। সে প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকায় ফকিরের দিকে।

বৃদ্ধ ফকির বলতে থাকে,
“তোর আর তোর স্বামীর কলাইয়ে বাধা আমার দেওয়া সেই কালো সুতোর কথা মনে আছে?”

আবার চমকে উঠে শ্যামা। ব্যাপক উত্তেজনায় এতোদিন তাদের কলাইয়ে বাধা সুতো দুটোর কথা ভুলেই গিয়েছিলো সে। এখন মনে পড়ে তার,এই বৃদ্ধ ফকির বলেছিলো, এই সুতো জোড়া তাদের জোড়া চিরকালের মতো বেঁধে দিবে।
মনে পড়তেই এক বুক আশা নিয়ে তাকায় শ্যামা বৃদ্ধ ফকিরের দিকে,
“আপনি কি আমার অরণ্যকে আবার জীবিত করে দিবেন?ওকে ফিরিয়ে দিবেন আমার কাছে?”

“বোকা মেয়ে! যার যাওয়ার সে যাবেই,মৃ’ত মানুষে প্রাণ সঞ্চার করার ক্ষমতা কারো নেই।”

আবার আশাহত হয় শ্যামা,ধরে আসা গলায় বলে সে,
“তাহলে আপনি যে বলেছিলেন এই সুতো আমাদের কলাইয়ে বাধলে ভাগ্য আমাদের জোড়া চিরকালের মতো বেঁধে দিবে?”

“সেই কথাটাই তো বলতে এসেছি মেয়ে। তোর স্বামীর মানুষ সত্ত্বা এখনো বেঁচে আছে,তবে তোর হাতে সময় বেশি নেই। এই জ্বিন সত্ত্বা নামক শেকলটি এখন চন্দ্রগ্রহণ চলাকালীন দুর্বল,আর এই ভাগ্যসুতোর অনেক গুণ।
তাই এই দুর্বল অবস্থায় সেই শেকল এই শক্তিশালী সুতো বাধা অবস্থায় তোর স্বামীর মানুষ সত্ত্বা আর তার দেহকে নিয়ে যেতে পারছেনা তার সাথে।
অপেক্ষা করছে সে চন্দ্রগ্রহণ শেষ হওয়ার। রাতের প্রথম প্রহর শেষ হলে চন্দ্রগ্রহণ শেষ হবে,সেই জ্বিন সত্ত্বা তখন তার শক্তি ফিরে পাবে। এই সুতোর শক্তিও তখন তাকে আঁটকে রাখতে পারবেনা,তোর স্বামীকে সাথে নিয়ে বিলীন হয়ে যাবে সে। তোর কাছে রাত তিনটা পর্যন্ত সময় আছে।”

শ্যামা ব্যস্ত কন্ঠে জিজ্ঞেস করে,
“কি করতে হবে আমাকে ওকে থামাতে হলে?কিভাবে ফিরে পাবো আমি আমার স্বামীকে?”

“তোর স্বামীর শক্তিশালী মানুষ সত্ত্বাকে ফিরিয়ে আনতে হবে। ভাগ্যসুতো এমনি এমনি কারোও ভাগ্য পরিবর্তন করেনা। তার জন্য পরীক্ষা দিতে হয়,সেই পরীক্ষার ফলাফলের উপর ভাগ্য নির্ভর করে। তোকেও একটি কঠিন পরীক্ষা দিতে হবে তোর ভাগ্যে পরিবর্তন আনতে হলে।”

শ্যামা অরণ্যের শরীর আলতো হাতে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে চোখ মুছে উঠে দাঁড়ায়,
“কি করতে হবে আমাকে? যেকোনো পরীক্ষা দিতে রাজি আছি আমি। কিন্তু অরণ্য ঠিক হয়ে যাবেন তো আবার?”

বৃদ্ধ ফকির ফ্যাসফ্যাসে গলায় রহস্যময় হাসি হেসে বলে,
“সেটা তো তোর উপর নির্ভর করে রে মেয়ে সে ঠিক হবে কি হবেনা।
শোন সময় বেশি নেই,আমার কথা মন দিয়ে শোন।
তোকে আমি এমন একটা দুনিয়ায় পাঠাবো যেখানে তোর স্বামীর অভিশপ্ত হওয়ার ঘটনা এখনো ঘটেনি,আমার সাথে দেখা হওয়ার আগেই তোকে তাকে ঠেকাতে হবে। সেই দুনিয়ার অরণ্যের হাত ধরে রাত তিনটার মধ্যে এই ঘরের দড়জা খুলে তোকে প্রবেশ করতে হবে। তখন তুই সেই দুনিয়া থেকে মিলিয়ে গিয়ে এই জগতে ফিরে আসবি। তবে তোর ফিরে আসার সেই সামান্য সময়ের মধ্যে দুই দুনিয়ার অরণ্যের মাঝে ভাগ্যসুতোর মাধ্যমে সাময়িক একটা যোগাযোগ স্থাপন হবে। তখন এই দুনিয়ার অরণ্যের দুর্বল মানুষ সত্ত্বা তার ভাগ্যসুতোর মাধ্যমে শক্তি ফিরে পাবে সেই অরণ্যের মানুষ সত্ত্বা থেকে।
এই শেকল তখন আর তাকে কাবু করতে পারবেনা তার শক্তিশালী অবস্থায়,নিয়ে যেতে পারবেনা তোর স্বামীকে। আর সে জেগে উঠবে আবার একজন পরিপূর্ণ মানুষ হিসেবে।

কিন্তু সাবধান মেয়ে,সেই দুনিয়ার রাত তিনটার মধ্যে অরণ্যের হাত ধরে এখানে না ফিরলে চিরতরে আটকে যাবি তুই সেই দুনিয়ায়। তবে ভয় নেই তোর, আমি বলেছিলাম ভাগ্য তোদের জোড়া চিরকালের মতো বেঁধে দিবে।
এই দুনিয়ার অরণ্য তুই ফিরে না আসলে মিলিয়ে গেলেও,ভাগ্যক্রমে সেই দুনিয়ার অরণ্যের সাথে ঠিক কোনো না কোনোভাবে তোর জুটি বেঁধে যাবে।
অবশ্য তুই চাইলে কোনো ঝামেলা ছাড়া একেবারেই সেই অরণ্যের কাছে থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে নিতে পারিস,এই অরণ্যকে বিলীন হয়ে যেতে দিতে পারিস।
এই অরণ্য আর সেই অরণ্য ভিন্ন দুনিয়ার হলেও,একই মানুষ তারা। তোর ভালোবাসা দিয়ে নতুন করে সাজিয়ে নিস তাকে আবার,কি বলিস?”

শ্যামা ভ্রু কুঁচকে তাকায় বৃদ্ধের কুটিল হাসিমাখা মুখের দিকে,রাগে শরীর রি রি করে উঠে তার।
এক সময় ভেবেছিলো এই বুড়ো অনেক ভালো।
কিন্তু একে এই মুহুর্তে তার কাছে সাক্ষাৎ কোনো শয়তানের থেকে কম মনে হচ্ছেনা।
সে দাঁতে দাঁত চেপে বলে উঠে,
“সেটা নাহয় আমার উপর ছেড়ে দিন। আমি এই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হবো,আমার স্বামীর কাছে ঠিক ফিরে আসবো আমি।”

বৃদ্ধ ফকির ফিক করে হেসে বলে উঠে,
“তুই ভুলে যাচ্ছিস মেয়ে,জমিদার অরণ্য তালুকদার কেমন মানুষ। তার মনে দয়া মায়া ভালোবাসা বলতে কিছুই নেই,নিজের মাকে পর্যন্ত বিশ্বাস করেনা সে, তার বাবার থেকেও নিষ্ঠুর আচরণ তার। সেই শয়তান কেনো রাজি হবে তোর হাত ধরে তোকে এই ঘরে নিয়ে আসতে?
সে তোকে চেনেনা জানেনা,তোকে সে জমিদার বাড়ির চৌহদ্দিও মাড়াতে দেয় কিনা সন্দেহ। এতো কম সময়ের মাঝে পারবি তুই তার বিশ্বাস অর্জন করতে?”

স্তব্ধ হয়ে যায় শ্যামা,আসলেই তো। এতো কম সময়ে সে সেই হৃদয়হীন অরণ্যকে এখানে নিয়ে আসতে কিভাবে রাজি করাবে?

বৃদ্ধ ফকির তাগাদা দিলেন,
“ভাগ্যের পরীক্ষা এতো সহজ হয়না মেয়ে।
তবে তুই যেতে যখন চাইছিস,আর বিলম্ব করিসনা।
সেই জগতের অরণ্যের সাথে খুব শীঘ্রই আমার দেখা হতে চলেছে। ইতোমধ্যেই সে বেড়িয়ে পড়েছে আম বাগানের উদ্দেশ্যে।”

বলেই সে তার লাঠি তাক করে ঘরের বন্ধ দড়জার দিকে,তীব্র বেগে খুলে যায় বন্ধ দড়জার কপাট আর সাথে সাথে তীব্র সোনালী আলো চোখ ধাঁধিয়ে দেয় তার।
সাথে সাথে উজ্জ্বল সোনালী আলোয় জ্বলে উঠে তার কলাইয়ে বাধা কালো সুতো,তার সুতো থেকে একটি সোনালী সুতো বের হয়ে বেধে যায় শুয়ে থাকা অরণ্যের হাতের কলাইয়ের সুতোটির সাথে।
তার হাতের সুতোটিও সোনালী আলোর মতো জ্বলে উঠেছে এবং তার হাতের সুতো থেকে একটি সোনালী সুতো বের হয়ে হারিয়ে যায় দড়জার সোনালী আলোর মাঝে।

বৃদ্ধ ফকির বলে উঠে,
“এখন তোদের তিন জনের ভাগ্য ই বাধা এই ভাগ্যসুতোর মাধ্যমে।
এই সুতো সোজা গিয়ে বেধেছে সেই দুনিয়ার অরণ্যের কলাইয়ে। এই সুতো তুই ছাড়া অন্য কেউ দেখতে পাবেনা। এই সুতো যেদিক গিয়েছে তা ধরে এগোলে পেয়ে যাবি তুই সেই দুনিয়ার অরণ্যের দেখা।
বাকিটা সব তোর উপর নির্ভর করছে,তুই কি ফিরে আসতে পারবি নাকি আটকে যাবি চিরতরে?
যা আর বিলম্ব করিসনা,তোর আগে তার আমার সাথে দেখা হয়ে গেলে কিন্তু সব শেষ। সে অভিশপ্ত হওয়ার পর তুই তাকে এখানে নিয়ে আসতে পারলেও লাভ হবেনা কিন্তু।”

শ্যামা এমন কথা শুনে আর এক মুহুর্তও দাঁড়ালোনা। যা হওয়ার দেখা যাবে। সেই দুনিয়ার অরণ্যকে কিভাবে মানাবে এখানে আনার জন্য সেটাও পরে দেখা যাবে। আপাতত তাকে যেতেই হবে।
শ্যামা দ্রুত কদমে হারিয়ে যায় খোলা দড়জার সেই সোনালী আলোর মধ্যে। শ্যামা সেই দুনিয়ায় প্রবেশ করতেই দড়জাটি সশব্দে আবার বন্ধ হয়ে যায়।

বৃদ্ধ ফকির ফিরে তাকায় অনুভূতিহীন অরণ্যের শুয়ে থাকা দেহটার দিকে। এগিয়ে গিয়ে ব্যথাতুর দৃষ্টিতে তাকিয়ে মাথায় হাত রাখে তার।
আক্ষেপের স্বরে স্বগতোক্তি করে বৃদ্ধ জ্বীন,
“আমাকে ক্ষমা করে দিস চারু মা। তোর কষ্ট গুলো আমার আর সহ্য হয়নি,অন্তত তোর ছেলেকে আমি তোর কাছে ফিরিয়ে দিতে চেয়েছিলাম।
ভেবেছিলাম এই অবস্থা হলে তোর ছেলে তার বাবা আর আশেপাশের মানুষদের আসল রূপ বুঝতে পারবে,আর জানতে পারবে একমাত্র তুই ই আপনজন তার।
পরে তুই তোর ছেলের অভিশাপ ভেঙ্গে দিতিস আর তোর ছেলে তোর মনের মতো হয়ে যেতো।
কিন্তু আমি কখনো কল্পনাও করিনি চন্দ্রগ্রহণের আগেই এতো বড় একটা ঘটনা ঘটে যাবে,আমার দেওয়া অভিশাপ তোর আর তোর ছেলের জীবন এভাবে ধ্বংস করে দিবে।
সত্যিই আমাদের জ্বীনদের কোনো মানুষের প্রতি ভালোবাসা দেখাতে নেই,হিতে বিপরীত হয় তাতে।
আমাকে পারলে ক্ষমা করে দিস। তবে চিন্তা করিসনা মা, তোর ছেলে অনেক ভালো জীবনসঙ্গী খুঁজে পেয়েছে।
সে ই পারবে তোর ছেলেকে একটা সুন্দর জীবন উপহার দিতে,আর ভাগ্যে থাকলে সেই দুনিয়ায় তুই অনেক জলদি তোর ছেলেকে ফিরে পেতে চলেছিস। ভালো থাকিস তুই যেখানেই আছিস এটাই আশা করি।”
কথা শেষ করেই অশ্রুসিক্ত নয়নে বিদায় নেয় বৃদ্ধ সেখান থেকে।

——————————-

চোখ ধাঁধানো সোনালী আলো মিলিয়ে গিয়ে চোখ সয়ে আসতেই শ্যামা নিজেকে একটি কাঁচা মেঠো রাস্তার মাঝখানে দাঁড়ানো আবিষ্কার করে।
১০৪ বছর আগের এই অজপাড়া গ্রামের সাথে তার দেখা সেই উন্নতির ছোঁয়া লাগা গ্রামের কোনো মিল নেই।
রাস্তার পাশ দিয়ে যতদূর চোখ যায় শুধু ফসলি জমি,দূরে কিছু কৃষক তপ্ত রোদ থেকে বাঁচার জন্য গাছের তলায় বিশ্রাম নিচ্ছে। তাকে খেয়াল করেনি তারা।
অরণ্যের ভাষ্যমতে সে বিকেল তিনটার পর বেরিয়েছিলো আম বাগানের উদ্দেশ্য,পশ্চিম দিকে সেই আম বাগান।
সেই সোনালী উজ্জ্বল সুতোটিও এই মেঠোপথ পেরিয়ে পশ্চিম দিকে চলে গিয়েছে।
তার মানে এই দুনিয়ার অরণ্য অনেক এগিয়ে গিয়েছে আম বাগানের পথে।
আঁতকে উঠে শ্যামা, সে সময়মতো পৌছাতে পারবে তো?এর আগেই যদি অরণ্যের দেখা হয়ে যায় জ্বীনের সাথে?

শ্যামা এক মুহুর্তও বিলম্ব না করে সর্বশক্তি দিয়ে ছুটতে থাকে সেই সোনালী সুতোকে অনুসরণ করে।
ভারী লাল বেনারসি,গা ভর্তি ভারী গয়না পরে ছুটতে গেলেও বেশি জোরে দৌড়াতে পারেনা সে।
পথিমধ্যে আশেপাশের লোক আশ্চর্য হয়ে তাকায় তার দিকে,
বধুবেশে এক রমণী দিন দুপুরে এমন উচ্ছৃঙ্খল ভাবে ছুটছে, এটা এই যুগের গ্রামের মানুষদের কাছে আশ্চর্যের বিষয়ই বটে।
কিন্তু শ্যামার এখন লোকলজ্জার তোয়াজ করার সময় নেই।
এক মুহুর্তের বিলম্ব তার ভাগ্যকে পুরোপুরি বদলে দিবে।
কিন্তু সে তো নির্ধারিত ভাগ্য চায়না,নিজের কাঙ্ক্ষিত ভাগ্য নিজে আদায় করে নিতে চায়।

ভারী শাড়ি গয়না নিয়ে ছুটতে গিয়ে হাঁপিয়ে উঠে শ্যামা,খালি পায়ে পাথরের খোঁচা লেগে ছিলে রক্ত বের হতে থাকে। তবুও সে থামেনা।
অরণ্য বলেছিলেন বেশ খানিকটা দূরে সেই আম বাগান।
এভাবে অনেকক্ষণ দৌড়ানোর পর অবশেষে সে সেই আম বাগানের প্রাচীর আর প্রবেশমুখ দেখতে পায়।

মনে মনে প্রার্থনা করতে থাকে শ্যামা,সে যেনো সময়মতো পৌছে যায়।
আম বাগানের প্রবেশমুখে কোনো প্রহরী না থাকায় অনায়াসে প্রবেশ করে শ্যামা। উত্তেজনায় বুক কাঁপছে তার। দৌড়ানোর ফলে শ্বাস নিতে সমস্যা হচ্ছে,একটু দাঁড়িয়ে প্রাণ ভরে নিঃশ্বাস নিতে পারলে ভালো হতো।
কিন্তু সে দাঁড়ালোনা,দেরি হয়ে যাবে তাহলে।

সোনালী সুতোকে অনুসরণ করে বড়ো বড়ো আম গাছগুলো পেছনে ফেলে ছুটতে ছুটতে এক সময় কিছুটা সামনে থেকে অরণ্যের রাগী কন্ঠস্বর ভেসে আসে তার কানে,
“আমার বাগানে এসে ঘাটি গাড়ার সাহস দেখিয়েছিস,তাহলে এখন লুকিয়ে আছিস কেনো?সাহস থাকলে সামনে আয়!”

আতঙ্কে শ্যামার হৃদপিণ্ড গলার কাছে চলে আসে যেনো।
শ্যামা তার সর্বশক্তি দিয়ে চিৎকার করে উঠে,
“অরণ্য!!!!!”

(চলবে)

#শ্যামারণ্য
#পর্বঃ৩৯
লেখনীতেঃ #ফাহমিদা_মেহেজাবীন

অরণ্যের নাম ধরে চিৎকার করেই পায়ের গতি বাড়িয়ে দেয় শ্যামা,ভয়ে তার প্রাণবায়ু বেড়িয়ে যাওয়ার জোগাড়,এই বুঝি সেই বৃদ্ধ ফকির অরণ্যের কথার জবাব দিবে।তবে বেশি আগাতে হলোনা তাকে,দুটি গাছ মাড়াতেই সে দেখতে পায় অরণ্যকে।

তার ডাক শুনে মাত্র ফিরে তাকিয়েছে এই দিকে,পড়নে তার হাতা গোটানো কালো পাঞ্জাবি,সাদা পায়জামা,এই প্রথম দিনের আলোতে দেখলো সে অরণ্যকে।
মুগ্ধ হলো হৃদয়,তার চেয়ে বেশি হলো স্বস্তি।
বৃদ্ধ ফকির আশেপাশে নেই তার মানে সে সময়মতোই ডাকটা দিয়েছিলো।

হঠাৎ পিছন থেকে কারো ডাক ভেসে আসায় চমকে উঠে অরণ্য। কোনো নারীকন্ঠ তার নাম ধরে এভাবে ডেকে উঠলো কেনো?আর এই সময়ে বাগানে কোন বাড়ির মেয়ে আসবে?এসব ভাবতে ভাবতে শব্দের উৎসের দিকে ফিরে তাকাতেই দেখতে পায় সেই রমনীকে।

পড়নে তার লাল বেনারসি,গা ভর্তি সোনার গয়না,দেখে কোনো সম্ভ্রান্ত বাড়ির বধু মনে হচ্ছে। কিন্তু মেয়েটার এই অবস্থা কেনো? খোলা লম্বা চুলগুলো এলোমেলো হয়ে চেহারায় বিক্ষিপ্ত ভাবে ছড়িয়ে পড়েছে, উজ্জ্বল শ্যামলা গোলগাল মুখটা ঘেমে ভিজে উঠেছে,পায়ে কোনো জুতো নেই,আর মেয়েটা সমানে হাঁপিয়ে চলেছে যেনো অনেকটা পথ এক নাগাড়ে ছুটে এসেছে।
তবে সবচেয়ে বেশি যেটা অদ্ভুত লাগলো অরণ্যের,তা হলো মেয়েটির চোখ।
তাকে দেখেই যেনো সেই অশ্রুসিক্ত লালচে ফোলা চোখগুলো হঠাৎ প্রাণবন্ত হয়ে উঠে, মেয়েটা এভাবে কাঁদছে কেনো?
থমকে যায় অরণ্য সেই রমণীর অদ্ভুত চোখের দৃষ্টির সামনে কিছুক্ষণ। তার দিকে অনেক রমণীই দৃষ্টি দেয়।
কারো দৃষ্টিতে মুগ্ধতা থাকে,কারো দৃষ্টিতে কামুকতা,কারো চোখে লাজুকতা। কিন্তু এই দৃষ্টি বড্ড অপরিচিত ঠেকলো তার কাছে,কি নাম দিবে এই দৃষ্টির?

তার ভাবনার মাঝেই শ্যামা তাদের মাঝের কয়েক কদমের ব্যবধানের সমাপ্তি ঘটিয়ে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে তাকে,
“অবশেষে,অবশেষে আমি সময়মতো পৌছাতে পেরেছি। আমিতো ভেবেছিলাম অনেক দেরি হয়ে যাবে আসতে…”

চমকে উঠে অরণ্য এক ঝটকায় মেয়েটিকে সরিয়ে দেয় বুক থেকে,বিস্ফোরিত নয়নে চেয়ে থাকে শ্যামার পানে।
শ্যামা দু কদম পিছিয়ে যায় অরণ্যের ধাক্কায়।
প্রথমে স্তব্ধ হয়ে গেলেও পরক্ষণে ঘোর ভাঙ্গে তার।
এই অরণ্য তার অরণ্য নয়,সে চিনেনা তাকে।
ইশ আবেগের বশেই প্রথম ভুলটা করে ফেলেছে, অরণ্য গায়ে পড়া নারীদের ঘৃ’ণা করে,এখন তাকেও না ভুল বুঝে বসে সে।
অরণ্যকে কিছু বলতে গিয়েও থেমে যায় শ্যামা।
অরণ্যের ঠিক পিছনের গাছটির সামনে দাঁড়িয়ে আছে সেই জ্বিন। চোখাচোখি হতেই তাকে উদ্দেশ্যে করে কুটিল হাসি হাসলো সে,তারপরেই হাওয়ায় মিলিয়ে গেলো সেই জ্বীন।
বুক চিরে স্বস্তির নিঃশ্বাস বেরিয়ে আসে তার,প্রথম ধাপ পার করতে পেরেছে সে তাহলে।

তবে তার স্বস্তি স্থায়ী হলোনা বেশিক্ষণ।
অরণ্যের রাগী কন্ঠস্বর ভাবনা থেকে বের করে আনে তাকে,
“এই মেয়ে! এতো বড় স্পর্ধা তোমার?আমাকে স্পর্শ করার সাহস হয় কি করে তোমার? দেখে তো মনে হয় বিবাহিত,বেশ ভালো ঘরের বউ মনে হচ্ছে। পরপুরুষকে জড়িয়ে ধরতে একটুও লজ্জা লাগলোনা?ছিঃ!”

শ্যামা অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে অরণ্যের দিকে,প্রচন্ড ক্লান্ত সে এই মুহুর্তে,মনের দিক থেকে বিধ্বস্ত,এরই মাঝে নিজের স্বামীর মুখ থেকে এমন প্রশ্নের কি জবাব দেওয়া উচিত তার?

“আর তুমিও কি তাহলে আম চুরির এই ঘটনার সাথে সম্পৃক্ত?ওরা যে বললো এক বুড়োর কথা,তার সঙ্গী তুমি?তোমাদের সাথে আর কে কে জড়িত আছে?
কোন বাড়ির বউ তুমি জলদি বলো। আমিও শুনি কোন পরিবার আবার আমার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার স্পর্ধা দেখায়।”

শ্যামা একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজেকে ধাতস্থ করার প্র‍য়াস করলো। সময় কম,তাকে এই সময় শান্ত থাকতে হবে,
“তালুকদার বাড়ির বউ আমি। অরণ্য তালুকদারের অর্ধাঙ্গিনী শ্যামা তালুকদার আমার নাম,আমি জমিদার অরণ্য তালুকদারের কাছে আমার স্বামীর প্রাণ ভিক্ষা চাইতে এসেছি।”
নিজেকে ধাতস্থ করে সোজাসাপটা জবাব দেয় শ্যামা।

অরণ্যের হৃদয় কোনো এক অজানা কারণে কেঁপে উঠে,অবাক হয়ে যায় সে সামনের মেয়েটির কথা শুনে। এই মেয়েটি তারই সামনে নিজেকে তার স্ত্রী দাবি করছে,আবার তারই প্রাণ ভিক্ষা চাইছে?এমন আজগুবি কথা জীবনেও শুনেনি সে।

শ্যামা হাত জোর করে মিনতি করে,
“আহামরি কিছু চাইবোনা জমিদার বাবু,আপনার ছোট্ট একটা সাহায্য আমার স্বামীকে আমার কাছে ফিরিয়ে দিতে পারে। দয়া করে শান্তভাবে আমার কথাগুলো একবার শুনুন,আমাকে বিশ্বাস করুন।”

অরণ্য বেশ রেগে যায় এবার,
“ব্যস! অনেক হয়েছে! আজ সবগুলো এক সাথে মিলে আজগুবি কথাবার্তা বলে,এসব নাটক করে আমাকে পাগল সাজানোর পায়তারা করেছো তাইনা?
কেউ বলছে বুড়ো পা’গ’ল আম চুরি করে বিলিয়ে দিয়েছে,এখানে এসে শুনি সব প্রহরীরা নাকি এখান থেকে বেরোনোর পথ পাচ্ছেনা,এখানে নাকি অতিপ্রাকৃত ঘটনা ঘটে চলেছে,আর তারপরে আসলে তুমি একেবারে নতুন কাহিনি নিয়ে।
এই ঘটনার সাথে জড়িত সবগুলোকে খুঁজে বের করবো আমি।
আর শোনো মেয়ে,তুমি যদি ভেবে থাকো তোমার এই বিধ্বস্ত অবস্থা আর চোখের অশ্রু দেখে আমি গলে যাবো,তোমার আজগুবি কথা শুনে তোমাকে পা’গল ভেবে ছেড়ে দিবো তাহলে ভুল ভাবছো তুমি।
আমার দরবারে ধনী,গরিব,শিশু,বৃদ্ধ,প্রতিবন্ধী সবার সমান বিচার হয়।
যে আমার বিরুদ্ধে যাবে তার শাস্তি হবে। আমার অনেক ক্ষতি করেছো তোমরা আজ,শাস্তি তো পেতেই হবে। আর তোমার মুখ থেকেও সত্যি কিভাবে বের করতে হয় আমার ভালো জানা আছে। প্রহরী! প্রহরী!!”

“অরণ্য…”

“সেই তখন থেকে আমাকে নাম ধরে ডেকে চলেছো! ‘জমিদার বাবু,মনিব,মালিক’ এগুলো বলে সম্বোধন করো বেয়াদব মেয়ে! আমার নাম ধরে ডাকার অধিকার একমাত্র আমার মা বাবার রয়েছে। আমার রাগ আর বাড়িও না মেয়ে,তোমার ও তোমার পরিবারের জন্য মঙ্গল হবে।”

“ব্যস! অনেক হয়েছে,কতক্ষণ ধরে নিজে একাধারে বলে চলেছেন। একবার আমার কথাও শুনবেন তো। প্রথমেই বলি, আমাকে দেখে মনেহয় আপনার আমি এতো বড় বড় গাছে উঠে আম পেরে বিলাতে পারবো?আর আমি যদি আপনার শত্রু হয়ে থাকি তাহলে আমি এভাবে আপনার সামনে কেনো আসবো? অরণ্য আমার অবস্থা দেখুন,আমাকে কোনোদিক দিয়ে স্বাভাবিক দেখাচ্ছে আপনার?আমাকে একবার সব খুলে বলার সুযোগ দিন,সব বুঝতে পারবেন আপনি।
আর আমার স্বামীকে আমি নাম ধরেই ডাকি,এই দুনিয়ায় যতক্ষণ আছি আপনিও আমার অরণ্য,আপনাকে যা খুশি ডাকার অধিকার রয়েছে আমার।”

অরণ্য মেয়েটাকে যত দেখছে অবাক হচ্ছে,তার চেয়েও বেশি হচ্ছে রাগ মেয়েটার অবাধ্য আচরণে। সচরাচর সে রেগে এক ধমক দিলেই সামনের জন দমে যায়। কিন্তু এই মেয়েকে শাস্তির ভয় দেখানোর পরেও দমে যাওয়ার বদলে উল্টো তার সাথে উঁচু গলায় কথা বলছে।
অরণ্য বাঁকা হেসে দাঁতে দাঁত পিষে বলে,
“আর তোমার সেই গুরুত্বপূর্ণ কথাটা হচ্ছে আমি তোমার স্বামী,আর আমার তোমাকে আমার প্রাণ বাঁচাতে সাহায্য করতে হবে?”

শ্যামা ব্যস্ত কন্ঠে বলে উঠে,
“ঠিক বলেছেন অরণ্য। আপনি আমার স্বামী,কিন্তু এই দুনিয়ায় নয়। আমি অন্য একটি জগৎ থেকে এসেছি,সেখানের সময়ের সাথে এই জগতের সময়ে ১০৪ বছরের ব্যবধান।
সেই দুনিয়ায় আপনি এই মুহুর্তে জীবন-মরণের মাঝখানে অবস্থান করছেন। আপনার সাহায্য ছাড়া ওকে আমি হারিয়ে ফেলবো চিরতরে।”

“ব্যস! অনেক হয়েছে তোমাদের কাল্পনিক কথাবার্তা,আজকের জন্য যথেষ্ট হয়েছে। প্রহরী! প্রহরী!!”,
অরণ্য দ্বিগুণ রেগে হুংকার ছাড়ে।

শ্যামা দমে গেলোনা মোটেও,সে কাতর কন্ঠে বললো,
” অরণ্য,আমি জানি আমার কথাগুলো ঠিক কতোটা অবিশ্বাস্য এবং হাস্যকর শোনাচ্ছে। তবে এটাই সত্যি,আপনার আমাকে বিশ্বাস করতেই হবে।”

অরণ্য তার মাথা হালকা ঝুঁকিয়ে শ্যামার চোখে চোখ রেখে তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলে,
“বিশ্বাস করতে হবে আমাকে? যে তুমি এই দুনিয়ার কেউ নও,তুমি অন্য দুনিয়ার মানুষ?তোমার স্বামী আমি আবার আমি না ও?তোমার সাথে বিয়ে হয়েছে আমার?”

“শুধু বিয়ে নয়…”
শ্যামা আচমকা অরণ্যের একটি হাত টেনে ধরে তার কোমরে জড়িয়ে নেয়,তারপর অরণ্যের চুলে হাত গলিয়ে অধরে অধর মিলিয়ে গভীর চুমু খেয়ে বলে,
“আপনি আমাকে এভাবে ধরে এভাবেই শ খানেক চুমুও খেয়েছেন! এবার আপনি আমাকে এভাবে নিঃস্ব করে একা রেখে চলে যেতে পারেন না! আমাকে সাহায্য করুন!”

ঘটনায় আকস্মিকতায় সেখানেই জমে যায় অরণ্য। বিস্ফোরিত নয়নে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকে মেয়েটির দিকে,ঠোঁট কিঞ্চিৎ ফাঁক হয়ে যায় তার বিস্ময়ে।সে কাঁপা কাঁপা হাতে তার ঠোঁট ছুয়ে দেখে একবার যেখানে মেয়েটার স্পর্শ এখনো লেগে আছে।
প্রহরীদের আসার পদধ্বনিতে ধ্যান ভাঙ্গে তার।
রাগে সারা শরীর কাঁপতে থাকে তার,হুংকার ছেড়ে প্রহরীদের উদ্দেশ্যে বলে সে,
“এক্ষুনি! এক্ষুনি এই মেয়েকে নিয়ে যাও আমার সামনে থেকে,নিয়ে জমিদার বাড়ির বন্দীশালায় বন্দী করো।”

বলেই শ্যামার দিকে দ্বিতীয় বার না তাকিয়েই সামনে হাঁটা ধরে অরণ্য,যেনো পালাতে চায় এই মেয়ে থেকে যত দ্রুত সম্ভব। এই মেয়ে তাকে জড়িয়ে ধরার,চুমু খাওয়ার মতো কাজ করার এতো বড় দুঃসাহস কিভাবে দেখায়, আর তার বুকের বা পাশটা এভাবে দ্রুত গতিতে উঠানামা করছে কেনো,বোধগম্য হয়না তার।
এই জন্যই হয়তো রাগটা বেশি হচ্ছে তার,এক মুহুর্তও আর মেয়েটির সামনে থাকতে চায়না সে।

শ্যামার দিকে প্রহরীরা এগিয়ে যেতে নিলে সে জোরে ধমক দিয়ে উঠে,
“খবরদার! কেউ ছোঁবেনা আমাকে,জমিদার বাড়ি নিয়ে যাবেন তো?আমিও সেখানেই যাবো,আমাকে বেধে নিয়ে যেতে হবেনা।”

প্রহরীরা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে একে অপরের মুখ চাওয়া চাওয়ি করে। শ্যামা এদের তোয়াক্কা না করেই দৌড়ে অরণ্যের কাছে চলে যায়।
অরণ্য তার হাঁটার গতি বাড়িয়ে দেয় তবু ফিরে তাকায় না তার দিকে। শ্যামার বেশ বেগ পেতে হয় অরণ্যের সাথে তাল মেলাতে গিয়ে,আর ছুটতে পারছেনা সে।

সে তার পিছু যেতে যেতে হাঁপাতে হাঁপাতে কাকুতি মিনতি করতে থাকে,
“অরণ্য একবার বসে আমার কথাগুলো শুনুন,আপনি সব শুনলে বুঝতে পারবেন।”

অরণ্যের ধৈর্যের বাধ ভেঙ্গে যায় এবার।সে পিছন ঘুরে শ্যামার বাহু খামছে ধরে,ব্যথায় কুঁকড়ে আর্তনাদ করে উঠে শ্যামা।
তারপর শোনা যায় অরণ্যের রাগী কন্ঠস্বর,
“তোর মতো মেয়েরা আমার পিছে কিসের জন্য ঘুরঘুর করে তা আমার বেশ ভালো জানা আছে। ঘৃ’ণা করি আমি তোদের।
আর তোর দুঃসাহসের শাস্তিও অনেক জলদি হাড়ে হাড়ে টের পাবি তুই!”
বলেই ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয় তাকে,ব্যথায় কুঁকড়ে উঠে শ্যামা।
অরণ্য একবারও ফিরে না তাকিয়ে গটগট পায়ে চলে যায় সেখান থেকে। পিছনের প্রহরীরা এসে দুপাশ থেকে টেনে তুলে তাকে। টানতে টানতে নিয়ে যেতে থাকে তাকে জমিদার বাড়ি।
শ্যামা পুরো রাস্তা অরণ্যের নাম ধরে সমানে চিৎকার করে গিয়েছে। আশেপাশের মানুষ পর্যন্ত ফিরে ফিরে তাকাচ্ছে।

অরণ্য বেশ বিব্রত হয় তাতে। তবে তার থেকেও বেশি অস্বস্তি হচ্ছে মেয়েটির এমন করুণ কন্ঠের ডাকে।
সহ্য হচ্ছেনা কেনো যেনো। ইচ্ছে করছে এক্ষুনি চুপ করিয়ে দিতে কোনোভাবে।
কিন্তু পারছেনা,একটু আগে ওকে ব্যথা দিতে গিয়ে কেনো জানি নিজের হাতে এক ধরনের জড়তা কাজ করছিলো,মনটা তীব্রভাবে ছটফট করছে তার এই মেয়ের সাথে দেখা হওয়ার পর থেকে,এই মেয়ের স্পর্শ আশ্চর্যজনকভাবে অনেক পরিচিত ঠেকছে তার কাছে,যেনো আসলেই অনেবার স্পর্শ করেছে সে তাকে।
এভাবে হবেনা,মেয়েটা তাকে কোনো না কোনোভাবে প্রভাবিত করছে,এর থেকে যতটা সম্ভব দূরে থাকতে হবে তার।

অরণ্য দ্রুত হেটে জমিদার বাড়ির ভেতরে চলে যায়,শ্যামা তখনো গেইটের কাছে। তার ডাকে একবারও ফিরে তাকায়নি অরণ্য। তার নিজেকে এখন ভীষণ অসহায় মনে হচ্ছে।
সূর্য অস্ত যেতে চলেছে,এখানে আসার পর অনেকটা সময় কেটে গিয়েছে। এখন কি করবে সে?

সে পুরোপুরি ভেঙ্গে পড়তে নিয়েছিলো,তখন এক নারীকন্ঠের আওয়াজ কানে আসে তার,
“এখানে কি হচ্ছে?কোথায় নিয়ে যাচ্ছো তোমরা মেয়েটাকে?”

জমিদারনি চারুলতা সন্ধ্যা নেমে আসছে দেখে পুকুর পাড় থেকে অন্দরমহলে ফিরে যাচ্ছিলেন,তখনি বাড়ির প্রবেশমুখ থেকে কারো চেঁচামেচি শুনে দাঁড়িয়ে পড়েন তিনি।
উঁকি মেরে ভালো করে দেখার পর দেখতে পায় প্রহরীরা একটা মেয়েকে বেঁধে নিয়ে আসছে। এটা কোনো নতুন বিষয় নয়। তার ছেলে আর স্বামীর সুবাদে প্রায় নিত্যদিনই এমন দৃশ্য চোখে পড়ে তার।
তবে নজর কাড়লো তার মেয়েটির পড়নের বেনারসি শাড়ীটি।
না,কোনো ভুল নয়। এটা তার বিয়ের বেনারসি,যেটা আলাদাভাবে শুধু তার জন্যই বানানো হয়েছে। এই মেয়ের পড়নে এই বেনারসি কেনো? কৌতুহল দমাতে না পেরে সে মাঝখানে কথা বলতে বাধ্য হলো।

শ্যামা সেই নারীকন্ঠের আওয়াজ শুনে চকিতে ফিরে তাকায় সেদিকে। দেখতে পায় একজন ছোটো খাটো গড়নের কৃষ্ণবরণের মহিলাকে যিনি সাদা জমিনের উপর লাল পাড়ের বাঙালি শাড়ী পড়ে দাঁড়িয়ে আছেন। তার অবয়ব ও তার হাতের বালা দেখে বুঝতে বাকি রইলো না শ্যামার কে হতে পারেন ইনি।
শ্যামা যেনো অন্ধকারে এক ফালি আশার আলো দেখতে পায় তাকে দেখে,পারলে একমাত্র এই ব্যক্তিই পারেন তাকে সাহায্য করতে।

প্রহরী এদিকে জবাব দেয়,
“বড় মালকিন, জমিদার বাবু বলেছেন এই নারীকে বন্দী করতে,তাই তাকে নিয়ে যাচ্ছি।”

চারুলতা এক দৃষ্টিতে শ্যামার পড়নের শাড়ীটা পর্যবেক্ষণ করে চলেছেন তখনও।
শ্যামা তার দৃষ্টি অনুসরণ করে তাকালো তার শাড়ীর দিকে,তড়িৎ গতিতে মাথায় এলো তার কথাটি,
“মা, আপনি একদম ঠিক ভাবছেন। এটা আপনারই বিয়ের বেনারসি। আমার হাতের কলাইয়ে দেখুন আপনার হাতের বালা। মা আমার আপনার সাথে অনেক জরুরি কথা আছে। আপনার ছেলের জীবন সংকটে আছে। একবার আমাকে আপনার সাথে কথা বলার সুযোগ দিন। দয়া করুন আমার উপর!”

(চলবে)